সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ

এপ্রিল মাসে আলতাফ হোসেন চলে যাওয়ার প্রায় আট মাসের মাথায় ইউএস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে নির্দেশ দেন বঙ্গোপসাগরে যেতে। সেভেন-ফ্লিট সমরকৌশল বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাধা হয়নি। ইস্পাতের বিশাল ভারী নৌবহর তখনো বঙ্গোপসাগরেই ছিল।

এপ্রিল থেকে যুদ্ধ চলাকালীন সময় ধরে পরিবার তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না, কেবল যশোর এলাকায় যুদ্ধ করছে, এটুকুই, যশোর রোডের কাছাকাছি কোথাও। যে-রাস্তা নিয়ে আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ বিখ্যাত ‘যশোর রোড’ কবিতা লিখেছেন।
ছেলে যুদ্ধে চলে যাওয়ায় বাবা-মা যেন আক্ষরিক অর্থে সমত্মানহীন হয়ে পড়ে, কেননা সে-ই তাদের একমাত্র সমত্মান তখন। অনেক আগে একাধিক যে-ভাইবোন ছিল তারা সবাই নানা রোগে মারা গেছে। বি.এ. পাশ-উত্তর ল পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে, তখন আসে ঘর ছেড়ে যুদ্ধে যাওয়ার সময়; এপ্রিল মাস। সে চলে যায়। ছাত্রলীগের বরিশাল জেলা শহরের নেতা ছিল। স্কুলে থাকতে বিয়ে হয় সহপাঠীর সঙ্গে, যা বাল্যবিবাহ! বিয়েরও কারণ প্রেমিকার অমত্মঃসত্ত্বা হওয়া। ফলে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার নিয়মে বিয়ে অবধারিত হতে হয়। একাত্তরের এপ্রিলে যুদ্ধে যাওয়ার সময় পেছনে ফেলে যায় ছয় বছরের ছেলে এবং স্ত্রী।
যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসার পালা শুরু হলে, তার ফেরায় দেরি হয়, এবং পরিশেষে ফেরেও না। বাড়িতে আসেন একজন তারই সহযোদ্ধা। তিনি সংবাদ নিয়ে আসেন, জানান, আলতাফ ‘যশোর রোডে’র কাছাকাছি কোথাও সম্মুখসমরে মৃত্যুবরণ করেছে। সহযোদ্ধা অবশ্য বলেছেন, ‘শহিদ’ হয়েছে। মৃত্যু অথবা শহিদ এই দুই শব্দের মধ্যে পরিবারটির হারানোর বিষয়ে কোনো তফাৎ তৈরি হয় না। স্ত্রীর যাবতীয় বিলাপের মধ্যে একটি বিলাপ – ‘তুমি কেন অতদূরে গেলে যুদ্ধ করতে?’ শ্বশুর কমরেড আলী জানতে চায়, ‘অতদূরে না গেলে কী লাভ হইত বউমা?’ বউমার উত্তর – ‘অমত্মত মৃত্যুর বিস্তারিত খবর জানা থাকত।’

এসব নিয়ে কমরেড আলীর পরিবার দিনাতিপাত করে। যেন কোনোদিন আলতাফ হোসেন নামে কেউ ছিল না, সেরকম কোনো একজন দেশ স্বাধীনের লড়াইয়ে যায়নি, মরেনি বা শহিদও হয়নি। চলে যাওয়া এপ্রিলেরও দুবছর আট মাস পরে স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল। একই তারিখ বেছে নিয়েছিল, যে-দিনটিতে স্বামী প্রাণ হারিয়েছিল। দেহ ঝুলে থাকতেই শাশুড়ি প্রথম চিৎকার দিয়ে বিলাপ করেছিল ‘ছেলেডারে একলা রাইখ্যা এইডা কী করলা বউমা?’ নিজেকে ঝোলানোর আগে ছেলের জন্য বাবার কয়েকটি ছবি কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করে দিয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়, মা চাইতেন বাবার ছবিকটির সঙ্গে ছেলে বড় হবে। মায়ের মৃত্যু-উত্তর দাদু ছেলের ছবির পাশাপাশি আরো কয়েকটি ছবির ফ্রেম যোগ দিয়েছিল, নাতি এসব ছবির সঙ্গে বড় হোক।

আলতাফ হোসেন, যিনি আমার বাবা, এবং তার স্ত্রী, আমার মায়ের অবর্তমানে দাদা কমরেড শাহ আলীর সঙ্গে বড় হই। কিছুদিন পরে দাদিও মারা যায়। দাদির মৃত্যুকেও মনে হতে থাকে আত্মহত্যাই। সেটাই; মায়ের পর যে-কোনো মানুষের মরণকেই মনে হতো আত্মহত্যা। এরপর দাদুভাই ছাড়া জগতে আর কেউ থাকে না।

আমি আর দাদু কখনো কোনোদিন, আসলে অনেকদিন, বাবার ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকি। যেমন : যিনি মৃত্যুসংবাদ বয়ে এনেছিলেন তিনি জানিয়েছিলেন – অপারেশনহীন রাতে সিথানের একইদিকে রাইফেল এবং মোমবাতি জ্বালিয়ে কবিতা পড়ত। দাদু ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল – ‘কার কবিতা?’ ফলে আমরা বন্দুক দিয়ে মিছে মুক্তিযোদ্ধা সাজি। বিছানার পাশে বন্দুক শুইয়ে দিয়ে, বন্দুকের বাঁটে, স্টকে, ট্রিগার-গার্ডে, ম্যাগাজিনে, ব্যারেলে, রিবে হাত বুলিয়ে মৃদু মোমবাতির আলোয় জীবনানন্দ পড়ে দেখেছি ‘কখনো বা মৃত জনমানবের দেশে/ দেখা যাবে বসেছে কৃষাণঃ / মৃত্তিকা-ধূসর মাথা/ আপ্তবিশ্বাসে চক্ষুষ্মাণ।’ যে-কোনো সমত্মান যেমন বাবার মতো হতে চায়, আমিও সেভাবে চেয়েছি। আমার কবিতা পড়া দেখে দাদু চুপ হয়ে যেত। এক কবিতা থেকে অন্য পাতায় অন্য
কবিতায় যাই – ‘এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়/ সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।’ হয়তো এমনিই বাবা সেজে খেলা করতে-করতে কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়তাম। দাদু কাঁথা টেনে মুড়িয়ে দিত শরতের সন্ধ্যায়। এভাবে দাদু ও আমি মিলে রাত জেগে, বাবা হয়ে বাড়িতে চিঠি লিখতাম, শুরুতেই সম্বোধন করতাম ‘প্রিয় প্রাণ’। বাবা নাকি এই সম্বোধনে মাকে ভালোবাসায় আদর করে ডাকতো। আমরা রণাঙ্গন থেকে ‘প্রিয় প্রাণ’ সম্বোধনে চিঠি লিখি। যখন এ-খেলায় যোদ্ধার পুত্র প্রসঙ্গ আসতো আমি তাতে রাজি হতাম না। যেখানে নির্দেশনা দিতো লেখার জন্য, ‘আমার প্রাণপ্রিয় টুকরা ছেলের প্রতি রইল অসীম আদর ও ভালোবাসা’। দাদুর ডিক্টেশনের এখানে বেঁকে বসতাম। না, খুব যে কিছু বুঝে বেঁকে বসতাম তা নয়, ‘ছেলের প্রতি আদর’ কথাটায় মন খারাপ হতো, হয়তো বিশ্বাস করতাম না বা তেমন কিছু। সে-মুহূর্তে দাদুকে খুব অসহায় দেখা যেতো, ভাবতো এই নিয়ে নাতির কষ্ট আছে। হতেও পারে হয়তো ভাবতাম, না গেলেও তো পারতো, না মরলেও পারতো। জানি না, কী ভাবতাম এবং কী করতাম।

মনে পড়ে না, কখনো দাদুকে দেখেছি ছেলে, যুদ্ধ, শহিদ, দেশ স্বাধীন এসব নিয়ে কথা বলেছে। তাকে দেখে কিছু বোঝা যেতো না, সে কি আনন্দিত ছিল, নাকি দুঃখিত? কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।

আমি এখনো, ওই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর সাড়ে চার দশক পরও যখন দেশে ফিরি, সময় নিয়ে জাদুঘরে যাই। যে-কারণে সেখানে যাই তা এমন কিছু নয়। তাও যাই, স্বাধীনতা ইনস্টলেশনে কামরায় গিয়ে নিজের কাছের বইয়ের কপি থেকে নামটা দেখি। কেমন যুক্তিহীন আবেগি শিশুর মতো এ-কাজটা নিষ্ঠায় করে থাকি। বাবার ওই বয়সটা দেখে কত আগে থাকতেই খারাপ লাগে। নিজের বয়স এখন, যে-বয়সে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে সে-বয়সের দ্বিগুণের চাইতেও বেশি। বাবা কীরকম তরুণই রয়ে গেল। এসব ভাবনা অর্থহীন। তবু ভাবি, ঢাকার দেয়াল, গাছের পাতা ও ধুলাসমূহে যেনবা ওই নাম। হোক ওটা সামত্মবনা, তবু, ‘বাবা’ এক না ডাকতে পারা ডাক, হয়তো কেউ কোথাও ডেকে যেতে থাকে। এসব অনর্থক হ্যালুসিনেশনের হয়তো কোনো অর্থ নেই। সেটাও তো একটা অর্থ। অর্থ না থাকার অর্থ।
দাদু মৃত্যুর সময়ে মায়ের আত্মহত্যার আগে আমাকে লেখা নোট পড়ার অনুরোধ করেছিল। পড়লে না পড়লে কী এমন তফাৎ হবে ভেবে আর পড়া হয়নি। কিন্তু এর চেয়েও জরুরি যা জানতে চেয়েছিল, বাবার ওপর রাগ করেছি কিনা। এভাবে মাথায় কখনো আসেনি, ফলে উত্তর দিতে হয় না আমাকে। কেন রাগ করব? আমাকে আবেদন করে দাদু, যেন রাগ না করি। বা করলেও বাবাকে ক্ষমা করে দিই যেন। হতভম্ব আমি দাদুর হাত ধরে থাকি, অল্প সময় ব্যবধানে যার মরণ হবে এই পৃথিবীতে আমাকে একা করে দিয়ে, তার এখন এসবের দরকার কী? তার পরও বলে, যদি তার পুত্রের ওপর রাগ থাকে তবে পুত্রের হয়ে সে ক্ষমা প্রার্থনা করছে, আবেদনটি যাতে অনুগ্রহপূর্বক মেনে নিই। এখানে কষ্ট হলো ভেবে যে, যদি আমার কোনো কাজের জন্য আমার সমত্মানের কাছে তার দাদুর ক্ষমা চাইতে হতো, যেমনটি দাদু চাইলো আমার কাছে, তবে সেই লোকটি, যে নেই আমার সমত্মানদের জীবনে, সেটাই খারাপ লাগা। আর কিছু নয়।

সে যুদ্ধে গিয়েছিল পেছনে এক ছোট ছেলে ও স্ত্রী রেখে। আর কোনোদিন ফিরতে পারেনি। যুদ্ধ থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না, সে আমি জানি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত