‘খেয়াল করেছ?’
‘কী?’
‘ছেলেটা কেমন করে দিন দিন বদলে যাচ্ছে।’
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। স্ত্রীর কথায় চোখ তুলে তাকালেন। কিছুটা আন্দাজ করেছেন তিনি। তারপরও বললেন, ‘কার কথা বলছ?’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ছেলে আমাদের ডজনখানেক।’ একটু করে হাসলেন সুপ্রভা দেবী। বললেন, ‘ছেলে তো আমাদের ওই একটাই, অর্ণব। তার কথাই তো বলছি তোমা…।’
মুখের কথা কেড়ে নিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। বললেন, ‘ছেলে তো আমাদের একটা নয়, তিনটা।’
করুণ চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সুপ্রভা দেবী। অতি চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। চিত্তরঞ্জনবাবু তা খেয়াল করলেন না। ডাইনিং টেবিলের ওপাশের দেয়ালে একটা ছবি-বাঁধানো ফ্রেমের মধ্যে গভীর দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজছেন তিনি। কাঁচা হাতের অাঁকা ছবি। লাল-নীল-সবুজ রঙের পেনসিলে অাঁকা। একটি গাছ, গাছে থোকা থোকা লাল ফুল, ফুলের ফাঁকে দোয়েল বা কাকের ছবি। পাশে একটি জলধারা। এর পাশেই সবুজ মাঠ। ধানক্ষেতই বোধহয় অাঁকতে চেয়েছে অাঁকিয়েটি। অতি যত্নে বাঁধাই করা ফ্রেমটি। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। স্ত্রীর গলা-খাঁকারিতে বাস্তবে ফিরে এলেন। হালকা চালে কথা বলতে চাইলেন তিনি। কিন্তু গলাটা ধরা ধরা শোনাল। বললেন, ‘প্রথমটা যখন তোমার পেটে, সবাইকে খাইয়ে-দাইয়ে পুকুরঘাটে থালা-বাসন ধুতে গেলে তুমি। পা পিছলে আছাড় খেলে। মৃত বাচ্চাই হলো তোমার। ধাই বলেছিল – ছেলেই ছিল।’ একটু থামলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। তারপর বললেন, ‘সেই সময় থেকে কীরকম পাগল পাগল ভাব তোমার। সংসারের কাজকর্ম সবই করে যাচ্ছিলে তুমি। একা যখন থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে। উদাসীন, অন্যমনস্ক। কিছু জিজ্ঞেস করলে ম্লান হাসতে। মা একদিন ডেকে বলল – চিত্ত, ভালো ঠেকছে না। তুমি বউকে একটু সঙ্গ দাও। চাকরি নিয়েই তো তোমার দিন কাটে।’
‘থাক না ওসব পুরনো দিনের কথা।’ সুপ্রভা বললেন।
‘ভুলেই থেকেছিলাম। তুমি কথাটা পাড়লে বলেই মনে পড়ে গেল। ভুল বললাম তোমাকে, ইচ্ছে করে মনের ভেতরে ওদের দুজনের স্মৃতি বড় একটা পাথর দিয়ে চেপে রেখেছিলাম।’
‘দুজনের স্মৃতি!’
চিত্তরঞ্জনবাবু যেন স্ত্রীর কথা শুনতে পাননি। আপন মনে বললেন, ‘অনেকটা বছর পরে পলাশ এলো। যখন পলাশ জন্মাল, ফাগুন মাস ছিল। পুকুরপাড়ের পলাশ গাছটি ফুলে ফুলে ছাওয়া তখন। বললাম – পলাশই রাখি তোমার ছেলের নাম। মৃদু হেসে সম্মতি দিয়েছিলে তুমি। এক-দুই করে করে পাঁচ বছরে পড়ল ছেলেটা। অাঁকিবুকির দিকে ঝোঁক তার। শুধু এখানে-ওখানে অাঁকতে চাইত। তোমার চাপাচাপিতে কাগজ আর রংপেনসিল এনে দিলাম। ওই নিয়েই পড়ে থাকত পলাশ। কত কিছুই যে অাঁকত – ব্যাঙ, পুকুর, মাছ, নৌকা, মাঠ, সাগর। পলাশ গাছটার প্রতি গভীর একটা টান ছিল তার। একদিন বলেছিলাম – ‘ওই গাছটার জন্যই তোর পলাশ নাম রেখেছি রে বাপ।’ তারপর ডাইনিং টেবিলের দিকে ঝুঁকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। তর্জনী দিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই ছবিটা দেখিয়ে বললেন, ‘পলাশের মৃত্যুর পর অনেক ছবি থেকে ওই ছবিটা খুঁজে বের করেছিলাম আমি। বাঁধাই করে টাঙিয়ে…।’ হঠাৎ হু-হু করে কেঁদে উঠলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। তাঁর বুক চিরে দমকে দমকে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল। কান্না জড়ানো গলাতেই বলতে থাকলেন, ‘যে দুপুরে মারা গেল পলাশ, আমি চাকরিতে ছিলাম। ফিরলাম যখন, উঠানে বসে পলাশের মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছ তুমি। আমাকে দেখে তোমার আর্তনাদ আরো বেড়ে গেল। বলতে থাকলে – তোমার ছেলের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। রান্নাবাটির কাজ শেষে শরীরটা ভেঙে যাচ্ছিল, পলাশকে পাশে শুইয়ে বললাম – ঠিক-দুপুর এখন বাবা, শরীরটা আমার ভালো যাচ্ছে না। মায়ের পাশে শুয়ে থাক। কালঘুমে পেয়েছিল আমায়। কোন ফাঁকে উঠে গেল। মধুরামের ছেলের সঙ্গে পুকুরে নামল। সাঁতার তো জানত না পলাশ। তারপর পলাশ রে বলে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠেছিলে তুমি। মূর্ছা গিয়েছিলে। সেই মূর্ছা ভেঙেছিল দুদিন পর, হাসপাতালে।’
চিত্তরঞ্জনবাবু তাকিয়ে দেখলেন – স্ত্রীর কপোল বেয়ে দুটো অশ্রুধারা নেমে যাচ্ছে।
‘এরপর দীর্ঘ অনেকটা বছর কেটে গেল।’ অশ্রুপাত করতে করতে সুপ্রভা বললেন।
‘টুপ করে মা-টা মারা গেল। গাঁয়ের প্রতি টানটা কমল আমার। পুকুরটা দেখলে প্রাণটা কৈছালি করে উঠত। যেখানে যেখানে পলাশ ঘুরে বেড়াত, সেসব জায়গা আমাকে উন্মাদ করে তুলত। তুমি কথা বলা কমিয়ে দিলে। শুধু ইতিউতি কী খুঁজে বেড়াতে। তোমার দিকে তাকালে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠত আমার। একদিন ঠিক করলাম – গাঁ ছাড়ব। তোমাকে না জানিয়ে শহরে বাসাও ঠিক করে ফেললাম। সওদাগরি অফিসে চাকরি আমার। মালিক আমার কাজে খুশি হয়ে প্রমোশনও দিল একটা। তুমি গাঁ ছাড়তে রাজি হওনি। আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়েছিলে তুমি। গাঁ ছাড়ার আগের রাতটা পুকুরপাড়ে কাটিয়েছিলে। ভোর সকালে তোমায় টেনে এনেছিলাম ঘরে।’ ধীরে ধীরে বলে গেলেন চিত্তরঞ্জন।
‘এরপর অর্ণব এলো।’ মৃদু কণ্ঠে সুপ্রভা বললেন।
‘ওর আসার কথা কিছুই জানাওনি আমায়। জানতে পারলাম তিন মাস পেরিয়ে গেলে। এক রাতে বললে – তোমার পেটে বাচ্চা এসেছে। খুশি হওয়ারই কথা আমার। কিন্তু বুকটা কেন জানি কেঁপে উঠেছিল, আশঙ্কায়। যদি আবার মৃত সন্তান হয়, যদি কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায়। সে-রাতে খুশি হওয়ার বদলে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। দুজন ছেলের অকালমৃত্যুতে বুকটা এমনিতেই দুমড়ানো-মোচড়ানো ছিল। বিশ্বাস করো, ওই রাতে ঈশ্বরের কাছে এক অদ্ভুত প্রার্থনা করে বসেছিলাম আমি – হে ঈশ্বর, সন্তানই যদি দেবে, পুত্রসন্তান দিও না, কন্যাই দিও। কেন এ-রকম অদ্ভুত প্রার্থনা করেছিলাম? ভেবেছিলাম – বারবার পুত্র হয়েছে আমাদের; কিন্তু ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে বা অভিশাপে মৃত্যু হয়েছে তাদের। পুত্রশোক যে কী কঠিন ব্যাপার, সে আমি জানি। ভুল বললাম। শুধু আমি জানি কেন, তুমি তো আমার চেয়ে আরো বেশি করে জানো। তুমি যে মা। সেই রাতে এক অলৌকিক বিশ্বাস আমার ওপর ভর করেছিল। মেয়ে হলে আমাদের সন্তান বেঁচে থাকবে – এরকম একটা বিশ্বাস আমার মস্তিষ্কের খোপে খোপে অনুরণিত হচ্ছিল।’ থামলেন চিত্তরঞ্জনবাবু।
এবার প্রশান্ত হেসে সুপ্রভা বলে উঠলেন, ‘ভগবান তোমার কথা শোনেননি কিন্তু। অর্ণবই তো হলো।’
‘তুমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলে নবজাতককে নিয়ে। তুমি যতই উৎফুল্ল হয়ে উঠতে, আমি ততই মনমরা হতাম। তবে আমার ম্রিয়মাণতা তোমাকে বুঝতে দিইনি কখনো। একদিন অবশ্য তুমি মুখ খুলেছিলে। বলেছিলে – তোমার মনমরা থাকার অর্থ আমি বুঝি। তোমার মধ্যে গভীর একটা আশঙ্কা কাজ করে। কিন্তু আমার মনে হয় কি জানো – অর্ণব আমাদের ছেড়ে যাবে না। স্থানান্তরে এসেছি যে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। ফাড়া কেটে গেছে আমাদের, দেখে নিও। তোমার বিশ্বাসটাই সত্য হলো।’
‘অর্ণব বড় হতে লাগল। এক-দুই করে করে ছয়ে পড়ল। আমি চারে স্কুলে দিতে চাইলাম, তুমি রাজি হলে না। বললে – ওর শৈশবটা কেড়ে নিও না। খেলতে দাও ওকে।’ সুপ্রভা বললেন।
‘খেলার ফাঁকে ফাঁকে পড়াতে লাগলাম ওকে। ওর লেখার হাতটা দারুণ ছিল। দাদা যে অাঁকাজোকা করত। ও অবশ্য সেদিকে যায়নি। তবে তার লেখার মধ্যে দাদার কীর্তি ফুটে উঠতে লাগল।’ একটু থেমে দম নিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। বললেন, ‘সুন্দর হাতের লেখার জন্য স্কুলে অনেকবার পুরস্কার পেয়েছে সে। থ্রি-ফোরের খাতাগুলো এখনো যত্নে রেখে দিয়েছি আমি। একদিন ওর ছেলেকে দেখিয়ে চমকে দেব।’
‘এর মধ্যে তেইশটি বছর পার হয়ে গেল। কী দ্রুতই না সময়টা ফুরিয়ে গেল!’ আফসোসের গলায় বললেন সুপ্রভা দেবী।
‘এক অর্থে তোমার কথা ঠিক। অন্যদিক দিয়ে ভাবলে ঠিক নয়। তেইশটি বছর তো আর এমনি এমনি যায়নি। আমাদের চোখের সামনেই তো অর্ণব ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। প্রথম বাসাটির কথা নিশ্চয় মনে আছে। ওই যে অভয় মিত্র রোডের বাসাটি। চৌচালা টিনশেডের বাসা। মার্গারেট দিদির বাড়ি ছিল ওটি। ছেলেটি বিয়ে করে বরিশাল চলে গিয়েছিল। স্বামীটি মারা গেলে আয়-ইনকাম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দিদির। আমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছিল তার। বাড়ির একটা মাঝারি রুমে সরে গিয়ে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছিল আমাদের।’ বলে গেলেন চিত্তরঞ্জনবাবু।
সুপ্রভাও পেছন দিনের স্মৃতিতে জড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘বড় ভালো মহিলা ছিল দিদি। এরকম মায়াবতী মানুষ আমি জীবনে দু-চারজন দেখেছি। আমরা যে ভাড়াটে, কোনোদিন বুঝতে দেয়নি। কেমন কেমন করে অর্ণবের শিক্ষার দায়িত্বটাও নিয়ে নিল দিদি।’
চিত্তরঞ্জন ডান হাতের তালু দিয়ে কপালটা একবার মুছে নিলেন। এই সকালে তাঁর কপাল ঘামার কথা নয়। কিন্তু তাঁর মনে হলো – কপালে ঘাম জমেছে। পাকা চুলগুলোকে কপাল থেকে পেছনে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘এই জন্যই অর্ণবের ইংরেজিটা এত ভালো। অ্যাংলো দিদির হাতে পড়ে ছেলেটার ইংরেজি বেশ সড়গড় হয়েছিল। কিন্তু বেশি ভালো ভাগ্যে সয় না আমাদের। বছরপাঁচেক পরে কোত্থেকে ছেলেটা এলো। সঙ্গে বউ-বাচ্চা, নাতিকে দেখে সব দুঃখ ভুলে গেল মার্গারেটদি। অর্ণবও একজন খেলার সঙ্গী পেয়ে খুব খুশি। যদিও দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশ।’
‘দিনদশেক পরে দিদি খবরটা দিলো আমাদের। বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। ছেলে বলছে – তার সঙ্গে বরিশাল চলে যেতে। ছেলে-নাতি-বউ নিয়ে ওখানে ভালোই কাটবে তার। খবরটা বজ্রাঘাতের মতো মনে হলো। প্রথমে নিজেদের স্বার্থের কথাই ভেবেছি। এই উঠোন, ওই আমগাছটি, উঠোনকোণের শিউটি গাছটি, পুরনো দিনের বাংলোটাইপের বাড়িটা কখন যে আমাকে এ-রকম করে দখল করে নিয়েছে, টের পাইনি। যা-হোক, আকারে-ইঙ্গিতে জিজ্ঞেসও করেছিলাম – আমাদের ছেড়ে, স্বামী-সন্তানের স্মৃতি জড়ানো এই বাড়িটি ছেড়ে বরিশালে শান্তি পাবে কিনা মার্গারেটদি। দিদিকে তখন নাতি পেয়ে বসেছে। দিদি বলেছিল – নাতিটিকে নিয়ে দিন কেটে যাবে আমার। তাছাড়া ছেলে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ছেলে আর বউ মিলে সুখেই রাখবে আমাকে। সেই সুখ শেষ পর্যন্ত দিদির কপালে জোটেনি।’ আস্তে আস্তে বললেন সুপ্রভা।
চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘বাড়িটা বিক্রি করার আগে দিদি আমাকে কেনার জন্য অফার দিয়েছিল। তখন আমার টাকা কোথায়? চোখের সামনে বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। টাকাটুকা গুছিয়ে মার্গারেট দিদিকে নিয়ে এক সকালে চলে গেল ছেলেটি। নতুন বাড়িওয়ালা পরের ছয় মাস থাকতে দিয়েছিল আমাদের।’ সুপ্রভা বললেন, ‘ওই বাড়ির ঠিকানাতেই তো দিদি চিঠিটি লিখেছিল মাসচারেক পরে। কী নিদারুণ কষ্টের কথাই না লিখেছিল। বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে উচ্ছন্নের জীবন শুরু করেছিল ছেলে আর ছেলের বউ। মদ-ভাঙ আর ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকত। ছোট্ট একটি ঘরে থাকতে দিয়েছিল দিদিকে। নাতিটাকেও মিশতে দিত না। চিঠিটা যেন চোখের জলে লেখা। চিঠিটা বহুবার পড়েছি। পড়তে পড়তে কতবার যে কেঁদেছি।
‘এরপর তো কত বাড়ি বদলালাম। কোনো বাড়ির কথা তেমন করে মনে পড়ে না। অভাগী মার্গারেট দিদির জন্যই বোধহয় বাড়িটার স্মৃতি মুছে যায়নি মন থেকে। চলে যাওয়ার দিন অর্ণব কেঁদেছিল খুব। এরপর অর্ণব যখন কলেজ ডিঙিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়তে গেল, একদিন বলেছিল – ইংরেজিটা ভালো করে না জানলে ডাক্তারি পড়া কঠিন। ছোটবেলায় মার্গারেট আন্টির কাছে ইংরেজিটা শিখেছিলাম বলে এখন আমার বেগ পেতে হচ্ছে না।’ চিত্তরঞ্জনবাবুর চোখে-মুখে আনন্দটা ফুটে উঠল।
নাশতা-চায়ের প্লেট-কাপ গোছাতে গোছাতে সুপ্রভা বললেন, ‘সকালে তো তুমিই পৌঁছে দিতে স্কুলে। সেন্ট প্লাসিডস্ স্কুলটা আটটায় শুরু হতো। অর্ণবকে হাত-মুখ ধুইয়ে, বাথরুম করিয়ে, স্কুল ড্রেস পরিয়ে ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে উঠতে পারতাম না আমি। স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত। একদিন ওকে পৌঁছানোর দায়িত্ব তুমি নিলে। নয়টায় অফিস তোমার, ছেলের জন্য দেড় ঘণ্টা আগে বের হওয়া শুরু করলে তুমি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা – কোনোকালেই এর ব্যতিক্রম হয়নি।’
চিত্তরঞ্জনবাবু বললেন, ‘প্লেটটে্লট গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছ? বসো বসো। তো একদিন হলো কি, ক্লাস ফাইভে পড়ে বোধহয় তখন, আমার আগে আগে হাঁটছে সে। ছোট রাস্তা। ছেলেদের আর মেয়েদের দুটো স্কুল পাশাপাশি। দুটোই আটটায় শুরু। পড়ুয়া আর সাধারণ মানুষে ভিড় লেগেছিল রাস্তায়। কোত্থেকে এক বাবুর্চি এসে অর্ণবকে দিল ধাক্কা, ও পড়ে গেল রাস্তায়। ছোটবেলা থেকে সে তো একটু শক্ত ধাঁচের। কাঁদল না, কিন্তু ব্যথাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি দিশে হারালাম। কাঁধে খন্তা-চামচওয়ালা লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। রাস্তার ওপর ঠেসেই ধরেছিলাম তাকে। পথের মানুষ ছাড়িয়ে না নিলে বড় ধরনের কোনো একটা কিছু হয়ে যেত। এখন ভাবি – কেন করেছিলাম ওইদিন এরকম বেমক্কা কাজটি। কোথায় বাবুর্চি আর কোথায় একজন অফিসার! ভুলে গিয়েছিলাম সব।’
‘তুমি যে অর্ণবকে খুব বেশি ভালোবাসো। তোমার অফিসের সুকান্তদা একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, যখন তোমার কাছে অর্ণব হওয়ার খবরটা পৌঁছেছিল, সমস্ত প্রটোকল ভুলে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিলে তুমি।’
চিত্তরঞ্জনবাবু একটু লজ্জা পেলেন যেন। মাথা নিচু করলেন। বললেন, ‘আমি তখন অফিসের বেশ বড় অফিসার। সব ভুলে গিয়েছিলাম। বড় সাহেব খবর পেয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভয়ে ভয়ে তাঁর ঘরে ঢুকেছিলাম। ড্রয়ার খুলে একটা খাম বাড়িয়ে ধরেছিলেন আমার দিকে, বলেছিলেন – আপনার ছেলের জন্য। গোটা অফিসকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন সেদিন বড় সাহেব।’
সুপ্রভা বললেন, ‘ও যখন সেকেন্ড ইয়ারে, তুমি রিটায়ারমেন্টে এলে।’
‘তার আগে তেতলা বাড়িটা করলাম।’
চিন্তান্বিত গলায় সুপ্রভা বললেন, ‘ভাগ্যিস বাড়িটা করেছিলে। মাথা গোঁজার ঠাঁই তো ছিল না আমাদের। বাড়ি ভাড়া দিয়েই তো সংসারটা চলছে এখন। আমার ছেলে কিন্তু তোমার খরচ করায়নি তেমন।’
‘ঠিক বলেছ তুমি। ছেলে তোমার মেধাবান। ডাক্তারি পড়া শেষ করতে তেমন খরচ হয়নি আমার।’
‘শুধু গাড়ি ভাড়াটা দিতে হয়েছিল।’ সুপ্রভা বললেন।
‘যাতায়াতের ব্যাপারে ওর আবার রাজকীয় চাল। হোস্টেলে থাকতে দিইনি তাকে। হোস্টেলের যা পরিবেশ। হইহল্লা, গাঁজা, ইয়াবা। ওই একটি জায়গায় তোমার ছেলে আমার কথা শুনেছে। হোস্টেলে ওঠার জন্য পীড়াপীড়ি করেনি।’ বললেন চিত্তরঞ্জনবাবু।
সুপ্রভা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের এই বাড়িটা থেকে মেডিকেল কলেজ কতইবা দূরে! রিকশায় যাবে না ছেলে, ট্যাক্সিতে যাবে। তাই প্রতিদিন তিনশো টাকা গুনতে হতো আমাকে।’
‘এখন তো ইন্টার্নি করছে। এখনো কি যাতায়াত ভাড়া নেয় তোমার কাছ থেকে?’
‘নেয় না আবার!’
চিত্তরঞ্জনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘থাক, থাক। যত দিন নিতে চায় নিক। ওই একটি মাত্র ছেলেই তো আমাদের।’
সুপ্রভা এবার ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন, ‘সব তো ঠিক আছে। ডাক্তারি পড়া শেষ করে আনল, এখনো যাওয়ার আগে রুমালটা, ঘড়িটা, মোবাইলটা সামনে এগিয়ে ধরতে হয়। না হলে কোনো না কোনো একটা ফেলে রেখে চলে যায়।
‘এসব করতে ভালো লাগে না তোমার?’ মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করেন চিত্তরঞ্জনবাবু।
সুপ্রভা বললেন, ‘ভালো লাগে না আবার! ও-ই তো ছেলে আমাদের। তোমাকে যা বলতে চেয়েছিলাম – কীরকম যেন একটা পরিবর্তন দেখছি তার মধ্যে ইদানীং। কেমন যেন রূঢ়রুক্ষ মেজাজ, কীরকম যেন কঠিন চোখে তাকিয়ে কথা বলে আমার সঙ্গে।’
‘তাই নাকি?’ চিত্তরঞ্জনবাবু জানতে চান।
বেদনাহত কণ্ঠে সুপ্রভা বললেন, ‘গত পরশুর সকালের ঘটনাটি শোনো না। সকাল আটটায় বেরিয়ে যাওয়ার কথা। সার্জারি ডিপার্টমেন্টে নাকি তার ডিউটি। দেরিতে ঘুম থেকে উঠল। রেডি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। অমনিতেই মেজাজ খারাপ করল সে। তড়িঘড়ি করে কেকটা মুখে পুরল, কফির কাপে দু-এক চুমুক দিলো। দরজার বাইরে গিয়ে জুতার স্ট্যান্ডে জুতা জোড়া খুঁজে পেল না। ঝাঁঝিয়ে উঠল – আমার জুতা গেল কোথায়? এখান থেকে জুতা সরাও কেন? তার বলার ভঙ্গি আমার ভেতরটা জ্বালিয়ে দিল। পরে জুতাটা পাওয়া গেল তার ব্যাগে, কাগজ জড়ানো। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আর জুতো পরেনি, স্যান্ডেল পরেই বাড়ি ফিরেছিল। বলো, আমার কী দোষ!’
‘আমি কোথায় ছিলাম তখন?’
‘তুমি মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলে।’
চিত্তরঞ্জনবাবু ম্লান মুখে মাথানত করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘দেখো এখন আমার তেষট্টি, তোমার ছাপ্পান্ন। আমরা বাইরে-টাইরে তেমন যাই না। মানুষের সঙ্গে যে কথা বলব, সেটা হয়ে ওঠে না আমাদের। আমাদের যত কথা ওই অর্ণবের সঙ্গেই। ওকে ঘিরেই তো আমাদের সব বাৎসল্য। সকালে বেরিয়ে যায় সে, রাতে ফেরে। তার সঙ্গে সুখ-দুঃখের দু-চারটি কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকি আমি। আগে চাকরি করতাম। নানা মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় দিন কেটে যেত। এখন তো আর সে সুযোগ নেই। তুমি গোটা দিন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত থাকো। আমি এ-ঘর, ও-ঘর ঘুরি, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু কাঁহাতক। একাকিত্ব পেয়ে বসে আমাকে। আমি ছটফট করতে থাকি। সন্ধ্যায় তুমি বসো টিভি নিয়ে। একের পর এক সিরিয়ালে মশগুল হও তুমি। ওগুলোতে আমার রুচি লাগে না। বই নিয়ে বসি। কিন্তু কতক্ষণ পড়া যায় বলো।’ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। তারপর বললেন, ‘অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি গভীর আগ্রহ নিয়ে। ও আসে। স্নানঘরে ঢোকে। এগারোটা বেজে যায়। আমারও ঝিমুনি আসে। আমি শোবার ঘরে যাই।’
সুপ্রভা বললেন, ‘কেন মাঝেমধ্যে তো দুই বাপ-বেটাকে কথা বলতে দেখি।’
‘দেখো বটে, কিন্তু আগের অর্ণবকে খুঁজে পাই না। বেশিরভাগ প্রশ্ন করি আমি, হুঁ-হ্যাঁ করে সে উত্তর দেয়। মোবাইলই টিপতে থাকে সারাক্ষণ। আমি উদ্যম হারাই। চুপচাপ বসে থাকি তার পাশে।’ চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন।
‘ও তো এ-রকম ছিল না। দুজনে ড্রইংরুমে বসে জম্পেশ আড্ডা দিতে। মাঝেমধ্যে ওর হো হো হাসির শব্দে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসতাম আমি।’
‘সেই অর্ণব কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথা বলতে তার যত কষ্ট। কষ্ট বলছি কেন, বিরক্তি বলাই ভালো। কোনো একটা জিনিস জানতে চাইলে একবারের ওপর দু-বার বলতে চায় না। সেদিন জিজ্ঞেস করলাম – পুরুষের তুলনায় নারীদের মস্তিষ্ক নাকি ছোট? তোমাদের ডাক্তারি বিদ্যা কী বলে? প্রথমে সে আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করল না। দ্বিতীয়বারে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল। অথচ, এমন দিনও গেছে – লবকুশ রাবণের ছেলে না রামের ছেলে, সীতার প্রতি রামের গভীর সন্দেহ ছিল, না বিশ্বাস ছিল – এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমি যতই বলেছি – রামের ঔরসেই জন্ম লবকুশের, অর্ণব যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে আমায় – তাই যদি হয়, তাহলে চৌদ্দ বছরের বনবাসকালীন সীতার বাচ্চা হলো না কেন, সীতা গর্ভবতী হলো লঙ্কার কারাবাস শেষ করে। রাবণ তো ভীষণ নারীলোলুপ ছিল। বাল্মীকি রামায়ণেই আছে – সীতাকে হরণ করে প্রথম দিন নিজ রাজপ্রাসাদেই নিয়ে গিয়েছিল রাবণ, রাজপ্রাসাদ থেকে সবাইকে বের করে দিয়েছিল। তারপর একান্তে এক রাত কাটিয়েছিল সীতার সঙ্গে।’
সুপ্রভা বিচলিত কণ্ঠে বললেন, ‘এসব কী বলছ তুমি?’
হাসতে হাসতে চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘তোমার ছেলে ঠিকই বলেছে। এক রাত পর অশোকবনে স্থানান্তর করেছিল সীতাকে। এছাড়া আরেকটা ব্যাপার ভাববার আছে। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ যখন বনবাসে যাচ্ছেন, তখন ওঁরা যুবক-যুবতী। পঞ্চবটী বনে পর্ণকুটিরের অভ্যন্তরে থাকতেন রাম-সীতা আর লক্ষ্মণ বাইরে দাঁড়িয়ে বসে পাহারা দিতেন। দিনের বেলায় যা-ই হোক, রাতের বেলায় তো বটেই। অশোকবনে সীতার অল্পসময় কেটেছে, বেশিরভাগ সময় কেটেছে তো পঞ্চবটীবনে, রামসংসর্গে। তো ওই সময় কোনো বাচ্চা হলো না সীতার, বাচ্চা হলো লঙ্কা থেকে ফিরে। চিন্তার বিষয় না ব্যাপারটা।’
‘ঠাকুর ঠাকুর। এসব কী বলছ তুমি? বলছিলে তো ছেলের কথা।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সুপ্রভা।
‘বিষয় থেকে একটু দূরে চলে এলাম। বলছিলাম – তোমার ছেলের সঙ্গ দেওয়ার কথা। বড় নিঃসঙ্গতায় ভুগছি আমি। কথা বলার কাউকে পাই না।’ বললেন চিত্তরঞ্জন।
‘শুনেছি, মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে তার আশপাশে কেউ থাকে না। ঘরভর্তি সবাই আছে অথচ কেউ নেই। কেউ নেই মানে কথা বলার কেউ নেই। সবাই এড়িয়ে চলে।’ সুপ্রভা বললেন।
চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘যেমন এড়িয়ে চলছে অর্ণব।’
‘এখনো আমাদের কত বয়স বাকি! তেমন পুরোপুরি বুড়ো হইনি আমরা। চলতে-ফিরতে পারি। আমি রান্নাবান্না করি, তুমি দিব্যি হেঁটে চলে বাজার-টাজার করে আনো। তো এই বয়সেই এরকম! বার্ধক্যে কী হবে কে জানে? তুমি যদি আমার আগে যাও?’
‘আমি আগে গেলে তোমার তেমন অসুবিধা হবে না। ছেলের সংসারে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। তোমাদের সহিষ্ণুতা বেশি। অবহেলা সয়ে নিতে পারো তোমরা। আমাকে তো চল্লিশ বছর ধরে দেখছ তুমি। আর সব সইতে পারি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়। কিন্তু আমার আগে যদি তুমি চলে যাও, কী হবে আমার কে জানে! সন্ন্যাসী হয়ে মঠে-মন্দিরে আশ্রয় নিতে হয় কিনা, বুঝতে পারছি না।’
‘তুমি ওভাবে ভাবছ কেন? তোমার তো টাকা থাকবে, এই বাড়িটা থাকবে। একটা গতি হয়ে যাবে।’ বলেই হঠাৎ ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন সুপ্রভা। ‘ঠাকুর, ঠাকুর। এসব কী বলছি আমি। অর্ণব কখনো ওরকম হবে না। বুড়ো বয়সে আমাদের অবহেলা করবে না কখনো। ও তো আমার স্বপ্নসন্তান। দুজন সন্তান মারা যাওয়ার পরে সে আমার কোলজুড়ে এসেছে। জ্বরে-অসুখে কত রাত জেগেছি আমরা। তা কি কখনো ভোলার! আর তুমি যে তার প্রতি কী গভীর স্নেহ পোষণ করো, তা কি আমি জানি না। ওই যেদিন সে স্কুল থেকে রাত করে ফিরল, সেইদিন তো তুমি পাগলই হয়ে গিয়েছিলে প্রায়।’
চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘নাইনে পড়ত সে। স্কুল ছুটির পর সেলিম স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ত, ফিজিক্স। ছুটি হয়ে যেত পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। সেদিন সাতটা বেজে যাওয়ার পরও ফিরল না। শ্রাবণ মাসই ছিল বোধহয়। কী অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল, বজ্রপাত হচ্ছিল ভীষণ। ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে গেলাম আমি। স্কুলের প্রতিটি আনাচ-কানাচ তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, সেলিম স্যারের বাসায় গেলাম। কোথাও পেলাম না। শেষ পর্যন্ত এক বন্ধুর বাসায় খুঁজে পেয়েছিলাম তাকে। দিব্যি নুড্লস খাচ্ছিল।’
‘ফিরলে যখন, তোমাকে চেনা যাচ্ছিল না। জলে-কাদায় একাকার। টপটপ করে জল পড়ছিল গা থেকে। ছেলের মাথায় ছাতা ধরে নিজে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরেছিলে। ওইদিন একটা কথা বলেছিলে অর্ণব সম্পর্কে।’
‘কী?’ চকিতে জিজ্ঞেস করলেন চিত্তরঞ্জনবাবু।
মাথা নিচু করে সুপ্রভা বললেন, ‘দেখে নিও সুপ্রভা, তোমার ছেলে কোনোদিন দায়িত্বশীল হবে না।’
‘কী জানি বাবা, এতদিনের কথা, মনে থাকার কথা নয়। তবে তোমার কথা শুনে ভাবছি – আমার ওইদিনের কথা সত্যি হতে যাচ্ছে কিনা।’
সুপ্রভা এবার ধীরে ধীরে বললেন, ‘ওর দিকটাও আমাদের একবার ভাবা দরকার। ইন্টার্নি করতে গিয়ে কতজনের কত কথা শুনতে হয়। শুনেছি আজকাল রোগীরাও নাকি হম্বিতম্বি করে, গায়েও নাকি হাত তোলে ডাক্তারদের। সবসময় তার মনমেজাজ তো ঠিক থাকার কথা নয়।’
‘আমি ভাবছি অন্য। কোনো ব্যক্তিগত ক্রাইসিস হলো না তো তার? এমন ক্রাইসিস, যা আমাদের বলতে পারছে না।’
‘আমাকে না বলুক, তোমার সঙ্গে তো বন্ধুর সম্পর্ক তার।’
‘ছিল। একদা বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। এখন নাই। বেশ দূরে দূরেই থাকে সে। অন্যমনস্ক। মোবাইলে মশগুল।’ তারপর একটু থামলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। বললেন, ‘অর্ণবের কাছে আমাদের বৈষয়িক কোনো চাওয়ার বা পাওয়ার নেই। শুধু ভালোবাসাই পেতে চাই আমরা তার কাছ থেকে। তাও দিতে তার যেন ভীষণ অনীহা। অথচ একদা এক রাজপুত্র তার যৌবন ধার দিয়েছিল তার বুড়ো বাপকে।’
‘যৌবন ধার দিয়েছিল!’ বিস্মিত সুপ্রভা বললেন।
চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘সত্যি, এক দুই বছরের জন্য নয়, সহস্র বছরের জন্য পুরু তার পিতা যযাতিকে যৌবন ধার দিয়েছিল। মহাভারতেরই কাহিনি। যযাতি চন্দ্রবংশীয় রাজা। দুই স্ত্রী তাঁর – দেবযানী আর শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর ঘরে দুই পুত্র। শর্মিষ্ঠার তিন ছেলে – দ্রুহু্য, অনু ও পুরু। শুক্রাচার্যের অভিশাপে একদা যযাতি জরাগ্রস্ত হলেন। কিন্তু তার ভোগাকাঙ্ক্ষা তখনো শেষ হয়নি। পুত্রদের কাছে তিনি সহস্র বছরের জন্য যৌবন ধার চাইলেন। চার পুত্র রাজি হলো না। কনিষ্ঠপুত্র পুরু কিন্তু রাজি হয়ে গেল। পিতাকে সহস্র বছরের জন্য নিজের যৌবন ধার দিয়ে পিতার জরাকে বরণ করে নিয়েছিল পুরু।’
‘সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। যৌবন বদলাবদলির উপায় নেই। মানুষও আজকাল সহস্র বছর বাঁচে না। কিন্তু ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আনুগত্য – এসব তো বদলাবদলি করা যায়?’ বললেন সুপ্রভা।
চিত্তরঞ্জনবাবু করুণ মুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার ছেলের কাছে আমি, আমরা সহস্র বছরের যৌবন চাই না। আমরা চাই তার সঙ্গ, সুস্মিত কথা। চবিবশটা ঘণ্টার অন্তত কিছুটা সে আমাদের দিক। এই তো আমাদের চাওয়ার, তার কাছে।’
সুপ্রভা বললেন, ‘তুমি ভেঙে পড়ো না। একদিন না একদিন আমরা আগের অর্ণবকে ফিরে পাব।’