ভরযুবতী সে হয়ে উঠত ঝমঝমা বাদলার কালে। আর তার শিকড়-বাকড়ের ডানা-পাখনা জলমগ্ন করে দিয়ে খলবলিয়ে বয়ে-যাওয়া যে খাল – সে-ও তখন ভর-ভরন্ত। সোমত্ত যৌবনা। তুখোড় স্রোতস্বিনী। চিত্রাহরিণের যুগল আঁখির মতো গভীর ছিল ওই খালের জল। যেন-বা অমনই দয়ার্দ্র। আর কান্না-মাখামাখা। কিছুদিন বাদেই কিনা ক্রমাগত অদলবদলের ধন্দে ঘুরপাক খেত বেগবান জলরাশি। নয়নাভিরাম দৃশ্যপটে যুক্ত হতো আরো নানা দৃশ্য, দৃশ্যাবলি। ছায়াচ্ছন্ন মেঘশামিয়ানার তলায় ওই ভরযুবতী হিজলের পত্র-শাখে যে গাঢ়-সবুজ রঙের প্রলেপ অথবা
মৃগচক্ষু-জলের ঘূর্ণি নিয়ে প্রবহমান অনন্ত জলধারা – যতটা সহজ করে মায়া অদ্য ভাবতে পারছে – ওইসব দিনে মায়ার পক্ষে ওইভাবে খেয়াল করাও দুষ্কর ছিল।
বছরের প্রায় পুরোটা জুড়েই ওই ন্যাড়াটুন্ডা হিজল – তাকে সহসা দেখে কেই-বা কুল-বংশের পাত্তা লাগাতে পারত? মায়ার পক্ষেও ওই গাছ চেনা দূরে থাক, তার শরীর-স্বভাবও বিলক্ষণ নির্দেশ করা প্রায় অসম্ভবই ছিল। ওইটুকু বয়সে মায়ার কি ছাই
জ্ঞান-বুদ্ধি তেমন ছিল? ফলে কী করেই বা সে ওই ঢাউস-বৃক্ষ, এন্তার গুল্ম-লতা আর তরু-পলস্নবের নামধাম-বংশ মুখস্থ রাখবে?
মায়ার নিজের বয়সেই তখন পাশাপাশি দুই সংখ্যা বসে নাই। অবশ্য তা না বসলেই বা কি? যা দেখার তা সে ঠিকই দেখতে পেত। ওই ন্যাড়াটুন্ডা হয়ে থাকা হিজলের দু-চারটা ডালে-শাঁখে যে সামান্য সবুজ বা গাঢ়-সবুজ-পত্রালি চিলকে উঠত, তা মায়ার নজরদারিতেই থাকত। আর ওইসব চিলকানো পাতার হাওয়ার স্পর্শে নড়ে ওঠা বা ইতিউতি চোখ-মেলার চেষ্টা সে খেয়াল করত।
বছরের অধিকাংশ সময়েই ওই বিরিক্ষির ন্যাড়াটু-া সুরত ধরে থাকা। ফলে সে বেঁচে আছে কি নেই – তার হদিসও মায়ার জানার কথা ছিল না। ওই মরাধরা গাছলতার খেয়ালে মায়ার দিনমান পেরিয়ে যেত এমন নয়। বরং সে তাকিয়ে থাকত আসমানের দিকে। আহা রে! আসমানকে কি আর আসমান বলে ভাবা যেত? সে তখন যেন মেঘভাসা অন্য কোনো দুনিয়া। মায়া নাওয়া-খাওয়া ভুলে আসমানের পানেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। আর মন দিয়ে দেখত মেঘেদের রূপ-বদল। মেঘের চাঙড়ের উড়ে-চলা। আসমানের রং আর লীলা। একখ- চলিষ্ণু মেঘ যেন অতিকায় হাতির রূপ ধরত। শুঁড়ের ভেতর গুটিয়ে আনা মেঘ মুহূর্তে ছিট্টিছান হয়ে যেত। মায়া হয়তো আশা করেছিল ওই হাতির শুঁড়টা দীঘল হলো বলে! দীঘল হতে-হতে তাকে পেঁচিয়ে ধরে ছুড়ে ফেলল বলে। সাত আসমানের ঠিক মাঝখানে।
খানিক বাদেই মায়া দেখত অন্য দৃশ্য। ওই মেঘহাতি ফুলতে-ফুলতে এক্কেবারে চূড়া হয়ে উঠেছে। আর তাতে সুরমারং ঢেলে দিয়ে ময়ূর সিংহাসন বানিয়ে ফেলেছে। মায়া তখন নিষ্পলক। চোখের পাতা ফেলতেও তার ভয় করত। আহা! যদি এই মেঘের চাঙড় অন্য কোথাও ভেসে যায়? ভেসে-যাওয়ার পূর্বেই যদি বসা যেত ওই ময়ূর-সিংহাসনে। কেমন তুলা-তুলা মেঘের বিস্তার। যেন-বা কোনো তুলাপাহাড়। ওই পাহাড়ে একবার উঠতে পারলে কোমলের চাইতেও কোমলতর কোনোকিছুর সন্ধান হয়তো পাওয়া যেতে পারে। হতে পারে তা শাপলার পাপড়ির মতো। ওই ফুলদলরূপ-মেঘের স্পর্শে দুই নয়ন ভরে হয়তো আরামের ঘুম নেমে আসতে পারে। কিন্তু ওই তুলোট-মেঘ মায়ার চক্ষি-মুখে ভেলকি লাগানো পর্যন্তই সার। মায়া জানে, পরীর মতো ডানা পেলেও সে কখনো ওই মেঘরাজ্যে পৌঁছাতে পারবে না। যদি সেটা সম্ভবও হয়, সে তার ছোট্ট দুহাতে কীভাবে ছুঁতে পারবে ভাসাভাসি মেঘের হিম-অলিন্দ? ফলে শুধুই তাকিয়ে থাকা। বহুদূর থেকে তাকিয়ে-তাকিয়ে
মেঘকন্যা বনতে চাওয়া। আর দৃষ্টির তীরে মেঘের চাঙড়কে বশীভূত করতে চাওয়া।
মায়ার আরো ছিল বৃষ্টির জন্য ক্রমাগত অপেক্ষা। ঢাউস-ঢাউস মেঘের চাদর ছিঁড়ে গিয়ে কখন জলপতন শুরু হবে? জলপতন শুরু হলেই চারপাশের দৃশ্যপট বদলে যাবে। যাবেই। মায়া তো অনেকদিন ধরেই ওই বদল খেয়াল করেছে। বিশেষ করে গুল্মরাজি আর ঘাসঘাসালির বদল। চক্ষির সম্মুখে ওই যে হিজল বিরিক্ষি – যার চেহারা-সুরত ন্যাড়া-খরখরে। অথচ বাদলা নামল কি নামল না, মুহূর্তে সে বড় ধরনের ভুলভুলাইয়ার ভেতর ঠেলে দেবে। মেঘের চাঙাড়ি ভেঙে জল ঝরতে শুরু করল কি, সে দেখাতে শুরু করত ভানুমতির খেল! কোথায়ই বা-তার সেই টু-ামু-া সুরত। হঠাৎ একদিন সে শরীরের চারপাশে সবুজ-ছত্র ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একেবারে ভরযুবতী বনে যেত। তখন তার মতো ঢলকানো-যৌবনা কোনো বিরিক্ষি আশপাশে দেখা যেত না। যাদের বৃক্ষপ্রেম ছিল তাদের তখন ওই হিজলবাহারই ভরসা। সবার তখন হিজলের যৌবন হিলেস্নালে মদমত্ত হয়ে থাকা। হিজলের সবুজ ছত্র আদতে তার পাতার বাহার। বিচিত্র রঙের সবুজ নিয়ে পত্রালির নয়ন-কাড়া শোভা।
বিস্তর পত্ররাজির মধ্য দিয়ে লম্বা-লম্বা সবুজদ- ঝুলে নামত। আর ওই দ- ঘিরেই ফুটে উঠত সিঁদুররঙা হিজলফুল। যেন ঝুমকোলতারা বিরিক্ষির কানে ঝুলে পড়েছে। আর হাওয়ার টানে কেবলই নৃত্যপর হতে শিখেছে! ওই লালচে ফুল তুলে এনে চুলে গুঁজলে বেশ ফুলপরী হয়ে থাকা যেত। কিন্তু মায়া জানে, সবুজ-দ– ঝুলন্ত ফুলগুলি বড় নাজুক। হাওয়ারা সামান্য এতাল-বেতাল হলেই ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়বে। অতঃপর তুখোড় জলস্রোতে ভেসে যাবে। মায়ার কি সাধ্য আছে হিজলের ফুলরাশিকে আগলে রাখার?
স্রোতের ঘূর্ণিতে পাক-খাওয়া অদৃশ্যের দিকে ধাবমান ফুলরাশি। মায়া মনে-মনে ওই স্রোতকে বাধা দিতে চাইত। যাতে করে ঝরাফুলের রাশিতে তার ছোট্ট-আঁজলা ভরে ওঠে। কিন্তু বেগবান স্রোতকে কীভাবে বাধা দেবে মায়া? আর কীভাবেই-বা ভেসে-যাওয়া ফুলরাশিকে আঁজলায় তুলে নেবে? অপারগ হয়েই সে মনে-মনে
দুই-একটা লাইন জপে যেত –
হিজলফুল হিজলফুল
তুমি আমার কানের দুল!
বাবুর সঙ্গে তুরাগ নদীতে বেড়াতে এসে মায়া ভয়ানক চমকে উঠেছিল। তার দৃষ্টির সম্মুখে তখন অর্ধডুবন্ত হিজলগাছ। অনেককাল আগে যে-গাছকে সে আলিঙ্গন করতে চাইত। তুরাগের জলে হিজলগাছের পুষ্প-পত্ররাজি তাকে ফের মনে করিয়ে দিয়েছিল –
হিজলফুল হিজলফুল
তুমি আমার কানের দুল!
মায়া বিড়বিড় করে লাইনদুটো বারংবার আওড়ে গেলেও বাবুর কাছে তা স্পষ্ট হয়নি। বাবু তখন সদ্য সিগারেট ধরিয়েছে। আগুনের উত্তাপ ভেতরের তামাকে কেবল উষ্ণতা ছড়িয়েছে। মায়ার দৃষ্টি অর্ধেক বাবুর মুখের ওপর, অর্ধেক জলডুবন্ত গাছটির ওপর। হিজলফুল কিংবা কানের দুলের খোঁজে মায়া আনমনা। বাবুর কচুপাতার মতো সবুজে-হওয়া ত্বকে বা সরল কেশগুচ্ছে ধোঁয়ার কু-লী ঢুকে পড়ছে। পরক্ষণেই কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। অথচ ধোঁয়ার এই ওঠানামা মায়ার নজরে পড়ল না। পড়লে হয়তো অন্য দৃশ্যের জন্ম হতো। শৈশবের খরস্রোতা-খাল আর ঝরে-পড়া হিজলফুলে মায়া তখন আটকে থাকত না। বাবুর শরীরের মদে মদমত্ত হতো। পুরুষদেহের গভীর নৈকট্যে সন্নিবিষ্ট হতো। মায়া যদিও জানে, ওই খালের জলে ভেসে-যাওয়া হিজলরাশির মতো বাবুও খানিক পরই অন্তরীণ হয়ে যাবে। হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্য। বাবুকে সে আর অনেকদিন দেখতে পাবে না। বাবুর সঙ্গে তার স্বর্গীয় ও চরম আকাঙিক্ষত দেহস্পর্শ থেকে সে ছিটকে পড়বে।
গোল্ডলিফের ধূম্রজালের ভেতর দিয়ে বাবুই আদতে মায়াকে দেখছিল। হিজলগাছের কা– নৌকার নোঙর আটকে মাঝি যখন অন্য নৌকায় আড়াল নিয়েছে, বাবু তখন দৃষ্টিজালে মায়াকেই তুলছিল।
তুরাগের জলরাশি প্রায় সমুদ্দুরের চেহারা পেয়েছে। সেই অথই জলের ওপর দুপুরের রোদ্দুর একতাল সোনা গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। ফলে জল থেকে কনকাভা ঠিকরে উঠছিল। সেই কনকাভার বৃত্তে মায়া বসা ছিল। তীব্র সোনালি আভা স্থির হয়ে ছিল মায়ার চিবুক ও নাকের দুপাশে। এমনকি কণ্ঠার হাড়ের খাঁজে।
মায়ার চিবুক, নাসিকা বা কণ্ঠার হাড়ের স্বর্ণরেণুতে বাবুর দৃষ্টি নিবদ্ধ। মায়ার টুকরো-টুকরো সৌন্দর্য বাবুকে এক ধরনের যন্ত্রণার ভেতর ঠেলে দেয়। হয়তো মায়া আর সে মাসকাবারে দেখা করে বলে ওই যন্ত্রণা তাকে কয়েকগুণ বেশি পোহাতে হয়। কিন্তু কী করবে বাবু? মায়াই বা কী করবে? পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল সম্পর্কের নোনাজলে তারা দুজনই ডুবে আছে।
বাবু বা মায়া দুজনেই জানে তাদের এই সম্পর্ক সহজ নয়। তাদের জীবনযাপনও সহজ নয়। বরং তা গাঢ় অন্ধকারে পরিপূর্ণ।
কূল-কিনারাহীন তুরাগের মতো তাদের সম্পর্কও স্বাধীন। আবার একই সঙ্গে পরাধীনও।
টাপটুপানি লোহার কাঠি
বৃন্দাবনে টিয়ার কাঠি
বাতাসে জলার্দ্র ঘ্রাণ গাঢ় হলে টের পাওয়া যায় নদী নিকটবর্তী। আর যদি পাহাড় নিকটবর্তী হয়? পাহাড় নিকটবর্তী হলে বনজ গন্ধের ঝাপটা এসে নাক-মুখ ঝলসিয়ে দিতে চায়। মায়া নদীর রহস্যকথা যতটা জানে, পাহাড়ের ততটা নয়। নদী, মায়ার কাছে সহোদরার মতো। মায়া যেন নদীর সব কথাই জানে। নদীতে কেন ঢেউ ওঠে, আর কেনই-বা সেই ঢেউ ভেঙে পড়ে? মায়ার কাছে নদীর কোনোকিছুই অগোচর নয়। অথচ পাহাড়কে তার মনে হয় বহুদূরের কেউ। পাহাড় মানেই কঠিনতা। পাহাড় মানেই অন্তরাল। পাহাড় মানেই যাবতীয় রহস্যের আধার। দূরবর্তী পাহাড়কে মায়া শুধু একবার আপন ভেবেছিল। মায়ার মনে হয়েছিল, পাহাড়ের অন্তরালটুকু অসহজ জীবনের জন্য বড় দরকারি। হতশ্রী জীবন থেকে পালিয়ে নতুন জীবন জন্ম দেওয়ার জন্য পাহাড়ই হতে পারে আশ্রয়। শুধুমাত্র নিজেকে তেমন করে ভালোবাসার জন্য পাহাড়ে ঠাঁই নেওয়া যেতে পারে। যে-পাহাড়কে মায়া আপন ভেবেছিল, সেটা ছিল ভিনদেশের পাহাড়। টিভি চ্যানেলের কল্যাণে সে-পাহাড়কে মায়ার প্রেমময় মনে হয়েছিল। প্রায় আকাশ ছুঁয়ে থাকা চৈনিক-পাহাড়। অসম প্রেমের কিংবদন্তিতে ওই পাহাড় ঘিরে ছিল কৌতূহল। সেই কোনকালে বয়সে এগিয়ে-থাকা এক নারীর প্রেমে পড়েছিল এক তরুণ। কিন্তু তাদের মিলন ছিল অসম্ভব। সমাজের ভয় কি না বাঘের ভয়কেও হার মানায়। ফলে সমাজ ছাড়ো। মানুষ ছাড়ো। ছাড়ো লোকালয়। নির্জনতার দিকে ধাবিত হও। অসম-প্রেমিক-জুটিকে নির্জনতার দিকেই আগাতে হয়েছিল। আর পাহাড় তাদের দিয়েছিল আশ্রয়। জনমানবহীন পাহাড়ের চূড়ায় ঘর বেঁধেছিল তারা। অতঃপর সুখী হয়েছিল।
পুরুষটি যেত কাঠ কাটতে। ফলমূল সংগ্রহ করতে। ওই পাহাড়ের পায়ের কাছে বয়ে-যাওয়া ঝরনা থেকে নারীটিকে তুলতে হতো জল। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেতে ভারি কষ্ট হতো তার। তবু সে নিত্যই তুলত জল। জল তোলার কষ্ট দেখে তরুণ মাটি কাটতে শুরু করল। মাটি কেটে সে বানাতে লাগল সিঁড়ি। চোদ্দোশো সিঁড়ি কাটল সে। নারীটির কষ্ট লাঘব হলো। অতঃপর নারী আর পুরুষটি মিলে পাহাড়ের নিচের জমিনে ছড়িয়ে দিলো শস্যের বীজ। বুনে দিলো সবজি আর কলার গাছ।
মায়ার মনে হয়, ওই পাহাড়ের চূড়াটি যদি তাদের হতো। ওইরকম কোনো পলায়নে তারা সুখী হতো। বাবু কেটে আনত কাঠ। সেই কাঠে আগুন জ্বালিয়ে ভাত রাঁধত মায়া। আর আলু পুড়িয়ে খেত।
তুরাগনদের জোয়ারভাটা দেখতে-দেখতে মায়া এসব ভাবে। নৌকার ভেতর যখন তারা চরম ও পরমভাবে মিলিত হয়, মায়ার তখন ওই চৈনিক-পাহাড়ের দৃশ্য মনে পড়ে। বাবুর নগ্ন-শরীরের শ্যামল বরণ দেখে মায়ার পলায়নের চিন্তা মাথায় আসে। মায়া ধীরে-সুস্থে সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে চায়। বাবুও ধীরগতিতে আগায়। ধৈর্য নিয়ে শরীরের রহস্য উন্মোচন করতে চায়। মায়া আর বাবু জানে তাদের দেহমিলন ফুটে-ওঠা সূর্যমুখীর মতো। যে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে। বিষণ্ণতা যাকে কখনো স্পর্শ করে না। তবু নিজেদের নগ্নতা, আনন্দ ও উপায়ান্তরহীনতা নিয়ে দুজনই ভেবে মরে। মায়া চীন দেশের সেই পাহাড়ের কথা বাবুকে বহুবার বলেছে। ফলে পাহাড়-রহস্য বাবুও অল্পবিস্তর জানে। মায়ার উন্মুক্ত স্তনে মুখ ডুবিয়ে সে রহস্যের সমাধান খুঁজে মরেছে। দীর্ঘ চুম্বনে মায়ার ঠোঁট থেকে জীবন শুষে নিতে-নিতে বাবুও সেই সিঁড়ির ধাপের কথা ভেবেছে।
মায়ার সমর্পণের সঙ্গে বাবুও কি একাত্ম নয়? অথবা বাবুর একাগ্রতার সঙ্গে মায়া? বাবুর চোখের দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা দুলে উঠলে মায়াও কি অশ্রম্ন গোপন করার চেষ্টা করে না?
মায়া জানে, ভালোবাসার অপর নাম স্পর্শ, সমর্পণ। বাবুর আগ্রাসী চুম্বনে কেঁপে উঠতে-উঠতে তার মনে হয় – চোদ্দোশো সিঁড়ির প্রথম ধাপটি সদ্য পেরোচ্ছে তারা। বাবুও জানে বাৎসায়ন যদি চৌষট্টি কলার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে, পঁয়ষট্টি নাম্বার কলাটি তার আবিষ্কার। মায়াকে সে মন্ত্রমুগ্ধ রাখে।
পর্দাঢাকা নৌকার দুলুনিতে তুরাগের জল কেঁপে ওঠে।
নতুন-নতুন ঢেউয়ের স্তর তৈরি হয়। ঊনশহরের এই নদীতে প্রতিদিন অজস্র প্রেমিক-জুটি ভেসে যায়। যাদের পলায়ন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। ছইয়ের ওপর পর্দা ফেলে জীবনের আসল বা নকল কিছু একটা তারা উপলব্ধি করে। কেউ ঘর ফেলে আসে, কেউ-বা ঘর ছাড়তে আসে। সংসার ফেলে কেউ আসে, কেউ-বা সংসার গড়তে। সন্তান ফেলে অথবা সন্তান জন্মানোর আশায়। মায়া আসে। বাবু আসে। তাদের মতো মিলনোন্মুখ আরো নর-নারী। হিজলফুলের মতো জলের টানে ভেসে যায় তারা। হংসমিথুনের মতো পালকে পালক লাগিয়ে উষ্ণতার সন্ধান করে। হয়তো ভুলে যেতে চায় – সংসার-কারাগারের জলস্নাদেরা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। জলস্নাদের রক্তচক্ষু সংসার-পালানোদের দিকেই মেলে রাখা।
কচুর পাতা হলদি
ছুঁইয়া আয় জলদি!
আশুলিয়ার আকাশে যখন মেঘ জমে তার অনতিকাল পরেই তুরাগের চেহারা বদলে যায়। বোঝা যায় না, মেঘেদের সঙ্গে নদীরা কোনো গোপন সূত্রে বাঁধা কিনা। আকাশে যত মেঘ ঘনায় – নদীর জল ততটাই ফুলে ওঠে। ক্রমে তা ভেঙে ঢেউ হয়ে ভেসে যায়। তুরাগ নদে শুধু যে ঢেউয়েরা ভাসে এমন নয়। মানুষেরাও হরদম ভাসে। কেউ-বা সওদা নিয়ে ভাসে। কেউ-কেউ মৎস্য শিকারের আশায় ভাসে। কেউ ভাসে ভোগের ইচ্ছায়, কেউ-বা ত্যাগের ইচ্ছায়।
কেউ-কেউ অসহায় বলে ভেসে যেতে হয়। যারা অসহায় হয়ে ভাসতে আসে তাদের অধিকাংশের জীবন গোলমেলে, পোড়-খাওয়া। অথবা ভাগ্যের হাতে মার-খাওয়া। নিজেদের সঙ্গিন দশা নিয়ে দিনমান ভেসে চলে। সন্ধ্যার আগেই ফিরে যেতে হয় নিজের ডেরায়।
সমুদ্দুর হয়ে থাকা তুরাগে মায়া ভেসেছিল বহুবার, বাবুর সঙ্গে। বাবুও ভেসেছিল বহুবার, মায়ারই সঙ্গে। দুজনেই নিজেদের ডেরা ফেলে এসে ভেসেছিল।
প্রলম্বিত সঙ্গম শেষ হলে তারা যখন ফিরে যেত, নিজেদের অসহায়ত্ব ভালোমতন উপলব্ধি করত। প্রতিবারই মায়ার চোখের কোণে জলের আভা চিকচিক করত। বাবুর মুখ দেখা যেত না। তা গোল্ডলিফের ধোঁয়ায় সদা আচ্ছন্ন। মায়াকে বিদায় জানানোর প্রাক্কালে বাবুর হাতে জ্বলত সিগারেট। বাবু মনে-মনে ভাবত, সিগারেট জীবন ধ্বংসকারী। কিন্তু মনের অবস্থা ঢেকে রাখার জন্য কার্যকরী। বাবুর অস্থিরতা ধূম্রজালের আড়াল হয়ে যেত। আর মায়া আনমনা হয়ে আধডুবন্ত বৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে থাকত। হিজলগাছ! দু-চারটা হিজলগাছ। এমন তো নয় যে, আশুলিয়ায় হিজলের কোনো বনভূমি গড়ে উঠেছে। তবে মায়ার কখনো-সখনো ভ্রম ঘটত। সে দেখতে পেত কোনো-কোনো গাছে ফাটল ধরেছে। দেখতে-না-দেখতেই সেই ফাটল বিসত্মৃত হতো। মায়া তাকিয়ে দেখত হিজলগাছেদের বুক বিদীর্ণ করে একটা ঘোরানো সিঁড়ি – যা জলের তলায় পৌঁছে গেছে। সেখানে পৌঁছালে পাহাড়ের সারি। একটা উঁচু পাহাড় থেকে দীর্ঘ সিঁড়ি নেমে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বৃক্ষদের বুক চিরে দুভাগ হয়ে যাওয়া! মায়া এর চাইতে বেশি কিছু দেখতে চাইত না। তার মনে পড়ে যেত দুঃখী রাজকন্যার কথা। বিমাতা যাকে দিবারাত্র তাড়া করে ফিরত। একদিন এক বৃক্ষ তার মা হয়ে উঠল। রাজকন্যা স্পর্শ করা মাত্রই সে দুভাগ হয়ে যেত। আর তাকে আশ্রয় দিত। মায়া নিজেও জানত বৃক্ষিরও শোকতাপ আছে,
বেদনা-অভিমান আছে। বৃক্ষির মর্মরে ধ্বনিত হয় মর্সিয়া। হয়তো তারা মানুষের হিংস্রতা আর অনাচার সইতে পারে না। এজন্যই প্রতি
শীতে নিজেদের পত্ররাজি ঝরিয়ে ফেলে। ফের নতুন পাতা গজায় – হয়তো নতুন কোনো পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর হয়েই তারা জন্মায়।
মায়া এমন করে ভাবে। মানুষের অসহায় অবস্থা তাকে পীড়ন করে। মায়াকে নিত্যদিনই সইতে হয় অপমান। দেখতে হয় হিংস্রতা আর প্রতারণা। মায়া ভেবে পায় না – সামাজিকতার বন্ধনের জন্য একজন মানুষকে কেন নিত্যই সইতে হয় পীড়ন? একজন মানুষের মৃত্যুকে জানার পূর্বেই কেন এভাবে বারংবার মরতে হয়?
বাবুর সঙ্গে শরীরী-মিলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে মায়া অন্য এক বিভ্রমে ঢুকে পড়ে। সুখী করার আপ্রাণ চেষ্টারত বাবুকে তার সেই বৃক্ষির মতো মনে হয়, পৃথিবীর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে যে রাজকন্যাকে আড়াল করেছিল। যে নিজেকে দ্বিখ–ত করে দিত। যাতে করে মেয়েটি নিরাপদে থাকতে পারে।
বাবুর দীর্ঘ কেশরাজিতে মায়ার স্তন ঢেকে গেলে বাবুর বৃক্ষরূপ আরো প্রকট হয়। যেন সে পত্র-শাখার আচ্ছাদনে মায়াকে আগলে রাখতে চাইছে। মায়া জানে – তুরাগের ছইঢাকা নৌকাগুলোতে সঙ্গমরত প্রতিটা পুরুষ তখন ঝুঁকে পড়েছে। আর নারীটির ওপর মেলে দিয়েছে পত্ররাজির ছায়া। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা চটকানোর গন্ধে চারপাশ ভরে উঠেছে। মায়া বা বাবু যখন যে-যার ডেরায় ফিরতে শুরু করে, তখন ওই পাতার গন্ধ তাদের তাড়া করে ফেরে।
তুরাগের মাঝি-মালস্নারা একদিন হতবিহবল হয়ে পড়ে। যেদিন সূর্য খুব দ্রম্নত ডুবে যায় আর বিশাল এক চাঁদ হেসে ওঠে জলের ভেতর। মাঝিরা দেখে, তাদের নৌকার যুগল সওয়ারি কীভাবে চন্দ্রাহত হয়। আর চাঁদের আলোর সঙ্গে পালস্না দিয়ে তুরাগে জোয়ার আসে। মাঝিরা ঠাহর করতে পারে না কিসে কী হয়? তাদের সওয়ারিরা নিখোঁজ হয়ে যায়। তখন খালি নৌকা নিয়ে মাঝিরা দ্রম্নত তীরে পৌঁছে। আর
ভয়ে-ভাবনায় তুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যাত্রী নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি তারা প্রকাশ করে না। কারণ এতে তাদের কামাই-রোজগার কমতির আশঙ্কা থাকে।
পরদিন মাঝিরা নতুন এক দৃশ্যের সম্মুখীন হয়। জলমগ্ন হিজলগাছেরা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুরাগের জলরাশি নীলবর্ণ ধারণ করেছে। এতসব ভোজবাজি দেখে তাদের বুক ঢিপঢিপ করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই তারা প্রকাশ করে না।
নিরুদ্দেশ সওয়ারিদের খোঁজে আত্মীয়স্বজনরা এলেও মাঝিরা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কারণ তারা জানে অসামাজিক কাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য জরিমানা হতে পারে। এমনকি জেলও খাটতে হতে পারে। তারা এও জানে, তাদের বয়ান গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। প্রেমিক-যুগলের বৃক্ষি পরিণত হওয়া কোন পাগলেই বা বিশ্বাস করবে? কিন্তু কিছুদিন বাদে চন্দ্রাহত মাঝিরা ওই সত্য প্রকাশ করে দেয়। তখন সবাই তাদের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে।
তবে এখনো চাঁদনি রাতে মাঝিরা অদ্ভুত দৃশ্যাবলিই দেখে। তারা দেখে জোড়া-লাগানো হিজলগাছেরা দ্বিখ–ত হয়ে যায়। বৃক্ষদের খোড়ল থেকে বাবুর মতো বা মায়ার মতো বা নিরুদ্দেশ অন্য যাত্রীর মতো কেউ বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে তারা নদীর জলে সণান করে। গুনগুনিয়ে কোনো চেনা গানের সুর ভাঁজে। ফের কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝিরা ভয়ে-আতঙ্কে এসব কাউকে প্রকাশ করে না। কারণ ফের তাদের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হবে। তারা একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আর বলে –
‘কী যে হৈল! কী যে হৈল! চান্নি উঠলেই আমাগো চক্ষি পর্দা নাইম্যা আসে। আমরা আর ঠিকঠাক কিছুই দেখতে পারি না।’
মাঝি-মালস্নাদের অহেতুক প্যাঁচাল কে শোনে? ফলে তেমন কিছুই আর ঘটে না। শুধু হিজলগাছেদের স্থানান্তর ঘটে। তারা পূর্বের স্থান ত্যাগ করে আলিঙ্গনাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তুরাগের উন্মত্ত জলরাশি বৃক্ষদের কোমর ছাপিয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে…