মহিতোষ ছবিটা ইউনুসকে ফেরত দিয়ে বলে, তোমার এই ছবি নিয়ে আমি খুব বিপদে পড়েছি।
ইউনুস মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কী আবার বিপদ হলো?
– আর বলো না, আমার বউ জামা-কাপড় কাচতে দিতে গিয়ে আমার জামার পকেট হাতড়ে এই ছবিটা পায়, একটি মেয়ের ছবি। সেই থেকে তার মুখ ভার। আমি যত বলি ছবিটা আমার নয়, আমার এক বন্ধুর; ওপার বাংলা থেকে এসেছে। বউ বলে, তা হ’লে ছবিটা তোমার পকেটে কেন? যত বলি, ছবিটা ভুল করে আমার পকেটে ঢুকে গেছে। সে কিছুতে বিশ্বাস করে না।
কাল আড্ডা দেওয়ার সময় ইউনুস ছবিটা মহিতোষকে দেখিয়েছিল। শহিদুল বলল, এই মেয়েটি ইউনুসের প্রেমিকা। দেশে গোলমাল না বাধলে এতদিনে ওদের বিয়েও হয়ে যেত। ইউনুস বলল, দেশে ফিরে গিয়ে সে এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে। ইউনুস আর শহিদুল ওপার বাংলার এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। ওদেশে তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ঢুকে পড়ে ওদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, ওরা তখন প্রাণভয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ছেড়ে পালায়। বর্ডার পেরিয়ে এপারে চলে আসে। এখানে এক ইউনিভার্সিটির অতিথিশালায় আশ্রয় পায়।
মহিতোষ ওদের কাছে ওপার বাংলার অনেক খবরই শুনতে পায়। রবীন্দ্রনাথ ওদেরও খুব প্রিয় কবি, পাকিস্তান বেতার কেন্দ্রে
রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ। কারুর বাড়ির দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝুলতে দেখলে বাড়ির মালিককে ভারতের চর বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবু ওদেশে রবীন্দ্র-চর্চা বন্ধ করা যায়নি।
মহিতোষ প্রথম যেদিন ওপার বাংলার রেডিওতে এই গানটা শুনতে পায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ও কেমন বিহবল হয়ে পড়ে। সে একি শুনছে! সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ যেন বহুদিন বিচ্ছেদের পর দুই বাংলার মানুষকে এক হওয়ার ডাক দিচ্ছে। শহিদুলও কলকাতায় এসে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটির নাম পারভিন, ওরা এখানে যে ইউনিভার্সিটির অতিথিশালায় আশ্রয় পেয়েছে পারভিন সেই ইউনিভার্সিটিতে এমএ করছে। পারভিনের বাবা-মা থাকে মফস্সলে। তাই পারভিন থাকে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। মেয়েদের হোস্টেলটা ইউনিভার্সিটির অতিথিশালার পাশেই।
ওপার বাংলা থেকে মিলিটারির হাত থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসা মানুষজন এখানে বীরের সম্মান পাচ্ছে। হোস্টেলের মেয়েরা দলবেঁধে ওদের দেখতে আসে। সেই দলে পারভিনও থাকে।
একদিন পারভিন একাই আসে ওর এক প্রিয় বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে। শহিদুল ওদের সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলছিল দেখে
পারভিন আপত্তি করে বলল, আমরা তো এখনো ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আর আপনি শিক্ষক। আমাদের তুমি বলবেন।
শহিদুল পারভিনের চোখের ভাষা ঠিক-ই পড়েছিল। পারভিন প্রায়ই আসে শহিদুলের ঘরে। কখন যে ওরা পরস্পরকে তুমি বলতে শুরু করেছে, খেয়াল করেনি।
পারভিনের সঙ্গে একদিন দেখা না হলে শহিদুলের মন খারাপ হয়ে যায়, যাওয়ার সময় হলে শহিদুল কাতর-চোখে জিজ্ঞাসা করে, কাল আসছ তো?
শহিদুল পারভিনকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু এই অবস্থায় সে কী করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়? দেশ স্বাধীন হলে ও দেশ থেকে ফিরে এসে পারভিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু দেশ কবে স্বাধীন হবে, আদৌ স্বাধীন হবে কিনা ওরা বুঝতে পারছে না। ওরা ভেবেছিল ভারত পাকিস্তানি জলস্নাদদের হাত থেকে ওদের রক্ষা করবে। বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, ভারত এখনো কিছু করছে না। তবে কি ওরা এদেশে পালিয়ে এসে ভুল করল? এখন তো দেশেও ফিরতে পারবে না।
ডিসেম্বর মাস। শীত পড়ে গেছে। উত্তরের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ওরা এদেশে পালিয়ে আসার সময় শীতের জামা-কাপড় কিছুই আনতে পারেনি। ওরা ভাবেইনি এতদিন ওদের এদেশে থাকতে হবে।
৩ ডিসেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা আসছেন। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা করবেন।
ওরা সবাই মিলে দলবেঁধে গেল ব্রিগেডে ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনতে। ওরা আশা করছিল, হয়তো ব্রিগেড থেকে উনি কিছু বিশেষ ঘোষণা করবেন। মাঠে লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই। শীতের রোদ পড়ে এসেছে; রোদ এখন গাছের মাথায়।
ওরা একদম পেছনের সারিতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছে, উনি অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন কিন্তু ওরা যা শুনতে এসেছিল সেসব কিছুই বলছেন না। ভিড়ের ভিতর একটা গুঞ্জন উঠছে, হয়তো ওদের মতো আরো অনেকে হতাশ হচ্ছে। বক্তৃতা শেষ করার সময় শুধু উনি বললেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি সীমান্তে গিয়েছিলেন
শরণার্থী-শিবির পরিদর্শন করতে। সেখানে তিনি আশ্বাস দিয়ে এসেছেন শরণার্থীদের শিগগির ঘরে ফেরাবার ব্যবস্থা করবেন।
এই কথাতে শহিদুলরা যে খুব আশ্বস্ত হলো তা নয়, বরং হতাশই হলো।
মহিতোষ বাড়ি ফিরে খবর শোনার জন্য রেডিওটা খুলল। খবর শুনে সে বেশ বিস্মিত হলো। পাকিস্তান অমৃতসর, জয়পুরে বোমা ফেলেছে। তাতে বেশকিছু লোক হতাহত হয়েছে, খবরের শেষে শুনল, পরবর্তী ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করুন।
মহিতোষ শুয়ে-শুয়ে খবর শুনছিল। পরবর্তী ঘোষণা শোনার জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল। ঠিক রাত বারোটায় পরবর্তী ঘোষণা শোনা গেল। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মহিতোষ জানে, শহিদুল-ইউনুসরা এই খবরটা পেয়ে কতটা খুশি হবে। এতদিন তো ওরা এটাই চাইছিল। রোজ সন্ধ্যায় শহিদুল আর ইউনুসের সঙ্গে মহিতোষের দেখা হয়। তখন শহরে
বস্ন্যাক-আউট চলছে। বস্ন্যাক-আউটের অন্ধকারে ওরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে, ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখছে।
ভারতীয় সৈন্য ও ওপার বাংলার মুক্তি ফৌজ দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলেছে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন ঘটছে।
আমেরিকা আগে থেকেই হুমকি দিয়ে রেখেছিল, ভারত যদি পাকিস্তানকে আক্রমণ করে, আমেরিকা পাকিস্তানকে সাহায্য করতে ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাবে। এখন পর্যন্ত সেই সপ্তম নৌবহরের দেখা মেলেনি। ঢাকা শহর এখন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ।
যে-কোনো মুহূর্তে ঢাকা শহরের পতন ঘটতে পারে।
সেদিন ওরা এক চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। দোকানের বাইরে বস্ন্যাক-আউটের অন্ধকার। দোকানের ভেতরে
টেবিলে-টেবিলে মোমবাতির ক্ষীণ শিখা।
হঠাৎ শহরটা আলোয় ঝলমল করে উঠল। ওরা খুব অবাক। কী হলো? বস্ন্যাক-আউট উঠে গেল নাকি?
ওরা দৌড়ে দোকানের বাইরে চলে আসে। বাইরে এসে শোনে রেডিওতে এইমাত্র খবর এসেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে, ওপার বাংলা এখন হানাদার-মুক্ত। স্বাধীন।
ওরা পরস্পরকে আবেগে জড়িয়ে ধরে। আনন্দে ওদের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ওরা আর দেরি করে না। যে যার ঘরে ফিরে যায়। কাল সকালেই ওরা ওদের স্বাধীন দেশের উদ্দেশে রওয়া দেবে।
ফিরে যাওয়ার পথে শহিদুল আর ইউনুস মহিতোষের সঙ্গে দেখা করে যায়। মহিতোষ ওদের বাসস্ট্যান্ড অবধি এগিয়ে দেয়।
শহিদুল বলে, দেশে ফিরে যাচ্ছি, খুব আনন্দ হচ্ছে। দেশে সবার সঙ্গে দেখা হবে। আবার এই শহরটাকে ছেড়ে যেতে কষ্টও হচ্ছে। এই নয় মাসে শহরটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এখানে। শহিদুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, শিগগির আবার ফিরে আসছি। তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে। পারভিনকে বিয়ের প্রস্তাব। জানি না, ওর বাবা-মা রাজি হবে কিনা?
– কেন রাজি হবে না? পাত্র হিসেবে তুমি বেশ সুপাত্র। তাছাড়া তোমরা একই ধর্মের মানুষ।
– পারভিনের বাবা-মা মেয়েকে এত গোলমালের মধ্যে ওদেশে পাঠাতে রাজি নয়।
– এ-কথা তোমায় কে বলল?
– পারভিনই বলেছে, পারভিন এও বলেছে, ওর বাবা-মা এই বিয়েতে রাজি না হলে ও আমাকে বিয়ে করবে না। শহিদুলের চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। মহিতোষ ওকে কী বলে যে সান্তবনা দেবে, ভেবে পায় না।
মহিতোষ ইউনুসকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কবে বিয়ে করছ? বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দেবে তো? ইউনুস বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয় বিয়ের দিন ঠিক হলে তোমাকে চিঠি দিয়ে জানাব। তোমার আসা চাই।
তারপর ইউনুস বলে, বিয়ের কথা এখনই আমি ভাবছি না। দেশে ফিরে গিয়ে আমার সামনে এখন অনেক কাজ।
– কী কাজ?
– কোলাবরেটরদের সঙ্গে মোকাবিলা করা।
– কারা কোলাবরেটর?
– যারা ওদেশে থেকে গেল খানসেনাদের পা চাটতে।
– যারা ওদেশে থেকে গেল তারা কি সবাই কোলাবরেটর?
– সবাই নয়। তবে, কেউ-কেউ তো আছে।
বাসটা ছেড়ে দিলে ইউনুসের কথাগুলো আমার কানে বাজতে থাকে, দেশটা কি আরেকটা গৃহযুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছে?