চাঁদ সদাগরের সাতমহলা বাড়িতে আজ সাজ-সাজ রব। যমলোক থেকে বেহুলা ফিরে এসেছে প্রাণাধিক পতি লখিন্দরকে সঙ্গে নিয়ে। ইন্দ্রের সভায় যখন পা দিয়েছিল বেহুলা, তার কোলে ছিল লখিন্দরের কঙ্কাল। আজ লখিন্দর ফিরে পেয়েছে তার জীবন, তার কন্দর্পকান্তি। লোহার বাসরঘরে যাকে একবার চোখের দেখা দেখেই মনপ্রাণ যার পায়ে সঁপে দিয়েছিল বেহুলা সুন্দরী, সেই সোয়ামির সঙ্গে আজ তার বাসর যাপন হবে।
শুধু কি লখাই? বেহুলা যমলোক থেকে ফিরিয়ে এনেছে চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্রকেও। ফিরিয়ে এনেছে লখাইয়ের প্রাণের বন্ধু শঙ্কর গাড়ুড়িকে। শঙ্করের আরেক নাম বিষহরা ধন্বন্তরি। সে থাকলে লখাইকে কোনো সাপের বিষ দিয়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। যে-সাপই দংশন করুক না কেন, সেই বিষ নামিয়ে ফেলা শঙ্কর গাড়ুড়ির বাঁহাতের খেল। প্রথমে শঙ্করের জন্য বিষ-মেশানো দই পাঠিয়েছিল মনসা। দই খেয়ে ঢেঁকুর তুলে মৃদু হেসেছিল শঙ্কর। এরপর মনসা পাঠিয়েছিল বিষ-মাখানো ফুলের তোড়া। নিশ্বাসের সঙ্গে বিষ গেলে নিশ্চয়ই শঙ্কর বাঁচবে না। কিন্তু কিছুই হয়নি শঙ্করের। শেষে শঙ্করের বউ কমলার কাছ থেকে কৌশলে মনসা জেনে নিয়েছিল যে, একমাত্র যদি শঙ্করের ব্রহ্মতালুতে তক্ষক দংশন করতে পারে, কেবল তাহলেই মৃত্যু ঘটবে তার। সেই কৌশলে কাজ হয়েছিল। তক্ষক কামড় দেওয়ার পর বিষহরা ধন্বন্তরি যাতে নিজের চিকিৎসা নিজে করতে না পারে, সে-কারণে মনসা আগেই শঙ্করের ওষুধের ঝোলা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই শঙ্কর গাড়ুড়িকেও যমলোক থেকে ফিরিয়ে এনেছে বেহুলা।
বেহুলার কথায় চাঁদ সদাগর পূজা দিয়েছে মনসা দেবীকে। এমন পুত্রবধূর কথা কে ফেলতে পারে! চাঁদ বেনে আগে মনসার নাম উঠলেই গালি দিয়ে বলত –
ধামনা-ভাতারি তোর হিতাহিত নাই।
আমি তোর দেবকুলে ভাঙ্গিব বড়াই।
এমনকি ঠ্যাঙ ভেঙে দেওয়ার জন্য সে একবার হেন্তালের লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল মনসাকে। পালিয়ে বেঁচেছিল মনসা।
আজ পুত্রবধূর কথায় সেই ‘চ্যাংনী’, কানি’ মনসাকে পুজো দিয়েছে চাঁদ বেনে। তবু সদাগর মন থেকে মেনে নিতে পারেনি মনসাকে। পূজার সময় ফুল-বেলপাতার নৈবেদ্য দিয়েছে বাঁহাতে।
এবার আর লোহার ঘরের দরকার নেই। বাসর হবে জলটুঙি মহলে। পদ্মদিঘির মধ্যে জলটুঙি মহল। দূর থেকে দেখে মনে হবে, জলে ভাসমান এক হংসপ্রাসাদ।
এতদিন আলো জ্বলেনি চাঁদ সদাগরের সাতমহলা বাড়িতে। জীবনের সাড়া বলতে ছিল কেবল কান্নার শব্দ। দিন-রাত কান্না। পুত্রশোকে কেঁদে জার জার লখাইয়ের মা। তার বুকফাটা কান্না। এমন কান্দন দেখে কে পারে নিজের চোখের জলে বাঁধ দিতে। কেঁদেছে আত্মীয়-স্বজন, যত পুরনারী-পুরুষের দল। কেঁদেছে চোতমাসের রোদে শুকানো মাটি, পাতা-নাচানো গাছপালা, এমনকি কাকপক্ষীও।
সেই কান্না মুছে গিয়ে আজ হাসি ফিরে এসেছে মহলে মহলে। যেন ঢেকে রাখা সুরুজ ফের মুখ দেখাতে এসেছে মেঘের পর্দা ফালা ফালা করে কেটে ফেলে।
চাঁদ সদাগরের মহালে মহালে শতেক দাসি-বান্দি। তবু পতির জন্য শত ব্যঞ্জন রাঁধতে বসেছে বেহুলা নিজেই। লখাইকে তো চেনেই না বলতে গেলে। জানে না কী তার পছন্দ আর কী অপছন্দ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে শাশুড়ির কাছ থেকে। তারপর ঢুকেছে হেঁসেলঘরে।
সূর্য মাথার ওপরে ওঠার আগেই যত ব্যঞ্জন, পায়সান্ন, পরমান্ন – সব রন্ধন শেষ।
এবার বেহুলা বাসররাতের জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করতে শুরু করে। আগেরবার লোহার বাসরে স্বামীকে মনভরে দেখার সুযোগ হয়নি তার। মনসার মন্ত্রে নিদ্রা এসে তাদের বেভুল করে দিয়েছিল। তবে স্বামীর রূপের বর্ণনা শুনেছে সে। যমলোকে দেখা হয়েছিল সুতানাগিনীর সঙ্গে। সে-ই দংশন করেছিল লখিন্দরকে। মনসার আদেশে তাকে এ-কাজ করতে হয়েছে বলে সে ক্ষমা চেয়েছিল বেহুলার কাছে। সেই নাগিনীই বেহুলাকে শুনিয়েছে বালা লখিন্দরের সৌন্দর্যের কথা –
নাগিনী বোলে কর্ম্ম করিনু দারুণ।
বালার রূপ দেখি মোর জ্বলিছে আগুন \
শত চক্ষু হয় জদি দেখি রূপখানি।
কেমত দংশিব বালাক আমি দুচারিণী \
মুখ যেন চন্দ্রমা খঞ্জন দুই চক্ষ।
বাহু যেন মৃণাল নাসিকা শুক্লপক্ষ \
গন্ধবর্ব সমান রূপ দেখি নাগে দয়া।
কেমত দংশিব বালাক নিদারুণ হয়া \
বেহুলা জানে, নাগিনীর কথায় একটু অতিরঞ্জন নেই। প্রথম বাসরঘরে কালঘুমে ঘুমিয়ে পড়ার আগে যতটুকু দেখেছিল পতিকে, তার রূপের কাছে নিজেকে বড়ই নিষ্প্রভ ঠেকেছিল তার। নিজের রূপ নিয়ে কিশোরীকাল থেকেই বড়াই ছিল বেহুলার। যে-ই তাকে দেখেছে সে-ই বলেছে, তিনকুলে এমন রূপবতী নারী আর একজনও নেই। পুরুষমাত্রই কামার্ত-মুগ্ধ হয়ে পড়ত তাকে দেখে। কিন্তু সেই বেহুলাও বাসরঘরে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল লখিন্দরকে। কী রূপ! হাঁটার কী পুরুষালি ছন্দ! দৃষ্টিতে যেন বিশ্বজয় করার আত্মবিশ্বাস।
আজ সেই স্বামীর কাছে নৈবেদ্য হিসেবে নিজেকে অর্পণ করবে বেহুলা। মনে ভীতি। তাকে কি উপযুক্ত মনে হবে লখাইয়ের? প্রাণাধিক পতির চোখের দৃষ্টিতে যদি এমন আভাস ফুটে ওঠে, যাতে বোঝা যায় বিন্দুমাত্রও কমতি আছে বেহুলার মধ্যে, তখন সে আঘাত কেমন করে সইবে বেহুলা?
সখি-বান্দিদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে অর্গল আটকে দেয় বেহুলা। নিজেকে দাঁড় করায় দেয়ালজোড়া প্রতিবিম্বকের সামনে। তারপর একের পর এক বসন সরিয়ে উন্মুক্ত করতে থাকে নিজেকে। অনেকবার এভাবে নিজেকে দেখে সে। কিন্তু নিজেকে আজ সে দেখছে পরীক্ষকের দৃষ্টিতে। দেখতে চাইছে লখিন্দরের দৃষ্টিতে। কোনো ঘাটতি, কোনো কমতি আছে কি বেহুলার দেহবল্লরীতে?
নিজের ঝলমলে কালো বন্যার মতো কেশরাশি, ছোট উপত্যকার মতো মাঙ্গলিক কপাল, টিকালো নাকের ছাঁদ, নিভাঁজ কোনো দাগহীন গাল-কপোল, মরালের ঈর্ষাজাগানো গ্রীবা বেয়ে চোখ নেমে আসে দুই দড়িম্বফলের দিকে। শরীরের গঠনের সঙ্গে মানানসই উঁচু দুই স্তন। সুউচ্চ, কিন্তু বিন্দুমাত্র হেলে পড়া নয়। বুকপেট-তলপেট ভেলভেটের মতো মসৃণ। নাভির গর্ত সুগভীর সুছাঁদ। নাভিতে পদ্মছাপ। ত্রিভুজ আর কদলিবৃক্ষের মতো দুই ঊরুর নিখুঁত জ্যামিতিক মিলন।
নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার পর কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয় বেহুলা। নিজেকে অভয় দিতে চায় এই বলে যে, প্রথম দৃষ্টিপাতে লখাই অন্তত তার দেহবল্লরীকে ত্রুটিপূর্ণ বলে কটাক্ষ করবে না।
এবার জলটুঙির মহলে বাসরযাপনের জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করতে মনোযোগী হয় বেহুলা।
দুই
কিন্তু রাতের প্রহরের পর প্রহর কেটে গেলেও লখিন্দরের পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না।
সখি-বান্দিরা, ছয় জা, পড়শি ননদিনীরা বেশ আগেই বিদায় নিয়েছে বাসরঘরে বেহুলাকে একলা রেখে। যে-ই লখিন্দর পা রেখেছে জলটুঙি মহলে, সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে তারা মহল খালি করে। মহলে অন্য কোনো জন-মনুষ্য নেই। শুধু পদ্মদিঘির পাড়ে পাড়ে গদা-কৃপাণ-ষষ্টি হাতে চাঁদ সদাগরের খাস পালোয়ানের দল প্রহরারত। তারা চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে, হাঁক দেয়, কেউ কেউ আলোয় আলোময় জলটুঙি মহলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুই-এক পদ গীত গেয়ে ওঠে।
বাসরঘরে পিলসুজের আলো। এই ঘরের নাম পরল-ঘর। অনেক ঘরের পরল দিয়ে ঘেরা। অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে তারপর ঢুকতে হয় এই ঘরে। ঘরগুলোর দরজা-জানালা এক সারিতে নয়। বাসরঘরের দরজা-জানালা যেখানে, তার পরের পরল ঘরের দরজা-জানাল তার থেকে ছয় হাত ডাইনে ডাইনে। তাই বাসরঘরের সবগুলো দরজা-জানালা খোলা থাকলেও, ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বললেও, বাইরে থেকে কেউ কিছুই দেখতে পাবে না। জলটুঙির সিঁড়ির ধাপে অন্যদিন পাহারা থাকে। আজো পাহারা আছে। না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। কারণ আজ সিঁড়ি খুলে ফেলা হয়েছে লখিন্দর মহলে পৌঁছানোর পর। তাকে আসতে দেখে সখি-বান্দি-নফরের দল বিদায় নিয়েছে তৎক্ষণাৎ। মহলের ঘরে ঘরে রাখা আছে খাদ্য-বস্ত্র-জড়ি-বুটি। চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সবকিছু। শুধু হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। অন্যদিন হুকুম তামিল করার জন্য কয়েকজন বাছাই করা নফর-দাসী রাখা হয়। আজ লখিন্দরের ইচ্ছাতে পুরোপুরি খালি করে দেওয়া হয়েছে জলটুঙি মহল।
ফুলের বিছানায় বধূ সেজে বসে আছে বেহুলা সুন্দরী। একের পর এক আকাঙ্ক্ষার পল কেটে যাচ্ছে। তারপর প্রহর। এখন তার কাছে একটা নিমেষকেও একটা যুগের অপেক্ষার সমান মনে হচ্ছে। কিন্তু আসছে না কেন প্রাণাধিক পতিবালা লখিন্দর! এতদিনের সাধনার পর একটা মুহূর্তও আর মিছা কাটতে দিতে চায় না বেহুলার মন।
কিন্তু বাসরে প্রবেশিছে না কেন স্বামী?
আর অপেক্ষা সয় না। যে নারী স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য কলার ভেলায় পাড়ি দিতে পেরেছে শত শত রশি নৌপথ, যে-নারী নাওয়া-খাওয়া ভুলে পথশ্রমের কথা ফুলে পাড়ি দিয়েছে মাসের পর মাসের পথ, যে-নারী যমলোকে ঢুকেছে, ইন্দ্রপুরীতে ঢুকেছে, সেই বেহুলা আজ বাসরের পালঙ্ক থেকে পা নামাতেও যেন পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও একবিন্দু জল পান করতেও পারছে না। বাসরঘরে বসে স্বামীর আগে কোনো কিছু খাওয়া তো কুলক্ষণার কাজ। বেহুলা কেমন করে করতে পারবে সেই কাজ!
রাত কত হলো? বেহুলা কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু প্রহরের শেয়ালের ডাক শুনে বুঝেছিল যে অনেক রাত হয়ে গেছে। অপেক্ষার ক্লান্তিতে তার সমস্ত মন এখন ভারি। সে কি ঘুমিয়ে পড়বে? এ-কথা মনে আসতেই নিজেকে ধিক্কার দেয় বেহুলা – মুখে আগুন ওই রকম ঘুমের!
কিন্তু বালা লখিন্দর কী করছে বাহির-মহলে? হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে বেহুলা। কোনো বিপদ-আপদ ঘটেনি তো স্বামীর?
এবার আর বসে থাকতে পারে না বেহুলা। নেমে আসে পালঙ্ক থেকে। বেরিয়ে আসে বাসরঘর থেকে।
একেবারে শেষের পরল-ঘরে কেদারায় হেলান দিয়ে দিঘির জলের দিকে চোখ বিছিয়ে বসে আছে লখিন্দর। তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে পাথর নেমে যায় বেহুলার। আহ! স্বামী তার সুস্থ আছে, অক্ষত আছে। পরক্ষণেই ভারি হয়ে ওঠে বুক। স্বামীকে এত উদাস দেখাচ্ছে কেন?
আজ রাতে তো লখিন্দরের থাকার কথা চরম উৎফুল্ল। থাকার কথা কামনা-কাতর। থাকার কথা যে-নারীশরীর অচেনা তার কাছে, সেই ভূগোলের সঙ্গে পরিচয়ের অজানা আগাম শিহরণ। তার জন্য বরাদ্দ জমিতে লাঙলের ফলা প্রবেশ করানোর অধীর আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু তার পরিবর্তে স্বামীকে এমন বিষণ্ণ চিন্তাকুল দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে বেহুলার। যে-বেহুলা স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য নির্ভয়ে পাড়ি দিয়েছে হাজার হাজার বিপদের অরণ্য, সেই বেহুলা স্বামীর মুখে এমন অলক্ষুনে রেখার আঁকিবুঁকি দেখে থরথর করে কাঁপে দেহে-মনে। সে একেবারে কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় লখিন্দরের। তার বাহু-বাজু-কবজির কঙ্কনের রিনিঝিনি, তার স্বর্ণমলের ঝুনঝুন, তার উত্তরীয়র খসখস, তার আতর-অগুরুর কামজাগানিয়া সুবাস – কোনোকিছুই লখিন্দরকে যেন বেহুলার উপস্থিতি জানান দিতে পারে না। সে একেবারে কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় লখিন্দরের। আকুল কম্পিত কণ্ঠে শুধায় – প্রাণাধিক পতি! কী হয়েছে তোমার? জীবনে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত মধুর এই লগ্নে কেন আনন বিষণ্ণ তোমার?
লখিন্দর কথা শুনে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় বেহুলার চোখে। তারপর আবার দৃষ্টি ফেরায় আবছা আলোর নিচে জলের ওপর খেলা করা বাতাসের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেহুলা। মনে ভাবে স্বামীকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। কিন্তু অন্তরের আকুলতা তাকে স্থির থাকতে দেয় না। এবার সে কোমল দুই হাতে লখিন্দরের, তার প্রিয় বালা লখাইয়ের, মুখটাকে ফিরিয়ে আনে নিজের দিকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে প্রিয়তম? আমি কি কোনো অপরাধ করেছি প্রভুর চরণে? আমার দোষ থাকলে যে-কোনো শাস্তি আমাকে দাও; কিন্তু দোহাই তোমার, এভাবে বিষণ্ণ থেকো না!
লখিন্দর এবার এক অন্যরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় বেহুলার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে ভেতরে ভেতরে একেবারে কুঁকড়ে যায় বেহুলা। তবু মনের সবটুকু জোর একত্রিত করে দুই হাত ধরে আকর্ষণ করে স্বামীকে – চলো, ঘরে চলো! বাসর অপেক্ষা করছে।
লখাই হাত ছাড়িয়ে নেয় এক ঝটকায়। উঠে দাঁড়ায় – বাসর! বাসর তাই না? কার বাসর? কার সঙ্গে বাসর?
হতভম্ব বেহুলা কিছুই বুঝতে পারে না। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে নিখাদ বিস্ময় – এ কী বলছ স্বামী!
লখিন্দর যেন খেয়ালই করে না বেহুলার বাক্য। নিজের মনেই যেন নিজেকে শুনিয়ে, জলকে শুনিয়ে, জলের সঙ্গে খেলা করা মৎস্যকুল আর বাতাসকে শুনিয়ে বলতে থাকে – বাসর! কার সঙ্গে? অসতী এ-নারীর সঙ্গে বাসর! ধিক এই বাসরে!
ভঙ্গুর কাচের মতো হাজার টুকরো হয়ে যেন ভেঙে পড়ে বেহুলা – এ কী বলছ স্বামী! কাকে তুমি বলছ অসতী?
একেবারে ডান হাতের তর্জনি বেহুলার দিকে উঁচিয়ে ধরে লখিন্দর। নিষ্কম্প আঙুল। নিষ্কম্প কণ্ঠে বলে, তুমি অসতী। তোমাকেই বলেছি আমি।
আমি অসতী!
বেহুলার মনে পড়ে স্বামী সর্পদংশনে মারা যাওয়ার পর সবাই যখন তার শবদাহের কথা বলছিল, তখন সে লখাইকে পোড়াতে দেয়নি। বলেছিল, কলাগাছের ভেলায় সে-স্বামীকে নিয়ে ভেসে যাবে যমলোকে। যমলোক কোথায়, কেউ তা জানে না। প্রাচীন লোকেরা শুধু এটুকু বলতে পেরেছিল যে, যমলোকে পৌঁছতে হলে তাকে ভেসে যেতে হবে নদীর স্রোতের উল্টাদিকে। উজানের দিকে। তা কেমনভাবে সম্ভব? বেহুলা বলেছিল –
যদি সতী হই আমি পতিপ্রাণা নারী।
আপনে উজায়া ভুরা জাও দেবপুরী \
সতি কন্যার বাক্যে ভুরা আপনে উজায়।
দুই কূলের প্রজাগণে রাহিয়া রঙ্গে চায় \
হাজার হাজার মানুষ সচক্ষে দেখেছে, বেহুলার সতীত্বের গরিমায় কলার ভেলাকে মাঝি ছাড়া, বৈঠা ছাড়া উজান দিকে ভেসে যেতে।
সেই ঘটনা স্বামীকে মনে করিয়ে দিতে চায় বেহুলা। কিন্তু কণ্ঠ চিরে কোনো শব্দ আসে না। তীব্র বেদনা আর অভিমানে ভারি বুক নিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে।
তার সমস্ত প্রসাধন যেন ধুয়ে গেছে অপমানের জলে। মুখটা ফ্যাকাসে মৃতকল্প। শরীর কাঁপছে থরথর করে। দেখলে মনে হবে সে এখনই পড়ে যাবে মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে। কিন্তু তাকে দেখে করুণায় বিগলিত হওয়ার বদলে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে যেন লখিন্দর। কণ্ঠে বিষ মিশিয়ে বলতে থাকে, কোনো যুবতী নারী একাকী পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে অজানালোকে? যদি সে সুন্দরী হয়, যুবতী হয়, তাহলে পথে পথে সে তো বিপদে পড়বে। তার শ্লীলতাহানি ঘটাবে দস্যু-তস্কর-লম্পটের দল। কোনো নারী এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারবে না। তোমারও তো পারার কথা নয়।
আমি কীভাবে এড়াতে পারলাম? আমি কীভাবে জয় করেছি সেসব প্রতিকূলতা? বেহুলা প্রায় ভুলে যাওয়া নৌপথের কথা স্মরণে আনার চেষ্টা করে –
গদা চোরা বড়শি আড়ে গাঙুরের চরে।
শুধু অন্ন খায় না গদা রুইমাছ ধরে \
যুবতিনী দেখে গদা করে উপহাস।
কহে কহ সীমন্তিনী কোন দেশে বাস \
ওগো সুন্দরী তুমি আমার কথা রাখো।
তোমার মরা স্বামী বাঁচাইব আমার কাছে থাকো \
তোর মুকে ছাইরে গদা তোর মুকে ছাই।
মা মনসার দাসী আমি জলে ভেসে যাই \
গদারে পরিবোধ দিয়া ভাসিয়া চলিল।
শিগাল কুকুরের খাই আড়াইয়া গেল \
কে বোঝাবে লখিন্দরকে সেসব দিন-রাত্রির কথা? তার মনে ঢুকেছে সন্দেহের কুটিল বিষ। কালনাগিনীর বিষের চেয়েও শতগুণে বিষাক্ত সন্দেহের বিষ। সেই সন্দেহকে যখন কেউ পুরোপুরি সত্য বলে স্থির করে, তার থেকে কে তাকে বের করে আনতে পারে? বেহুলা বুঝতে পারে। তবু উচ্চারণ করে পঙ্ক্তিগুলো। লখিন্দর যেন শুনেও শোনে না। সে আসলে ধাপে ধাপে জেরা করে বেহুলাকে নিয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রের সভায়।
তিন
তুমি কেন গেলে ইন্দ্রের জলসাঘরে? কেন নৃত্য করলে সেখানে?
এটা কোনো প্রশ্ন হলো! তবু বেহুলা মৃদুকণ্ঠে উত্তর করে – তোমার জন্য প্রভু! তোমার প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য স্বামী!
আমার প্রাণ!
স্বামীর মঙ্গলের জন্য সতী নারী করতে পারে না হেন কাজ নেই প্রাণনাথ।
সতী নারী! সতী নারী!
এই দুটো শব্দ দিয়েই যেন বেহুলাকে চূড়ান্ত গালি দিয়ে যাচ্ছে লখিন্দর।
নৃত্য দেখিয়ে মুগ্ধ করেছ দেবরাজ ইন্দ্রকে।
হ্যাঁ প্রভু।
ইন্দ্র সম্পর্কে তুমি জানো না? সে যে লম্পট-শিরোমণি সে-কথা জানো না?
মাথা নিচু করে পায়ের আঙুল দিয়ে কাঠের মেঝেতে আঁকিবুঁকি করে বেহুলা।
ইন্দ্র খুশি হয় কোন নৃত্য দেখে, সেটা তো তুমি জানো?
একবার মুখ তুলে লখিন্দরের চোখে তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নেয় বেহুলা।
লখিন্দর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ইন্দ্র একমাত্র খুশি হয় যৌননৃত্য দেখে। তুমিও কি সেই নৃত্যই করোনি তার সামনে?
এবার আর মাথা তোলার চেষ্টাও করে না বেহুলা। বরং তার মাথা আরো বেশি নুয়ে পড়ে বুকের দিকে।
লখিন্দর বলে চলে – উর্বশী, মেনকা, রম্ভা নেচে চলে ইন্দ্রের সামনে। নাচতে থাকে। নাচতেই থাকে। কতক্ষণ নাচতে হবে? যতক্ষণ না কামোদ্দীপক যৌননৃত্য দেখতে দেখতে ইন্দ্রের বীর্যস্খলন হবে। এ-কথা তো দেবলোক-নরলোকে সবাই জানে। তুমিও সেভাবেই নেচে নেচে তৃপ্ত করেছ ইন্দ্রকে।
বেহুলা যেন মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। সে বলতে চায়, তার শরীরের সমস্ত অণু-পরমাণু কথা বলে উঠতে চায় – সেও তো কেবলমাত্র তোমার জন্যই প্রভু।
নৃত্যের সময় আমার কথা কি তোমার মনে ভেসে উঠেছিল একবারও।
অবশ্যই! বলতে গিয়েও থমকে যায় বেহুলা। মিথ্যা সে বলতে জানে না। এখন পরিষ্কার মনে পড়ছে, ইন্দ্রের সভায় নৃত্য করার সময় সে এক সময় ভুলে গিয়েছিল সবকিছু। তার শরীর এবং মন তখন নৃত্যপাগল হয়ে উঠেছিল। সে নাচছে, এটাই ছিল একমাত্র বাস্তব। ইন্দ্রকে খুশি করার জন্য তো বটেই, নিজের নৃত্যছন্দে নিজেও বিভোর হয়ে গিয়েছিল বেহুলা।
স্বামী উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। সত্য স্বীকার করে বেহুলা। মৃদু মাথা নেড়ে জানায়, স্বামীর কথা তখন তার মনে ছিল না।
ইন্দ্রকে নৃত্য দেখিয়ে তখন তুমি খুব আনন্দ পাচ্ছিলে?
শিল্পীসত্তাকে অস্বীকার করে কীভাবে বেহুলা! তার এই মেনে নেওয়ায় দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে লখিন্দর – তার মানে সে-কথাই সত্য। সব নারীই চায় যে তাকে লেহন করুক অসংখ্য পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি। প্রত্যেকেই মনে মনে ব্যভিচারিণী?
কাতর কণ্ঠে বলে বেহুলা, এতবড় অপবাদ দিয়ো না স্বামী!
নৃত্যের সময় তোমার শরীরের অণু-পরমাণু পর্যন্ত যাতে দেখা যায়, সেই কারণে ইন্দ্র তার শরীরে সহস্র চক্ষু বসিয়ে নিয়েছিল, এ-কথা তুমি জানতে না?
জানতাম। আমাকে নৃত্যের পোশাকে সাজানোর সময় রম্ভা বলেছিল সে-কথা।
তার মানে তুমি জানতে শুধু ইন্দ্র নয়, আরো সহস্র চক্ষু দেখছে নৃত্যের নামে তোমার যৌনমুদ্রা?
এবার বেহুলা মরিয়া হয়ে বলে, জানতাম। জেনেও করেছি। স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা ছিল আমার প্রধান কাজ। তার জন্য যা কিছু করতে হয়েছে, তা আমি করেছি। যা করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত নই। হ্যাঁ। নৃত্যের সময় তোমার কথাও আমার মনে ছিল না। জেগে ছিল কেবলমাত্র শিল্পীসত্তা। তাই বলতে পারি, তোমার জীবনের জন্য যেমন নেচেছি, আমার শিল্পানন্দেও তেমনি নেচেছি। কিন্তু আমি যা কিছু করেছি, তা তো তোমার জন্যই। ইন্দ্রের সভাতেও গেছি তোমার জন্যই। তোমার জন্যই…
বেহুলার কথা শেষ হয় না। সে দেখতে পায়, লখিন্দর চলে যাচ্ছে জলটুঙি মহলের সিঁড়ির দিকে। বাসর পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে লখাই। বেহুলা অন্তরের আর্তনাদে ফেটে পড়ে – স্বামী!
লখিন্দর একবার পেছনে ফিরে তাকায়। বলে – নিজের প্রাণের জন্য কোনো সত্যিকারের পুরুষ কখনো স্ত্রীকে বা প্রিয়তমাকে অন্যের দৃষ্টির লালসার শিকার হতে দেয় না। আমি ছিলাম মৃত। তা না হলে আমি কখনো তোমাকে ইন্দ্রের মতো লম্পটের সভায় যেতে দিতাম না। নৃত্যমুদ্রায় লম্পটের বীর্যস্খলন ঘটিয়েছ তুমি। আমি পুরুষ হিসেবে এটা সহ্য করতে পারি না। তোমার যোনিগর্ভে না হলেও ইন্দ্রের সেই বীর্যস্খলন ঘটেছে তোমার উদ্দেশেই। তুমিই তাতে ইন্ধন জুগিয়েছ কামোদ্দীপক নৃত্যের মাধ্যমে। আমার চোখে, পুরুষের চোখে – তুমি অসতী।
বেহুলা পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে লখিন্দরের চলে যাওয়া দেখে। মনে মনে উচ্চারণ করতে থাকে – পুরুষের চোখ! পুরুষের চোখ!