বন্ধ্যা

বন্ধ্যা
সত্যি করে বলোতো বউমা, তোমার কি আক্কেল জ্ঞান বলতে আদৌ কিছু আছে? পাত্রী দেখতে আসতে তোমায় সাথে আনাটাই হইছে চরম ভূল।যদি বিয়েতে কোনো অঘটন ঘটে তাহলে তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি পাঠাবো সোজা। আর কোনো কথা শুনবোনা আমি কারো এই বলে দিলাম।
-আহ মা হচ্ছেটা কি? সামনে পাত্রী বসা দেখছোতো নাকি? এসব কথা কি এখানেও না বললেই নয়? এতক্ষণ ধরে কথাগুলো সব আমার সামনেই হচ্ছিলো। ওনারা উঠে গেলেন কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু একটা বিষয় বুঝলামনা আমার হবু শাশুড়ি তার বড় ছেলের বউ কে এতো কথা শোনালেন কেন? তেমন কিছুতো করেনি শুধু আগ বাড়িয়ে ওনাদের আগেই আমার নামটা জানতে চেয়েছেন। তাতে কি এমন হয়েছে যে এই আচরণ করলো তাও
অপরিচিত মানুষদের সামনে?
রাতে বাবা জানালো পাত্র পক্ষের আমাকে পচ্ছন্দ হয়েছে। সামনে সপ্তাহেই বিয়ের কাজটা সম্পূর্ণ করতে চান ওনারা। বিয়ের দিন গাড়ি থেকে নামার পর কিছু নিয়ম-কানন আছে সেগুলো পালন করতেই শ্বশুর বাড়ির সবাই আমায় দাঁড় করিয়ে রাখলো। আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার সব নিয়ম গুলো দেখতেছি। হঠাৎ করে বড় ভাবি কে দেখলাম, সবার আড়ালে পিছন থেকে মুখটা মাঝে মাঝেই উঁচু করে আমায় দেখছে। ভাবলাম ভীড় বলেই মনে হয় আসতে পারছেনা সামনে। কিন্তু না, তাকে যে আসতে দেওয়া হচ্ছেনা সেটা বুঝলাম আরেকটু পরেই।কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমি। ভাবি মিষ্টির প্লেটটা কেন আনলো এটাই ছিলো তার দোষ। আমার শাশুড়িতো বললেন,
-তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে বড় বউ? কোনো প্রয়োজন আছে কি তোমায় এখানে? নতুন বউ নামানোর অনেক মানুষ আছে তুমি ভিতরে যাও। শুধু এ টুকুতেই আটকে ছিলোনা। আত্মীয়-স্বজনের ভিতর থেকে কেউ কেউতো মুখ বাকা করে বলেই উঠলো,
-কেমন বেকুব ব্যাটার বউগো ফাতিন এর মা তোমার হ্যা? এই নতুন বউয়ের সামনে ওই পোঁড়া মুখটা না দেখালেই কি নয়?কি কুলক্ষণে কারবার বাবা, পারেও বটে যত্তসব।
কথাটা শোনামাত্র ভাবি মুখে আঁচল চেপে ওখান থেকে চলে গেলো। মূহুর্তেই পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গেলো।সবার কানাঘুষাতে আমার খুব খারাপ লাগছিলো ভাবির জন্যে। ওনাদের কথাগুলো শুনে আমার তখনি উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু পারলামনা।কারন প্রথমত আমি নতুন বউ,আর দ্বিতীয়ত তারা কেন ভাবিকে সহ্য করতে পারেনা সেই বিষয়টা এখনো পর্যন্ত অজানা। পরদিন সকালে রান্নাঘরে ঢুকতেই ভাবিকে দেখলাম চা নাস্তা বানাচ্ছে। বললাম,কেমন আছো ভাবি? ভাবি ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো’ বললো ঠিকই কিন্তু মুখটা তুলে তাকাতেই দেখলাম চোঁখদুটো লাল হয়ে আছে।ভাবিকে আর কোনো প্রশ্ন করলামনা। চা নাস্তা নিয়ে আমার শ্বশুর শাশুড়ির রুমের দিকে গেলাম। ওনাদের দিয়ে আমার স্বামী ফুয়াদ কে চা’টা দিতেই আমার রুমের উদ্দেশ্য হাঁটছিলাম। কিন্তু মাথায় ওই একটা প্রশ্নই ছিলো ভাবির কি সমস্যা যার জন্য সবাই এমন ব্যবহার করে? রুমে ঢুকতেই দেখলাম ফুয়াদ বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ভাবলাম ফিরলে জিজ্ঞেস করবো।
একটু পরেই শাশুড়ি মা ডাক পাঠালেন আমায়। আমি তৈরি হয়ে যেতেই দেখলাম অনেক লোকজন এসেছে। সাধারণত বিয়ের পরদিন এমন অনেক আত্মীয়-স্বজন পারা প্রতিবেশী আসে নতুন বউ দেখতে। বিষয়গুলো জানা থাকার কারনে আমার তেমন খারাপ লাগলোনা।কিন্তু বিপত্তিটা ঘটলো সেই একটা জায়গাতেই। আজকেও সবার সেই নিন্দা সূচক কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো ভাবি কে নিয়ে। নাহ আর সহ্য করা যায়না। শাশুড়ি মা কে উদ্দেশ্য করে বলেই ফেললাম,আচ্ছা মা সমস্যাটা কি ভাবি কে নিয়ে? বাড়ি ভরতি মানুষজন যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো আমার প্রশ্নটা শুনে।তাদের মাঝে থেকে একজন মধ্যবয়সী ভদ্র-মহিলা চেচিয়ে বলে উঠলেন,
-ক্যানগো নতুন বউ তার সমস্যা বিয়ার পর পরই তোমার শোনা লাগবো ক্যান? তার সাথে একটু কম মিশো বুঝলা নতুন বউ, সে যে বাজাগো বাজা।দেইহো আবার সেই বাতাস তোমার গায়ে না লাগায়। কতটা নিচু মনের মানুষ হলে এরা একেকজন মেয়ে হয়ে অন্য আরেকটা মেয়েকে এইভাবে অপমান করতে পারে? এখন বুঝতে পারলাম এই জন্য এরা সবাই এমনকি আমার শাশুড়িও ভাবি কে সহ্য করতে পারেনা। রাতে ফুয়াদের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলে সবটা শুনে নিলাম।ভাইয়া-ভাবির বিয়ের ৭বছর চলছে। এখনো পর্যন্ত তাদের কোনো সন্তান হয়নি।
দু-একদিনের মাঝেই ভাবির সাথে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই দু’দিনে ভাবিকে দেখে যা বুঝলাম উনি খুব ভালো মনের একজন মানুষ। ভাবি নিজেও সন্তান না হওয়ার জন্য সবসময় একটা চাপা কষ্ট নিয়ে থাকে।অথচ সমাজের মানুষগুলো তার কষ্ট বুঝবে কি, উল্টো কথা শোনাতে ভোলেনা। সেইদিক দিয়ে ফাতিন ভাইয়া ভীষন ভালো একজন মানুষ। তিনি যদি ভাবীর পাশে না থাকতেন তাহলে হয়তো ভাবি আরো বেশি ভেঙ্গে পরতেন। এক সপ্তাহ পর আমার বাবার বাড়ি থেকে লোকজন আসে আমায় নিতে। আমি তৈরি হয়ে যাওয়ার পথে ভাবি কে কোথাও দেখতে পেলামনা।আমার এদিক সেদিক তাকানো দেখে ফুয়াদ জিজ্ঞেস করলো কিছু রেখে যাচ্ছি কিনা। আমি বললাম ভাবি কে কেন দেখছিনা? ফুয়াদ উত্তরটা দেওয়ার আগেই আমার শাশুড়ি বলে উঠলেন,
-বড় বউকে আমিই ঘরে থাকতে বলেছি।
-কিন্তু কেন মা? পাশ থেকে আমার চাচি শাশুড়ি বলে উঠলেন,
-কেন আবার জানোনা? বাজা নারীর মুখ দেখে যাত্রা করবে নাকি? অলক্ষীর মুখ দেখে যাত্রা শুভ হয়না জানোনা?
আমি কিছু বলার আগেই ফুয়াদ বললো,
-থামেন আপনারা। এসব কুসংস্কার আপনাদের মনে বাস। সেসব কেন অন্যের উপর ফেলছেন?
-ফুয়াদ তুই এখন বেশি কথা বলিসনাতো,যাওয়ার সময় হইছে ভালোভাবে শ্বশুর বাড়ি যা।
-কেন মা সত্য কথা বললেই কেন এতো অযুহাত তোমাদের?
-ফাতিনের মা, ফুয়াদতো ঠিকই বলেছে।এতোদিন বলেও তোমার মুখটা বন্ধ রাখতে পারিনি। এখন অন্তত একটু বন্ধ রাখো।বাড়ি ভরতি নতুন মেহমান তাদের সামনে কি শুরু করলে তুমি? বাবা আর ফুয়াদের কথা শুনে মা চুপ হয়ে গেলেন। হয়তো নিজের ভূলটা বোঝার চেষ্টা করছেন। এখনো আমি বলা বাকি।প্রথম থেকে শুনেই আসছিলাম কিন্তু আজ আর জবাব না দিয়ে যেতে পারছিনা।এবার আমি বলতে শুরু করলাম,
–মা আপনিও একটা মেয়ে আর ভাবি সেওতো একটা মেয়ে।একজন মেয়ে হয়ে যদি অন্য মেয়ের কষ্ট’টা না বোঝেন, তাহলে কি মেয়ে হিসেবে দাবী করা আমাদের সাজায় আপনিই বলেন? আজ যদি ভাবি আপনার গর্ভের মেয়ে হতো?পারতেন উঠতে বসতে এতো কটু কথা শোনাতে? আচ্ছা মা একবারও কি বিবেকে বাধেনা আপনার, যে মানুষটা সারাদিন আপনাদের মতো কুসংস্কারে আবদ্ধ মানুষগুলোর নিন্দাসূচক কথা হজম করে হাসি মুখে সংসারের প্রতিটা কাজ করে যায় তার প্রতি কি এতটুকুও মায়া আসেনা? এসব কথা কি না বললে চলেইনা? সমাজের মানুষ বরাবরই অন্যের কষ্টকে খুঁচিয়ে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পায়। তারা সবসময়ের জন্য কুসংস্কার পালন করে তবে সেটা শুধু অন্যের বেলায়।খোঁজ নিয়ে দেখেন নিজের বেলায় কিন্তু ষোলো আনা। তাদের কথা কেন সায় দেবেন আপনি?বরং তাদের কে প্রশ্রয় না দিয়ে চুপ থাকতে বলবেন।যদি এই কাজটা অনেক আগেই করতেন তাহলে এত বড় দুঃসাহস কারো হতোনা আপনারই চোঁখের সামনে আপনার ছেলের বউ কে অলক্ষী, কুলক্ষনে বলার।
আর আপনারা, আপনারা হলেন আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী আমাদের প্রতিবেশী।বিপদে আপদে যাদের সবার আগে পাশে পাবো তাকেই বলে প্রতিবেশী। আর আপনারা যদি এমন আচরণ করেন তাহলে কি আমরা আপনাদের কে হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে মনে করবো বলেন? ভাবি সন্তান জন্ম দিতে পারেনা এটা কি ভাবির দোষ? নাকি শুধু তার একারই দোষ?তাহলে তাকে কেন একা অলক্ষী বলেন? ভাইয়াকেও বলেন সেওতে সমান দোষে দোষী।
তাকে বাদ দেন কেন?ওহ তিনি পুরুষ বলে? ঠিকআছে আমি বলছিনা নারী পুরুষকে সমান চোঁখে দেখতে, তবে সব ব্যপারে একা নারীর দোষ দেবেননা। মনে রাখবেন আল্লাহ তায়ালার ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়েনা সেখানে সন্তান জন্মদানতো অনেক বড় ব্যপারই থাকলো। এটাতে ভাবির কোনো হাত নেই তাই ভাবি কে এরপর থেকে আর কোনো বাকা কথা শোনাবেননা। শুধু ভাবি কেন আমাদের সমাজে এমন অনেক ভাবি আছে যারা সন্তান জন্মদানে অক্ষম তাই বলে তাকে কেন কটু কথা শোনাবেন আপনারা? কোনো অধিকার নেই আপনাদের।মানুষ হিসেবে না পারলেও একজন নারী হিসেবে অন্য আরেকটা নারী কে সম্মান করতে শিখুন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী আপনা-আপনিই বদলে যাবে।
সবার মুখ দেখে এটাই বুঝলাম, কিছুটা হলেও কথাগুলো তাদের ভাবাচ্ছে।আমি আর দেরি না করে ফুয়াদ কে পাঠালাম ভাবি কে ডাকতে। ফুয়াদ আসলো ভাবি কে সাথে নিয়ে,ফাতিন ভাইয়া এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো মাথা নিচু করে। ভাবি কে বললাম, যাও তৈরি হয়ে নাও আমার সাথে তোমরাও যাবে। ভাবি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। বললাম যে, আমাদের ওদিকে একটা সুন্দর নিয়ম দেখি জানোতো।প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেকদিনের জন্য বাবার বাড়ি আসতে অনেকে স্বামীর বোন কে সাথে নিয়ে আসে। কিন্তু আমারতো আর ননদ নেই তবে বড় একটা বোন আছে তাই তাকেই আমার সাথে নিতে চাই। ভাবি আর কোনো কথা বলতে পারলোনা চোঁখদুটো মূহুর্তেই ভারি হয়ে এলো তার। ফাতিন ভাইয়াও পাশে এসে দাঁড়ালো, ভাবিকে সম্মতিসূচক উত্তর দিয়ে রুমে নিয়ে গেলো তৈরি হতে। এদিকে আমার বাবার বাড়ির লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কিছু দেখছিলো। বাবাতো বলেই বসলো, সোনিয়া মা তোর প্রতিবাদ করার স্বভাবটা আর গেলোনা এখনও? আমি বললাম,বাবা যতদিননা সমাজের একটা মানুষ কেও শোধরাতে পারবো ততোদিন অবদি এই স্বভাবটা রয়েই যাবে।
পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম ভাবি বোরকা পরে তৈরি আর সাথে ভাইয়াও ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। মা কে বললাম, মা আপনিও যাবেন কিছুদিন পর বাবাকে সাথে নিয়ে দুই মেয়েকে আনতে। মা অনুতপ্ত হয়ে আমার আর ভাবির হাতটা ধরে বললো, আমি আমার ভূলটা বুঝতে পেরেছি তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও মা। আর হ্যা দেখে শুনে যেও পৌঁছিয়েই কিন্তু একটা কল করবা। মূহুর্তেই সবার মুখে যেন বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটলো।পরিবেশটা ভীষন উৎসবমুখর হয়ে উঠলো।পরিবারের সবার চোঁখ তৃপ্তির খুশিতে চকচক করছিলো। এতো মানুষের ভীড়ে আমার চোঁখ তার চোঁখজোড়াতেই আটকে আছে। যার চোঁখে এখনোও অশ্রু তবে সেটা তিব্র নিন্দা,অপমানবোধের না, এই অশ্রু যে শুধু সুখের অশ্রু।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত