চমক নামের মধ্যে একটা চমক আছে। নিজের নাম নিয়ে রীতিমতো গর্ব অনুভব করে সে। আজকাল সব লেখক নিজেরা নিজেদের নামকরণ করে থাকে। পিতৃপ্রদত্ত হাবীবুর রহমান ওসমানী বাদ দিয়ে এখন সে চমক রহম। রহম শব্দটা রহমানের শর্টকাট। রহমানকে কোনো কোনো কবি-লেখক রাহমান বা রেহমান করেছেন। কিন্তু রহম কথাটা রহমানের অপভ্রংশ হিসেবে বেটার। নতুন নাম নিয়ে একজন লেখক রূপে সারাবিশ্বের মানুষের সামনে আত্মপ্রকাশ করে সে তৃপ্ত। অবশ্য ফেসবুকে ও ব্লগে। ভবিষ্যতে পত্রিকার পাতায় ও বইয়ের রাজ্যে তাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে। সেই সোনালি দিন কি এখনই শুরু হয়ে গেছে?
নিজেকে মনে মনে এক প্রস্থ অভিনন্দন জানাল চমক রহম।
এ-বাড়ির ট্র্যাডিশন হচ্ছে বাবাকে আববু বলা। ওর এক কাজিন তো তার বাবাকে আবিব ডাকে। আববা, আববু বা আবিব ওর মোটেই পছন্দ নয়। একই বর্গের বর্ণ ব-এর বদলে প করে পাপা ডাকলে অসুবিধা কী? বাবাকে আর ক-জন চেনে? পাপা ডাকটা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। আমাদের দেশটা পিছিয়ে আছে একটি মাত্র কারণে। এ-দেশের মানুষ জাতিসত্তা নিয়ে পড়ে আছে। আন্তর্জাতিক হওয়ার কোনো বাসনা তাদের মধ্যে নেই।
ওর বাবা হাফেজ হাফিজুর রহমান ওসমানী নিতান্ত আদ্যিকালের মানুষ। চমক রহম নাম শুনে তিনি অাঁতকে উঠেছিলেন। এ-নামের অর্থ কী জানতে চাইলে সে বিবর্তনমূলক অভিধানের উল্লেখ করে নামের গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বক্তৃতা দিলো। তার পিতা সেসব বুঝলেন কি বুঝলেন না, বোঝা গেল না। চমক যখন পিতার নামটাকেও কাটছাঁট করে হাফেজ হাফিজ রাখার প্রস্তাব জানাল, তখন তিনি বললেন, ছোটবেলায় আকিকা দিয়ে তোমার দাদা আমার নাম রেখেছিলেন। আমিও শরিয়তমতে আকিকা দিয়ে তোমার নাম রেখেছি। আজকাল যে জামানা উল্টো হয়ে গেছে, ছেলেরাই বাবার নাম রাখে, এটা জানা ছিল না। তুমি বাপু তোমার নাম চমক রাখবে না ধমক রাখবে, সেটা তোমার ব্যাপার। আমার নাম নিয়ে আর টানাটানি করো না। তোমার মায়ের নামও অক্ষত থাকতে দিও।
নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে একটা বিশদ ব্যাখ্যা মনে মনে তৈরি করে রেখেছিল চমক। বিশেষ করে লেখকদের সাফল্যের প্রধান কারণ যে পরিবর্তিত নাম, সেটা বোঝাতে চেয়েছিল। মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ যদি জহির রায়হান না হতেন, তাহলে দেশের মানুষ তাঁকে কোথায় পেত? আজিজুর রহমান যদি শওকত ওসমান নাম ধারণ না করতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? সুতরাং নামের ব্যাপারে নিজের কাছে নিজে একদম ক্লিয়ার চমক রহম।
আজ ক-দিন ধরে তাঁর উপন্যাস লেখার কথা মনে হচ্ছে। ব্লগের লেখা নয়, ফেসবুক নয়, একেবারে উপন্যাস। মাঝখানে মনে হয়েছিল দু-চারটা গল্প লিখে হাত পাকিয়ে নিলে ভালো হতো। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, হাত তো তার পাকাই আছে। এখন শুধু কম্পিউটারে আঙুল চালানোর অপেক্ষা।
উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদ যখন অতিক্রম করেছে, তখন বাবা ঘরে ঢুকলেন। বললেন, তোমাকে দিয়ে তো কোনো কাজই হয় না।
আমি এখন খুব ব্যস্ত। কিবোর্ডের ওপর হাত রেখেই সে বলল।
তুমি তো সবসময়ই ব্যস্ত। আমি অসুস্থ না হলে তোমাকে কিছুই করতে বলতাম না।
উপন্যাসের প্রারম্ভে বাবার অনুপ্রবেশে মনটা খিঁচড়ে গেল তার। খিঁচড়ে শব্দটা বাবার ক্ষেত্রে একটু হার্ড হয়ে গেল। কিন্তু এহেন মনোভাব কারো কাছে প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে ভাবনার কিছু নেই। এবার সে বাবার দিকে ফিরে তাকাল, কী করতে হবে বলো।
ওয়াসার বিলটা ওদের অফিসে গিয়ে পরিশোধ করে আসতে হবে। আজ লাস্ট ডেট। কাল ওরা পানির লাইন কাটতে আসবে।
পানির লাইন কাটতে চাইলেই হলো? ওয়াসার বিল আর টাকাটা আমাকে দিয়ে দাও। পরক্ষণে চমক বলল, না। না। টাকার দরকার হবে না। তোমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বরটা যেন কত?
টাকা ছাড়া বিল দেবে কী করে?
ব্যাংক থেকে সরাসরি পরিশোধ করা যাবে।
তাহলেও তো ব্যাংকে যেতে হবে।
না, ব্যাংকে যেতে হবে না। আমি অনলাইনে পেমেন্টের ব্যবস্থা করছি।
অনলাইনে বিল পরিশোধের পরও বাবা খুব যে একটা স্বস্তি বোধ করলেন না, তা বোঝা গেল। আসলেই বিল ঠিকমতো পরিশোধ হয়েছে কিনা, কে জানে! কিন্তু বাবা জানেন না তিনি চমকের কত বড় ক্ষতি করেছেন। উপন্যাসের প্রারম্ভেই বাবার অনাবশ্যক আবির্ভাব সবকিছু উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। পরবর্তী ঘটনাক্রমে, যা সে মাথায় স্টোর করে রেখেছিল তা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চমক অবশ্য কষ্টকল্পিত গল্প বানাতে চায় না। মুড এলে আবার সে কলম হাতে তুলে নেবে। এখন বিশ্বকাপের ক্রিকেট খেলা দেখা ভালো।
টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়েও বাবার সঙ্গে তার বিস্তর মতের পার্থক্য। বাবার মতে, ঘরে বসে বা মাঠে রোদে পুড়ে ক্রিকেট খেলা দেখার কী আছে? একজন খেলোয়াড় বল ছুড়ে মারছে আর প্রতিপক্ষের আরেকজন খেলোয়াড় সেই বল ব্যাটের বাড়ি দিয়ে দূরে ছুড়ে দিচ্ছে, এর মধ্যে জগৎ-সংসারের কোন উন্নতিটা সাধিত হচ্ছে? এটাকে একটা ভালো খেলা বলতেও বাবা নারাজ। যারা মাঠে খেলছে, তাদের দৌড়াদৌড়িতে না হয় একধরনের শরীরচর্চা হচ্ছে, কিন্তু ঘরে বসে টেলিভিশনে ওইসব ছাইপাঁশ দেখে দর্শকদের কোনো উপকার হচ্ছে কি? আর মাঠে বসে রোদের মধ্যে যারা খেলা দেখে, তাদের শারীরিক অপকারই হচ্ছে বলা যায়।
মা লায়লা আর্জুমান্দ ক্রিকেট খেলা দেখা পছন্দ করেন। বাংলাদেশের খেলা হলে অনেক সময় রান্নাবান্নার পাট বুয়াদের ওপর চাপিয়ে চমকের পাশে এসে বসেন। মায়ের মতে, ক্রিকেট খেলা দেখায় একটা দারুণ উত্তেজনা আছে। ওই উত্তেজনাটুকু তিনি উপভোগ করেন। এসব নিয়ে বাবার সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় মায়ের। বাবা ও মা দুজনেই হার্টের রোগী। তাই বাবা মাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যে-কোনো ধরনের উত্তেজনা হার্টের জন্য কত ক্ষতিকর! কিন্তু স্বামীর এসব স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মা মাঝেমধ্যে ক্রিকেট খেলা দেখেন। আর বাংলাদেশের খেলা থাকলে তো কথাই নেই।
বাসায় এখন দুজন পার্টটাইম কাজের বুয়া আছে। একজন রান্নাবান্না করে, অন্যজনের ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ। একজন ফুলটাইম কাজের লোক ছিল আগে। সে নাকি অতিরিক্ত চুরি শুরু করেছিল। তাই তাকে বাড়ির কাজ থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছে। সেই ব্যাটা ক-দিন আগে একটা উকিলের নোটিশ পাঠিয়ে বলেছে, আকস্মিকভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করায় ন্যাচারাল জাস্টিস হিসেবে তিন মাসের বেতন তাকে দিতে হবে। এছাড়া কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে মৌখিক হুমকি দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। হুমকির ব্যাপারে সে আদালতে মানহানির মামলা করবে বলে শাসিয়েছে।
রেজিস্ট্রি ডাকে প্রাক্তন কাজের লোক মফিজ জমাদারের উকিল নোটিশ আসার পর থেকে বাবা ও মা দুজনের মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। বাবা যদিও প্রথমে বলেছিলেন মফিজ ব্যাটা জমাদার হয়ে জমিদার সেজেছে, সেই তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, শেষ পর্যন্ত পচা শামুকে পা কাটল! এখন কোথায় উকিল পাই?
মা বললেন, চুরি সবাই করে। ওর চুরি-টুরি না দেখে চোখ বুজে থাকলেই হতো? কী দরকার ছিল ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার?
বাবা বললেন, ছোটখাটো চুরি তো কখনো তাকিয়ে দেখিনি। সে যখন একেবারে পুকুর-চুরি শুরু করল তখন –
যাও! এখন বাজারের ঝোলা নিয়ে বাজার করে এসো। তোমার শরীর ভালো না বলে এতদিন আমিই তোমাকে বাজারে যেতে দিইনি।
বাবা-মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এবার চমক বলল, বাজার নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। বাজারের ব্যবস্থা আমি করব।
তোকে তো ঠেলেঠুলে একদিনও বাজারে পাঠাতে পারলাম না। মফিজের সঙ্গে থেকে দু-চারদিন বাজার করা শিখলেও কথা ছিল।
আজকাল বাজার করতে আর বাজারে যেতে হয় না। আমি এখনই বাজারের ব্যবস্থা করছি। কী কী আনতে হবে, তার একটা লিস্ট করে দাও।
ঘরে বসে বাজার পাওয়া যাবে? বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।
অবশ্যই যাবে। চমক বলল, এখন কেনাকাটার জন্য দোকানে যাওয়ার দরকার নেই। ঘরে বসেই সব পাওয়া যায়।
আমার তো চিকন লতি আর কচি লাউ দরকার। এসব সবজি বেছে না আনলে কী করে হবে?
মা! তুমি কোনো চিন্তা করো না। তোমার সব সওদা ঠিক ঠিক চলে আসবে।
মাছ-মাংস বিকালে পেয়ে লাভ নেই। বিকালে কখনো টাটকা জিনিস থাকে না।
সব হবে। তুমি লিস্টটা দাও দেখি।
সত্যি সত্যি দুপুরের মধ্যে বাজার চলে এলো। এটা বিস্ময়ের ব্যাপারই বলতে হবে। মা মাছ-মাংস দেখে বেজায় খুশি। এভাবে বাজার করতে পারলে মফিজকে আগেই বিদায় করে দেওয়া যেত।
বাজার দেখে বাবাও এগিয়ে এলেন। বললেন, কত পার্সেন্ট বেশি খরচ পড়েছে?
তেমন বেশি নয়। চমক জানাল, এরা ভ্যাটও ধরেনি।
ভ্যাট না ধরলে ওরা ব্যবসা করছে কী করে?
প্রথমবার বলে ওরা ভ্যাটটা নিজেরা দিয়ে দিয়েছে।
এভাবে টাকা-পয়সা খরচ হলে ফতুর হতে বেশি দেরি হবে না।
বাবা যা-ই বলুন না কেন, টাকা-পয়সা নিয়ে এ-বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কারো কোনো চিন্তা নেই। সেই কবে চাকরিতে থাকা অবস্থায় রাজউকের একখন্ড জমি পেয়েছিলেন। দেশের এক নামকরা ডেভেলপারকে বাড়ি বানাতে দিয়েছিলেন। সাইনিং মানি হিসেবেই পাওয়া গেছিল বেশকিছু টাকা। ফিফটি ফিফটি ব্যবস্থা। অ্যাগ্রিমেন্ট সই করার সময় থেকে বাড়ি ভাড়াও দিচ্ছে ওরা। ইচ্ছা করেই তিনি আগের বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোনো এলাকায় উঠে যাননি। লায়লা আর্জুমান্দ অবশ্য বলে রেখেছেন, বাড়ি তৈরি কমপ্লিট হলে সেখানে একটা ফ্ল্যাটে উঠে যাবেন। এই অনভিজাত এলাকায় তিনি আর থাকবেন না। এটা কীভাবে অনভিজাত এলাকা হলো, এমন ঘোষণা কে দিলো, হাফিজুর রহমান ওসমানী ভেবে পান না। কিন্তু এ-বিষয়ে প্রশ্ন তুলে স্ত্রীকে ঘাঁটানোর ইচ্ছা হয়নি তার।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলা অধিকতর যুক্তিসংগত কিনা, ঠাহর করা মুশকিল। ক-দিন আগে তার এক ডাক্তার বন্ধু বলেছিলেন, তোমার তিন ধরনের অসুখ। কিডনির ফোর্থ স্টেজ, আনকন্ট্রোলড ডায়াবেটিস আর হার্টের ব্লক। তুমি বিদেশে চলে যাও।
এ-কথা শুনে তার একমাত্র মেয়ে নিউইয়র্ক প্রবাসী শায়লা মাকে বলেছিল, আববা আমার এখানে এলে ভালো হয়। ঢাকার চেয়ে এখানে চিকিৎসার মান অনেক উন্নত। চিকিৎসার পাশাপাশি আববা আমার বাবুটাকে যদি স্কুলে আনা-নেওয়া করতে পারে, তাহলে আমারও উপকার হয়। মোজাদ্দেদ তো সময়ই পায় না। শীতকালে বরফের মধ্যে আমার শরীর ভালো থাকে না।
স্বামীর অসুখের ব্যাপারে লায়লা আর্জুমান্দ খুবই উদ্বিগ্ন। কখন যে কী ঘটে যায়! চমককে বললেন, তোর বাবাকে সকালবেলা রমনা পার্কে নিয়ে গেলে পারিস। হাঁটাহাঁটি করলে ডায়াবেটিসটা কমত।
জগিং করতে পার্কে যেতে হবে কেন? চমক বলল, একটা ট্রেডমিল কিনে নিলেই হয়।
ট্রেডমিল কিনে কী লাভ হবে? হাঁটাহাঁটি করা যাবে ওতে? বাবার প্রশ্ন।
শুধু হাঁটাহাঁটি নয়, চাইলে দৌড়াতেও পারবে। জগিং করতে আজকাল কেউ পার্কে যায় না।
কিন্তু পার্কের আলো-বাতাস? মুক্ত বায়ু সেবন?
ট্রেডমিলটা দক্ষিণের বারান্দায় পেতে নিলেই হলো। সেখানে আলো-বাতাসের কমতি নেই।
ট্রেডমিল হলে আমারও সুবিধা হয়। আমার পক্ষে তো আর বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করা সম্ভব নয় – মা বললেন।
ট্রেড মিল কেনা হলো। বাবা-মা উভয়েই সেটার ওপর চড়াও হলেন প্রথম কয়েকদিন। মাসখানেক পরে ওটায় চড়তে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল। জিনিসটা ব্যবহার না করলে নষ্ট হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত চমকই সেটার ওপর সওয়ার হতে থাকল। কিন্তু তার স্ফীত শরীরের ওজন কিছুমাত্র কমল বলে মনে হলো না।
যে-ঘটনা বা দুর্ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছিল, সেটার মোড় ঘুরে গেছে। আসলে সেটাও অসুস্থতাজনিত কারণে। নিউইয়র্কে মেয়ের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন ভেবে তিনি একদিন আমেরিকার দূতাবাসে ভিসার লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভিসা অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমেরিকা যেতে চান কেন?
হাফিজুর রহমান ওসমানী মনে মনে এর দু-ধরনের উত্তর খুঁজে পেলেন। এক. মেয়ের কাছে বেড়াতে যেতে চাই। দুই. ওখানে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চাই। আমার তিন ধরনের শারীরিক প্রবলেম। আমেরিকায় অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা হয়। আমেরিকার প্রশংসা করলে ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে করে তিনি চিকিৎসার অপশনটার কথাই ব্যক্ত করলেন।
সত্য কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অফিসার বললেন, কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা মূলত আমাদের নাগরিকদের জন্য। তারা চিকিৎসা-বিমার আওতায় সেবা পেয়ে থাকেন।
সত্যকথনের প্রশংসার জন্য তিনি মনে মনে যতটা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন, পরের কথাগুলো শুনে ততটাই মিইয়ে গেলেন।
আপনাকে ভিসা দেওয়া সম্ভব হলো না। এজন্য আমরা দুঃখিত।
বাসায় ফিরে ইন্টারভিউয়ের ঘটনাটা বলতে চমক বিরক্তি প্রকাশ করল, তুমি আবেদন করেছ ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য। চিকিৎসার কথা বলতে গেলে কেন?
বারে! সত্য কথাটা বলব না? উনি আমার সত্য কথা বলার প্রশংসা করলেন।
তাতে কী লাভ হলো? লায়লা আর্জুমান্দ বললেন, ভিসা তো আর দিলো না।
তা অবশ্য। তবে ভিসা না দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।
সেই সুখেই থাকো। বলে রান্নাঘরের উদ্দেশে চলে গেলেন লায়লা।
রাতের বেলা শায়লা ফোন করে জানতে চাইল, আববার ভিসার অবস্থা কী?
ভিসা হয়নি। উনি আমেরিকায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা বলেছেন। মা বললেন।
আববা চিরকালই বোকা। কিন্তু তোমরা ইন্টারভিউয়ের আগে সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর শিখিয়ে দিলে না কেন? ইস! এখন আমার বাবুটার স্কুলে আনা-নেওয়ার ব্যাপারে কী হবে? আমি কত আশা করে রয়েছি।
হতাশ কণ্ঠে ফোন রেখে দিলো শায়লা।
সারা বাড়িতে হতাশার ঢেউ লাগলেও আশার বাণী শোনাতে চায় চমক রহম। আজকাল ঢাকায় বসেই নাকি আমেরিকার ডাক্তারদের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব। একজন রোগীর রোগের বৃত্তান্ত ই-মেইলে পাঠিয়ে দিলে যে-কোনো স্থান থেকে ডাক্তার তার চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু বিদেশে বসে একজন ডাক্তারের পক্ষে কি রোগীর অপারেশনে গাইড করা সম্ভব? চমকের কাছে ব্যাপারটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এমন দিন কি আসবে, যখন বিদেশে বসে ডাক্তার রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে লেজার দিয়ে রোগীর দেহে অস্ত্রোপচার করতে পারবেন? অনাগত ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিদ্যার বিস্ময়কর উত্থানের বিষয়ে মনে মনে একটা ছক কাটল চমক রহম।
কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। দিনে দিনে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বাবা। বাবাকে নিয়ে এমনিতে তার তেমন কোনো ভাবনা ছিল না। আজ কিছুদিন ধরে বাবার অসুস্থতা নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ বিরাজ করে। উদ্বেগ থেকে মন খারাপের ডালপালা ছড়াতে থাকে ভাবনার ভেতর। সে নিজে ইচ্ছা করে কিছু ভাবে না। ভাবনারা স্বয়ম্ভু বলে তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে মনের মধ্যে আসন পেতে নেয়। মন খারাপ হচ্ছে ভাবনার বাই-প্রোডাক্ট। তবে অনেক সময় মন খারাপের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে দু-ধরনের মন খারাপ আছে : সকারণ মন খারাপ ও অকারণ মন খারাপ। চমক রহম অধিকাংশ সময়ে অকারণ মন খারাপের কবলে পড়ে যায়। তখন সে এর উৎস সন্ধান করতে থাকে।
চমকের মনে হয়, মানুষের ভেতর একটা ইন-বিল্ট ভীতি আছে। সে যে-কাজটা করতে চায়, সেটা না পারার জন্য ভীতির প্রবণতা বাড়তে থাকে। কারো কাছে কিছু পাওয়ার থাকলে, সেটা না পাওয়ার আশঙ্কায় ভীতির উদ্রেক হতে পারে। অন্যদিকে কেউ কাউকে ভালোবাসলে, তাকে হারানোর ভয় সর্বদা মনের মধ্যে বিরাজ করে। ভালোবাসার শর্ত যেন প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রতি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। যেখানে উদ্বেগ নেই, সেখানে ভালোবাসা নেই। চমকের একেক সময় ধারণা হয়, মানুষের জীবনটাই বুঝি ভয়ভীতি দিয়ে মোড়া। একটা উদাহরণ মনে পড়ল। প্রায় সব ধর্মের মূল ভিত্তি কিন্তু বিশ্বাস নয়, নিতান্তই ভীতি। তুমি ধর্ম পালন না করলে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কঠিন নরক যন্ত্রণা। স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ভালোবাসার চেয়ে ভীতিই মুখ্য। এসব বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে সে যখন স্ট্যাটাস দেয়, তখন কেউ কেউ একমত হলেও উগ্রপন্থীরা দলবদ্ধ হয়ে তাকে আক্রমণ করে। গত কয়েকদিন ধরে তাকে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। অভিজিৎ রায়ের মতো পরিণতি হবে নাকি তার?
চমক ফেসবুক খুলে দেখতে পেল ক্লিওপেট্রা ফেসবুকে বসে আছে। ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও আজকাল ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও চালু হয়ে গেছে। এ-মুহূর্তে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে কথা বলতেই ভালো লাগবে তার। ওর সঙ্গে তার যোগাযোগ দীর্ঘদিনের নয়, এক বছরের কাছাকাছি সময় হতে পারে। ফেসবুকে চমকের স্ট্যাটাসগুলো পড়ে ক্লিওপেট্রা নিজেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। চমকও বন্ধু-বলয়ের মধ্যে তাকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি।
আপনার ক্লিওপেট্রা নাম কে দিয়েছে? চমক প্রশ্ন করেছিল।
আমার নানা। কিন্তু নামের কথা কেন? নামটা ভালো নয়?
নাম না-হয় ভালো, কিন্তু মানুষটা ভালো নয়।
মানে? আপনি আমার কী খারাপ দেখলেন?
না, না। আমি আপনাকে মিন করছি না।
তাহলে?
আমি মিসরের রানি ক্লিওপেট্রার কথা বলছি।
রানি ক্লিওপেট্রাকে আপনার খুব অপছন্দ? কেন? তার ব্যক্তিগত চরিত্রের কারণে?
না। আমার কাছে তার চেহারা মোটেই ভালো লাগেনি। গলাটা বেশ লম্বা।
কি আশ্চর্য! এমন কথা জীবনে এই প্রথম শুনলাম। পৃথিবীতে এখনো বুদ্ধের মূর্তির চেয়ে ক্লিওপেট্রার আবক্ষমূর্তি বেশি বিক্রি হয়।
এই তুলনা কি ঠিক হলো? এটা তো পণ্যের বাণিজ্যিক তুলনা। এমন তুলনা দিয়ে নিশ্চয়ই বলা যাবে না, ক্লিওপেট্রা বুদ্ধের চেয়ে বেশি আদৃত।
আমি তা বোঝাতে চাইনি। ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে ক্লিওপেট্রার তুলনা করব, এমন নির্বোধ আমি নই।
আপনার কথার মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা আছে।
পৃথিবীর সব মানুষের কথায়ই পরস্পর বিরোধিতা থাকে। ক্লিওপেট্রা বলেছিল।
এসব হচ্ছে ওদের প্রথম দিকের উক্তি। তখন ওদের কথাবার্তার মধ্যে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা বেশি ছিল। তারপর বাক্যবিনিময় অনেকটা স্বাভাবিকতার পর্যায়ে নেমে আসে। আজকাল ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে বাক্যবিনিময় বেশি হয়। ক্লিওপেট্রা কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার দৃশ্যপটের বর্ণনা লিখে পাঠায়। চমকের কথাগুলো ভিন্ন ধরনের। যেমন – কোথাও থেকে পড়ে পাওয়া একটা শিউলি ফুলের রূপ ও গুণের বিশ্লেষণ তার কথার উপজীব্য। শিউলি ফুলের স্থাপত্যরীতি ও দৈহিক গঠন সম্পর্কে তার ভাবনা প্রকাশ করে সে। অন্যদিকে শিউলি ফুলের ঘ্রাণের মাদকতা নাসারন্ধ্রে কী ধরনের আবেশ সৃষ্টি করে, তা তুলে ধরতে চায়। ক্লিওপেট্রার চিন্তায় প্রাত্যহিক বিষয় প্রাধান্য পেলেও, চমকের ভাবনার জগৎ অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব, পরাবাস্তব, এমনকি ভার্চুয়াল।
ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনো বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করেনি। খুব একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ওদের আলোচনায় উঠে আসেনি। চমক একবার পারস্পরিক সাক্ষাতের কথা তুলেছিল। ক্লিওপেট্রা সরাসরি বলে দিয়েছে সামনা-সামনি দেখা করে সে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। ফেসবুকের বাইরে সে সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। চমক যদি অন্যদের মতো কাছে আসতে চায়, তাহলে বন্ধুত্বের তালিকা থেকে তাকে বাদ দিলে পারে। সামান্য একটা ব্যাপারে এমন কঠিন কথা কেন বলল ক্লিওপেট্রা, কারণ খুঁজে পেল না সে।
মানুষের সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট স্থানে থেমে থাকে না। নারী-পুরুষের সম্পর্ক তো নয়ই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে যায়। কেউ কেউ প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার এর উল্টোটাও হয়। সামনে এগোতে গিয়ে অনেকে হোঁচট খায় এবং পরিণতিতে সম্পর্কে ভাঙন ধরে।
আজ ফেসবুকে বসে চমক ওকে প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার? তোমার পাত্তা নেই কেন? বেশ কিছুদিন ধরে তোমার সঙ্গে কথা হয় না।
শরীর খারাপ ছিল। অনেক সময় মন ভালো থাকে না।
মন খারাপের কোনো কারণ আছে কি?
কারণ অবশ্যই আছে। কারণ ছাড়া কারো মন খারাপ হয় নাকি?
আমার তো অকারণেও মন খারাপ হয়।
ওটা হচ্ছে মন খারাপের বিলাসিতা। কী নাম দেব? বেদনাবিলাস বলা যেতে পারে।
শেক্সপিয়রের একটা কথা আছে : ‘আই নো নট হোয়াই আই অ্যাম সো স্যাড।’ তিনি কি মিথ্যা বলেছেন?
ওটাই তো বেদনাবিলাস। যাদের মন খারাপের কোনো কারণ থাকে না, তারাই অকারণে মন খারাপের বিলাসিতা করে।
তোমার কি এমন কারণ আছে?
আছে। সেটা বলে কারো করুণা কুড়াতে চাই না।
দেখো, মানুষের জীবনে সুখের পাশাপাশি দুঃখ, আনন্দের পাশাপাশি বেদনা তো থাকেই। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া দরকার। কাউকে নিজের কষ্টের কথা বললে তার করুণা কুড়ানো হবে কেন?
আমার জীবনে কোনো সুখ নেই, সবটুকুই যন্ত্রণা। যা বোঝেন না, তা নিয়ে কথা বলতে আসবেন না।
বুঝি না বলেই তো আমি বুঝতে চাই।
এটা আপনার অনধিকারচর্চা হয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের বন্ধুত্ব ফেসবুকেই সীমিত থাকা উচিত।
তুমি নিজেই বলছ, বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের কি কোনো সীমারেখা থাকে? যা তুমি বলতে চাও না, তা আমি জানতে চাইব না। কিন্তু বন্ধু কথাটা বললে শব্দটার চারপাশে দেয়াল তুলে দেওয়া কেন? কেন সেটার পরিধি ও আয়তন কমিয়ে আনা?
আপনার সঙ্গে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না।
ক্লিও, আমার কথায় যদি আঘাত পেয়ে থাক, তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না, তোমার কষ্ট শেয়ার করতে চাই।
কী লাভ হবে? আপনি আমার কষ্ট শেয়ার করতে চাইলেও আমার লাভ হবে না। আমার কষ্ট কমবে না।
তা-ই যদি হয়, আমাকে তোমার কিছু বলার দরকার নেই।
এরপর ফেসবুকে আর কোনো কথা নেই। শব্দ নেই। ক্লিওপেট্রা এখনো অনলাইনে আছে। কিন্তু ওর নীরবতা চমকের মনে স্পর্শকাতরতা ছড়িয়ে গেল। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ক্লিওপেট্রার ছবিটির দিকে। কী সুন্দর চেহারা তাঁর। চোখগুলো ইতিহাসের ক্লিওপেট্রার মতো টানা টানা নয়, কিন্তু বড় আর ফোলা ফোলা। এ-ও এক ধরনের সৌন্দর্য!
চমক ওর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল ল্যাপটপের সামনে। ক্লিওপেট্রা উঠে না গেলে তারও উঠে যাওয়া সম্ভব নয়। কী করছে এখন ক্লিওপেট্রা? ও কি কাঁদছে? চমকের সে-রকম মনে হলো। ক্লিওপেট্রা যদি অনন্তকাল কাঁদতে থাকে, সে-ও অনন্তকাল বসে থাকবে সাড়া না পাওয়া পর্যন্ত।
শুনুন। ভেবেছিলাম কাউকে আমার কথা বলব না। কিন্তু আপনাকে বলছি। স্ক্রিনে এ কথাগুলো ভেসে উঠে আবার বিরতি।
আমি অপেক্ষা করছি তোমার কাছ থেকে শোনার জন্য।
আমার দুটো পা কাটা।
মানে?
মানে আমি পঙ্গু। দু-বছর আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে আমার পা দুটো কেটে বাদ দিতে হয়। আমি এখন হুইল চেয়ারে বসে থাকি।
সরি! ভেরি সরি!
আমি আপনাকে সমবেদনা জানাতে বলছি না। আমি কারো করুণাপ্রার্থী হতে চাই না।
একজন দুখী মানুষের দুঃখ শেয়ার করা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। এটা করুণা করা বলা চলে না।
আচ্ছা, আমি রাখি। বলে ফেসবুক থেকে অন্তর্হিত হলো ক্লিওপেট্রা।
ল্যাপটপ ওপেন রেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল চমক। ফেসবুকে সে সর্বদা সিরিয়াস নয়। সে নিজে খুব বেশি মানুষকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়নি। যে কয়েকজনকে বন্ধু হিসেবে বরণ করেছে, তাদের মধ্যে ক্লিওপেট্রা অন্যতম। ওকে ফেসবুকে দেখে, ওর সুন্দর ও আকর্ষণীয় মুখখানা দেখে, এমন নির্মম পরিণতির কথা ভাবতে পারেনি চমক। ইচ্ছা হচ্ছিল ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটায়। কিন্তু ক্লিওপেট্রা তাকে ফোন নম্বর বা ঠিকানা কিছুই দেয়নি।
ক্লিওপেট্রাকে দেখার খুব ইচ্ছা করছে চমকের। কেন সে তাকে দেখতে চায়, কিংবা ওকে দেখতে চাওয়ার কীইবা আছে? অথচ নিজের মনের মধ্যে এক দুর্দমনীয় ইচ্ছা অনুভব করল সে। এর কারণ খুঁজে পাওয়া ভার। তাছাড়া চমক চাইলেই যে ক্লিওপেট্রা তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হবে, এমন নয়। তবু মনের কোণে ক্লিওপেট্রার জন্য এক ধরনের গভীর মমত্ববোধ তাকে উদ্বেল করে তুলল। এর নাম কি সহমর্মিতা? করুণা, না অন্যকিছু?
মানুষের জীবনে অন্ধকার যখন ঘনিয়ে আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে। বাবা অসুস্থ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যে এমন আকস্মিকভাবে মারা যাবেন, তা ভাবতে পারেনি চমক। মৃত্যুর জন্য কখনো কারো প্রস্ত্ততি থাকে না। সব মৃত্যুকেই তাই আকস্মিক মনে হয়। বাবা নিজেও সম্ভবত বুঝতে পারেননি যে, মৃত্যু তার কতটা নিকটবর্তী। সকালে চমককে কাছে ডেকে তিনি বলেছিলেন, ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখো, আজ বিকালে তাকে দেখাতে যাব।
বাবার মৃত্যুর পর বাস্তবতার এক ভিন্নরূপ দেখতে পেল চমক। এ-রকম কিছু যে ঘটবে, তা সে ভাবতে পারেনি। লাশ দাফন-কাফন নিয়ে রীতিমতো মুসিবতে পড়ে গেল সে। ঢাকা শহরে তাদের আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই। বাবা যে অফিসে চাকরি করতেন, ছুটির দিন বলে সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হলো না। এ-এলাকায় পাড়া-প্রতিবেশীরা এক রকম বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন। মৃত্যুর খবরে দু-চারজন ছাড়া তেমন কেউই এগিয়ে এলেন না।
মা বললেন, পাড়ার মসজিদে গিয়ে দেখ! ওখান থেকে দু-চারজন মাদ্রাসার ছাত্র আনা যায় কিনা!
মাদ্রাসার ছাত্ররা কী করবে?
ওরা কয়েকজন মিলে কোরআন শরিফ খতম দিতে পারলে ভালো হয়। মৃত মানুষের সঙ্গে তো আর কারো কোনো রেষারেষি থাকতে পারে না।
এ-কথা বলছ কেন?
পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে তোর আববার মনোমালিন্য ছিল। গত তিন-চার বছর ধরে তিনি ওই মসজিদে নামাজ পড়তে যাননি। জুমার নামাজ পড়তে যেতেন কাকরাইল মসজিদে।
চমক কথাটা আগেও শুনেছে। মাকে জিজ্ঞাসা করল, কী নিয়ে তাদের মধ্যে গন্ডগোল ছিল?
শরিয়তের কোনো বিষয় নিয়ে। তোর আববার সঙ্গে ইমাম সাহেবের মতের মিল ছিল না। পাড়ার মসজিদের হিসাবপত্র নিয়েও তোর আববা প্রশ্ন তুলেছিলেন। মসজিদ কমিটির মেম্বাররা তাই তোর আববার ওপরে নাখোশ ছিল। কিন্তু তার ইন্তেকালের খবরটা তো কমিটির সবাইকে জানানো উচিত।
চমক মসজিদে গেল। ইমাম সাহেব ছিলেন না। মোয়াজ্জিন সাহেব বললেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা অখন পরীক্ষা লইয়া ব্যস্ত। তাই তারা যাইতে পারব না। আপনে লাশ লইয়া আইসেন। বাদ আছর মুর্দার জানাজা পড়াইয়া দেবানে।
চমক চলে এলো ওখান থেকে। ডেকোরেটারের দোকানে ফোন করে কয়েকটি মাইক ও এমপ্লিফায়ার আনতে বলল। বাসায় সম্পূর্ণ কোরআন শরিফের ক্যাসেট আছে। বাবা ক্যাসেট রেকর্ডারে তা প্রায়ই বাজিয়ে শুনতেন। চমক তা মাইকে বাজিয়ে দিলো, যাতে পাড়া-প্রতিবেশী শুনতে পায়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে কোরআন শরিফের তেলাওয়াতের রেকর্ড বাজানো হচ্ছে। তবে ক্যাসেটের উচ্চারণ অনেক বেশি শ্রুতিমধুর, সাধারণ তেলাওয়াতের সঙ্গে এটুকুই যা পার্থক্য।
মা শোকে মুহ্যমান। ওর-এর দূরসম্পর্কের খালা এসেছিলেন। তিনি বললেন, মুর্দাকে গোসল দিতে হবে। কে গোসল দেবে?
পাড়ার মসজিদ থেকে কাউকে পাওয়া যাবে না।
তুমি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ফোন করো।
প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনেছে চমক। কোরবানির সময় পশুর চামড়ার জন্য বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটা দেখেছে। ওদের ফোন নম্বর কোথায় পাওয়া যায়? চমক ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটে গিয়ে ফোন নম্বর বের করে ফেলল।
ফোন করে দাফন-কাফনের কথা জানাতে অপরপ্রান্ত থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, মুর্দা কি বেওয়ারিশ?
না। বেওয়ারিশ হবেন কেন?
আমরা বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি। অপরপ্রান্তের কণ্ঠ বললেন, আমি আপনাকে অন্য একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি। সেখানে ফোন করে দেখুন। আপনার কাছে কি কাগজ-কলম আছে?
আছে। এক মিনিট ধরুন।
চমক কাগজ-কলমে টেলিফোন নম্বর লিখল। জিজ্ঞাসা করল, এটা কার নম্বর?
কথাটা পুরো বলার আগেই অপরপ্রান্ত লাইন কেটে দিয়েছে।
চমক নম্বরটিতে ফোন করল। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহে বারকাতাহু।
ওয়ালাইকুম আসসালাম!
আপনার জন্য কী করতে পারি জনাব?
আমার আববা মারা গেছেন। তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করার জন্য –
মারা গেছেন কথাটা বলবেন না। বলুন ইন্তেকাল করেছেন।
জি! ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমরা শতকরা একশ ভাগ শরিয়ত মোতাবেক সব ব্যবস্থা করে দেব। আল মারকাজুল ইসলামী আপনাদের খেদমতে সবসময় হাজির।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ এখনই না। কাজের পর। আমাদের কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি আছে। জানেন তো?
জি হ্যাঁ।
আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের টিম এখনই আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবে। এবার আপনার বাসার ঠিকানা বলুন।
দাফন-কাফনের আংশিক ব্যবস্থা করে মায়ের কাছে এলো চমক। স্বামী-শোকে লায়লা আর্জুমান্দ একেবারে ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু কিছু বিষয় আছে যা তার সঙ্গে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বাবাকে কোথায় কবর দেওয়া হবে? দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বনানী গোরস্তানে ফোন করে জানল, সেখানে নতুন করে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কারো পুরনো কবর থাকলে কাগজপত্র দেখিয়ে সেখানে কবর দেওয়া যেতে পারে।
প্রায় আকস্মিকভাবে এ-সময়ে বাসায় এসে উপস্থিত হলো মফিজ জমাদার। কারো কাছে বাড়ির মালিকের মারা যাওয়ার খবর শুনে সে ছুটে এসেছে। প্রথমে মায়ের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে বলল, বেগম সায়েব, আমারে মাফ করে দেন। সায়েব যে এভাবে চলে যাবেন, তা ভাবতে পারি নাই।
মা তেমন কোনো সাড়া দিলেন না।
মফিজ এবারে চমকের কাছে এসে দু-হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইজান! মাফ করে দেন। সায়েবরে আমি অনেক কষ্ট দিছি।
চমক হাত সরিয়ে নিল না। বলল, এখন আমি খুব ব্যস্ত।
হাত নামিয়ে নিল মফিজ।
মাকে জিজ্ঞাসা করল চমক, বাবার কবর কোথায় হবে?
উনি তো আজিমপুরের কথা বলেছিলেন। যে-গোরস্তানে কবরের কোনো চিহ্ন থাকে না, মানুষের কোনো ভেদাভেদ থাকে না, তোর আববা সেটাই একবার জানিয়েছিলেন।
কথাটা শুনে এক নিমিষে বুক হালকা হয়ে গেল চমকের। এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বাবা। মুক্তিযুদ্ধের একখানা সনদপত্রও আছে তার। তবে সনদপত্রটা অনেকের মতো বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়নি। চাকরিক্ষেত্রেও ওটা কোনো কাজে লাগেনি। চমক একবার ভেবেছিল, ওটা দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোরস্তানে তার দাফনের স্থান হতে পারে কিনা! কিন্তু এসব করতে গেলে কোথায়, কার কাছে যেতে হবে – জানা নেই তার। অনলাইনে কিছু করা সম্ভব নয়। লোকবল বলতে কিছু নেই তাদের। এ-অবস্থায় বাবার কবরের সিদ্ধান্তটা অনেক সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে ফেলল।
মফিজ সামনে এসে বলল, ভাইজান! একটা দরখাস্ত লিখে দেন।
কিসের দরখাস্ত?
সিটি করপোরেশন থেকে পারমিশন আনতে হবে। ওখানে আমার চাচত ভাই কাজ করে। সে করায়ে দেবে। আমার বাপ মারা গেলে আমি পারমিশন আনছিলাম।
এ-রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা একবারও মনে হয়নি চমকের। সে একখানা দরখাস্ত লিখে মফিজের হাতে দিলো। এ-সময়ে মফিজের উপস্থিতিতে অনেকটা বল-ভরসা পাওয়া যাচ্ছে। এসব করতে করতে আল মারকাজুল ইসলামীর লোকজন চলে এলেন। তারা মরদেহ গোসল দিতে ব্যবস্থা নিলেন। কাফনের কাপড়ও তারাই নিয়ে এসেছেন। এমনকি লোবান পর্যন্ত। চমক আর কোনো রকম টেনশন বোধ করল না। ইতোমধ্যে পাড়ার কিছু বাসিন্দা সমবেত হয়েছেন। তারাই জানাজার জন্য মরদেহ বয়ে নিয়ে গেলেন পাড়ার মসজিদে। আছর নামাজের পর জানাজা পড়ালেন মসজিদের ইমাম মুফতি সাদউদ্দিন কামালপুরী। চমককে জানালেন, তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন। হাফেজ হাফিজুর রহমান ওসমানী সাহেবের ইন্তেকালের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। জানাজার আগে চমক পিতার পক্ষ থেকে সবার কাছে জানা-অজানা দোষ-ত্রুটির জন্য মাফ চাইল। কারো কোনোরূপ পাওনা থাকলে তা পরিশোধের উল্লেখ করল।
সময় এক অত্যাশ্চর্য বিষয়। প্রতিটি মুহূর্ত পরবর্তী মুহূর্তের ওপর গড়িয়ে যায়। কথায় আছে, সময় ও জলের স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কথাটা ঠিক নয়। জলের স্রোতকে বাঁধ দিয়ে হয়তো ঠেকানো যায়, কিন্তু সময়কে ধরে রাখা যায় না। ঘড়ির কাঁটা অনবরত ঘুরতেই থাকে। যদিও ঘড়ির কাঁটা কোনো কারণে থামতে পারে, কিন্তু সময়ের কাঁটা প্রতিক্ষণ সচল। কথাগুলো চমকের মনে হলো, বাবার মৃত্যুর পর কীভাবে তিন-তিনটা দিন কেটে গেল, তা বুঝতে পারেনি সে। কেবল মফিজ বলেছিল, আইজ মরলে কাইল একদিন!
তিনদিন পরে কুলখানির ব্যবস্থা করা হলো বাসায়। মফিজ নিজেই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। দোয়া মাহফিলে পাড়ার লোকজন ও মসজিদের ইমাম সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে এলো চমককে সঙ্গে নিয়ে। কামালপুরী বললেন, এতে দাওয়াতের কী আছে? হাফেজ সাহেবের কুলখানিতে আমি মিলাদ পড়াতে যাব। বড় ভালো মানুষ ছিলেন হাফেজ হাফিজুর রহমান ওসমানী। বড় ইমানদার মানুষ ছিলেন। তার জন্য দোয়া মাহফিলে শামিল হওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমার সঙ্গে মাদ্রাসার তালেবে-এলেমরা কুলখানিতে যাবে।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এক গভীর শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয়ে আছে চমক রহম। একজন মানুষ, যিনি প্রতিনিয়ত সামনে ছিলেন, যার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত সরব, তিনি আজ শুধুমাত্র স্মৃতি। বাবার স্মৃতিভারে জর্জরিত চমকের মনে ভেসে বেড়াতে থাকল অসংখ্য ঘটনাবলি। দুজনের মধ্যে মতের পার্থক্য ছিল অনেক, চিন্তার পার্থক্য কম ছিল না। কিন্তু বাবা কখনো তার কাজে বাধা দেননি বা বাধা হয়ে দাঁড়াননি। নিজেকে এক ধরনের সীমিত অবস্থানের মধ্যে রেখেও বাবা তার সামনে এগিয়ে যাওয়া অবারিত করে দিয়েছিলেন। মুক্ত আকাশের দিকে তাকে যেন ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা।
কিছুই ভালো লাগছিল না তার। বাবার অবর্তমানে এক ধরনের বিষণ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। মনের এই বেদনাবোধ তো অকারণ নয়। অকারণ বেদনাবিলাসও নয়। চমক অনুভব করল, বাবার কথা মনে করে তার চোখের কোনায় দু-ফোঁটা অশ্রু জমে উঠেছে।
রাতে ফেসবুকে এসে বসল চমক। গত কয়েকদিন ফেসবুকের কথা মনে পড়েনি। বাবার মৃত্যু সংবাদটা ফেসবুকে যে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া যেত, তাও মনে হয়নি। ল্যাপটপে টাচ করে সে দেখতে পেল ক্লিওপেট্রা অনলাইনে আছে। চমক স্ক্রিনে শুধু ওর নামটুকু লিখল, ক্লিওপেট্রা! আর কী লিখবে ভেবে পেল না।
কি আশ্চর্য! আপনি কোথায়? ক-দিন ধরে আপনার কোনো খবরই পাইনি। ভাবলাম, আমার কথা শুনে আপনি হয়তো ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আমাকে বাদ দিয়েছেন।
না। তা হবে কেন?
তাহলে গত ক-দিন ডুব মেরে ছিলেন যে! শরীর খারাপ ছিল?
না।
আমার মন বলছিল, কিছু একটা হয়েছে আপনার। আপনার তো অকারণেই মন খারাপ হয়।
চমক লিখল, আমার একটা দুঃখের খবর আছে।
আমাকে বলা যায়? ব্যক্তিগত কিছু হলে আমি জানতে চাই না।
আমার বাবা মারা গেছেন।
সে কি! কবে?
তিনদিন আগে। তাঁর হার্টফেল করেছিল। হাসপাতালে নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।
আমি খুব দুঃখিত। আপনাকে শোক জানানোর ভাষা আমার নেই।
বাবার মৃত্যু আমার মনে চরম শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।
বাবা হারানোর কষ্ট কত, তা আমি বুঝি।
তুমিও কি তোমার বাবাকে হারিয়েছ?
হ্যাঁ। যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা হয়, সেদিন আমার বাবা স্পটেই মারা যান। আমি কেবল পা দুটোর বিনিময়ে প্রাণে বেঁচে যাই।
আমি তা জানতাম না। মনে হচ্ছে, আমরা দুজন পিতৃহারা একই দুঃখের সমতলে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? ক্লিওপেট্রা বলল, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করলে আপনার দুঃখ কি কিছুটা কমবে?
চমক কথাটার উত্তর দিলো না। ল্যাপটপের সামনে নির্বাক বসে রইল, বেশ কিছুক্ষণ।
আপনার কি আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না?
চমকের হাতের আঙুল ল্যাপটপের ওপর নেমে এলো। সে লিখল : আমি তোমার সঙ্গে সারাজীবন কথা বলতে চাই ক্লিও। তোমার সঙ্গে জীবন মেলাতে চাই।