কোরবানির গরু বানানো শেষে ভাগ বন্টনের এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই আমার ছেলে এসে পিছন থেকে গলাটা জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলো, আব্বু তুমি কখন খাবা? আমি তখন গোস্ত,হাড় কাটতে কাটতে ঘেমে নেয়ে একাকার।ছেলে’কে কোনোমতে ছাড়িয়ে উত্তর দিলাম, জ্বি আব্বু খাবো এইতো কাজ শেষ হবে একটু পরেই।
বাড়ির সবাই তখন কাটাকাটি রেখে আমার ছেলেটার বাবার প্রতি এতো দরদ দেখে অনেক প্রশংসা করছিলো।আমারও বেশ ভালোই লাগছিলো নিজের সন্তানের প্রশংসা শুনতে।কিছুক্ষণ পর পর ছেলেটা বাড়ির ভিতর থেকে এসে এসে দেখে যাচ্ছে আমার কাজগুলো কতদূর।কখনো কখনো বা টেবিল ফ্যানটা সবাইকে রেখে সোজা আমার দিক করেই সেট করে দিচ্ছে।এসবের কোনোটাই আমার চোখ এড়ালো না। এতদিন জানতাম ছেলেরা নাকি মা ভক্ত বেশি হয় কিন্তু আমার ছেলের বেলায় এটা উল্টো।আমার ছেলে মা বাবা দুজনেরই সমান ভক্ত। ঘন্টাখানেক পর আমাদের সবকাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে আমি বাড়ির ভিতরে গেলাম হাতমুখ ধুতে।কিছু সময় যেতেই মনে হলো আমার ছেলেটার কোনো সাড়া শব্দতো পাচ্ছি না।ঘরে একটু উঁকি দিতেই দেখি পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া অবস্থাতেই ছেলে টা ঘুমিয়ে পড়েছে।এদিকে আমার চাচা চাচিসহ চাচাতো ভাইয়েরা সবাই মিলে খেতে বসেছে।
সেখান থেকে আমার নাম ধরে অনবরত হাঁকডাক আসছে।আমি দরজাটা খানিক লাগিয়ে দিয়ে বের হলাম ঘর থেকে।উঠোনে কয়েক পা ফেলতেই সামনে আমার স্ত্রী পড়লো।সে খানিক রেগেমেগেই বললো, কখন থেকে সবাই ডাকছে তোমায় শুনতে পাওনি?আর তোমার ছেলেটাকেও দেখছি না,কোথায় যে গেলো না খেয়ে।শুধু একটু পায়েস মুখে দিয়েছিলো এ টুকু শুনেই আমি উঠোন থেকে আবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।আমার স্ত্রী কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না ছেলেটা আমার জন্য না খেয়ে থেকেই এত তাড়া দিচ্ছিলো। ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে গিয়ে ছেলের কপালে হাত রাখলাম।ও খানিক মোচড় দিয়ে আমার পা দুটো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রইলো।আমি ডাকবো ভেবে ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম বালিশের উপর একটা খাম।খামটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম ছোট্ট একটা সাদা কাগজে এলোমেলো ভাবে লেখা,”আব্বু এটা তোমার সেলামি,দাদু বেঁচে থাকলেতো তোমায় দিতোই তাইনা বলো?”
আমি কাগজটা রেখে খামের ভিতরে দেখলাম চকচকে একশত টাকার একটা নোট।আজ সকাল থেকেই বাবা মা’র কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো।মূহুর্তেই আমার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। এগারো টা বছর হলো আব্বা মারা গেছেন।আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমরা চাচাতো ভাইয়েরা মিলে কোরবানির হাট থেকে হৈ হুল্লোড় করে গরু কিনে আনতাম।সে কি অানন্দ হতো তখন!ঈদের দিন সবাই মিলে মাঠে যেতাম একসাথে।আব্বা গরু জবাই দেওয়ার পর একটা মোড়া নিয়ে বসে থাকতো আর আমাদের ভাইদের বলে দিতো কোনটা কিভাবে করতে হবে।
বাড়ির ভেতর থেকে আম্মার রান্না-বান্নার ঘ্রাণে যেন সেদিন অন্য একটা ভালো লাগা মিশে থাকতো।সেই খুশি আনন্দ আব্বা আম্মা মারা যাওয়ার পর কোথায় যেন বিলীন হয়ে যায়। একদিন বিকেল বেলা খবর আসে আব্বা হাটে চায়ের দোকানে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।আম্মা খবরটা শোনার সাথে সাথে রান্নাঘর থেকে একটা চিৎকার দিয়ে বের হয়ে সেই যে জ্ঞান হারান আব্বার মাটি হওয়ার পর সেই জ্ঞান ফেরে।আম্মা আব্বার শোকে বেশিদিন আর বাঁচতে পারেনি।ছয়মাসের মাথায় আম্মাও মারা যায়।আমরা দুই ভাই বোন একে অন্যের অবলম্বন হয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি। চাচা চাচি ছিলেন অনেক ভালো মনের মানুষ।তারা আমাদের ভাই বোনের দায়িত্ব নেন।বছর খানেক পর চাচা আপার ভালো দেখে বিয়ে দেন।
এর মাঝে আমার পড়াশোনাটা স্নাতক অবদিই সমাপ্ত করি।আপা দুলাভাই চাচা-সহ পড়তে বললেও কেন জানি না আর ভর্তি হয়নি।আমাদের বাড়ির পিছনের পুকুরটা দশবছর মেয়াদে মাছচাষের জন্য বিক্রি করে দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে ছোটোখাটো একটা ব্যবসা শুরু করি।ধীরে ধীরে ব্যবসার হিসাব নিকাশটাও বেশ আয়ত্ত করে ফেলি।লাভ-ক্ষতি সবমিলিয়ে মোটামুটি ভালো ভাবেই সবদিক সামাল দিয়ে উঠতে পারি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রাতে সেই শূন্যতা ভর করে বুকের মধ্যে।সারাবছর খুব কম মনে পড়লেও বছরে দুইটা ঈদে আব্বা আম্মাকে এতো মনে পড়ে ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করতে যে, সৃষ্টিকর্তা কেন এতো মায়া মহব্বত দিলো সন্তানের সাথে বাবা মায়ের?আর যদি এতো ভালোবাসাই দেবে তাহলে কেন কেড়ে নেয় বুকটা খালি করে? কি যে যন্ত্রণা হয় তখন বুকের মধ্যে যার বাবা মা নেই সে ছাড়া এ দুনিয়ার কেউ বুঝবেনা সেই যন্ত্রণার কথা।
আম্মার কথা প্রায় দিন মনে হতো।সকালে ঘুম থেকে উঠলেই আম্মার মুখটা আগে দেখতাম।বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোথাও গেলে যদি ফিরতে দেরি হতো তাহলে আম্মা আব্বাকে দিয়ে কলের ওপর কল দিতো।প্রতিরাতে না খেয়ে থাকতো কখন আমি ফিরবো তখন খাবে।মাঝেমধ্যে বলেই ফেলতো এখনও সেই ছোটোই রইলি অথচ আমি যখন থাকবো না তখনতো নিজের যত্ন নিজেরই নিতে হবে।তখন কি করবি বলতো? আমি মুখ ভার করে উত্তর দিতাম, তুমি কোথায় যাবে যে অামার কাপড় চোপড় আমার ধুতে হবে? এই কথা শুনে আম্মা উচ্চস্বরে হেসে উঠতো আর আপা পিছন থেকে এসে আমার কান ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলতো, ওঠ এখন আমি আদর খাবো অনেক খাইছিস। আম্মা তখন হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে দুজনকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিতো। আজ কতগুলো বছর হলো আম্মার হাতের খাবার খায় না।মনে হয় কত হাজার বছর হয়ে গেছে আম্মার মুখটা দেখি না।আল্লাহ কেন সন্তানের আগে মা কে কেড়ে নেয়?কলিজাটা মোচড়ে ওঠে আম্মার কথা মনে হলে।
আম্মা মারা যাওয়ার পর আপাকে দেখেছি কতরাত কতদিন যে না খেয়ে কান্না করে কাটিয়ে দিয়েছে।চাচি এসে কতশত বুঝিয়ে এক লোকমা খাবার মুখে দিতে পেরেছে তা সেই ভালো জানে।আপা প্রায় রাতে ডুকরে কেঁদে উঠতো আমি তখন মুখে বালিশ চেপে কাঁদতাম।আমিতো ছেলে আমার যে উচ্চস্বরে কাঁদতে নেই লোকে কি বলবে?
এখনো মনে পড়ে আম্মা মারা গেলে সেদিন আপা পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছিলো।যখন আম্মার লাশের খাটিয়াটা আমরা নিয়ে যাবো আপা দৌঁড়ে গিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ভাইরে আম্মারে নিস না ভাই আমরা যে এতিম হয়ে যাবো। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না চেপে আপাকে আমার থেকে ছাড়িয়ে সেদিন আম্মার খাটিয়া বহন করেছিলাম। আপার বিয়ের সময়ও অনেক কান্না আমায় ধরে।আপা যাওয়ার পর আমি একদম একা হয়ে যায়।ঘরে ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসতো।পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলতো আমাদের ভাগ্যটা নাকি খুব খারাপ।বলবে নাইবা কেন?যাদের বাবা মা বেঁচে নেই তাদের ভাগ্য কি করে ভালো হয়?
আপার বিয়ের দের বছরের মাথায় চাচা আমায় বিয়ে করায়।বছর ঘুরতেই আমাদের ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
আপারও দুই ছেলে মেয়ের জন্ম হয়।ওদিকে আপা আর এদিকে আমি খুব সুখেই সংসার কাটে আমাদের।কিন্তু আজও আপা যখন বেড়াতে আসে তখন বাড়িতে ঢুকেই আগে আব্বা আম্মার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদে।আর ঈদ এলেই আপা সকালে উঠেই আগে আমায় কল দেবে।আমি রিসিভড করতেই ওর কান্নাগলাটা শুনতে পায়।বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে আমার।সারাদিন শত কাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আব্বা আম্মার সাথে কাটানো কত ঈদের স্মৃতি।ছেলের খুনশুটি তে যেন ফিরে যায় আমার ছোটোবেলায়।আরো বেশি করে মনে পড়ে তখন। আজকে আমার ছেলে যে আমায় এতোটা চমকে দেবে ভাবতে পারিনি।ওতটুকু বাচ্চা কি করে বোঝে আমিও আমার বাবা মা’কে মিস করছি? চোখের পানি আমার ছেলের গালে পরতেই ঘুম থেকে উঠে আমার চোখদুটো মুছে দিতে দিতে বললো, আব্বু দাদু দাদি কে তোমার খুব মনে পড়ছে তাইনা? আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না।বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চোখদুটো বন্ধ করে অনুভব করলাম সন্তানের জন্য তার পিতামাতা না থাকা কতটা কষ্টের।
মুখ তুলে তাকাতেই দেখলাম চাচা চাচিসহ আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।আমি দ্রুততার সাথে চোখমুখ মুছে বললাম, দেখো না ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও’কে নিতে এসেই এতো দেরি হয়ে গেলো। খেয়াল করলাম আমার কথাতে কেউ কিছু বললো না।আমি অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্ন করলাম। সবাই হঠাৎ দরজার কাছ থেকে সরে দাড়াতেই দেখলাম আপা দাঁড়িয়ে আছে।এই প্রথম বিয়ের পর আপা ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে।আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।আপার চোখ টলমল করছে আমি কাছে যেতেই বললো, তোর বউয়ের কাজ এসব বুঝলি ভাই,ও ফোন করে বললো তুই আর তোর ছেলে না খেয়ে আছিস এখনো।আমি আর কি করে খেতে পারি বল?তাই দৌঁড়ে ছুটে এলাম।
আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সবাই’কে নিয়ে খেতে বসলাম।আমার ছেলেটা ওর ফুফি আর আমার প্লেটে গোস্ত তুলে দিয়ে বললো, ফুফি আজকে আমি তোমার আর আব্বুর হাতে খাবো। আমরা সবাই ওর কান্ড দেখে তখন হেসে উঠলাম।আপাকে দেখলাম আমার ছেলের মুখে এক লোকমা খাবার দিয়ে চোখ মুছে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।জানি আপা আর আমি যত আনন্দ আর খুশিতেই মাতি না কেন আব্বার আম্মার কথাও যে আজ মন থেকে যাবার নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প