দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে যাকে কোনোদিন মনে রাখার মতো একবিন্দু অসুস্থতা স্পর্শ করেনি, সে একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার স্ত্রী উঠোনটাকে ধোঁয়ার আখড়া বানিয়ে খড় দিয়ে ভাত জ্বাল দিচ্ছিল। চুলোর তিনটে ইটের একটা ঈষৎ নিচ হওয়াতে কাত হয়ে ছিল ডেকচি। সেটা সোজা করে বসানোর প্রচেষ্টা করতে করতেই চোখ গেল ক্লান্ত জানে আলমের দিকে। একদিন তীব্র ঝড়ে পড়ে যেতে থাকা কাঁঠালগাছকে সজোরে ঠেলে দাঁড়িয়ে থাকছিল যে-পুরুষটা সে নিষ্প্রভ চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। কাত করা ডেকচি সোজা করা হলো না। সাহেরা বানু ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা খটখটে চৌকিতে সোজা শুয়ে আছে। প্রথমতই জানে আলমের কপালে হাত গেল সাহেরার। কদিন ধরে খুক খুক কাশি বেড়েছে লক্ষ করেছে সে, কিন্তু কপালে জ্বরের চিহ্ন নেই। সামান্য কাশিতেই অবেলায় বিছানায় শোওয়ার লোক জানে আলম না। কপাল কুঁচকে আসে চিন্তায়।
কী হইছে আপনার? নির্জন ঘরের ভয়াবহতা চিরে সাহেরা স্বামীর মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে। কথা বলে না জানে আলম। সাহেরা আরেকবার জিজ্ঞেস করে। জানে আলম চোখ বুজে আছে। এবার সত্যিই সে ভয় পেয়ে যায়। স্বামী রাগী মানুষ, পুনরায় জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না তার।
পরদিন ভোরে স্বামীর একনাগাড়ে কাশির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সাহেরার। কাশতে কাশতে বিছানা থেকে কাত হয়ে মাটিতে ঝুঁকে পড়ছে জানে আলম।
সাহেরা ধড়ফড় করে উঠে বসে। মাটিতে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তিন ছেলে। সাহেরা অন্ধকারে দেশলাই হাতড়ায়। পেয়ে মাথার কাছের ছোট্ট খিড়কিটা খুলে দেয়। একঝলক ভোরের বাতাস হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে। সাহেরা স্বামীর মাথা চেপে ধরে মাটির দিকে তাকায়। ভয়ে হাঁ হয়ে আসে মুখ। ছেলেদের বিছানার পাশেই মাটিতে চাপচাপ রক্ত দলা হয়ে আছে। স্বামীর মাথা ছেড়ে ও বাজান গো… বলে শুরু করতে যায় সাহেরা। স্বামী থাম থাম চিল্লাইস না বলে স্ত্রীর শুরু হতে থাকা বিলাপ থামিয়ে পুনরায় কাশতে থাকে। কাঁথা সরিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে নেমে আসে সাহেরা। ছেলে তিনটাকে ঠেলা দেয়, ওই তোরা উঠলি? ওই কালাইম্যা, একটু হরি ডাকতররে খবর দে, ওই আমিইরা…।
আমির-কালাম দুজন উষ্মা প্রকাশ করতে থাকে। সাহেরার চিৎকার বাড়ে, কিরে বাপটা মইরা যাইতাছে তোরা উঠলি?
ঘুমঘুম কণ্ঠে তেতে ওঠে আমির, যা ভাগ পারুম না।
ভোরের মিষ্টি হাওয়া ছিন্ন করে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে জানে আলম – কুত্তার বাচ্চারা বাইর হ বাড়ি থাইক্যা।
তার চিৎকারে ঘরের শিকা কেঁপে ওঠে। খিড়কি মেঝেসহ শরীরও একবার কেঁপে থেমে যায়। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠল তিনটে ছেলে। বাপকে তারা যমের মতো ভয় পায়। ঘুমজড়ানো চোখে আতঙ্ক। মায়ের ফ্যাকাশে কুঁচকানো মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তারপর মেঝের দিকে। এ-কাজের গুরুত্ব ওদের হাড়ের ভেতর ঢুকে গেছে ততক্ষণে। ফলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ওদের পড়ে যেতে থাকা হাফপ্যান্ট কোমরে উঠাতে উঠাতে ছোটে আমিরও। পিচ্ছি মহসীন দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু বাবার চোখের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না সে। দৌড়ে নেমে গেল। ততক্ষণে আবার কাশি শুরু হয়েছে জানে আলমের।
ডাক্তার ওষুধ দিয়ে যায়। কিন্তু পরদিন সুস্থ-সবল জোয়ান পুরুষটার শরীর ক্রমেই নেতিয়ে আসতে থাকে। বাড়িতে একটা অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মাটির মেঝে থেকে ত্যানা দিয়ে রক্ত সাফ করতে করতে ফুঁসফাঁস করে কাঁদে সাহেরা। আর চৌকি থেকে ক্লান্ত চোখ মেলে উঠোনের পেয়ারা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে জানে আলম। যেখানে তার দুধেল গাইটা বাঁধা আছে, অত অসুস্থতার ভেতরও বুকের ভেতরটা একরাশ প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। সে অসুস্থ হওয়ার পরদিন থেকে ওটাকে পেয়ারা গাছেই বেঁধে রাখা হয়। ঘর থেকে সোজা সেখানে চোখ যায় জানে আলমের, গাইটার দিকে তাকালে সে সমস্ত কষ্ট এবং অসুস্থতার কথা ভুলে যায়।
গ্রামের মানুষ পরামর্শ দেয় – শহরে গিয়া ভালা ডাকতর দেখাও গা মিয়া।
শহরের কথা শুনে অজপাড়া গাঁয়ের জানে আলম একটা ভৌতিক স্বপ্ন দেখে। জীবনে কোনোদিন সে শহরে যায়নি। শহর তার কাছে একটা ভুতুড়ে রহস্য। যেখানে গেলেই মানুষ মরে যায়।
এই একটা অহেতুক চিন্তার জন্য গ্রামের বিজ্ঞ-আধা বিজ্ঞ লোকদের কম টিপ্পনী শোনেনি জানে আলম। কিন্তু সে ওসবকে আমল না দিয়ে নিজের পরিবারের ভেতরও শহরের ভৌতিক পরিবেশকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে উঠোনের দিকে চেয়ে থাকে জানে আলম। একপাল মুরগিকে কক কক করে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সাহেরা। বড় ছেলে কালাম বোকামতোন, গাইয়ের দড়ি খুলছে গোয়ালঘরে নিয়ে যাবে বলে। আমির দুহাতে বাছুরটাকে চেপে ধরে আছে। কদিন ধরে সকালে দুধ বিক্রির টাকাটা হরি ডাক্তারের কাছে চলে যাচ্ছে। জানে আলম নিজেও ভেবে পায় না, কীভাবে দুটো খেতে পাচ্ছে সে। ঘুম থেকে উঠেই সাহেরা তার ভেঙেপড়া শরীরটা হেলিয়ে-দুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শাকটা, লতাটা কুড়িয়ে দুপুর নাগাদ ঘরে ফেরে সে। ততক্ষণ প্রচন্ড নির্জনতার ভেতর ডুবে থাকে জানে আলম। নিজের কাশির শব্দ ছাড়া কিছুই কানে আসে না তার। মা না থাকলে ছেলেগুলোও পারতপক্ষে ঘরে আসে না। বাবার সামনে কিছুতেই সহজ হতে পারে না তারা।
ঘরে কুপি নিয়ে এসেছে সাহেরা। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে জানে আলমের। কুপির আলোয় স্ত্রীর বিবর্ণ মুখ দেখল সে! কুপি রেখে সাহেরা তার কম্পিত হাত জানে আলমের বুকের ওপর চেপে ধরে। মমতায় ভরে যায় জানে আলমের বুকটা। স্ত্রীর ভেঙেপড়া শরীর এবং চেহারা নিয়ে যে কষ্টটা এতদিন বুকের ভেতর ছিল, সন্ধ্যার ছায়ায় তো নিমেষেই উঠে যায়। সে স্নেহের গলায় ডাকল সাহু তর চিন্তা হয় না রে?
প্রথমে বিস্ময়ে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে সাহেরা। অপরিচিত কারো গলা শুনছে না তো? লোকটার সেই তেজি গলা কই? একটা আশঙ্কায় পুনরায় কেঁপে ওঠে সাহেরা। তারপর মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে ওঠে। কী কথা বলতে চেয়ে আবার কাশতে শুরু করে জানে আলম। তার চোখ দুটো ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। সাহেরা হঠাৎ কঠিন স্বরে বলে ওঠে, কাইলই আপনি শহরে যান। এইখানে থাইক্যা মরবেন নাকি?
ভৌতিক ছবিটা আক্রমণ করে জানে আলমকে। এক গাদা গাড়ি ছুটছে এবং শত শত মানুষ পিষে যাচ্ছে সেই গাড়ির তলায়। সে স্ত্রীর দিকে কঠিন চোখে তাকায়। তুই আমারে মাইরা ফালতে চাস?
স্বামীর দেওয়া ধারণায় প্রভাবিত হয়ে চুপ মেরে যায় সাহেরা। হাতের ওপর লেপটে থাকা ফাটা প্লাস্টিকের চুড়িটা সে বাইরে ছুড়ে ফেলে। এই সময় এসব অকল্যাণকর ফাটা জিনিস না পরাই ভালো।
খড়মে খটাস খটাস শব্দ তুলে পাশের বাড়ির আববাস আলী আসে। মাথায় কাপড় টেনে জলচৌকি এগিয়ে দেয় সাহেবা। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে জানে আলমের। আববাস আলীর অসংলগ্ন কথা তার কানে গেল না। আববাস আলী জানে আলমের ডান হাতে একটা তাবিজ বেঁধে দিতে দিতে বলল, হরি ডাকতরের ওষুধ খাইয়া কেউ কোনোদিন ভালো হইছে? তুই তো দিনে দিনে বিছানার সঙ্গে মিলা যাইতাছস আলইম্যা। বাঁচপার যদি চাস তো শহরে যা। দেখলি না গতবার শহরে গিয়া উত্তরপাড়ার মীনু মিয়া কেমন মরণের মুখ থাইকা ফিইরা আইছে?
বুড়ো লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আশার আলো দেখতে পায় সাহেরা। সে-ই উন্মুখ হয়ে তারপর জানে আলমের দিকে তাকায়। কুপির আলোয় তার জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকা বুকটাকে ভয়াবহ দেখায়।
আমার অসুখ এমনিই ভালা হইব – চিরাচরিত সাহসী গলায় বলল জানে আলম, তাছাড়া শহরে যামু টাকা কই?
এতক্ষণে সাহেরার চোখের সামনে ভয়ংকর একটা কালো পর্দা এসে পড়ে। তাই তো। মূল সমস্যাটাই তো এদ্দিন তার মাথায় আসেনি। এদিকে দুটো ভাত মুখে দিতে ধারদেনা করে চারদিক ভরিয়ে ফেলছে সে।
হতাশায় বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সে তার বলিষ্ঠ শরীরের স্বামীর ফুরিয়ে আসতে থাকা দেহের দিকে তাকিয়ে উঠোনের দিকে এগিয়ে যায়। কালাম শাক সেদ্ধ করছে। সে একমনে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খড়ের আগুন উস্কে দিচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজায় পা রাখে সাহেরা। তখুনি আববাস আলীর গলা শোনা যায়, তোর গাইটা বেইচা দে।
ভয়ে কেঁপে ওপে সাহেরা। এই বুঝি তার স্বামী চিৎকার করে উঠল। সে ঘুরে দাঁড়াল। বিস্ময়ে জমে যায় সে – জানে আলম হাসছে। কাশলে যেমন তার বুক ওঠানামা করে, হাসির দমকেও তেমনই হচ্ছে। সে ক্লান্ত চোখে আববাস আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, পাগলা আর কারে কয়? এইটা বেচলে পরিবারসুদ্ধা খামু কী?
স্নেহের দিকটা বাদ দিয়ে যুক্তির খাতিরেই বাস্তব সমস্যাটাকে প্রাধান্য দেয় জানে আলম। উঠে দাঁড়ায় আববাস আলী। তুই বাঁইচ্যা থাকলে এই রকম হাজারটা গাই আইব।
তুই মরলে, একটা গাইয়ের দুধ দিয়ে তোর এক পোলারও ভরণপোষণ হইবো না।
কথাটা মনে ধরে সাহেরার। এসব কোনো কথাই জানে আলমের কানে গেল না। তার গলা দিয়ে তখন ঘড় ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে। আববাস আলী বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে যায়। ভীষণ জোরে জোরে কাশছে জানে আলম। তার গাল গড়িয়ে লালাসহ রক্ত বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে এসে তার মাথা চেপে ধরে সাহেরা। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে ওঠে, ওরে কে আছসরে : হরি ডাকতররে…।
প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। চুলো রেখে দৌড়ে আসে কালাম। ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে জানে আলম। তিনটা ছেলে পাল্লা দিয়ে চিৎকার শুরু করে।
পরদিন দুপুরের দিকে সবার দিকে স্পষ্ট করে তাকাল জানে আলম। তারপর উঠোনের দিকে। ভয়ে জমে আছে সাহেরা। বিস্ময়ভরা চোখে খালি পেয়ারা গাছটা একবার দেখে বউয়ের দিকে তাকায় জানে আলম, বউ বলল, বেইচা দিছি।
নিষ্প্রভ হয়ে আসে জানে আলমের চোখ।
সে শ্বাস টেনে টেনে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, আর তো কিছু করলি না। আমার মরণটা আগায়া আনলি।
এরপর থেকে সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো জানে আলম। নিঃশব্দে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে সে উঠোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। গাইয়ের বিনিময়ে শহর? যে-শহরের কথা ভাবলেই অজানা রহস্যে শরীর জমে আসে? সাহেরা জানে আলমের পায়ের কাছে মাথা ঠুকে, আপনি কথা কন। আপনি ভালা হইলে কত গাই আইবো? কথাটা বলে নিজেই ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হয় সাহেরা। কতদিনের পুরনো গাই। জানে আলমের কত যে আদরের। প্রথমদিকে এই নিয়ে কত ঝগড়া হতো। সাহেরা গাল ফুলাতো, আমার চেয়ে গাইটাই আপনার কাছে বড়। সেই সাহেরার মুখে এই কথা মানায় না। সে ধীরে ধীরে জানে আলমের কাছ থেকে উঠে যায়। আজ দুপুরে ভাত চড়েনি হাঁড়িতে। ছেলে তিনটের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
একটা খাটিয়ায় জানে আলমকে শুইয়ে গ্রামের চারজন লোক শহরের দিকে রওনা হয়। খাটিয়ায় এভাবে স্বামীকে শায়িত অবস্থায় দেখে একটা ভয়ংকর দৃশ্য যেন দেখল সাহেরা। সে হঠাৎ এমন বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠল, মনে হলো তার স্বামীকে শহরে না নিয়ে গোরস্তানে নেওয়া হচ্ছে।
সাহেরার চিৎকার জানে আলমের কানে এলো। সে ক্লান্ত চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। পেছনে সবুজ ঘাস। দূরে বহুদূরে জানে আলমের ঘরটা। তার মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটা আকাশে ঢেকে গেছে। এবং সে তার স্মৃতি এবং বড় ভালোবাসার গ্রাম ছেড়ে মহাশূন্যে নির্বাসনে যাচ্ছে। গাইটার কথা মনে হতে এতক্ষণে চোখের কোণে ভিজে যায় জানে আলমের। আমার ফিইরা আইসাই কী লাভ? জানে আলম ভাবে। আমার দুনিয়াটা তো আর আগের মতো রইল না।
ঝাঁকুনিতে তার স্থির শরীর কাঁপছে। একটা অজানা যন্ত্রণা শরীরে ভর করছে। ঘন ঘন শ্বাস নেয় জানে আলম। আমি তো পূর্ব গাঁয়ের ধলা মিয়ারে চিনি – জানে আলম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভেবে কেঁপে ওঠে। যার কাছে গাই বেচা হইছে। আমি কোনো দিন কোনো অসৎ কাম করি নাই। ভালা হইয়া আইসা আমি একটাই পাপ করমু জীবনে। যেন পাপটা এমনিই সে করছে, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে জানে আলম – আমি গাইটা চুরি কইরা আনুম, তাহলেই আমার দুনিয়াটা আগের মতো হইব।
কিন্তু শহর? অসংলগ্ন চিন্তা ভর করে জানে আলমের মাথায়। জানে আলম যখন জোয়ান পুরুষ তখন সে শহরে চাকায় পিষ্ট হওয়া একটা লাশ দেখেছে। পাশের বাড়ির একটা ছেলে শহরে পড়ত। সেই অনুভূতিটা তার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
তারা বিড়বিড় করে কী যেন পরামর্শ করে। জানে আলম তার আজীবন বুকে পোষা ভৌতিক শহরকে দেখায় আশায় মাথা উঁচু করতে চাইল। কিন্তু ক্লান্তিতে পুনরায় ঢলে পড়ল সে। চারদিকে শব্দ আর শব্দ। জানে আলমের মনে হয় চারপাশের বড় বড় দালান হুড়মুড় করে তার ওপর ভেঙে পড়ছে বুঝি। ভয়ে-উত্তেজনায় কাঠ হয়ে থাকে সে। কান পেরিয়ে শব্দগুলো বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসে জানে আলমের। জানে আলম দেখল তার দুধেল গাইটা পেয়ারা গাছের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, সাহেরার উদাস চোখ দাওয়ায়। জানে আলম মুহূর্তেই সমস্ত শব্দের ঊর্ধ্বে চলে যায়।
লোক চারজন কুশল জিজ্ঞেস করে খাটিয়া মাথায় তুলে নেয়। চারপাশে সন্ধ্যা নেমে গেছে ততক্ষণে।
একটা খুপরির মতো স্যাঁতসেঁতে হোটেলে এসে ওঠে ওরা। চারপাশে ভয়াবহ গন্ধ আর লোকজনের খুটখাট শব্দ। লোক চারজন জানে আলমকে বিছানায় শুইয়ে অন্য বিছানায় তাস নিয়ে বসল। জানে আলম পানের পিকওয়াল দেয়াল দেখে। পলেস্তারা উঠে পড়া ছাদ দেখে, মশারি দেখে। হঠাৎ তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। চারজন লোক হই হই করছে, আরে শালা আমি গেলোবার যখন শহর আইছিলাম…। ওদের চুরুটের ঝাঁঝাল গন্ধ এসে জানে আলমের মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দেয়। হঠাৎ তার কাশি শুরু হয়। ওরা তাস পেটাচ্ছে, আরে বুঝলি আমার বউ…। জানে আলমের কাশি বাড়তে থাকে। চারপাশের ঘরদোর উল্টাপাল্টা ঘুরতে শুরু করে। ওরা বলছে, আরে তখন কলিম শেখ লেঙ্গুর তুইলা দে দৌড় হাঃ হাঃ। জানে আলম দেখে ওপরের ছাদটা তার বুকের ওপর উঠে আসছে। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে কেশে ওঠে সে। লোক চারজন সচেতন হয়ে দৌড়ে আসে। দলাদলা রক্তে মেঝে ভেসে যায়। ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, পেরাইভেট ডাকতর কাম নাই – চল হাসপাতালে লইয়া যাই। আলস্য গ্রাস করে আরেকজনকে। কলিম শেখ হাসপাতালে নিতে বারণ করছে, ওই হানে মানুষ মরে। কাশি থেমে যায়। ওরা নিজেদের জায়গায় ফিরে আসে। একটা প্রচন্ড কাশি এসে জানে আলমের গলায় আটকে যায়। জানে আলম লক্ষ করল, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আবারো চুরুটের ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে আসে।
চারজন তখন তুঙ্গে – আরে খোদেজারে দেইখ্যাই আমার মাথা গেল ঘুইরা।
ছাদটা বুকের ওপর নেমে আসছে। দাওয়ার ওপর সাহেরার উদাস দৃষ্টি। কক কক করে সন্ধ্যার মুরগি ঘরে তোলে সাহেরা। উঠোন ভরে গেছে ধোঁয়ায়। ছেলে তিনটা উদম দাঁড়িয়ে থাকে। প্রচন্ড ঝড়ে কাঁঠালগাছ চেপে ধরে জানে আলম। গলায় শব্দ হয় না। তার বোবা দৃষ্টি উজ্জ্বল করে দড়ি ছিঁড়ে ছুটে আসতে থাকে একটা দুধেল গাই।
পরদিন চারজন আবার খাটিয়া তুলে নেয়। সমস্ত পথ তাদের কাটে বিভিন্ন গল্পে। চেম্বারে এসে তারা জানে আলমের স্থির শীতল হয়ে আসতে থাকা শরীরটাকে টেনে তোলে। টিকিট দিয়ে ঢুকে যায় চেম্বারের ভেতরে।
চারজন লোক শুইয়ে দেয় জানে আলমকে। টেলিস্কোপ নিয়ে এগিয়ে আসে ডাক্তার। এবং ডাক্তারের বিচলিত চেহারার দিকে চারজন লোকই একসঙ্গে তাকায়।
ডাক্তার বলে, বড় দেরি করে ফেলেছো তোমরা… আমার আর করার কিছু নেই। টেস্ট দিলে টাকার অপচয়ই হবে। রোগী দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। তাদের স্বাভাবিক চেহারা বিবর্ণ হয়ে আসে ক্রমশ।
জানে আলম তার ফুরিয়ে আসা দম নিয়ে স্পষ্ট দেখে, শত শত গাড়ি এসে দুধেল গাইসহ তাকে বিরাট রাস্তার মাঝে পিষে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে।