দোকানের সাইনবোর্ডে আমার মায়ের নাম সুচিত্রা ব্যানার্জি দেখে পুলিশ অফিসার একটু আড় চোখে তাকালো। বাবার নামটাও সুব্রত ব্যানার্জি। কিন্তু আমার নামের শেষে ইসলাম উপাধি। শফিকুল ইসলাম। হোটেলটা চৌরাস্তার মোরে হওয়ায় দিনভর কাস্টমারের ভীড় লেগে থাকে। অনেকের সাইনবোর্ড দেখার সময় হয়না। অনেকেই সাইনবোর্ড দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, কিছুক্ষণ আনমনে কি যেন ভাবে, তারপর আমাকে নানান কিছু জিজ্ঞাসা করে। অনেক সময় উত্তর দেই, বাকিটা সময় ব্যস্ততার ভানে চুপচাপ এড়িয়ে যাই। আমার দোকানের নাম ‘মা বাবার দোয়া ভাতের হোটেল’। নিচেই লিখে দিয়েছি মা: সুচিত্রা ব্যানার্জি, বাবা: সুব্রত ব্যানার্জি, প্রোপাইটার: শফিকুল ইসলাম।
অনেক হুজুর আমার দোকানে খেতে আসে। দূর থেকে আসে। তাদের ভাষ্যমতে আমার উপর আল্লাহর অশেষ রহমত হয়েছে বিধায় আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি। খাবার শেষে ওয়েটারদের কয়েকটা টাকা বেশী টিপসও দিয়ে যায়। অনেকেই বলে যায়- তোমার বাবা মাকেও দাওয়াত দাও। রহমতের হেফাজতে তাদেরকেও নিয়ে আসো। আল্লাহ চাইলে সবিই সম্ভব। আমার জন্য অনেক দোয়া করে যায়, আমার ব্যবসায় বরকত প্রার্থনা করে। অনেক হিন্দু এসে আবার নাক ছিটকায়। জাত ধর্ম ভুলে গিয়ে সম্প্রদায়কে বেহজ্জতি করেছি, আমার জায়গা নরকেও হবে বলেনা ভৎসনা করে যায়। আমার অবশ্য এসবে কিছুই আসে যায়না। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত।
পুলিশ অফিসার ইলিশ শ্যুটকির ভর্তা মুখে নিতে নিতে বললো- শফিক মিয়া তোমার হোটেলের ভর্তাটা ফার্স্টক্লাস। বিভিন্ন টেলিভিশনে রান্নাবান্নার প্রতিযোগিতা হয়। তুমি যাবা, এই ভর্তাটা বানাবা, প্রথম রাউন্ডেই তোমারে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিবে। আমি মুচকি হেসে বললাম স্যার এই রেসিপিটা আমার মায়ের কাছ থেকে শিখা। ছোট বেলায় আমি আর দিদি ভাত খাওয়ার প্রতিযোগিতা করতাম যখন মা ভর্তাটা বানাতো। কে কতো বেশী ভাত খাইতে পারে!
অফিসার আমার দিকে মুখ তুলে বললো- মুসলমান হইছো কবে? তার নেমপ্লেটে তাকিয়ে দেখলাম নাম ‘অশিতুষ দাস’! আমি তেমন কিছু বললাম না। আজ দিদি আসবে, আমাকে জ্বলদি বাড়ি যেতে হবে বলে ম্যানেজারকে চাবি দিয়ে চলে আসলাম।
দিদি আমার চেয়ে চার বছরের বড়। ৯৮ সালের বন্যাতে আম্মা টাইফয়েডে যখন মারা যায় তখন আমার বয়স ১ বছর। বাবার পরিচয় কখনো জানতে পারিনি। আম্মা কাজ করতো সুব্রত ব্যানার্জির বাড়িতে। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে কি করবে ভাবতে ভাবতেই সুচিত্রা ব্যানার্জি তার স্বামীকে বলেছিলো- আমাদের পরবর্তী সন্তানটা না তুমি ছেলে চেয়েছিলে? তাকে আমরা ছেলে হিসেবে রেখে দেই? সুব্রত ব্যানার্জি সম্মতি দিয়েছিলো, আমি পরিবার পেয়েছি। মা পেয়েছি, বাবা পেয়েছি, দিদি পেয়েছি। আমি যখন বুঝতে শিখেছি মা বলতো দিদি আমার গায়ে কখনো এক কনা বালির স্পর্শও লাগতে দেয়নি। যখন খুব কান্না করতাম, অসুখ হতো, দিদি তখন পাগল প্রায় হয়ে যেতো। দিদির কোল ছাড়াও নাকি আমি খুব কান্না করতাম। গায়ে ১০০ এর উপরে জ্বর থাকলে দিদির কোলে থাকলে আমি হিমাগারে থাকতাম। শত অসুখ বিসুখেও আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হতোনা।
দিদি যখন কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে তখন থেকে আমিও সবকিছু বুঝতে শুরু করি। ভালো মন্দ, ধর্ম- অধর্ম, কিসে প্রেম হয় কিংবা কখন কাকে দেখলে ভালো লেগেছে অনুভূতি ভিতরে কাজ করে এসব কিছু। আমার আম্মা যখন মারা যায় তখন নাকি সুচিত্রা ব্যানার্জিকে বলেছিলো ছেলেকে কুর-আনের হাফেজ বানাবে। বড় হুজুর বানাবে। পড়াশোনায় আমি ততো মনোযোগী ছিলাম না। দূরের এক মাদ্রাসায় মা হুজুর ঠিক করেছে আমাকে পড়ানোর জন্য। আমি দুইদিন যেতাম, তিন দিন যেতাম না। শেষমেশ মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো। ১৫ দিনের বেশী টিকতে পারলাম না। সত্যি বলতে দিদিকে ছাড়া আমার একটা দিন কাটানো অকল্পনীয় ছিলো, অসহ্য যন্ত্রনার ছিলো। আমি যন্ত্রনায় ছটফট করতাম, কান্না করতাম। শেষে বাড়িতে চলে আসলাম।
হিন্দু মহল্লা ছিলো বলে ইসলামিক কোন ব্যাপারে প্রচন্ড কান কথা হতো। বাসায় এক হুজুর রেখেছিলো আমার জন্য, কিন্তু পন্ডিতদের কড়া কথার জন্য সেটাও টিকেনি। শেষে দিদির এক মুসলিম বান্ধবীর বাসায় সেই হুজুরকে রাখা হলো- দিদি আমাকে নিয়ে যেতো আবার নিয়ে আসতো। আমি ইসলামিক শিক্ষা পেলাম। পাঁচ কালেমা শিখলাম, মুসলিম হিসেবে বড় হলাম! কথায় কথায় শুনেছি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিলে হিন্দু হয়, মুসলিমের ঘরে জন্ম নিলে মুসলিম হয়। যখন ১ বছর বয়সে আমি দুধের বাচ্চা ছিলাম, দ্বীন দুনিয়া কিছুই বুঝতাম না, তখন আশ্চর্যজনক ভাবে একটা হিন্দু পরিবারেও আমি মুসলিম হিসেবে বড় হলাম। তখন থেকে বুঝতে শিখেছি, আমি কোন ধর্মাবলম্বীর ঘরে জন্ম নেইনি বা বড় হইনি। বড় হয়েছি কয়েকজন প্রকৃত মানুষের ঘরে। যাদের মন কাচের মতো মসৃন, যেখানে প্রতিবিম্ব হয় উত্তম চরিত্রের। যাদের মন সমুদ্রের গভীরতার মতো অতল, যেখানে জায়গা হয় প্রানের। ধারন করে রাখে গভীর মায়ায় শত বৈচিত্রের মাঝেও!
ঘরে ছবি থাকলে নামায হয়না এজন্য আমার ঘরে কখনো কোন ছবি ছিলো না। মা রাখতে দেয়না। যেহেতু আশেপাশে কোথাও মসজিদ নেই তাই বেশীরভাগ সময় নামায ঘরেই পড়তাম। ফজরের নামাযের সময় মা ডেকে দেয়। দিদি ঘুম থেকে উঠার পর উলু দিয়ে শঙ্খ বাজাতো। তখন প্রায়ই আমি নামাযে থাকতাম বা কুর-আন পড়তাম। মা দিদিকে নিষেধ করেছিলো আমার কাজ শেষ হওয়ার পর যেন দিদি পূজোয় বসে। মাও বসতো। পাশের বাসা থেকেও শঙখের শব্দ আসতো। মা ওখানেও বলে আসতো। বলতো আমার ছেলেটা নামায পড়ে, একটু পরে শঙ্খটা বাজালে হয়না দিদি? এমনকি সন্ধ্যাতেও! দিদি কানামাছি কিংবা গোল্লাছুট খেলার মাঝখানে আমাকে উলু দেওয়া শিখাতো। মা একদিন দৌড়ে এসে দিদির কানমলা দিয়ে বললো- তোরে কতদিন কইছি ছেলেটারে উলু দেওয়া শিখাবিনা। এই রিতী ইসলামে নাই। দিদি আমাকে নিয়ে দূরে চলে যেত। শঙ্খ বাজানো শিখাতো। দিদি বলতো- তুই যাই করিস বিশ্বাস ব্যাপারটাই আসল। তুই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই যে পূজো দিয়ে ফেলবি তা না। ব্যাপারটা হচ্ছে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে তুই কি ভাবছিস সেটা।
ধর তোকে কেউ কিডন্যাপ করলো। এমন একটা ঘরে রাখলো যেখানে চতুর্দিকেই মূর্তি। তোর নামাযের সময় হলো। মূর্তি সরানোর উপায় নেই কিন্তু নামায পড়তে হবে। পশ্চিম কোন দিক তুই সেটাও জানিস না। দিক না জানা থাকলেও নামাযের সময় হলে একদিকে আল্লাহর নাম স্মরন করে হলেও নামাযে দাঁড়াতে হবে। এটা আছেনা হাদিসে? চোখটা বন্ধ করে নিয়ত করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলি। সিজদা দিচ্ছিস, রুকু দিচ্ছিস। আপাতত দৃষ্টিতে চিন্তা কর অন্যকেউ দেখলে কিন্তু ভাববে তুই মূর্তিকে সিজদা দিচ্ছিস। কিন্তু আসলেই কি তোর সিজদার সাথে মূর্তির কোন সম্পর্ক আছে? তোর ধ্যান আর বিশ্বাস আল্লাহর কাছে। তোর সিজদা পাবে আল্লাহ, তোর দিক হবে ক্বিবলা। এটাই বিশ্বাস। তুই শঙ্খ বাজালেই হিন্দু হয়ে যাবিনা। উলু দিলেও না। এই ব্যাপারটা হচ্ছে তুই কোন বিশ্বাস নিয়ে এগুলো করছিস সেটা। শোন শঙ্খ বাজানোর কিছু বৈঙানিক উপকারিতা। এসব আমি গুগল করে জেনেছি। তুই বাজাবি উপকারিতার জন্য, আর আমি বিশ্বাসে!
শোন শঙ্খ বাজানোর বৈঙানিক উপকারিতা কি- শঙ্খ বাজানোর সময় জোরে ফু দেওয়ার কারণে মুখের পেশির যেমন সংকোচন-প্রসারণ ঘটে, তেমনি পা পর্যন্ত শরীরে প্রতিটি পেশিতে সচলতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে সারা দেহে রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটে। ফলে প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে গিয়ে সার্বিকভাবে শরীরের কর্মক্ষমতার উন্নতি ঘটে। আরো অনেক আছে। আমি পূজোর সময় বাজাবো তিনবার। আমার পরে তুই বাজাবি অনেক বার। আমাদের তিববারের বেশী নিয়ম নাই। কিন্তু তোর জন্য তো কোন নিয়ম নেই। ঠিকাছে? আমি দিদির সাথে উলু দিতাম, শঙ্খ বাজাতাম। মাঝেমাঝে দিদিকে যখন দেখতাম প্রতিমার সামনে হাত উঠিয়ে এক ধ্যানে বসে আছে তখন দ্বিধায় পড়ে যেতাম। প্রতিমার চেয়ে আমার দিদিকে বেশী ভালো লাগতো। মনে হতো প্রতিমার জায়গায় আমার দিদিকে মানাবে বেশী। মনে হতো প্রতিমাটা আমার দিদি না হয়ে এই মূর্তি কেনো! দিদিকে বললাম দিদি তোমাকে যে ছেলেটা বিয়ে করবে তার জন্য আমার খুব হিংসে হয়। কেনো রে?
প্রতিমার মতো দেখতে যার চেহারা আমার সে দিদিকে কোন দিকের না কোন দিকের একটা ছেলে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তা মানা যাবে বলো? আর আমি নিশ্চিত জিজু তোমাকে পেয়ে মন্দিরে যাওয়া ভুলে যাবে। তোমার প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে নতুন কোন দেবীর সন্ধান দিবে দুনিয়াকে! নাম হবে প্রিয়াংকা দেবী! ও হ্যা আমার দিদির নাম প্রিয়াংকা ব্যানার্জি। খুব পেকেছিস তাইনা? বলেই দিদি আমার কান চাপা দিয়েছিলো সেদিন। তার ৪ মাস পর দিদি স্কলারশিপ পেয়ে ব্রিটেনে চলে যায়। ইন্টার শেষ হওয়ার পরেই। ওখানে মাস্টার্স কমপ্লিট করে দেশে আসছে আজ। আমার জীবনে ঈদ তিনটা। তিন নাম্বার যে ঈদটা সেটা হচ্ছে দিদি যখন দেশে আসে সে দিনটা! আজ আমার ঈদের দিন!
মা বাবা দিদি সবাই দেশে এসেছে। দিদি বিদেশ যাওয়ার ২ বছর পরেই মা বাবাও চলে যায়। আমার দেশে থেকে ব্যবসা করার ইচ্ছা ছিলো বেশী। তাই যাওয়া হয়নি। আমি থেকে গিয়েছি মা বাবার ভিটায়! ও হ্যা তাদের দেশে আসার কারন হচ্ছে দিদির বিয়ে। ওখানে বাংলাদেশি এক ছেলের সাথে দিদির সম্পর্ক হয়েছে। চাইলে ওখানেই বিয়ে হতে পারতো। ছেলের পরিবারও ওখানেই থাকে। কিন্তু দেশে আসছে আমার জন্য! দিদি বলেছে আমার ভাইকে ছাড়া বিয়ের পিড়িতে বসবোনা। মাও বলেছে আমার একমাত্র ছেলেকে ছাড়া মেয়ে বিয়ে দিবো না কোন ভাবেই! আমার আকাশে বাতাসে রাজ্যের ব্যস্ততা। দিদির বিয়ে নিয়ে এটা সেটা। গত কয়েক রাত ঘুমাতেই পারছিনা ঠিকমতো। বিয়ে বাড়িতে রাজ্যের মেহমান। এরমধ্যে দেখলাম পুলিশ অফিসার অশিতুষ দাসও এসেছে। দাওয়াতি মানুষ। আমাকে দেখেই কাছে এসে বললো কি শফিক মিয়া! বিয়ার রান্নার দায়িত্ব পেয়েছো? তোমার রান্নার হাত ভালো। খেয়ে মজা পাবো।
আমি আলতো হেসে বললাম রান্নার দায়িত্ব না, পুরো বিয়ের দায়িত্বটাই আমার ছিলো। বিয়েটা আমার আপন দিদির!
অফিসার হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অফিসারের মতো অনেকেই আড় চোখে তাকাচ্ছে। কারন পুরো বিয়ে বাড়িতে একমাত্র আমার গায়েই পাঞ্জাবী, পায়জামা, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি! যেন ছানা মিষ্টিতে আমি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত মাছি। অফিসার কানের কাছে এসে বললো- তোমার দিদির এত সুনাম, তার বিয়েতে এত নামিদামি মানুষ আসছে। তুমি একজন ধর্মান্তরিত ছেলে। মানুষ খারাপ চোখে দেখছে তো! জানো তো আমাদের ধর্মে জাতের দিকটা কতো কঠোর ভাবে দেখা হয়? আমি বললাম যে মানুষরা একথা বলছে বা বলবে তারা তো মানুষই না। মানুষ কখনো একথা বলেনা। মানুষ বলবে একসাথে মিলেমিশে বেঁচে থাকার কথা। ধর্ম-জাত টেনে মানুষকে আলাদা করে ফেলা মানুষেরাই অমানুষ, সবচেয়ে বড় অধার্মিক। এ কথাটা আমাকে কি শিখেয়েছে জানেন? অশিতুষ দাস চোখ তোলে তকিয়ে বললো, কে?
আমার দিদি শিখিয়েছে। ধর্ম আর সম্পর্ক এই দুইটা ব্যাপারই বিশ্বাসের জায়গা। আপনার ধর্ম সেটা যেটা আপনি বিশ্বাস করেন। আপনার সম্পর্ক সেটাই হবে যে সম্পর্কটাতে আপনি বিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। বরং বিশ্বাসে উগ্রতা আনলে আপনি উগ্র, বিশ্বাসে বিচ্ছেদ আনলে সম্পর্কের টানাপোড়ন। আপনার ধর্ম যেমন একটা ইবাদাত, মানুষে মানুষে মিলেমিশে, বিভেদ ভুলে চলতে পারাটাও একটা ইবাদাত। এগুলোও আমার দিদি শিখেয়েছে। আর শোনেন, আমি ধর্মান্তরিত নই। আমার বয়স যখন ১ বছর তখন থেকেই এই পরিবারে মুসলিম হিসেবে বড় হয়েছি। আমার জন্ম মুসলিম পরিবারেই! কথা শুনে মনে হচ্ছে অফিসার দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। কঠোর ভাবে মিথ্যা বিশ্বাস করা মানুষেরা হুট করে সত্য শুনলে দ্বিধায় পড়ে যায়। কোনটাকে সত্য ভাববে? যেটা শুনেছে নাকি যেটা সে মেনে আসছে? ওরকম দ্বিধা অফিসারের চোখে দেখতে পাচ্ছি।
অফিসারকে দ্বিধায় রেখে আমি আমার কাজে মনোযোগ দিলাম। রাতভর কীর্তন হচ্ছে। ঢোল পিটানো হচ্ছে, বাধ্য বাজছে। আমার খুব শখ ছিলো দিদির বিয়ে পালকিতে করে দিবো। পালকিতে করে আমার দিদি শ্বশুড়বাড়ি যাবে। খুব কষ্টে একটা পালকিও ম্যানেজ করেছি। এদিক সেদিক দেখছি, কার কি লাগছে খোঁজ নিচ্ছি। বিয়ের লগ্ন প্রায় কাছাকাছি। দিদির সিথিতী সিঁদুর দেওয়া হবে। হঠাৎ মা থামিয়ে দিলো। দূরে কোথাও আজান হচ্ছে। মা বললো আমার ছেলের নামাযের সময় হয়েছে। ছেলে নামায পড়ে আসুক, তারপর সিথীতে সিঁদুর দেওয়া হবে। উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব করে দিলো আমার মা। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে নামাযে চলে গেলাম। নামায শেষে দিদির বিয়ে সম্পন্ন হলো।
দিদি চলে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে অনবরত। এই প্রথম কোন প্রকার কষ্ট ছাড়া কান্না করছি। কষ্টবিহীন কান্না সুখের প্রতিচ্ছবি নাকি হয়। কিন্তু আমার দুঃখও আছে। দিদি চলে যাবার দুঃখ। কোন এক অদ্ভুত কারনে আমাকে সুখ কিংবা দুঃখ কোনটাই ছুঁয়ে যাচ্ছেনা। গাল বেয়ে শুধু পানি ঝরছে। পিছনে মা আমাকে ধরে কান্না করছে। একেবারে হাউমাউ করে কান্না। দূর থেকে দেখি বাবা মুখে রুমাল রেখে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। সেই ব্যর্থ চেষ্টা আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, ছোট্ট করে ধাক্কা দিয়ে আমার নিরব কান্নাকে হাউমাউ কান্নায় নিয়ে এসেছে।
এতগুলো মানুষ দেখছে সম্পর্কের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই। সম্পর্কের ধর্ম বরং বিশ্বাস। আমি এই মানুষটাকে ঠিক কিভাবে চাই সেই বিশ্বাস। দাড়িওয়ালা একটা ছেলেকে শাঁখাসিঁদুর পড়া এক দিদির জড়িয়ে ধরে কান্না করার বিশ্বাস!
দিদি হুট করে আমায় কান মলা দিলো। কান্না করতেছিস কেন গাধা? আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি? শোন তোর জন্য একটা মেয়ে দেখবো জ্বলদি। প্রতিমার মতো দেখতে হবে। আমার পাশে দাঁড়ালে তুই দ্বিধায় পড়ে যাবি কে বেশী সুন্দর তোর দিদি নাকি তোর বউ! পরে মনে হবে তোর বউ সুন্দর। সেই সুন্দর বউটাকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে এনে আমার বাড়ির প্রতিমা করে রাখবো ঠিকাছে?
আমি কান্নামাখা কন্ঠে বললাম দিদি তুইও খুব পেঁকে গেছিস! দিদি পালকিতে উঠছে। চারিদিক উলুধ্বনিতে প্রমকম্পিত হয়ে যাচ্ছে। সেসব কেনো জানি আমাকে স্পর্শ করেনা। হুট করেই আমার মন নিজ থেকে বলতে থাকলো- হে আল্লাহ আমার দিদিকে ভালো রেখো। অনেক ভালো রেখো। দিদি আমাকে এটাই শিখিয়েছিলো একদিন- তুই কখনো আমার জন্য দোয়া করতে চাইলে আল্লাহর কাছে দোয়া করবি। তুই যেই আল্লাহকে বিশ্বাস করে বড় হয়েছিস সেই আল্লাহর কাছে। আর আমার ভগবানের প্রার্থনাতেও তুই থাকবি!
গল্পের বিষয়:
গল্প