অনুশোচনা

অনুশোচনা
খাতাটা হাতে নিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— তুমি এসএসসিতে কিভাবে এ প্লাস পেয়েছো আমায় একটু বলবে? কারণ অপর জনেরটা দেখে দেখে পরীক্ষা দিলে কোনরকম পাস নয়তো সর্বোচ্চ মোটামুটি একটা রেজাল্ট করা যায় কিন্তু কখনো এ প্লাস পাওয়া সম্ভব না। আজ ৫দিন ধরে তোমায় আমি একটা জিনিস বুঝাচ্ছি কিন্তু তুমি বারবার একই ভুল করছো। তোমার মাথায় কি গিলু বলে কিছু নেই নাকি পুরোটাই গোবর? তরী চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে বলবো,
– ভাইয়া, আমার দ্বারা পড়াশোনা হবে না। আপনি আপুকে একটু বুঝিয়ে বলবেন আমায় পড়াশোনা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে? ছাত্রীর মুখ থেকে এমন বেহায়া টাইপের কথা শুনে ইচ্ছে করছিলো কষে একটা থাপ্পড় মারি কিন্তু ইন্টারে পড়ুয়া মেয়ের গায়ে হাত তুলা উচিত হবে না। তাই আমি কিছু না বলে চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এমন মেধা শূন্য অভদ্র মেয়েকে আর পড়াতে যাবো না ৭-৮দিন পর তরীর বড় বোন তুয়া আপু আমাকে ফোন দিয়ে বললো আমি যেন উনার সাথে আজ বিকালে একটু দেখা করি। বিকালের দিকে যখন উনার সাথে দেখা করতে আসলাম তখন দেখি তুয়া আপু আর উনার স্বামী একসাথে বসে টিভি দেখছে। আমাকে দেখে তুয়া আপুর স্বামী বললো,
~ কি ব্যাপার তুমি পাশের বাসায় ঠিকিই পড়াতে আসো অথচ তুমি তরীকে পড়াতে আসছো না যে? আমি কিছু বলতে যাবো এর মাঝেই তুয়া আপু আমাকে বললো,
~ তোমার ডিমান্ড একটু বেশি থাকলে বলতে পারতে আমরা না হয় সামনের মাস থেকে তোমায় কিছু টাকা বাড়িয়ে দিতাম কিন্তু কিছু না বলে হুট করে পড়ানো বাদ দিয়ে দিয়েছো এটা তো ঠিক না আমি তখন তুয়া আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আপু, আমি খুব নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ঢাকা শহরে থেকে নিজের খরচ চালানোর পরেও আমাকে বাড়িতে সংসার চালানোর জন্য টাকা পাঠাতে হয়। যেহেতু পড়াশোনা শেষ হয় নি সেহেতু আমার টিউশানি করেই টাকা উপার্জন করতে হয়। আজ যদি তরী ফেল করে তাহলে কেউ কিন্তু আমাকে টিউশনির জন্য ডাকবে না। সবাই ভাববে আমি তরীকে ভালো করে পড়াতে পারি নি দেখে তরীর মত এ প্লাস পাওয়া ছাত্রী ফেল করেছে। বিশ্বাস করেন আপু আপনার বোনের পড়াশুনার প্রতি বিন্দু পরিমাণ মনোযোগ নেই আমার কথা শুনে তুয়া আপু আমায় বারবার অনুরোধ করলো আমি যেন তরীকে পড়ায়। এইবার থেকে তরী নাকি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর আমিও ইচ্ছে না থাকা শর্তেও রাজি হলাম আজ মাসের ৩ তারিখ। তরী যখন হলুদ খামটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
— মুরব্বিরা বলে, নিয়ম হলো টাকা সব সময় গুনে নেওয়া।এতে লজ্জার কিছু নেই খাম থেকে যখন টাকাটা বের করলাম তখন দেখি টাকার সাথে একটা কাগজ ভাঁজ করা। আমি অবাক হয়ে তরীকে বললাম, এটা কি? তরী মাথা নিচু করে বললো,
– আছে একটা জিনিস। আপনি মেসে গিয়ে তারপর একা পড়েন যে আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিলাম। জোরে একটা ধমক দিয়ে বললাম,
— একটা থাপ্পড় মারবো ফাজিল মেয়ে কোথাকার। নেক্সট টাইম এইসব চিঠি আমায় দিলে তোমার আপুর কাছে বিচার দিবো তরী কিছু বললো না। শুধু মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো আর আমি চিঠিটা ফেলে পড়াতে মন দিলাম গরমে অবস্থা খারাপ আমার। হাটুর উপর লুঙ্গি তুলে খালি গায়ে ফ্লোরে শুয়ে আছি। এমন সময় রুমমেট মামুন এসে বললো,
~কিরে, তলে তলে টেম্পু চালাস আর আমি বললে হরতাল? তুই তো দেখছি আগুনের সাথে প্রেম করিস। দেখিস বেশি কাছে যাস না পুড়ে যাবি আমি অবাক হয়ে বললাম,
— মানে কি?
~মানে কিছুই না৷ গেইটের বাহিরে তোমার গার্লফ্রেন্ড তরী তোমার খুঁজে দাঁড়িয়ে আছে  তরীর নাম শুনে আমি তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হলাম।
বাহিরে এসে দেখি তরী দাড়িয়ে আছে। গরমে ওর ফর্সা মুখটা হালকা গোলাপি বর্ণের হয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা ঘাম গুলোকে মনে হচ্ছে মুক্তার দানা। মেয়েটা সত্যি অসম্ভব রকম সুন্দর অথচ আগে কখনো খেয়াল করে দেখি নি। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো এই ফাজিল মেয়ে এইখানে কেন এসেছে। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,
— তুমি আমার মেসের ঠিকানা পেলে কি করে? আর এইখানে এসেছো কেন? তরী মাথা নিচু করে বললো,
– ঠিকানাটা অনেক আগে একবার বলেছিলেন। আচ্ছা আপনার কি কোন মেয়ে বান্ধবী কিংবা গার্লফ্রেন্ড আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কেন? তরী মাথা নিচু করে বললো,
– আমি আজকের রাতটা আপনার কোন বান্ধবী কিংবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে থাকতে চাই। কাল সকালেই আবার বাসায় চলে যাবো কথাটা শুনে ওর গালে কষে থাপ্পড় মেরে বললাম,
— চুপচাপ বাসায় যাও৷ তা নাহলে কিন্তু আরেকটা থাপ্পড় মারবো তরী গালে হাত দিয়ে চুপচাপ সামনের দিকে হেটে চলে যাচ্ছিলো আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগলাম অনেক হয়েছে আর সহ্য করতে পারবো না ১০-১২ দিন হয়ে গেছে আমি তরীকে পড়াতে যাই না। অবশ্য তুয়া আপু ফোন দিয়েছিলো আমি উনাকে সরাসরি বলে দিয়েছি আমি আর পড়াতে পারবো না। তবুও উনি আজ ফোন দিয়েছিলো কিন্তু আমি ফোন রিসিভ না করে ফেইসবুকে ঢুকলাম। অনেকদিন ফেইসবুকে ঢুকা হয় না।
আজ কি মনে একটু ফেইসবুকে ঢুকলাম। ইনবক্সে গিয়ে দেখি তরী sms করেছে। আমি ওর smsটা পড়তে লাগলাম, ভাইয়া, যে মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে সম্মান করেছি নিজের অভিভাবকের মত দেখেছি সেই মানুষটা যখন মাঝরাতে আমার বুকের মাংসপিণ্ড চেপে ধরে বলে, আমায় বাঁধা দিলে তোর বোনকে আর তোকে মেরে ফেলবো। সেই অমানুষের বাসায় থেকে কি পড়াশোনায় মন দেওয়া যায়? বাবা মারা যাবার পর মা খুব কষ্টে আমাদের বড় করেছেন। এসএসসিতে ভালো করার পর আপু আমাকে গ্রাম থেকে এইখানে নিয়ে আসে। এইখানে কলেজে ভর্তি করায়। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিক ছিলো কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারি দুলাভাই আমাকে একটু অন্য চোখে দেখে। মাঝে মধ্যে মজার চলে আমায় এমন কিছু কথা বলতো যা শুনে আমি খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে যেতাম।
আপুকে কিছু বললে আপু রেগে গিয়ে বলতো, “দুলাভাই শালীর সাথে একটু আধটু দুষ্টুমি করবে এটাই তো স্বাভাবিক “
মা যখন অসুস্থ হয়ে যায় আমিও আপুর সাথে গ্রামে যেতে চেয়েছিলাম অপু তখন আমায় সাথে নিয়ে যায় নি বরং আমায় বলেছিলো আমি যেন তিনবেলায় দুলাভাইকে রান্না করে খাওয়াই। আমি দুলাভাইকে ঠিকিই তিনবেলা রান্না করে খাইয়েছি কিন্তু তাতে দুলাভাইয়ের মন ভরে নি। তিন বেলা ভাতের সাথে তাকে অসংখ্যবার আমার শরীরের কাঁচা মাংসও খাওয়াতে হয়েছে। আমি বারবার এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি। ভাবতাম আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবো। আমি চিঠিতে আপনাকে এইগুলো লিখেছিলাম কিন্তু আপনি আমায় ভুল বুঝলেন।
সেদিন আপু আমাকে রেখে আবার গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলো। তাই আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম একটা রাত অন্য কোথাও থাকার জন্য কারণ এই নরপশুটা তা নাহলে আমায় আবার ছিড়েখুঁড়ে খাবে কিন্তু আপনি সেদিনও আমায় ভুল বুঝলেন। আমাকে সাহায্য করার মত কাউকে আমি পাচ্ছিলাম না তাই আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি বরাবরই আমায় ভুল বুঝেছেন। এখন শুধু একটা পথ খুলা আছে আর সেটা হলো তরী আর কিছু লিখে নি। তারমানে মৃত্যুই কি একমাত্র পথ। না আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম তরীকে বাঁচাতে হবে তরীর নিথর দেহটা ফ্লোরে পড়ে আছে। পাশে বসে তুয়া আপু কাঁদছে আর সোফায় বসে তুয়া আপুর স্বামী কাঁদছে। কেন জানি লোকটার কান্না দেখে হাসি পাচ্ছে। সেই হাসিটা ঘৃণার না অন্য কিছুর বুঝতে পারছি না। আমি উনার পাশে বসে বললাম,
— আপনি কেন কাঁদছেন? আর কচি মাংস খেতে পারবেন না সেই কষ্টে কাঁদছেন কি? আমার কথা শুনে তুয়া আপুর স্বামী চমকে গিয়ে বললো,
~মানে! আমি ঘৃণার হাসি হেসে বললাম,
— প্রতিদিন আপনার হাতে একটু একটু করে মরার থেকে একে বারেই মরে গেছে এটাই হয়তো ভালো হয়ছে
তুয়া আপুর সামনে বসে কানের কাছে আস্তে করে বললাম,
— আপনার চোখে যে ফেরেশতার মত অন্যের চোখে সে নর্দমার কীটের মতও হতে পারে।আপনি স্বামীকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য নিজের ছোট বোনকে রেখে গিয়েছিলেন। স্বামীর ভিতরের যৌনতা পূরণ করার জন্য পাতিতালয় থেকে যদি একটা পতিতা রেখে যেতেন তাহলে তরী আজ হয়তো বেঁচে থাকতো কালো পিচঢালা পথে হেটে যাচ্ছি আর ভাবছি তরীর মৃত্যুর জন্য আমিও সমান ভাবে দায়ী। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন শুধু আমার অনুশোচনা হবে একটা মেয়ে আমারে কাছে বাঁচতে চেয়েছিলো আর আমি ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত