জোনাকীর স্বামী আমাকে ফোন করে বলল, “ভাইয়া আমি এসেছি।” আমি কোনোরকমে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হয়ে গেলাম মোড়ের কাছে। । গাড়ি থেকে একজন ফর্সা ছেলে বেরিয়ে এলো। তার উচ্চতা ছয় ফিটের কাছাকাছি হবে। আমার সাথে হাত মিলিয়ে গাড়ি বিদায় করে দিলো। আমি তাকে নিয়ে সাগরপাড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কাছেই আরব সাগর। আমি প্রায়ই সাগরপাড়ে যাই। আমার পছন্দের একটি জায়গা। সাগরপাড়ের পাথরে বসে মৃদু বাতাসে পানির দোল খাওয়া দেখতে ভালো লাগে। আমি কখনো ভাবিনি জোনাকীর স্বামী আমার সাথে দেখা করতে আসবে। গতকাল খালা ফোন করে বলল, “জোনাকীর স্বামী বাহরাইনে নতুন। তুমিও যেহেতু সেখানে আছো, একটু দেখা করে কথা বলো। তাহলে হয়তো ছেলেটা একটু সাহস পাবে।”
আমি অমত করতে পারিনি। জোনাকীর স্বামী হিসেবে না হোক, একজন বাঙ্গালী ভাই তো। দেশের বাইরে যারা নতুন আসে তারা যত জ্ঞাণীই হোক, কিন্তু বোকা হয়ে যায়। আমারো প্রথম অবস্থায় তেমনটাই হয়েছে। কারো সাথে কথা বলতেও কেমন দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে পড়তাম। সারাক্ষণ মনে হতো কোনো ভুল হলো না তো? এটা তো আমার গ্রাম নয়, এটা বিদেশ। খালার কথার উত্তরে বলেছি, “মায়ের কাছ থেকে আমার নাম্বারটা নিয়ে উনাকে দিয়ে দিয়েন। আমাকে ফোন করা মাত্রই আমি যোগাযোগ করব।”
আমি দেখা করার কথা থাকলেও আজ জোনাকীর স্বামী নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে এলো। জোনাকীর বিয়ে হলো দেড় বছর, আমি এখনো তার স্বামীর নাম জানি না। জানার প্রয়োজনও মনে করিনি কখনো। ছেলেটা আমাকে ভাইয়া বলে সম্মোধন করছে। তার পরিচয়ে সে বলল, তার নাম তৌকির। হাসিমুখেই কথা বলে। বয়সে আমার ছোট হবে বলেই বিশ্বাস। তাদের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। তবে যাতায়াত ছিল আমার খুবই কম। কথার এক পর্যায়ে সে বলল, “শ্রাবণ ভাই, আপনি যদি বলেন আমি জোনাকীকে ছেড়ে দেব। আপনি আবার নতুন করে সংসার সাজাতে পারেন।”
কথাটুকু শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। প্রথম দিনের দেখাতে কেউ এমন কথা বলতে পারে আমার জানা ছিল না। কোনো গল্প ছিনেমায় হয়তো এমনটা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেউ স্ত্রীর প্রেমিকের কাছে গিয়ে বলবে না যে, আপনি আপনার প্রেমিকাকে গ্রহণ করুন। তার মানে জোনাকী তার স্বামীকে আমার ব্যাপারে সব বলে দিয়েছে। ভাবনায় থাকতেই তৌকির বলল, “জোনাকী আমাকে সব বলেছে। আরো বলেছে সে আপনাকে ভুলতে পারবে না। সেটা মেনেই যেন আমি সংসার করি। তাই আমি মনে করি, আপনার জন্য যেহেতু এখনো জোনাকীর ভালোবাসা বিদ্যমান। আপনি তাকে গ্রহন করুন।”
আমি একগাল হেসে মিথ্যে করে বললাম, “আরে তৌকির ভাই আমি তো আর এখন জোনাকীকে ভালোবাসি না। একসময় কিশোর বয়সে ছেলে মেয়েরা প্রেমে পড়ে। কিশোর বয়সের চোখের ভালোলাগা নিয়ে পড়ে থাকলে জীবন চলবে?” বুঝতে পারলাম তৌকির এই বিষয়ে আরো কথা বলতে আগ্রহী। কিন্তু আমি চাই না এই বিষয়ে কথা বলতে। জরুরি কাজ আছে বলে তৌকির’কে গাড়ি ঠিক করে বিদায় নিলাম। বলে দিলাম, বাহরাইনে কোনো সমস্যা হলে যেন আমাকে ফোন করে। আমি আবারো সাগরপাড়ে ছুটে গেলাম। সাগরের ঢেউয়ের মতো আমার ভিতরেও বিশাল ঢেউ। তবে সাগরের ঢেউ গর্জন করে তীরে আছড়ে পড়ে। আমি গর্জন করতে পারি না। কেমন মরা নদীর মতো শান্ত ও নীরব হয়ে গেছি।
আমার মা ও খালারা পাঁচ বোন। জোনাকী সেজু খালার মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা খুব বেশি চঞ্চল। এতটা চঞ্চল সেটা আমি বুঝতে পারি জোনাকী যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। একদিন হুট করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, শ্রাবণ ভাই তুমি কাউকে ভালোবাসো? আমি তখন কেবল ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। প্রেম ভালোবাসা কী সেটা আমাদের বুঝার কথা না। শুক্রবারে বিটিভি’তে একটি করে বাংলা ছায়াছবি দেখাতো। সেখানে ভালোবাসি শব্দটা শোনা হয়েছে অনেকবার। আমরা তখন জানতাম, ভালোবাসি কথাটা খুব খারাপ। লজ্জার কথা। এসব কথা ভালো ছেলে মেয়েরা বলে না। যাদের লজ্জা শরম নেই, বেহায়া, তারা ভারোবাসি বলে।
প্রেম ট্রেমের কথা বলে বেড়ায়। তবে আমরা ভালো লাগাটা খুব করে বুঝতে পারি। কাকে দেখলে ভালো লাগে। কার সাথে খেলতে ভালো লাগে। কার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, এসব। আমি তখন জোনাকীকে বললাম, “হ্যাঁ বাসি। আমি তো তোকেই ভালোবাসি।” এই কথা শুনে জোনাকী লাজুক মুচকি হাসি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। ছোট্ট ঐ চঞ্চল মেয়েটাকে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগত। কিন্তু ঐ যে, ভালোবাসি কথাটা তখন জানতাম লজ্জার কথা। সেটা ভেবেই লজ্জা পেয়ে জোনাকী দৌড়ে চলে গিয়েছিল সেদিন। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই আমি চলে যাই মাদ্রাসায়। বড় খালার বাড়িতে থেকে মাদ্রাসায় যাতায়াত করি। আবার সেই বড় খালার ছোট মেয়েটি আমাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে। মা বড় খালাকে বলল, এখান থেকে স্কুল কাছে।
তাছাড়া আমার পাঁচটি ছেলে থাকলেও মেয়ে নেই। তোর ছোট মেয়েটাকে আমাকে দে। সেই থেকে সুমি থাকে আমাদের বাড়ি আর আমি সুমিদের বাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। কারণ সুমিদের বাড়ি থেকে আবার আমার মাদ্রাসা কাছে। জোনাকী সেই খালাদের বাড়ি মাঝেমধ্যেই যেত। আমি তার চঞ্চলতা দেখতাম। কিন্তু জোনাকী আমার সামনে আসলেই লজ্জায় লাল হয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আমার সাথে কোনো কথা পর্যন্ত বলে না। হয়তো তাকে ভালোবাসি কথা বলাতে সেটা মনের ভিতর গেঁথে নিয়েছে। তাই বলে এতটা লজ্জা পেতে হবে হবে? যে একদম কথাই বলা যাবে না।
এর বছর খানেক পরের কথা। মেয়ে মানুষ নাকি পায়ে বাড়ে। একটু লম্বা হলেই অনেক বড় হয়ে যায়। বড় হবার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশ মনের দিক থেকে আমাদের মনে হয় একটু বড় করে দিলো। তখন অবশ্য বুঝতে শিখেছি সবার একটা মনের মানুষ লাগে। মনের মানুষ না থাকলে বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে হয়।
নিজের পছন্দের একটা মানুষ থাকলে সারাটা জীবন তার সাথেই থাকা যায়। আমি বহু ভেবেছি, কত ঘুরেছি। আমার কেবলই মনে হতো, যাকে দুই বছর আগে ভালোবাসি বলেছিলাম। যাকে দেখলে মনে আনন্দ লাগে। গুনগুন করে গান গাইতে ইচ্ছে করে। তার লাজুক মুচকি হাসি দেখলে বুকের ঢিবঢিব বেড়ে যায়। সেই জোনাকীই তাহলে আমার মনের মানুষ। আমার ছোট্ট মনের ভালোবাসা। কিন্তু জোনাকী? তার এখনো দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া কমেনি। মাথা নিচু করে শুধু বলবে, “শ্রাবণ ভাই কিসের জন্য ডাকছো তাড়াতাড়ি বলো।” কতবার বলেছি, বস না একটু কথা বলি। পালিয়ে বেড়াস কেন আমাকে দেখলে? উত্তরে একটাই কথা, শরম লাগে। এমনি করে দিনগুলো নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছিল।
আমি যখন মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে পড়ি। তখন নিয়ম কানুন খুব কড়া হয়ে গেল। মাদ্রাসায় থেকে পড়তে হবে। জোনাকী পড়ে তখন অষ্টম শ্রেণীতে। আমার বড় ভাই তখন দেশের বাইরে। মা’কে বলেছি মোবাইল কিনতে হবে। নয়তো বাড়িতে কথা বলব কীভাবে? মা বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে আমাকে টাকা দিলেন। আমার কাছেও কিছু টাকা ছিল। আমি দুইটি নকেয়া মোবাইল কিনলাম। সাথে কিনে এনেছি দুইটি গ্রামীন সীম কার্ড। গ্রামীনে তখন বন্ধু প্যাকেজে প্রথম বিশ মিনিটের টাকা কাটে তারপর থেকে সম্পূর্ণ ফ্রি।
যখন বাড়িতে গেলাম, তখন একটি মোবাইল দেখিয়েছি। বাকি একটি রেখে দিলাম ব্যাগের ভিতর। বড় খালার বাড়ি যেতে হবে। সেখানে নাকি জোনাকীও আছে। তার কাছে গোপনে একটি মোবাইল দিতে হবে। আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে থাকে। কথা বললে লজ্জা লাগে। মোবাইলে কথা বললে আর লজ্জা লাগবে না। আর যেহেতু মাদ্রাসায় থেকে পড়তে হবে। তাকে কতদিন না দেখে থাকতে হয় কে জানে? দিনের পর দিন না দেখে, কথা না বলে থাকতে খুব কষ্ট হবে আমার। যদিও জোনাকী এখনো বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে নাকি বাসে না। আমি শুধু তার লাজুক হাসিটি সম্মতির লক্ষন মনে করে এগিয়ে চলেছি এতগুলো দিন। আমার বিশ্বাস জোনাকী আমাকে ভালোবাসে।
বড় খালামনির বাড়িতে যাবার আগেই দেখি জোনাকী একটি জমি থেকে ধান গাছের অবশিষ্ট নাড়া কেটে জমা করছে। আমার খুব রাগ হলো। আমি কাছে যেতেই জোনাকী দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্লাস এইট পড়ুয়া মেয়েটিকে কেমন বড় মনে হচ্ছে। সেই চঞ্চলতা নেই এখন। কেমন লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমাকে দেখে দৌড়ে পালিয়েও যাচ্ছে না। আমার রাগ তখনো কমেনি। আমি জোনাকীর গালে চড় বসিয়ে দিলাম। তার চোখ ছল ছল করছে। ছল ছল চোখেই আমার দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে অবাক হয়ে তাকালো। আমি বললাম, “তুই খালাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিস। কাজ করতে নয়। এত বড় ঢিঙ্গি মেয়ে রাস্তার পাশের জমিতে নাড়া কাটতে আসে? রাস্তায় কত ছেলেপুলে হেঁটে বেড়ায়। কীভাবে তাকিয়ে থাকে ছেলেরা। তুই এখনো ছোট নাকি?” এবার কেঁদেই দিল মেয়েটা। আমি ডানে বামে তাকিয়ে দেখি কেউ আছে নাকি। জোনাকীকে কাঁদতে দেখলে লোকে কী ভাববে?
-এই চুপ। একদম কাঁদবি না। মানুষ দেখলে খারাপ ভাববে।
-বাড়িতে গিয়ে দেখো, আমরা সবাই চড়ুইভাতি খেলব আজ। বাকিরা তরকারি কাটছে। আমি আসছি নাড়া নিতে। আর তুমি এসে কিছু না জেনেই চড় বসিয়ে দিলে। তোমরা ছেলেরা এমনই, দয়া মায়া নাই।
কে বলবে এই মেয়েটা ছোট? কেমন পাকা পাকা কথা বলে। আমি তার গালে হাত দিলাম চোখের পানি মুছে দেবার জন্য। জোনাকী হাত সরিয়ে দিলো। আমি আবারো হাত দিলাম। এবার সরিয়ে দেয়নি। চোখ থেকে আরো বড় বড় পানির ফোটা গড়িয়ে পড়ল আমার হাতেই। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার মাদ্রাসার ব্যাগ থেকে লুকিয়ে রাখা মোবাইলটি বের করে জোনাকীর হাতে দিলাম। বললাম, “তোর সাথে কথা না বলে থাকতে খুব কষ্ট হয়। এই মোবাইলের ডায়াল নাম্বারে আমার ফোন নাম্বার আছে। এখন থেকে প্রতিদিন কথা বলবি।” সে বলল, বাবা মা দেখলে কী হবে বুঝতে পারছ তুমি? তাছাড়া স্বর্ণা আপা বেশিরভাগ সময় আমার সাথেই থাকে। আপা যদি বলে দেয় বাবা মা’কে? আমি অভয় দিয়ে বললাম, তোকে আর সেই ছোট মেয়ে মনে হয় না আমার। আমি জানি তুই পারবি। আমার তবুও কথা বলা চাই। তোর সাথে আমার একজনমের কথা বাকি। জোনাকী মুচকি হাসি দিলো। মেয়েটা একটু আগেও কাঁদছিল। অথচ এখন তার প্রাণ খোলা হাসি। সারাটি জীবন এমনি করেই যেন হাসতে পারে।
মাদ্রাসায় আমার প্রতি মাসে খরচ বাবদ দেয় নয়শত টাকা। পাঁচশত টাকা মাদ্রাসার খরচ। একশত টাকা মাসে দুইবার বাড়ি যাবার গাড়ি ভাড়া বাবদ। আর তিনশত টাকা থাকে হুজুরের কাছে। সেখান থেকে হুজুর প্রতিদিন দশ টাকা করে হাতে দেয় খরচ করার জন্য। মোবাইলে কথা বলার জন্যও সময় নির্ধারিত ছিল। আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের আজান দেয়ার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত সময়। এই সময় ছাড়া যদি কাউকে মোবাইলে কথা বলতে দেখে তাহলে মোবাইল হুজুর নিয়ে যায়। আমি প্রতিদিন জোনাকীর কাছে ফোন দিতাম কিন্তু প্রতিদিন তাকে পেতাম না। কারণ ততদিনে জোনাকীর বড় বোন স্বর্ণা সব জেনে গেছে। কিন্তু স্বর্ণা তবুও বাবা মা’কে কিছু বলেনি। কারণ স্বর্ণাও প্রেম করে। সে যাকে ভালোবাসে সেই ছেলেটিও এই মোবাইলে ফোন দিয়ে কথা বলে। মোবাইল কিনে দিলাম আমি, ব্যবহার করে দুই বোন। আমিই ঠিকমত কথা বলতে পারি না। এমনও সময় গিয়েছে মাগরিবের আজান হয়ে গেছে কিন্তু কথা শুরুই করেছি অল্প কিছুক্ষণ। ফোন কেটে দিয়ে নামাজের পর যদি আবার ফোন দেই তাহলে আবার বিশ মিনিটের টাকা কেটে তারপর ফ্রি।
এমনিতেই প্রতিদিন যে দশ টাকা খরচ দেয় সেটাই মোবাইলে ঢুকাই। তাই আর লাইন কাটতাম না। মোবাইলের লাইন না কেটে মাদ্রাসায় রেখে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ পড়ে আবার মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলতাম। সাথের ছাত্ররা একদিন টাকা ঢুকালে পনেরোদিন চলে যায়। আমার দৈনিক টাকা ঢুকাতে হয়। একদিন হুজুরের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। যদিও ডায়াল নাম্বার, কল হিস্ট্ররী ডিলিট করে ফেলতাম। কিন্তু হুজুর কীভাবে যেন বের করত গত সাতদিনে কত মিনিট কথা বলেছি। হুজুরের বুঝতে বাকি নেই যে আমি প্রেমে পড়েছি। তিনি আমার মোবাইল নিয়ে বন্ধ করে রেখে দিলেন। আমাকে আর মোবাইল দেয় না। কথা না বলে যে কেমন লাগে সেটা কেউ বুঝবে না। নিশ্চয় জোনাকীও আমার মতো কষ্ট পাচ্ছে। তবুও আমাদের যোগাযোগ ছিল না দশদিনের মতো। একেকটা দিন আমার কাছে বছর মনে হতো।
হুজুরের নাম্বার সব ছাত্রের অভিভাবকের কাছেই থাকে। একদিন হুজুর আমার বন্ধ মোবাইলটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। হাতে দুইশত টাকা দিয়ে বললেন, শ্রাবণ যা বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। আমি বিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। মোবাইল ফিরিয়ে দিয়ে, দুইশত টাকা হাতে দিয়ে ছুটি দিলেন। তাও আবার জুবায়ের হুজুর। বিশ্বাসই হচ্ছে না। তবুও জানতে চাইলাম, হুজুর ছুটি কত দিনের? তিনি বললেন, কয়েকটা দিন থেকে চলে আসিস। আমি বাড়ি রওনা হলাম। কিন্তু আমি মন থেকে কেন যেন শান্তি পাচ্ছি না।
এলাকায় ঢুকার পর থেকে মানুষগুলো আমার দিকে কেমন আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি আমাদের বাড়িতে অনেক মানুষ যাচ্ছে, বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে আসছে। আমার বুকের ঢিবঢিবটা বেড়ে গেল। অজানা এক কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আগরবাতির কড়া ঘ্রাণ ভেসে আসছে। বাড়িতে ঢুকে দেখি কান্নার রোল পড়ে গেছে। মা কাঁদছে মাটি আর আর বুক চাপড়ে। বাইরে লাশ নেয়ার একটি খাটিয়া। খাটিয়ায় এখনো লাশ তোলা হয়নি। ভাইগুলো উঠোনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। আমার চলার গতি ধীর থেকে ধীরে হচ্ছে। বড় খালা পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে ধরলেন। আমি পেছন ফিরে তাকাতে ভুলে গেছি। বড় চাচা বলছেন, “মৃত লাশ ঘরে বেশিক্ষন রাখতে নেই। বারান্দায় শোয়ানোর ব্যবস্থা করো। হালিমকে কাফনের কাপড় আনতে পাঠালাম, এখনো এলো না। কবর খুঁড়তে যারা গেল তাদের সাথে একজন যাবার দরকার ছিল। প্রথম কোপের মাটি সাবধানে যেন রাখে। এই শফিক ঐ কোণায় চৌকি বিছিয়ে দাও, ওখানেই গোসল দেয়া হবে।”
আমি মনে হয় অনুভূতি শূণ্য ছিলাম। কিন্তু লাশের উপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলার পর বাবাকে লাশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারিনি। ফুপিয়ে কান্না জুড়ে দিলাম। বড় হবার পর থেকে লুকিয়ে কান্না করেছি সবসময়। আজ বাড়ি ভর্তি মানুষ কিন্তু আমার কান্না লুকাতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এক সমুদ্র পানি ঝরিয়ে ফেলি দুই চোখ থেকে।
বাড়িতে তিনদিন রান্না হবে না। মৃত বাড়িতে নাকি তিনদিন আগুন জ্বালিয়ে রান্না করতে হয় না। পাশের কয়েক ঘর থেকে খাবার দিলো। অনেকে মুড়ি, চিড়া, গুড়-বাতাসা আর জিলাপী নিয়ে এলেন। মরা বাড়িতে সবাই কেমন চুপচাপ। টেলিভিশনে কেউ খবর শুনে না। কারো মুখে কথা নেই, হাসি নেই। মরা বাড়ির সবাই কেমন মরে আছে। বাড়ির বাইরে বের হলে যার সাথে দেখা হয় সবাই শান্তনার বানী শোনায়। দুয়েকটা দিন খুব দূরে গিয়ে থাকতে পারলে ভালো হতো। আমি বড় খালার বাড়ি গেলাম। সেখানেও খালা খালু শান্তনার কথা শোনায়। কিন্তু বাবাবে হারিয়ে কোনো শান্তনাই মনে জায়গা করে নিতে পারছে না। কিন্তু বড় ভাই যখন দেশের বাইরে থেকে ফোন দিয়ে বললেন, “শ্রাবণ আমি তো আছি। তুই শুধু তোর ছোট ভাই দুটোকে আদর আর শাসন দিয়ে রাখিস, যেন নষ্ট হয়ে না যায়। বাকিটা আমি দেখছি।” তখনি কেবল মনে হয়েছে, একটা ছায়া অন্তত আছে আমাদের উপর।
বড় খালার বাড়িতে জোনাকী এলো বিকেল বেলা। আমি তাকে ফোন করিনি। বাবা মারা যাবার দিন নিজের কান্নাই থামাতে পারিনি। কে কে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল সেটাও জানি না। মোবাইল হাতে পেয়েও জোনাকীকে ফোন করিনি। নিশ্চয় বড় খালার মেয়ে বলেছে আমি এখানে এসেছি। আমাদের চোখাচোখি হলে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কোনো কথা হয়নি। সন্ধায় যখন বিদ্যুৎ চলে গেল, তখন সবাই উঠানে পাটি বিছিয়ে বসেছে। কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে আমার হাতের আঙ্গুলে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। জোনাকী আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় ওড়না দিয়ে। মেয়েটা অন্ধকারেও মাথায় ওড়না রাখে, দেখতে বড্ড ভালো লাগে। সে আমার হাতের আঙ্গুলের চিপায় তার আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে আছে। আমি একবার তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে বললাম, “হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে এলে সবাই দেখে ফেলবে।” তখন জোনাকী বলল, অনেকদিন কথা বলি না। রাতে ফোন দিও।
অনেকদিন পর জোনাকীর সাথে ফোনে কথা বললাম। একই বাড়িতে থেকেও ফোনে কথা বলা। ফিস ফিস করে কথা বলছি ঘরের পেছনে। সে আমাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেনি। সে জানে শান্তনা দিয়ে লাভ নেই। বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। আমার মন ভালো করার জন্য একা একা কত বকবক করে গেল। মন যে ভালো হয়নি তেমনটা নয়। সময়টুকু ভালো কেটেছিল। মাদ্রাসায় গেলে হুজুর আবার মোবাইল নিয়ে যাবে কিনা ভাবছি। আমার এই মন খারাপের দিনগুলোতে জোনাকীর সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন। হঠাৎ করেই মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। বুঝতে পারলাম আমার দ্বারা আর লেখাপাড়া হবে না। বাবা প্রতিটি ছেলেমেয়ের জন্য বটগাছের ছায়ার মতো। বটগাছটি না থাকলে রোদে পুঁড়তে হয়। এখন বাবা নেই, ভাই বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়।
এক ভাইয়ের টাকায় পুরো সংসার চলে। মা’কে যদি বলি পাঁচটি টাকা দাও, কলম কিনব। মা আমার মামাতো ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে সত্যিই কলমের দাম পাঁচ টাকা নাকি আরো কম? আমি অবিশ্বাসের কোনো কাজ করেছি বলে মনে হয় না। তবুও কলমের জন্য পাঁচ টাকা দেয়ার জন্য মোবাইলে আরো তিন চার টাকা খরচ করে ফেলে মা। ভেবে নিলাম, নিজেই কিছু একটা করব। ইলেকট্রিকের কাজ শিখার জন্য এক ওস্তাদ ধরলাম। তার একটি দোকানও আছে। দোকানে যেতে হলে সেজু খালার বাড়ি পেড়িয়ে যেতে হয়। অর্থ্যাৎ জোনাকীদের বাড়ির পাশ দিয়েই রাস্তা। ভালোই হলো, প্রতিদিন যেতে আসতে অন্তত একবার হলেও জোনাকীকে দেখতে পাব। দু’টি কথা বলতে পারব। ওস্তাদ ঠিক করে দিয়েছে জোনাকীর বড় বোন স্বর্ণা। আমার বেতন ঠিক হলো সপ্তাহে বিশ টাকা, মাসে আশি টাকা। কাজ শিখা হলে তো অনেক টাকা রোজগাড় করতে পারব।
প্রতিদিন কাজ শিখতে যাবার সময় জোনাকীকে ফোন দেই। সে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। একটু দেখে চলে যাই। আবার রাতে যখন ফিরি তখনো তাকে ফোন দেই। কখনো কখনো রাত হয়ে যেত। আমি না যাওয়া পর্যন্ত তার চোখে ঘুম নেই। বই খুলে বসে থাকত। রাতে দেখা করলে আমাকে পাঁচ টাকা দশ টাকা করে দিত। জোনাকী তার টিফিনের টাকাটাই আমার জন্য রেখে দিত। বলত, তোমার যখন কাজ শিখা হয়ে যাবে তখন কাজ করে আমাকে ফিরিয়ে দিও। আমিও কাজ শিখার পাশাপাশি পাশের দোকানে রাতের বেলা একটু বসতাম। কেউ কেউ গান লোড করতে আসত। আমি গান ভরে দিয়ে যে টাকাটা পেতাম তা জমিয়ে রাখতাম। জোনাকী বলেছিল তার চুলের আগা ফেটে যায়।
সেজন্য ইন্ডিয়ান কদুর তেল দরকার। আমি তার চুলের যত্নে তেলের দ্বায়িত্ব নিয়ে নিলাম। কাজ শিখার ফাঁকে ওস্তাদ যখন দুপুরে খাবার খেত তখন জোনাকীর সাথে একটু কথা বলতে পারতাম। অন্য সময় কাজের ফাঁকে ফোন দিলে বিজি পাওয়া যেত। পরে অবশ্য ভুল ভেঙ্গেছে। কারণ আমার ওস্তাদ ভালোবাসত জোনাকীর বড় বোন স্বর্ণাকে আর স্বর্ণা ওস্তাদকে বলে দিয়েছে আমাকে কাজ শিখানোর জন্য। ওস্তাদ জানত আমি জোনাকীকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো কিছু বলত না। অথচ এমনিতে বন্ধুর মতই চলাফেরা করত ওস্তাদ। তখন তো সিগারেট খাওয়ার বয়সও এক বছর হয়ে গিয়েছিল। ওস্তাদ অর্ধেক সিগারেট টেনে আমাকে দিতেন। কখনো আস্ত সিগারেট দিয়ে বলতেন, নে খা। কোথায় ছিলাম মাদ্রাসার ছাত্র। আর বাবা মারা যাবার পর বছর দেড়েক হয়ে গেল কাজ শিখি। সিগারেট ধরে ফেলেছি। জীবন কেমন যেন হঠাৎ করেই রাস্তা বদল করে দেয়।
বাড়িতে মা, অন্য দুই ভাই, চাচা কেউ আমাকে দেখতে পারত না। আমার ভাইয়েরা লেখাপড়া করে আর আমি কিসের কাজ শেখা শুরু করছি লেখাপড়া ছেড়ে। লোকমুখে আমার সিগারেট খাওয়ার কথাটিও চাপা নেই। সেই খবর দেশের বাইরে বড় ভাইয়ের কানেও গেল। হঠাৎ খবর দিলেন, ভাই দেশে আসবেন। বাবার পর যদি কাউকে ভয় পাই সেটা আমার বড় ভাইকে। ভয়ের চেয়ে শ্রদ্ধা করি আরো বেশি। ভাই অনেক শিক্ষিত। স্কলারশীপ নিয়ে মালয়েশিয়া পড়তে গিয়েছিল। সেখান থেকে ডিগ্রী অর্জন করে সেখানেই চাকরিতে জয়েন করেছিলেন। পরের মাসে ভাই বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে এসে আমাকে বুঝালেন। ভাইয়ের মধ্যে আমি বাবার ছায়া দেখতে পাই। বাবার মতোই অল্প কথা বলেন কিন্তু প্রতিটি কথা গুরুত্ব সহকারে শুনতে হয়। ভাই আমাকে বললেন, “জগতের কোনো কাজই ছোট না। তবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা উচিত নয়। তোর পড়তে ভালো লাগেনি, আবার নিজে বসে না থেকে কাজ শিখছিস। এটা মন্দ নয়। ইলেকট্রিকের পাশাপাশি মোবাইল সার্ভিসিং এর কাজটাও শিখে ফেল। আমি বছর দুয়েকের মধ্যে তোকে বাজারে একটা দোকানের ব্যবস্থা করে দেব।”
ভাইয়ের কথায় একবুক সাহস পেলাম। শুধু কষ্ট পেলাম কয়েকটা দিন পরে। ভাই যেহেতু ছুটিতে এসেছে, আবার চলে যাবেন। তাই ভাইকে বিয়ে করাতে চান মা, চাচা। শেষ অবধি বিয়ে করালেন বড় খালার মেয়ে সনিয়াকে। যে আমাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করত। আমার তাকে একদম পছন্দ না আমার সাথে সনিয়ার দা কুমড়া সম্পর্ক। বাবা মারা যাবার পর থেকে অন্তত ছয় থেকে সাতবার ঝগড়া হয়েছে সনিয়ার সাথে। আর এখন নাকি তাকে ভাবি ডাকতে হবে। বিয়ের দিন রাগ করে আমি বাড়িতে খাইনি। ভাই সেদিন কষ্ট পেয়েছেন জানি। খালাত বোনকেই কেন বিয়ে করতে হবে? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব? আমি তো জানি সনিয়া এই বাড়িতে অধিকার পেয়ে গেলে আমার সাথে নিত্য নতুন ঝগড়া লেগেই থাকবে।
ভাই চলে যাবার পর থেকে সনিয়ার সাথে কোনো কথা বলিনি। আমি ভাবী বলে ডাকও দেইনি। সনিয়া বাড়ির সবাইকে খাবার দিলেও আমাকে বলে আমারটা যেন আমি নিজে নিয়ে খাই। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি, বাড়িতে টাকা দেই না। বসে বসে খাই। এই সমস্ত কথাও শুনতে হয়েছে সনিয়ার মুখ থেকে। তখন আমার ইলেকট্রিক কাজ শেখা মোটামোটি শেষ। এখানে শেখানে কাজ করে মোটামোটি টাকা রোজগাড় করতে পারি। ঐদিকে মোবাইল সার্ভিসিং এর কাজ শিখার সময় গান লোড করে দিলেও কিছু টাকা পাই। জিদ করে বাড়িতে খাওয়া ছেড়ে দিলাম। বড় ভাই বিদেশ থেকে ফোন করে বলল, তোর ভাবী কী বলল সেটা ধরতে হবে না। তোর বাড়িতে তুই খাবি। কিন্তু তবুও আমি খাইনি। মাঝেমধ্যে কিছু বাজার করে আনতাম বাড়িতে। রান্না হলে সবাই খেত, আমি খেতাম না। মা মন খারাপ করত। আমার মন খারাপ হতো না। আমার সেই দিনগুলোতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহস দিত জোনাকী।
একদিন রাত এগারোটায় আমাদের গ্রামের মেম্বার ফোন দিলেন। উনার পানি তোলার মোটরের কী যেন জ্বলে গেছে। আজকে রাতের মধ্যেই সারতে হবে। মেম্বার ততদিনে জানে আমি একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রী। রাত দু’টা বেজে গেল কাজ সারতে সারতে। আমি ভেবেছিলাম জোনাকী ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি মেসেজ, “রাত যতটাই বাজুক ফোন দিও।” ফোন দিয়ে দেখি মেয়েটা তখনও জেগে আছে আমার জন্য। বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় ফোন দিলাম। জানালা খুলে দিল। জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ে জোনাকীর মুখে। আমি বাইরে থেকে আলতো ছুঁয়ে দেই। আমার সারাদিনের কষ্ট যেন এক মূহূর্তেই শেষ হয়ে যায়।
পরদিন এক অঘটন ঘটে গেল। জোনাকীর বড় বোন স্বর্ণা আমার ওস্তাদের সাথে পালিয়ে গেছে। মোটামোটি সব খালাদের বাড়ির সাথে বাজারেও ঘটনা রটে গেল। কারণ বাজারেই তো ওস্তাদের দোকান ছিল। কোথায় গেছে, তারা পালিয়ে বিয়ে করেছে কি-না তারও খবর পাওয়া গেল না। শুধু জোনাকীর চাচী বলল, আগের দিন বিকেল বেলা আমার ওস্তাদ স্বর্ণার সাথে দীর্ঘ সময় পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল। যেহেতু দুইজনকে একসাথে পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে নিশ্চয় তারা পালিয়েছে। পালানোর আরেক কারণ আমি বুঝতে পারলাম স্বর্ণাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসা। গত সপ্তাহে জোনাকী জানালা দিয়ে কথা বলার সময় আমাকে বলেছিল, আপুকে আজ দেখতে এসেছে। আপু অঘটন একটা ঘটাতে পারে। সেটা যে এত দ্রুত হবে ভাবতে পারিনি। আর এই অঘটনের মধ্য দিয়েই আমারও সুখের দিনের চির সমাপ্তি হয়ে গেল।
আমার বড় ভাইয়ের বউ সুমি, যার সাথে আমার দা-কুমড়া সম্পর্ক। সে মাসখানেক ধরে টের পেয়েছে আমি রাত হলে বাড়ির উঠানে এসে জোনাকীর সাথে ফোনে কথা বলি। স্বর্ণা পালিয়ে যাবার খবর যখন সব খালাদের বাড়ি পৌঁছে গেল তখন সুমি জোনাকীর মা’কে ইঙ্গিত করে বলেছে, এবার জোনাকীর দিকে একটু নজর রাখিয়েন। জোনাকীও তো রাত জেগে ফোনে কথা বলে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হবার জোগাড় হলো। জোনাকী মোবাইল পেল কোথায়? এতদিন তো কেউ জানেই না জোনাকীর মোবাইল আছে। জোনাকীর বাবা মা মোবাইল ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলেছে। সেই মোবাইলে পাওয়া গেল আমার আর ওস্তাদের নাম্বার। ভুল বুঝাবুঝির শুরু। খালার ধারণা, ওস্তাদ স্বর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে কোথায় গেছে তা আমি জানি। আর আমরা পরিকল্পনা করেই এমনটা করেছি বলে কথা উঠল।
বাড়িতে গেলে মা আমার সাথে কথা বলে না। একা একা বলে, আমাদের সম্মানটুকুর কথাও চিন্তা করল না। আমার বোনের এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি বোনদের কাছে আর কোনোদিন বড় মুখ করে কথা বলতে পারব না।
আমার দুঃখের দিনগুলো শুরু। জোনাকীর সাথে দেখা নেই, কথা নেই। কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। বাড়িতে কটুকথা। বাজারেও কানাকানি। এ যেন নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো। রাতের পর রাত চোখে ঘুম নেই। যার সাথে একটা দিন কথা না বলে থাকতে পারি না আমি। তার সাথে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। বাজারের পাহাড়াদারদের সাথে মনের দুঃখে দু’দিন মদ গিলেছি।
সে খবরও আমার বাড়িতে কীভাবে গেল, কে বলেছে আমার জানা নেই। বড় ভাই যখন ফোন করে বলল, আমাদের বংশে কেউ নেশা করেছে কোনোদিন? আমার তখন মনে হয়েছে, এই কথা শুনতে না পেলে ভালো হতো। বা মাটির নিচেই যদি চলে যেতে পারতাম। যে ভাইকে এত ভয় পাই, শ্রদ্ধা করি। সে ভাইয়ের মুখে নেশার কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। এর সপ্তাহ দুয়েক পর এক সন্ধ্যায় সুমি কান থেকে ফোন রেখে মা’কে ডেকে বলছে, “আম্মা, বিকেলে জোনাকীর বিয়ে হয়ে গেছে।” লুঙ্গি পরেই রওনা দিলাম। পাগলের মতো হয়ে গেছি জোনাকীর বিয়ের খবর শুনে। মা মনে হয় পেছন পেছন ডেকেছিল, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। সুমিকে মনে হয় মা বলেছিল ফোন দিতে। ফোন রিসিভ করে সুমির কন্ঠ শুনেই চিৎবার করে বললাম, ঐ ফোন রাখ তুই। আর ফোন দিবি না।
জোনাকীদের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি তাদের উঠান জুড়ে মহিলাদের গল্প গুজব। জোনাকীকে বর পক্ষ দেখতে এসে বিয়ে করে সাথে করে নিয়ে গেছে। এটা কেমন বিয়ে? বিয়ের গেইট নেই। আত্মীয় স্বজন দাওয়াত করা নেই। দেখতে আসলেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে? আর কনে সাথে করে আজই দিতে হবে? তারা জানত আমি আসব?
বাড়ির বাইরে থেকেই যখন জানতে পেরেছি জোনাকীকে বর পক্ষ নিয়ে গেছে তখন আর বাড়ির ভিতর ঢুকতে ইচ্ছে হয়নি। সন্ধ্যার জোনাক পোকা বের হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। জোনাকীর বিয়ের দিন আজ, তারা আলো দিবে। কিন্তু জোনাকী কবুল বলল কীভাবে? সে তো আমাকে ভালোবাসে?
বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানের ভেতর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। আমার কী করা উচিত বা কী করব কিছুই মাথায় আসছে না। সেই রাতে বড় ভাইয়ের কথা ভুলে, বাড়ি ঘর আর জগত সংসারের কথা ভুলে আবারো ভরপুর মদ গিলেছি। যদিও পরদিন শুধু এটাই ভেবেছি, মদ খেলে কি জোনাকী ফিরে আসবে?
পরের তিনটা মাস কেটেছে আমার পাগলের মতো। চেহারা দেখে অনেকে চিনতেই পারত না এটা শ্রাবণ। গভীর রাতে বাড়ি গিয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে থাকতাম। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তাম বাড়ি থেকে। টুকটাক কাজ পেলে করতাম। কোন সময়ের খাবার কখন খেতাম তার ঠিক ছিল না। সব খবর গেল ভাইয়ের কানে। ভাই আমাকে আর ফোন করেনি। হয়তো রাগে বা গভীর অভিমানে ভাই আমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলো। একদিন চাচা আমাকে ডেকে বলল, শ্রাবণ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
বাবা নেই, চাচা যেহেতু ডেকেছে নিশ্চয় জরুরী কথা হবে। বাড়ির পাশের জমিতে চাচা হাল চাষ করছিল। আমি গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছি। চাচা বললেন, “তোর ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। ভালো একটা ভিসা আছে। তুই তো ইলেকট্রিক কাজ জানিস। গেলে দুই চার পয়সা কাজ করতে পারবি। তোর ভাই টাকার ব্যবস্থা করবে। তুই কাল পরশু গিয়ে পাসপোর্ট বানাতে দিয়ে আসবি।” আমি তখনো জানতাম না বাহরাইন নামক কোনো দেশ আছে। আমার কেন যেন মনে হলো, ভাই যেহেতু বলেছে তাহলে অন্তত এই কথাটা রাখি। দূর প্রবাসে পড়ে থাকি। ভালো থাকি আর মন্দ থাকি অন্তত কেউ দেখবে না। আরব সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে আবার পাথরে উঠে বসলাম। বাংলাদেশ থেকে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে ফোন আসল। রিসিভ না করে কেটে দিয়ে আমি ফোন দিলাম। কানে দিতেই প্রথম যে কথা শুনলাম তা হলো.
-শ্রাবণ তুমি নাকি আমাকে ভালোবাসো না?
সেই কন্ঠ। সেই কথা বলার ছন্দ। জোনাকীর কন্ঠ শুনলাম এতদিন পর। নিশ্চয় তার স্বামী বলেছে কথাটি যে আমি তাকে ভালোবাসি না।
-কী হলো শ্রাবণ? কথা বলছ না কেন?
-কী বলব? আমি তোমাকে ভালোবাসব কোন দুঃখে? তুমি তো আরেকজনের বউ।
-আমি এতগুলো দিন আমার স্বামীকে বলে এসেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটা মেনেই যেন সংসার করে। আর আজ তুমি এই কথা বলছ?
-ঠিকই তো বলেছি। আমাকে ভালোবাসলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে না। আর একটা বয়সে সবাই এমন প্রেম ট্রেম করে। এসব সারাজীবন মনে রাখতে হয় নাকি?
-এসব তুমি বলছ শ্রাবণ?
-হ্যাঁ আমি বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি না। আজ থেকে আমার স্বামীকেই ভালোবাসব।
বলে ফোন রেখে দিলো। আরব সাগর সাক্ষী থাকল, আমি বলেছি জোনাকীকে ভালোবাসি না। বেহায়া মনটা রাত জেগে যার জন্য কাঁদে সেই চোখের পানি সাগরে মিশবে না কোনোদিন। তাই আরব সাগরের সাক্ষীও সত্যি। রাতের গভীরে আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানিও সত্যি।
গল্পের বিষয়:
গল্প