কালিকাপুর : দিশারী এক্সটেনশন

সকাল সাড়ে আটটা। বৈশাখের প্রবল হলকা দিনদুয়েক কিছুটা পশ্চাৎপদ। ফজল খাবার টেবিলে। পশ্চিমের জানালা খোলা। ঘরে পাউরুটি নেই। অগত্যা দুটো ক্রিম ক্র্যাকার আর নিউটেলার কৌটোটা খুলে বসেছে। দশতলা ফ্ল্যাট নীরব। বাসায় কেউ নেই। সেগুনবাগিচার ফ্ল্যাট থেকে দূরের উদ্যান নজরে পড়ে। আগে মাঠটা ফাঁকা ছিল। ছিল ঘোড়দৌড় মাঠ, এখন বাগান। গাছপালা বড় হয়ে যাওয়ায় খালি মাঠ আর দেখা যায় না। শুধু আগের ময়দানটা অনুভব করা যায়। হাতের ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট, নাকি নিউটেলা, যা কদিন আগে কলকাতায় কেনা, নাকি বিস্তৃত ময়দান… কে জানে কোনটা তাকে চকিতে কলকাতায় হাজির

করে। হাজির করে সোজা কালিকাপুর। সিংহবাড়ি বাসস্টপেজ পার হয়ে উত্তরে সামান্য জলভূমি, ডানে পড়ে দিশারী এক্সটেনশন। শীর্ণ জলাভূমিটা বড় রাস্তার পাশে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। ফজল দাঁড়ায় একটা অতি-ক্ষুদ্র শিশুপার্কের সামনে। এই পার্কের উলটোদিকে চারতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। সামনে ভাঙা প্লাস্টার ফেলে নিচু জায়গা ভরাট করা হয়েছে। চোখা বাখারি দিয়ে তৈরি নিচু বেড়া। টাঁটিটা খোলা। ফ্ল্যাটের নিচতলায় একটা লাল গাড়ি ঠিকানাটা দেখাল, হ্যাঁ ঠিক মিলে যাচ্ছে ১৯/৩, কালিকাপুর : দিশারী এক্সটেনশন, কলকাতা : ৯৯। ফ্ল্যাটটা কিনেছিল ভাগ্নি সেলিমা, দশ বছর আগে, নিজে পছন্দ করে। কলেজ-অধ্যাপক স্বামী মকবুলেরও পছন্দ ছিল। কলকাতার এদিকটা নতুন উন্নয়ন হচ্ছে। এখনো নির্মাণাধীন অনেক ফ্ল্যাট। নিচু উচ্চতার। মনে হয় শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা এখানে জমায়েত হয়েছে।

সেলিমা তার খুব প্রিয় মানুষ ছিল। সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৯৭১-এ ও ছিল তিন-চার বছরের। গোলগাল, ছোটখাটো একটা পুতুলের বড় সংস্করণ যেন। ওই সময় যে-কবার দেখা হয়েছে ওকে খুব চঞ্চল মনে হয়নি। বয়সের তুলনায় একটু বেশি ধীর।

তারপর দেশ স্বাধীন হলো। অনেক চড়াই বেয়ে এগোতে হচ্ছে দেশকে। কলকাতা যাওয়ার সময় কোথায়? আশির দশকের শেষের দিকে খোঁজ পেল সেলিমার, রাশিয়ায় স্কলারশিপ পাওয়ার। ভর্তি হয়েছে মস্কোর লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা করছে। খুব খুশি হয় ফজল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে পড়তে যাওয়া তো একটা সৌভাগ্য! পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্টের শাসন। ওখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরলে চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি আনুকূল্য পেতে পারে। এই নিয়ে মাসতুতো বোন হামিদার সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়। লেখাপড়া শেষে ফিরে আসার পর ওর মা জানাল, চাকরির চেষ্টা করছে।

এখনো কোথাও সুযোগ হয়নি। তবে রাইটার্সে একটা কাজের কথা চলছে। হয়ে যাবে, চিন্তা করো না। এর মধ্যে ও একটা বই লিখছে মস্কোর ওপর… কীভাবে ওর চোখের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল সেই বিষয়ে।

বাহ্, খুব ভালো হবে। চোখের সামনে কেমন করে অমন জাঁদরেল একটা সুপার পাওয়ার ভেঙে গেল, যারা ছিল দুনিয়ার মেহনতি মানুষের বন্ধু, তাদের পতন মানে আমরা গরিবদের অনাথ হয়ে যাওয়া। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার এখন পোয়াবারো। এবার সাম্রাজ্যবাদ অবাধে বিস্তার করবে তার লুকিয়ে রাখা থাবা। সারা দুনিয়ায় সে একক হুকুম চালাবে। না মানলে আনবে অর্থনৈতিক অবরোধ। তাতেও না হলে সরাসরি নামবে সোলজার, ভয়টা ওখানে। সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত?

তা তো জানি। ওর বইটা এক পাবলিশার নিয়েছে এবং বলেছে ভালো বই হবে।

যাক, খুব খুশি হলাম। এর মধ্যে আমার কলকাতা আসার সম্ভাবনাও আছে। দেখা হবে।

চলে এসো। অনেক দিন হলো আসোনি।

মধ্য নববইয়ের সময় ফজল কলকাতা যাওয়ার সুযোগ পায়। সেলিমারা আগে থাকত বেনিয়াপুকুর, মিস্ত্রিপাড়া লেনে। নোনাতলা ট্রাম স্টপেজ থেকে খুব একটা দূরে নয়। এখন ওরা বাসা নিয়েছে পাম অ্যাভিনিউ। আমির আলী অ্যাভিনিউ থেকে মে ফেয়ার বা কপার হাউসের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পৌঁছতে সুবিধে। পাঠ-ভবন নামে মেয়েদের একটা স্কুল আছে, ওটা ছাড়িয়ে গেলেই গলির মধ্যে চারতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়াবাড়ি। মোট তিনটি কামরা। পাশে রান্নাঘর, কলঘর আর ল্যাট্রিন।

জ্যৈষ্ঠ মাস। কলকাতায় বেশ গরম। বিকেল পাঁচটার দিকে ফজল হাজির। কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করতে হয়নি।

সহাস্যে স্বাগত জানায় সেলিমা।

মামা, আপনার সঙ্গে কত বছর পর দেখা?

কয়েক যুগ হবে।

ফজল ভালো করে ভাগ্নিকে লক্ষ করে। মুখটা তেমনি আছে। তবে অনেক উজ্জ্বল লাগছে। মস্কোর হাওয়া। তন্বী। সুশিক্ষিতা।

বসার ঘরটা চমৎকারভাবে সাজানো। দেয়ালে লেনিন আর কার্ল মার্কসের ছবি। একদিকে চেঞ্জার। অনেক এলপি। সবকিছুর মধ্যে একটা শ্রী বিরাজ করছে। কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই।

তারপর, তোমার বইয়ের কথা বলো।

বই প্রায় ছাপা শেষ। এরই মধ্যে দু-একজন প্রুফ কপি দেখে খুব প্রশংসা করেছে। সিপিএমের এক নেতা তো আমাকে রীতিমতো ইন্টারভিউ করে বসলেন।

দেখ যদি কোথাও প্রোভাইড করে। দেখা যাক।

গরমের দিনে কলকাতায় বিকেল বেলায় গঙ্গা থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়। হাওয়াটা তারের জানলা দিয়ে একটু একটু উঁকি দিচ্ছে।

ফজল সেলিমাকে বলে, তোমাদের মূল দরজাটা খুলে দাও না, গলি দিয়ে দেখবে খুব ফোর্সে হাওয়া ঢুকবে। ঘরে জমে থাকা গরম হাওয়া সব বেরিয়ে যাবে। পাখা ঘরের গরম হাওয়াটাকেই ঘোরাচ্ছে।

সেলিমা উঠে গিয়ে ঘরের মূল ফটক খুলে দিতেই হু-হু করে শীতল বাতাস ঢুকতে লাগল।

বলেছিলাম না, এমনটা হবে।

ঠিকই।

তোমার মা কোথায় গেল?

গেছে সেজ খালার বাসায়। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবে।

তোমার এলপির কালেকশন তো অনেক!

সব রাশিয়ান।

তোমাদের কলকাতায় এখন গণমাতানো গানের একটা জোয়ারও এসেছে…

তার সূত্রটা শুনবেন?

শোনাও।

রাশিয়ান এক সংগীতশিল্পীর খালি গলায় গান বেজে চলে। সঙ্গে কোনো যন্ত্রসংগীত নেই। আরে, সুরগুলো আর গায়কি তো একেবারে ইদানীং তৈরি বাংলা গানের মতো!

সেলিমা গায়কের নাম বলেছিল। এখন ফজল সেটা ভুলে বসে আছে।

তারা এসব নিয়ে আলাপ করছে, এমন সময় বসার ঘরের বাইরের জানালায় ছায়া পড়ল।

সেলিমার চোখ এড়ায় না। সে বলে,

মা, দরজা খোলা আছে।

তা আমি দেখেছি, বলে জানালা থেকে সরে গিয়ে হামিদার প্রবেশ। মুখ গম্ভীর।

সেলিমা, দরজা খোলা কেন? আমরা বস্তির লোক নাকি!

হঠাৎ এমন উষ্মা! ফজল অবাক। সেলিমা উঠে দাঁড়ায়। খুব শান্ত স্বরে বলে, মা আমি দরজা বন্ধ করে আসছি।

আমি জানতে চাচ্ছি দরজা খোলা কেন?

তুমি শুধু শুধু ওর ওপর রাগ করছ। দরজা খোলা রাখতে আমি বলেছিলাম।

তুমি বলেছ ঠিক আছে, কিন্তু ওর তো জ্ঞানগম্যি আছে, ও খুলতে গেল কেন?

তুমি কিন্তু অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছ। মেয়েকে তুমিই পাঠালে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আবার তুমিই বলছ আমরা কি বস্তিবাসী! না, তুমি আমি কেউ বস্তিবাসী নই, তবে প্রতিটি বড় শহরের সঙ্গে এরকম বস্তিবাসী আছে বলেই একদল আরামে থাকে। তোমার বাড়িতে একটা মেয়ে রান্না করে যায়। একটা মেয়ে ঘর মোছে। আর একজন কাপড় ধোয়… তাদের জন্য তোমার তো সহানুভূতি থাকা উচিত। এরা সবাই বস্তিবাসী।

উত্তর দেয় না হামিদা।

ভেতর ঘরে চলে যায়।

মূল ফটক বন্ধ হওয়ায় ঘরে বিকেলের গঙ্গাধোয়া শীতল বাতাসের স্রোত বন্ধ। সিলিং ফ্যানটা ঘরের গুমোট হাওয়ার ঝাপটা মেরে চলে।

মামা, চা করি, আপনি খবরের কাগজ দেখেন।

আবহাওয়া হালকা করার প্রয়াস সেলিমার।

খানিক পর হামিদা বসার ঘরে ঢোকে।

কখন এসেছ?

এই তো পনেরো-বিশ মিনিট।

সেলিমার একটা চাকরি-বাকরির ব্যাপারে দেখো না!

এ-ব্যাপারে তুমিই যথেষ্ট।

বলেছি কয়েকজনকে। রাইটার্সে একটা চাকরি হব-হব করছে। তবু তোমার যদি ওপর মহলে কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকে…

ঘনিষ্ঠতা নেই, তবে চেনাজানা আছে। দেখব…

চা নিয়ে সেলিমার প্রবেশ। ট্রে আর কাপ-পিরিচ সবই মনে হলো বিদেশি।

তোমার চায়ের কাপ-পিরিচ মনে হয় এখানকার নয়?

আসার সময় এগুলো মস্কো থেকে এনেছিলাম। ওখানে খুব সস্তা।

প্রোলেটারিয়েটদের জন্য তৈরি তো!

তবে এখন আর কোনো কিছুই সস্তা নেই।

থাকবে কী করে! তোমার গর্বাচভবাবু তো পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্ত করে সবকিছু ভেঙে দিলেন।

হ্যাঁ। উন্মুক্তকরণ আর পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে তিনি আসলে করেছেন গ্লাসনষ্ট, বলে হাসে সেলিমা। ফজল এতক্ষণে সেলিমাকে একটু হাসতে দেখল। তা-ও স্মিত হাসি।

হামিদা সহজ। তবে এখনো গম্ভীর। চা খাওয়া শেষে ফজল বেরিয়ে পড়ে।

কলকাতায় সন্ধ্যা নামছে। তাকে যেতে হবে ভবানীপুর। বড় রাস্তা পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে সে ভেবে চলে, আচ্ছা হামিদা ঘরের দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও জানালায় অমন উঁকি দিলো কেন? আর দরজা খোলা রাখায় অমন রিঅ্যাক্ট করারইবা কারণ কী?

তার মনে ফ্রয়েড উঁকি দেয়।

তবে কি মা-মেয়ে লাভ-হেট রিলেশন? ব্যাপারটার একটা সুরাহা হতে যাচ্ছে দেখে মনে মনে সে হাসে।

সেলিমাদের পাম অ্যাভিনিউয়ের ওখানে আর একবার তাকে যেতে হয়, সেলিমার হাতে দুটো বই দেয় কলকাতার বাংলা একাডেমিকে দেওয়ার জন্য। বই দিয়েই সে বেরিয়ে পড়ে। বসেনি।

সেলিমার রাইটার্সে চাকরির খবর, বিয়ে… সবকিছু জেনেছে ফজল, কিন্তু মাঝে গেছে দীর্ঘ ব্যবধান। এর মধ্যে হামিদা একদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোন করে বলে, দাদা, মেয়েটার যে কী হলো, খুব অসুস্থ… হাসপাতালে।

ওরা কলকাতায় আছে বলে ফজল তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কলকাতায় আছে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা। চিন্তা কি!

কিন্তু দুসপ্তাহ না যেতে সে সেলিমার ছোট মামার ফোন পায়। জানতে পারে সেলিমার ইন্তেকালের খবর। সে স্তম্ভিত। জানাশোনা মেয়েদের মধ্যে এমন সুন্দর-মার্জিত মানুষ তার আর দ্বিতীয়টি মনে পড়ে না। আহা, তার মা যখন ফোন করেছিল যদি জানাত যে ক্যানসার… তাহলে একবার দেখা করার চেষ্টা করতে পারত। শেষ দেখা হতো মেয়েটার সঙ্গে। ওর মা তো সত্যি কথাটা বলেনি! মায়েরা সন্তানের রোগ-ভোগের সত্যি কথা মুখে আনতে ভয় পায়। তবে সামান্য ইশারা যদি দিত! ফজল মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে বেড়ায়। অনেক দিন তার মনে একটা কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তারাশঙ্করের কবির সেই উক্তি : জীবন এতো ছোট ক্যানে…

ট্যাক্সি আগেই ছেড়ে দিয়েছে ফজল। সে ফ্ল্যাটবাড়িটার দিকে এগিয়ে চলে। এই তো কালিকাপুর দিশারী এক্সটেনশন।

দারোয়ান জানাল যে, হামিদারা তিনতলায় থাকে।

কলিংবেশ টিপতেই দরজা খুলে গেল। এসো, বলে হামিদা ফজলকে নিয়ে বসায় বসার ঘরে।

ফজল দেখে শক্ত-সমর্থ হামিদার শরীরটা হঠাৎ করে ভেঙে গেছে। চুল সব সাদা। অসময়ে বোনটা বৃদ্ধায় রূপান্তরিত। শেষবার খুব সতেজ দেখেছিল। ও সবসময় খুব হাসিখুশি। বরং ওর অকারণ হাসির জন্য ও বকাঝকাও কম করেনি। আজ     সে- স্রোত বন্ধ। কোনো উপল পড়ে স্রোতস্বিনী স্তব্ধ?

হামিদা ভেতর ঘরে গিয়ে একটা বড় অ্যালবাম নিয়ে আসে। সব সেলিমার বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি। কী সুন্দর মানিয়েছে মেয়েটাকে। ফজল এক এক করে পাতা উলটায় আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবই ছবি। শুধু ছবি। মনটা বিষাদে ভরে যায়। একটু হালকা হওয়ার জন্য বলে, আমাদের নাতিটা কোথায়? ওর তো আওয়াজ পাচ্ছি না?

বাবার সঙ্গে বাইরে গেছে। এই এসে পড়ল বলে। লেখাপড়ায় বসতে হবে।

পাঁচ মিনিট না যেতেই মকবুল তার পুত্র নিষাদকে নিয়ে হাজির হয়।

ফজল দেখে ছেলেটির চোখ-মুখ একেবারে মায়ের মতো। তেমনি গোলগাল, ধীর চাউনি।

এই এক নানা, বাংলাদেশে থাকে। তুমি বাংলাদেশ যাবে? বলে হামিদা।

হ্যাঁ যাব। মা বলেছিল এই নানার কাছে বাংলাদেশে যাবে। ঠিক মনে রেখেছে নিষাদ, মায়ের ইচ্ছাগুলো।

ফজল কাছে ডেকে আদর করে।

খুব অল্প সময়ে তারা সখ্য অর্জন করে।

বাপি, এবার যে পড়তে বসতে হবে।

আসছি, বলে সাত বছরের নিষাদ বাবার ঘরে চলে গেল। কোনো প্রতিবাদ নয়। ফজলের মনে পড়ে ওর মায়ের কথা, এমনি ছিল সেলিমা। কোনো প্রতিবাদ করত না।

সন্তানকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে মকবুল ফজলের সঙ্গে আলাপে অংশ নেয়। মকবুল বেশ সপ্রতিভ মানুষ। ফজলের ভালো লাগে। আছে সারল্য। ওর জন্যও দুঃখ হয় ফজলের। ছেলেটিকে মা ছাড়া মানুষ করা… চাট্টিখানি কথা নয়। নানি আজ আছে, কাল না থাকতে পারে। পাম অ্যাভিনিউর বাসা ফেলে রেখেছে। শুনেছি সেখানেও জানালা ভেঙে চুরি হয়েছে। বাগনানে নতুন একটা বাড়ি করেছিল, সেখানেও দেখাশোনা করতে পারছে না। সবদিক দিয়ে একটা বড় জট পাকিয়ে গেছে।

নাশতার পর পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখাল হামিদা। বেডরুমের দক্ষিণে একটা ছোট বারান্দা। সামনে বড় রাস্তা আর খোলা বিশাল ময়দান। এটা দেখেই সেলিমা পছন্দ করে ফ্ল্যাটটা। তার হাতে লাগানো অপরাজিতাটা রেলিং ছেয়ে ফেলেছে। নীল রং মাতাল করা। বারান্দার লাগোয়া আরেকটা কামরা, এটাও দক্ষিণে। চওড়া জানালা দেওয়া। শুধু বারান্দাটা নেই। এই কামরায় আলমারি ভরা বই আর বই। দুজনই লেখাপড়া জগতের মানুষ… বই ছাড়া আর কিইবা থাকবে।

রাত আটটার দিকে ফজল উঠতে চাইলে হামিদা থেকে যাওয়ার জন্য অনুনয় করে। কিন্তু আমি তো তৈরি হয়ে আসিনি, বলে ফজল।

আরে তাতে কী? জামাইয়ের একটা লুঙ্গি হলেই তো হবে।

নিষাদও হাত ধরে বলে, নানা, থেকে যান…

অগত্যা ফজল রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

রাতে বইভরা কামরাটায় শুয়ে শুয়ে সেলিমার লেখা বইটা পড়তে থাকে।

এক একটা অধ্যায় যেন এক একটা ছোটগল্প। তার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ আর চিত্রগুলো ফুটে উঠেছে। ফজল ভাবতে থাকে কোথা থেকে এই কাহিনি তৈরির ক্ষমতা পেল সেলিমা? মা তো শুধু ম্যাট্রিকুলেশন। বাবা সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। মস্কো গিয়ে এতকিছু অর্জন করেছে? আসলে প্রতিটি মানুষ কত গুণ নিয়ে জন্মায়। ভালো পরিবেশ পেলে তাদের অনেকে কিছু মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তো সমাজতন্ত্র স্থাপন। কিন্তু কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল। দেশটা লক্ষ্যচ্যুত হলো। বিপদে পড়ল সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষ।

পরদিন সকালেও ফজল বোন আর নাতির অনুরোধে বেরোতে পারল না।

নটার মধ্যে ঘর খালি। মকবুল কলেজে। নিষাদ নানিকে নিয়ে স্কুলে। একা ফজল সেলিমার বইটা পড়ে চলে। সময় ভালো কাটে। একবার কামরা থেকে বেরিয়ে পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে কালিকাপুরের ফাঁকা মাঠ। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাজপথ। বাস-ট্রাক-ট্যাক্সি চলছে। এইখানে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় সেলিমা দূরের দৃশ্য উপভোগ করত। ওপর থেকে সবকিছু সুন্দর দেখায়। দিগন্ত ছুঁয়ে যায় চোখ। কলকাতার এদিকটায় ঘনবসতি নেই। তাই শ্রীমন্ডিত।

বিকেলে ফজল চিন্তা করে বাজারে গিয়ে কিছু একটা কিনে আনে। একেবারে খালি হাতে এসেছে।

সে হামিদাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তোমাদের বাজারটা কোনদিকে?

কেন, বাজারের খবর জেনে কী হবে?

এমনি দেখতে চাই। সারাক্ষণ তো ঘরে বসে আছি…

মকবুলের তো আসতে আরো দেরি হবে। তুমি অবশ্য নিষাদকে সঙ্গে নিতে পারো। ও বাজার চেনে।

বিষাদ গাইড হতে পেরে খুব খুশি। চট করে পোশাক পরে নেয়।

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পুবদিকে যাত্রা করে তারা।

বাজার খুব কাছে। আমি অনেক সময় বিকেলে নানির সঙ্গে বাজারে যাই। ছোট ব্যাগ আমিও বই, বলে নিষাদ।

তোমার কষ্ট হয় না?

না, অত ওজন দেয় না নানি। ভারিটা নানি হাতে নেয়। যেটা খুব হালকা সেটা আমি নিই। বাজার বইতে আমার খুব ভালো লাগে।

ওর কথা শুনে ফজল মনে মনে বলে, সেলিমার ছেলে তো, এমনই তো হবে!

বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাটবাড়ি পার হয়ে তারা একটা নালার কাছে পৌঁছাল। এখানে একটা কালভার্ট দেওয়া। নালায় ধূসরবর্ণের জলরাশি গোধূলির আলোয় কালচে লালরং ধারণ করেছে।

কালভার্টের দুপাশে রেলিং। বাঁদিকে একটি তেরো-চৌদ্দো বছরের কিশোরী টম্যাটো নিয়ে বসে। টম্যাটোগুলো খুব তাজা আর পাকা। রঙের বাহার। ফজল মেয়েটির সামনে দাঁড়ায়।

মাসি, তোমার টম্যাটোর কিলো কত?

পঁচিশ টাকা।

আচ্ছা, ফেরার সময় দেখব।

বাবু, এক কিলো নিলে কুড়ি টাকা করে দেবো।

ঠিক আছে, আমি ঘুরে আসছি।

অদূরে বাজার। পাকা বাজারের দোকানপাট তখনো সব তৈরি হয়নি। কাজ চলছে।

নিষাদ, মেয়েটি কি টম্যাটোর দাম ঠিক বলেছে? জানতে চায় ফজল।

সকালে হলে পঁচিশ টাকার কম দিত না। বিকেল বলে পাঁচ টাকা কমিয়ে দিচ্ছে।

নিষাদের উত্তর শুনে খুশি হয়।

একটা রুটি-বিসুকটের দোকানে দাঁড়ায় ফজল। পাঁচশো গ্রামের দামি এক প্যাকেট টফি কিনে দেয় নিষাদকে।

এত! বলে নিষাদ।

এত কোথায়! এক কিলোর অর্ধেক। এরপর কয়েক পদের বিস্কুট কিনল। চলো, এবার আমরা ফেরত যাই। এতক্ষণে তোমার বাবাও মনে হয় ফিরে এসেছে।

নিষাদ খাবারের ব্যাগ বইছে। তোমার কষ্ট হবে না তো? না নানা। এ তো খুব কম ওজন। আমি এর চেয়ে বেশি নিতে পারি।

খুব ভালো। বাজারের ব্যাগ বইলে শরীর শক্ত হয়।

কথা বলতে বলতে তারা নালার কাছে পৌঁছে যায়। কালভার্টের ওপর মেয়েটি টম্যাটো নিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হলো বিক্রি হয়নি।

ফজল দাঁড়াল ওর সামনে। কত দেবো? মেয়েটি জানতে চাইল। মেয়েটির প্রতি মায়া হলো ফজলের। ভাবে দেশভাগ হওয়ায় সে আজ ঢাকায়। কলকাতায় থাকলে এরা তার আপন লোক হতো। আজ সে বিদেশি।

দু-কিলো মাপো।

এত নেবেন! নিষাদ বলে।

তোমার নানিকে বলব টম্যাটো-শস তৈরি করতে।  টম্যাটোগুলো খুব সুন্দর না?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর।

ফজল পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে।

মেয়েটি দশ টাকার নোট ফেরত দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে ধরে।

তুমি ওটা রেখে দাও, বলে ফজল।

না বাবু, আমি তো কুড়ি টাকা দাম ধরেছি। আমি তো বেশি রাখতে পারি না।

এটা টম্যাটোর দাম হিসাবে নয়, আমি তোমাকে আইসক্রিম খেতে দিলাম।

মেয়েটি তবু না না করতে থাকায় ফজল বলে, মনে করো তোমার এক জ্যাঠামণি তোমাকে আইসক্রিম খেতে দিলো।

এখন তো আর কোনো বাধা নেই।

মেয়েটি স্নেহের পরশে মাথানত করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ফজলের সামনে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল।

আরে প্রণাম করতে হবে না, ওঠো… বলে ধরে ওঠায়।

তোমার নাম কী?

অহনা।

বাহ্, সুন্দর নাম। কী পড়ছ?

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি।

ভালো করে লেখাপড়া করো। এক সময় জীবন বদলে ফেলতে পারবে। জ্ঞানই শক্তি।

আশীর্বাদ করবেন, বলে মেয়েটি নিজের জায়গায় গিয়ে বসে।

টম্যাটোর পলিব্যাগটা নিষাদ হাতে তুলে নেয়।

ওটা আমাকে দাও, বলে ফজল।

দু-কিলো কোনো ওজনই নয়। বলে বীরদর্পে এগিয়ে চলে নিষাদ।

এই রাতও ফজলকে কাটাতে হলো কালিকাপুরে। বিশেষ করে নিষাদের অনুনয় সে ফেলতে পারে না। শকুন্তলা যেমন কণ্বমুনিকে বেঁধেছিল, ফজল তেমনিভাবে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।

রাতে সেলিমার বইটা শেষ করার জন্য পড়তে শুরু করেছে, এমন সময় হামিদা প্রবেশ করে। তার হাতে একটা খাম।

তোমার একটা চিঠি আছে দাদা!

চিঠি!

হ্যাঁ। সেলিমা লিখেছিল। হাসপাতাল ভর্তি হওয়ার পর। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এই নাও।

হামিদার হাত থেকে খামটা নিয়ে দেখতে থাকে।

হামিদা কোনো কথা না বলে বেরিয়ে যায়।

খামটা আঠা দিয়ে লাগানো।

ফজল চিঠিটা খুলে ফেলে।

কাগজটা পাতলা, নীল, চিঠি লেখার প্যাডের। শুধু সম্বোধন আছে, ডানদিকে তারিখের জায়গাটা খালি।

শ্রদ্ধেয় মামা,

আমার সালাম নেবেন। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আপনার বইদুটো কলকাতা বাংলা একাডেমিতে দেওয়া হয়ে ওঠেনি বলে। বইদুটো পড়ে দেব ভেবেছিলাম। কাজের চাপে পড়াও হয়নি, হয়নি দেওয়াও।

আপনার সঙ্গে আলাপ করার পর বাংলাদেশে একটা কাজের পরিকল্পনা করেছিলাম – কাজটা হলো বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ অথচ ওখানকার মেয়েরা ভারতবর্ষের মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে গেছে – এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমি ওটাই স্টাডি করতে চেয়েছিলাম, কীভাবে বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে গেল… আমার অফিসও এ-পরিকল্পনা অ্যাপ্রুভ করে এবং সব খরচ বহনের দায়িত্ব নেয়। আমি অফিস থেকে সব ছাড়পত্র নিয়েছিলাম। আপনাদের বিভিন্ন মহিলা সংস্থা যেমন, মহিলা সমিতি, মহিলা পরিষদ, শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইত্যাদির জন্য অফিসিয়াল চিঠিও নিয়েছিলাম। তবে জানতাম এসব চিঠির দরকার হবে না, আপনার রেফারেন্সে সব জায়গায় সহযোগিতা পাব। তবু অফিসিয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করেছি দুদেশের ব্যাপার বলে। কাজ শুরু করব এমন সময় ধরা পড়ল আমার অসুখটা… মাকে আমি অসুখের সিরিয়াসনেসটা  আপনাকে জানতে নিষেধ করি। আপনি সেন্সিটিভ মানুষ, কষ্ট পাবেন বলে।

চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছবে তখন আমি নিঃসীম শূন্যে। খুব মনে পড়ত মস্কোর সেই দিনগুলোর কথা, আপনার কথা…

নিষাদকে রেখে গেলাম। মাতৃহারা শিশুর জীবন বড় বিড়ম্বনার। কলকাতায় এলেই ওকে একটু সময় দেবেন। অনেক কাজ করার ইচ্ছা ছিল, কিছুই হলো না। অসুখটা…

আমার সশ্রদ্ধ সালাম নেবেন।

ইতি

আপনার স্নেহধন্য সেলিমা

দরজায় কলিংবেলটা বেজে উঠল। তন্ময়তা ভেঙে যায় ফজলের। কলকাতার মঞ্চের যবনিকা পতন। সে ঢাকায় ফিরে আসে। রাঁধুনি মেয়েটা এসে গেছে। দরজা খুলতে হবে। হাতে ধরা ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটে কামড় দিতে গিয়ে থেমে যায়। লোনাজলে বিস্কুটটা কখন যে ভিজে গেছে টের পায়নি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত