স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ
যখন থেকে বুঝতে শিখলাম দেখতাম আব্বা কোনো কাজ করতেন না। পাঁচ সদস্যের সংসারটাকে আম্মাই টিকিয়ে রেখেছেন। ছাগলের দুধ, হাঁস-মুরগীর ডিম বিক্রি করেই সংসারের পাশাপাশি আমাদের লেখাপড়াও করিয়েছেন তিনি।
বুঝতেই পারছেন, খুবই নিন্মবিত্ত পরিবার ছিলো আমাদের। রং উঠা ভাঙ্গা টিনের ছোট ঘরটা পাঁচ জনের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। এমনো কত দিন গিয়েছে তিন বেলার ভাত যোগাতে আম্মাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। এখনো মনে পরে তরকারি না থাকলে আম্মা কাঁচা মরিচ, পেয়াজ দিয়ে পান্তাভাত মেখে দিতেন। আম্মার হাতের সে খাবার ছিল অমৃত যা মাংসের স্বাদ কেও হার মানায়। আব্বা মাঝে মাঝে দুই একটা ঘটকালি করতেন। কিন্তু তিনি এমনই মানুষ ছিলেন ঘটকালি করেও টাকা নিতেন না। আম্মাকে দেখতাম এ নিয়ে অনেক ঝগড়া করতেন। আমরা ভাই বোনরা সেদিন একদম শান্ত হয়ে যেতাম।
আব্বা ছিলেন তখনকার সময়ে এসএসসি পাশ। আম্মার কাছে শুনেছিলাম, দাদির বিয়ের অনেক বছর পর আব্বার জন্ম। তাই দাদা দাদি আব্বাকে মাথায় তুলে রাখত। ফলে ছোট থেকেই আব্বা ছিলেন অলস প্রকৃতির। আম্মার বিয়ের সময় আব্বা চাকরি করতেন। উনার চাকরি দেখেই মামারা বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পেরুতেই আব্বা চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসলেন। শুনেছি এরপর আর্মি, পুলিশের বড় পদে চাকরি পেয়েও করেন নি। আব্বা নাকি বাড়ি ছেড়ে থাকতে পারতো না আর দাদিও ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারতো না। মাঝখান দিয়ে আম্মা আর আমাদের ভুগতে হত অভাবে।
একবার হলো কি, গ্রীষ্মকাল কাঁঠাল পেকেছে। আম্মা আব্বাকে বললেন- কাঁঠাল বাজারে নিয়ে বিক্রি করে আসতে। বিকাল বেলা আব্বা বাজার থেকে ফিরলে আম্মা বললেন কাঁঠালের টাকা দিতে। কিছুক্ষন চুপ থেকে আব্বা বললেন- পাশের বাড়ির দাদি কাঁঠাল খুজায় তিনি তা বিনা টাকায় দিয়ে দিয়েছেন। এই ছিল আব্বার বাজে স্বভাব।
আম্মাকে আব্বার ভয়ে টাকা লুকিয়ে রাখতে হত। কোনো কাজ না করায় আব্বার কাছে টাকা থাকতো না। আম্মার কাছে খুজলেও আম্মা দিতো না। তাই আম্মা ঘুমালে আব্বা গলা থেকে চাবি খুলে নিয়ে টাকা চুরি করতো। পরদিন ঠিক আব্বা ধরা পরে যেতেন। আম্মা তখন আরো শক্ত হতেন শুধুমাত্র আমাদের জন্য।
১৯৯৪ সাল। আমার এসএসসি টেস্ট পরিক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফলাফল গনিতে ফেল। আম্মা ভীষণ রাগ করলেন। আব্বার চাচাতো ভাই ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে আম্মা তার কাছে গিয়ে বললেন আমাকে কিছুদিন গনিত পড়াতে। চাচা তিন মাস গনিত পড়ালেও কোনো টাকা নেন নি। তিনটা মাস খুব পড়লাম। দেখতে দেখতে এপ্রিল মাস চলে এলো। তখনকার সময়ে এপ্রিলে এসএসসি পরিক্ষা হতো। ফর্মফিলাপের ১৫০০ টাকা ছিলো আমাদের কাছে অনেক বড় কিছু। আম্মা কিভাবে তা যোগাড় করেছিলেন আম্মাই জানেন। এখনো মনে আছে পরিক্ষার সময় আম্মা ফজরের সময় ঘুম থেকে তুলে দিতেন। ঘুম ঘুম চোখে আমরা ভাই বোনরা ঢুলতাম। আম্মা ধমক দিয়ে বলতেন- জোরে জোরে পড়বি, আমি যেন রান্নাঘর থেকে শুনতে পাই। আম্মা আশা করতেন আমি বড় ছেলে আমি ভালো কিছু করবো।
বর্ষাকাল চলতেছে, শুনলাম রেজাল্ট বেরুবে দুদিন পর। এক অজানা ভয় আমাকে দুদিন গ্রাস করে ফেলেছিলো। আম্মাকে দেখতাম নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করতেন। দুদিন পেরিয়ে রেজাল্ট এর দিন চলে এলো। তখনকার সময়ে রেজাল্ট আনতে স্কুলে যেতে হতো। এখনকার মতো এতো আধুনিক প্রযুক্তি ছিলো না। স্কুল ছিলো বাড়ির কাছেই। পাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ১০ মিনিটের পথ। বাড়ি আর স্কুলের মাঝে খাল রয়েছে। আমরা গ্রীষ্মকালে খাল শুকিয়ে গেলে সেখান দিয়ে যেতাম। খাল দিয়ে গেলে ৫মিনিটেই পৌছে যেতাম স্কুল। আর বর্ষাকালে খাল পানিতে ভরে গেলে পাকা রাস্তাই ছিলো ভরসা।
১২টার সময় আব্বা গেলেন স্কুলে রেজাল্ট আনতে। আমরা ঘরে বসে দোয়া দরুদ পড়ছি। দুপুরের দিকে আব্বা ঘরে ঢুকলেন। আমরা আব্বাকে দেখে হা করে চেয়ে রইলাম। আব্বার পুরো শরীর থেকে টুপটুপ করে পানি পরছে। আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- ভিজছেন কেমনে? আব্বা মুখে এক বিরাট হাসি এনে বললেন- স্কুল থেইকা পাকা রাস্তা দিয়া হাইটা আইলে দেরি হইব তাই খাল সাঁতরাইয়াই আইসা পরছি। তোমার পোলায় ফাস্ট ডিভিশন পাইছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত