বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামী কে সাহস করে বলি—আমাকে পড়াবেন?বলতে দেরি হলেও চড় পড়তে দেরি হয়নি।উনি বলে–কি বলে এ কথা বললি?তকে কি পড়াব বলে বিয়ে করেছি?বাড়ির বউ বাড়ির কাজ করবি ওসব মাথা থেকে বাদ দে।আরাকবার বিশ্বাস ভাঙল।আমার মনে হয়েছিল উনি শিক্ষক মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব বুঝবেন।তারপর উনি বলে উঠল —যৌতুকের টাকা যত দিন না পাচ্ছি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে না।আবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল। কেন যে এত আশা করি।
তারপর দিন শাশুড়ী মা এসে আমার বিয়ের গয়না গুলো নিয়ে যায়।আমার কাছে উপায় নেই তাই দিতে হয়।মা বাবার স্মৃতি ও হারালাম। ননদ আর আমি একই সমান।আমি সারাদিন রান্না ঘরে কাজ করছি।আর ননদ আমার বয়সী মেয়ের যেমন থাকার কথা তেমনি থাকছে।সারাদিন বই নিয়ে পরে থাকে মাঝে মাঝে হিংসা হয়।পরশু ননদের পরিক্ষা।আজ ও নদীর পাড়ে ঘুরতে গেছে দেখে আমার স্বামী ওওকে অনেক বকে।পড়ালেখার বিরুদ্ধে তিনি নন তাহলে আমাকে কেন পড়াতে চাইল না।আসলে বাড়ির মেয়ের জন্য যেটা বরাদ্দ বাড়ির বউএর জন্য তা নয়। সারাদিন কাজ করতে হয়।নতুন অনেক কাজই করতে হয়।আগে কখনো করি নি।তারপরও বিনা বাক্যে করি।কারন এটাই ভাগ্য। ভুল হলে স্বামী শাশুড়ী খোটাদিতে ভুলে না।
সকালে একটু দেরি হয়ে গেলে শাশুড়ীর গালিতে ঘুম ভাঙে—এই দেখ লাটের বিটি চ্যাট এসেছে।এটা কি বাপের বাড়ি যে পরে পরে ঘুমাবে।বাড়ির কাজ কি ওর বাপ এসে করে যাবে।?আমি কিছুই বললাম না।রান্নাকরছি আর ভাবছি আমি যখন ছিলাম না এ কাজ গুলি কে করতো?, সকালে বাবা ফোন দিয়ে যখন বলল যৌতুকের টাকা আনছে,,আমার খুশি দেখে কে!এবার মনে হয় স্বামী শাশুড়ীর আদর পাব। বাবার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করছি।দুপুরে আসছে।খেতে দিব। বাবা টাকা দেওয়ার পর আরাকটু বসবে তখনি শাশুড়ী বলল–আমার মেয়ের শশুড় বাড়ি থেকে একফোটা জল ও খাই না।আপনি ও নিশ্চয় খেতে চাইবেন না। আমি মনে মনে বলছি একবেলা মানুষ কে খাওয়ালে কি খাবারের অভাব পরত?এত দুপুরে বাবাকে না খেয়েই যেতে হলো।
ঘরে যেতেই দেখি স্বামী যৌতুকের টাকা গুনছেন।আমি যেয়ে বলি—এবার ত টাকা পেলেন।আমায় পড়াবেন এবার?ভয়ে ভয়ে বলি।উনি কেমন রেগেই বললেন–তর বাপ যৌতুকের টাকা দিসে।পড়ার খরচ দেই নি।আর বিয়ের আগে কি তকে বলছি যে আমার টাকায় তকে পড়াব। তারপর উনি বললেন—কিন্তু আজ তকে একটা জিনিস দিব।আমি বলি–কি দিবেন? উনি বলে–স্বামির অধিকার। বলেই নিজের পুরুষত্ব জাহির করলেন।আমি প্রস্তুত কিনা একবার ও জিজ্ঞেস করলেন না। ননদের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।ওর পড়া শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।তারপর রান্না করতে চলে এলাম।আরে ওসব আমার ভাগ্যে নাই। শাশুড়ী স্বামী ননদ সবাই দেবরের জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছে।আমি ও যেতে চাইলাম।মানা করে দিল.।বলে–আমি ছোট ঘরের মেয়ে।আমায় দেখে যদি বিয়ে ভেঙে দেয়!আমি মন খারাপ করে চলে গেলাম।ছোট ঘরের মেয়ে বলে কি মানুষ না!
বিয়েতে আমার গয়না গুলো আমার জা কে দেই।আমি কোন গয়না পড়িনি।হাতে শুধু কাঁচের চুড়ি।অনেকেই চিনতে পারে নি আমি এ বাড়ির বউ।স্বামী সাথে দাঁড়িয়ে আছি।একজন বলল–তুমি এ বাড়ির কে হউ?আমি আশা নিয়ে স্বামীর দিকে তাকাই উনি বলবেন আমি উনার বউ কিন্তু উনি চলে গেলেন।আমার পরিচয় দিতে এতই লজ্জা উনার!
বাড়ি ফিরে,,,দেখলাম স্বামী সোজা শাশুড়ী ঘরে গেল আবার দরজা লাগিয়ে দিল।আমি জানালার ওপাশে দাড়িয়ে কথা শুনছি–
—মা তুমি ভাইয়ের জন্য যে মেয়ে পছন্দ করেছ।আমার জন্য ওকে আনতে পারলা না?সাঁঝের সাথে বিয়ে দিয়ে আমার জীবন শেষ করে ফেললে তুমি।
–তখন ত এই সমন্ধ আসে নি।না হলে কি ওই গরিবের সাথে বিয়ে দিতাম তর!
আমি আর কিছু না শুনেই কানতে কানতে চলে আসি।বিয়ের পরও এমন করছেন উনি।উনার ভাইয়ের বউ কেও ছাড়লেন না। রাতে উনি ঘরে আসলে বলি–আপনার মত নিচ মানুষ দেখি নি যে নিজের ভাইয়ের বউ কে নিজের করে পেতে চাই উনি কথা শুনে এক মিনিট ও দাঁড়িয়ে না থেকে ঝাঁটা হাতে নিয়ে মারা শুরু করলেন।বেত দিয়ে পিঠে আঘাত করতে লাগলেন।আমি হাজার থামতে বললেও থামে নি।আমি মুখে মুখ চেপে দু চোখ দিয়ে পানি ফেলছি কারন আমি চাইনা বিয়ে বাড়িতে অন্য মানুষ জানুক ঘরের ভেতর একটা মেয়ে আছে যে কত নির্যাতন সইছে।পুরো শরিরে কাল সীটে পড়েছে।পরের দিন অবশ্য উনি ব্যাথার ট্যাবলেট আর মলম এনেছিলেন।প্রথমে রাগ করে লাগাতে চাই নি।তারপর প্রচন্ড ব্যাথায় কাজ করতে কষ্ট হচ্ছিল তাই লাগাতে হয়।
শাশুড়ী জাকে খুব ভালোবাসে।বড় ঘরের মেয়ে।বিয়েতে অনেক যৌতুক পেয়েছে।জা কে কোন কাজ করতে হয় না।
জাকে মাছের পেটি দেয়।আর আমার জন্য সবার খাওয়ার পর মাছ বাঁচেও না।কিন্তু কেউ একবার ঘুরেও তাকাই না।
একদিন অনেক জ্বর হয়।উঠতে পারি না।তাও উঠতে হল।জা কে রান্না ঘরে দেখে শাশুড়ী চিল্লাচিল্লি করতে লাগল—ও কেন রান্না করবে?সাঁঝ বাড়ির বড় বউ এটুকু জ্বর নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?রাতে অবশ্য স্বামী এ অবস্থা দেখে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলে।আমি বলি—লাগবে না।আমার মত গরিবের ডাক্তার সইবে না।ভয় লাগে।ডাক্তার দেখানোর খরচ নিয়ে আবার খোঁটা দিলে!
সবাই শাশুড়ীর মায়ের বাড়ি যাচ্ছে নতুন বউ দেখাতে।আমি কিছু বললাম না।জানি বললেও নিয়ে যাবে না।
শাশুড়ী বলল—আজ রান্না করার দরকার নাই।পান্তা ভাত আছে।মরিচ দিয়ে খেয়ে নিও।আজ অন্ন ধংস করিও না।
আমার চোখের জল পড়তে লাগল।আমি ভেবেছিলাম একজন হলেও বলবে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু না।
জ্বর আবার বেড়েছে।কেমন কাপুনি দিয়ে জ্বর আসছে।সারা শরীর ব্যাথা তবুও কাজ করতে হয়।হটাৎ দেখি পাতলা পায়খানা শুরু হয় আর পায়খানা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে।
একটু পর দাঁত আর নাক দিয়েও রক্ত পরতে লাগে।কল পাড়ে বসে রক্ত বমি করছি।আর নিজেই নিজের ভাগ্যের উপর হাসছি।মানুষ কতটা বিবেকহীন হলে অসুস্থ মানুষ কে এমন ভাবে ফেলে ঘুরতে যেতে পারে।মনে মনে বলি—মা এবার দেখা করার সময় এসে গেছে।পেছন থেকে কেউ আমার ঘাড়ে হাত দিল পেছনে তাকাতেই দেখি স্বামী। উনি চোখে মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে বললেন–কি হয়েছে তোমার সাঁঝ?আমার শক্তি নেই উনাকে কিছু বলার।কেন জানি উনাকে দেখার পর ও উঠে দাঁড়াতে পারছি না।উনি আমাকে কল পাড় থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালেন। মাজাতে হাত দিয়ে উনার বাহুডোরে আবদ্ধ করলেন।এই রকম ভাবে আবদ্ধ হতেই ত চেয়েছিলাম কিন্তু এখন এই আনন্দ উপভোগ করার মত হাতে সময়ই নেই। ক্লান্ত লাগছে খুব জানেন–বলেই উনার বুকে নিজের মাথা রাখলাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প