অরিন্দম মুখার্জি বিয়ে করেছে।
একটা গল্পের সূচনা-লাইন এরকম ম্যাড়মেড়ে হলে কি কেউ আর গল্পটা পড়তে চাইবে? এই লাইনে কোনো চমক নেই, ঠমকও নেই, নেই কোনো কৌতূহল – উদ্রেককারী তথ্য বা তত্ত্ব। পাঠকের কী দরকার পড়েছে সাদামাটা একটা পঙ্ক্তি দিয়ে শুরম্ন করা গল্পকে এতটা সময় দেওয়ার? মানুষের কাছে সময়ের এখন অনেক দাম। কোনো শিক্ষিত মানুষ এখন আর মুহূর্তকাল অহেতুক অপচয় করতে চায় না। দিনে দিনে, সপ্তাহে সপ্তাহে, মাসে মাসে, বছরে বছরে কত গল্প লেখা হচ্ছে! অতশত গল্প পড়ার সময় কোথায় এখন পাঠকের হাতে?
গল্প নিয়ে লেখকের কত করণ-কৌশল! ভাষা, শৈলী, বিষয়বৈচিত্র্য, বোধ্যতা-দুর্বোধ্যতা – কত কিছুই না দিয়ে এখন লেখকরা পাঠকের দৃষ্টি কাড়ার জন্যে অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন! লেখার জগতে কম্পিটিশন কি কম? সেই জায়গায় অরিন্দম মুখার্জি না কে একজন বিয়ে করেছে – এই দিয়ে গল্প শুরম্ন করেছেন মশাই। ধুর্-ধুর্, আপনার এই গল্পের কাহিনি মাঠে মারা যাবে।
কী, কী বলতে চাইছেন? অরিন্দম তরম্নণ, হালকা-পাতলা দেহ, কোঁকড়ানো চুল, চোখ দুটো উজ্জ্বল, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি – এসব কথা বলতে চাইছেন তো? কী বললেন? এমবিবিএস? ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে? পিজিতে এমএস করছে? সার্জারিতে? তো এইরকম একজন কোয়ালিফাইড ছেলে বিয়ে করেছে, করবেই তো! এই সময়ে, এই বয়সেই তো বিয়ে করা উচিত। উচিত কাজই তো করেছে অরিন্দম মুখার্জি। তাই বলছিলাম ভাই – আপনার এই গল্প পাঠক খাবে না। আর ওই নেতিয়েপড়া লাইনটি দিয়ে পাঠককে গল্পের ভেতরে ঢোকাতে পারবেন না আপনি।
বিয়ে করার পর অরিন্দম মুখার্জির নাম হয়েছে জন টমাস।
কী বললেন? জন টমাস!
অরিন্দম মুখার্জি আইরিন ডি কস্টাকে বিয়ে করে জন টমাস হয়েছে। বামুনের ছেলে খ্রিষ্টান হয়ে গেছে।
ও -! কিঞ্চিৎ ভাবনার বিষয় তো! তা বামুনঘরের মেয়ে পাওয়া গেল না? নিদেনপক্ষে হিন্দুর ঘরের? বলছেন – পাওয়া না যাওয়ার কী আছে? হাজার হাজার ব্রাহ্মণের অনূঢ়া কন্যা ঘরে ঘরে? কোয়ালিফাইড? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কত কী? হিন্দুর ঘরে তো বিবাহযোগ্য মেয়ে অগণন। তা মশাই, স্বজাতে এত এত মেয়ে থাকতে অরিন্দম মুখার্জি আইরিন ডি কস্টাকে বিয়ে করতে গেল কেন?
প্রেম? ও, প্রেম করে বিয়ে করেছে অরিন্দম! তাই নতুন নাম নিয়ে, নতুন ধর্ম নিয়ে নতুন জীবন শুরম্ন করেছে। তা এখন থাকছে কোথায় জন টমাস? ঢাকায়?
মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই তার? আছে? তা তাদের পরিচয়টা?
বাবা অন্নদা মুখার্জি? মা সরলা মুখার্জি? এক ভাই, এক বোন অরিন্দমের?
বোনও ডাক্তারি পাশ করেছে? ভাইটি বিবিএ পড়ছে?
বাপ কী করেন অরিন্দমের? থুড়ি, জন টমাসের?
করেন নয়, করতেন? একসময় নামকরা অধ্যাপক ছিলেন? চট্টগ্রামের একটা সরকারি কলেজের? রিটায়ারমেন্টে গেছেন? মা? মা গৃহিণী? তিনটি সমত্মান লালনপালনে দিন গেছে, রাত গেছে সরলা মুখার্জির? অরিন্দমের জন্যে সর্বাধিক বাৎসল্য পোষণ করতেন তিনি? তো এখন কী অবস্থা? জাতপাতের ব্যাপারে তো হিন্দুরা ভীষণ কট্টর। ব্রাহ্মণদের তো কথাই নেই? খোদ হিন্দুদেরই যেভাবে ঘৃণা করে তারা! খ্রিষ্টান হলে তো কথাই নেই। যা হোক, অরিন্দমের বিয়েটাকে মেনে নিয়েছে তো মুখার্জি ফ্যামিলি?
আপনাদের এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর দিতে পারব না আমি। তবে এইটুকু বলতে পারি, ঘটনাটি জানার পর মুখার্জি পরিবার থেকে চারটি চিঠি গিয়েছিল অরিন্দমের কাছে, ওই দেখুন আবার ভুল করলাম, মানে জন টমাসের কাছে। প্রথম চিঠিটা তার ছোট ভাইয়ের, দ্বিতীয়টা বোনের, তৃতীয়টি অন্নদা মুখার্জির এবং শেষ চিঠিটা ছিল তার মা সরলা মুখার্জির।
ছোট ভাই অতুলের চিঠি –
দাদা,
কেমন আছিস? এখন তো ভালোই থাকার কথা তোর। ফুর্তি মারছিস খুউব। লাইরে লাপ্পা জীবন। টাক ডুমা ডুম বাজনা বাজাইয়া যাইতাছ। একদিকে টাকার সুখ, অন্যদিকে বউয়ের সুখ। সুখের বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিস এখন। তুই মাংস খেতে খুব ভালোবাসতিস। মা খাসির মাংস রান্না করত শুধু তোর জন্যে। আমাদের পাতে সেই মাংস পড়ত না। পড়বে কী করে, বাবার যে এক কেজি মাংস কেনার মুরদ ছিল না! কষ্টেসৃষ্টে আধা কেজি মাংস আনত বাবা। সদরঘাট কালীবাড়ির কসাইদোকান থেকে। জামাল কসাই আধা কেজি মাংস বেচতে চাইত না। বাবা নাকি একদিন চাপাস্বরে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। বলেছিল, আমার বড় ছেলেটা খাসির মাংস খেতে বড় পছন্দ করে, কিন্তু ভাই সংসারে টানাটানি। এক-দেড় কেজি মাংস কেনার সামর্থ্য নেই আমার। তুমি যদি মাঝেমধ্যে আমার কাছে আধা কেজি মাংস বেচ, তাইলে ছেলেটার সাধ মিটে। জামাল কসাইয়ের কাছে নিজেকে ছোট করে তোর জন্য মাংস আনত বাবা।
মা একদিন আমাকে আর সুনন্দাকে কাছে বসিয়ে বলল – দেখ বাছারা, তোমাদের বাবার আয়-ইনকাম সম্বন্ধে তো তোমরা জান। গোটা পরিবারের জন্যে মাংস কেনার ক্ষমতা নেই আমাদের। তাই আধা কেজি আনা। বড়দার জন্যে। তোমাদের পাতে খাসির মাংস দিতে পারব না বাছারা। বলতে বলতে কেঁদে দিত মা।
তো আমাদের প্রাপ্য হক মেরে মেরে মা যে মাংস রেখে দিত, তাই খেতিস তুই, এবেলা-ওবেলা, পরের বেলা। আমাদের জন্যে ডালনা-চ্চচড়ি-পুঁইশাক। নিদেনপক্ষে তেলাপিয়া। ওগুলো সসত্মাতে পাওয়া যেত। ওহো, বলতে ভুলে গেছি, খেসারি ডালও থাকত। ওগুলো খেয়ে কী যে তৃপ্তি পেতাম! না না, কোনোদিন হিংসা করিনি তোকে। মা বলত – তোমাদের দাদা একদিন মসত্মবড় ডাক্তার হবে। কত টাকা আয় করবে তখন! নিত্যদিন কেজি কেজি মাংস আসবে ঘরে। ইলিশ, কাতলা, চিতল – রাঁধতে রাঁধতে হয়রান হয়ে যাব আমি। তোমাদের পাতে গলদা চিংড়ি তুলে দেব, কোরমা-পোলাও তুলে দেব। তোমরা না না করবে।
মায়ের কথা বিশ্বাস করেছিলাম আমরা। সেই সুদিনের আশায় ছিলাম। যা-ই বলিস, খাসা মাংসভাগ্য তোর। সেই সময়ও খেয়েছিলি, এখনো মাংস খাচ্ছিস তুই, কাঁচা আর রান্না করা। কাঁচা মাংস খেতে কেমনরে দাদা? চান কপাল তোর। তোর জীবনটা মাংসে মাংসে সয়লাব।
তুই কিছু মনে করিস না, একটু আকথা বলে ফেললাম। তুই তো জানিস, ছোটবেলা থেকে আমি একটু ওই ধরনের, মুখ আলগা। আমার আলগা মুখের কথা শুনতে তো তুই অভ্যসত্ম।
বিয়ে মানে তো দরজায় খিল দেওয়া। দশজনের চোখের সামনে থেকে একটু আড়ালে যাওয়ার জন্যে বউকে নিয়ে দরজায় হুড়কো তোলে পুরম্নষরা। তুইও তুলছিস নিশ্চয় – রাতে-বিরাতে, সকালে-দুপুরে। এই হুড়কো তুলতে কেমন লাগেরে তোর? বিন্দাস, তাই না? বউকে নিয়ে এক বিছানায়, কম্বলের নিচে…।
থুউক্কা, আর খাচ্চর খাচ্চর কথা লিখুম না। তুই এখন বিরাট ভদ্দরনোক। এমবিবিএস পাশ! শুনছি – কাটা-ছিঁড়া লইয়া উচ্চতর পড়ালেখা করতাছস। ভালা ভালা। তা বউটি, ধুত্তুরি তোর লাভার কাম বউটি দেখতে কেমুনরে? খাসা, না? নইলে তোর মতো ক্যারিয়ারিস্ট পোলা আটকে গেলি কেমনে? হুন, বারবার বউদি বইলা ঝামেলা করতে চাই না, অহনতোন তোর বউরে বউদি লাভু বইলা ডাকুম। লাভ কইরে বিয়া করছস তো, হেইজন্যে লাভু। তুই নিজে কালা কেষ্ট হইলে কী হইবে, বরাবর তোর টান কিন্তু সাদা মাইয়াগোর দিকে। কেষ্টঠাকুরের যেমুন টান আছিল সাদা চামড়ার রাধা ঠাকুরাইনের প্রতি। তুই না বইল্যেও আমি ধইরা নিতাছি, তোর বউ দেখার মতন একখান জিনিস। নিশ্চয় বর্ষাকালের কাজি পেয়ারার মতো টসটসে, পুষ্ট।
আর একটা কথা শুইন্যা আমি বিশ্বাস করি নাই। তোর কাছে শুইনলে বিশ্বাস করম্নম। তোর বউডা নাকি দুইটা বাছুর বিয়ানো গাই। মাইনে তোর ঘর করবার আগে নাকি বউদি লাভু দুইডা বাইচ্চার জন্ম দিয়া ফেইলছে? হাঁচানি? তা কী মধু আছে পোকায় খাওয়া ওই পেয়ারাটার মইধ্যে? হুনছি, তোর হাসপাতালে রোগী লইয়া আইছিল মহিলাটি। হঠাৎ গভীর রাইতে নাকি সোয়ামির পেট ব্যথা শুরম্ন হইছিল। অত রাইতে কুনু উপায় না দেইখা হাসপাতালেই লইয়া আইছিল সোয়ামিরে। তুই নাকি অন-ডিউটিতে ছিলি সেই রাইতে। ইন্টার্নশিপ শেষ হইতে নাকি মাস দুয়েক বাকি ছিল তখনো। তো তোর সেবাযত্নে সোয়ামিটি মুগ্ধ হওনের আগে বউদি লাভু নাকি এক্কেবারে গলে গেছিল? বেশ কদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর সোয়ামিটা অক্কা পাইছিল? মহিলাটি নাকি বাচ্চা দুইটারে বুকে জড়াইয়া জোরসে কাইন্দ্যা দিছিল। সেই কান্দনের ফোঁটা ফোঁটা পানি পইড়া পইড়া তোর তরম্নণ মনের ভূমিটারে অক্করে ভিজাইয়া তুলছিল। হেই ভিজা মাটিতেই নাকি পিরিতের বীজটা রম্নইখ্যা দিছিল মহিলাটি। প্রেমের গাছটা নাকি লকলকিয়ে বাইড়া উঠছিল তোর হৃদয়ে? উঠবে না! নারীর স্পর্শ বইলে কথা। কান্দনের সময় চোখের পানি মোছাতে টোছাতে গিয়া তোর লগে তো একটু আধটু ছোঁয়াছুঁয়ি হইছিলই। ওই ছোঁয়াছুঁয়িতে কাত হইয়ে গেলি তুই? দুই বাইচ্চাসহ গাইটারে নিয়া নিজের গোয়ালঘরে বাঁধলি? মাইনষে হুদা হুদা তরম্নণী ভাইর্য্যা তরম্নণী ভাইর্য্যা বইলা হলস্নাচিলস্না করে। তোর লগে কথা কইলেই বুঝতে পারত দোফসলা জমিতে চাষ করতে কত সুখ! তুই আনাড়ি বটে, মাঠটা তো আর অনুর্বর নয়?
আর একখান কথা কইতে ভুইল্যা গেছি তোরে। একজন মাইয়া পোলার মুখম-ল ওপরে-নিচে সাত ইঞ্চি, ডানে-বাঁয়ে নয় ইঞ্চি। গুণ করলে তেষট্টি বর্গ ইঞ্চি হয়। মাইয়া লোকদের চেহারাতেই যা পার্থক্য। মগর ভেতরে সবার একরকম। একই রকম যন্ত্রপাতি।
আইজ হোক, কাইল হোক, তোরে তো বিয়া করাইতোই বাপে-মায়ে। সে-রকম কথাও চালাচালি হইতাছিল। তো তুই অপেক্ষা না কইরা ওই তেষট্টি বর্গ ইঞ্চির কাছে আত্মসমর্পণ করলি। একবারও ভাবলি না তুই, ওই তেষট্টি বর্গ ইঞ্চির বিনিময়ে কত লক্ষ বর্গ যোজনের স্নেহ আর শ্রদ্ধার ভূমি হারালি তুই!
আমার জীবন, আমার জীবন – এই কথা বইল্যা তুই উড়াইয়া দিতে পারস আমাদের। কিন্তু উড়াইয়া দিলেও তো উড়ে যাওনর না আমরা। তোর জীবনের লগে যে আমাদের জীবন জড়াইয়া আছে। এই যে তোর শইলের এত বাড়-বাড়মত্ম, ওইখানে তো আমাগোর হিস্যা আছে। আমাদের না খাইয়ে না খাইয়ে তোরে খাবার জোগান দিছে অন্নদা মুখার্জি আর সরলা মুখার্জি। তোর জন্যে ভালা একখান শার্ট গায়ে দিতে পারি নাই, এক প্যান্টে কলেজে যাতায়াত করছি, স্যান্ডেলে যে কতবার তাপ্পি মারছি, মনে রাখি নাই। সুনন্দার কথা ভুইল্যা গেছস? তোর টাকায় টান পড়বে বইল্যা বাবার কাছে মুখ ফুটে কুনুদিন কিচ্ছুটি চায়নি বোনটি। টিউশনি কইরা কইরা মেডিক্যালে পড়ার খরচ জোগাড় করছে। যা, সব তুই ভুইল্যা যা। আমাগোর কিচ্ছু আসবে যাবে না। তবে আমাগোর দীর্ঘশ্বাস তোরে তাড়াইয়া বেড়াইব, যতদিন তুই বাঁইচা থাকস। তু্ই ভালা ছাত্র আছিলি। আমি ফেল্টুমার্কা। পরীক্ষায় ডাববু মাইরা সাইরা পিছাই পড়ছি। তারপরও হিম্মত হারাইনি।
কেন তুই এরকম করলি দাদা? কত ভালোবাসতিস তুই আমাকে! মনে পড়ে তোর – একবার গাঁয়ের বাড়িতে গেছি আমরা সবাই, মা-বাবা ভাইবোন। দুর্গোপুজোর সময়েই গেছিলাম আমরা। কী সুন্দর গ্রাম আমাদের, দুর্গাপুর! ওই যে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন – ধন-ধান্য পুষ্পভরা, সেরকমই। গাঁয়ের মাঝখানে আমাদের বাড়িটা, মাটির দোতলা বাড়ি। বহুদিনের পুরনো মুখার্জি বংশ। জমিদারবাবু নাকি নদিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের প্র-প্র পিতামহকে। দুর্গোপুজো করার জন্যে সদ্ব্রাহ্মণ দরকার। বাড়িটি গড়ে দিয়ে, একশ কানি জমি দিয়ে পুজোর ভারটা আমাদের বুড়ো পিতামহের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে দুর্গোপুজোটার দায়িত্ব আমাদের বংশের পুরম্নষরা পালন করে আসছে। জমিদারি বিলুপ্ত হয়েছে, জমিদারও গেছেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্ষয়ে ক্ষয়ে অমাবস্যার আগের রাতে এসে ঠেকেছে। বাবা কিন্তু পুজো করা ছাড়েনি। গাঁয়ের মানুষদের কাছ থেকে চাঁদাটাদা নিয়ে পুজোটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। বাবা নিজে প্রধান পুরোহিত হয়ে তন্ত্রধারায় পুজো করে যাচ্ছে এখনো।
সেবারও আমরা পুজো উপলক্ষে দুর্গাপুরে গিয়েছিলাম। বাবা পুজো নিয়ে ব্যসত্ম, মা রান্নাঘরে। আমার বয়স আর কত তখন? সাত-আট। দুর্গামন্দিরের পাশেই বিরাট দিঘি, জমিদার আমলের। তো টলটলে জলের টানে সেই দিঘিতে নেমে পড়েছিলাম আমি। সাঁতার তো জানতাম না, কিছুক্ষণ পোটকা মাছের মতো হাবুডুবু খেয়ে জলের তলে তলিয়ে গিয়েছিলাম। কে নাকি চিৎকার করে ওঠায় তড়িদ্বেগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে তুমি? যখন চোখ খুলল আমার, ড্যাবডেবে চোখে দেখলাম – আমাকে কোলে নিয়ে আকুল হয়ে কাঁদছ তুমি। আমার অশ্রম্ন দিঘির জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সেদিন।
আমার সেদিনের দাদাটি আজকে কোথায়? এর মধ্যে যদি আমার মৃত্যু হয়, হতেও তো পারে দাদা, স্বাভাবিক মৃত্যু না হলেও আত্মহত্যার মধ্য দিয়েও তো হতে পারে, তখন কে আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদবে দাদা?
ইতি অতুল
ছোট বোন সুনন্দার চিঠি –
বড়দা,
তোমাকে আগে কখনো চিঠি লিখিনি। চিঠি লেখার প্রয়োজন হয়নি বলে লিখিনি। মোবাইলেই প্রয়োজনীয় কথা সেরেছি। আজো মোবাইলে আমার কথাগুলো বলতে পারতাম। কিন্তু মোবাইলের কথা অত্যমত্ম ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণিক পরেই উড়ে যাবে। মোবাইলের কথাগুলো তোমার মধ্যে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও স্থায়ী কোনো ছাপ ফেলবে না তোমার মনে। আমি চাই, আমার কথাগুলোর একটা লিখিত রূপ থাকুক। এই চিঠিটি একবার পড়ে হয়তো তাচ্ছিল্যভরে তোমার ঘরের এক অবহেলিত কোণে ফেলে রাখবে। দীর্ঘদিন পরে, যদি কখনো এই চিঠিটি আবার তোমার চোখে পড়ে, আমি জানি, তা আবার তুমি হাতে তুলে নেবে। তখন হয়তো তোমার বর্তমানের ইমোশন কেটে যাবে, হয়তো তোমার অতীত জীবন তোমাকে একটু-আধটু খোঁচা দিতে থাকবে, সেই মুহূর্তে তোমার কেমন লাগবে, তা না দেখলেও অমত্মত অনুভব করবার বড় ইচ্ছে জাগছে। তাই এই চিঠি লেখা, তোমাকে। অন্যরা যে যা-ই বলুক, এটা তো সত্য যে, হিন্দুসমাজ অত্যমত্ম রক্ষণশীল। জাতপাতের ব্যাপারটি এখনো শিথিল করতে রাজি নয় তারা। কথাচ্ছলে বা বক্তৃতামঞ্চে অনেকে অনেক কথা বলে – হিন্দুসমাজ এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, মডার্ন হয়েছে। আগের গোঁড়ামি এখন আর নেই। উঁচুনিচু ভাই ভাই – এসব। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা আচরণ করে ঠিক তার উলটো। ব্রাহ্মণদের মধ্যে তো কট্টরতা আরো ভীষণ। আমাদের পরিবারের কথাই ধর না। বাবার মতো সজ্জন, উদারলোক আশপাশে দু-চারজন খুঁজে পাওয়া ভার। কোনোদিন কাউকে কটুকাটব্য করতে দেখেছ? দেখনি। সেই বাবাই কিন্তু বর্ণত্ব সংরক্ষণের ব্যাপারে একরোখা।
এই একগুঁয়েমিতে তুমিও কি কম ছিলে দাদা? নিশ্চয়ই বিশ্বপতি রায়ের কথা মনে আছে তোমার। যদি বল – কোন বিশ্বপতি রায়, ঠিকঠাক মতন মনে পড়ছে না তো আমার? তোমার এই কথা শুনে যে সবচাইতে বেশি অবাক হবে, সে আমি। কারণ, বিশ্বপতি-সংক্রামত্ম ব্যাপারটিতে তুমিই প্রচ- ভিলেনের ভূমিকা নিয়েছিলে। যাই হোক, সেদিন যে-বিষয়টি তোমাদের সামনে আমি স্পষ্ট করে বলবার সাহস করিনি, আজ তা বলছি। এখন অবশ্য বলে লাভ নেই। কারণ বিশ্বপতির মতো নিরপরাধ ছেলে তোমার হাতেই তো মার খেয়েছিল, ওই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে। সেদিন লজ্জায় আর বিষণ্ণতায় মরমে মরে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ভীতু আমি, কাপুরম্নষ আমি, কিছুই করতে পারিনি সেদিন। হ্যাঁ, নারী হয়েও আমার জন্য ‘কাপুরম্নষ’ শব্দটিই লিখলাম। ‘কাপুরম্নষে’র স্ত্রীবাচক শব্দ কী আমার জানা নেই। তাছাড়া একজন মানুষের ভীরম্নতা প্রকাশের জন্য ‘কাপুরম্নষ’ শব্দের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
যা হোক, বিশ্বপতির বাবার নাম সুবিমল শীল। বিশ্বপতি শীল না লিখে রায় পদবি লিখত। সুবিমল বাবুকে বাবা চিনত। একসময়ে ওরা একই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিল। তো এই বিশ্বপতির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দুজনে একই ইয়ারে পড়তাম। আমাদের মনে হয়েছিল এমবিবিএস শেষ করে আমরা বিয়ে করলে পৃথিবীর শ্রেম্নষ্ঠ দম্পতির একটি হব।
ব্যাপারটি এক সন্ধ্যায় বাবাকে জানালাম। বাবা রিঅ্যাক্ট করল ভীষণ। তুমিও সেই সন্ধ্যায় বাসায় উপস্থিত ছিলে। কী উপলক্ষে তোমাদের হাসপাতালে ধর্মঘট চলছিল তখন। চট্টগ্রামে এসেছিলে। অতুলদাও ছিল। আমার কথা শুনে বাবার চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছিল কোটর থেকে। ক্ষোভে হঠাৎ তোতলাতে শুরম্ন করেছিল বাবা। মুখ দিয়ে তার কথা সরছিল না। অনেক চেষ্টায় তিনটে শব্দ বেরিয়ে এসেছিল বাবার মুখ থেকে – নাপিত্যার ছেলেকে বিয়ে…? দাদা, তুমি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছিলে। অতুলদা তোমাকে আটকে দিয়েছিল। কী অলৌকিক মন্ত্রবলে বাবা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে ফেলেছিল। তারপর স্বভাবসুলভ শামত্মকণ্ঠে বলেছিল, ‘বিশ্বপতি রায় নাপিতের ছেলে। তার বাপ সুবিমল শীল। বর্ণচোরা। আমরা মুখার্জি। ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে শীলের ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছিস? মনে রাখিস, যেদিন তুই ওকে বিয়ে করবি, সেদিনই আমি আত্মহত্যা করব।’ সব শুনে দাদা তুমি ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলে। হঠাৎ লাফ দিয়ে আমার চুলের গোছা চেপে ধরেছিলে। অতুলদা তোমাকে ছাড়িয়ে না নিলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত সে-সন্ধ্যায়। তুমি চেয়ারে বসতে বসতে বলেছিলে, ‘জাত খোয়াতে বসেছিস? নাপিতের ছেলেকে বিয়ে করে মুখার্জি পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে চাইছিস?’
আমি সেদিন বুঝেছিলাম, মুখার্জি পরিবারের কৌলীন্য তোমার হাত দিয়েই সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু বিধাতার কী পরিহাস দেখ দাদা – কী নিদারম্নণভাবেই না তুমি আজ বাবার ব্রাহ্মণত্বকে রক্ষা করলে!!
সেদিন আমার গায়ে হাত তুলে তুমি ক্ষামত্ম হওনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হলে কী হবে, চট্টগ্রামেও তোমার বন্ধুর অভাব ছিল না। একদিন কলেজে গিয়ে ওই বন্ধুদের নিয়ে বিশ্বপতিকে লাঞ্ছিত করে এসেছিলে তুমি। আজ বর্ণবাদী সেই অরিন্দম কোথায়? মুখার্জি পরিবারের কৌলীন্য রক্ষাকারী সেই উন্নত মসত্মকের সৈনিকটি আজ কোন অাঁধারে মুখ লুকিয়েছে? বিশ্বপতির কাছে মাফ চেয়েছিলাম আমি, দুহাত জোড় করেই ক্ষমা চেয়েছিলাম তার কাছে। সেদিনই আমার ভালোবাসাকে ওই কর্ণফুলীর জলে বিসর্জন দিয়েছিলাম।
আরো অনেক কিছু লেখার ছিল দাদা তোমাকে। কিন্তু কেন জানি, বারবার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। পোড়া চোখ দুটো আবার জলে ভিজতে চাইছে কিনা কে জানে। যা কাঁদার ওইদিন, মানে যেদিন তুমি বিশ্বপতিকে মেরেছিলে, সেইদিনই কেঁদে ফেলেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে যখন আমার অশ্রম্নভা-ার একেবারেই শুকিয়ে এসেছিল, চোখ দিয়ে আর জল বেরোচ্ছিল না, তখনই কান্না থামিয়ে ছিলাম আমি। মনে করেছিলাম – এই জীবনে আমাকে আর কাঁদতে হবে না। আজকে কেন মরার পোড়া চোখ দুটো দিয়ে আবার জল আসতে চাইছে, জানি না। আমি আর কারো জন্যে কাঁদব না। তোমার জন্যে কাঁদব না, মায়ের জন্যে কাঁদব না, অতুল দাদার জন্যেও কাঁদব না। এমনকি আমার নিজের জন্যেও আর কোনোদিন কাঁদব না বলে ঠিক করেছি।
এখন আমাদের পরিবারে কাঁদছে শুধু দুজন – মা আর বাবা। মা কাঁদছে চাপাস্বরে, বুক-মাথা চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে। আর বাবা কাঁদছে গুমরে গুমরে।
দাদা, চিঠিটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গুছিয়ে আর লিখতে পারছি না। আগের কথা পরে আর পরের কথা আগে হয়ে যাচ্ছে।
শেষে একটি কথা লিখি তোমাকে – বাবা যেন কী রকম হয়ে গেছে। কারো সঙ্গে কথা বলে না, ঠিকঠাক মতন খেতে বসে না দুবেলা। কোথাও বের হয় না। চুপচাপ বারান্দার কোনায় বসে বসে রাসত্মার দিকে থাকিয়ে থাকে। ঢাকা থেকে ওই রাসত্মা দিয়েই আসতে তুমি দাদা।
তোমার বোন
সুনন্দা
অন্নদা মুখার্জির চিঠি –
আমি অন্নদা মুখার্জি। এককালে তোমার পিতা ছিলাম, এখন তোমার পিতৃত্ব স্বীকার করি না। প্রশ্ন করতে পার, পিতাই যখন নাই, তাহলে এ চিঠি কেন? এ চিঠি এজন্যে যে, তুমি ঋণগ্রসত্ম। তোমার সমাজঋণ, পিতৃ-মাতৃঋণ পরিশোধ করনি তুমি। ঋণদাতাদের মধ্যে আমিও একজন বলে ঋণগ্রহীতা তোমাকে চিঠি লেখার অধিকার এখনো আমার আছে। তাই এই চিঠি লিখছি তোমাকে। জেনে রেখ, তোমাকে লেখা এই আমার শেষ চিঠি।
‘পুত্র’ শব্দের অনেকগুলো প্রতিশব্দ আছে। ‘আত্মজ’ তাদের একটি। আত্ম মানে নিজের। ‘জ’ মানে জন্মানো। ‘আত্মজ’ মানে নিজে জন্মানো। একজন মানুষ পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করে। তাই পুত্রের অপর নাম ‘আত্মজ’। তুমি আমার ‘আত্মজ’ ছিলে। তোমার মধ্যে আমি আমার বিসত্মারকে দেখে অপার আনন্দ লাভ করেছিলাম। প্রথম সমত্মান ছিলে তুমি আমাদের।
তোমার মা ভীষণ সুন্দরী ছিল। কিন্তু জন্মাবার পর দেখা গেল, তুমি আমারই গাত্রবর্ণ পেয়েছ, কৃষ্ণকালা। কাজলকালো বোঝাতে যা বোঝায়, সেরকমই রং হলো তোমার, আমি অরিন্দম ডাকলেও তোমার মা তোমাকে কৃষ্ণ বলে ডাকা শুরম্ন করল। তোমার মায়ের এই সম্বোধনের মধ্যে পুত্রবাৎসল্য এবং ভক্তিভাব – দুটোই মিলেমিশে ছিল। আমি মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করলেও তোমার মা তা গায়ে মাখত না। মুচকি হেসে গৃহাভ্যমত্মরে যেত।
তুমি যত বড় হচ্ছিলে, আমার বুক ফুলে ফুলে উঠছিল। বছর বছর তুমি এ-ক্লাস থেকে ও-ক্লাসে যাচ্ছিলে – ওয়ান টু থ্রি, একাদশ দ্বাদশ। ভালো ছাত্র ছিলে তুমি, ভীষণ ভালো ছাত্র। স্কুলজীবনে কখনো ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হওনি। তোমাকে আমি দিন দিন অাঁকড়ে ধরছিলাম। এই মুখার্জি পরিবারের পরবর্তী অবলম্বন বলে মনে হচ্ছিল তোমাকে। তোমাতে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারলেই যেন আমার জীবনের যথার্থ সুখ আর স্বসিত্ম।
আমি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতাম বটে, কিন্তু সেই বেতনে সংসার চলত না। তোমার পরে আরো দুটো সমত্মান হলো আমাদের – অতুল আর সুনন্দা। পাঁচ-পাঁচটি হাঁ-করা মুখ ঘরে। যা বেতন পেতাম তার অর্ধেকটা ঘরভাড়াতে চলে যেত। তারপর তোমাদের পোশাকআশাক, ভরণপোষণ। তোমার মাকে বছরে দুটো ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারতাম না। তোমার মা আমাকে সামত্মবনা দিত, তুমি মন খারাপ কর না। দেখে নিও – একদিন আমার কৃষ্ণ অনেক বড় হবে, তখন শাড়ি পরার সকল আহ্লাদ আমি পুষিয়ে নেব। আর আমার তো মাত্র এক জোড়া প্যান্ট আর এক জোড়া শার্ট ছিল। ওই দিয়েই আমি বছরের পর বছর চাকরি করে গেছি। তোমাকে কখনো সংসারের অভাবের ব্যাপারটি বুঝতে দিইনি।
তুমি ডাক্তারিতে ভর্তি হলে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকায় তো অনেক খরচ। খরচের দিকে তাকাইনি আমি। তোমাকে ঢাকায় পাঠালাম। পরিবারের খরচের বাজেট আরো সংকুচিত করে আনলাম। ঢাকায় তোমাকে স্বসিত্মতে রাখতে হলে আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রিটায়ারমেন্টে গেলাম আমি। চাকরি শেষে দশ লাখ টাকা পেলাম। তখন তুমি থার্ড ইয়ারে। তোমার খরচ বেড়ে গেল। চাকরি শেষের টাকা থেকেই তোমার শেষদিকের পড়ার খরচ চালালাম। ধীরে ধীরে ওই টাকা শূন্যে এসে ঠেকল। তারপরও আমার আনন্দের শেষ থাকল না। তুমি এমবিবিএস পাশ করলে। তুমি বললে – সার্জারিতে এমএস করবে, এই মুহূর্তে কোনো চাকরি করবে না বা প্রফেশন করবে না। আমি চোখ বুজে বললাম – ঠিক আছে। কিন্তু আমার টাকা যে তলানিতে। তারপরও সেদিন কোন সাহসে বলেছিলাম – ঠিক আছে, জানি না। তোমার প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা আর অগাধ বিশ্বাসই আমাকে ‘ঠিক আছে’ বলতে প্রণোদিত করেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যমত্ম তোমার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাসের ভিতটা ভেঙে চুরমার করে দিলে তুমি। বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে বসলে।
তুমি জান – ধর্ম মানে বিশ্বাস। বিশ্বাস মানে অবলম্বন। মানুষের দুটো সত্তা, বাহ্যিক আর অমত্মরগত। বাহ্যিক অসিত্মত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ বস্ত্তগত অবলম্বনকে অাঁকড়ে ধরে। যেমন – বিপদে মা-বাবার সাহায্য নেওয়া, অসুখে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, চুল কাটতে নাপিতের শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু মানুষের অমত্মরগত অবলম্বনটাই আসল। সেই অবলম্বনের আধুনিক নাম বিশ্বাস আর চিরমত্মন নাম – ধর্ম। ধর্ম একজন মানুষকে, একদল মানুষকে, সমাজকে, সম্প্রদায়কে টিকে থাকার, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়। এক একটি সম্প্রদায় পুরম্নষানুক্রমে এক একটি ধর্মবিশ্বাসকে জীবনের একমাত্র পাথেয় মনে করে যুগযুগ ধরে টিকে আছে। ঝড়ে-ঝঞ্ঝায়, রাজনৈতিক ওলটপালটে, অর্থনৈতিক সংকটে, মন্বমত্মরে মানুষ সবকিছু হারিয়ে বসে। কিন্তু ধর্ম হারায় না। ওই ধর্মবিশ্বাসটাই মানুষকে আবার কোমর সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মানুষের সত্তাটাই আসল। যে-লোক পূর্বপুরম্নষের ধর্মবিশ্বাসকে হারিয়ে বসে, প্রকৃতপক্ষে সে সবকিছুকে হারিয়ে বসে। তুমি আজ সব হারিয়ে বসে আছ। মনে রেখ – ধর্মামত্মরিত আর দেশামত্মরিত মানুষের মতো অসুখী আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আজ তুমি নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখীদের একজন ভাবছ, এমন একদিন আসবে, যেদিন নিজেকে সর্বনিকৃষ্ট ভাববে। সেদিন মনোবেদনা বোঝানোর জন্য আপনজন বলে কাউকে পাশে পাবে না তুমি। আমি অন্য সব অপরাধকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু পিতৃপুরম্নষের ধর্ম ত্যাগের পাপকে মাফ করতে পারি না। তোমার জাত্যামত্মরের কারণে আজ সমাজে মুখ দেখানোর অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি। এর চেয়ে আমার মরণ শ্রেয়।
ইতি
অন্নদা মুখার্জি
মায়ের চিঠি –
কৃষ্ণ,
তুমি জীবনে সুখী হও বাবা, স্বসিত্মতে তোমার ভবিষ্যৎ জীবন কাটুক – এই কামনা।
ইতি
তোমার মা
চারটি চিঠিই কাছাকাছি সময়ে অরিন্দম মানে জন টমাসের কাছে এলো। অরিন্দম খামগুলোর মুখ খুলল না, আলমারির এককোণে অবহেলায় রেখে দিলো।