ট্রেনে উঠতেই কানে এলো কেউ একজন আস্ফালন করছে, আপনি আমাকে চেনেন? কথা বলতে-বলতে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বুঝলাম, কোনো একটা বিষয় নিয়ে অনেক আগে থেকেই চলছে। মাঝবয়সী ভদ্রলোক, লম্বা-চওড়ায় দশাসই, মাথায় কদমছাঁট চুল, দুদিনের না-কামানো দাড়িগোঁফ, পরনে ফেডেড জিনসের ওপরে লাল-সবুজের ডোরাকাটা টি-শার্ট। চোখমুখে অদ্ভুত একটা রুক্ষতা।
দুপুরের বনগাঁ লোকাল এমনিতেই ফাঁকা থাকে, আজ তুলনায় বেশি ফাঁকা। হতে পারে শনিবার বলে। একজনও দাঁড়িয়ে নেই। সকলের বসার পরেও বেশকিছু সিট তখনো ফাঁকা।
জবাবে জানালার ধারে বসা বয়স্ক ভদ্রলোকের গলায় তাচ্ছিল্য, টাইম নেই। বয়স অনুমান সত্তরের কাছাকাছি। মাথায় সব চুল সাদা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পোশাক-আশাকে মার্জিত রুচির ছাপ। নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে ভদ্রলোক আমার পরিচিত। ডেইলি প্যাসেঞ্জার মহলে নীলুদা নামে পরিচিত। রিটায়ার করেছেন অনেক বছর। অধ্যাপক ছিলেন। এখন একটি ওপেন ইউনিভার্সিটিতে পড়ান।
লোকটি হয়তো এ-ধরনের উত্তরের জন্য প্রস্ত্তত ছিল না। অথবা বুঝতে পারেনি। থতমত খেল। কয়েক মুহূর্তের নীরবতায় উপলব্ধি করার চেষ্টা করল উত্তরের তীব্রতা। তারপর গলার স্বর আরো একধাপ চড়িয়ে আবার প্রশ্ন, আপনি আমাকে চেনেন? জানেন আমি কে?
নীলুদার গলায় একই রকম নির্লিপ্ততা, বললাম না, টাইম নেই।
– মুখ সামলে কথা বলুন। প্রথম থেকে দেখছি আপনার মধ্যে নেগলেক্ট করার টেন্ডেন্সি। কী ভাবেন নিজেকে, শিক্ষিত? পন্ডিত? বুদ্ধিজীবী? আপনার মতো বুদ্ধিজীবী আমাদের পেছনে কুত্তার মতো ফ্যা-ফ্যা করে ঘোরে।
– তাই সকলের জানা উচিত আপনি কে, এই তো? তো আপনি কে ভাই, মস্তবড় কোনো সেলিব্রেটি? মানে ফিল্মস্টার, মিনিস্টার, খেলোয়াড়, না নামকরা কোনো শিল্পী-সাহিত্যিক? যতদূর মনে পড়ছে টিভি বা খবরের কাগজে আপনার কোনো ছবি কখনো দেখিনি। দয়া করে আপনার পরিচয়টা বলবেন?
– রাখুন তো নাটক। জগন্নাথ মালাকার ওসবের পরোয়া করে না।
– না, নামটাও শোনা বলে মনে হচ্ছে না। দয়া করে একটু বলবেন, আপনি কেন বিশেষ? মানে, আপনাকে না চেনাটা কেন গর্হিত অপরাধ?
– আবার কথায় প্যাঁচ মারছিস? শালা বুড়ো সুড্ডা…
– বাহ্! বাপ-বয়সী লোককে তুই বলছেন? ভালো, বলুন। আমি কিন্তু আপনাকে আপনিই বলব –
– নিকুচি করেছে আপনার মতো বাপ-বয়সীর –
– থ্যাঙ্ক য়্যু। নীলুদা মিটিমিটি হাসেন। এখন পর্যন্ত তার আচরণে কোনোরকম উত্তেজনা নেই। বরং জগন্নাথ মালাকার যত উত্তেজিত হচ্ছে তিনি তত কুল। হতে পারে তার এই শীতলতাই জগন্নাথের উত্তেজিত হওয়ার কারণ।
– ও দাদু, আপনি কিন্তু বেশি বকছেন, আর একটাও কথা না। চুপচাপ বসুন। এবার জগন্নাথের পাশে বসা ছেলেটি। বয়স খুব বেশি হলে পঁচিশ-ছাবিবশ। গলায় স্পষ্ট নির্দেশ।
নীলুদা গায়ে মাখেন না। যেন কিছুই হয়নি, অথবা ছেলেটির কথা শুনতে পাননি, এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ওনার সঙ্গে আছেন?
– হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
– আপনি জানেন, উনি কে?
– জানবো না কেন। কুসুমপুর ৩নং গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার বলরাম মালাকারের ছোটভাই। বলরামদাকে পাঁচ গাঁয়ের মানুষ একডাকে চেনে।
– ওনার দাদার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিনি, জানতে চাইছি উনি কে।
– বললাম তো মেম্বারের ছোটভাই।
– মানে দাদার পরিচয়ে পরিচয়, নিজের কোনো পরিচয় নেই। মানুষ বাবা-দাদার পরিচয়ে পরিচয় দেয় নাবালক অবস্থায়। ওনার এখনো নিজের পরিচয় তৈরি হয়নি?
– আবার বাজে কথা বলছেন! আমি নাবালক! দেখবেন কে নাবালক আর কে সাবালক?
– কী করবেন?
– বুড়ো না হলে এতক্ষণে টের পেতেন। জিওগ্রাফি বদলে দিতাম।
– তাতে একটা পরিচয় অবশ্য প্রকাশ পেত, তবে সেটা প্রকাশ্যে এভাবে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলার মতো নয়। আমি কী বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এ-ধরনের মানুষদের সমাজবিরোধী বলে।
– আমি সমাজবিরোধী! দেখে মনে হচ্ছে আমাকে সমাজবিরোধী বলে –
– ওটা দেখে বোঝা যায় না, আচরণে প্রকাশ পায়।
– আপনি বাধ্য করছেন খারাপ আচরণ করতে।
– ঠিকই বলেছে, সঙ্গী ছেলেটি আবার মুখ খোলে, ইনটেনশনালি আপনি ওনাকে উত্তেজিত করছেন। এরপর যদি কোনো অঘটন ঘটে, তার দায় আপনার –
– কিছু ঘটবে না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অতটা দুঃসাহস আপনার বন্ধুর নেই। আর যদি ভুলেও কোনো দুঃসাহস দেখায়, পরিণতি ভয়ংকর হবে।
– কিচ্ছু করতে পারবেন না। আপনার ধারণা নেই ওর সম্পর্কে –
– ওর, না ওর দাদার?
– দাদার মানেই ওর।
– তা বটে! মেম্বার বলে কথা।
– শুধু মেম্বার। পঞ্চায়েতপ্রধানের ডানহাত। আর প্রধানের সঙ্গে এমএলএর রিলেশন জানেন? দুজনেই এক লবির লোক।
– তাই নাকি! নীলুদা বেশ মজা পেয়েছে, এমন ভঙ্গিতে বলে।
– সেজন্যেই তো বলছি, চেপে যান। আর কথা বাড়াবেন না।
– দাঁড়ান দাঁড়ান, বিষয়টা একটু বুঝতে দিন। দাদা মেম্বার, প্রধানের ডানহাত। প্রধানের সঙ্গে এমএলএর ভালো সম্পর্ক। অর্থাৎ প্রয়োজনে জল অনেকদূর গড়াতে পারে। শুনেছি এমএলএর সঙ্গে আবগারি মন্ত্রীর আবার ভালো রিলেশন।
– জানেন দেখছি।
– আবগারি মন্ত্রী তো মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ।
– তাহলেই বুঝুন।
– মুখ্যমন্ত্রী আবার কেন্দ্রের কোয়ালিশন সরকারে আছে। চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রীরও হেল্প নিতে পারেন।
ছেলেটি এবার থমকায়। চোখ সরু করে দেখে। ভেবেছিল ভয় দেখাতে পেরেছে, বৃদ্ধ যে এভাবে তাকে উপহাস করবে অনুমান করতে পারেনি। ট্রেনভর্তি প্যাসেঞ্জার সব মিটমিট করে হাসছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় ছেলেটির। বলে, কী ভেবেছেন? আপনার মতো একটা আরশোলাকে টাইট দিতে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হবে?
– পাগল! তার অনেক আগেই হাপিস করে দিতে পারেন, সে আমি জানি। আমি দেখছি, আপনার বন্ধু, মানে জগন্নাথের হাত কত লম্বা! আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তো আমেরিকার অর্থনীতি ফলো করছেন। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন। প্রয়োজনে উনি ওবামার সাহায্যও পাবেন। চাই কি ন্যাটোর সৈন্য পাঠিয়ে দেবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। মানে জগন্নাথ টু ওবামা, হাতটা নেহাত কম লম্বা নয়।
– চোপ। আর একটা কথা বলবি তো টুঁটি চেপে ধরব। কী ভেবেছিস, তোর চালাকি বোঝার ক্ষমতা নেই। জগন্নাথ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। রাগে উত্তেজনায় চিৎকার করতে-করতে এবার সে উঠে দাঁড়াল। মারমুখী ভঙ্গি। গতিক খারাপ দেখে ছেলেটি পেছন থেকে টেনে ধরল। বলল, জগন্নাথদা, কুল কুল…
– তুই ছাড় তো, বড়ো বাড় বেড়েছে। যা ইচ্ছা তাই বলছে। কী ভেবেছে আমাকে! শোন বুড়ো, তোর মতো টিকটিকি পিষে মারতে আমার এক মিনিটও লাগবে না। যা ভাবছিস, আমি তা নই।
– তাই?
– হ্যাঁ, তাই। ভুল ভাবছিস আমাকে।
– এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। স্যরি, জগন্নাথবাবু, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। আসুন, আপনাকে জানালার ধারের সিটটা ছেড়ে দিলাম।
নীলুদা হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নাটকীয় ভঙ্গিতে।
এতক্ষণে বুঝতে পারি, গন্ডগোলের কারণ আসলে জানালার ধারের সিটটা নিয়ে। বসার জায়গা নিয়ে লোকাল ট্রেনে ঝগড়াঝাঁটি নতুন ঘটনা নয়। মাঝে মাঝে এরকম বাধে।
যদিও জগন্নাথ জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়ে না। অন্য কেউও জানালার ধারে বসার আগ্রহ দেখায় না। নীলুদাও দাঁড়িয়ে থাকে এবং ট্রেনসুদ্ধ মানুষকে অবাক করে মুখে কুলুপ আঁটে। জগন্নাথ তখনো গজরাচ্ছে। মাঝে মাঝে কটুবাক্য ব্যবহার করছে। সেসব শব্দ প্রতিপক্ষকে উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ট। নীলুদা তবু নিরুত্তর। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে।
ঝগড়া শুনতে-শুনতে সময়টা বেশ কাটছিল। কেবল আমি নই, ট্রেনসুদ্ধ মানুষ মজা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোকের হঠাৎ এমন মৌনব্রতে হতাশ হতে হলো সবাইকে।
জগন্নাথ আরো কিছুক্ষণ আস্ফালন করল। কিন্তু নীলুদার দিক থেকে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না আসায় একসময় রণে ভঙ্গ দিলো। বৈশাখের দুপুর। খাঁ-খাঁ রোদ। বাতাসে যেন লু বইছে। ফাঁকা মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে গন্তব্যের দিকে।
গুমা পার হলে নীলুদা পায়ে-পায়ে এগোতে থাকে। পরের স্টেশন অশোকনগর। তার গন্তব্য। একই রকম নির্লিপ্ত মুখ। একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায় না। ভাবটা এমন, যেন কিছুই হয়নি।
ভদ্রলোক গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়। আমিও অশোকনগরের যাত্রী। উঠে এসে দাঁড়িয়েছি পেছনে। জগন্নাথ নামবে কুসুমপুর, এখনো বেশ কয়েকটা স্টেশন। নীলুদার সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত বাদেই নেমে যাব, তাই জগন্নাথকে ভয় না পেয়ে, মনে হলো প্রশ্নটা করাই যায়। কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, নীলুদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, কিছু মনে করবেন না?
– বলুন ভাই।
– ভালোই তো ফাইট দিচ্ছিলেন, হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন?
– ভয় পেয়ে।
– ভয়! আপনি! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
– সত্যি ভয় পেয়েছি, ভাই। ভদ্রলোক হাসি-হাসি মুখে বললেন।
– কিসের ভয়?
– কেন, শুনলেন না, উনি কী বললেন। ওনাকে যা ভাবছি উনি তা নন।
– কী ভেবেছিলেন?
নীলুদা এবার জগন্নাথের দিকে তাকায়, একঝলক দেখে নেয় লোকটার মুখ, তারপর গলাটা উচ্চগ্রামে তুলে বলে, মানুষ!