হালাল ভালোবাসা

হালাল ভালোবাসা
আমার আর রাফসানের বিয়ে হওয়ার পরে সবাই’ই আমাদের একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখেন। এত কম বয়সে বিয়ে হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো গোপন কারণ আছে, এমনটাই ধারণা সকলের। প্রায়ই পরিচিত জনেরা নানান অছিলায় জানতে চান, বিয়েটা আসলেই পারিবারিকভাবে হয়েছে নাকি নিজেরাই করে ফেলেছি। এসব প্রশ্নের মূল কারণ আমাদের বয়স। কেননা আমার বয়স সতেরো আর রাফসানের বিশ। এত কম বয়সে এই যুগের ছেলেমেয়েদের বিয়ে যেন অবাস্তব কোনো ঘটনা।
বাংলাদেশের আইনেও বাল্যবিবাহ বলে গণ্য করা হয়। এত বাঁধা থাকা সত্বেও আমরা দু’জন বিবাহিত দম্পতিতে পরিণত হতে পেরেছি। এটাই এখন বেশ অবাক করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিল্ডিংয়ে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। সেদিন ছাদে শুকনো কাপড় আনতে গিয়ে দেখি পাশের বাসার আন্টি নতুন আসা আন্টির সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। আমি ওখানে পৌঁছানো মাত্রই তাদের কথা থেমে গেল। আমি চুপচাপ কাপড়গুলো নিয়ে বাসায় চলে এলাম। বেশ বুঝতে পেরেছি আলোচনায় আমিই ছিলেম। ইদানীং আশেপাশের লোকেদের কথার আসরে আমার নামটা থাকে। এই বিষয়টাতে আমিও দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। সকালে ফজরের নামাজ শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ কথার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ‘আম্মা! কি হয়েছে? কে এসেছিলো?’
‘সামনের বিল্ডিংয়ের আনোয়ার ভাইয়ের মেয়ে তুলি গতকাল সন্ধ্যায় নাকি পালিয়ে গিয়েছে। পাশের বাসার ভাবী এসে জানিয়ে গেল।’ আম্মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে লাগলেন, ‘কেন যে অভিভাবকেরা জানা মাত্রই ছেলেমেয়ের মতামতে বিয়ে দিতে রাজি হন না!’ তুলি আপাকে প্রায়ই দেখতাম একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে। আজকালকার মেয়েদের ছেলে বন্ধু থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলেটা তুলি আপার বন্ধু থেকেও বেশি ছিল, তা আচারণেই বুঝা যেত। আব্বা বলেছিলেন সেদিন, তুলি আপার বাবা নাকি তার বিয়ের জন্য ভালো চাকুরিজীবী পাত্র খুঁজছে। ভালো মানুষ না খুঁজে, ভালো চাকুরির কদর করার কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো।
খুব সকালের শহর দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। তুলি আপার বাসার দিকে চোখ যেতেই তুলি আপার কথা মনে পড়লো। গতকাল বিকেলে তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। ছলছল চোখ জোড়া লাল হয়ে ছিল, অনেক কাঁদলে চোখ যেমন লাল হয় তেমনই লাগছিল। বাড়িতে ঝগড়াঝাটি করে বের হয়েছিল এখন বেশ বুঝতে পারছি। রাফসানের কথা খুব মনে পড়ছে। এখন নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে, বিরক্ত করা ঠিক হবে না। ঘুমালে রাফসানকে আরও বেশি সুন্দর লাগে। ভাবতেই রাফসানের ঘুমন্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
‘ভাবী! শুনলাম আপনাদের বিল্ডিংয়ের তৌকির ভাইয়ের যে মেয়েটা সবসময় হাত মোজা, পা মোজা, বোরকা, হিজাব পরে বাহিরে বের হয় ওর নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছে? এত কম বয়সে বিয়ে হলো কিভাবে?’
‘প্রশাসনের লোকেদের সঙ্গে বেশ খাতির, কে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে!’
‘তবুও এত কম বয়সে বিয়েটা ঠিক হয়নি।’
‘আরে ভাবী, হাঁড়ির খবর কি আর আমরা জানি! উপরে পর্দা দেখিয়ে ভেতরে যদি অকাজ করে বেড়ায়, কয়দিন আর চাপা থাকে বলুন? বাধ্য হয়েইতো বাবা মা বিয়ে দেয়।’ ‘তা ঠিক বলেছেন।’ সিঁড়ি থেকে নিচে নামবো ঠিক তখন পাশের বাসার আন্টি আর পাশের বিল্ডিংয়ের এক আন্টির কথপোকথন বেশ স্পষ্ট ভাবেই আমি শুনতে পেলাম। ভেতরে খুব খারাপ লাগছিল, ইচ্ছে করলো বাসায় ফিরে যাই৷ কিন্তু বাহিরে আমার খুব জরুরী কাজ পড়ে আছে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি থেকে নিচে চলে এলাম। আমাকে দেখা মাত্রই তাদের কথা থেমে গেল। ধীর পায়ে হেঁটে চলছি। খানিক দূর যেতেই দেখি রাফসান দাঁড়িয়ে। অবাক হলাম বেশ।
‘কি ব্যাপার তুমি এখানে?’
‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।’
‘তাহলে বাসায় গেলে না কেন?’
‘তুমি তো এখন বের হবে জানতাম। তাই আর যাই নি।’
জীবনটা রাফসানের সঙ্গে এভাবে গেঁথে যাবে কখনও ভাবিনি। বিয়ের আগে রাফিয়ার মুখে অনেক প্রশংসা শুনলেও কখনও দেখা হয়নি রাফসানকে। তবে দেখার আগ্রহ যে জমেনি তা কিন্তু নয়। রাফিয়া আমার খুব কাছের বান্ধবী। যে আমায় পুরোটা বুঝতো। একদিন হুট করে রাফিয়া বললো, ‘ঠিক করেছি তোকেই আমার ভাবী বানাবো। ভাইয়া রোজ তোর কথা জিজ্ঞেস করে।’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার কথা কেন?’ ‘তোর কথা তো সারাদিন আমার মা আর আমি প্রশংসা করতেই থাকি৷ মা তো সেই প্রথম যেদিন তোকে দেখলো সেদিনই বলে বসলো, মেয়েটাকে যদি আমার ছেলের বউ করতে পারতাম!’ কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছি না। আমার নীরবতা দেখে রাফিয়াই বললো, ‘আমার মনে হয়, ভাইয়া তোর প্রেমে পড়ে গিয়েছে। প্রায়ই কৌশলে তোর কথা জানতে চায়।’ ‘আমার পক্ষে এসব সম্ভব নয় তুই জানিস।’ করুন গলায় রাফিয়া বললো, ‘কোনোভাবেই কি সম্ভব নয়?’
‘আমি দুঃখিত রাফিয়া। আমার বাসায় ফিরতে হবে।’
‘আচ্ছা, একটা কথার উত্তর দে।’
‘অবশ্যই।’
‘আমার ভাই’কে কি তোর অপছন্দ?’ রাফিয়ার দিকে ঘুরে তাকালাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলাম, ‘ভালো মানুষকে খারাপ জানবেইবা কেন মানুষ!’ আমার পরিবার আধুনিক যুগের দশটা পরিবারের মত নয়৷ বেশ আলাদা। আমাদের ভাইবোনদেরও এভাবেই বড় হওয়া। বিয়ের আগে কারো সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে কড়া নিষেধ আব্বার। তার কথা হলো, ‘ভালোবাসা অবশ্যই ভালো জিনিস। তবে সেটা অবশ্যই হালাল হতে হবে।’
এই হালাল ভালোবাসার জন্যই সকল হারামের রাস্তা থেকে নিজেকে সংযত রেখেছি। প্রশ্রয় দেইনি কোনো প্রস্তাবকে। জাগতে দেইনি কোনো আবেগ। বেশ কিছুদিন পরে একদিন হঠাৎ আব্বা আম্মার মুখে রাফসানের নামটা শুনতে পাই। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন এই নামটা আমাদের পরিবারে উচ্চারিত হচ্ছে! পরে জানতে পারি, রাফসানের বাবা-মা এসেছিলেন। আমি বিশ্বাস’ই করতে পারছিলাম না, আব্বা এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। এই যুগে এরকম কম বয়সী, বেকার, পড়াশোনা করুয়া এক ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করবেন। যদিও আমি ভেতরে সবসময়ই চাইতাম আমার ভালো একজন মানুষ দরকার, ভালো চাকুরি আর সম্পদ নয়। স্বল্প পরিসরে আমাদের বিয়েটা হয়েই যায়। বিয়ের পরেই রাফসানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তারপর থেকে চলছে আমাদের হালাল ভালোবাসা।
প্রতিদিনের মত আজও কলেজের ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলাম। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি বিল্ডিংয়ের সামনে মানুষের জটলা বেঁধে আছে। পুলিশের গাড়ি থেকে পুলিশ নামছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিল। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম। জানতে পারলাম, চার তলার কৌশিক নামের ছেলেটা গলায় ফাঁস দিয়েছে। আত্মহত্যার কথা শুনলেই ভেতরটা কুঁকড়ে উঠে। আফসোস হয় মৃত মানুষটার প্রতি। আত্মহত্যা যন্ত্রণা কমায় না, বরং বাড়ায়। কথাটা কেন মানুষ বুঝে না! আম্মার কাছেই ঘটনা সম্পর্কে জানলাম, আজ সকালে বেকার কৌশিক ভাইয়ের প্রেমিকার এক বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটাকে সফল করেছেন। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তার পরিবারের সকলে। বাকিরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে লাগলো।
সন্ধ্যার আধো আলোতে শহরটাকে খুব শান্ত মনে হলো। এত গাড়ি-ঘোড়ার শব্দেও পরিবেশটা যেন নিস্তব্ধ। মানুষের দীর্ঘশ্বাসে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বাতাস। অক্সিজেনের থেকে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ যেন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মনে বাসা বেঁধেছে অসুখেরা, অশান্তিতে ছেয়ে গেছে ভেতর। প্রতিদিন শহরে বৃষ্টি না নামলেও, মানুষের চোখ ভিজে বৃষ্টি নামে রোজ। রাফসানের সঙ্গে খুব কম দেখা হয় ইদানীং। পড়াশোনা নিয়ে দুজনেই ব্যস্ত সময় পার করছি যার যার বাড়িতে। রাফসানকে দেখার জন্য আজ হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে মনটা। ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’ মুঠোফোনের ওপাশ থেকে রাফসান জবাব দিল, ‘কাল সকালে আসি? নাকি তুমি আসবে?’ ‘তুমিই এসো। আম্মা তোমার কথা খুব মনে করেন।’ পড়াশোনার মাঝে ভালোবাসার এই সময়গুলো মনে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে, ভালো রাখে ভেতর থেকে।
চুপচাপ জালানার পাশে বসে আছি। বাইকের শব্দে রাস্তার দিকে তাকালাম। রোজকার মত আজও দিশা আপাকে একটা ছেলে পৌঁছে দিয়ে গেল। পাশের বাসার আন্টির একমাত্র আদরের মেয়ে দিশা। বিয়ে হয় নি এখনও। এর আগে একবার একটা ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে মা হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটা চোখ পাল্টিয়ে অস্বীকার করলেন সম্পর্ক। বাধ্য হয়ে মেরে ফেললেন একটা জীবন দুনিয়ায় আসার আগেই। অনেকদিন নিজেকে বাসায় আঁটকে রাখলেন। তারপর কোথা থেকে এই ছেলে এলো তার জীবনে, আর ঘরবন্দী মানুষটাকে বাহিরে নিয়ে এলো সে। রোজ সকাল, দুপুর, বিকেল যখন ইচ্ছে বের হয়ে যায় আপা। আর রাতে ফেরত আসে। এতে বরং আন্টি বেশ খুশি। বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের এমন একটু-আধটু সম্পর্ক সবারই থাকে, এমনটাই ধারণা তার।
কিন্তু অবাক লাগে যখন ভাবি, এই আন্টিই আমার কম বয়সে বিয়ে নিয়ে খুব কথা রটিয়ে বেড়ান। আঁড়চোখে তাকান আমার দিকে, সমাজে আমার পরিবারকে ছোট করার চেষ্টা করেন।
দিশা কিংবা তুলি অথবা কৌশিক ভাইয়ের মত চোখের সামনে যখনই এরকম ঘটনা দেখি, সমাধান হিসেবে আব্বার বলা সেদিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ে। প্রতিটি লাইন মনের মধ্যে এখনও এঁটে আছে। রাফসানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ঠিক আগের দিন তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। ‘আল্লাহ রিজিকের মালিক। ছেলেকে অনেক টাকা পয়সা আয়ের পরেই কেন বিয়ে করতে হবে! তার আগে কেন করা যাবে না? আমরা বাবা-মা’রা ছেলেমেয়েদের বিয়ের আগে তাদের সকল দায়ভার গ্রহণ করতে পারলেও বিয়ের পরে একদমই পারি না, এটাই যেন নিয়ম করে ফেলেছি। তাদের বিয়ের আগের প্রেম ভালোবাসাটাকে সহজ ভাবতে পারি কিন্তু বিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক রাস্তাটা দেখানোর কথা চিন্তাও করিনা। অথচ চাইলেই আমরা আমাদের সন্তানদের জীবনটা সুন্দর করে দিতে পারি।
বাদ বাকি সব আগের নিয়মে রেখে শুধু তাদের ভালোবাসাটা হালাল করে দিতে পারি। একটা শক্ত ভিত থাকবে আর থাকবে একটা দলিলও। নিজেদের দায়িত্ব নেওয়ার তাগিদে একদিন নিজেরা সফলতা অর্জন করবেই। কেবল হালাল ভালোবাসায়’ই আল্লাহর রহমত থাকে।’ রাফসানকে খুব ভালোবাসি আমি। দু’জন মিলে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরিশ্রম করে চলছি। রাফসান আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারের একটা। যাকে ছাড়া জীবনটা এখন অসম্পূর্ণ মনে হয়। ছাদ জুড়ে জোছনার আলো। রাফসানের কাঁধে মাথা রেখে চেয়ে আছি চাঁদের দিকে। ছাদের পূব কোণে বেলিফুল ফুটে আছে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।
নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলাম, ‘এত ভালোবাসো কেন তুমি আমায়?’ রাফসান মুচকি হেসে উত্তর দিল, ‘তুমিই যে আমার বাম পাঁজরের হাড়, তুমিই তো আমার অধিকার, তোমাকে ভালোবাসলেই শান্তি মেলে।’ চোখে মুখে আনন্দের রেখা নিয়ে শক্ত করে রাফসানকে আঁকড়ে ধরলাম। ভেতরের এক রাজ্যের অনুভূতিরা আমায় চুপ করিয়ে দিল। এবার রাফসান প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আচ্ছা, তুমি কেন বাসো এত ভালো?’ একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমিই যে আমার হালাল ভালোবাসা।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত