মালিবাগের একটা মেসে ছিলাম । পাঁচ পাঁচটা টিউশনি করে চলতাম । সেই সাথে একটা কোচিং সেন্টারে পার্ট টাইম ক্লাস নিই । বাসা থেকে টাকা দেয় না । বাবা যখন বেঁচে ছিল তখন কিছু টাকা দিতো । দুই বছর আগে বাবা গত হয়েছেন । সৎ মা আমাকে টাকা দিতে রাজি না । বলেছে নিজের রাস্তা করে নিতে । তখন আমি কলেজে পড়ি । সৎ মায়ের সাথে আর কথা বাড়াই নি । মফস্বল থেকে এসে ঢাকা শহরে থাকা চাট্টিখানি কথা নয় । তাও যদি বাসা থেকে টাকা না আসে তাহলে ঢাকা শহরে কুকুরও গুনে দেখে না । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটে ।
খুব করে মনে আছে দুই মাস মেসের টাকা দিতে পারিনি বলে আমাকে মেস থেকে বের করে দিয়েছিল । অনেক অনুনয় করেও থাকতে পারিনি । সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও খুব খারাপ লাগে । একটা টিনেজ ছেলে বই খাতা আর লেপ তোশক নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে । স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোটা গায়ে এসে পড়ছে । নিজেকে অসহায় লেগেছিল খুব !! আমার মা নেই । হারিয়েছি সেই তিন বছর বয়সে । মা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ঘরে এলো নতুন মা । আত্মীয়দের থেকে শুনেছিলাম বাবা আর অপেক্ষা করেন নি । দুই মাসের মধ্যেই বিয়ে করে নিয়েছিলেন । আমার সেই বাবা মারা গিয়েছেন কয়েকদিন আগেই ।মেজর হার্ট এটাক ।
বাবা নেই । বাধ্য হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ ধরলাম । আসলে ছোট ছিলাম তো তাই আমাকে ওয়েটার হিসাবে না দিয়ে ,কাজ দিলো রান্না ঘরে । মানুষের এটো প্লেট ধোয়া , বেসিন পরিস্কার রাখা , রেস্টুরেন্টের ময়লা আবর্জনা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলা এই ছিল আমার কাজ । বিনিময়ে পেতাম ৩ বেলা খাবার । আর রাতের বেলা ঘুমানোর জায়গা । ও হ্যা … সপ্তাহে ৩ দিন কলেজে যেতাম । ওইদিন কর্ম ঘন্টা পুষিয়ে দিতে হতো রাতের বেলা । মালিক আমার একদম নির্দয় ছিল না । মাস শেষে হাতে গুজে দিতো কয়েক হাজার টাকাও । একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেলো আমার !! বেতন পেলেই টাকাগুলো নিয়ে স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে এসে গুনে দেখতাম । ঠিক আছে তো !! নাকি কম দিলো ?
জীবনযুদ্ধটা শুরু হয়েছিল সেই বয়েস থেকেই । মামাদের কাছে হাত পেতে কিছু সাহায্য চেয়েছিলাম । পাইনি । আমার বাবার সম্পত্তির অবস্থাও খুব ভালো ছিল না । এরমধ্যে বাবা মারা গিয়ে জটিলতা আরো বাড়লো । আমি কিছুই পেলাম না । সৎ মা কৌশলে সব কিছু নিজের করে নিলেন । কলেজটা পাস দিলাম । আসলে পাস দিলাম বললে ঠিক হবে না । একবারে জিপিএ ফাইভ । নাহ …আমাকে নিয়ে কোন পত্রিকায় রিপোর্ট আসেনি । আড়ালেই থেকে গেছি । ইচ্ছে ছিল মেডিকেলে পড়বো । কোচিং করার টাকাও আমি পাই নি । ভর্তি পরীক্ষার পড়াশুনা করতে হলে রেস্টুরেন্টের চাকুরী ছাড়তে হবে । অন্যথায় সম্ভব না । সিদ্ধান্ত নিলাম চাকুরী ছাড়বো । তার আগে দরকার টিউশন । ভার্সিটির স্টুডেন্ট না হইলে মিডিয়া টিউশনি দিতে চায় না । আমি তো মাত্র কলেজ পাস । কে আমাকে টিউশনি দেবে ?
মিথ্যে করে পরিচয় সাজিয়ে নিলাম । বললাম ঢাবিতে পড়ি । ফাস্ট ইয়ার । এরকম মিথ্যে কথায় পেটের দায়ে সদ্য কলেজের গন্ডি পেরেনো একটা ছেলে টিউশনি বাগিয়ে নিল ঢাকা শহরে । দিলাম রেস্টুরেন্টের চাকুরী ছেড়ে । নতুন মেসে উঠার মতো টাকা তখনো আসে নি । মেসের বন্ধুদের সাথে বেড শেয়ার করতাম । আস্তে আস্তে দু চারটা করে টিউশনি আসতে থাকলো । এক টিউশনি থেকে বেতন পেলে তার অর্ধেক টাকা মিডিয়া ফি হিসাবে দিয়ে আরেকটা টিউশন ধরতাম । বাকি অর্ধেক টাকায় মাস পার । তোষক আর অপ্রয়োজনীয় বই গুলো বিক্রি করে বড় একটা ব্যাগে নিজের প্রয়োজনের বই গুলো রাখতাম । পড়াশুনা হতো খুব কম । তবে যাই পড়তাম মনযোগ দিয়েই পড়তাম । আর আমার মনোযোগ বাড়তো রাস্তার ধারের স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে গিয়েই । কারন যখন মেস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল তখন জায়গা নিয়েছিলাম ফুটপাতের ওই স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচেই । একদিকে টিউশন ,অন্যদিকে নিজের পড়া ।
এর মধ্যে বাড়িতে একবার খবর নিয়েছিলাম । চেয়েছিলাম নিজের অংশের সম্পত্তিটা বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে আসতে । সৎ মায়ের বাধার কারনে সেটাও পারলাম না । আত্মীয় স্বজনের সাহায্য চাইলাম । ইচ্ছে করেছিলো মামলা করে সম্পত্তি আদায় করে নিতে । কিন্তু সেই সামর্থ্য আমার নেই । অগত্যা ঢাকাতেই টিউশন চালিয়ে যেতে লাগলাম । মাঝে মাঝে টিউশনগুলো থেকে বেতন দিতো না ঠিক মতো । সেই দিন গুলো অনাহারে কাটতো । খুব নিয়ম করে অল্প টাকায় শুধু রাতের বেলা পেট ভরে খেতাম । আর সারাদিন অভুক্ত থেকে নিজের পড়াশুনা আর টিউশনি করাতাম । বন্ধুদের সাথে বেড শেয়ার করে কতোদিন ? মানুষ সবসময় হেল্প করতে চায় না । আমিও কারো দয়ায় থাকতে চাই না । রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন একটা মেসে উঠে গেলাম । আশায় রইলাম টিউশনের বেতন ঠিকঠাক পেলে এখানে থাকতে অসুবিধে হবে না । ঠিকঠাক চলতে লাগলো সব ।
মগবাজার আর মালিবাগ এরিয়ার মধ্যে বেশ ভালো টিউশন করাই । এরই মধ্যে এলো ভর্তি পরীক্ষা । মেডিকেলের কোচিং করি নাই । শুধু এপ্লাই করে এক্সাম দিয়ে এসেছি । এরপরেও শেষের দিকের একটা প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম । কিন্তু আমার মতো হতভাগার পক্ষে ১৫/২০ লাখ টাকা দিয়ে প্রাইভেটে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়া সম্ভব না । বাড়ির জমিজমা বিক্রি করে এই টাকা জোগাড় করা যাবে ? তাও আমার ভাগের সম্পত্তিটা ? বোকার মতো চিন্তা !! তারপরেও খবর নিলাম বাড়িতে । শুনলাম আমার সৎ মা বিয়ে করে নিয়েছেন । বাড়িতে আমার নাম নিশানা বলেও কিছু নাই । শুধু শুধু ঝামেলা না বাড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার দিকে ।
ঢাকা ভার্সিটিতে এক্সাম দিলাম । টিকেও গেলাম । কিন্তু পছন্দের সাবজেক্ট এলো না । আরো ৩ ভার্সিটিতে দিয়েছিলাম। চবি , রাবি আর জাবি । তিন জায়গাতেই টিকলাম । রাবিতে আইন , জাবিতে ইংরেজি আর চবিতে ইকোনোমিক্স । ভর্তি হলাম ঢাবিতেই । মনে আছে ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পর আমি স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম । কেন কেঁদেছিলাম জানি না । পছন্দের সাবজেক্ট না পেলেও দাঁত কামড়ে পড়ে রইলাম । ডি ইউনিট থেকে সাবজেক্ট পেলাম ইতিহাস । সেই ইতিহাস থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে চাকুরীর বাজারে দৌড় লাগিয়েছিলাম । জীবনে প্রেম করার সাহস হয় নি । আমার মতো ছেলেদের প্রেম করার মানসিকতা থাকে না । কি করে থাকবে ? যখন আমার বয়সী টিনেজ ছেলে গার্লস কলেজে মেয়েদের পেছনে ঘুরতো তখন আমি সময় দিতাম রেস্টুরেন্টে । যে বয়সে সন্তানেরা বাবার হাত ধরে এটা সেটা কেনে সেই বয়সে আমি টাকার অভাবে ফুটপাতে রাত কাটিয়েছি ।
সবাই যখন নিজের স্বপ্ন পূরনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় এডমিশন দিতো সেই সময় আমি টিউশন করিয়ে পেট চালিয়েছি । পাশাপাশি পড়াশুনা । কে জানতো এইরকম লাগাম ছাড়া একজন মানুষ জীবন যুদ্ধে টিকে যাবে ?
যখন আমি গল্পটা আপনাদেরকে বলছি তখন কিন্তু আমি টিউশন করাচ্ছি না । একটা বেসরকারী ব্যাংকে মোটা বেতনে চাকুরী করছি । জীবন আমার থেকে সব রকম পরীক্ষাই নিয়েছে । আমাকে টলাতে পারেনি যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন দেখি একটা টিনেজ ছেলে বই খাতা নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে । স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় তার পরনের মলিন জামা কাপড়টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কে জানতো জীবন তাকে এক ধাক্কায় উপরে তুলে নেবে ? কেউ জানতো না । বর্তমান যেমনই হোক , ভবিষ্যৎ ভালোই হবে । কেননা ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই
গল্পের বিষয়:
গল্প