গল্পটা পাঞ্জাবীর

গল্পটা পাঞ্জাবীর
আব্বু যেদিন প্রথম স্যার কে নিয়ে এলেন আমি তখন টেবিলের উপর বসে চেয়ারে পা রেখে কাঁচা আম লবণ দিয়ে মেখে খাচ্ছিলাম। স্যারকে দেখেই তারাহুরো করে নামতে গিয়ে স্কার্ট এর কোনা আটকে ধপাস করে পরে গেলাম ফ্লোরে। ভেবেছিলাম খুব হাসবে স্যার। কিন্তু খুব গম্ভীর গলায় বললেন:
-ঠিকাছে। ব্যাপার না। উঠে বসুন।
উঠতে উঠতে স্যার কে ভালো করে দেখে নিলাম। স্যার চশমা পড়েন। জিন্স প্যান্টের সাথে পাঞ্জাবী। কালো ফিতার ঘড়ি। সিল্কি চুল ফ্যানের বাতাসে নড়ছে। বেশ লম্বা। স্যামলা। এক চিমটি ভুড়ি নেই। নিজের অজান্তে বলে উঠলাম। বাব্বাহ আব্বু কি স্যার এনেছে নাকি জামাই?? আমার ভাবনার সুতো কেটে দিয়ে স্যার বললেন:
-কী দেখছেন??
-কই কিছু না তো!!
-আজ থেকেই আপনাকে পড়াবো আমি। আপনার বাবা বলেছেন আপনি রসায়নে খুব কাঁচা। আমি আপনাকে রসায়ন পড়াবো। প্রথম পত্র আর দ্বিতীয় পত্র দুটোই। চলুন পড়ার টেবিলে চলুন। পরিক্ষা যেহেতু এসেই পরেছিলো স্যার আমাকে রোজ পড়াতেন। ছোট বেলা থেকেই দেখতাম আব্বু শুধু শুক্রবার পাঞ্জাবী পরতেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে স্যারকে দেখছি। রোজ ই পাঞ্জাবী। কখনো শর্ট পাঞ্জাবী কখনো লং। একটা মানুষ কি করে সবসময় পাঞ্জাবী পরেন? গুনে ফেলেছি স্যার এ ক দিনে পাঁচটা পাঞ্জাবী ঘুরে ফিরে পরেছেন। একেই বলে পাঞ্জাবীওয়ালা। একদিন স্যারকে বলেই ফেললাম:
-স্যার আপনি সবসময় পাঞ্জাবী পরেন কেন??
-ভালো লাগে তাই।
-তাই বলে সবসময়?? মাঝে মাঝে তো শার্ট পরতে পারেন। কাউকে কখনো এভাবে সবসময় পাঞ্জাবী পরতে দেখিনি। ব্যাপারটা কেমন যেনো লাগছে। আপনার গরম লাগে না??
-না। আমার ভালো লাগে। আমি শান্তি পাই।
জানিনা কেনো আমার ও সেদিন থেকে মনে হতে লাগলো পুরুষ মানেই পাঞ্জাবী। স্যারের নাম দিয়ে দিলাম পাঞ্জাবীওয়ালা। যত দিন যাচ্ছে স্যারের সাথে মিশছি। ফ্রি হচ্ছি। উনি যা বলেন আমার তাই ভালো লাগে। যা করেন তাই ভালো লাগে। স্যারের হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। আমি কী স্যারের প্রেমে পরছি??? কিন্তু স্যার ঐ হাসি অবদিই। কখনোই আমার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাননা।। সেদিন মায়ের নতুন শাড়িটা দেখেই ইচ্ছে হলো পরে ফেলি। স্যার আসার আগে চট করে পরে সেজেগুজে বসে রইলাম। স্যার এসে রুমে ঢুকেই হা!!
-তুমিও পারো শাড়ি পরতে?
-ভালো লাগছে না??
-বেশ লাগছে।।
-স্যার আপনার কী গার্লফ্রেন্ড আছে??
-কেনো আমার গার্লফ্রেন্ড হতে ইচ্ছে করে?? বলেই সেই অদ্ভুত হাসি। আমি নিশ্চুপ। পাঞ্জাবীওয়ালা একটুখানি থেমে বললেন:
-মাঝে মাঝে শাড়িও তো পরতে পারো। তোমার সাথে ভীষণ যায়।
-স্যার আপনিও তো মাঝে মাঝে পাঞ্জাবী ছেড়ে শার্ট পরতে পারেন। আপনার সাথে যায় কীনা বুঝলাম ই না।
-কি হয় বলোতো নীরু!! আমি যখন ই শার্ট কিনতে যাই কোনো না কোনো পাঞ্জাবী আমার পছন্দ হয়ে যায়। আর বাজেট যেহেতু সীমিত তাই শেষ অবদি আর শার্ট টা কেনা হয়ে উঠে না।
-আমি কিনে দিলে পরবেন??
-হা হা হা। ঠিকাছে পরবো। আগে তো পাশ টা করো। তোমাকে পাশ করাতে পারলে তোমার বাবা বলেছে আমাকে সুন্দর একটা পাঞ্জাবী কিনে দিবে।
-এখানেও পাঞ্জাবী?? স্যার আমার বই এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে মুচকি হেসে বললেন:
-হুম ওরকম ই তো বলেছেন।
-আর আমাকে কী দিবেন বলেছেন??
-সে জানিনা তবে আমি একটা লাল শাড়ি কিনে দেবো তোমাকে কথা দিলাম।
-কেনো?? আপনি কেনো দিবেন? আব্বু আপনাকে পাঞ্জাবী দিবে বললো তখন ই ঠিক করে ফেললেন যে তাহলে আপনি আমাকে লাল শাড়ি দিবেন?
-না আজ ই মনে হলো। লাল শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগবে।
আচ্ছা স্যার এভাবে বললো কেনো?? স্যারের কী আমাকে ভালো লাগে?? আমার পরিক্ষার যখন আর অল্প ক দিন বাকী তখন একদিন আম্মু ভালো মন্দ খাইয়ে স্যারকে বিদায় দিয়ে দিলেন। সেদিন খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার। স্যারের মনটাও খারাপ ছিলো। চশমার ভেতর দিয়েও আমি কষ্ট দেখেছি। আচ্ছা ঐটা কি ভুল ছিলো?? তারপর আমার পরিক্ষা হয়ে গেলো। স্যারকে পুরোটা সময় মিস করেছি।। মিস করেছি একজন পাঞ্জাবী পরা শান্ত পুকুরের মতো মানুষকে।
বেশ বুঝতে পারছি আমি ভালোবাসছি স্যারকে। এটা বলতেই হবে। জানাতেই হবে।আজ আমার পরিক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। পাঞ্জাবীওয়ালা এবার আব্বুর থেকে একটা পাঞ্জাবী পাবে। মানে ইন্টারমিডিয়েট টা পাশ করে ফেলেছি উইথ বেশ ভালো রেজাল্ট। আম্মু ফোন করে স্যারকে রেজাল্ট জানাতে চেয়েছে। আমি দিইনি। যদিও জানি স্যার আমার আগে জানবে। তবুও আম্মুকে বললাম স্যারকে রেজাল্ট টা আমি গিয়ে বলে আসি। আম্মু রাজি হয়ে গেলেন। আম্মুর হাতের পাঁয়েশ স্যারের প্রিয়। বললেন যাচ্ছিস যখন নিয়ে যা। হাত খরচের বেঁচে যাওয়া কিছু টাকা ছিলো। ভাবছি যাবার পথে স্যারের জন্য একটা শার্ট কিনে নিয়ে যাবো। স্যার তো বলেছিলো আমি কিনে দিলে শার্ট পরবে স্যার। আজ ই স্যারকে বলবো “শুনুন আজ থেকে আপনার সব শার্ট আমি কিনবো। আপনি আমার পাঞ্জাবীওয়ালা, তবুও মাঝে মাঝে শার্ট ও পরতে হয়, পরবেন।”
পুড়ো ডাইরীটা পড়ে ফেলেছে সাব্বির। এভাবে গল্পের মতো করে ডাইরী কেবল নীরুই লিখে। এত এত ডাইরী পড়েছে কখনো এরকম ডাইরী পড়েনি। ফোন এলো হসপিটাল থেকে। নীরুর জ্ঞান ফিরেছে। সে সাব্বিরকে দেখতে চাইছে। চট করে ওয়্যারড্রপ থেকে দুটো প্যাকেট বের করে হসপিটালের দিকে রওনা হলো। সাব্বির হসপিটালে পৌঁছে হাপাচ্ছে। চোখে মুখে রাজ্যের উৎকন্ঠা। নীরু ওর আব্বু আম্মুকে বাইরে যেতে বললো। তারপর হসপিটালের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো:
-স্যার !
-হুম।
-আমি আপনাকে ভালোবাসতাম।
-এখন বাসো না?
-এই প্রশ্নের উত্তর নেই স্যার। ওরা সব শেষ করে দিয়েছে!!
-এত সহজে শেষ হয়?
-তাইতো কঠিন ভাবে শেষ করলো।
-এই নীরু!! বোকা নাকি তুমি?? কি হয়েছে?? কাঁদে না। কিচ্ছু হয়নি। আমি তো আছি। এই যে দেখো, দেখো এদিকে আমি, তোমার পাঞ্জাবীওয়ালা।
-আপনি ডাইরীটা পড়েছেন?
-হুম।
-কিভাবে?
-ওটা তো সবসময় তোমার সাথেই রাখতে। সেদিন স্পট থেকে পুলিশ তোমার ভ্যানিটি ব্যাগ আর এই প্যাকেটটা পেয়ে আমাকে দিয়েছিলেন। ভ্যানিটি ব্যাগেই ডাইরীটা ছিলো।
-আপনাকে কেনো দিলো??
-তোমার মোবাইল থেকে লাস্ট কল টা আমাকে করেছিলে। তাই ওরা আমাকেই কল দিয়েছিলো। আমি ওখানে যাবার আগে তোমার আব্বু আম্মুকে জানিয়ে গিয়েছিলাম।
-পুলিশ কিভাবে জানলো??
-স্টুপিড গুলো যখন তোমাকে জোর করে ধরে ঐ পুরোনো বাড়িটাতে নিয়ে যায় একটা ছোট বাচ্চা দেখতে পেয়ে সাথে সাথে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ যতক্ষনে ওখানে গেছে ততক্ষনে…!
-থাক আর বলতে হবে না। আমি মনে করতে চাইনা সেই বিভৎস স্মৃতি।
-আমিও না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে তুমি বেঁচে আছো।
-কিন্তু একজন ধর্ষিতাকে….
-ধর্ষিতা আমাদের দেয়া একটা অপবাদ। এই কথাটা আর কোনদিন বলবেনা। ওরা ধর্ষক, ওরা অমানুষ, কিন্তু তুমি আমার নীরু। ধর্ষিতা বলে কিছু নেই।
-স্যার,, এত কিছুর পর ও আপনি আমাকে ভালোবাসবেন??
-আমি তো এত কিছুর আগে থেকেই তোমাকে ভালোবেসে বসে আছি। তোমার জন্য লাল টুকটুকে শাড়ি কিনে রেখেছি। এই যে দেখো! একটা প্যাকেট থেকে লাল টুকটুকে শাড়ি বের করে নীরুর গায়ের উপর ধরলো সাব্বির। কপালে হাত দিয়ে বললো:
-নীরু তোমাকে ভালোবাসি। হাটু গেড়ে বসে হয়তো বলতে পারলাম না। কিন্তু তাই বলে কী পাঞ্জাবীওয়ালা রিজেক্টেড??
-কিন্তু স্যার নীরুর মুখটা হাত দিয়ে আটকে কথা থামিয়ে দিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে সাব্বির বললো:
-চশমার ফাঁক দিয়ে হাজার বার দেখেছি তোমায়। তুমি বুঝতে পারোনি কারণ তুমি তখন ব্যস্ত ছিলে পর্যায় সারণীর ইলেকট্রন বিন্যাস নিয়ে। আমি তখন ঠিকি তোমার নাকের ডগায় জমতে থাকা ঘামের কণায় ভালোবাসার পারমানবিক সংখ্যা বের করে ফেলেছি। আচ্ছা এবার আমায় এটা বলোতো কিনতে গেলে শার্ট কিন্তু প্যাকেট খুলে দেখি পাঞ্জাবী, আর চিরকুটে লেখা “আমিও শার্ট কিনতে পারলাম না, চোখটা পাঞ্জাবীতেই আটকে গেলো”। আমি না হয় পাঞ্জাবী ফ্রিক তাই পারিনা। তুমি তো পারতে একটা শার্ট কিনতে, কেনো কিনলে না??
-কারন গল্পটা পাঞ্জাবীর!!! এখানে শার্টের প্রবেশ নিষেধ!!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত