-আমি আমার বাচ্চাকে নিজের হাতে খুন করেছি। সবাই আমাকে ডাইনী মা ডাকে। মেসেজটা দেখে আমি থেমে গেলাম। মাস খানিক আগে একটা ফিল্টার মেসেজ পেয়েছিলাম।
-তৃষা দি, তোমার লেখা আমি পড়ি, আমার জীবনের গল্পটা একটু লিখে দিবে? আমি অনেক দিন পর দেখি মেসেজটা। আমি রিপ্লে করেছিলাম,
-আমি তো এখনো অত বড় লেখিকা হয় নি যে কারো জীবনের গল্প আমার লেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারবো। আমি অনুভব না করলে লিখবো কিভাবে? তারপর অনেক দিন সে কোন উত্তর দেয় নি। সাপ্তাহ খানিক আগে আবার রিপ্লে দিলো।
-তোমার না একটা মেয়ে আছে? ভীষণ আদুরে, খুব ভালোবাস তাই না মেয়েকে?
– হুম। অবশ্যই।
-তাহলে তুমি অনুভব করতে পারবে।
আমি আমার মেয়ে লাবন্যকে তখন নুডুস খাওয়াচ্ছি। ভীষণ দুষ্ট। সারাঘরে দৌড়ায়। ধরতে গেলে এক যুদ্ধ খাওয়াতে গেলে আরেক। কিল দুইটা না দিলে মুখেই খুলে না। মেসেঞ্জারে টুং টুং শব্দ হচ্ছে অনেক গুলো। ভাবলাম মেয়েটা ছোট ছোট মেসেজ পাঠাচ্ছে।
কিছুক্ষন পর অন করলাম। একটা তিন বছরের মেয়ে ছবি। লাল পরীর ড্রেসে। ছোট বেলার ছবি। হামাগুড়ির ভিডিও। হাটার ভিডিও। মাম্মা মাম্মা বলা একটা ভিডিও আছে। সব মোট ৩৪ টা ছবি ভিডিও দিলো। সব দেখার কি টাইম আছে? স্কিপ করে মেসেজ দিচ্ছিলাম। আদুরে মেয়ে তোমার। কিন্তু লাস্ট ছবি টা দেখে বুক কেঁপে উঠল আমার। মোবাইল পড়ে গেলো হাত থেকে। সাদা কাফন পড়ানো চোখ বন্ধ , এমন ছবি যেকোন মায়ের কলিজা ঠান্ডা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি অনেকক্ষন রিপ্লে করলাম না। সে বলল-
-দেখেছো দিদি, কি আদুরে মেয়ে না আমার?
-হুম, কিন্তু, মারা গেছে-? আমি আর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন সে রিপ্লে করল।
-আমি আমার বাচ্চাটাকে নিজের হাতে খুন করেছি। সবাই আমাকে ডাইনী মা ডাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কি বলছে। এত আদর করছে দেখালো ভিডিও৷ এত আদরের বাচ্চাকে, তাও নিজের হাতে? আমি রিপ্লে দিলাম,
-মানে? তখন সে ছোট ছোট মেসেজে বলতে লাগলো এলোমেলো ভাবে। আমি সাজিয়ে নিয়েছি।
– আমি ছিলাম ভীষণ রাগী মেয়ে। মা বাবার ভীষণ আদুরে ছিলাম। আমার স্বামী আতিক(ছদ্মনাম)। সে ভুলিয়ে আমায় ঠান্ডা রাখত। বিয়ের পর প্রথমে বেবি নিলাম না। পড়া লেখা শেষে চার বছর পর বেবি নিলাম। আসলে বিয়ের পর একটা বেবি থাকাটা খুব ফিল হয়। সবার কথা তো ছিলো। মাঝেমধ্যে নিজে কান্না করতাম। কখন হবে আমার সোনার একটা পুতুল? আমি তাকে ইচ্ছেমতো সাজাবো৷
খোদা আমার কথা শুনেছিল৷ আমাকে একটা পুতুল দেওয়া হলো। মারিয়া। ভীষণ সুন্দর আমার মেয়েটা। কিন্তু আমার বেবি ছিলো কলিক বেবী। সারারাত কান্না করত। তাকে নিয়ে হাটতে হতো সারারাত। সকালের দিকে একটু ঘুমাতাম। শশুড়বাড়ি থাকতাম তারা যত ভালো হোক দশটা অবধি ঘুমানো তো পসিবল না। আমি পাঁচ টার দিকে ঘুমাতাম আট টায় উঠে যেতাম। আমি উঠার আগেই প্রায় আতিক অফিস চলে যেতো ওর অফিস ছিলো দূরে। সারারাতের ক্লান্তি, দিনের বেলা কাজ কর্ম,বাচ্চার কান্না, ময়লা কাথা, খেতে বসলে খেতে না পারা আধা পেটে দুধ খাওয়াতে গিয়ে আর খাওয়াই হতো না৷ যত বড় হচ্ছিল তত চিন্তা আজ এইটা তো কাল এইটা। তার স্বাস্থ্য বাড়ে না। তারপর এলো খাবারের যুদ্ধ।
এইসব কিছুর মধ্যে একসময় খেয়াল করলাম আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আতিকের সাথে পাশাপাশি বসা হয় নি অনেক দিন। প্রিয় শাড়িটা ভাজ নষ্ট হয় নি বহুকাল। ধুলো জমছিলো গয়না গুলোতে, পেটে মেদ জমে ভারী করছিলো শরীর, চোখের নিচের কালি গুলো যেন অযত্নের সাক্ষী, মাথা লাগানো হয় না চিরুনি প্রতিদিন। কবিতা পড়ার শখ ছিলো ভীষণ। সবেতে পড়ছিলো ধুলো। আমি কাউকে কিছু বলতে পারতাম সবাই বলত এইটা স্বাভাবিক সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর পারছিলাম না। নিজেকে ভীষণ হীন করে ফেলেছি মনে হচ্ছিল। স্বামীকে যেন পর লাগে। মা বাবার যেকোন কথায় যেন আমাকেই বলা হতো মনে হতো।
মারিয়া ততদিনে ভীষণ দুষ্ট। টিভি মোবাইল না দেখালে ভাত খেতে না। নিয়ম করে দুধ ডিম কলা ভাত সব খাওয়াত কিছুতে শরীর ফিরতো না। খাবার নিলে ঘন্টার পর ঘন্টা দৌড়াতে হতো। এতে আমার মেজাজ আরো খিটখিটে হতে যেতো। অল্প কিছুতেই মারধর করতাম বাচ্চাকে। কেউ কিছু বললে বাচ্চা মেরে রাগ দেখাতাম এতে ওরা আর বলত না। আমার মনে হতো উচিত হয়ছে। কিন্তু এতে করে ভয় জমছিলো মারিয়ার মনে। এত মারতাম তাও আমার বুকে এসেই কাঁদতো। সারাক্ষন পিছনে ঘুরতো। কোন কাজ করতে পারতাম না। নিজের জন্য কোন টাইম ছিলো না। সব কিছুর পর ও মেয়ের হাসিতে সব ভুলে যেতাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মনে একটা আত্মগ্লানি রয়েই যেতো। পরোক্ষ ভাবে তা মারিয়ার উপর ফেলতাম। একদিন মেয়ে কি হয়েছে জানি না। কোন কাজ হয় নি আর মেয়ে কোল থেকেই নামে না। এইদিকে ওর খাবার টাইম হয়ে গেছে। খাবারের বাটি নিতেই মারিয়ার কান্না শুরু। খুব রাগ উঠে। দিই পিঠে দুইটা মাইর। স্বাভাবিক, প্রায় দিতাম। এরপর ঢেলেঢুলে খাওয়াতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর সে আবার বমি করতে চাইলে আমি আবার মাইর দিই।
মেয়ে কান্না করেই যাচ্ছিল। কোন মতে আর খাওয়ার মুখে তুলছিলো না। আমি রাগ করে রান্না ঘরে চলে যাই। রান্না চুলায় দিয়ে অনেকক্ষন পর এসে দেখি মেয়ের কান্না নেই তবে শুয়ে আছে। তখন কেমন যেন মায়া লাগে। গিয়ে মেয়েকে বুকে তুলে নিতেই দেখি সারামুখে রক্তের ছড়াছড়ি। কাপড় চোপড় সব। আমি এত ভয় পাই, কি হয়েছে আমার মেয়েটার? আমি ওকে ডাকি, পানি খাওয়াই, দুধ মুখে দেওয়াই, না কিছুতেই মেয়ে আমার সায় দেয় না।
মা সহ এসে অনেক চেষ্টা করি। না কিছুতে চোখ খুলে না আমার ছোট্ট পাখিটা। হাতের কাছে যা ছিলো তা নিয়ে ছুটে যাই হাসপাতালে। তখনো বেঁচে ছিলো আমার সোনাটা, তবে বাঁচবে না আর বেশিক্ষন। খাওয়াতে গিয়ে কাটা আটকে গিয়েছিলো গলায় আড়াআড়িতে। বমি করালে হয়ত বের হয়ে যেতো। আমি না বুঝে আবার খাওয়ালাম। মাইর দিলাম। কান্না করাতে ছিড়ে গেলো নরম গলা। আমি দেখলাম ও না। এক বেলা না খেলে কি হতো।বেঁচে তো থাকতো।
এইটুকু লিখতে গিয়ে আমার হাত কাপঁছে।চোখের কোণে জল জমছে। বুকটাতে কেউ পাথর চাপা দিলো মনে হচ্ছে। তখন পড়ার পর আমি আমার মেয়েটার দিকে তাকালাম।এতক্ষন চোখের সামনে মারিয়াতে নিজের মেয়ের মুখ খানা ভাসছিল। এইবার আতঁকে উঠলাম। কি ভাবছি? না না, আমার মেয়ে। চেপে ধরলাম বুকে। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। মেয়ে আমার মাথা নেড়ে যাচ্ছে সে নুডুস আর খাবে না। আমি তাকিয়ে রইলাম। এক বেলা না খেলে কি হতো মারিয়ার? বেঁচে তো থাকতো। তখন সে আবার মেসেজ দিলো,
-কি ভাবছো? আমি ডাইনী না?
– না। আমিও মা। আমিও মাইর দিই মেয়েকে খাওয়া নিয়ে। তোমার ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো। তোমার দোষ ছিলো না।
-তুমি ভাবছো। তারা ভাবে নি। তারা আমাকে খুনী বানালো। সেদিন ফেইসবুকে নিউস ছড়াল মায়ের হাতে খুন হলো নিষ্পাপ মারিয়া।
আমি চারদিন কিছুই মুখে দিই নি তখন। বসে ছিলাম হসপিটালে। চারদিন পর মারিয়াকে দিলো। না তখন ও আর মারিয়া ছিলো না।লাশ শব্দটায় ডাকা হচ্ছিলো তখন। আমার ছুঁয়ে দেখতে দিলো না ওরা আমার মেয়েকে। রাতের পর রাত জেগে কোলে নিয়ে হাটতে থাকা সন্তানকে ছুঁয়ে দেখার অধিকার আমার ছিলো না। আমি ছুঁয়ে দেখতে গেলে আমাকে বলা হয়েছিলো,
-ডাইনী কোথেকার, কুকুর বেড়াল ও সন্তান আগলে রাখে তুই তো তার চেয়ে খারাপ। মেরে ফেললি? আমি বড় করি নি বাচ্চা? কি হতো এক বেলা না খেলে? আমিও ভাবি কি হতো? আমি তো চারদিন না খেয়ে আছি, কি হয়েছে আমার? মরে তো যাই নি? আমি সে রাত ঘুমাতে পারি নি। বার বার মারিয়াকে ভাবতে গিয়ে নিজের মেয়ের মুখ খানা ভাসছে। আমিও তো এই মাহিমার মতো ভাবি সব শেষ হারিয়ে ফেলেছি সব। কি ছিলাম কি হয়ে গেছি। আমার মতো কত মেয়েই তো ভাবে এমন। কিন্তু যারা একটা সন্তান পায় না তারা তো এই কি থেকে কি হয়ে যাওয়া টাই খুঁজছে। পরের দিন আবার নক দিলাম,
-তুমি কেমন আছো এখন?
-আমি ছয় মাস রিহেভে ছিলাম। খেয়ে দেয়ে ঘুমাতাম শুধু। কোন কাজ ছিলো না। কারো জন্য রাত জাগতে হতো না।
ছুটতে হতো না সারাদিন। বাকা কোমর নিয়ে ঘুমাতে হতো না। চাইলে সাজতে পারতাম। যা ইচ্ছে তা করতে পারতাম। কিন্তু কিছুই করতে পারতাম। চোখের সামনে মেয়েটা হাসতো। মাম্মাম করে ডাকতো। তারপর ভাসতো রক্তমাখা সে মুখ। আমি জেগে থাকলে চিৎকার করে কাঁদতাম। তাই কড়া ঘুমের ওষুধে ঘুম পাড়ানো হতো আমাকে দিনের পর দিন না খেয়ে দেয়ে৷ কত দিন গেলো জানি না। একদিন আতিক এলো। সাথে কিছু খাবার। আমি ওসব হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোন প্রশ্ন ছিলো না। ওকে দেখতে লাগলাম। কেমন ভেঙ্গে পড়েছে শরীর চেহেরাটা দেখে কেঁপে উঠলাম। ও বলল-
-মারিয়ার জন্য বাসায় মিলাদ রেখেছিলাম তার খাবার – বাকিটা বলতে পারছে না ও। আমিও পারছিলাম না কিছু বলতে।মনে হচ্ছে আমার গলায় কেউ মোটা দড়ি বেঁধে দুইদিক দিয়ে টানছে। আমার গলা দিয়ে নামবে এই-? আমি টিফিনটা ছুড়ে মারলাম ওর দিকে। মাথায় লেগেছে। সারাগায়ে খাবারের ছড়াছড়ি। আতিক এইবার ভয়ংকর রেগে গেলো।
-আমাকেও মারতে চাও? পাগল হয়েছো? রাক্ষসী। যাও পড়ে মরো এইখানে।
আতিক আর কখনো আসে নি। আমাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হতো। মেয়ের খেলনা জামা জুতা এমন কি ভাঙ্গা পুতুল গুলো আগলে ধরে বসে থাকতাম সারাদিন। মা বাবা চেষ্টা করতো আমাকে স্বাভাবিক করতে। যা পছন্দ করতাম তা করাতে। এখন তো অনেক সময় আমার। পারতাম কোথায় বলো? মেয়ের সব কিছু মুছে দেওয়া হলো। লুকিয়ে রাখা হয় সব খেলনা। কিন্তু মায়ের মন থেকে কি কিছু মুছা যাই? চোখ বন্ধ করলেই তো সে একদিনের পিটপিট করা চোখ, চামড়া উঠা হাত, সব ভাসতো। আমার আবার নিশ্বাস আটকে যাচ্ছিলো। আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ও আবার বলল-
-তৃষা দি, আমি তোমাকে এইসব বলছি কারণ আমি চাই তুমি আরো অনেক কে জানাও। কেন আমাদের মধ্যে এত হতাশা? সন্তান তো আমাদের। সময় ও আমাদের। আমরা চাইলে তো সময় বের করে নিজের শখ গুলো করতে পারি। এতে তো বাচ্চাদের কোন হাত থাকে না। কেন মনে মনে এত গ্লানি পুষি। সব তো একসময় ঠিক হয়ে যাবে। যখন বড় হবে তখন তো কাছেই পাবো না। এই সময়টা না হয় নিজের করে সাজিয়ে নিই নিজের সন্তানের শৈশব।
সারাজীবন একটা সন্তানের আশায় প্রার্থনায় হাত তোলা হাত গুলো চিন্তা করলে তো বাচ্চার গায়ে আর হাত উঠে না।
সারাদিন ব্যস্ততাকে আঁকড়ে ধরে গ্লানি না পুষে আমার জায়গায় নিজেকে একবার ভেবে দেখুক না। কেমন কষ্ট এই ব্যস্ততা হীন দিন আমার।
আমি কিছু বলতে পারি না। তবে এই যেন আমার জন্য একটা জোরে থাপ্পড়ের মতো পড়ল গালে। আমি আমার মেয়েকে আর খাবার নিয়ে মারবো বলে ঠিক করি। খেয়াল করলাম সে মুখ থেকে ভাত ফেলে দিয়ে গালে হাত দিয়ে রেখেছে। দুই বছরের মেয়ে বুঝে গেছে এখন আমি গালে থাপ্পড় লাগাবো। আমি কিছুতেই নিজেকে মাহিমার জায়গায় ভাবতে পারছিলাম না। কিন্তু একটা হাসি দিলাম। এতে মেয়ে হি হি করে জোরে হেসে উঠল। আবার ছুটে গেলো টিভির দিকে। কার্টুন দেখে দেখে হাসছে ভীষণ জোরে, গড়িয়ে পড়ছে আমার গায়ে। আমি হেসে আবার খাবার দিলাম ওর দিকে, মেয়েও হাসতে হাসতে টুপ করে মুখে নিয়ে নিলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প