বাসে উঠেই বুঝে ফেলেছিলাম আজই আমার জীবনের শেষ জার্নি। আম্মা রোজই বলত, “এমন চাকরি ছেড়ে দে।যেই চাকরি করে বাসায় ফিরতে হয় মধ্যরাতে, সেই চাকরির দরকার নেই।আল্লাহ না করুক মানুষের বিপদ আপদের তো ঠিক নেই।” মনে পড়লো মিলির কথা।চাকরিটা ছাড়া না ছাড়া নিয়ে প্রায় লাগত আমার সাথে।
সবসময়ই বলতো,”শাতিল,এই চাকরিটা প্লিজ করা লাগবে না।” চাকরিটা ছাড়ছি না বলে গত তিনদিন কথা বলছে না আমার সাথে,যেরকমটা সে প্রায় সময়ই করে। সত্যি বলতে কী,ভেবেছিলাম আজই বাসায় গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তাকে জানাবো।কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার,বাসায় ফেরা নিয়েই আজ আমি শঙ্কিত। রাত তখন তিনটা।ডিউটি শেষ করে বাসায় যাওয়ার জন্য মালিবাগের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি।আজ কোন যানবাহন খুঁজে পাচ্ছি না।বিরক্তিকর!আসলেই এই চাকরি আর করা যাবে না। দূর থেকে এগিয়ে এসে আমার গা ঘেঁষে তখনি থেমে গেল বড় কালো রঙের এসি বাসটা। “মামা কই যাইবো,কই যাইবো?” “উত্তরা।” “আসেন,আসেন।তাড়াতাড়ি।” “হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত যাবে তো?” “হ হ উঠেন।”
উঠার সাথে সাথেই দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল।গাড়ির ভেতরের দিকে তাকাতেই গা একটু শিউরে উঠল।মোটামুটি পঞ্চাশ কিংবা ষাট জনের সিট হবে বোধ হয়,কিন্তু যাত্রীশূণ্য।শুধু আমিই যাত্রী?আর সব সিট ফাঁকা?এ কী করলাম আমি।হুট করেই কিছু আগ পর না ভেবে বাসটায় উঠে গেলাম?চিন্তার শুরু তখন থেকেই।চারদিকটা আবার তাকালাম ভাল করে।নাহ,সব সিট ফাঁকা নয়।আমার দু’ সিট পেছনে জানালার ধারের সিটটায় বসে আছে একজন।তাকে দেখে চিন্তাটা যেন ভয়ে রূপ নিলো।তার আপাদমস্তক ঢাকা লম্বা আলখাল্লা ধরনের পোশাকে।মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে গেছে।মুখ ভর্তি লম্বা দাঁড়ি আর গোঁফ।
তার কোন নড়চড় নেই।স্থির হয়ে একদৃষ্টিতে সামনে চেয়ে বসে আছে।অনুভব করলাম আমার হার্টবিটটা বাড়ছে ত্বরণের মতো,সেকেন্ডে সেকেন্ডে।কী করব বা কী করা উচিত হুট করেই চিন্তা করতে পারছিনা। ড্রাইভারের দিকে তাকালাম।তার নাক মুখ থেকে অনর্গল ধোয়া বের হচ্ছে।হুম বিড়িই টানছে সে।ব্যাপারটা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।ভয়টা আরো বেড়ে যাচ্ছে,টের পাচ্ছি।আশ্চর্য! ড্রাইভারের পাশের মহিলা সিটগুলোতে বসে আছে আরো তিনজন।একজনের মাথায় ক্যাপ।ক্যাপের সামনের ছাউনিটা মাথার পেছনে।পেছন দিক থেকে তাকালে চোখে সানগ্লাসের উপস্থিতিটাও স্পষ্ট দেখা যায়।বাকি দুজনকেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা।একজনের পরনে লুঙ্গি আর গায়ে ছেড়া গেঞ্জি।অন্যজন কোর্ট টাই পরিহিত অতি ভদ্র সাজে।বাসের ভেতরে গাঢ় নীল রঙের ড্রীমলাইটে তাদের কেমন যেন দেখাচ্ছে।মনের মধ্যে ভয়টা জেঁকে বসছে আরো দ্রুত।হার্টবিট বেড়েই যাচ্ছে।
আমি যদি মরে যাই?পরদিন খবরের কাগজে আমার খণ্ড খণ্ড লাশের ছবিটা ছাপিয়ে যদি শিরোনাম দেওয়া হয় ‘অজ্ঞাত ব্যক্তির বিভৎস মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়’? আম্মা,মিলি আর আমার দুবছরের বাচ্চা মুনতাহিন? কী হবে তাদের?মুনতাহিন বাবা বাবা বলে দৌড়ে এসে কার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে?কাকে ফোন করে বলবে,”বাবা,হাও আর ইউ?”আম্মা কী পুত্র হারানোর বেদনা নিয়ে বাঁচতে পারবেন?শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যাবেন না তিনি?কিভাবে বাঁচবেন তিনি!আর মিলি?যে কিনা আমাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসে?আজ কলিংবেলের টিংটিং শব্দ না শুনতে পেয়ে সে কী করবে?সারাজীবন তাকে আগলে রাখব বলেছিলাম।আর আজ আমিই তার থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছি?শিউরে উঠলাম আবার। চিন্তার শেষ নেই।চিন্তা যত বাড়ছে,পথ যত এগুচ্ছে, আমার ভয় তত গভীর হচ্ছে। এরকম আরো অনেক ঘটনা শুনেছি আমি।তাছড়া আজকের মতো আর কোনদিন এমন মনে হয়নি।আমার কী করা উচিৎ সেটা ভাবতে হবে।আমাকে তো বাঁচতে হবে।উপায় বের করতে হবে।কী করব আমি?চেঁচাবো?ফোন দেব কাউকে?
এমন সময় কন্ডাক্টর এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।”ভাড়া দেন।” তার কণ্ঠে যেন কেমন ঝাঁঝালো গন্ধ।বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।সেই চোখ থেকে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে।আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। “কী হইলো,ভাড়া দেন?” আমি পলক ফেললাম। “ও, হুম!এই নিন।” কম্পিত হাতে তার দিকে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম।”একশ ট্যাকা?ভাংতি দেন।” ভয়ে ভয়ে বললাম, “ভাংতি তো নেই।” দেখলাম তার দৃষ্টি আমার মানিব্যাগের দিকে। “আইচ্ছা পরে নিয়েন বাকি ট্যাকা তাইলে।” “আচ্ছা।”সে চলে গেল সামনে।বিপদ যে আসছে,বুঝতে পেরিছি ইতিমধ্যেই।ভয়ে যেন আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।কী করতে পারি?বুদ্ধি খাটাতে হবে।মাথা গরম করা যাবেনা।
এমন সময় দেখলাম,আমার সামনের সিটে হুট করে এসে বসল একজন।হাতে কালো ব্যাগ।পরনে শার্ট প্যান্ট।চোখে চশমা।দেখে ভালো মানুষই মনে হচ্ছে।একটু ভরসা পেলাম।ভয়ের মাত্রাটা সামান্য কমল।বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম।”কোথায় যাবেন,”সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম আমি।তিনি আমার দিকে তাকালেন বড় চোখে।অবাক হলাম!তিনি পুরুষ নয়,অল্প বয়স্ক রূপবতী একটা মেয়ে।কী সুন্দর তার চেহারা! অদ্ভূত তো!দেখে বুঝতেই পারিনি আমি। ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল সে।চিকন গলায় বলল,”আমি?আমি যাবো আকাশে।” আবার হেসে দিল।”আপনি যাবেন আমার সাথে?” আমি তো থ বনে গেলাম।বুঝতেও পারছি না মেয়েটা মজা করছে কিনা।কিছু বললাম না।মনে পড়ল সচারচর ঘটা এইধরনের ঘটনাগুলো।যাত্রী বেশেই দু তিনজন থাকে।কেউ মিষ্টি মিষ্টি কথাও বলতে পারে। মেয়েদেরকে দিয়েই এসব করানো হয় কৌশলগত সুবিধার জন্য।ভাবনা আর বাস্তব একসাথে মিলে যাচ্ছে আজ।সুতরাং বিপদ সামনে অপেক্ষা করছেই,বুঝলাম আমি।
আমি ঘামাচ্ছি এসিতে থেকেও।ভয় আরও গভীর হচ্ছে।হঠাৎ বাইরে চোখ পড়ল। এ কি?কোন পথে যাচ্ছি?পথ তো এটা নয়।মেইন রোড ছেড়ে অন্ধকার গলির মতো পথ?এবার মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই গেলাম যে কোন বড় একটা চক্রে ফেঁসে গেছি আমি।গলা উঁচিয়ে কন্ডাক্টরকে ডাক দেওয়ার শক্তি তখন আমার নেই।তবুও চেষ্টা করলাম।”এই কন্ডাক্টর, কোন পথে যাচ্ছ?”যতটা সম্ভব উঁচু গলায় বললাম।আমার পেছনের আলখাল্লা পরিহিত লোকটা মোটা কণ্ঠে হেসে উঠল,”ভেতর দিয়ে যাবে।পথ কমে হবে।তাড়াতাড়ি যেতে পারব।” আমি ভয় পেলাম।লোকটার চেহারা যেমন ভয়ংকর, গলাটাও তেমনি মারাত্মক।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে।তাও আমি জানি,বিপদে নার্ভাস হতে নেই।স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম, “ও আচ্ছা।”
এরপর থেকে আমার একটাই ভাবনা।কী করে বের হওয়া যায় এই বিপদ থেকে।মনটা ছটফট করল বেশ কিছুক্ষণ।মাথায় তৎক্ষণাৎ একটা বুদ্ধি এঁটে ফেললাম।জানিনা কাজ দেবে কিনা।শুরু করলাম বুদ্ধি মোতাবেক কাজ।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে চারপাশে দেখলাম কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা।নাহ্,সবাই নিজ নিজ মতো।আস্তে আস্তে ফোনের সেটিংস অপশনে গিয়ে রিংটোনটা বাজালাম।এরপর টিউনটা বন্ধ করে এমন একটা ভান করে ফোনটা কানে নিলাম যেন কেউ আমাকে কল করেছে।ফোন কানে নিয়ে জোরে জোরে বললাম, “হ্যাঁ মতিউর,বলো।ও আম্মার ওষুধ লাগবে?এখনই লাগবে?দোকান খোলা পাব?কী?অবশ্যই লাগবে।আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।দেখছি কী করা যায়।”
এরপর ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কন্ডাক্টরকে চটুল গলায় বললাম, “এই কন্ডাক্টর,বাস থামাও।আমার আম্মার ওষুধ নিতে হবে এখনি।থামাও থামাও।” সবাই একযোগে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো।ক্যাপ পরা লোকটা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,”এত রাতে ওষুধ পাবেন কোথায়?এখানে কোন দোকান নেই।” আমার হৃদস্পন্দন থম দিয়ে উঠল।”না না আমাকে নামতেই হবে,ওষুধটা লাগবেই।” “আরে না না,এত রাইতে এই জায়গায় ওষুধ পাইবেন না।সামনে থেইকা লইয়েন,” কন্ডাক্টর জবাব দিল আমার কথার।আমি আর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম না।যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।একমাত্র চেষ্টাটাও বিফলে।ধরেই নিয়েছি এটা আমার জীবনের শেষ রাত। 01কিছুক্ষণ পর লুুঙ্গি পরা লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসল, “আপনার ফোনটা একটু দিবেন?একটা ফোন করুম।
আমার ফোনে টাকা নাই।” আমার সাথে নাটকীয়তা শুরু হয়ে গিয়েছে, বুঝতে পারলাম আমি।কেননা,নইলে লোকটা সামনের সবাইকে বাদ দিয়ে আমার কাছে এসে ফোন চাইলো কেন? কিছু না বলেই ফোনটা দিয়ে দিলাম।লোকটা কাকে যেন কল দিল।শুনলাম সে বলছে,”হুম কাজ শেষ হয়েছে,আসছি।” শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে উঠলাম।সব যেন আরো স্পষ্ট হয়ে গেল।এরপর সে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।আমি কল লগ চেক করে দেখলাম কিছুক্ষণ পর।কললগে অচেনা কোন নাম্বার নেই।তাহলে কি লোকটা কাউকে কল দেয়নি?যাচাই করেছিল কেউ আমাকে ওষুধের জন্য কল দিয়েছিল কিনা?নাকি সে তার কথা শেষ করে তার নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়েছে লগ থেকে?ভয়ে কাঁপছি আমি।বুঝতে পারলাম আমি এখন নিঃস্ব।কিছুই করার নেই। “যা আছে সব নিয়ে যান,প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না,”এইসব বলব?দোহায় দেব আমার দুই বছরের বাচ্চার?আমার বৃদ্ধা মায়ের অজুহাত দেখিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইব ওদের কাছে?ওরা মায়ের বেদনা বুঝবে কি?ছাড়বে আমাকে?আমার পরিবারের কথা বলব তাদের? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি।তখন আমার করুণ অবস্থা।যেন হ্যার্ট অ্যাটাকেই মারা যাবো।
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি মানসিক অস্বস্তিতে।নিভু নিভু চোখে করে ভাবছি মুনতাসিনের কথা,”মুনতাসিন,বাবা,ভালো থেকো।তোমার আম্মুর যত্ন নিও।দাদুকে দেখে রেখো।বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ো।আর হ্যা,আর যাই করো,মধ্যরাতের চাকুরি করোনা কখনো।” ভাবলাম মিলির কথা,”মিলি,শুধু এই চাকরিটা নয়,সকল চাকরি ছেড়েই আজ তোমার থেকে বিদায় নিচ্ছি।তুমি ভাল থেকো।নিজের যত্ন নিও।মুনতাসিনকে দেখে রেখো।আম্মার সেবা করো।”চোখে পানি চলে এসেছে।মিলিকে খুব ভালবাসি আমি।তাকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে যেতে ইচ্ছে করছেনা আমার।ভাবতে ভাবতে আমার ক্লান্ত চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।
হঠাৎ একটা ডাক শুনে চোখ মেললাম।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি তখন ভোর পোনে চারটা। “এই ভাই, উঠেন উঠেন,হাউস বিল্ডিং আইসা পড়ছে।নামেন নামেন।” তাকিয়ে দেখলাম বাইরে।তাই তো!হাউস বিল্ডিং ই!বিস্মিত আমি!হতবাক আমি!আনন্দে যেন আমি কেঁদে ফেলছিলাম।যেন ফিরে পেলাম নতুন জীবন।বুকের ধুকপুকানি কমেনি তখনো।তাড়াতাড়ি দৌড়ে নেমে পড়লাম বাস থেকে।নেমেই হাঁটা শুরু করলাম প্রচণ্ড জোর পায়ে।মনে মনে তখন খুব হাসছি।যেন নতুন কিছুকে জয় করেছি আমি।পেছন থেকে আচমকা শুনতে পেলাম কন্ডাক্টরের চিৎকার ধ্বনি,” এ ভাই,একশ ট্যাকা দিছিলেন না বাকি ট্যাকাটা লইয়া যান।”
গল্পের বিষয়:
গল্প