হরেন মন্ডল দুপুরের দিকে এলো। বেলাবেলি এলে তবু কথা ছিল। সরমা তখন বেরোবে ঠিক করেছে। দুপুরের দিকে কেউ আসে? লোকটার জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়! সরমার বিরক্তি! হার্বাল প্রোডাক্ট বিক্রি করতে আসে হরেন মন্ডল। কথা বলতে বলতে অকারণে হরেন মন্ডল থুতু গেলে। ছবির মতো ঘর সরমার। ড্রয়িংরম্নমে যেখানে যেটা থাকা উচিত…। হরেন মন্ডল জল চাইল। ‘সরমা’ এই নামটা উচ্চারণে পুরনো লেপতোশকের গন্ধ বেরোয়। দুপুরের দিকে ঠা-ঠা রোদ। হরেন মন্ডলের চোখে কালো চশমা। একটা টি-শার্ট। ঘামে ভিজে গন্ধ বেরোচ্ছে। ‘সরমা’ নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে হরেন মন্ডল বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল। ম্যাক্সির ওপর ওড়না ছিল সরমার। জলের গস্নাস এগিয়ে দিলো। জলটা ঠান্ডা নয়। গরম। ফ্রিজে জল ঠান্ডা হচ্ছে না। এত লোডশেডিং হচ্ছে। সরমার বেরোনোর কথা ছিল…। দুপুরে সে যায় কম্পিউটার শিখতে। সমীরের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তার এখন বাপের বাড়ি…। সমীর ছিল এতদিন। এখন সে অতীত। সমীর ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। কিন্তু মনে অসুস্থ। দাম্পত্যে নির্মম। কারণে-অকারণে সরমার গোপন স্থানে আঘাত করে। এবং তারপরেই সে গেয়ে ওঠে, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর…।’ সরমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। গোপন স্থানে সমীর অবলীলায় সিগারেট চেপে ধরে। স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক শারীরিক খেলায় সমীর আদৌ বিশ্বাস রাখে না। সে উদভ্রান্তের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। অপুর্ব তার গলা। গলার এই রকমফের ও কারুকার্যে সরমাকে টেনেছিল সমীর। না হলে সাযুজ্য নেই মোটেই। সমীর সুদর্শন পুরুষ্ তার কাঁধে ও বগলে এবং মাথায় সুগন্ধ যেনো উপচে পড়ে।
দুই
হরেন মন্ডল ব্যাচেলর। তার একমাত্র নেশা নিজের সঙ্গে কথা বলা, একামেত্ম। লাইনের ওপারে কলোনির নিভৃত অবকাশে হরেন তার দরমার বেড়া-দেওয়া ঘরে দুপুরে জলে ভেজানো ভাতের সঙ্গে কলা চট্কে খায়…। হরেনের বস্ নন্দুবাবু বলে – ওহে হরেন, আজ কী দিয়ে ভাত হলো?
আজ্ঞে স্যার, কলা দিয়ে চট্কে… হরেন মন্ডল থুতনিতে হাত দিয়ে কথা বলে।
খ্যাকখ্যাক করে হাসে নন্দুবাবু। নন্দুবাবু বাড়ি ক্যামাকস্ট্রিটে। নৎতলার ওপর ফ্ল্যাট। হরেন ওখানে গেছে। একটা রোগো পাতলা ফর্সা বউ। নাকে নথ ছাপা শাড়ি। ওরই নামে বিউটি পার্লারের ব্যবসা। নন্দুবাবু হার্বাল প্রোডাক্টগুলো হরেনের হাত দিয়ে পাঠায় বিভিন্ন পার্লারে…। হরেন – কালো রং। গায়ে লেপ্টে থাকা টি-শার্ট। মাথার সামনের চুল ক্রমশ ফিকে। নন্দুবাবু একদিন হরেনকে বলে – হরেন কলকাতা শহরে নরক চেনো?
না স্যার।
তোমায় আমি চেনাব। নন্দুবাবুর চোখদুটো কুতকুতে। হাসলে গালে টোল পড়ে। সবুজ রঙের সাফারি স্যুট ওর অভ্যসত্ম পোশাক। সরমার বাড়িতে বিউটি পার্লারের প্রোডাক্ট বেচতে আসা হরেন মন্ডল প্রায়ই দেখে ম্যাক্সি পরে সরমা দাড়িয়ে আছে বারান্দার এক কোন। তার মাথার ওপর ঝুলছে রোদে মেলে দেওয়া গামছা, শাড়ি, ম্যাক্সি, রুমাল এবং অন্তর্বাস। বিভিন্ন রঙের অন্তর্বাস।
ইস্ কী দেখছেন আজ, সরমা বলে…
হ্যাঁ, ওই… কপালের ঘামে রুমাল বোলায় হরেন।
দাঁড়ান, একটু ঠান্ডা জল আনছি – দৌড়ে চলে যায় সরমা ভেতরে।
ব্যস, তারপর বারান্দার পরতে পরতে অমত্মর্বাস দেখে হরেন। লাল-হলুদ…। সাহস করে ছুঁয়ে দেয়। হাত ফসকে নিচে পড়ে। ঠিক সে-সময় সরমা জল নিয়ে বারান্দায়। ও-মা পড়ে গেল, ইস… সরুন…আমি তুলছি। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নেয় তার গোপন পোশাক।
তিন
জল খেতে খেতে হরেনের মনে হয় নন্দুবাবুর চোখ সরু করে খিকখিক হাসি। হাসির মধ্যে অশস্নীলতার গন্ধ। হরেনকে নন্দুবাবু একদিন সত্যি সত্যি নিয়ে যায় বালিগঞ্জ পেলসের এক মুজরোয়। ‘এখানে কচি আছে হে…’।
নন্দুবাবু হেসে হেসে বলে। তুমি বাইরে বসো। আমি ভেতরে যাচ্ছি…। হরেন বসে থাকে। নন্দুবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে এক লা-জবাব মধ্যবয়স্ক সুন্দরী।
হরেনকে দেখিয়ে নন্দুবাবু বলে, এই হলো আমার বাহন সুলেখা, এ বাইরে থাকল। ব্যস, তারপর প্রায় পাক্কা দুটি ঘণ্টা নন্দুবাবু ভেতরে…। হরেন মন্ডলের বিচ্ছিরি লাগছে।
গাড়িতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নন্দুবাবু কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘ব্রাদার কাউকে বলো না…।’ ক্যামাক্ স্ট্রিট ফ্ল্যাটের গেটে নন্দুবাবু নামার আগে হরেনের পকেটে গুঁজে দেয় পাঁচশো টাকা। এটা হরেনের বাড়তি রোজগার, মাইনের বাইরে।
দরমার বেড়ার ঘরের মধ্যে হরেন ও তার মা। সদ্য বিধবা মাকে নিয়ে হরেন এসেছে ওপার বাংলা থেকে দশ বছর আগে। রেশনকার্ড হয়ে গ্যাছে রাজনৈতিক দাদার কৃপায়। হরেন মন্ডল মাঝে মাঝে মিছিলে যায়…। মিছিলে গিয়ে সে শুনতে পায় কতগুলো শব্দ…। আমেরিকার ষড়যন্ত্র, লগ্নিপুঁজি এবং বিদেশির কালো হাত। একঘেয়ে, বড় একঘেয়ে। একদিন হরেন ইচ্ছে করেই সরমার হাত ছুঁয়ে দেয়। মনে হয় আগুনের পরশমণি। সরমার ম্যাক্সির রং আজকে লাল। হরেনের মনে হয় সরমাকে একদিন হাত ধরে জিজ্ঞেস করতে, সে কি কলা চট্কে পান্তাভাত খেতে ভালোবাসে!
গভীর প্রশ্ন। নন্দুবাবুকে একদিন এই জিজ্ঞাসায় জড়িয়ে দিয়েছিল হরেন। নন্দুবাবু খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর হেসে কুটোপাটি। হাসতে হাসতে নন্দুবাবুর চোখে মাঝে মাঝে জল গড়ায়। সেই জল রম্নমালে মুছে নন্দুবাবু বলে – ভাই, তোমার একটা আসত্ম মেয়েছেলে প্রয়োজন। যেখানে তুমি বীজ রোপণ করবে…। হরেন মাথা নিচু করে বসে থাকে। ওঠো হরেন এখন। কলকাতায় সন্ধে নামছে। তুমি এখন চলে যেতে পারো।
চার
হরেন একদিন পুরো কাত হয়েছিল নন্দুর স্ত্রী উষা ভাবির কাছে। রুগ্ন, ছাপার শাড়ি, ফর্সা উষা একদিন হরেনের হাত ধরে টেনে ছিল প্রগাঢ় আশেস্নষে…। তখন ক্যামাক্স্ট্রিটের বহুতলের খুব কাছে অতল আকাশ…। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হাত টেনে উষা ভাবির বুকের কাছে। হরেন মন্ডল হাঁটু গেড়ে বসে বলেছিল, এটা পাপ উষা ভাবি…। পুরো ঝকঝকে ফ্ল্যাটটা তখন হরেন ম-লের মতোই আকস্মিকতায় লাজুক।
এক আঁটুবাঁটু লেপ্টে আছে উষা ভাবির মুখে। মনে মনে তখন হরেন মন্ডল পা ছড়িয়ে দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে বিকেলের হলুদচাপা আলোয় আজ নিসেত্মজ শরীরে বসে আছে…। নৈর্ঋতে মেঘ জমেছে। হরেনের মনে হলো ঈশানকোণেই যাওয়া শ্রেয়। ঈশানকোণে সরমা থাকে না। তার বারান্দার গ্রিলে ঝুলে থাকা রং-বেরঙের অমত্মর্বাস একটা না বলে নিয়ে এসেছে হরেন। মা যখন গল্প-গুজবের জন্য প্রতিবেশীর আঙিনায়। হরেন গন্ধ শোঁকে সেই অমত্মর্বাসের। টাটকা গোলাপের সুখটান। কী পাউডার মাখে সরমা? কখনো মনে হয় টাটকা লাল কাঠগোলাপ। কখনো মনে হয় তাজা হাস্নুহানা…।
পাঁচ
মাথার ভেতর গুমোট। সেই জড়তা কাটিয়ে আবার নন্দুবাবুর সঙ্গে মোলাকাত। ‘কী হে ব্রাদার, আজ যাবে নাকি নরক গুলজারে?’
হরেন নিরুত্তর। তার নাকে লেগে আছে অমত্মর্বাসের দুর্লভ সুবাস। ‘চলো হে হরেন, আজ যাব সুকিয়াস্ট্রিটে।’ এখানে নন্দুবাবু দরাজ-মাখানো হৃদয়ের মানুষ। সে নিজে একটি এবং হরেনের জন্য আরেকটি মেয়ে ঠিক করে।
হরেন মন্ডলের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ লাল হয়। সে মেয়েটির হাত না ধরেই মুখ নিচু করে চুপচাপ বসে…। মোটেই জমে না ধামাকা। হরেন চুপচাপ। মেয়েটি হাসে, হেসে হেসেই ঢলে পড়ে বিছানার দিকে। সেখানে তার দেহের বাইরে বেরিয়ে থাকে উপচানো বুক…। হরেনের হাত-পা কাঁপে। সে ছুটে চলে যায় বাইরে…। তারপর আরো বাইরে এবং সটান নিজের বাড়ি…।
নন্দুবাবু পরদিন হরেনকে একেবারে মালাই ভাজা করে। ‘শালা নপুংসক’। হরেন মন্ডলের হৃদয় তখন উতলা হয় অন্য কারো জন্য। সেই ‘অন্য কেউ’ কে? তবু হরেন পা পিছলে পড়ে না। এ-কারণে সে মেরুদন্ড সোজা রেখে চলে এবং তার মনে হয় এসব ঘটনার মধ্যে কোথাও যেন ঘুণ আছে।
নন্দুর চাকরি হরেন করবে না ঠিক করে। কিন্তু নন্দু ছাড়বে কেন? সে একদিন হরেনকে টেনে টেনে নিয়ে চলে উষা ভাবির কাছে…। উষা ভাবি তাকে বোঝায়, ‘আরে হরেন তোমাকে আমরা কত ভালোবাসি, কী চাও তুমি।’ উষা ভাবির শাড়ির রং লাল। চামসে পাছা। গুটানো দেহে কেমন শুকনো পাতা! নন্দু খিকখিক করে হাসে। সে হরেনকে বলে, ‘কেমন জব্দ,… হে হে।’
হরেন মন্ডল তার পরের দিন সরমার বাড়িতে যায়। দুপুরের রৌদ্রে ঘেমে সে স্নান করেছে। সরমাকে আসতে দেখে হরেন বিউটি পার্লারের ভেষজ প্রোডাক্ট বের করে …। সরমার দিকে আঙুল আসে। তার দিকেও। ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে সরমার অমত্মর্বাস বের করে…।
ওফ এটা আপনি কোথায় পেলেন? সরমার মুখে সুর্যাস্তের আভা।
হরেন মন্ডল নিরুত্তর। তার পেটে গুড়গুড়ানি। তার চোখে কৃতজ্ঞতার ছায়া।
ফেলে দিন ওটা… সরমার গলার স্বরে আড়ষ্টতা।
না, কেন ফেলব?… হরেন গোঁয়ারের মতো উত্তর দেয়। তার গলার স্বরে উত্তেজনা। সরমা অবাক-চোখে হরেন মন্ডলকে দেখে। তারপর দৌড়ে ঘরে চলে যায়…। শব্দ নেই কোনো। হরেন মন্ডল প্রতিদিনকার মতো বাড়ি ফেরে। দরমার বেড়ার আড়ালে একটা ছোট নিজস্ব বাক্সে ফেলে রাখে অন্তর্বাস।
ছয়
পান্তাভাতে কলা দলে মেখে খায় হরেন। পরদিন নন্দুবাবু তাকে ডেকে বলে, ওহে হরেন আমি আর এই ব্যবসা করছি না…। প্রোমোটারিতে নামছি। রিয়েল এস্টেট বিজনেসে দারুণ লাভ। হরেন মন্ডলের তখন মনে হয় এই ভালো, লাল অন্তর্বাসটা আর ফেরত দিতে হবে না সরমাকে।
ওটা তার নিজস্ব সঞ্চয়। তার চাকরির পি-এফ।
হরেন মন্ডল এরপর, এখন নন্দুবাবুর রিয়েল এস্টেট বিজনেসের মস্তবড় ম্যানেজার…। দরমার বেড়া-দেওয়া বাড়ি ছেড়ে সে এসেছে নতুন গৃহে, গৃহ নির্মাণে…। উষা ভাবি এর মধ্যে মারা গেছে। নন্দুবাবুর নৈশজীবন আরো উদ্দাম। সারাদিন পরিশ্রমের পর হরেন বাড়িতে এসে, ঘুমুতে যাবার আগে একবার তার নিজস্ব বাক্স থেকে বের করে শুঁকে নেয় অমত্মর্বাসের গন্ধ।
বিন্দাস আছে হরেন। থুড়ি হরেন মন্ডল। প্রায় দিনই নন্দুবাবুর বগলদাবা হয়ে সে ঘুরে ঘুরে শহরের আনাচে-কানাচে! বুভুক্ষু যযাতির মতো…।
মাঝে একদিন নন্দুবাবুর সঙ্গে দমদমের শেঠ-বাগানের এক প্রাচীন বাড়িতে রাতের মায়াবী খেলায় ঋদ্ধ হয়ে, নিজের তৈরি বহুতলের সামনে এসে দাঁড়ালো হরেন। বহুতলের গেটে লেপ্টে আছে সাইনবোর্ড, ‘এখানে সেলসম্যানের প্রবেশ নিষিদ্ধ।’ চাঁদের হাসির বাঁধভাঙা খেলায় হরেন মন্ডল দেখল আরেকজন হরেনকে…। যে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার শরীরে লগ্নিপুঁজির ছাপ, সেই শুধুই নিকষ নিটোল এক পূর্ণ হরেন মন্ডল। যে দরমার বেড়া। রম্নগ্ণ। দুস্থ পুরনো হরেনকে দেখে নতুন হরেনের বমি আসে। ভরভর করে বমি করে হরেন মন্ডল…, গভীর রাতে পাড়া জানে, মাল খেয়ে হরেন এই বাড়ি ফিরল।