কুসুমবীজ

জ্যোৎসণার আলপথ দিয়ে সমরের মনে হলো চাঁদটা বুঝি গলে গেছে ধানক্ষিতের মধ্যে। এবারে কুয়াশা খুব। শীত যত না পড়ছে, কুয়াশা পড়েছে তার দ্বিগুণ। ধানক্ষিত নয়, আলুক্ষিত। আলুতে এবার ধসা হবে। কুয়াশার জলে আলু নষ্ট হয়। সমরের ডান পা ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে। আলের হাঁটা তো ব্যালান্স রেখে চলা ভারি মুশকিল। যতদিন অফিস ছিল ততদিন অফিসে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এসে ব্যায়াম করাত। শহরের লোক সে। গ্রামে এসে তার পড়তায় পোষাবে কেন? অবসরের পর যেন শরীরটা ধুঁকছে। কোথায় সে যায়নি! ভ্যালোর থেকে ব্যাঙ্গালোর – সব তার ঘোরা হয়ে গেছে। অফিস থেকে লোন তুলে কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে সে গেছে সেখানে। তখন খরচ পুষিয়ে যেত। এখন হাত খালি। তখন ছিল তিন ভাইয়ের যৌথ সংসার, এখন একা, একা, একা। পাশাপাশি বাড়ি। মেজভাই তো থাকেই না, তার এক মেয়ে, সেই মাঝের হাটে বিয়ে দিয়েছে, মেজ অতুল সেখানেই আছে। ছোট অসুস্থ, ছোট কমল বিছানায় শুয়ে এক বছর। তার স্ট্রোক হয়েছিল। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। সমরের বউ গত বছর মারা গেল হঠাৎ, হঠাৎ। আসলে তার এই অসুখের মতো। ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দেওয়ার সময়ই সে বুঝতে পেরেছিল তার ডান পায়ে কোনো সাড় নেই। এরকম তো অনেকবার হয়েছে। অনেকক্ষণ বসে রয়েছে, উঠতে গেলে পা ফেলতে কষ্ট হয়…; তবু এরকম নয়। তখনো তার চাকরির অবসর নিতে আরো দশ বছর। সে ভয় পায়নি, দেয়াল ধরে ডান পা-টা ওপরে তুলে নামিয়ে আনার সময় যেন কোমর থেকে পা অবধি ব্যথার বিদ্যুতের ঝলকানি…, তার চিৎকারে আশা উঠে পড়ল। মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল…; ব্যস শুরু হয়ে গেল কষ্টের এক দীর্ঘ ইতিহাস। অফিসে সে আসত ট্রেন ধরে। সঙ্গে হয় তার ভাই, না হলে গ্রামের জ্ঞাতিদের কোনো ছেলেপুলে তাকে পৌঁছে দিত…; পরে তার ছেলে জীবন পৌঁছে দিত। কী করে হলো? কী করে হয় এসব? প্রশ্নটা অফিসের কলিগ থেকে গ্রামের চেনাজানা সবাই জিজ্ঞেস করেছে। সে কী উত্তর দিতে পারে!

খুব ছোটবেলা আমগাছ থেকে সে পড়ে গিয়েছিল। সেই আঘাতটাই এতদিন বাদে ফিরে এসেছে। ডাক্তারবাবু সে-কথা বললেন। গ্রামের প্রায় সবাই সে-কথা বিশ্বাস করল। অফিসেরও সবাই…; কিন্তু সমরের অমত্মরঙ্গ বন্ধু বেণু বিশ্বাস করল না। বেণু সমরকে একদিন বলেই ফেলল, সমর, এ তোর পাপের ফল।
কী সব যা-তা বলিস… সমর ক্ষুণ্ণ হলো।
তুই বুকে হাত দিয়ে বল তো সমর…
কেন বুকে হাত দিতে যাব…
তাহলে আমি ঠিক বলছি।
তুই মিথ্যে বলছিস।
আমি যে সাক্ষী সমর – তুই আমাকে এড়াতে পারবি না…
এবার সমর থমকে গেল। সত্যিই তো, সে এড়াতে পারে না। বেণু ও সে তখন গ্রামের ত্রাস। তুই মদ্দ জোয়ান। ধানের গোলার পয়সা পকেটে। অতএব সংসার চালানোর পর বাড়তি টাকায় সুখ কিনতে এধার-ওধার। আরাম। অনুকে বেণুই ফিট করেছিল। গ্রামের প্রামেত্ম মস্তবড় ঝিলের পাশে ছোট্ট এক খড়ের ছাউনি। ওখানে বসে গ্রামের ছেলে-ছোকরারা তাস পিটাত… নেশা ভাং…। কে যে ছাউনি করে রেখেছিল কে জানে! বেণু ও সমর অনেকবার ওখানে গরমকালের সকালে তালের রস দিয়ে মাছভাজা খেয়েছে। তারপর ঝিলে ঝাপ… এফোঁড়-ওফোঁড়। জলকেলি। জল ছেড়ে উঠত যখন রোদ মাথার ওপরে গনগনে।

ছাউনির ভেতরে ছোট একজনের শোয়ার মতো বাঁশ দিয়ে উঁচু করে বন্দোবস্ত করা আছে। অনুকে ওখানেই শোয়ানো হলো। প্রথম পালা বেণু সাঙ্গ করার পর…, সমরের টার্ন। কিন্তু সেদিন অধিক মাত্রায় তালরস ও মাছ খাবার পর সমরের মাথায় কোনো হুঁশ ছিল না। বাঁশের তক্তপোশ, ততোধিক সরু তার পরিসর, উলঙ্গ সমর হঠাৎই মাঝপথে অনুর শরীর থেকে শক্ত মাটির ওপর পড়ে গিয়েছিল। কিছু ভাঙা ইটও ছিল। হাসির ঝরনায় ভাসছিল বেণু ও অনু। সমরের আজ আর মনে নেই সে হেসেছিল কিনা! বেশ ব্যথা পেয়ে সে কঁকিয়ে উঠেছিল। নেশার ঘোরে ব্যথা আর বেশিদূর হাঁটেনি। কিন্তু সেদিন রাতে পাশ দিয়ে বউ আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল, ব্যথাটা আসলে লুকিয়েছিল…;

অস্থিমজ্জার ভেতর ব্যথাটা আত্মগোপন করেছিল। ব্যস ওইটুকুই। রাতে গরমজলের সেঁক। ব্যথা কমানোর ট্যাবলেট। ব্যথা উধাও। তারপরে অনেকদিন কেটে গেছে। বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম হয়েছে তার ঔরসে। চাষের কাজ। গোয়ালের গরুর পরিচর্যা। হাঁটতে-হাঁটতে ভিনগাঁয়ে ফাংশন শুনতে যাওয়া…, ট্রেন ধরে অফিস যাওয়া…; কত রকম কাজ। কত ধরনের কাজ সে করেছে, শরীর যেন তরতাজা। সবাই বলাবলি করত আহা সমরের শরীর যেন লোহা দিয়ে গড়া। একাই সে দুবস্তা চাল পিঠে বয়ে নিতে পারত। গায়ে যেন অসুরের শক্তি। রাতে গোটা বারো রুটি, সমপরিমাণ তরকারি তার পেটে বেমালুম হজম। দুপুরে দু-কাপ চালের ভাত…; গ্রামের যে-কোনো কঠিন কাজে সমরকে চাই…, সমর নেতৃত্ব দেবে। সমরকে পাওয়া মানে সেই কঠিন দুরূহ কাজ অবলীলায় উদ্ধার হওয়া…; কিন্তু এখন সমর আগের সমরের ছায়া। তার লিকলিকে ডান পা। বেঁকে-যাওয়া শরীর। গত বছর বউ আশা চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে মনের জোরটাই চলে গেছে। তবু তো রাতে একজনকে পাশে পাওয়া যেত…;

জীবন, তার বাবা-মরা ভাইপো। ঠিক তারই মতো অবিকল। একাই এক কেজি খাসির মাংস খেয়ে ফেলবে। তার জোর অসম্ভব। বিয়ে দিয়েছে তার সমর। বিয়ে হয়ে গেল প্রায় চার বছর। বাচ্চা হয়নি। বাচ্চা নেই। স্বামী-স্ত্রীতে আগে মিল ছিল। এখন প্রত্যেকদিন ঝগড়া। জীবন সন্ধে হলেই নেশা করে… রাতে তাসের আড্ডা থেকে ফিরেই ছুতানাতা নিয়ে ঝগড়া। তুমুল চিৎকার। ঝগড়ার শেষ কথা জীবনের গালি – শালা বাজা মাগি… গতরই আছে তোর, আর কী আছে! ব্যস তারপর চুপচাপ। জীবনের বউ কুর্মির ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। ভালো লাগে না সমরের। একেবারে বেহুদা লাগে। কিন্তু কী আর করা যাবে!

আলুর ফলন মোটেও ভালো নয়। মাঠ থেকে আলু উঠছে তবু। আলুর দরও পাওয়া যাচ্ছে না…, সরকার পাশের রাজ্য থেকে আলু আমদানি করছে। জীবন তবু চেষ্টা করে। দিনের বেলা সে তো সাদা চোখে সব দেখে। চুপচাপ থাকে। থুতনিতে তার দাড়ির চুল গোটা পাঁচেক পেকেছে। চোখের নিচে বিষম কালি। মাথার চুলে দু-চারটে রুপালি রেখা। এ-বছর মাঘের শীত পেরোলে বিয়ের পাঁচ বছর। দোষটা তবে কার! জীবনের বউ কুর্মি ডাগর। শরীর স্বাস্থ্য মাংসের কোনো ঘাটতি নেই। তবে ইদানীং মুখে চোপা…; শীতের সকাল দশটায় তার রোদে পিঠ দিয়ে মটরশুঁটি, তেল দিয়ে মুড়ি খেতে ইচ্ছে করে, সঙ্গে এক গস্নাস চা। তারপর আয়েশ করে বিড়ি। দেবে কে! কুর্মির আজকাল দেরিতে ঘুম ভাঙে। গভীর রাত অবধি তো ঝগড়া, তারপর মারামারি। মারামারি করতে-করতে উঠোনে দুজন দুজনের পেছনে দৌড়োদৌড়ি করে উদোম হয়ে…; হায়-হায় সমর বেঁচে আছে কেন? সমর তাই ঘুমের ওষুধ প্রতিদিন খায়। তার বুক ধড়ফড় করে। সে বিছানায় একা শুয়ে হাঁপায়। তার ভাইদের বাড়ি থেকে আগে কেউ-কেউ এসে এই তা-ব থামানোর চেষ্টা করত…। এখন কেউ আসে না। এখন অভ্যাস। রোজকার মেগা সিরিয়াল…; কারো কোনো উৎসাহ নেই দেখার। কেউ ঘুম থেকে উঠে দেখে না, শেষ পর্যমত্ম কার হার কার জিত হলো।

দুদিন পরপর এই বাড়ি থেকে কোনো আওয়াজ নেই। কোনো বাছা-বাছা শব্দবাণ ছোড়েনি কেউ প্রতিপক্ষের দিকে। সমরের কেমন সন্দেহ হলো। হলোটা কী! সমরের নিত্য অভাস্যের রোজনামচার ব্যাঘাত মোটেও সহ্য হয় না। যা সে কোনোদিন করে না, আজ তাই করল। আলগা দরজার বাইরে কান পাতল। ঘরে নাক ডাকার আওয়াজ…, বাকি কোনো শব্দ নেই। তবে! তবে আর কী, সমর খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বাড়ির দাওয়ায় নেমে ক্ষিতের দিকে রওনা হলো। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, বেশ কষ্ট হচ্ছে…

দেড় বিঘা জমির ওপর আলু লাগানো আছে। কত কষ্ট করে এই আলুর বীজ, হায় ঈশ্বর, এসব কে দ্যাখে! জীবনটা চোখের সামনে হয়ে গেল মদোমাতাল। এক আঙুল মোটাসোটা আলুগাছ। লম্বা হয়েছে। ডাগর। এরকম ডাগর দেখেই তো সমর কুর্মিকে এনেছিল। ঝুমরিতলা থেকে। সম্পন্ন গ্রাম। অবস্থাপন্ন পাল্টি ঘর। নিটোল একখানি মুখশ্রী। দীঘল চোখ। গলার স্বরে সবসময় আত্মসমর্পণের ভঙ্গিমা। সেই মেয়েটাকেই এখন অচেনা লাগে। গলার স্বরে লাগামহীন উত্তেজনা।

আলুগাছগুলিতে ফুল ধরেছে। দু-তিনবার জল খাবার পর এই ফুল। আলুর ভেলিতে (ড্রেন) জল…, জলে জ্যোৎসণার রং অন্যরকম। এই ভেলি না থাকলে আলুর রং সবুজ হয়। সমর জানে এসব। অথচ জীবন জানে না। শিখতেই চাইল না। হালকা নীল রঙের ফুল। মেশিনে সেচে জল নিয়ে আসা হয়। শারীরিক শ্রম। অঘ্রানের প্রথম সপ্তাহে এই বীজ রোপণ করেছিল সমর।

ফাল্গুনের শেষে এই আলু ক্ষিত থেকে তুলবে সে। আলুক্ষিতের পাশে কুসুমগাছ, যবগাছ। কুসুমগাছের ফুল খেতে আসে একঝাঁক টিয়া…, টিয়ার ঝাঁক। সমরের মা করে দিত কুসুমবীজের সঙ্গে চালভাজা মিশিয়ে তাদেরকে খেতে। প্রথম-প্রথম সংসারে এসে কুর্মিও করত।

ফাল্গুন মাসের শেষে গরুর লাঙুলে আলু ভরে বস্তায় পুরে বাড়ির উঠোনে…; তখনও বউ ছিল সমরের, কুর্মি এসে গেছে সংসারে। দুপুরে রোদের পিঠে পুঁটিমাছের ঝোল দিয়ে দেদার ভাত খেয়ে, তাস পিটানো…;

সেই কুসুমগাছগুলি জড়ো হয়ে আছে। কুসুমগাছের কাঁটা তড়বড়ানি লাগে শরীরে।
চমৎকার এক গন্ধও উড়ে আসে আলের ভেতর…; এ-সময় সাপের গর্তে… ম্যাকোজেম স্প্রের গন্ধে জমিতে ইঁদুর উধাও, সাপও তেমন কই!

সে দেখল এক উলঙ্গ মেয়েছেলে যেন আকাশ থেকে হড়হড়িয়ে নেমে আসছে তার পায়ের কাছে। অপরূপ তার বিষণ্ণ দৃষ্টি…; ভয় পেয়ে দৌড়তে গেল সমর…, হয় এসব মাঝে-মাঝে গাঁয়ে। কেউ-কেউ দেখে ফেলে তেনাদের। সমর পড়ে গেল জমির ভেলের ভেতর। শুকনো জমানো পাতা… আলু… জলের জ্যোৎসণা নিয়ে গড়াগড়ি। বুকের ’পরে সে মহা-আশ্চর্য হয়ে দেখছে কুর্মি…; এও কি সম্ভব! চোখ কচলে নিজের লুঙ্গি ঠিক করতে গিয়ে সে যেন অবশ…;
(কুর্মি বীজ বপন কেই-বা করবে। হায় ঈশ্বর, এও কি সম্ভব? কোমর থেকে সব ব্যথা নেমে যাচ্ছে সমরের ওই অপোগ- ছেলের জন্য)

জীবনের ভোরে ঘুম ভাঙে। পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কুর্মি। শীত ভোরের দিকে একটু থাকে। দুপুরে বেশ উষ্ণতা, আর পরে শীত আবার আসে। এ এক আশ্চর্য আবহাওয়া।
শীত যত বাড়ে, ততই ভালো। আলুতে ধসা হবে কম। চাষির ঘরের ছেলে জীবন, এটুকুই তো বোঝে। আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। জীবন বেশ চনমনে হয়ে গেল। আদুরে বেড়ালের মতো কুর্মি তার হাত জড়িয়ে আছে।

একটা হাত বাড়িয়ে কুর্মি জীবনের হাতে চাপ দিলো। জীবন বড়-বড় চোখ দিয়ে কুর্মিকে দেখছে। কুর্মি যেন তৃপ্ত… ধসা নেই…

একটা লম্বা আলপথ বেয়ে লোক চলেছে হেঁটে। দুধারে আলু ওপড়ানো জমি। নতুন ফসলের অপেক্ষায় আঁতুড়-জমি, একটি দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে…। উঁকি মারছে কেউ। কারো স্বরে বিস্ময়ের গোঙানি। এ যে সমর…; প্রায় উলঙ্গ। বুকের মাঝে হাত জড়ো। প্রবীণ-নবীন গ্রামের সবাই সমরকে জানে। সমরের তো সব ভালো, সম্পন্ন গৃহস্থ, কিন্তু ছোঁকছোঁক বাই।
কুসুমগাছের ডালে আজো অঢেল টিয়া। উড়ে যাচ্ছে, বসছে। আবার উড়ে যাচ্ছে, বসছে। দেহগ্রামের এক প্রামেত্ম দাহ করা হলো। ঘর ফাঁকা, উঠোন নীরব। জীবন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বাবা মারা গেল কী করে! সমরের তো কোনো রোগ ছিল না! আর অমন নিশি-বেলায় সে কেনই-বা গিয়েছিল আলুক্ষিতে…; বছর ঘুরতেই কুর্মির পেটে ছেলে…; জীবন ভাবছে যে, ধসা নেই আর! সমরের মতোই দেখতে অবিচল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত