অসহায় কোরবানি

অসহায় কোরবানি
শ্রাবণ মাস। আকাশে দল বেঁধে গাঢ় রূপ দিয়ে মেঘেরা ছুটাছুটি করছে। এই বুঝি এক ঝাঁক বৃষ্টি নিয়ে গুড়মুড়িয়ে ধপাস করে মাথার উপর পড়বে। সাদা-সাদা কাশফুল গুলো কোমড় দুলাচ্ছে দক্ষিণা মৃদু বাতাসে। কখনো বা বৃষ্টির আগমন আবার কখনো রোদের আলোড়ন । তেমনি আজ হঠাৎ ফুরফুরে আকাশ, একদমই বৃষ্টি নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পড়ন্ত রোদ আবির কে রাঙিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আবির মন খারাপ করে নদীর ধারে বসে আছে। আনমনে সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশে আজ মেঘ কেন নেই?
আজ কি তাহলে শ্রাবণের সব মেঘ আবিরের মনে এসে ভীড় জমিয়েছে? হয়তোবা। তিন দিন পর কোরবানির ঈদ।চারিদিকে কুরবানির গরু-ছাগল কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। আগামীকাল আবিরের বাবাও তার লালুকে কোরবানির হাটে তুলবেন।লালু তাদের গরুর নাম। আবির আদর করে গরুটার নাম লালু রেখেছিল।পরিবারের সবার আদরের লালুকে কাল তোলা হবে কোরবানির হাটে। আবিরের বাবা মোঃ তাহের আলীর অভাবের সংসারে এটা বিক্রি ছাড়া আর কোন গতি নেই।এক অসহায় – দরিদ্র পরিবারে লালুকে রেখে পালন করার ক্ষমতা নেই তাদের।গত ছয় মাস যাবত তাহের আলী বেকার বসে আছেন।কোন কঠিন কাজ তিনি করতে পারেন না। পেশায় তিনি ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি । ওনার রোজগারে সংসার খুব ভালোভাবেই চলতো।কিন্তু ছয়মাস আগে এক দূর্ঘটনায় তিনি তার এক পা হারান।
চারতলা এক ভবনের উপর তলায় বাইরে প্লাস্টারের কাজ করার সময় পা ফসকে গিয়ে তিনি পায়ে আঘাত পান।এতে তার এক পা ভেঙে যায়।হাসপাতালে নেওয়ার পর তার পা কেটে ফেলতে হয়।এই এক্সিডেন্টে তাদের জমি বিক্রি করে তার চিকিৎসা করাতে হয়।আবিরের মা রাহেলা বেগম সেই বাড়ির মালিক এবং তাহের আলীর হেডমিস্ত্রি এর বাসায় গিয়ে হাতজোর করে কান্নাকাটি করে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।কিন্তু এই ভদ্র সমাজের সেই মানুষ গুলী তাহের আলীর এই দূঃসময়ে চোখ ফিরেও তাকায়নি।ফলাফলস্বরূপ তাহের আলীর জমানো কিছু টাকা আর জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে হয়। সবকিছু হারিয়ে তাদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ কালো অন্ধকার।
রাহেলা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে টাকা পায় সেটা দিয়ে কোনমতে তাদের সংসার চলে।আবিরের বাবার এই পঙ্গুত্বতার কারণে তিনি কোন কাজও পাচ্ছেন না। তার চিকিৎসার সময় তাদের বেশকিছু টাকা দেনা হয়ে যায়।দেনাদাররা তাদের পাওনা টাকার জন্য প্রায়ই তাদের বাসায় আসে।অনেকে অনেক কটু কথা শুনিয়ে যায়।এমতাবস্থায় তারা বাধ্য হয় তাদের গরুটা বিক্রি করতে।এতে তাদের কিছু টাকা হাতে আসবে আর দেনাদারদের পাওনাও শোধ হবে। আবির বসে বসে ভাবছে লালুর সাথে কাটানোর দিনের কথা।”বাবা যখন লালুকে কিনে আনে তখন লালু ছিল কয়েক মাসের ছোট্ট বাচ্চা।বাচ্চাটিকে আনাতে সবচাইতে বেশি খুশি সেইদিন ছিল আবির।লাল, কালো রঙের বাচ্চা টাকে নিয়ে আবির খুশিতে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়।সারা বাড়ি মাথায় করে তুললো আবির।মাকে বললো,মা আমি বাচ্চাটার একটা নাম রাখবো।
মা হেসে বললেন গরুর বাচ্চাটাকে দেখে তুই যা খুশি হযেছিস দেখে মনে হচ্ছে এ যেন তোর বন্ধু। তাই তোর ইচ্ছে মত একটা নাম রেখে দে। আবির অনেক চিন্তা ভাবনা করে বাছুর টার নাম রাখে লালু।লাল রঙের ডোরাকাটা রঙ থেকে এই নামটা রাখে সে।লালুকে সে সপ্তাহে ৩-৪ দিন গোসল করে দিত সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে।গায়ে তেল দিয়ে দিত এতে পশম গুলো চিকচিক করত।বাবার কাছ থেকে বিস্কুট,পাউরুটি,চিপস্,টিফিনের টাকা নিয়ে সে লালুর জন্য খাবার কিনে নিয়ে তাকে খাওয়াতো। আবির তখন ক্লাস টু-তে পড়ত।বিকালে স্কুল ছুটি হলে সে মাঠে গিয়ে ঘাস কেটে নিয়ে বাসায় ফিরত।আবিরের এমন আদর যত্নে লালু খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে নাদুসনুদুস হয়ে উঠল।
আবির স্কুল ছুটি হলেই ছুটে যায় লালুর কাছে।লালুও আবিরের কাছে গিয়ে আবিবের গায়ে গাঁ ঘসা দেয়।সুন্দর করে হাম্বা হাম্বা করে ডাকে।আবির আলতো ভাবে লালুর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর তারা কত রকম কথা বলে। নিজের সকল কথা আবির লালুকে বলত।ধীরে ধীরে লালু হয়ে উঠল তার খেলার সাথী।যেন লালুকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন।” কিন্তু সেই লালুকেই আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। হ্যা একে তাড়ানোই বলে।অভাবে স্বভাব নষ্ট, তাইতো টাকার জন্য লালুর মত একটা বন্ধুকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। কিন্তু আবির কিচ্ছু করতে পারছেনা, এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আবির। কালকেই বাবা লালুকে নিয়ে যাবে বাজারে।নিজের সব চাইতে প্রিয় বন্ধুকে সে হারাতে চলেছে।আবির এখন ক্লাস ফোরে পড়ে।বয়স মাত্র এগারো বছর।অভাব-অনটন,দেনাপাওনা সমন্ধে কি বা আর জ্ঞান আছে তার।
ওর এখন একটায় ভাবনা লালুকে যে ভাবেই হোক তার কাছে রাখতে হবে।আবির ছুটে যায় তার মায়ের কাছে।
আবিরের মা রাহেলা বেগম তখন রাতের জন্য উনুনে খাবার চড়াচ্ছেন।আবির ছুটে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে।চমকে উঠে রাহেলা বেগম।আবির কে জড়িয়ে ধরে বলে,কি হয়েছে বাবা তোর এমন করে কান্নাকাটি করছিস কেন? আবির কাঁদতে কাঁদতে বলে,,মা তোমরা লালুকে বিক্রি করে দিও না।আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না মা। রাহেলা বেগম নিশ্চুপ হয়ে যান।কি বলবেন ছেলেকে?আবির কে আড়াল করে চোখের পানি মুছেন। আবিবের গলা জড়িয়ে ধরে কোন রকমে মুখে হাসি এনে আবিরকে বলে, বাবা তোকে একটা গল্প শোনায় শুনবি?
আবির মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি দেয়।
তিনি আবিরকে কোলে নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ) এবং তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) এর কাহিনি বলতে লাগলেন।কিভাবে একজন পিতা আল্লাহর হুকুমে তার নিজের কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করেছিল এবং পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) বিনা দ্বিধায় কিভাবে তরবারির নিচে মস্তক অবনত করেন।তিনি আবিরকে বলেন,দেখো বাবা ইব্রাহিম (আ) যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার নিজের ছেলেকে কোরবানি দিতে পারে তাহলে আমরা আমাদের লালুকে কোরবানি দিতে পারব না? আবির মাকে বলে,”কিন্তু মা ওনি তো ইসমাইল (আ) কে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিয়েছিল।আমরা তো লালুকে কোরবানি না দিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছি?”
রাহেলা বেগম ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলে,বাবা দেখো কত মানুষ কোরবানি দেয়। তাদের অনেক টাকা আছে।কিন্তু বাবা আমাদের তো এত টাকা নাই, তোমার বাবা কাজ করতে পারে না। আর দেখো না এলাকার কিছু মানুষ এসে আমাদের কাছে তাদের পাওনা টাকা চায়। তাদের টাকাও তো শোধ করতে হবে। আমাদের তো একটা গরু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নাই তাই আমরা আমাদের লালুকে কোরবানি না দিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছি।এতে আমাদের দেনাও শোধ হবে আর ইনশাল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই ত্যাগকে কোরবানি হিসেবে কবুল করে নিবেন।কারণ তিনি তো আমাদের সব দেখছেন তাই না বাবা? গল্পটি শুনে আবির চুপচাপ মায়ের কোল থেকে সরে আসলো।রাহেলা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলেন।
আবির বাড়ির বাইরে এসে ভাবতে লাগলো মা তো ঠিকই বলেছে।গল্পটি আবিরের ছোট হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করল।সে ভাবতে লাগলো এ আমি কি করছি।তাহলে কি আমি আল্লাহকে ভালোবাসি না?না না আমি আর কাঁদব না।আমি আল্লাহকে খুব ভালোবাসি।কিন্তু লালুর দিকে তাকাতেই আবার আবিরের মনটা হু হু করে কেঁদে উঠে। তার মনে দোলা দেয় লালুকে নিয়ে কাটানো দীর্ঘ দিনের স্মৃতি। হয়তো আর কখনো সে লালুকে নিয়ে খেলতে পারবে না। পারবে না লালুর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে। এত দিনের খেলার সাথীকে হারাতে চলেছে সে। ভাবতে ভাবতে আবারো অজস্র অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাতের বেলা।খাওয়া-দাওয়া শেষে আবিরের মা আবিরকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবিরের বাবার সাথে কথা বলছেন। আবিরের মা বললো, “আচ্ছা লালুকে না বিক্রি করলে হয় না।ছেলেটা খুব কান্নাকাটি করছে।আমি ছোটনদের বাড়ি থেকে(যার বাড়িতে কাজ করে তার ছেলের নাম) এই মাসের বেতন সহ ঈদের জন্য বাড়তি কিছু টাকা পাবো। এই গুলা দিয়ে আমাদের দেনা শোধ হবে না?”
আবিরের বাবা বললো, “এই গুলো থেকে আর কতই বা টাকা পাওয়া যাবে যে এত গুলো দেনা শোধ হবে।গত ঈদে তো আবিরকে কিছুই কিনে দিতে পারিনি।তবুও ছেলেটা কিচ্ছু বলেনি এই ঈদে অন্তত কিছু তো দিতে হবে।আর তুমিও তো নিজের জন্য কিছু নাও না।কত দিন ধরে এই পুরাতন গুলো পড়ে থাকতে দেখছি।গরুটাকে বিক্রি করলে দেনা পরিশোধের পাশাপাশি বেশকিছু টাকা আমাদের থাকবে তা দিয়ে যদি একটা ছোট্ট চা – পানের দোকান দেই তাহলেও আমাদের ইনশাল্লাহ মাস শেষে কিছু টাকা থাকবে।ছেলেটাও তো বড় হচ্ছে ওর জন্য কিছু একটা তো করে দিতে হবে?”
“আচ্ছা তোমার যেটা ভাল মনে হয় করো আর শোন, কাল যদি গরু টাকে বিক্রি করো তাহলে আসার সময় ঈদের দিনের জন্য আটা,সেমাই, আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এসো।নিজের জন্য লুঙ্গী আর শার্ট নিও তোমারো তো নতুন কোন কাপড় নাই।” আবিরের বাবা হেসে বলে, “আচ্ছা কিনে নিবনি,আবিরের জন্য কিছু জামা কাপড়,তোমার জন্য শাড়ি আর দরকারি যা লাগে সব নিবনি।” “এখন তাহলে ঘুমিয়ে পরো কাল সকালে আবার উঠতে হবে বলে শুয়ে পরে আবিরের মা।” ওর বাবা শুয়ে থেকে ভাবে, “কেমন ছিল আমাদের দিন গুলো আর এখন কেমন যাচ্ছে।সত্যিই এক সেকেন্ডের বিশ্বাস নাই কি থেকে কি হয়ে গেল।ইনশাল্লাহ আল্লাহ খুব শিঘ্রই আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দান করবেন। আমিন।”
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আবির।আজ যে তার লালুকে বাবা হাটে নিয়ে যাবে।ঘুম থেকে উঠে সোজা লালুর কাছে যায়।লালুর গলা ধরে কাঁদতে থাকে, চোখের পানি লালুর গায়ের পশমে মুছে দেয়।লালুও ঘাড় নেড়ে আবিরে গায়ে গা ঠেকিয়ে হাম্বা হাম্বা করে।হয়তো সেও বুঝতে পেরেছে আজ তাকে বিক্রি করা হবে।তাকে নিয়ে যাওয়া হবে তার প্রিয় বন্ধুর কাছে থেকে।আর কখনো ফিরা হবে না সেখানে।আবিরের চোখে মুখে লালু জিহ্বা দিয়ে চেটে দেয়। আবির দেখতে পায় লালুর চোখেও পানি।হয়তো সেও কাঁদছে।লালুর গলা জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।লালুর চোখ দিয়েও পানি পড়তে থাকে। দুজনের ভালোবাসা আর দুঃখ বিনিময় দেখে আবিরের বাবারো চোখ ভিজে উঠে।মনে মনে ভাবে আজ এই অভাবে না পড়লে কখনোই তিনি আবির আর লালুকে আলাদা করতেন না।তিনি নিজেকে নিজের কাছে ধিক্কার জানান।কেমন বাবা তিনি নিজের একমাত্র ছেলের ভালোবাসাকে তার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন।এদিকে আবিরের মা আবিদের কান্নাকাটি দেখে নিজেও কেঁদে চলেছেন।
দেখে মনে হচ্ছে একটা পরিবারে যেন শোক নেমে আসছে।সবাই সেই শোকে শোকান্নিত,জর্জরিত। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসলেন আবিরের চাচা জনাব খাদেম আলী।তিনিই লালুকে হাটে নিয়ে যাবেন আবিরের বাবাকে সাথে নিয়ে।তিনি এসে দেখেন এই অবস্থা।সবার চোখেই পানি।আবির লালুর গলা ধরে কেঁদেই চলেছে লালুর চোখেও পানি। তিনি এমতাবস্থায় কি বলবেন নিজেও বুঝতে পারেন না। তার সংসারের অবস্থাও ভালো না, নয়তো নিজের বড় ভাইকে অবশ্যই সাহায্য করতেন। তিনি কোন রকমে পরিস্থিতি শান্ত করে বড় ভাইকে বলে লালুর গলায় দড়ি লাগিয়ে নেন।তারপর ভাবিকে বলে, অগ্রসর হচ্ছিলেন লালুকে নিয়ে।কিন্তু লালুকে কোন ভাবেই নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। লালু অসহায় দৃষ্টিতে একবার আবিরের দিকে তাকায় একবার বাড়ির সকলের দিকে তাকায়।যেন সে এই বাড়ির মায়া ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চায় না।তার চোখ দিয়েও অনবরত পানি ঝড়ছে।
আবিরকে তার মা ধরে আছে।আবির এক দৃষ্টিতে লালুর দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। সে লালুর দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে।আবির মনে মনে ভাবছে লালু হয়তো বলছে,বন্ধু তোমরা আমাকে হাটে নিয়ে বিক্রি করো না আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না।তোমাদের সবার প্রতি আমার একটা মায়া পড়ে গেছে সেই মায়া কখনো ভাঙা সম্ভব না।মনে হচ্ছে আবিরের বাবাকে বলছে,আপনি আমাকে আমার বন্ধুর কাছ থেকে আলাদা করবেন না আমরা দুইজন দুইজনকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি একজন পশু হয়ে আপনাদের মায়া ছাড়তে পারছি না আপনারা মানুষ হয়ে কিভাবে আমাকে আমার বন্ধুর থেকে আলাদা করছেন?
আবির মায়ের কাছ থেকে দৌড়ে গিয়ে লালুর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে,মনে মনে বলে বন্ধু আমিও তোকে ছাড়া থাকতে পারব না রে।কিন্তু তোকে যে আমাকে ছাড়তেই হবে।আমি যে তোকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি দিয়ে দিছি।আল্লাহকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি।তুই ভাল থাকিস ইনশাল্লাহ আমাদের আবার দেখা হবে।মৃত্যুর পর জান্নাতে গিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে আমি তোকেই আমার জান্নাতের সঙী হিসেবে চাইব। আবির শক্ত করে লালুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।আবিরের চাচা আবিরকে লালুর কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মার কাছে দিয়ে লালুকে নিয়ে যেতে থাকে।লালু অসহায় দৃষ্টিতে আবিরের দিকে চেয়ে আছে।তার পা সে নড়াচ্ছে না।আবিরের চাচা তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।আবির কাঁদতে কাঁদতে লালুর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।লালু চোখের আড়াল হওয়ার পর আবির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এক ভাবে কাঁদতে থাকে।আবিরের মা বাইরে বসে থেকে নিজেও লালুর জন্য কাঁদতে থাকে।
তিনি ভাবতে থাকেন,মায়া বড্ড অদ্ভুত জিনিস।কারো ওপর ভুল করেও একবার মায়া পরে গেলে তাকে সেই মায়ার বাধন থেকে সরানো অসম্ভব হয়ে যায়।কারো উপর একবার মায়া পড়ে গেলে সে মায়া কমেনা বরং বাড়ে।
লালু সামান্য এক গরু।একটা পশু।সেও কিভাবে আমাদের মায়ায় ফেলেছে।লালুকে আমরা না কতই আপন করে নিয়েছিলাম।সেও আমাদের কত আপন করে নিয়েছিল।কিন্তু টাকার কাছে শেষ পর্যন্ত আমাদের এই ভালোবাসাটা হার মানতে বাধ্য হলো।আজ আমরা দরিদ্র বলে নিজের ছেলের কাছে থেকে তার ভালোবাসা,খেলার সাথীকে আলাদা করে দিলাম।
আবিরের বাবা হাটে গিয়ে লালুকে খুব ভাল দামে বিক্রি করে।আর করবেই না কেন লালু দেখতে একদম নাদুসনুদুস ছিল।যে গরুটিকে কিনেছিল সে লালুকে কোরবানি দেওয়ার জন্য কিনেছিল।আবিরের বাবার লালুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল।আর মাত্র দুই দিন পরেই লালু পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাবে।ওনার চোখে পানি এসে গেল।চোখের পানি মুছিয়ে তিনি লালুকে বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে চান।কিন্তু লালুকে বিক্রি করার পর সেই ক্রেতার কাছেই লালুকে একদমই যেতে চাইছিল না।চার পা শক্ত করে মাটিতে রেখে অসহায় দৃষ্টিতে সে আবিরের বাবার দিকে তাকিয়ে রইল।আবিরের বাবা লালুর কাছে গিয়ে লালুর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে লালুর ঘাড়ে একটা চুমু দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন।লোকগুলো টেনে হিচরে লালুকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলতো।
আবিরের বাবা মার্কেটে গিয়ে আবিরের জন্য শার্ট,পান্ট,গেঞ্জি,পাঞ্জাবী আর জুতা নিলো। ওর মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনলো আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ,পেটিকোটের জন্য সিট কাপড় কিনলো।নিজের জন্য একটা লুঙী,শার্ট নিলো।বাজারে গিয়ে আবিরের মায়ের দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী বাজার করলো।অনেক দিন পর ছেলে-বউয়ের জন্য কিছু কিনতে পেরে খুশি মনে তিনি বাড়ি চলে আসলেন। রাহেলা বেগম বাড়িতে আবিরকে নিয়ে ওর বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল।আবির আগের চাইতে এখন শান্ত হয়ে বসে আছে।কিন্তু তার মুখে এক রাশ বিষণ্ণতা।
আবিরের বাবার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।বাড়িতে এসে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে তিনি আবিরকে কোলে নেন।
বলেন “দেখো বাবা কোন কিছুই তো চিরস্থায়ী হয় না আমাদেরকেও একদিন চলে যেতে হবে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।আমরা সবাই একদিন সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো অন্ধকার কবরে।আজ তোমার লালুকে নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছুদিন পর তুমি এই কষ্টটাকে এখনকার মত অনুভব করতে পারবে না।সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলার নামই জীবন। তুমিও এক সময় লালুকে হারানোর কষ্ট ভুলে যাবে।হয়তো লালুকে কখনো ভুলতে পারবে না।আমি তোমার জন্য আবারো একটা ছোট্ট বাছুর এনে দিব।তুমি তার নামও লালু রেখো।লালুকে ঠিক যে ভাবে আদর,যত্ন,ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছো তাকেও ঠিক সে ভাবে ভালোবেসে পালন করবা।তোমাকে গত ঈদে কিছু দিনে দিতে পারি নি তাই এই ঈদে তোমার জন্য কিছু কাপড় আর জুতা নিয়ে এসেছি।এই গুলা তুমি নাও।ঈদের দিন এগুলো পড়ে তুমি ঈদের নামাজ পড়তে যাবে।”
আবির বাবার কাছ থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে রুমে চলে আসে।সে চায় না আবারো তাকে বাবা একটা বাছুর কিনে দিক।হয়তো আবারো তাকেও একসময় বিক্রি করে দিতে হবে অভাবের তাড়নায়।আবির রুমে এসে দৃঢ় সংকল্প করে সে বড় হয়ে চাকরি করে পরিবারের অভাব অনটন দূর করবে।তারপর সে একটা বাছুর কিনে তাকেও লালুর মত ভালোবাসা দিয়ে বড় করবে।তখন আর থাকবেনা অভাবের তাড়না,প্রয়োজন হবে না লালুর মত আবার অন্য কোন লালুকে বিক্রি করার।
– ঈদের দিন সকাল বেলা।রাহেলা বেগম খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পোলাও-সেমাই রান্না করছে।আবিরের বাবা আবিরকে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।আবিরের মা রান্না শেষে আবিরের বাবাকে বললো” কৈ গো তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করো নামাজের সময় হয়ে এলো যে।আবিরকে তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দিয়ে নিজেও গোসল করে নেন। আবির রুমে এসে তার নতুন কাপড় গুলো বের করে।পাঞ্জাবী আর প্যান্ট পড়ে নেয় সে।ওর বাবা গোসলে করে রেডি হয়ে দুই বাপ-বেটা একসাথে খেতে বসে। ওর মা ওদেরকে পোলাও,সেমাই খেতে দেয়।হাল্কা মিষ্টি মুখ করে তারা রওনা দেয় ঈদগাঁহ নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে আবিরের মনে কেন জানি খুব খুশি খুশি লাগছে।
আবির বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা আমিও আমার লালুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিয়ে দিলাম।আমি বড় হয়ে আবারো একটা গরু কিনে তার নামও রাখবো লালু।তাকে কখনো বিক্রি হতে দিবনা।আমার কাছেই আমি তাকে রাখবো। আবিরের মায়ের চোখে পানি এসে গেল ছেলে কথা শুনে। তিনি আবিরকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আল্লাহ তোমার কোরবানি আর মনের আশা পূরণ করুক। আল্লাহর ভালোবাসার ক্ষেত্রে তুমি অনেক দূর এগিয়ে গেছ বাবা। আমি দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন তোমাকে পুরোপুরি মুমিন হওয়ার তাওফিক দেন। শামিল করেন তার প্রিয় বান্দাদের কাতারে। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।
আবির মায়ের কপালে চুমু খেয়ে দৌড়ে চলে গেল খেলতে। আবিরের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ছেলেটাকে কত খুশি খুশি দেখাচ্ছে।অথচ তার মনের মাঝে বিষাদে ভরে আছে।লালুর জন্য ওর মনে যে স্থান ছিল তা হয়তো অন্য কোন লালু পূরণ করতে পারবে না।আল্লাহকে বললেন, “আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে তোমার পথে চলার তৌফিক দান কর।তার জীবন তুমি সুখ-শান্তি, আনন্দময় করে দিও।প্রিয়জন হারানোর কষ্ট অনেক।তুমি আবিরের মত আর অন্য কাওকে তাদের ভালোবাসাকে টাকার কাছে পরাজিত করো না। আমিন।”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত