আকস্মিকভাবে এসআই মকবুলের পোষা কুকুরটি মরে গেল। ভীষণ মন খারাপ তার। বিষাদের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারে না। দুঃখ আরো এজন্য যে, কী হয়েছিল তা বুঝেই উঠতে পারল না, ডাক্তারের কাছে নেওয়াও হলো না, এমন মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন। হোক তা পোষা প্রাণী তাতে কিছু আসে-যায় না, সে যদি একজন মানুষের প্রিয় প্রাণী হয় সেটাই বড় কথা। ডাক্তার সগীরের কাছে অনেক দিন ওকে দেখানো হয়েছে, তিনি হেসে বলতেন, কুকুরটিকে আপনি খুব ভালোবাসেন, বুঝতে পারি। পশুর ডাক্তার হিসেবে আপনার ভালোবাসা দেখলেও আমি আনন্দিত হই। ভাবতে ভালো লাগে যে, ও আপনার কাছের কেউ। এসআই মকবুল ওকে গুডু বলে ডাকে, আদরের নাম, নিজের নাম শুনলেই ছুটে কাছে এসে দাঁড়ায়। মকবুল ডাক্তার সগীরকে ফোনে বলল, ডক্টর, আমার গুডু তো নেই।
ডক্টর সগীরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, নেই মানে?
– গুডু মরে গেছে।
– কী করে কুকুরটাকে মেরে ফেললেন?
– মেরে ফেললাম? কী বলছেন?
ডক্টর সগীর গম্ভীর কণ্ঠে বলে, অযত্ন করলে তো মেরেই ফেলা হয়।
ফোনের লাইন কেটে দেয়। মন আরো খারাপ হয়ে গেল মকবুলের। ডাক্তার সগীরের এমন অভিযোগ তার কাছে খুব অশালীন মনে হয়, লোকটিকে বর্বর ভাবতেও দ্বিধা হয় না। নিজের বিষাদের সঙ্গে মানুষের বর্বর আচরণ যুক্ত হয়ে গেলে সেদিন দুপুরে ও রাতে ভাত খায় না। মৌসুমী ডাকতে এলে সাফ জবাব, খেতে ইচ্ছে করছে না। খিদে নেই।
রেগে যায় মৌসুমী। দুদিন ধরে কুকুরের জন্য এমন দুঃখ পাওয়া তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। একরকম চেঁচিয়েই বলে, একটা কুকুরই তো মরেছে, তার জন্য রাতদিন হারাম করে ফেলতে হবে?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মৌসুমীর দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না এসআই মকবুলের। ওর কথার জবাবও দিলো না। মৌসুমী গলার স্বর আরো একধাপ উঠিয়ে বলল, কথার জবাব দিচ্ছ না যে?
– যে-প্রশ্নটি করেছ তার কোনো জবাব হয় না। একটা ভালগার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় আমি নেই না।
– কী বললে? ভালগার প্রশ্ন? এজন্য তোমার সঙ্গে আমার বনে না।
– না বনলে নিজের পথ খুঁজে নাও। আমার সঙ্গে চেঁচামেচি করবে না।
– কী, কী বললে?
মকবুল কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির কোনায় যেখানে গুডুকে রাখা হতো সেখানে এসে দাঁড়ায়। বেশ বড়সড় একটি পাপোশ ছিল ওর বিছানা। লাল ও নীল রঙের বাটি দুটো উলটে পড়ে আছে। একটিতে ওকে ভাত দেওয়া হতো, অন্যটিতে পানি। ও ব্যাংকক থেকে কিনে এনেছিল। বিদেশে কোথাও যাওয়া হলে ও গুডুর জন্য শুকনো খাবার কিনে আনত। পাঁচ বছরের সংসারে এখনো বাচ্চা নেই। পোষা প্রাণীটির জন্যই ছিল সবটুকু টান, মৌসুমীর কাছে ওর অন্য ব্যাখ্যা ছিল। সুযোগ পেলে বলতে ছাড়ত না যে, হয়তো তুমি বাবা হওয়ার যোগ্যতা রাখ না।
ও সরাসরি তাকিয়ে বলত, আমাদের তো ডাক্তারি চেকআপ হয়নি। সেটা হলে বুঝতে পারব সমস্যাটা কার। আগেই দোষ চাপিও না।
ওর এমন কথা শুনে কখনো ভেংচি দিত মৌসুমী। কখনো বলত, আমি যদি বাঁজা হই তাহলে সুইসাইড করব। একদিন ঘরে এসে দেখবে নেই হয়ে গেছি। যতদিন পরীক্ষা হবে না ততদিন তোমাকে খুঁচিয়ে কথার ফুটবল খেলব। প্রতি খেলায় একশটা গোল খাবে।
তারপর হাসতে হাসতে বলত, আজ অফিস থেকে ফিরে তোমাকে চিকেন স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেব। আড়ংয়ের সামনে থেকে পনির কিনে আনব।
তখন মকবুলের মনে হতো মৌসুমী সাইকিক। নাকি অন্য কোনো মানবী, যাকে বোঝার জন্য মাথা ঘামাতে হয়। না, মৌসুমী হয়তো অতটা মেধাবী নয়। মেধাবী হলে কবিতা লিখত, নয়তো ছবি অাঁকত।
এভাবেই দিন গড়াচ্ছে।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। বাইরে থেকে ঘরে ফিরলে মৌসুমী দৈনিক পত্রিকাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, পড়ো। স্টিভ তোমার বন্ধু হতে পারে। কুকুর নিয়ে পাগলামি করে।
মকবুল কথা না বলে কাগজটা নেয়। মৌসুমী আঙুল দিয়ে খবরটা দেখায়। খবরের শিরোনাম – ‘কুকুরের জন্য জীবন উৎসর্গ’।
যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, তোমার অবশ্য পাগলামি নেই। তোমার তো একটাই কুকুর ছিল। থাকগে। শোনো রাসত্মার ধারের কুকুরটা তোমাকে দেখলে কুঁই-কুঁই করে। তুমি ওটাকে পাত্তা দাও না। এখন থেকে ওটার দিকে তাকিও।
মকবুল কুকুর-সংক্রামত্ম খবরটি পড়ার জন্য পত্রিকার পাতায় চোখ রাখে। মনোযোগ দিয়ে খবরটি পড়ে চোখ বুজে থাকে মকবুল। মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়ায় খবর। স্টিভ থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। নিজের স্থায়ী বাসস্থান নেই। কিন্তু কুকুরের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। খাবার জোগাড় করে। মকবুল বিড়বিড় করে, তুমি বেশ কুকুরপ্রেমী স্টিভ। আমি একটি কুকুরছানাকে সমত্মানের ভালোবাসায় যত্ন করেছিলাম।
আবার চিমত্মায় ভেসে ওঠে ক্যালিফোর্নিয়া, ওই এলাকাটা দেখা হয়নি। নিউইয়র্কে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল একবার। অন্যদের কাছে শুনেছে ক্যালিফোর্নিয়া খুব সুন্দর। স্টিভকে ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে ইন্ডিয়ানা রাজ্যে যেতে হবে। এক বন্ধু তার জন্য কাজের
ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কুকুরগুলো কীভাবে নেবে? এগারোটি কুকুর। পকেটে তেমন পয়সা নেই, বড় গাড়ি ভাড়া করার সাধ্য নেই। নিজের মোটরসাইকেলে করে যাবে ও। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইন্ডিয়ানার দূরত্ব দুই হাজার মাইল। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে স্টিভ। একসময় চমক ভাঙে। ভাবে একটি শপিং কার্ট জোগাড় করে কুকুরগুলোকে সেখানে ওঠাবে। তারপর মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যাবে ইন্ডিয়ানায়। যা ভাবা, তাই কাজ। শপিং কার্টে কুকুরগুলো তুলে রওনা হয় স্টিভ। পথে দেখা হয় অ্যালেসিয়ার সঙ্গে। সে এক প্রাণীর আশ্রমে কাজ করে। স্টিভের সঙ্গে কথা বলে অ্যালেসিয়ার বুক তোলপাড় করে, মানুষ এমন করে প্রাণী ভালোবাসতে পারে! ও দু-হাতে চোখের জল মুছে বলে, স্টিভ, তোমাকে আমি হেল্প করব। তোমার জন্য অনলাইনে পেজ খুলব। নিশ্চয় অনেক মানুষ তোমাকে সহযোগিতা দেবে। পাঁচ ডলার করে দিলেও অনেক টাকা জমে যাবে তোমার।
স্টিভ খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে অ্যালেসিয়াকে দেখে। বলে, তুমি খুব দয়াবতী অ্যালেসিয়া। আমার কুকুরগুলোকে যত্ন আর ভালোবাসা দিলে।
অ্যালেসিয়ার হাসিমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে স্টিভ। বলে, সারাজীবন তোমার কথা আমার মনে থাকবে।
খবরে এসব নেই। শেষের অংশটুকু মকবুলের বানানো। মনে মনে হাসে ও। বানাতে ভালো লাগল। ভাবল, এভাবেই তো নর-নারী পরস্পরের কাছাকাছি আসে। এভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মৌসুমীর সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। মকবুলের মনে হয়, যেটুকু গড়ে উঠেছে তাতে ফাটল আছে। অ্যালেসিয়া আর স্টিভকে নিয়ে যে সম্পর্কের গল্প ও বানাল তাতেও ফাটল ধরবে একদিন, কে জানে। চোখ বন্ধ করে মকবুল। বুকের ওপর খবরের কাগজ।
মৌসুমী অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে, তুমি দেখছি কুকুরের খবরে একদম মজে গেলে। অফিসে যেতে হবে না?
হবে তো। দশ মিনিটে রেডি হয়ে যাব।
আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। তোমার বাইকের জন্য অপেক্ষা করলে দেরি হবে। সিএনজি ধরব একটা। বাই।
বাই। মকবুল যেতে যেতে বলে। পেছন ফিরে তাকায় না। বাথরম্নমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকা মকবুলের প্রিয় অভ্যাস। পানি চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যমত্ম গড়াতেই থাকে। মকবুল মনে করে, এ-স্নান তার বিনোদনের রকমফের। এই মুহূর্তে ওর স্টিভের কথাই মনে হয়। জলের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক খুঁজে পায়। ভাবে, স্টিভ বোধহয় গিটার বাজায়। বেঁচে থাকার খানিকটুকু সম্বল নিয়ে কুকুরের সঙ্গে যে দিন কাটায় সে কুকুরের ভেতর মানুষের আত্মাই দেখতে পায়, এটাই হয়তো স্টিভের জন্য সত্যি। অ্যালেসিয়া ইন্টারনেটে ওকে যে পেজ খুলে দিয়েছে তাতে তার কিছু অর্থ জমা পড়েছে নিশ্চয়ই। সেই আনন্দে স্টিভ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইন্ডিয়ানা স্টেটে যাওয়ার পথে কোথাও থেমেছে। ওর চারপাশে বসে আছে কুকুরগুলো আর ও গিটার বাজাচ্ছে। হায় ঈশ্বর, কী অসাধারণ দৃশ্য! কুকুরও কখনো মানুষের মতো হয়! এটুকু ভেবে ও শাওয়ারের ট্যাপ বন্ধ করে। গা মুছতে মুছতে ভাবে, তাহলে মানুষও কি কখনো কুকুরের মতো হয়, যে-কুকুরের মাথায় পোকা থাকে – যেগুলো আচরণে নিষ্ঠুর প্রাণী মাত্র!
এই ভাবনা মাথায় নিয়ে এসআই মকবুল দ্রম্নত তৈরি হয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে, নাসত্মা খাওয়ার দরকার নেই, দেরি হয়ে যাবে। অফিসে গিয়ে চা খেলেই অর্ধেক বেলা কাটানো যাবে। দ্রম্নতপায়ে বাইরে এসে মোটরসাইকেলে হাত দিতেই দূরে বসে থাকা নেড়ি কুকুরটা কুঁই-কুঁই শব্দ করে ছুটে আসে। রম্নগ্ণ, শরীরের জায়গায় জায়গায় লোম উঠে সাদা হয়ে আছে। মায়াই হয় মকবুলের। ঘর থেকে টোস্ট বিস্কুট এনে কুকুরটিকে দেয়। নেড়ি বিস্কুটে মুখ দেয় না। হাঁ করে ওকেই দেখে। মকবুল বাইকে পা দিয়ে ভাবে, নেড়িকে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ওকে সুস্থ করা দরকার। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নাইট গার্ড কুদ্দুস মিয়াকে বলে, নেড়িটাকে ডাক্তার দেখানো দরকার।
তাইলে খুব ভালো হয় স্যার। আমি তো রোজ ওরে দেখি। ওর গায়ে অসুখ বাসা বাঁধছে।
আমার তো অফিসের অনেক ঝামেলা। কবে যেতে পারব দেখি। তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো। আমার বাসা থেকে রোজ ওকে খাবার দেবে।
কুদ্দুস ঘাড় নাড়ে। দুজনেই খেয়াল করে নেড়ি বিস্কুট চিবাচ্ছে। বাইক ছুটতে শুরম্ন করলে এসআই মকবুল ভাবে, আমার যা ব্যসত্মতা সেখান থেকে নেড়ির জন্য কবে সময় বের করতে পারব, কে জানে! একজন সন্ত্রাসীকে খোঁজার দায়িত্ব আছে আমার। বাইকের শব্দ দু-কান ভরে বাজে, যেন কোথাও গুলির শব্দ হচ্ছে। চারদিকের গাড়ির হর্নও তেমন শব্দে ছুটছে। শুধু স্নিগ্ধ বাতাস এই মুহূর্তে ওর প্রবল স্বসিত্ম।
অফিসে গিয়ে জানতে পারল ওকে কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে, আগামীকালই। ওর বস ওকে জরম্নরি কাজের ব্রিফিং দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছ?
– ইয়েস স্যার।
– আর কিছু জানতে হবে?
– না, স্যার। সব ঠিক আছে।
– রিপোর্ট সাবমিট করতে যেন চবিবশ ঘণ্টা পার না হয়।
ইয়েস স্যার। মকবুলের মাথার ভেতরে বাতাসের ধুলোর ঘূর্ণি। মন খারাপ হয় নেড়ির জন্য, ওকে ডাক্তার দেখানো হবে না। যাহোক, কদিনই বা সময়, ফিরে এসে দেখানো হবে। তুই ভালো থাকিস নেড়ি, মনে রাখিস আমিও একজন স্টিভ। শপিং কার্টে উঠিয়ে নেওয়া কুকুরগুলো আমেরিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাচ্ছে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে। তোকেও আমি বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখাব। খোলা জিপে বসিয়ে নিয়ে যাব ঢাকা থেকে সাজেক ভ্যালিতে; দেখবি, কী সুন্দর দেশ! ছবির মতো দেশ।
বাড়িতে ফিরলে মৌসুমী জিজ্ঞেস করে, তোমার কী হয়েছে?
– কিছুই হয়নি। আগামীকাল কুষ্টিয়া যেতে হবে।
– অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে তো যেতেই হবে। এজন্য তোমাকে এমন বিধ্বসত্ম দেখাচ্ছে কেন? গত এক বছরে তোমাকে এমন দেখায়নি, অমত্মত আমি তো দেখিনি।
– তুমি বোধহয় আমাকে অন্যভাবে দেখছ। আজ তোমার দৃষ্টিতে আলো নেই।
– তবে কী আছে? মৌসুমী ফুঁসে ওঠে।
মকবুল নির্বিকারভাবে বলে, অন্ধকার।
– অন্ধকার! খেঁকিয়ে ওঠে মৌসুমী। সত্যি কথা বললে গায়ে বাধে কেন? স্বীকার করতে পারো না। ঠিক আছে, আর কথা বলব না। কয়েকদিন বাড়িতে থাকবে না, এতে আমার কষ্টের হয় এটা তুমি জানো।
– জানি। আমি না থাকলে তুমি গুডুকে যত্ন করতে, এটাও আমি জানি।
– আমাদের সে-জায়গাটা খালি হয়ে গেল। তুমি আর একটি কুকুরছানা আনবে?
– আনব। ফিরে আসি। কেনার সময় দুজনে একসঙ্গে যাব।
– ঠিক আছে। মৌসুমীর উৎফুলস্ন হাসিতে মুগ্ধ হয় মকবুল। ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
মৌসুমী মকবুলের হাত নিজের মুঠিতে টেনে নিতে নিতে বলে, হুম, বুঝেছি।
তারপরে দুজনের হা-হা হাসিতে চৌচির হয় সত্মব্ধতা। যেন দুজনে ছুটে যাচ্ছে কোথাও – অপরূপ জন্মভূমির কোথাও, নদী কিংবা পাহাড় বা সমতল কিংবা সমুদ্রে। পথ ফুরোয় না। দেখাও শেষ হয় না।
প্রায় সাত-আট দিন পরে ঢাকায় ফিরে আসে মকবুল। বাড়ির সামনে সিএনজি থেকে নামতেই নাইট গার্ড কুদ্দুস এগিয়ে আসে, তখন সূর্য উঠেছে মাত্র, রোদ ছড়ায়নি। মকবুলের মনে হয় বাতাসের স্নিগ্ধতা ওকে স্বসিত্ম দিচ্ছে না। কোথাও থেকে দুর্গন্ধ আসছে, গলা ঝেড়ে মকবুল নাকে হাত চাপা দেয়। এই মুহূর্তে পকেটে টিসু পেপার নেই।
মকবুলের হাতের ব্যাগটা নেওয়ার জন্য কুদ্দুস হাত বাড়ালে মকবুল বলে, তুমি কেমন আছ কুদ্দুস?
– ভালোই তো আছি স্যার।
– নেড়ির খবর কী? আজকে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারব না। অফিসে কাজ থাকবে। কাল যাব। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।
– নেড়ি মরে গেছে স্যার।
– মরে গেছে? মকবুলের কণ্ঠস্বর বাতাসে মেলায় না। আর্তনাদের মতো কণ্ঠস্বর বাতাস ভারী করে দেয়।
– কাল রাতে নেড়ি অনেক কুঁই-কুঁই করেছে। ও বোধহয় আপনার জন্য কাঁদছিল স্যার। সকালে খোঁজ করতে গিয়ে দেখি মরে পড়ে আছে।
– কোথায় পড়েছিল?
– এইখানে আপনার বাসার সামনে। আমি গলায় দড়ি বেঁধে টেনে দূরে রেখে এসেছি।
– চলো দেখি, কোথায় রেখেছ। ওকে মাটিতে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা আমি করব। ওর শেষ ঘুমটা যেন ও শামিত্মতে ঘুমায়।
আপনি ঘরে যান স্যার। হাত মুখ ধুয়ে –
চুপ করো। আমাকে নেড়িকে দেখাও।
কুদ্দুস গাঁইগুঁই করে বলে, নেড়িকে তো বেশ দূরেই রেখে এসেছি স্যার।
– ঠিক আছে দেখে আসি।
কিন্তু বেশিদূর যেতে হয় না। প্রথমে কুদ্দুসই দেখতে পায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে পড়ে আছে পাড়ার সন্ত্রাসী জহুর আলী। কুদ্দুস আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, স্যার স্যার কুত্তাটা মরেছে।
মকবুল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জহুর আলীর দিকে। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। শরীরের অনেক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়েছিল ওকে। আবার জামিনে মুক্তি পেয়েছে। সন্ত্রাসের দাপটে হিংস্র হয়ে উঠত, সেই চেহারা এখন রক্তমাখা। ঘাড় কাত করা, চোখ খোলা, দেখলেও আতঙ্ক লাগে, কারণ মৃত্যুর পরও সে স্বাভাবিক চেহারায় নেই।
– স্যার, থানায় খবর দিতে হবে তো!
– হ্যাঁ, তুমি যাও।
– আলস্নvহর কাছে হাজার শোকর যে কুত্তাটা মরেছে। কুদ্দুস দু-হাত ওপরে তুলে তড়পায়।
মকবুল ভাবে, এটা কোন ধরনের কুত্তা।