তখনো দিনের আলো ফোটেনি, তবু তার চোখে আলো ফুটে ছিল দিনের মতো। সারারাত ধরে অন্য সবার সঙ্গে জেগে আছে সে, জেগে জেগে কী যে দেখছে বুঝতে পারছে না। ক্ষুধায় শরীর ভেঙে আসছে, ঘুম ঘুম লাগছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখ দুটো এক আর হচ্ছে না কিছুতেই। কেউ কেউ অবশ্য দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। চেষ্টা করেছিল শোলার বেড়ায় হেলান দিয়ে খানিকটা ঘুমানোর। কিন্তু অচেনা অস্থিরতা কাউকেই কোনো সুযোগই দিলো না একটু ঘুমিয়ে পড়ার। আবার মশাও আছে, সেগুলো কোনো গান গায় না, আচমকা কামড় দিয়ে ফিরিয়ে আনে ইহজগতে। অতএব তৃষ্ণার্ত চোখ তুলে তারা তাকিয়ে থাকল অন্ধকারের দিকে। ঝরা বৃষ্টির গান সেই অাঁধার জুড়ে, তাদের নির্ঘুম শ্রুতির জগৎ ঘিরে। ঘুম আসার ভয়কে অাঁকড়ে ধরে জেগে আছে তারা। বড় ভয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের হয়তো ঘুম আসবে, চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়বে তারা। পবিত্র সৈনিকেরা তাদের জন্যে ঘুম নিয়ে আসবে, অনেক ডেকেও তাদের আর জাগানো যাবে না সেই কালঘুম থেকে।
ভয়ে ভয়ে তারা নির্জন হতে থাকে। নির্জনতার মধ্যে স্পষ্ট অনুভব করে, বড় সড়কের ওপর দিয়ে শব্দ তুলে মিলিটারিদের কনভয় যাচ্ছে। কনভয়ের সার্চলাইট এদিক-ওদিক নাচানাচি করছে; এত সশব্দের মধ্যেও বৃষ্টিধোয়া শেষরাতের সড়কে নিঃশব্দ মৃত্যুদূতের মতো লাগছে সেগুলোকে। গোয়ালঘরের মধ্যে থেকে তারা অভিব্যক্তিহীন চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সন্ধ্যাকালে, তারপর আর থামে নাই। মাঝরাত পর্যন্ত ঝমঝমিয়ে নামার পর খানিকটা ক্লান্ত হয়ে ঝিরঝিরিয়ে ঝরছে এখন। বৃষ্টিতে ভিজে গোয়ালঘরটা আর্দ্র এতক্ষণে। শোলার বেড়া পানি লেগে ফুলে উঠেছে, মাটির মেঝে ভিজে স্যাঁতসেঁতে পিছলা হয়ে গেছে। ছড়ানো-ছিটানো খড় আর গোবর মিলেমিশে একাকার হতে না হতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে গরুগুলোর অস্থির খুরের ধাক্কায়। তাও ভালো, রাত বলে হাম্বা হাম্বা রব তোলে নাই। বসে বসে জাবর কেটেছে, কখনো আবার ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে মাটিতে খুর মেরে, লেজ মুচড়িয়ে কখনো আবার গোবর ঝেড়েই নিষ্কৃতি দিয়েছে তাদের। কিন্তু আশ্চর্য, গোবরের কোনো গন্ধ পাচ্ছে না তারা। অথচ সারা গোয়ালেই কাঁচা গোবর ছড়িয়ে আছে। আর একটা গরু বেশ অসুস্থও, মাঝেমধ্যেই পাতলা গোবর ছাড়ছে শব্দ তুলে। কিন্তু তারা বোধহীন হয়ে পড়েছে, সরে যাওয়ার কোনো তাগিদ অনুভব করছে না ভেতর থেকে। গরুদের সঙ্গে সহাবস্থান করছে শান্তিপূর্ণভাবে।
শহর ছাড়িয়ে এসেছে তারা সন্ধ্যার খানিক আগে। সেটাকে তা হলে বিকেল বলাই ভালো। এমনিতেই শহর ফাঁকা, তার ওপর কাউকে চেনে না তারা। যারা আছে, তারাও ব্যস্ত চলে যাবে বলে, কথা বলার সময় নেই তাদের হাতে। গ্রামের মতো শহরের মধ্য দিয়ে পাকা সড়কটা নিঃসঙ্গ একচিলতে ফিতা হয়ে পড়ে আছে। বন্ধ দোকান, বন্ধ বাড়িঘর। শুধু দু-একটা খোলা দোকানের মধ্যে থেকে ক্রূঢ় অনিশ্চিত চোখে তাকিয়ে লোকজনের চলে যাওয়া দেখছে নিশ্চুপ বিহারিরা। ক্রূঢ় অনিশ্চয়তার সঙ্গে দানা বাঁধছে প্রতীক্ষার অধিরতা, কখন আসবে মিলিটারিরা। মিলিটারি এলেই তারা মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে, ঝাঁপিয়ে পড়বে আশপাশের দোকানপাট ও বাড়িঘরে। খুঁজে খুঁজে দেখবে অবশিষ্ট আছে কিনা কেউ, অবশিষ্ট আছে কিনা কোনো নারী। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে তেমন কিছু। তারা এখন রয়েছে যেমন করে, অনেক বাঙালিও নিশ্চয়ই থেকে যাবে তেমন করে। বিমান আর উড়ছে না তখন আকাশটাতে, বোমাও পড়ছে না। কিন্তু সেসবও খুব বেশি আগের কথা নয়। নাসির তখন ছিল বড়াল নদীর কাছে, নুকালি গ্রামের কাছে। নদী বরাবর যেন এক দ্বীপ জেগেছে। ফেরি আর নৌকা তাই সরাসরি আসা-যাওয়া করে না। ওপার থেকে যখন কোনো ফেরি বা নৌকা আসে, ঘাট ছেড়ে শ-দুয়েক গজ ডানদিকে যায়, তারপর আবার শ-দুয়েক গজ উজানে এসে এ পারে ভেড়ে। এ-পার থেকেও ও-পারে যায় একইভাবে। কাছেই নুকালি গ্রাম, কিন্তু ডাববাগানের যুদ্ধ হওয়ার পর থেকে প্রায় জনশূন্য। তারপরও যারা আছে, তারা সবাই সকালবেলা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে এগিয়ে এসেছিল, সঙ্গে থেকেছিল। অস্ত্র ছাড়াই সোৎসাহে তারা এগিয়ে এসেছিল, কোদাল হাতে বাঙ্কার খুঁড়েছিল। কিন্তু বিকেল এলে যেমন যোদ্ধারা, তেমনি গ্রামের মানুষরাও হাহাকার তুলে ছুটছিল আলপথ দিয়ে, ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। মাত্র কিছুক্ষণ তারা নদীর পাড়ে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল গোলাগুলি, দেখেছিল বোমা ফেলা। হতে পারে বালি, হতে পারে মাটি, হতে পারে কেবলই ধোঁয়া দখল করে নিচ্ছিল খানিক আকাশ। খাপছাড়া চিৎকার তুলেছিল এক যুবক, মার শালাগারে…।
কিন্তু কেউই মাথা তোলেনি বাঙ্কারের মধ্যে থেকে। ধুলাবালি সামলাতে সামলাতে নাসির বিড়বিড় করে বলেছিল যুবকের উদ্দেশে, ‘কখন মারা লাগবে, তোমার তা জানা থাকলে তো কাজই হতো।’ একটু আগেই ভুল হয়ে গেছে, বলা নেই-কওয়া নেই কে যেন গুলি ছুড়ে বসেছে। তারপর থেকেই এই ঝড়ঝাপটা, ওই শালাদের মারা আর অত সহজ না। সারকথা, কয়েকটা রাইফেল আর খানদুয়েক স্টেনগান ছাড়া অন্য কিছু নেই তাদের কাছে। নাসির তাই বলে উঠেছিল, আর থাকা ঠিক না রে রবি। ভালো করে মালকোঁচা মেরে ছুটতে শুরু করেছিল তারা ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। পায়ের চাপে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কচি কচি চারা, সেসব খেয়াল করার সময় কোথায়। অনেক পরে ক্ষেতের মধ্যে থেকে সড়কে উঠতে উঠতে নাসির পেছনের দিকে ফিরে চেয়েছিল। দেখেছিল, রবি বলে কেউ নেই তার সঙ্গে। একা, নিঃসঙ্গ সশস্ত্র সে নিরস্ত্র কয়েকজনের ভেতর। তাদের কাউকে চেনে না সে। হয়তো তারা নুকালি গ্রামের মানুষ, আশপাশের মানুষ, ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে আসা মানুষ। তার সঙ্গে তাও একটা রাইফেল রয়েছে আর কারো সঙ্গে কোনো কিছু নেই। কোনো নারী নেই, কোনো শিশু নেই, কেবল জীবনটাকে সঙ্গে করে ছুটছে তারা। ছুটতে ছুটতে কতদূর এসেছে, বলতে পারে না তারা। শুধু টের পেয়েছে, শহরটা পেরিয়ে এসেছে তারা। শহর মানে একচিলতে ফিতার মতো এদিক-ওদিক চলে যাওয়া পাকা রাস্তা, কয়েকটা পাকা বাড়িঘর, রাস্তার দুধারে দোকানপাট। ছোট ছোট দলে বিভক্ত নারী-পুরুষ আর শিশুরা চলে যাচ্ছে এদিক-ওদিক। সে কোনো দলে আছে বলে মনে করেনি, সে শুধু হাঁটছিল সামনের দিকে, সে শুধু ধরে নিয়েছিল, ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে সবাই। ছত্রভঙ্গ হতে হতে জোরে জোরে হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে কেবলই সামনে এগোচ্ছে। একবার কড়িফুলের তীব্র ঘ্রাণ নাকটাকে ছুঁয়ে গেল। তারপরই যেন তা মিলিয়ে গেল দূর থেকে ভেসে আসা বোমার শব্দ আর ধুলাবালির গন্ধের মধ্যে। তাড়া খেতে খেতে এগিয়ে চলল তারা। হঠাৎ টিপটিপ বৃষ্টি, তারপরই নেমে এলো ঝমঝম বৃষ্টি। তারা সবাই নেমে পড়ল সড়কের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তায়। কে কে নেমেছিল, জানা নেই তার। বৃষ্টির ছাঁট ঠেকাতে ঠেকাতে একজনের পেছন পেছন সে ঢুকে পড়েছিল একটা গোয়ালঘরে। চারপাশ অদৃশ্য করে তখন বৃষ্টি ঝরছে তীব্র বেগে। যাই হোক, একটা ঘর পাওয়া গেছে। আর একটা যখন আছে, তখন নিশ্চয়ই আরো কয়েকটা আছে। কিন্তু আশপাশের বাড়িঘরের জানালা-কপাট সবই বন্ধ, সাড়া-শব্দ নাই কোনো জনমানবের। হয়তো সবাই পালিয়ে গেছে; হয়তো কেন, নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে। গোয়ালঘরের মধ্যে জায়গা খুঁজে নিতে নিতে আবারো সে খেয়াল করে, একজন আরেকজনকে আদৌ চেনে না তারা। হয়তো এরা এই এলাকারই লোকজন, হয়তো এখানে কোনো কাজে এসেছিল, হয়তো বা শরণার্থী – এখানে এসে কারো বাড়ি অথবা স্কুলঘরে উঠেছিল। বোম্বিং শুরু হওয়ার পর বেরিয়ে পড়েছে আতঙ্কিত হয়ে। সে না হয় দল থেকে ছিটকে পড়েছে, শেষসম্বল রবিউলকেও হারাল এবার; কিন্তু এরা তো যুদ্ধ করছে না অথচ এদের মধ্যেও এমন কেউ নেই, যার চেনাজানা অন্তত আরেকজন সঙ্গী আছে। এই হঠাৎ আবিষ্কার তাদের স্তম্ভিত করে দেয় কিনা, তাও বোঝা যায় না। সারারাত বৃষ্টির গান শোনে তারা। মাঝেমধ্যে থ্রি নট থ্রিটাকে স্পর্শ করে নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করে নাসির। একবার কে যেন গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে। তারপর গজ গজ করতে থাকে, হু-হ… দাবাড় খেয়ে ভেগে গেছে, ঘরে আবার তালা মেরেছে। যেন সে ধাওয়া খেয়ে আসেনি, শখ করে ঘুরতে বেরিয়েছে। কে একজন রুষ্ট গলায় গরুগুলোকে গোয়ালেই আটকে রাখার নিন্দা করতে থাকে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে, আগুন লাগলে এই অবলা নিরীহ জানোয়ারগুলোর কী দশা হবে? আরেকজন আবার কিছুক্ষণ পর তাকে আশ্বস্ত করে, তার কাছের গরুটাকে বেঁধে রাখা হয় নাই, হয়তো কোনোটাকেই বাঁধা হয়নি। লোকগুলো হয়তো আজকেই বাড়ি ছেড়েছে, হয়তো পরিস্থিতি ভালো বুঝলে কালই আবার ফিরে আসবে। মিলিটারিরা বোমা ফেলছে জেনে সরে গেছে তারা বাড়িঘর থেকে। ছুটে গেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে খোলা দিগন্তের দিকে। কিংবা কে জানে, আশপাশে কোথাও হয়তো একজন লুকিয়ে থেকে চোখ রাখছে বাড়িঘরের ওপর, গরুগুলোর ওপর। আর গরুগুলো খুঁটিতে বাঁধা না হলেও দাঁড়িয়ে আছে, এই বৃষ্টিতে চেনা জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না বলে।
তা হলে কী করা যায় এই বৃষ্টির মধ্যে? একজন আরেকজনকে চিনে নেবে গল্প-গুজবে একটু একটু করে, খোঁজখবর নেবে বাড়িঘর আর আত্মীয়-স্বজনের, আর কোনখানে যাওয়া যায় ঠিক করে নেবে তাও – কিন্তু সেসব আর হয়ে ওঠে না। বৃষ্টির মধ্যে কখনো বসে, কখনোবা দাঁড়িয়ে সময় পার করছে তারা। একবার একজন সিগারেট ধরানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ম্যাচের কাঠি ফুরিয়ে গেল। তার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল সিগারেট জ্বালানোর সব চেষ্টা। কেবল উদগ্র হয়ে উঠল সিগারেট-বিড়িতে টান দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নাসির চেষ্টা চালায়, সবাইকে একটু একটু করে জাগিয়ে তোলার, কথা বলার। কিন্তু কী আশ্চর্য, মনে হয় নিজেই সে পারে না জেগে উঠতে, কথা বলতে। তবে এখন সেসবেরও দরকার নেই, সবাই এখন সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে সড়কের দিকে, কখনো আবার পরস্পরের দিকে। গ্রাম দেখে কনভয় থেমে গেলে কী হবে বলা যায় না, কেউ হয়তো ভয়ে প্রাণপণে দৌড় দেবে, কেউ আবার সুবোধ চোখে আত্মসমর্পণের হাত তুলে এগিয়ে যেতে পারে, কেউ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। নাসির তীক্ষ্ণ চোখে লরিগুলো দেখতে দেখতে চাপা গলায় বলে সবার উদ্দেশে, এদিকে ওরা আসবে বলে মনে হয় না, আপনারা কেউ ভয় পাবেন না –
ভয় তো আপনার জন্যই – কে একজন কথা বলে। আবছা আলোয় তাকে আর অনুমান করা যায় না। শুনতে শুনতে নাসির থ্রি নট থ্রিটাকে স্পর্শ করে। গতকালও এটার জন্য সে অনেকের সাহস ছিল অথচ এখন এটার জন্যই সে এদের ভয়ের কারণ। অথবা সে নিজেও ভীত হতে শুরু করেছে, কেবলই পিছু হটছে। পিছু হটতে হটতে রাজাবাজার থেকে ডাববাগান আর বাঘাবাড়ি পেরিয়ে এই এতদূরে কোনখানে চলে এসেছে। খুলনায় তার ফেরা হলো না, রবিউলেরও কুষ্টিয়া যাওয়া হলো না। হোক পিছু হটা, হোক বাড়ি না ফেরা, তবু তারা একসঙ্গে ছিল, বেঙ্গল রেজিমেন্টের তারা কয়েকজন আর কথাও ছিল একসঙ্গেই থাকবে। অথচ কত দ্রুত সব এলোমেলো হয়ে গেল। এখন অন্তত একজন ভীত তার জন্য। হয়তো সে আর কাউকে খুঁজে পাবে না, হয়তো সে বাড়িতেও ফিরতে পারবে না, সেসবের চেয়েও কষ্টের ব্যাপার, হয়তো সে আর সামনের দিকেও এগোতে পারবে না। কী বলবে সে ভেবে পায় না। তার আগেই আরেকজন বলে ওঠে, উনি না থাকলে কি আপনে রেহাই পাবেন?
কোনো উত্তর আসে না তার প্রশ্নের। লরির কোনো শব্দও পাওয়া যায় না। পেছনে আর কোনো কনভয় নেই বোধহয়। আবারো সুনসান চারপাশ। কেবল সারারাতের বৃষ্টি কেমন এক হাহাকার রেখে গেছে, বাতাসের ধাক্কায় কখনো কখনো আর্তনাদ করে উঠছে সেই হাহাকার, পুবের দিগন্তজুড়ে যেন শুয়ে আছে সেই হাহাকার, ভেজা পথের ওপর আছড়ে পড়েছে সেই হাহাকার। পুব আকাশ জেগে উঠছে, গোয়ালঘরের ভেতরটাও আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। কাঁচা গোবরের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। একটা ষাঁড়, পাঁচটা গরু আর একটা বকনাবাছুর আছে এ-গোয়ালটাতে। অন্ধকারের লোকটা ঠিকই বলেছে, কোনোটাকেই খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়নি। চলে যাওয়ার আগে সবগুলোকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেছে সদয় গৃহস্থ। দিনের আলো ফুটতে শুরু করলে গরুগুলো হয়তো বেরিয়ে পড়বে গোয়াল ছেড়ে। হয়তো দিনের শেষে সেগুলো আবার ফিরে আসবে, হয়তো বিকেল হতেই – ক্লান্ত হয়ে, কিংবা হয়তো আর ফিরবে না কখনো। হয়তো তাদের অন্য কেউ ধরে নিয়ে যাবে। যাই হোক, অন্তত অপঘাতে মারা যাবে না। এর মধ্যে বলা কি যায়, হয়তো দুপুরের আগেই বাড়ির লোকজন ফিরে আসবে, খুঁজে নেবে গরুগুলোকে। গোবরে লেপটানো মাটিতে ন্যাটা দিয়ে শোলার বেড়ায় মাথা ঠেকিয়ে নাসির চোখ দুটো বন্ধ করে। তারপর আবারো খুলতে গেলে আলোয় ধাক্কায় বুজে ফেলে চোখগুলো। আশ্চর্য, তা হলে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে সে নিজের অজান্তেই। তাই বলে এইভাবে! তার কি কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না নিজের শরীরের ওপরে! ভাবতে ভাবতে সোজা হয়ে বসে সে। ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর ছাড়া আর কেউ নেই গোয়ালঘরে। অদ্ভুত চোখে ছেলেটা তাকিয়ে রয়েছে তার থ্রি নট থ্রিটার দিকে। কিন্তু অন্য সবাই কোথায় গেল!
সবাই চলে গেছে নাকি? ছেলেটির দিকে জিজ্ঞাসু চোখে নাসির তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না, কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ করে ছেলেটা। তারপর আবারো তৃষ্ণার্ত চোখে রাইফেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য, চলে গেছে সবাই, কেউ তাকে ডেকে তোলার প্রয়োজন বোধ করে নাই। মাথার ওপর তাদের অনেক বিপদ, সশস্ত্র কাউকে সঙ্গে নিয়ে নতুন বিপদ ডেকে আনতে চায় না তারা। অতএব তারা ডাকে নাই তাকে। হয়তো এই ছেলেটা রয়ে গেছে রাইফেল দেখার তৃষ্ণা নিয়ে। নাসির জিজ্ঞেস করে তাকে, দেখতে চাও এইটা?
মুখে কিছু বলে না, তবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ করে ছেলেটা। নাসির তার দিকে রাইফেলটা বাড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর তাবৎ আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে ছেলেটা। রাইফেলের গায়ে তর্জনীটাকে রেখে আস্তে আস্তে ভর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। ছেলেটার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে নাসির অনুমান করার চেষ্টা করে, ঠান্ডা মাথায় খুন করার ইচ্ছা জাগছে কিনা ওর মধ্যে। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, গলায় একটা ছোট গামছা, তবে পায়ে কিছু নেই ছেলেটার। পদ্মাসনের মতো করে বসে রয়েছে গরু-বাছুরের পানি খাওয়ার চাড়িটার কাছে। গরুগুলো এখনো বসে আছে মেঝেতে, জাবর কাটছে আর মাথা দোলাচ্ছে। হয়তো অভ্যাসবশে অপেক্ষাই করছে, কখন কে এসে তাদের বের করবে গোয়াল থেকে, বাইরে নিয়ে গিয়ে ঘাসের মধ্যে গোছর দেবে। এখনো জানে না, হয়তো কখনোই কেউ আর আসবে না তাদের কাছে। বাঁশের চ্যাগার করা দরজা দিয়ে সরাসরি আলো আসছে, আসছে বাতাস; কিন্তু এত আলোর মধ্যেও ছড়িয়ে আছে রাতের বৃষ্টির আবহ।
ছেলেটা এবার ট্রিগারটাকে ছুঁয়ে দেখছে। কখনো নলটাকে, কখনো আবার ট্রিগারটাকে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে। এমনকি একবার কুঁদোটাও শুকে দেখল। ও কি মৃত্যুর ঘ্রাণ খুঁজছে, নাকি বারুদের? এখন আবার কী বিষণ্ণ বিস্ময় নিয়ে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটার দিকে। হাসি পায় নাসিরের। প্রথম প্রথম সেও এরকম অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকত রাইফেলের দিকে। নিষ্প্রাণ হেলাফেলার একটা কিম্ভূত বস্ত্ত, সে জন্যই কি মুহূর্তের মধ্যে হেলাফেলায় প্রাণহীন করে দিতে পারে যে-কাউকে! আজো এই জিনিসটার সঙ্গে তার কোনো বন্ধুতা হলো না। এমনকি ভয়ংকর ওই কালো রাতেও – যখন চারপাশ তলিয়ে যাচ্ছিল বজ্রের গর্জনে, চারপাশ কেঁপে উঠছিল থরথরিয়ে, আকাশজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা, সশব্দ আগুনের কুন্ড – এসে পড়ছিল আশপাশে; হয়তো মেশিনগানের গুলি, হয়তোবা কামানের, হয়তোবা ট্যাংকে – – হয়তো বা সবকিছুরই। চিন্তা করার অত সময় নেই তাদের হাতে। তারা শুধু বুঝেছিল, মেরে ফেলা হচ্ছে তাদের, বাঁচতে হবে তাদের, মারতে হবে ওদের। কত তুচ্ছ হাতের এই অস্ত্র ওইসব অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ আর আয়োজনের কাছে। তবু সেই অস্ত্র নিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে পচা নর্দমার মধ্যে নেমে পড়েছিল তারা কয়েকজন। আর সবাই কোথায় গেছে? ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে নাসির।
মুখে কিছু বলে না সে, শুধু হাতটা তুলে সড়কটাকে দেখায়। সেখানে বৈশাখের রোদের সঙ্গে একরাশ শূন্যতা খেলা করছে। হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে নাসিরের। আজ বোধহয় এক মাস পূর্ণ হলো, এখনো তার বাড়ি যাওয়া হলো না। অথচ ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে ঢেঁকিঘরে একটা রাত কাটাবে, কালামাণিক গাছের আম পড়লে সহজে কুড়ানো যায় ঢেঁকিঘর থেকে আর রুবিদের রান্নাঘর ওই ঘরের পাশে। তারপর আবারো বেরিয়ে ফিরবে একেবারে যুদ্ধশেষে। কিন্তু ঢাকা থেকে হ্যাঁচোড়-পাঁচোড় করে মানিকগঞ্জে আসতে আসতে রবিউলদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাড়ি না গিয়ে সে ওদের সঙ্গে গেল পাবনার দিকে। পাবনা থেকে আবার ডাববাগানে। এভাবে সবকিছুর হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হতে লাগল, এলোমেলো হতে হতে তারা বাঘাবাড়ি এলো, এখন সে একা একা এইখানে কোনখানে জানা নেই তার।
তুমি গেলে না?
শুনে ছেলেটা বোবা চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। অস্বস্তি লাগে নাসিরের। মনে হচ্ছে, পায়ে একটু একটু টান লাগছে। ছাত্রগুলোর সঙ্গে কাল নুকালিতে অযথাই একটু ঝগড়া হলো। অযথাই কি?! সে কেবল বলেছিল, শক্তি ক্ষয় করে লাভ কী বলেন? চলেন, আগে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করি, একটু-আধটু চালানো শিখি… ছাত্রগুলো তার দিকে তেড়েমেড়ে ছুটে এলো। একজন অবশ্য ছুটে এসে থামাল তাদের। নাসির অসহায় কণ্ঠে তাকেই সাক্ষী মেনেছিল, বলেন ভাই, আমি খারাপ কী বললাম? হারামজাদারা আসবে বিমান নিয়ে, কামান-বোমা-ট্যাঙ্ক-মেশিনগান নিয়ে। এই দু-তিনটা এলএমজি আর বন্দুক নিয়ে সামনা সামনি দাঁড়ায়ে আমরা সাহস দেখাতে পারি, কিন্তু জিতব কেমন করে? জান দিতে রাজি আছি, কিন্তু বোকার মতো সাহস দেখানোর মানে কী বলেন?
শুনে আবারো ওরা হইচই জুড়েছিল। একজন অতর্কিতে তাকে ধাক্কাও দিয়েছিল। লিডারগোছের ছাত্রটা আর রবিউলরা তাকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল সেখান থেকে। টানটা বোধহয় ওইসব হাঙ্গামাতেই লাগে। কিন্তু তখন কী আর এইসব পাত্তা দেওয়ার সময়! কিছুক্ষণ পরই বড়াল নদীর ওই পারে মিলিটারিদের কনভয় এসে থামল। লঞ্চ নিয়ে এ পারে আসার তোড়জোড় শুরু করল মিলিটারিরা। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে বাঙ্কারের মধ্যে অপেক্ষা করছে তারা। আসুক – এগিয়ে আসুক, রেঞ্জের মধ্যে আসুক। কিন্তু তার আগেই এক ছাত্র বন্দুক দিয়ে বোকার মতো গুলি করে বসল। গুলি আর কতদূর যাবে, কিন্তু শব্দ ছড়িয়ে পড়ল অনেকদূরে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরই ওদিক থেকে ছুটে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। বাঙ্কারের মধ্যে মাটি কামড়ে পড়ে থাকল রবিউল আর সে। একবার মাথা তুলে দেখল, গুলি শুরু করা ছেলেটা এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে জঙ্গলের দিকে। চিৎকার ভেসে আসছে নুকালি গাঁয়ের ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ আগে তাদের মুড়ি-পিঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ খাইয়েছে ওরা, সারাদিন তাদের সঙ্গে সমানতালে কোদাল চালিয়ে নতুন নতুন বাঙ্কার খুঁড়েছে, তারপর কেউ কেউ গাছে চড়ে বসেছে যুদ্ধ দেখবে বলে। কিন্তু এখন আর্তচিৎকার করতে করতে গাছ থেকে নেমে আসছে। খানিক পর বিমান হামলা শুরু হতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সবাই। পথে পথে ছড়িয়ে পড়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, কলেজ আর ভার্সিটির ছাত্র অবরুদ্ধ ক্রোধ নিয়ে এক হয়েছিল আবারো তারা ছড়িয়ে পড়ল নানা দিকে।
ষাঁড়টা এখন ফোঁস ফোঁস করছে, নিঃশ্বাসের তোড়ে নাকের সামনে থাকা দু-চারটা খড় কেঁপে কেঁপে উঠছে। নাসির উঠে দাঁড়ালে সেটাও উঠে দাঁড়ায় মাটি থেকে, তারপর গোবর ছাড়তে থাকে। সে আবারো জিজ্ঞেস করে ছেলেটাকে, কী, গেলে না তুমি?
আপনে যাবেন না? ছেলেটা তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে।
যাব। তুমি গেলে না?
কই যে যাই, বুঝতে পারছি না।
ও-ও… বাড়ির লোকজন কেউ নাই?
না, – নির্বিকার কণ্ঠে বলে ছেলেটা। তা শুনেই বোঝা যায়, সেসব অনেক আগের ব্যাপার, অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে নিরাত্মীয় জীবনযাপনের সঙ্গে। বলতে ভালো না লাগলেও সে এখন বলে যেতে পারে। একবার নাসিরের ইচ্ছা করে সবকিছু শুনতে। তারপরই নির্ণয় করে, বরং জরুরি কথাগুলোই জেনে নেওয়া ভালো। সবচেয়ে আগে জানা দরকার, কোথায় আছে সে। এখান থেকে ভারতের সীমান্ত কত দূরে, কাছের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, নদীঘাট, হাটবাজার – এসব কোথায় কোথায়। খুলনাইবা কতদূরে। তা হলে কোনো একটা পথ সে খুঁজে নিতে পারবে। কয়েকটা নীল মাছি ওড়াওড়ি করছিল, সেগুলো তাড়াতে তাড়াতে সে প্রশ্ন করে, কোন জায়গা এটা?
এ-গাঁও শাজাদপুরে, নাম জানি না। ওইদিকে উল্লাপাড়া। ওরা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওইদিকে গেছে, নদীর দিকে…
হাত দিয়ে দিক দেখায় সে। বাঁশের চ্যাগার ও শোলার বেড়া ছাড়িয়ে দিব্য চোখে সেদিকে তাকায় নাসির। উল্লাপাড়া? অনেকবারই উল্লাপাড়ার নাম শুনেছে সে, কিন্তু শাজাদপুরের নাম শুনল মাত্র এবার, ডাববাগানে থাকার সময়। খুলনা যাওয়া নিশ্চয়ই তত সহজ নয় আর এখান থেকে। তা ছাড়া খুলনা যাওয়ার কোনো মানে নেই। ব্যারাক থেকে চলে এসেছে সে অস্ত্র হাতে। এর মধ্যে সমনজারি হয়ে গেছে। এর মধ্যে সে যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। বাড়ি কিংবা ব্যারাক কোনোখানেই তার আর ফেরা হবে না। সমন তুলে নিলেও না। খারাপ লাগছে, মাঝেমধ্যেই খারাপ লাগছে কদিন হয়, হারামজাদারা নিশ্চয়ই বাড়ির লোকজনকে ধরে নিয়ে যাবে তাকে না পেলে। কিন্তু তাকে পেলেও কি আর ছাড়বে ওদের? অথবা হয়তো এর মধ্যেই কিছু একটা ঘটে গেছে বাড়িতে। সেখানেও ছত্রখান লোকজন, বাড়িঘর। দৈবাৎ দেখা হলে হতেও পারে, হতে পারে কান্নাকাটি, কিন্তু সবকিছু নিশ্চিত জানা যাবে কেবল যুদ্ধ শেষে।
ওজন ভালোই – বলতে বলতে রাইফেল ফিরিয়ে দেয় ছেলেটা। নাসিরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেটা আবার বলে, এটা দিয়ে মানুষ মেরেছেন কখনো?
মানুষ না জানোয়ার, জানোয়ার মারি – বলে রাইফেলটা ঘাড়ে ঝুলায় সে।
ছেলেটা আবার বলে, কিন্তু মানুষও তো মারা যায়, মানুষও তো মরে।
শুনে সে বিষণ্ণ হয়। তা ঠিক, মানুষই তো প্রথমে মরে, কোনো কিছু বোঝার আগেই তার মৃত্যু ঘটে। জানোয়ার আর কটা মরে, কটাইবা মরে মানুষের মতো জানোয়ার। কেবল অজস্র মানুষই মরতে থাকে কী এক ইঙ্গিতে। অজস্র মানুষ জেনেশুনে হাঁটতে থাকে মৃত্যুর পথ দিয়ে। এখন যেমন হাঁটছে তারা। মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য হাঁটছে মৃত্যুর পথ দিয়ে। অবাকই লাগে, ঘুমন্ত তাকে ফেলে অন্য সবাই চলে গেছে ভেবে। কেউ কাউকে চেনে না তারা, কিন্তু অচেনা হয়েও তারা কাছাকাছি এসেছিল, মৃত্যু তাদের একজনকে আরেকজনের কাছে নিয়ে এসেছিল। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় হেঁটে হেঁটে, দৌড়ে বা প্রায় দৌড়ে নির্ভরতার পাল্লা তাদের ভারিও হচ্ছিল। একবার সে পড়ে গেল হোঁচট খেয়ে, রাইফেলটা আছড়ে পড়ল পিঠের ওপর, কয়েকজন দৌড় থামিয়ে টেনেটুনে তুলল তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তাকেই রেখে গেল ওরা সবাই! শেষরাতে লোকটা তা হলে ঠিকই বলেছিল, ভয় কেবল তাকে নিয়ে… সশস্ত্র তাকে নিয়ে। ওদের বাঁচার সম্ভাবনা তা হলে কমে যেতে শুরু করেছিল তার জন্য! এই কদিনে কতভাবে কতজনের সঙ্গে কতদূর এলো সে, কিন্তু একবারো মনে হয় নাই কেউ তাকে ফেলে রেখে যেতে পারে। কেউ তাকে এড়িয়ে যাওয়ার বিড়ম্বনায় ফেলতে পারে। চট করে কোনো কথা সে খুঁজে পায় না। গোবরের গন্ধ পাওয়ার ছুঁতোয় নাক কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অবশেষে ছেলেটার দিকে ফেরে সে, চলো, আশপাশে দেখে আসি।
গোয়ালঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায় নাসির। রোদ উঠছে, দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ছাপ। দূরে কোথাও বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। রোদেলা আকাশের গায়ে আগুনের লেলিহান শিখা আর ছাইরঙা ধোঁয়া একটা আরেকটাকে সাপ আর বেজি হয়ে ধাওয়াধাওয়ি করছে। মেঝে থেকে উঠে এসে ছেলেটা তার পেছনে দাঁড়ায়। আগুন দেখেও তার চোখে কোনো ক্রোধ জমে না, সে বরং অধীর কণ্ঠে বলে, ‘বাড়ির মধ্যে খাওয়ার জিনিস আছে। ঘরের বেড়ার ফুটা দিয়ে দেইখছি।’
সরাসরি খাওয়া-দাওয়ার কথা বলছে না ছেলেটা। তবে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কোথাও যাওয়ার চেয়ে খাওয়াই ওর কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ। সে-ও সরাসরি কোনো কথা না বলে প্রশ্ন করে, নাম কী তোমার?
আবিদ – আবিদ ইসলাম। আমার মালিকের ফ্যাক্টরি পাবনায়। কিন্তু বাড়ি মৌপুরে। মৌপুরের নদী আছে না? ওই নদীর ধারে।
যেন মৌপুরকে এই জগতের সবাই চেনে, মৌপুরের নদী তাদের অবগাহনের নদী; যেন অনেকবার নিজেকে নাসির শুদ্ধ করেছে সেই নদীতে অবগাহিত হয়ে। আর নিজের বাড়িঘর না থাকুক, মালিকের বাড়িঘর আছে, ফ্যাক্টরি আছে – তার মানে তারও অস্তিত্ব আছে। আবিদের আচ্ছন্নতা ভাঙতে চায় না সে। গোয়ালঘর থেকে বাইরে বেরোয় তারা, ষাঁড়টাও হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়, গোঁয়ারের মতো তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে, ছুটে যায় বাড়ির পাশের শসা ক্ষেতের দিকে। নিচু জাংলা বেয়ে শসার সবুজ লতাপাতা লক লক করছে ছোট ক্ষেতজুড়ে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টিতে ভেজা কান্নাকাতর হলুদ ফুল। কাল রাতে ভালো করে চোখে পড়ে নাই, কিন্তু এখন সকাল – দেখতে না চাইলেও দেখতে পাচ্ছে নাসির, বড় সড়ক থেকে নেমে ছোট চিকন একটা কাঁচা সড়ক ধরে এইখানে এসেছে তারা। ১০-১২টা ঘর মাত্র, তারপর ফের ফসলের ক্ষেত, তারপর আবারো কয়েকটা বাড়ি। হয়তো সেখানে গেলেও এরকম কয়েকটা বাড়ি আবার চোখে পড়বে। কিন্তু এখন আর কোনো জনমানব নেই এখানে। কোনো পাখি নাই, কোনো গান নাই। জনবসতি হলেও এখন এসব বসতবাড়ি শূন্য পড়ে আছে। অনেক দূরে ক্ষেতের মধ্যে একদল মানুষ ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। পাকিস্তানিদের ধাওয়া খেয়ে তারা হয়তো চলে যাচ্ছে অন্য কোনো দিকে। তাদেরও চলে যাওয়া দরকার। এ-জায়গা নিরাপদ নয় – বড় সড়ক থেকে সরাসরি চোখে পড়ে এই জায়গা। হয়তো সে-কারণেই বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর এখানকার মানুষজন চলে গেছে বসতভিটা ফেলে। এখনো দুটো সুপারি গাছের মধ্যে বাঁধা একটা রশিতে একটা গেঞ্জি, একটা হাফপ্যান্ট আর একটা লুঙ্গি আর গামছাও ঝুলছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ছাড়ার সময় হয়তো ভুলে গেছে নিয়ে যেতে।
কিন্তু নাসির তেমন ভুল করে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ভিটার চারপাশে পুরনো সব সুপুরি গাছের সারি। একটা বড় আমগাছও আছে পেছন দিকে। গোয়ালঘরের পাশেই ছোট্ট উঠান। তারপর টিনের ছয়চালা ঘর, পাশে আরেকটা টিনের দোচালা ঘর। তারপর খানিকটা ফাঁকা জায়গা, আপাতত একটা খড়ের পালাও আছে সেখানে। খড়ের পালার কারণে ভালো করে চোখে পড়ে না বাঁশ দিয়ে বানানো খোলা পায়খানা। ঢালু বরাবর আস্তানা গাড়তে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে গড়ান বেয়ে নালার পানিতে গিয়ে মিশেছে পায়খানা-প্রস্রাব। বাড়িঘর মিলিয়ে একটা ইউ প্যাটার্নের জায়গা, কিংবা বলা যেতে পারে এটা বক্স প্যাটার্ন। ছয়চালা ঘরের বারান্দায় বেঞ্চ আছে একটা, ডোয়া ঘেঁষে রয়েছে একটা বড়সড় ড্রাম। মনে হয় ওটাই শুইয়ে দিয়ে ধানের অাঁটি পিটিয়ে ধান আলাদা করা হয় ছরা থেকে।
আবিদ বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে এখন। আগে আগে যাচ্ছে, দৌড়ে দোচালা ঘরের ছোট বারান্দায় উঠে দাঁড়াল। তারপর বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে বলল, এই ঘরে ভাত-তরকারি রান্না করা আছে।
তুমি জানো?
জানি। সকালে ওরা চলে যাওয়ার পর আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ওই ঘরের জানালার পাল্লা খোলা। ঘরের ধর্নায় কয়েকটা শিকা ঝোলানো। শিকায় ভাত-তরকারির পাতিল আছে। রাতে বৃষ্টি ছিল, মনে হয় ভালোই আছে।
বলতে বলতে আবিদ নাসিরের পাশে চলে আসে। নাসির বারান্দায় উঠে জানালা দিয়ে ভেতরে তাকায়। সত্যিই বলেছে ও। রাইফেলের কুঁদো দিয়ে দরজার তালা ভাঙতে গিয়েও ভাঙে না নাসির। কারা যেন আসছে বাড়ির পেছন থেকে, অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেঞ্চের ওপর বসে পড়ে সে। এবার চোখে পড়ে, গড়ান বেয়ে কয়েকজন উঠে আসছে। কয়েকজন ঘুরপথে অন্য কোনো বাড়ির দিকে গেল। কয়েকজন আবার সোজাসুজি এইদিকে। মাঝবয়সী এক নারী আর এক কিশোরীও আছে তাদের ভেতর। রাতে আশপাশের কোনো গ্রামে থেকেছে, এখন আবার ফিরে আসছে। কত বিপদ, কত আশঙ্কা, কত যে অনিশ্চয়তা – তারপরও মানুষ চলে যেতে নয়, ভালোবাসে ফিরে আসতে।
বাড়ির উঠানে ঢুকেই মাঝবয়সী লোকটা থতমত খায় সশস্ত্র নাসিরকে দেখতে পেয়ে। বেঞ্চ থেকে সে উঠে দাঁড়ায়, বলে, আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল, এখন আবার দিনের বেলা। কোনোখানেই যাওয়ার উপায় নাই।
থতমত ভাব চলে গেছে লোকটার, ভালো করেছেন। বাঘাবাড়ি থেকে আসছেন?
জি, কাল এসেছি বাঘাবাড়ি থেকে। কিন্তু আসলে আসছি ঢাকা থেকে। এক মাস ধরে –
মুহূর্তে একটা মাস চোখের সামনে খেলা করে ওঠে তার। কত লাশ, কত রক্ত, কত আগুন – আবারো তার শরীর উত্তেজনায় শিরশিরিয়ে ওঠে। লোকটা সাগ্রহে এগিয়ে আসে, তাই? ঢাকা থেকে আসছেন? বেলা মা, ঘরের দরজা খোল। ওনাকে ভেতরে বসতে দাও – বাইরে বসা নিরাপদ না। খানসেনারা মনে হয় উল্লাপাড়ায় – বলেই সে আরেকজনকে বলে, রহমত, যাও ষাঁড়টাকে বান্ধো, গোয়ালঘরে যাও, গরুগুলোর ব্যবস্থা করো।
বেলা, পেছনে থাকাটা কিশোরীটা – তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ছয়চালা ঘরের দরজা খুলতে থাকে। লোকটা আবারো জিজ্ঞেস করে তাকে, ঢাকার অবস্থা কী? আপনি নিজের চোখে দেখেছেন, না?
তা ঠিক, নিজের চোখেই দেখেছে নাসির। কিন্তু কতবার আর বলা যায় একই কথা? যাওয়ার কথা ছিল আরিচা থেকে গোয়ালন্দঘাট পেরিয়ে খুলনার দিকে। কিন্তু চলে এসেছে নগরবাড়ি পেরিয়ে উল্লাপাড়ার দিকে। এখনো মৃত্যুর ঘ্রাণ নেই এখানে আর অস্বস্তিটা সেখানেই, যে-কোনো সময় শুরু হবে মৃত্যুর উৎসব। মৃত্যু না দেখা পর্যন্ত কেউ কি ঠিক বুঝতে পারে, ঘোর নাকি বাস্তব, কোনখানে আছে সে? কোনখানে যাবে সে? ঘরের দরোজা খোলা হয়েছে, ঢুকতে ঢুকতে সে দেখে শসার ক্ষেত থেকে রহমত ষাঁড়টাকে টেনে আনছে। আবিদ ঢুকতে ইতস্তত করছে দেখে নাসির ডাক দেয় তাকে, আসো, তুমিও আসো – বলে সে লোকটার দিকে চায়। আমরা সারারাত একসঙ্গে ছিলাম। আরো কয়েকজন ছিল। তারা সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে।
আবিদও মুখ খোলে এ-সুযোগে, কিন্তু ভাইজানের যাওয়া ঠিক হতো না। ভাইজানের সঙ্গে রাইফেল আছে না?
বেশ গর্বিত মনে হয় তাকে। অস্ত্রটা যেন তার, নাসিরকে কয়েকদিনের জন্য ধার দিয়েছে। নাসির তাড়াতাড়ি দেখে নেয় ঘরটাকে। ছিমছাম, পরিপাটি, দুপাশে দুটো খাট পাতা হয়েছে। একটা বাঁশের মাচাও আছে, রাজ্যের কোলা আর হাঁড়ি-পাতিল তার ওপরে।
চলে গেছিলেন, তাড়াতাড়িই ফিরলেন মনে হয়? বিছানার ওপর বসতে বসতে প্রশ্ন করে নাসির। কিন্তু লোকটা নয়, দু-হাতে দু-গ্লাস শরবত নিয়ে আসতে আসতে তার বউ বলে ওঠে, পালাতেই চাইছিলাম ভাই। ঠিক করছিলাম, আরো গ্রামের ভেতর যাব। সকালবেলা মনে হলো, ছেলেগুলো কোথায় না কোথায় আছে… আবার কবে ফিরবে… কোনখানে উঠবে… তার চেয়ে বাড়িতেই থাকি, যা হয় হবে। দেখছেন তো ভাই, ওদের আহার-নিদ্রা হারাম হয়ে গেল, মাঝেমধ্যে আসবে, তখন থাকতেও যদি দিতে না পারি…।
কণ্ঠ তার বুজে আসে, যেন কোনো প্রার্থনাসংগীত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্তহীন কোনো প্রান্তে। দুজনের হাতে শরবতের গ্লাস দুটো দিয়ে সে অাঁচল টেনে দ্রুত সামলায় নিজেকে। গৃহস্থ লোকটা এই ফাঁকে ফিসফিসিয়ে বলে, ওরা মাইনকার চরে গেছে…
অস্বস্তিটা কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে, অনুভব করে নাসির। অনুভব করে, সকালে ঘুম ভাঙার পর নিরাত্মীয়তার যে স্বাদ পেয়েছিল, তা ক্রমেই দূর হয়ে যাচ্ছে। আর শরবতের গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে আবিদ বলে, ভাইজান সারারাত না খেয়ে আছে।
শুনে কেন যেন হাসি পায় নাসিরের। বলে, তোমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, না?
লজ্জাই লাগে আবিদের। লোকটা, তার বউ আর তাদের মেয়েটা এমনকি গোয়ালঘর থেকে ফেরা রহমতও হেসে ওঠে একসঙ্গে। আবার হঠাৎ করেই থেমে যায় মাঝপথে। লোকটা সন্তর্পণে বাইরে থেকে হেঁটে আসে একবার। কিন্তু কানটা খাড়া করে রাখে নাসির। বলা কি যায়, কনভয় আবার কখন আসে! ইচ্ছা হলো, থেমে পড়ল, হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ল গ্রামের ভেতর। তারপর আবার ইচ্ছা হলো, কিছুক্ষণ গোলাগুলি করল, আগুন জ্বালিয়ে দিলো, গুলি চালিয়ে শিকার করল পালাতে থাকা কিছু লোকজন। আবার ধর্ষণও করল, যাতে দূর-ভবিষ্যতে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিদগ্ধ সাংবাদিক-গবেষক লিখতে পারে, পাকিস্তানি সেনারা তাদের নারীদের রেখে এসেছিল হাজার হাজার মাইল দূরে, জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য তারা তাই ধর্ষণ করেছিল। দক্ষিণের বুক-সমান উঁচু জানালাটা দিয়ে নাসির বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সারা গায়ে রোদ লাগানোর ইচ্ছা জাগে। আবিদ আবারো তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে বাঁশের মাচার দিকে, যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে চায়নিজ রাইফেলটাকে। এখন আর বাড়ি ফেরার কোনো মানে হয় না। তবে এখনই তো বেরোনো সম্ভব নয়, রাত ছাড়া সম্ভব নয় এই রাইফেল নিয়ে কোথাও যাওয়া। কিন্তু রাতে অবশ্যই চলে যেতে হবে এ-বাড়ি থেকে। অন্য কোনোখানে যেতে হবে তাকে – এমন কোথাও যেখান থেকে এই রাইফেলটাকে কাজে লাগানো যাবে।