আমার সেই বান্ধবীটি গতকাল রাতে গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছে ! আমি মা’কে নিয়ে গিয়েছিলাম বান্ধবীদের বাসায়। তবে সে আমাকে রুমে ঢুকার প্রশ্রয় দেয় নি। রুমে ঢুকতে দিয়েছিলো শুধুমাত্র আমার মা’কে। পরবর্তীতে মায়ের কাছেই শুনলাম পুরো ঘটনা। বান্ধবী না-কি মায়ের সামনেও বোরখা পরে ছিলো। শুধুমাত্র চোখদুটো আবছাভাবে দেখা যায়। বাকি সব কালো কাপড়ে ঢাকা। মায়ের সামনেও সে না-কি মুখোশটা পর্যন্ত খুলে নি!
আমি খানিকটা অবাক হলাম। যে বান্ধবীটি না-কি প্রায়ই আমার মায়ের সামনে এসে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকতো ! বিকেলের নরম আলোয় যে না-কি ছাদে গিয়ে আন্টিদের সাথে গল্পের আসর জুড়ে দিতো ! আজ সে না-কি অপর এক নারীর সামনেই নিজের মুখমন্ডলটুকুও প্রকাশ করতে লজ্জা পায় ! সত্যিই এটি খুবই বিব্রতকর ! নারী হয়ে অপর নারীর সামনেও সে এখন লজ্জায় কাতর ! আজ মধ্য দুপুরে আমি তাকে ফোন করলাম। কিছুক্ষণ বেজে থেমে গেলো। কেউ রিসিভ করলো না। আমি আরো কয়েকবার ফোন দিলাম। ৪র্থ বারের মাথায় তার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। আমি আন্টিকে বললাম বান্ধবীকে ফোনটা দিতে। কিন্তু বান্ধবী এখন কারো সাথেই কথা বলতে নারাজ। তবে আমি হাল ছাড়লাম না। অনেক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পর বান্ধবী ফোন ধরলো। সে এখনও অঝোরে কাঁদছে ! কান্নার দমকে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে আবারো সেই একই বেগে কান্না ! বান্ধবী কাঁদো কণ্ঠেই অস্পষ্টভাবে বলল– ভাই, আমি তো শেষ ! আমি ওকে ধমক দিলাম। বললাম–শেষ মানে কি! তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর পাশে আছি। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়বো।
পরদিন বান্ধবীকে নিয়ে গেলাম নামকরা একটি থানায়। ওসির সাথে কথা বললাম। যারা এই অন্যায়ের সাথে যুক্ত তাদের উপর কেস করলাম। তবে আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম ওদের নামে আগেও বেশ কয়েকবার কেস এসেছে। সেগুলোও রেপ কেস ! একটি কেসে দেখলাম লিখা আছে — ৯ বছরের বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণের পর খুন ! এখানেও এই কয়েকটি যুবকের নাম লিখা। আমি ওসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলাম। বললাম– তারা ছাড়া পেয়েছে কিভাবে ? আমার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেলেন৷ বললেন– আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা যেকোনো মূল্যে আসামীদেরকে গ্রেপ্তার করবো। আমি বান্ধবীকে নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এলাম। শুধুমাত্র থানার উপরে ভরসা করে থাকলে চলবে না। আমরা চলে গেলাম বেশ কিছু নামকরা জ্ঞানীগুণীদের কাছে। তারাও আমাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলো। তবে দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততই আরো আঁধারে নিমজ্জিত হচ্ছিলাম আমরা !
তিন-চারদিন পেরিয়ে গেলো। আসামী ধরার কোনো নাম নেই। এদিকে আমারাও দিন দিন হয়রানির স্বীকার হচ্ছি। বান্ধবীর বাসায় মাঝরাতে কারা যেনো এলোপাতাড়ি ঢিল ছুড়ে যায়। ঢিলের সাথে আবার কাগজ মুড়িয়ে দেয় যেখানে আঁকা থাকে অশ্লীল ছবি, লিখা থাকে জঘন্য শব্দের কিছু কথা ! আমি আবারো থানায় গেলাম। কথা বললাম তাদের সাথে। তারা বলল– আমারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ! কিন্তু এদিকে নিশ্চিন্তে থাকা আর হলো না। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে মা যা বলল তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
মা বললো — যা, তোর বান্ধবীর জানাজা পড়ে আয় ! আমি নিথর হয়ে বসে রইলাম । জিজ্ঞেস করলাম — বলছো কি এসব ! কোন বান্ধবী ? মা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম — বান্ধবী দ্বিতীয়বারের মতো ধর্ষিত হয়েছে। তবে এবার আর রাস্তায় বা ঝোর-জঙ্গলে নয়। এবার তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে নিজ বাসায়। পুলিশেরা এসে তদন্ত চালাচ্ছে। তাদের কাছে জানতে পারলাম বান্ধবীর মা-কে বেঁধে রাখা হয়েছিলো প্রথমদিকে। মায়ের সামনে তার মেয়েকে ধর্ষন করে আসামীরা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে খুন করেছে মেয়েকে। এরপর ঠিক একই ধরণের নৃশংসতা নেমে এসেছিলো মায়ের উপরেও। একই রাতে মা-মেয়ে খুন। পুলিশেরা একটি চিরকুটও পেয়েছে লাশের পাশে । আসামীরাই ছেড়ে গিয়েছে এটি। লিখা আছে –অতিরিক্ত পাকনামির ফল !
আমি এবার খানিকটা বেঁকে বসলাম। পুলিশেরা আমাকে বলল–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমরা দেখছি ব্যাপারটা ।
তবে আমি আর তাদের কথার উপরে ভরসা করে থাকলাম না। তাদের উপর থেকে ভরসা চলে গিয়েছে। একটি রিকসা নিয়ে নিজ বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে রিসার্চ শুরু করলাম। কি কারণে এতো ধর্ষণ হয় ! একই আসামী এতোগুলো ধর্ষণ করবার সুযোগ পায় কেনো ! দেখলাম ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে রয়েছে — সর্বোচ্চ দশ বছরের এবং সর্বোনিম্ম ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। অথবা এর অনধিক অর্থদণ্ড। অথবা মৃত্যুদন্ড। এই কঠিন শাস্তির পরেও কেনো ধর্ষকেরা পার পেয়ে যায় সেগুলি নিয়ে ভাবলাম । এরপর নিজের মতবাদ প্রকাশ করার লক্ষ্যে ছুটে বেড়ালাম। লিখালিখি শুরু করলাম ধর্ষণের বিরুদ্ধে। ধর্ষকদের কোনোভাবেই আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না এ বিষয়ে একটি লম্বা আর্টিকেল লিখলাম। আর্টিকেলের মাঝে একটি নতুন বিষয় যোগ করে দিলাম। লিখলাম
— ধর্ষকদের যৌনাঙ্গ কেটে দেয়া হোক। যারা নিজেদের উত্তেজনা মেটাতে অন্যায়ের আশ্রয় নেবে তাদের জন্যে এই শাস্তিটিই তো কাম্য ! আর এই শাস্তি প্রদান করা হলে ধর্ষকেরাও ঘুরে দাড়াতে শিখবে। বেশ সারাও পেলাম অনেকজনের কাছ থেকে। জ্ঞানীগুণীরা বললেন ভেবে দেখবেন। তবে মেইন টুইস্ট ঘটলো ঠিক এর পরের দিন ! মানে বলতে গেলে আজ। এখন । এই সময়।
আর কিছুই মনে করতে পারছি না । চিন্তাশক্তিও ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। হাত-পা সবকিছুই অবশ হয়ে আসছে। মাথা ফেঁটে রক্ত পড়ে গিয়ে রাস্তা এখন একাকার। বেশ কিছু মাছি ভনভন করছে মৃত লাশের চারপাশ দিয়ে। দু’একটি জন্তুরও সাড়াশব্দ পাচ্ছি। মনে হয় এগুলি কুকুর। মৃত লাশ দেখে ছুটে এসেছে। বিজ্ঞান বলে– মারা যাবার পর আরো পাঁচ মিনিট পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে এবং ব্যক্তি তখন বুঝতে পারে যে সে মারা গিয়েছে। আমার কতো মিনিট হয়েছে অনুমান করতে পারছি না৷ বোধ হয় দু-তিন মিনিট। আর কিছুক্ষণ পর আমিও কি তাহলে হারিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির অতল গহ্বরে ! শুকনো পাতার মর্মর শব্দ অনুভব করতে পারছি । মনে হয় ঝরো বাতাস বইছে। সেই বাতাসের তালে তালে কোথা থেকে যেনো অস্ফুট স্বরের কণ্ঠধ্বনি এদিকে ধেয়ে আসছে। কণ্ঠটি কি যেনো বলতে চাইছে ! সেটা কি প্রতিবাদের প্রতিদান !
গল্পের বিষয়:
গল্প