গোলাপ নির্মাণের গাণিতিক

জয়িতা আপ্রাণ চেষ্টাতেও তার মগ্নতা ধরে রাখতে পারছে না। কয়েকদিন ধরে একটা বিষয়বস্ত্ত নিয়ে সে গভীরভাবে ভেবেছে এবং তার নিজের ভাবনার প্রতীকী প্রকাশের জন্য সে-গল্পকে মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৈশোর থেকে কী এক গল্পঘোরের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে যে, পথ চলায়, রান্নাঘর এমনকি স্নানের সময়ও সে কোনো এক গল্পের দৃশ্যকল্পের ভেতর ডুব দিতে ভালোবাসে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাকে খুব মেধাবী ছাত্রী জেনেও এই ‘পাগলামি’র জন্য তার জীবনে চূড়ান্ত ভালো কিছু হবে না বলে আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। হলোও তাই। পদবিধারী স্বামী, বাড়ি-গাড়ি সব পেয়েও মেয়েটার কী রোগে পেয়ে বসল যে, নিজের দামি চাকরিটাও ছেড়ে গল্প-উপন্যাস পড়া আর লেখার জন্য একান্ত কিছু সময় বের করতে সে মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু স্বামী-সন্তান সবার নাশতার পর নিজের সংসারের কাজ সামলে সে যখন পড়ার টেবিলে নিভৃত হতে চায়, ঠিক তখন তার শাশুড়ি বিভিন্ন অজুহাতে জয়িতার মনোযোগ শুধু নষ্ট করেই ক্ষান্ত হন না বরং মাঝে-মাঝে তাকে তিনি হাড়-হাভাতে বলতেও দ্বিধা করেন না। ছোট্ট বাচ্চা কোথাও ধাক্কা খেলো তো তার গলা চড়তে শুরু করল,

বলি, উনি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে গেলেন! বাচ্চা  কোথায়, কী করছে – কোনোদিকেই তার খেয়াল নেই। আমাদের সময় আমরা এত কাজ করেও সন্তানদের…

শাশুড়ির পরের বাক্যটা পুরো হওয়ার আগে জয়িতা লেখার টেবিল ছেড়ে এসে প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করে, মা, আপনি কয়েকদিন আগেই আপনার ছেলেকে বলছিলেন, বাচ্চাদের তোরা এখন এত পুতুপুতু করে বড় করছিস যে, ওরা ফার্মের মুরগির মতো হয়ে যাবে। আমাদের সময় আমরা সকালে একবার খাইয়ে তোদের ছাড়তাম আর খবর নেওয়ার ফুরসত পেতাম না।

আমরা সংসারের কাজের ঝামেলায় সময় পেতাম না…

আমি সংসারের কাজ করার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছি।

আহা, কী তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ! বলি, মেয়েরা কেন গল্প-উপন্যাস নিয়ে পড়ে থাকবে? তার চেয়ে টবে একটা মরিচের গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করলে কয়েকটা ঝাল মরিচ পাওয়া যায়। ওই মরিচের দুই টাকা মূল্য আছে, একটা মেয়ের লেখা গল্পের কী মূল্য আছে?

মূল্য দিয়েই জীবন কি মূল্যায়িত হয়, নাকি জীবনের আরো কোনো অর্থ খুঁজতে হয়?

তুমি তো বিয়ের সময় একজন বড় চাকুরে আর তার সম্পদের মূল্যই দেখেছ।

মা, আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন যে, বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয়নি।

তোমার ইচ্ছায় হলে কাকে বিয়ে করতে একটু শুনি তাহলে?

তা জানি না। আমি আমার জীবনটাকে অন্যভাবে দেখতে চেয়েছি। আর জীবনকে চতুর্দিক থেকে আলো ফেলে স্পষ্ট করে এই দেখার ইচ্ছাটা জাগিয়েছে, আপনার কাছে অপাঠ্য বলে বিবেচিত গল্প-উপন্যাসের এ-বইগুলো।

জয়িতার কথায় তার শাশুড়ি এবার বিদ্রূপাত্মক হাসি হাসলেন এবং বললেন, নিজেই যা অপাঠ্য বলছ তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন?

কারণ যা কিছু শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠ্য তা মানুষকে মননশীলতায় সমৃদ্ধ করে না। পাঠ্যবই মানুষকে তার কর্মের জন্য এবং পরিশেষে অন্য বইগুলো পাঠের জন্য উপযুক্ত করে।

তুমি তো বই পড়ে দার্শনিক হয়েই গেছ…

দর্শনটা আমার নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও জীবনকে খুঁজতে এসব ‘অপাঠ্য’ বইয়ের গুরুত্বের কথা বুঝিয়েছেন। যত বড় চাকরিই হোক, তার সঙ্গে ‘চাকর’ শব্দ জড়িত। মানবের মহান জীবন এমন একটি নিম্নতর শব্দের সঙ্গেই শুধু ঘোরপাক খাবে এর চেয়ে বেদনার আর কী আছে? তাতেই চাকর শব্দের ঘেরাটোপে বন্দি প্রাণগুলো মাসশেষে কচকচে কিছু টাকা পাওয়ার কলরবে এই ভেবে মেতে উঠবে যে, জীবনের চূড়ান্তপ্রাপ্তি তার মতো করে আর কেউ অর্জন করেনি। জীবনকে রঙিন করার ভ্রান্ত ধারণায় তারা আরো কলহাস্যে আনন্দ উৎসব করবে, তাদের নিয়ে সমাজে যারা বন্দিত্বের শেকড়কে প্রবল করেছেন।

বাহ, দারুণ বকবক শিখেছ দেখছি। তা তোমার স্বামীর সেই কচকচে টাকাগুলো না থাকলে এমন চকচকে ভাবনা তোমার পোকার খাদ্য বইয়ের পাতাগুলো কী করে ভাবাতে পারত, জানতে বড় ইচ্ছা হয়।

চকচকে জীবনের অন্তরালে এই সমাজে শেওলা জমেছে, মা। এ এমন শেওলা, যা সারাতে নীরবতার অনন্য জগৎ প্রয়োজন। বইয়ের পাতার মাঝে লুকানো সে-রহস্যময় জগতে ঢুকতে আপনার মতো সরব না হয়ে মৌনতা প্রয়োজন। এর অর্থ আপনার কাছে কোনোদিন স্পষ্ট হবে না। তবে, আমার কাছে একটা জিনিস স্পষ্ট হলো। তা হলো, নারীর সৃজনে শুধু পুরুষ নয়, নারী নিজেও এক বাধা।

কী বললে? আমি বাধা? তা তো হতেই হবে। সৃজন নিয়ে তোমার পুরুষদের কাছে গিয়ে দেখো, তারা তোমাকে গাছে তোলার জন্য মই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু সেখানে কোনো নারীকে ওঠানোর পর তারা মইটা সরিয়ে নেয়।

জয়িতার সকালের লেখালেখি প- তো হলোই, সঙ্গে আরো যা সে অর্জন করল তা বহন করা তার মতো মননের মানুষের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল। জয়িতার স্বামী শরীফ তালুকদার অফিস থেকে ফিরে আসার পর শাশুড়ি কীসব বলে সেদিনই তাকে মেয়ের বাসায় রেখে আসার জন্য গোঁ ধরলেন। আর কেন যেন সে-কথায় দ্বিরুক্তি না করে শরীফ তার মাকে বোনের বাসায় রেখে এলো। প্রতিদিনের মতো রাশভারী ভঙ্গিতে সে সিগারেট ধরাল। গোসলের জন্য জয়িতার কাছে গরম পানি চাইল এবং গোসল শেষে দীর্ঘক্ষণ ধরে খাবার খেল। তার মুখ দিয়ে একটাও কথা সরছে না। দুই বছরের ছোট সন্তান ততক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। জয়িতার ইচ্ছা করছিল বাচ্চার সঙ্গে ঘুমিয়ে যেতে।

কিন্তু শরীফের গুরুগম্ভীর চলন দেখে তার মনের ওপর যে বোঝা চেপেছে তা সে মোকাবেলা করেই ঘুমাতে চায়। সে নিজ থেকে প্রশ্ন করতে চেয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে। শরীফের খাবার প্রায় শেষ হতে চলল অথচ সে যখন জয়িতার কাছে একবারের জন্যও জানতে চাইল না যে, সে খেয়েছে কিনা তখন জয়িতা নিজ থেকেই পেস্নটে খাবার তুলে নিয়ে তার পাশে বসে প্রশ্ন করল,

তুমি যে কোনো কথা বলছ না?

জয়িতার প্রশ্নে শরীফের ভেতরের টগবগে লাভা এবার সবেগে উদ্গীরিত হলো, গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা মহিলার উদরও চাকরের উপার্জিত টাকায় কেনা খাবার ছাড়া ভরে না। আগামী মাস থেকে তোমার বাপের থেকে টাকা নিয়ে নিজের খরচ নিয়ো…

শরীফ! বাজে বকবে না। আমার ভরণপোষণ না করলে বিয়ে করেছ কি…

ইয়েস, সেজন্যই আমি বিয়ে করেছি। চাকর শব্দের সঙ্গে যারা জড়িত তারা ওই কাজটুকু ছাড়া তোমার মতো সৃজনশীল আর কী মহান কর্ম বিয়ের মাঝে খুঁজবে, বলো?

প্রথম বাক্যটা গ্রহণ করার মতো মানসিকতা জয়িতার ছিল না। শারীরিক প্রয়োজনে শরীফ তাকে বিয়ে করেছে এ-কথাটায় জয়িতা ফুঁসে উঠল এবং নিজে কিছু বুঝে ওঠার আগে কষে তার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। শরীফ যেন এই ক্ষণের প্রত্যাশায় ছিল। তার ভেতরের আদিমতা নিয়ে সে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়িতার ওপর। জয়িতার সামনে থেকে তার খাবার ছুড়ে ফেলে দিলো। তার চুলের গোছা মুঠির মধ্যে নিয়ে এক টানে জয়িতাকে ফেলে দিলো মেঝেতে এবং জয়িতার জ্ঞান আছে না নেই, তা জানার কোনো প্রয়োজনবোধ না করে আদিমকালের কোনো এক দৃশ্যকল্পের মতো যেভাবে তারা বধ করা পশুকে টেনে গুহায় নিয়ে যেত, ঠিক সেভাবে শরীফ তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলো। জয়িতার মেঘ-বিসত্মৃত আর লম্বা চুলগুলোর অবশেষে এই একটা সফল ব্যবহার হলো যে, তার সেই চুলগুলো ধরে অজ্ঞান জয়িতাকে স্বামী নামধারী এক ধর্ষক তাকে ধর্ষণের জন্য সুন্দর এক বিছানায় নিলো।

জয়িতার জ্ঞান ফিরল, যখন শরীফ জ্বলন্ত সিগারেট তৃতীয়বারের মতো তার লজ্জাস্থানে চেপে ধরে তার আগুনটুকু নেভাল। সে চমকে ওঠে ছটফট করল। কিন্তু তার হাত বাঁধা অবস্থায় প্রতিরোধের কোনো উপায় করতে না পেরে পা দিয়ে সে লাথি হানল। সুতরাং শরীফ এবার তার পা দুটোও বেঁধে ফেলল। মুখে শক্ত কালো টেপ লাগিয়ে আদিম উন্মত্ততায় মেতে উঠল। শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়ার পাশাপাশি মানুষরূপী জানোয়ারটা তাকে বিকৃতভাবে ভোগের আনন্দে মেতে উঠল। জয়িতার মুখের সামনে সারাদিন না-মাজা হলুদ দাঁতগুলো বের করে বলল :

আহা রে, সৃজনশীল নারী! আমি তোমার চেয়ে কম ক্রিয়েটিভ নই… কী বলো?

কিন্তু ঠিক এই সময় জয়িতার মনে পড়ল তার প্রিয় এক উপন্যাসে পঠিত সামরা নামের সৃষ্ট চরিত্রের এক নারীকে ধর্ষণের বর্ণনা :

‘প্রাণপণ শক্তিতে তাদের কবল থেকে বাঁচতে চাওয়া সামরাকে তারা তক্তার উপর শুইয়ে দিয়ে মুখে টেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। একজন তার দুহাত আর মাথা শক্ত করে ধরছে তক্তার সাথে। জ্ঞান-অজ্ঞানের ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছে সামরা। এক নরপশু যখন তার শরীরের অন্তর্বাসটুকুও ছিঁড়ে ফেলল তখন সামরার মনে পড়ল ঠিক জন্মের ক্ষণে এক দেবদূত তার এক হাতে তীব্র আলো এবং অন্য হাতে রক্ত নিয়ে তার সামনে হাসছিল। সামরার শরীরের নিচ হতে আজ সেই রক্ত যেন তীব্র আলোক-কণার সুতীব্র ব্যথা হয়ে ছুটে গেল মানুষের পচনরত বিচ্ছিন্ন মাথা অতিক্রম করে ভাঙা আসবাবপত্রে। সামরার কুমারিত্বের রক্তের ধারা কাচের গুঁড়া, ছড়ানো-ছিটানো হাঁড়ি-পাতিল আর তৈজসপত্র পেরিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিশুদের ছেঁড়া জামায়, পরিত্যক্ত কয়েকটা মাথার খুলির কাছে এসে ডানে বাঁক নিতে-নিতে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নিহত শরীরের উদ্দেশে বলল – স্রষ্টা আমার চেয়েও তোমাকে ভাগ্যবান করেছে। সামরার কুমারিত্বের বিন্দু-বিন্দু রক্তকণা আকুল অভিযোগ নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট অতিক্রম করে ছুটে চলে জন্মদাত্রী মায়ের কাছে, তার শৈশবের খেলার পুতুলের গায়ে দাগ না-ফেলে সেই রক্তবিন্দুরা চলে যাচ্ছে অলস ভঙ্গিতে খেলায় মত্ত পূর্বাহ্ণের রোদ এবং প্রাচীন গাছগুলোর ছায়ার কাছে। তার রক্তটুকু পরিশেষে নশ্বর মানুষের বিরান অস্তিত্বের ফাঁপা সভ্যতার কাছে এসে থেমে যায়। মেতে ওঠে প্রকৃতির অলস ভঙ্গিমার আরো নিরলস খেলায়!’

আশ্চর্য, পুরুষ হয়েও তিনি কীভাবে একজন নারীর লাঞ্ছনার মুহূর্তের অনুভব নিয়ে এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা করলেন – ভেবে অবাক হলো জয়িতা। তাহলে সৃজনশীল মানুষ কি সত্যিই এমন তীক্ষন কোনো ইন্দ্রিয় নিয়ে জন্মায় যে, অন্যের অনুভূতির মাঝে আত্মনিবিষ্ট হওয়ার ক্ষমতা তার জন্মগত? লাইনগুলো মনে-মনে আওড়াতে গিয়ে জয়িতার দ্রম্নত মনে পড়তে থাকল, সেই ঔপন্যাসিকের আরো এক উপন্যাসের একের পর এক দৃশ্যকল্প। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ষিত এক নারীর জীবনালেখ্য জয়িতাকে তলিয়ে নিল অন্য এক জগতে। তার শরীরের ব্যথা-বেদনার অনুভূতির ঊর্ধ্বে সে সাত্ত্বিক হয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছে, এ-যেন ঠিক তার জন্মের ক্ষণ। এক দেবদূত তার এক হাতে তীব্র আলো এবং অন্য হাতে রক্ত নিয়ে তার সামনে হাসছে। তার ফোঁটা-ফোঁটা রক্তকণা আজ আকুল অভিযোগ নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট অতিক্রম করে ছুটে চলছে তার জন্মদাত্রী মায়ের কাছে, তার শৈশবের খেলার পুতুলের গায়ে দাগ না-ফেলে সেই রক্তকণারা চলে যাচ্ছে অলস ভঙ্গিতে খেলায় মত্ত পূর্বাহ্ণের রোদ এবং প্রাচীন গাছগুলোর ছায়ার কাছে। তার রক্ত পরিশেষে নশ্বর মানুষের বিরান অস্তিত্বের ফাঁপা সভ্যতার কাছে এসে থেমে যাচ্ছে।

 

দুই

শরীফের নিত্যনতুন অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকল। তার লকলকে বিকৃত রুচিগুলো দিন দিন যেন নতুন করে ডালপালা মেলছে। একদিন পূর্বাহ্ণে জয়িতা তার পরিকল্পনামতো সব গুছিয়ে নিল। বাসাটা খোলা রেখেই সে পালানোর জন্য ছেলে অপূর্বকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে এলো। অনেক যত্নে নিজের হাতে গড়া নিজের সংসারটার কোনো স্মৃতিই তাকে স্মৃতিতাড়িত করতে না পারলেও হঠাৎ কেন যেন তার চাল-বাছার ছোট্ট লাল-ডালাটার কথা মনে পড়ল। সে ফিরে ডালাটা নিয়ে এলো এবং তা সে তার ব্যাগের মধ্য পুরে নিচে ট্যাক্সিক্যাবে এসে উঠল।

তার তিন বছর পর। পালিয়ে জয়িতা বাবার ফ্ল্যাটে নিজের ছেলেকে নিয়ে তার সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। বিদেশি সংস্থায় ভালো একটা চাকরির পাশাপাশি সৃজনশীলতায় তার পসারও ঘটেছে। পত্রিকায় লেখা পাঠালে দুই সপ্তাহের মধ্যে সাহিত্য-সম্পাদক তা ছাপিয়ে দেন। কিন্তু আজকাল সে স্পষ্টত অনুভব করে, সে একজন লেখিকা – এই পরিচয়ের চেয়ে তার প্রতি তার আশপাশের পুরুষগুলোর আগ্রহের বড় কারণ, সে একজন ‘একা-মা’। স্বামী ত্যাগ করা নারীকে প্রলুব্ধের ভাষা এই সমাজ যত রপ্ত করেছে তার জীবনের অন্তরালের আর্তিকে জানার জন্য তার সামান্যতম শিক্ষাটাও তারা অর্জন করেনি। এর মধ্যে টিভিতেও তার ডাক পড়েছে। প্রথম কয়েকবার গেলেও পরে সে-ডাক সে উপেক্ষা করেছে তাকে নিয়ে আরো-আরো মানুষের তার ‘একা-মা’ হয়ে বাস করার খবর এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। সম্প্রতি পাঠ করা তার সেই প্রিয় ঔপন্যাসিকের একটা উপন্যাস তাকে আবেগাপস্নুতই শুধু করল না তার নিজের লেখার প্রতি চোখ ফেরানোর তাগাদা তৈরি করল।

জটিল এই সমাজে বাস করে এমন অনন্য এক উপন্যাস সৃষ্টির আদ্যোপান্ত জানার আগ্রহ থেকেই তার সঙ্গে দেখা করতে মন চাইল। ইচ্ছা করল তার একটা সাক্ষাৎকার নিতে। তখনই জয়িতার মনে হলো, সেই ঔপন্যাসিকের পত্রিকায় দু-একটা সাক্ষাৎকার ছাড়া তাকে সে আর কোথাও দেখেনি। অথচ তার মতো সামান্য এক লেখিকাকে নিয়ে মিডিয়ার আগ্রহের শেষ নেই। জয়িতা বুঝল, মিডিয়ায় কর্মরতদের তাদের কর্তাব্যক্তিরা ব্যবসার প্রতি মনোযোগী হতে বলেছেন। আর ব্যবসাটা সাধারণ জনগণকে ঘোল না খাওয়ালে ভালো হয় না। পঠিত উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠার ফ্ল্যাপে তার দৃষ্টি আটকে গেল। ঔপন্যাসিকের তারুণ্যময়, সপ্রতিভ আর গভীর মায়াময় চাহনির দিকে তাকিয়ে কী যেন সে ভাবল। তারপর গ্রন্থটিকে সন্তানের মতো বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল।

সে রাতে ফেসবুকে ঔপন্যাসিকের নাম অনুসন্ধান করে তাকে পেয়ে খুব খুশি হলো। অনলাইনে দেখে কেন যেন তাকে তার জীবনের পুরনো গল্পটাও বলতে ইচ্ছা করল। জয়িতা ধরেই নিল, তার গল্প থেকেই হয়তো তিনি বের করে আনবেন অনন্য কোনো জীবনালেখ্য; এই প্রত্যাশায় সে তার চ্যাট বক্সে লিখল :

স্যার, আমি কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি, আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা খুব প্রয়োজন। অপরপ্রান্ত থেকে ঔপন্যাসিক লিখলেন :

অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমাকে দয়া করে স্যার সম্বোধন করবেন না। আমার সংক্ষিপ্ত একটা নাম আছে, প্রতীক। আপনি আমাকে প্রতীক বলে সম্বোধন করলেই আমি খুশি হবো।

জয়িতা ইনবক্সে ‘প্রতীক’ লিখে তা কেটে দিয়ে বাকি অংশ পাঠাল :

আপনার এত সুন্দর ডাকনামটা আমার জানা ছিল না। জানানোর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে আপনার দেখা করা প্রয়োজন কারণ আপনি একজন ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। আমার গল্পটা আপনার জানা প্রয়োজন।

আপনার নাম কী, বলুন তো।

আমি জয়িতা।

জয়িতা! বাহ। ব্যাপারটা দারুণ।

কেন? কোন ব্যাপার?

থাক এসব। শুনুন জয়িতা, পৃথিবীতে বিচিত্র সব গল্প প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে। মানুষ তার জীবনের যে-গল্পকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে, একজন গল্পকারের আত্মায় গিয়ে তা ডালপালা মেলতে সমর্থ না হলে তা তার কাছে মূল্যহীন।

স্যার, গল্পের মূল্য সময় নির্ধারণ করে দেয় তার অর্থবহতা অথবা সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার কারণে।

আবার স্যার। কিন্তু জয়িতা, একটা গল্প সেই গল্পের অন্তরালের গল্পের প্রতি লেখককে সংবেদনশীল করে না-তুললে তা যে গল্পকারের হাতে সৃষ্টি হবে না – এও আপনার হয়তো অজানা নয়।

জয়িতা এবার অনেকটা সহজ হলো। ঔপন্যাসিককে সে তার ডাকনাম প্রতীক সম্বোধন করে বলল,

প্রতীক, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।

পিস্নজ, করুন।

নারীর সৃজন-ক্ষমতা অথবা তার সামর্থ্য নিয়ে আপনার কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ আছে কি?

জয়িতা, সংকেতময় স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে একজন শিল্পীর বেড়ে-ওঠার জন্য একজন নারীর গর্ভকেই স্রষ্টা বেছে নিয়েছেন। নারীর সৃজন ক্ষমতা নিয়ে স্বয়ং প্রকৃতি অথবা ঈশ্বর যা-ই বলি না কেন, নিঃসংশয় বলেই মানব প্রজাতি এই বিশ্বে এত অস্তিত্বময়।

আমি আসলে প্রাকৃতিক অথবা শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি না। আমি নারীর ভেতরের অনুভব আর সৃষ্টিশীল সত্তার প্রকাশ ক্ষমতা নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাইছি। আমাদের সমাজ আর পরিবার এর জন্য কি আমাদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করেছে? তবে ফেসবুকের এ কথোপকথন আপনাকে হয়তো বিরক্ত করছে। আমি আপনার অনুমতি পেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।

 

তিন

শহর ছেড়ে অনেকদিন পর জয়িতা নিজে গাড়ি চালিয়ে ঔপন্যাসিকের বাসার উদ্দেশে বের হলো। পথের অগণন মানুষের ছুটে-চলা দেখে কেন যেন সে হতাশ হলো। তার মনে হলো, মেয়েরা শুধু নয়, সৃজনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কোনো পুরুষের জন্যও এই সমাজে কঠিন। ঢাকার যানজট অতিক্রম করতে যখন তার তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেল তখন প্রতিনিয়ত এই জীবন-জট অতিক্রম করা মানুষের জন্য জয়িতার বড় মায়া হলো। মানুষের ছোট্ট এক জীবনে সময়-সমর্পণের এই অসহায় চিত্র তাকে ব্যথিত করে তুলল এবং সংক্ষিপ্ত এক জীবনে মানুষের আগ্রাসী উচ্চাকাঙক্ষা তাকে এই বার্তাই দিলো যে, সে এমন এক সমাজের বাসিন্দা যেখানে এই জীবন-জট অতিক্রমের ক্ষমতা অর্জনকারীরাই মহার্ঘ। তাই তো, এ-কথা ভেবে জয়িতা চমকে উঠল – একে অন্যকে অতিক্রমের, একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষির মন্ত্রসহ এই যানজট যেন অসহিষ্ণুতা আর সরবতার এক শিক্ষাক্ষেত্র।

প্রতীক তাকে বলেছিলেন নিজের আত্মা এবং সত্তার ধ্বনি শোনার জন্য নীরবতার প্রয়োজন। তিনি কি নীরব কোনো পরিবেশে বাস করার মানসে এই শহর ছেড়েছেন?

ছয় ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালিয়ে জয়িতা ঔপন্যাসিকের মফস্বল শহর পেরিয়ে গিয়ে তার নির্দেশনা মোতাবেক ডানের এক নির্জন কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। বাঁশঝাড়ের মোড় পেরোতেই প্রাচীন এক অশ্বত্থবৃক্ষের কাছে এলোমেলো চুলের এক পুরুষকে সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। জয়িতার মনে হলো, অনেক অনেক কাল থেকে সে অশ্বত্থগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে চেনে। হাত উঁচিয়ে তিনি জয়িতার গাড়ি থামার ইঙ্গিত দিলেন। গাড়ি থামিয়ে জয়িতা ভাষা হারিয়ে তার দিকে তাকিয়ে কেন যেন বলতে চাইল :

তুমি এখানে? কত কাল আমি তোমাকে খুঁজে ফিরছি!

তার চোখের গভীর আর সপ্রতিভ চাহনির মাঝে কেমন স্নিগ্ধ শান্ততা। অবিন্যস্ত চুল আর খোঁচা-খোঁচা দাড়ির মাঝে অমন নারীসুলভ চোখের মায়া জয়িতাকে ভুলিয়ে দিলো তার লম্বা সময় ধরে গাড়ি চালনার ক্লান্তির কথা। গাড়ির গস্নাসের কাছে ঝুঁকে তিনি উচ্ছল স্বরে প্রশ্ন করলেন :

জয়িতা?

তার প্রশ্নের উত্তরে জয়িতা শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলাল। তার মনোযোগ ততক্ষণে আটকে গেছে ঔপন্যাসিকের এলোমেলো একগুচ্ছ চুলের মাঝে দু-একটা পাকা চুলে। গাড়ির দ্বিতীয় আসনে বসে তিনি জয়িতাকে তার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসার লোহার দরজাটা একজন খুলে দিতেই জয়িতার চোখ ঝলমল করে উঠল। যতদূর চোখ যায় ভেতরে অর্কিড আর গোলাপের বিসত্মৃত বাগান। মূল প্রবেশদ্বারের বাঁয়ে এক পুকুরের পাশে উঁচু টিলার মতো অংশে বসার স্থানে একটা বড় দোলনা। টিলার মতো করে বানানো স্থানটিতে কয়েকটা পাতাহীন গাছ। নাম না-জানা অসংখ্য গাছ আর ফুলের এই রাজ্যের এক পাশে নীল-সাদা রঙের পোঁচ দেওয়া এক দ্বিতল বাসা। জয়িতাকে নিয়ে প্রতীক দোতলায় তার জন্য নির্ধারিত ঘরে এলেন। বললেন :

এই ঘরটা আপনার ব্যবহারের জন্য। আপনি স্নান সেরে খাবার টেবিলে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।

প্রায় তার সমবয়সী এক তরুণীকে জয়িতা তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখল। চটপটে আর ধারালো শরীরের মেয়েটার গোলাপি গায়ের রঙে রোদ তার সব আগুন ঢেলে দিয়ে তাকে টকটকে লাল বানিয়ে দিয়েছে। তার নীল চোখের চাহনিতে আর চোয়ালে একটা নীলাভ ছোট্ট তিল দেখে জয়িতা চমকে উঠল। কোথায় দেখা হয়েছে তার সঙ্গে – অনেক ভেবেও জয়িতা মেয়েটার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার ক্ষণকে মনে করতে পারল না। হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার পঠিত এক উপন্যাসের নায়িকা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঔপন্যাসিক নায়িকার বর্ণনা দিতে গিয়ে যেন এই মেয়েটির বর্ণনাই দিয়েছেন। সেই পটভূমিতে, সেই ঔপন্যাসিকের বাড়িতে তারই সৃষ্ট নায়িকার সামনে জয়িতা দাঁড়িয়ে! তাহলে? লেখকরা কি ভ- হন? এক সাক্ষাৎকারে, ‘উপন্যাস সৃষ্টির জন্য আসলে কী প্রয়োজন?’ – এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈকত বলেছিলেন :

দেখুন, মানুষ কখনোই মানুষের ভেতরকে অতিক্রম করতে পারে না। সুতরাং আত্মার দিগন্তকে বিসত্মৃত না করলে, জীবনকে দেখার ব্যাপ্তি আর আকুতি না বাড়ালে, বড় মাত্রার ব্যক্তিত্বকে ধারণ না করলে তার ঔপন্যাসিক হওয়া সাজে না। উপন্যাস সৃষ্টির জন্য জীবন থেকে অনেক কিছু ত্যাগ করার মানসিকতা অর্জনের পাশাপাশি ঔপন্যাসিককে বিশুদ্ধ মানুষ হতে হয়। সাধনা ছাড়া সফলতা, মগ্নতা ছাড়া ভালোবাসা হয় না – এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হয়।

প্রিয় লেখকের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে মুগ্ধ হয়েছিল জয়িতা। খুব মুগ্ধ। আজ সব যেন ভুল মনে হচ্ছে। সুন্দরী নারীকে নিয়ে নির্জন এক বাগানবাড়িতে তিনি মগ্ন হয়ে আছেন! এই তবে তার বিশুদ্ধতা? জয়িতা মনে-মনে এসব ভ-ামির প্রতি অভিসম্পাত জানাল। সৃজনের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে সে এখন নিজে সন্দিহান। জয়িতা যখন এসব এলোমেলো ভাবনায় এক ধরনের বিরক্তি আর হতাশায় নিমজ্জিত তখন মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বলল :

আমি স্যারের কম্পোজার। মাঝে-মাঝে তার লেখাগুলো কম্পোজের কাজ করি। তাছাড়া আমাদের বাগান থেকে ইউরোপে ফুল রপ্তানি হয় – রপ্তানির এই পুরো প্রক্রিয়াটা আমার হাতেই নিয়ন্ত্রিত এবং সম্পন্ন হয়। তবে দেশ-বিদেশের কোনো নারী অতিথি এলে তার দেখাশোনা আর যত্ন-আত্তিও করি। যে-কোনো কিছুর প্রয়োজনে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না, পিস্নজ।

আপনি বলছিলেন আমাদের বাগান, মানে?

মানে, স্যারের এই বিসত্মৃত বাড়ির পাশে আমাদের এইসব ফুলবাগান ছিল। স্যারের পৈতৃক-সূত্রে প্রাপ্ত বাসাটা ভেঙে এই যে বাংলো বানানো এর পাশে তাদের পরিত্যক্ত ভিটা ছিল। পাশে আমার বাবা পঁচিশ একর জায়গা কিনে তার সঙ্গে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে

যৌথভাবে বাগান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আসলে আমার ইচ্ছাটাই বাবাকে দিয়ে বলিয়েছিলাম। তিনি সম্মত হয়েছিলেন।

আপনি তো তার লেখাগুলো কম্পোজের চেয়ে বিদেশে ফুল রপ্তানির ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। সেভাবেই আপনার পরিচয় ভালো মানায়।

তার লেখাগুলোর দু-একটা বাক্য কেটে দেওয়ার অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে। কম্পোজার হিসেবে আমি পারিশ্রমিক নিই না। তবু তার সৃষ্টির সঙ্গে সংশিস্নষ্টের চেয়ে বড় গর্বের আমার কাছে আর কিছুই নেই।

এই-ই হলো মেয়েদের এক সমস্যা। তারা বিনা শ্রমে পুরুষের কাজ করে দিয়ে গর্ববোধ করবে আবার নারীর অধিকার নিয়ে চেঁচামেচিও করবে। ভাই, আপনার অধিকার নিয়ে আপনি সচেতন না হলে এই পুরুষশাসিত সমাজ কোনোদিন তা আপনাকে দেবে না। আপনি তার বাক্য কেটে দিয়েই গর্বিতবোধ করছেন। অথচ আপনার গর্বিত হওয়া উচিত ছিল এত বড় বাগানের একজন ম্যানেজার হিসেবে।

গর্ব, অহংকার এই শব্দগুলোর আলাদা দ্যোতনা ছাড়াও আমাদের একেক জনের কাছে এসবের একেক রকম অর্থ আছে। পুত্রের কাছে পরাজয় পিতার জন্য গর্বের। নিজের চেয়ে সন্তানের অগ্রগতিতে মায়ের প্রাপ্তি। আর কে না জানে, পৃথিবীর সব নাম তা বসুধা-বসুমতী-বসুন্ধরা যাই-ই হোক তা নারীকেই বোঝায়। ধান ফলাতে যে মাটিকে কর্ষণ করে তাকেই বাহবা দেওয়া হয়। মাটির উর্বরতার প্রশংসা কে করে? যাহোক, এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার পরে কথা হবে। আমার নাম জয়িতা, আপনি?

মেয়েটার বুদ্ধিদীপ্ত কথাগুলো সে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কিন্তু জয়িতা শব্দটা শোনার পর তার মনে হলো সে ভুল শুনেছে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে সে বলল :

আমি জয়িতা। আপনি কি ভুল করে আমার নামটাই উচ্চারণ করলেন?

কী আশ্চর্য, আমাদের দুজনের নামই এক! ফেসবুকে আমিই আপনার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়েছিলাম। তার নামের ওই অ্যাকাউন্টটা আমিই চালাই।

তাই?

হুম। স্যার ইন্টারনেট আর টেলিভিশন ব্যবহার করেন না।

কেন?

অনেক তথ্য মানুষের প্রজ্ঞা অথবা উইসডোমকে বিভ্রান্ত করে – তিনি এমন ধারণা পোষণ করেন। বলেন, তার বাছাই করে রাখা বইগুলো পড়া আর চলচ্চিত্র দেখার সময় হয়তো জীবনে তিনি পাবেন না। সুতরাং অন্য সবকিছুর সঙ্গে তার কাট্টি।

আমি অবাক হচ্ছি, আপনার নামও জয়িতা!

নাম নিয়ে দেখছি বিভ্রান্তি তৈরি হবে। তবে আমার নামের শেষে আহসান এবং শান্তা এই শব্দ দুটি আছে। শান্তা আমার মা আর আহসান আমার বাপ-দাদার পরম্পরা নাম। জয়িতা আহসান শান্তাকে আপনি সংক্ষেপে ‘শান্তা’ ডাকতে পারেন। অদ্ভুত ব্যাপার, আমরা দুজনই একজন ঔপন্যাসিকের সৃষ্ট জগৎকে এত ভালোবাসি যে, সেই জগৎকে আমাদের নিজস্ব বলে মাঝে-মাঝে ভুল করে বসি। আপনি গোসল সেরে আসুন, পিস্নজ।

মেয়েটি পুনরায় তার স্নিগ্ধ আর মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে চলে গেল। তার চলে যাওয়ার পথে জয়িতা তাকিয়ে থেকে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে-মনে বলল, কী বিচিত্র এই পৃথিবী আর তার মানুষগুলো!

স্নান সেরে খেতে এসে জয়িতার মন খারাপ হয়ে গেল। শান্তা শুধু তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতীক নেই। জয়িতা আহসান তার মনের কথা যেন টের পেল। জয়িতা টেবিলে বসতেই সে তার পেস্নটে খাবার তুলে দিতে-দিতে বলল :

স্যার গ্রামের দিকে গিয়েছেন। এটা তার নিত্যদিনের কাজ। তবে ছুটির দিন, আবহাওয়া খারাপের দিন ছাড়া। আর খুব বৃষ্টির দিনে তিনি কিছুই করেন না। মানুষ, লেখালেখি সবকিছু ভুলে তিনি বৃষ্টি নিয়ে এত মাতেন মনে হয় যেন বহুকাল পর তার প্রেমিকা

ফিরে এসেছে। আমি বুঝি এটা তার মনস্তাত্ত্বিক এক রোগ। বৃষ্টি ধুলা-ময়লা পরিষ্কার করে প্রকৃতিকে নির্মল করলেও মানুষের মন যে তাতে পরিচ্ছন্ন হবে না – একথা কে তাকে বোঝাবে?

তাই? আর কী করতে ভালোবাসেন তিনি? তিনি কি দুপুরের খাবার খেয়েছেন?

এই গ্রামকে ঘিরে আমাদের বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া আছে। দুপুর দুটা থেকে সেগুলো দেখাশোনা ছাড়াও তিনি গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কাছে যান। তাদের কথা শোনেন। তারপর ফিরে এসে দেখা যাবে তাদের তিনি তার পরিকল্পনার কথা বলবেন।

আপনি তাকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলছেন।

হুম, বলছি। কারণ আমি তার ‘স্ত্রী’ নই।

তবু…

আশপাশের মানুষ আমাদের এভাবে দেখে-দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তারা প্রথমে কানাঘুষা করলেও তাকে কাছ থেকে দেখে-দেখে এখন সত্যটুকু হয়তো উপলব্ধি করেছেন। সত্য বাইরে থেকে বোঝার জিনিস নয়। ভেতর থেকে তা উপলব্ধি করার ব্যাপার।

শান্তা, আপনি ভালো কথা বলেন।

একজন মানুষ ভালো কথা তখনই বলে অথবা লেখে যখন তার কাছে জীবনের দর্শন স্পষ্ট হয়। আমি স্যারের লেখাগুলো নিয়ে বলতে পারেন প্রায় গবেষণা করি।

কিন্তু শান্তা, আপনি এত সুন্দর বলেন, ভাবেন – নিজে লিখেন না?

খাবারের গ্রাস মুখগহবরে সামলে নিয়ে জয়িতা আহসান শান্তা স্মিত হাসল। তারপর বলল :

নিজে লিখতে গেলে ঘটনাক্রম মাথার মধ্যে প্যাঁচ তুলে আমাকেই পাগল করে তোলে।

কিন্তু আপনি তার বলা থেকে নিজেই কিছু…

জয়িতার কথা শেষ হওয়ার আগে জয়িতা আহসান শান্তা বলে :

শুধু তাই-ই নয়। এমনকি তার নিজস্ব লেখাগুলো আমি আমার মতো করে লিখতে গিয়ে দেখেছি, আমার ভেতর থেকে বের হওয়া ভাষারা তার মতো করে অনুপ্রাস তৈরি করতে পারে না। একই বিষয় নিয়ে আমি লিখছি অথচ তা তার লেখার মতো করে মনকে আবিষ্ট করতে, হৃদয়কে মগ্ন করতে সমর্থ নয়। বুঝি, লেখক বাক্যের গঠনের ভেতর তার আত্মার ধাঁচটা লুকিয়ে রাখেন। মানুষের

জীবন-আকুতিকে তিনি তার সত্তার চিহ্নে অঙ্কিত করতে এমন গোপন সংকেত ব্যবহার করেন, যার রহস্য ভাঙা সম্ভব নয় এবং যা হয়তো তিনি তার মাতৃগর্ভে ভ্রূণ হয়ে ওঠার প্রাক্কালে অর্জন করেছিলেন।

বাপরে, আপনার স্যারের জীবন সার্থক। এমন একজন ভক্ত তার জুটেছে!

একথায় জয়িতা আহসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেন যেন তাকে বিষণ্ণ দেখাল। তাকে দেখে জয়িতার মনে হলো যে, তার খাদ্যনালি দিয়ে খাবার নিচে নামছে না। জয়িতা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল :

শান্তা, কী হলো? দুঃখিত, আমি ভুল কিছু বলে থাকলে…

সার্থক জীবন! তার চেয়ে অনবদ্য জীবন আর কার হতে পারত? কে বোঝাবে তাকে। বিয়ে করবেন না, প্রেম করবেন না… উনি আছেন…

বিশুদ্ধতা নিয়ে?

না।

তাহলে?

সময়ের ভাবনা নিয়ে।

মানে?

তার মতে কাছের মানুষরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে কষ্ট দিতে চান না তিনি। তাই সংসারে জড়াতে চান না।

বাবা-মাকে হারিয়েছেন আর তার প্রিয় এক বোনকে হারানোর পর

জীবন-উচ্ছ্বাসকে তিনি তার সৃষ্টির সঙ্গী করেছেন। নিঃশব্দতা ভালোবাসেন। বৃষ্টির রিমঝিম আর পছন্দের গান তার আত্মার খাদ্য।

জয়িতা চমকে উঠল। তার প্রিয় এক লেখকও কী এক মান্ধাতা আমলের অনুভব নিয়ে বসে আছেন ভেবে সে অবাক হলো। দুজনেরই খাওয়া শেষ। জয়িতা খেয়াল করল শান্তা প্রচুর সবজি আর মাছ খেলেও মাত্র পঞ্চাশ গ্রামের মতো ভাত খেল। জয়িতা আহসান শান্তাকে সে প্রশ্ন করল :

ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি বলে দুঃখিত। আপনার পরিবার?

বাবা-মা ঢাকায়। এই বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে আমার জন্য একতলা একটা বাংলো আছে। রান্না সেখানেই হয়। আমার সঙ্গে দুজন মহিলা আর দত্তক নেওয়া দুটো মেয়েবাচ্চা থাকে। মেয়ে দুটো স্কুলে যায় আর মহিলা দুজন রান্না থেকে সংসারের সব কাজ সামলায়। কিন্তু আমরা দুজন দুপুরের খাবার একসঙ্গে এই বাসায় খাই। বাবা-মা আসেন মাঝে-মাঝে। যোগ্য ছেলেদের ছবি আর বায়োডাটা নিয়ে আসেন। বিয়ের জন্য তাগাদা দেন।

আপনি তাঁদের কী বলেছেন?

বলেছি আমি মানসিক আর শারীরিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্ত্তত নই। আমি কখনো বিয়েতে জড়াতে চাই না।

এখানে আছেন কত বছর?

সাত বছর।

সাত বছর যার সঙ্গে একসঙ্গে খান, লম্বা সময় একসঙ্গে কাটান

তাকে বিয়ে করলেই…

কারণটা আপনাকে বলেছি।

তাহলে খামোখা তার জন্য কেন আপনি আপনার জীবন নষ্ট করবেন?

প্রশ্নটা করে জয়িতা আনমনা হয়ে গেল। নিজেকে সে নিজেই প্রশ্ন করল, ‘বিয়ে করলেই কি জীবন অর্থবহ হয়? তুমি নিজেই কি আর কাউকে নিজের জীবনে জড়াতে চাও জয়িতা?’ সে উপলব্ধি করল, জয়িতা আহসান শান্তা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের মনের মতো মানুষ না পেলে বিয়ের মতো গভীর এক সম্পর্কে জড়ানো ভালো ফল বয়ে না-ও আনতে পারে। তবু তার নিজের প্রশ্নের উত্তরটা শান্তার কাছ থেকে জানতে ইচ্ছা করছিল। জয়িতা আহসান তখন বলছে :

আর অন্য কোনো ছেলেকে আমার জীবনে আমি দেখতে চাই না। তাকে দেখে-দেখে এমন হয়েছে যে…

জয়িতা আহসানের কণ্ঠ ধরে এলো। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে তবু সে বলল :

পৃথিবীর আর কোনো পুরুষকে আমার ভালো লাগবে না। পুরুষের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য জ্ঞানের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততায়, কর্মে এবং সমর্থতায়। আমি এমন সমর্থ এক পুরুষকে দেখেছি যিনি কোনোদিন নিজেকে ছোট করতে জানেন না। যশ-খ্যাতির চেয়ে মগ্ন হয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। স্তাবকতা তার একমাত্র ঘৃণা আর সবচেয়ে যিনি শ্রদ্ধা করেন নারীদের।

জয়িতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে-মনে সে নিজের ওপর বিরক্ত হলো। কাছ থেকে না দেখে, ভেতর থেকে না জেনে কোনো ঘটনা অথবা কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা যে ভালো নয়, সেই শিক্ষাটা সে আজ মন থেকে গ্রহণ করল। বুঝল, ভালো মানুষ সেজে থাকলেও সত্যিকারের ভ-রা নিজেকে আড়াল করতে পারে না। সময় নিলেও ভালো মানুষের সত্তা সমাজকে তার সঠিক বার্তাটি ঠিকই পৌঁছে দেয়। তার জন্য জয়িতা আহসান তার পাশে নির্বিঘ্নে এই নির্জনে নিজেদের মতো করে বাস করতে পারছে হয়তো। নাকি তাদের প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসার জন্য সমাজের চোখে যা ধৃষ্টতা তাকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই দুই মানব-মানবীকে এখানে আগলে রাখতে সাহায্য করছে? ঘটনা যাই-ই হোক, তার এখনই ইচ্ছা করছে, নিরিবিলি-নির্জন এই স্থানে এসে আবাস গড়তে, যেখানে মানুষের ভাবনায় ঘৃণা অথবা ঈর্ষা নয় বরং স্বপ্নের বসবাস। জয়িতার দীর্ঘশ্বাস তাকে যেন বলল :

তুমি যে-সমাজে বাস করো সেখানে ভালোবাসার চেয়ে প্রতিযোগিতা, নিমগ্নতার চেয়ে সাধনাহীন সফলতার হাতছানি গিজগিজ করছে। তেমন সমাজ তোমাকে কী সৃষ্টি করতে শেখাবে, জয়িতা? ঘৃণা কখনো স্বপ্নের জন্ম দেয় না। আর স্বপ্নের পথ প্রলম্বিত না হলে হৃদয় ভাষা খুঁজে পায় না। নিজের সঙ্গে কথা বলা থামিয়ে জয়িতা শান্তাকে বলল :

আমি তার সাক্ষাৎকারটি আজ সন্ধ্যাতেই নিতে চাই। সঙ্গে নারীর সৃজন-ক্ষমতা অথবা তার সামর্থ্য নিয়ে তার ভাবনাটাও জানতে চাই।

কিন্তু, তিনি মনে হয় না মুখে-মুখে তার জীবনালেখ্য বর্ণনা করবেন। তিনি কী করেন, কী খেতে ভালোবাসেন, কখন ঘুম থেকে ওঠেন, তার প্রিয় পোশাক কী… এসব প্রশ্ন করলে তার উত্তর পাবেন না। কাছে থেকে এসব দেখে নিতে হবে। তবে তার ভাবনা জানতে হলে তার সঙ্গে আড্ডা দিতে পারেন। আচ্ছা আপনি কয়েকদিন

থাকছেন তো?

মাথা খারাপ। বাসায় আমার পাঁচ বছরের বাচ্চা আছে। যদিও ওর নানির কাছে আমি তাকে রেখে এসেছি। একদিন থাকার কথা বলে এসেছি।

আপনার স্বামী?

নেই…

মানে, আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে?

না।

তাহলে?

সম্পর্কটা ঝুলে আছে। বলতে পারেন আমি ঝুলিয়ে রেখেছি।

কেন? জীবনে ঝুলে থাকার তো কিছু নেই, ম্যাম।

আমার পক্ষ থেকে তা ঝুলিয়ে রাখার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি তাকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। শান্তা, আপনি নিজে কি আপনার জীবনটাকে ঝুলিয়ে রাখেননি?

না, আমি মোটেও আমার জীবনকে ঝুলিয়ে রাখিনি। জীবন নিয়ে আমার লক্ষ্য স্পষ্ট।

শান্তা, না, জীবন নিয়ে আপনার লক্ষ্য স্পষ্ট তো নয়ই বরং আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনার জন্য আরো একজনের জীবন ঝুলে আছে।

জয়িতা, আমি আমার সব দিয়ে নিজেকে তার হাতে সমর্পণের জন্য প্রস্ত্তত। আমি তার জন্য মরে যেতেও তৈরি… কিন্তু…

টলটল জলে ভরে এলো জয়িতা আহসানের দুচোখ। নিজেকে লুকাতে সে দ্রম্নত জয়িতার কাছ থেকে পালিয়ে গেল।

 

শান্তার অশ্রম্নসজল চোখ কেমন জয়িতার ভেতরটা ভেজা-ভেজা করে তুলল। অনেকদিন পর অজানা এক বেদনা, যে-বেদনা স্বপ্নের পথে মানুষকে তাড়িত করে; তেমন অনুভূতিতে সে মনে-মনে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নিল। জয়িতা জানে পাথর থেকে আগুন বের করতে কী করতে হয়। মোবাইলে সে তার মাকে ফোন করে বলল :

মা, তুমি দয়া করে অপূর্বকে কয়েকটা দিন সামলাতে পারবে?

মায়ের কাছ থেকে আশ্বাস না পেয়ে ভোর রাতে ঢাকায় গিয়ে সেদিনই আবার জয়িতা তার ছেলে অপূর্বকে নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরে এলো। ফিরতে-ফিরতে তার রাত হয়ে গেল। তার এই যাতায়াতের কোনো তথ্যই প্রতীক না জানলেও শান্তা সার্বক্ষণিক তার খোঁজ রাখল।

 

চার

জয়িতা অবাক হলো, প্রথম আগমনের দিন যে-মানুষটি তাকে নিজে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অভ্যর্থনা জানালেন, তার আর কোনো পাত্তা নেই। দুপুরের খাবার শেষে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে সে দোতলার বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া পোর্চের ছাদে এসে মুগ্ধ হয়ে

প্রকৃতির পানে চোখ মেলে থাকল। দক্ষিণে এক মরা নদী। এই শীত-শীত অগ্রহায়ণে তার চরাচর জুড়ে অসংখ্য নাম না-জানা শীতের পাখি। দূরবিসত্মৃত মাঠজুড়ে সরিষাফুলের হলুদ সমারোহ। বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া ছাদে পায়চারি করতে-করতে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেল :

বাগানের চারপাশে তৈরি হাঁটার পথটিতে ট্র্যাক-স্যুট পরে প্রতীক অপূর্বর হাত ধরে আর তার পিছু-পিছু জয়িতা আহসান শান্তা হ্যাট আর ট্র্যাক-স্যুট পরে দৌড়াচ্ছে। তারা দূরের এক ফটক দিয়ে বের হয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় গিয়ে দৌড় থামিয়ে হাঁটা শুরু করল। এরপর তারা কাঁচা রাস্তা থেকে নেমে শুকনা নদীটার অবশিষ্ট সামান্য জলের কাছে গিয়ে থেমে গেল। অপূর্বকে কোলে তুলে নিয়ে প্রতীক ঝাঁক-ঝাঁক পাখির দিকে আঙুল নির্দেশ করে কী যেন বোঝাতে চাইছেন।

এই দৃশ্য দেখে জয়িতার বুকের মধ্যে এক কলকল স্রোত বয়ে গেল। তা যতটা না আনন্দ আর বেদনার তার চেয়েও বেশি স্বপ্নময়তার। সে শান্তা আর তার প্রিয় ঔপন্যাসিকের মাঝখানে এক অনাগত ভবিষ্যৎকে কল্পনা করে আবেগাপস্নুত হলো। জয়িতা আজ এমন এক পরিপূর্ণ নারীর আবেশে ভরে উঠল, যে নারী আগামী মানবপ্রজন্মকে ধারণ আর প্রবহমান নয় বরং তাদের উচ্ছলতা আর আনন্দ দেখে অনন্য ভালোলাগায় আপস্নুত হয়। যে ভালো লাগার কাছে মৃত্যু হার মানে, তুচ্ছ হয়ে যায়। কিন্তু এই দৃশ্য জয়িতার পাশে সারাজীবন এক শিশুকেই শুধু কল্পনা করতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে না। আরো কী যেন তাকে করতে বলছে। তার মন আর শরীরের উর্বর প্রান্তরে এক আনন্দ-স্রোত তাকে আনমনা করছে।

বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। অপূর্বকে নিয়ে তারা দুজন মানুষ কোথায় গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। হালকা কুয়াশার আস্তরণ দিগন্তরেখায় জমতে শুরু করেছে। বেলা প্রায় অস্তমিত। পশ্চিমের গোধূলিতে এখনো রক্তিমাভা জেগে আছে। এমন সময় জয়িতা তাদের ফিরে আসতে দেখল। তাকে এখন পর্যন্ত প্রথম দেখার পর প্রতীক একবারের জন্য ধরা না দিলেও এখন  সে দেখল, অপূর্ব তার কাঁধে বসে তার মাথার চুলগুলো শক্ত করে ধরে আছে। দূর থেকে বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে তাদের। তারা কাছে আসতে-আসতে লাল রক্তিম সূর্যটা গোধূলির কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।

সাঁঝের মায়া এখানে গাছের পাতায়, শুকিয়ে-আসা নদীটার চারপাশের প্রকৃতিতে, ধোঁয়াশাময় গোধূলি হয়ে আকাশের প্রান্তসীমানায় ঢেলে রেখেছে তার অনন্তকালের হাতছানি। এই মায়ার বাঁধনে থেকে একাকিত্ববোধ আরো তীব্র হওয়ার কথা। এই মন আকুল-করা

প্রকৃতির মাঝে প্রিয়জনকে দ্রম্নত শনাক্ত করে নেওয়ার কথা। অথচ, অন্য সবাইকে জীবনের প্রতি তীব্র আকুতি সৃষ্টি করাতে সমর্থ এক ঔপন্যাসিক কিনা, তার জন্য হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা নিয়ে পাশে বাস করা নারীর চোখের ভাষাই পড়তে পারেন না! জয়িতা গত দুদিনে শান্তার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজগুলো কাছ থেকে দেখেছে। তার সব কাজের মাঝে অদৃশ্য এক মানুষের মঙ্গল কামনা লুকানো আছে। তার পছন্দের খাবার, তার লেখার অথবা শোবার ঘরের পরিচ্ছন্নতা সবকিছু আনমনেও যে নারী যত্ন করে, সেই নারীকে তার মতো সংবেদনশীল মানুষ চিনে নিতে ভুল করবেন – তা বিশ্বাস হয় না জয়িতার। এর মাঝে কী রহস্য লুকানো, তা খুব জানতে ইচ্ছা করছে তার। যেসব লেখক একেবারেই মানহীন লেখা নিয়ে লেখক সেজে বসে আছেন তাঁদের হৃদয়ে সারাক্ষণ জাগ্রত কোনো মহাপ্রেম কি তার মনে এতটাই ঘৃণার জন্ম দিয়েছে যে, তিনি সত্যিকারের লেখকসত্তার অধিকারীদের এই অপবাদ থেকে মুক্তি দিতে এই ব্রহ্মব্রত ধারণ করেছেন?

কিছুক্ষণ পর জয়িতা বহমান এই সময়ের কাছে চারণ কবির মতো গান গেয়ে চলা মানুষটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখল। শান্তা তার পাশে ছায়ার মতো চলছে। পাশাপাশি পথচলা তাদের দুজনের জুটিতে যে অসাধারণ রসায়ন, জয়িতার ইচ্ছা করল তাদের এই পথচলাকে ভিডিওতে ধারণ করে রেখে দিতে।  কিন্তু তার পাশে এমন সুন্দরী এক নারীর আকর্ষণকে কীভাবে তিনি উপেক্ষা করে চলেন – ভেবে সে তার ওপর বিরক্তও কম হলো না। আজ সন্ধ্যার পর জয়িতার সঙ্গে তার লম্বা একটা আড্ডা দেওয়ার কথা। আজ তিনি নিশ্চয়ই জয়িতার হাত থেকে ছাড়া পাবেন না। এসব প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।

প্রতীক সন্ধ্যায় যখন বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া ছাদে এসে বসলেন তখনো অপূর্ব তার সঙ্গে। দুদিনেই ছেলেটা তার এত আপন হয়ে উঠেছে ভেবে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে জয়িতা দুঃখিত হলো। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় এ-নিয়ে নিশ্চিত সে বিপত্তি বাধাবে। কিন্তু জয়িতাকে অবাক করে অপূর্ব তখনই বিপত্তি তৈরি করল। সে তার মায়ের কাছে এসে প্রশ্ন করল,

মা, আমি বাবাকে ছেড়ে আর যাব না। আমরা আগে কেন এখানে আসিনি?

এখনো প্রতীকের সঙ্গে জয়িতার তেমন কোনো

কথাবিনিময় হয়নি। তার আগেই ছেলের এমন কথা তাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিলো। সামনে বেতের সোফায় বসা মানুষটার বয়সের সঙ্গে তার চোখের গভীর ভাষা আর প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যেন লুকোচুরি খেলা খেলতে গিয়ে পরিশেষে তার ভেতরের শক্তি এবং সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলছে। নিজেকে আর কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে না জড়ানোর জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতীতের লাঞ্ছনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত অসংখ্য ঘটনা পুরুষদের ব্যাপারে তার মন বিষিয়ে তুলেছে। তবু কেন অনেকদিন পর এই অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে সামনে বসা পুরুষটিকে যুগ-যুগান্তরের চেনা এক জীবনসঙ্গী কল্পনা করে জয়িতার মনে মধুর কাঁপন জাগছে – তা সে জানে না। তাকে সত্যি ‘অপূর্বর বাবা’ কল্পনা করতে গিয়ে তার হৃদয়স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে জয়িতার পা থেকে মাথার সব সণায়ুতন্ত্রে।

এমন পরিস্থিতিতে জয়িতার লাজুক হৃদয়ে স্পন্দন দ্রম্নততর হয়ে গেল। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মৃদু কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করলেও চাঁদের আলো এখনো ধোঁয়াশাময়। মহাকালের কাছে চাঁদের রুপালি নিষ্প্রভ আলো মানবের অনিত্যতার রূপ ধারণ করে যেন স্থির হয়ে আছে। এই আবছা আলো-আঁধারির খেলা ঔপন্যাসিকের অন্তর্লোকে কী প্রভাব ফেলে, তা জানতে চেয়েও এ-মুহূর্তে প্রশ্নটি করতে জয়িতা বেমালুম ভুলে গেল। সে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে অপূর্বকে তার শান্তা আন্টির কাছে যেতে বলল। ঠিক সে সময় জয়িতা আহসান শান্তা এসে অপূর্বকে ইশারায় কাছে ডাকতেই সে দ্রম্নত তার কাছে গেল। যেন এক সন্তান তার মার কাছে ফিরে গেল। অপূর্ব চলে যাওয়ার পর কিছু বলতে গিয়ে আবার দ্বিধান্বিত হলো জয়িতা। কোত্থেকে শুরু করা উচিত – এমন ভাবনায় সে যখন চিন্তিত তখন প্রতীক বললেন :

আপনি একজন লেখিকা এবং মা। চাঁদের এই নিষ্প্রভ আলোতে নিজের ‘মাতৃত্ব’, নাকি ‘লেখকসত্তা’ কোনটা বেশি সক্রিয় বলে অনুভব করছেন? আমি কখনো ‘বাবা’ সম্বোধনে সম্বোধিত হইনি। কিন্তু জয়িতা, বিশ্বাস করুন; অপূর্ব কাল থেকে আমাকে ‘বাবা’ ডাকার পর আমার কাছে এই চাঁদের আলোর ভাষা বদলে গেছে। মরা নদীটাতে এত প্রাণ আর আমার চারপাশের এই নির্জন নিরিবিলি প্রান্তর এত প্রাচুর্যময় হয়ে উঠেছে, আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না।

তার কথায় জয়িতা এবার সাবলীল হয়ে উঠল। বলল :

আমি আপনার সব লেখার একনিষ্ঠ পাঠক। আপনাকে জানার আমার অপার আগ্রহ। বলতে পারেন, আপনার উপন্যাস পাঠ থেকেই আমারও সাধ হয়েছিল লেখিকা হয়ে ওঠার জন্য।

হ্যাঁ, আপনি তো এখন আমার চেয়েও অনেক বড় একজন লেখিকা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা আপনার লেখা ছাপে, টিভি আপনার সাক্ষাৎকার করে…

এবার জয়িতার মরে যেতে ইচ্ছা করল। তিনি কি তাকে কটাক্ষ করলেন? জয়িতার ভেতর যেহেতু অবারিত হয়েছে সুতরাং সে আর থামল না। প্রশ্ন করল :

কিন্তু আমি তো জানি, আপনি প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ছাড়া দৈনিক পত্রিকা অথবা টেলিভিশন দেখেন না। আপনার সব তথ্য জয়িতা আমাকে জানিয়েছে।

কী অদ্ভুত কা-! আপনারা দুজনই জয়িতা। জয় একদিন আপনাদের হাতের মুঠোয় আসবে। সেদিন আমার চেয়ে আর কেউ বেশি খুশি হবে না।

বলে তিনি চুপ থাকলেন। কিন্তু তার শেষ বাক্যটায় তার কণ্ঠ থেকে ঝরেপড়া আবেগ জয়িতাকে ভুলিয়ে দিলো তার মনে-মনে গুছিয়ে রাখা পরের বাক্য। দুজনের মাঝে নীরবতা এসে ভর করল। চুপচাপ বহমান সময় আশপাশ থেকে ভেসে-আসা রাত – প্রাণীদের নিনাদের সঙ্গে তান তুলে দুজনের আত্মায় প্রোথিত হয়ে চলছে যেন কাল-কালান্তর। জয়িতার সত্যি কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু তাকে অবাক করে অনাকাঙিক্ষত এক ইচ্ছা তার প্রবল হচ্ছিল। আর তা হলো, তীব্র আলো জ্বালিয়ে সামনের পুরুষটার চোখে চোখ রেখে দীর্ঘক্ষণ অনিমেষ তাকিয়ে থাকা। কৈশোরে কোনো জীবনসঙ্গীকে কল্পনা করলেই জয়িতার এমন ইচ্ছা জাগত। সেই ইচ্ছা একসময় তার স্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল। বাস্তব জীবন                 তার কিশোরী আবেগের স্বপ্নকে কেড়ে নিয়েছিল। আজ আবার

ভুলে-যাওয়া স্বপ্নটা হাঁটি-হাঁটি পায়ে ফিরে এসেছে! কী আশ্চর্য! তা কি এই প্রকৃতির জন্য? নাকি, সেই মানুষটার জন্য যার শব্দবিন্যাসের মাঝে রোমাঞ্চকর, রহস্যময় এক স্বপ্নময় জীবন আর জগৎ ক্রমশ উন্মোচিত হয়ে তাকে এতটাই স্বপ্নবিলাসী করেছিল যে, তার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এই প্রশ্নগুলো তার মনের কোণে উঁকি দেওয়ার জন্যই সে হয়তো এবার নীরবতার অসীম তান কেটে দিয়ে প্রতীককে প্রশ্ন করল :

যত বড় পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হোক, দূরদর্শনের যত মাধ্যমই আমাকে নিয়ে প্রচারণায় মেতে থাকুক আমি তো আর ‘আপনি’ হতে পারব না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর, মানিক, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ, জীবনানন্দ – কেউ-ই প্রচারণায় বড় হয়ে ওঠেননি। আপনারও প্রচারণার প্রয়োজন নেই। ফুল বাতাসে গন্ধ ছড়ায়, আর কৃত্রিম গন্ধকে বাজারজাতকরণে বাহারি বোতল লাগে।

জয়িতা, সেসব বোতলের গন্ধেই এখন বাতাস ভরা।

জয়িতার মনে হলো, তার লেখাগুলো তিনি পড়েছেন এবং তা নিয়ে প্রতীকের মাঝে হতাশা আছে। নিজের কথা না বলে পুরো নারীদের পক্ষ নিয়ে জয়িতা তাকে প্রশ্ন করল :

নারীদের সৃজন সামর্থ্য নিয়ে আপনার মনে কোনো সন্দেহ আছে?

নেই। নারীদের চেয়ে পুরুষরা সৃজনের সঙ্গে কখনও বেশি সম্পৃক্ত নয়। তবে সৃষ্টির উৎকর্ষতা অথবা সামর্থ্য নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণে পুরুষরা এগিয়ে।

কারণ, নারীর সৃজন বলতে পুরুষরা নিজেদের সেবা করাকেই বোঝায়। নকশিকাঁথা, বিয়ের গীত এবং বিয়ের উপঢৌকন সাজানোয় নারীর একক কৃতিত্ব তাদের কাছে কখনই মূল্যায়িত হয়নি।

সমাজবিদগণ আবিষ্কার করেছেন যে, আদিকালে পুরুষরা যখন শিকার করে শুধু মাংস জোগাড় করত তখন ধান এবং গমের আবাদ সৃষ্টি হয়েছে নারীদের হাতে। আজ সারাদিন পৃথিবীতে যত মাংস ভক্ষিত হলো তার চেয়ে অনেক বেশিগুণ ধান এবং গমের প্রয়োজন হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রান্তে সৃষ্টিশীল মানুষ ছাড়া পুরুষদের অলস বসে থাকতে দেখা গেলেও নারীদের তার পরিপার্শ্বকে সুন্দর করে দৃষ্টিনন্দন করে গুছিয়ে রাখতে দেখা গেছে।

এসব বলে তার সৃজনের মূল্যকে আমরা তার কর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছি।

জয়িতা, নারীর সৃজনকে মূল্যায়নের আগে আমরা যে ভুলটা করি, তা হলো, তার চারিত্রিক এবং প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যকে আমরা আমলেই নেই না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে নারী এবং পুরুষের

সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেখানেও কি নারীর সৃষ্টি-সমর্থতা একই মাত্রার? পুরুষের নোবেল-পুরস্কারপ্রাপ্তির পাশে নারীর নোবেলপ্রাপ্তি কম হলে কিছু আসে যায় না। পুরস্কার দিয়ে মানবজাতির উৎকর্ষতা নির্ণীত হয় না। কাজ দিয়ে হয়, কিন্তু…

কিন্তু তাদের কাজের ধরনে স্রষ্টা অথবা প্রকৃতি একটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন এবং সেখানেই নারী মহান। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইনস্টাইন থেকে পৃথিবীতে এমন কোনো মহাবীর কি নারীর গর্ভের সযত্ন লালন ছাড়া শিল্পী-বিজ্ঞানী তো পরের কথা, এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পারতেন? আর এক মানব ভ্রূণের জটিল সৃজন প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্রষ্টা নারীকেই বেছে নিয়েছেন বলে পুরুষরা যদি এই বলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন যে, তাদের কেন সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো? আর নারীরা যদি এই বলে আফসোস করেন যে, হোমারের মতো মহান একজন লেখক কেন মহাবীর হিসেবে অ্যাকুয়োলিসকে সৃষ্টি করলেন? কেন কোনো নারীকে নয়? তাহলে তো কাজ হবে না। এখন পর্যন্ত মহাপরাক্রমশালী আমেরিকা কোনো সম্মুখ সমরে নারীকে পাঠায় না। কিন্তু, বিশ্বের এমন কোনো প্রান্তে, আকাশের কোনো সীমানায়, জলের কোনো অসীমতায় একজন পুরুষ মহাবীরের মতো যুদ্ধ করেছে, নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে – তার মা অথবা অন্য কোনো নারীর অস্তিত্ব তার ভেতরে তীব্রভাবে অনুভব না করা পর্যন্ত?

কথাগুলো জয়িতাকে তার সমূলে কাঁপিয়ে দিলো। তার কণ্ঠে ভর করল ঔপন্যাসিকের সুর ও স্বর – এখন আমারও বলতে ইচ্ছা করছে পৃথিবীর কোন চারণ কবি, মহাসাধক আর মহান একজন কথাশিল্পী অন্যের অস্তিত্বে, তার অনুভবে প্রবল অনুভবের তোলপাড় তুলেছেন তার মাঝে একজন নারীর আকুল উপস্থিতি ছাড়া! স্যার, এখন তাহলে একটা প্রশ্ন করি? কোন সেই নারী, যার জন্য আপনি জাগতিক এক ভুবন ছেড়ে এই নির্জনে শব্দে-শব্দে নিজের ভেতরকে খুঁজে ফেরেন। কোন সেই নারী, যার জন্য লাইনের পর লাইনে মূর্ত করে চলেন জীবনের অন্তরালের জীবনকে?

জয়িতার প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলেন তিনি। বিকেলে অপূর্বকে কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি এক অনন্য স্মৃতিলোকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, তাকে এভাবেই কাঁধে তুলে নিয়ে তার বাবা নদীটার পাড়ে ঘুরতেন। বাবার রেখে-যাওয়া ছবিতে আছে, তার দাদার কাঁধে বসে আছেন তার পাঁচ বছর বয়সী হাস্যোজ্জ্বল বাবা। দাদা এই নদীটার পাশে হাঁটছেন। দূরে সরিষাক্ষেতে হলুদ ফুলের সমারোহ আর নদীতে তখন অনেক জল। অপূর্বকে কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি যেন তার রক্তস্রোতের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। অনুভব করেছিলেন, বহুকাল আগে এমনি এক শীতের বিকেলে তার দাদা নন বরং তার বাবাই তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছেন। তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। তিনি এখন কী উত্তর দেবেন জয়িতাকে? আবেগে রুদ্ধ কণ্ঠকে তিনি কষ্ট করে সামলে নিলেন। বললেন :

না, জয়িতা আমার এই নারী, প্রেরণার মূলে থাকা অন্য কোনো নারীর মতো নন। তিনি আমার বড় বোন। তিনিই ছিলেন আমার মা।

আমি আমার গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার গল্পটা জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।

না, আমার গল্পের চেয়ে আমি আপনার গল্পটা শোনার জন্য বসে আছি।

আমার গল্প শুনে কিছু উপলব্ধ হবে না। তবে পাঁচ মিনিটের জন্য আমাকে আপনার সামনে নির্লজ্জ হয়ে যেতে হবে।

মানে?

আমার পুরো শরীরের এক-একটা ক্ষতে লুকিয়ে আছে আমার জীবনের গল্প। সেই গল্পগুলো না বলে আমি আপনাকে দেখাতে চাই। আমি নিশ্চিত, আপনার সামনে, একজন শিল্পীর সামনে পুরো নগ্ন হতে আমার কোনো লজ্জা কাজ করবে না, শুধু কান্না পাবে। গল্পকারের সামনে গল্প নিজেকে অবারিত করলে তাতে পাপ হয় না।

কথাগুলো বলে জয়িতার কী হলো, সে কেঁপে-কেঁপে উঠল। তার শরীরের বাঁকে-বাঁকে জেগে-ওঠা কান্না লুকানোর কসরত করল। প্রতীক চেয়ারটা টেনে তার কাছে বসে জয়িতার হাত মায়াভরে দুই মুঠের মধ্যে নিয়ে বলল :

আমি সেই নিষ্ঠুর পুরুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছি, যে আপনার মতো অনন্য মননের মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পেরেছে। এ ছাড়া আর কী করার আছে? আমাদের এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এখন তো আমাদের প্রতিবাদের স্বরকে নিখুঁতভাবে কেটে ফেলেছে। একজন পুরুষ হয়ে আমি সেই পুরুষের জন্য লজ্জিত।

 

জয়িতা কেন যেন হঠাৎ বলে বসল, আপনিও কম নিষ্ঠুর নন। আমি? নিষ্ঠুর! হ্যাঁ, আপনি তার চেয়েও নিষ্ঠুর, যে আমার শরীরের নারীসুলভ ন্যুব্জ অংশগুলো ক্ষত-বিক্ষত করেছে। শব্দ দিয়ে এত অনন্য জগৎ যিনি নির্মাণ করতে জানেন, তিনি যদি তাঁর পাশে বহমান এক ঝরনাধারার কলকল ধ্বনি শুনতে না জানেন; যিনি অনবদ্য চরিত্রের জন্ম দেন তাঁর পাশে বাস করা এক অনিন্দ্যসুন্দর আর ঢলঢল লাবণ্যের প্রাণময়তায় পরিপূর্ণ এক নারীর অন্তর্লোকের যাতনার সঙ্গী না হোন – তাহলে তিনি নিষ্ঠুর নিঃসন্দেহে। বাইরের সমগ্র নারী জাতিকে মহান ভেবে, তাদের সম্মান দেখিয়ে কী লাভ, যদি আপনি আপনার পাশে বাস করা নারীর যত্ন আর ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে না পারেন।

প্রতীক জয়িতার হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করলেন। জয়িতা তার দুহাতের ভেতর জেগে থাকা প্রতীকের উষ্ণতা না হারানোর জন্য হাতদুটো চাদরের ভেতর নিয়ে নিজের বুকের কাছে নিল।

চাঁদের আধো-আলোতেও তারা এখন একে অন্যের কাছে স্পষ্ট। জয়িতা প্রতীকের অভিব্যক্তি ভালো করে খেয়াল করল। তিনি কোনো এক অতীত ঘোরের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। দু-একবার অসহায় ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন জয়িতার মুখের দিকে। তার মায়াবী আর করুণ দৃষ্টি সংবেদনশীল জয়িতার হৃদয় আর্দ্র করে তুলল। অপূর্বকে কাঁধে নিয়ে প্রতীক বিকেলের মস্নান আলোয় যখন হাঁটছিলেন, সেই হাঁটার ক্ষণ তার মানসপটে চিত্রকল্পের মতো ভেসে উঠল। সে এবার নিজের হাত চাদরের ভেতর থেকে বের করে প্রতীকের হাত দুটো ধরে দয়ালু কণ্ঠে বলল :

আমি দুঃখিত। এত প্রিয় একজন মানুষের কষ্ট থাকুক, আমি তা মানতে পারিনি বলে এত শ্রদ্ধেয় সেই মানুষটাকে কথা দিয়ে আঘাত করতে দ্বিধা করিনি। আমি এখন লজ্জা পাচ্ছি। একটা কথা বললে আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন, যে-রাতে আমাকে বীভৎস কায়দায় ধর্ষণ করা হচ্ছিল সেই রাতে আমি শারীরিক লাঞ্ছনার ঊর্ধ্বে ওঠে মনে-মনে আপনার সৃষ্ট এক নারী চরিত্রকে ধর্ষণের বর্ণনার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে ঈশ্বর মেনেছিলাম। আমি আমার সেই প্রিয় আর ঐশ্বরিক সত্তাসম্পন্ন মানুষের সামনে বসে… আই’ম সরি।

জয়িতার কথায় লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন প্রতীক। তার চোখ ভেজা কিনা জয়িতা বুঝল না। তবে তার কণ্ঠ ভিজে আছে। তিনি ভেজা-ভেজা কণ্ঠকে স্বাভাবিক করতে-করতে বলে চললেন :

জয়িতা! এই নামটা আমার জীবনে বারবার ঘুরেফিরে আমাকে এত বিষণ্ণতার জগতে ঢুকে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে বুঝতে পারিনি। আমার নির্মোহ যা আপনার কাছে নিষ্ঠুরতা তা হয়ে ওঠার গল্পটা আপনাকে শোনাই তবে। কিন্তু গল্পটা শুরুর আগে ১৪ ডিসেম্বর, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা – এই শব্দগুলো আমাকে আনমনা করে তুলছে। শব্দগুলো সারাজীবন আমার খাঁ-খাঁ বুকের প্রান্তে চৈত্রের শনশন হয়ে বয়েই চলছে। সেখানে আর কোনোদিন বৃষ্টি নামল না।

আপনি জয়িতা নামটা নিয়ে কথা বলছিলেন।

হ্যাঁ, জয়িতা। বাবা, খুব ভালোবেসে তার বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন ‘জয়িতা’। বাবা হয়তো নারীমুক্তি নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। তাই মেয়ের অমন নাম রেখেছিলেন। একাত্তরে জীবন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে তারা যে স্বপ্নের বীজ রেখে গেলেন, সেই স্বপ্নকে এই রাষ্ট্র গিলে খেয়েছে। এই রাষ্ট্রে জয়িতা শব্দের মানে এখন, পরাজয়ে যার জয় নিশ্চিত হয়।

তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। জয়িতা তার হাত ধরে গুম মেরে বসে আছে। যেন ভুলে গেছে সে কোথায়, এটা রাত না মহারাত? পুনরায় লম্বা শ্বাস নিতে গিয়ে প্রতীকের হৃৎস্পন্দন যেন হঠাৎ ফুসফুসের ভুল কোনো অলিন্দে গিয়ে তালগোল পাকাল। তাতে তার বুকের মাঝে কেমন এক অস্থিরতা তিনি অনুভব করলেন। তবু শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন :

বাবা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি মার কোলে মাত্র সাত মাসের শিশুসন্তান। আমার বড় বোন জয়িতার তখন এগারো চলছিল। একাত্তর সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। মা বাধা দিতে গিয়ে শুধু জীবন হারালেন না, মৃত্যুর আগে মা’কে তারা লাঞ্ছিত করল। সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হলো। এই গ্রামে এসে আমার মাত্র এগারো বছরের বোন আমার মা হয়ে গেল। না-ই বা জানলেন আরো এক জয়িতার সেই জীবন-সংগ্রামের পর্বটুকু। তার জীবনে একসময় আনন্দের ক্ষণ এলো। আমার তখন এগারো বছর। রাষ্ট্র বড় করে অনুষ্ঠান করে শহীদ পরিবারদের সম্মান জানানোর আয়োজন করেছে। এখানে, ঠিক এখানে তখন আমাদের মাটির ভাঙা বাড়িতে আমাদের দুই ভাইবোনের ছোট্ট সংসার। পেনশনের এককালীন টাকায় সে আশপাশের পরিত্যক্ত বাস্ত্তভিটায় ফুলের চাষ করেছিল। কী জানি, ফুল চাষ করে অর্থ উপার্জন তার কাছে বড় ছিল নাকি বাবার দেওয়া পবিত্র রক্তকে মাটি থেকে ফুলের রঙে স্বপ্ন করার প্রত্যাশায় সে এত অল্প বয়সে অমন কাজে হাত দিয়েছিল। খাওয়া-পরার বাইরে আমার মায়ের মতো বোনটার নিজেকে সাজানোর জন্য তেমন কোনো দ্রব্য বা শাড়ি-কাপড় কিছুই ছিল না। সুতরাং তার প্রয়োজনে এ-বাড়িতে থেকে শাড়ি, সে-বাড়ি থেকে ইমিটেশনের গহনা-পাউডার এলো। সেই ছিল আমার বোনের প্রথম এবং শেষবার সাজা। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলাম :

আপু, তুমি এমন পরীর মতো সুন্দর!

আমার বোন আমার কথা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল :

দেখতে হবে না, আমি যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটির বোন!

সম্মাননা নিতে গিয়ে আমার সেই বোনটি আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। তাকে অসম্মান করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সেই অনুষ্ঠান যারা আয়োজন করেছিলেন তাদেরই স্তাবকদের দৃষ্টি পড়েছিল জয়িতার ওপর।

এটুকু বলে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন প্রতীক। জয়িতা নিঃশব্দতা ভাঙল,

তারপর?

ফিরে আসার পথে তারা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল। বাবার রেখে-যাওয়া স্বপ্নের আগুন আমার বোনকে পুড়িয়ে শেষ করেছিল। জয়িতা নামকে সার্থক করতে তার সামনে রাষ্ট্র আত্মহনন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা রাখেনি বলে আমার বোন…। দেখুন, যাদের জন্য আমার বাবা তার জীবন দিয়েছিলেন তারা সেই এগারো বছর বয়সে আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিকের জন্য কী মহান এক সৃজনের পথ করে দিয়েছিল!

টল-টল জলে ভরে উঠল জয়িতার দুচোখ। যে-মানুষটা তাকে জীবনে বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তার জীবনের অন্তরালে লুকানো এমন দুঃখগাথা তার অন্তরে রিনরিন ব্যথা হয়ে বেজেই চলল। কখন সে হাতদুটো প্রতীকের হাত থেকে বিযুক্ত করে নিয়েছিল। মাথার চুলের মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে ডানহাতে চাদর নিয়ে জয়িতা মুখ ঢেকে নিয়েছিল। প্রতীক তার হাত ধরে তাকে ওঠালেন। তার ফোলা-ফোলা লালচে হয়ে ওঠা চোখগুলো স্পষ্ট করে না দেখতে পেলেও তিনি তাকে বললেন :

রাষ্ট্র একদিন যুদ্ধাপরাধীদের হয়তো বিচার করবে। কিন্তু যে-রাষ্ট্রটা আমাদের হয়ে উঠল সেই রাষ্ট্র এমন ঘটনা যদি রাজনৈতিক স্বার্থে আড়াল করে নচ্ছারদের অট্টহাসিকে প্রকট করে তোলে, তার বিচার কে করবে? যাহোক, এক জয়িতার জন্য অনেক-অনেক বছর আমার হৃদয় কেঁদেছে। আর কোনো জয়িতার কান্না নেওয়ার জন্য আমার হৃদয়ে আর কোনো স্থিতিস্থাপকতা নেই। জয়িতাদের কান্না না শোনার জন্যই আমার এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন।

ধরে আসা কণ্ঠে জয়িতা বলল, এটা একটা ভুল দর্শন। জীবন থেকে পালিয়ে নয়, যুদ্ধ করেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। একজন মহান কথাশিল্পী তাদের সঙ্গে আর পাশে থাকলেই জয়িতারা জিতে যায়। কিন্তু এ-ও তো সত্যি, আপনার মতো একজন কথাশিল্পীর চেয়ে মানুষের মননে একজন বিজ্ঞানীও বাস করেন। সংখ্যায় তারা কম হলেও তাদের অফুরান ভালোবাসা একজন কথাশিল্পীর জন্য বড় অনুপ্রেরণা হয়ে তার

জীবনকে পরিপূর্ণ আর সার্থক করে তোলে। মানুষ জন্মে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে। যারা তা অর্জন করেন তাদের চেয়ে মহৎ জীবন আর কার আছে?

কিন্তু জয়িতা, আমার বোনের লাঞ্ছনার স্মৃতি বাবার স্বপ্নকে এত তীব্র উপহাস করে আমার শরীরে আর মনে বাস করে যে, এখানে অবসাদ আর বিষাদ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

বোনকে হারানোর পর আপনি এখানে একা ছিলেন?

জীবনের একমাত্র সম্বল আর ভালোবাসার আশ্রয় আমার বোনকে হারানোর পর আমার বাবার বন্ধু আহসান অ্যাংকেল আমাকে আবার ঢাকায় নিয়ে গেলেন। জয়িতা তখন মাত্র জন্মেছে। জয়িতার নাম তিনি ‘জয়িতা’ রেখেছিলেন বাবার স্বপ্নকে, জয়িতার পরাজয়কে না মেনে নিতে। তারা আমাকে পুত্রের স্নেহে বড় করলেন। তাদের প্রতি আমি এত কৃতজ্ঞ! তবু আমার করার কিছু নেই।

জয়িতা প্রতীককে আর কিছু বলল না। নারীর সৃজনের সর্বোৎকৃষ্ট উপাদানকে সে কাজে লাগানোর জন্য বদ্ধপরিকর হলো। প্রতীকের হৃদয় আর মন থেকে অবসাদ আর বিষাদ কাটিয়ে সে সেখানে জীবন-উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মনে-মনে পরবর্তী করণীয় গুছিয়ে নিল। জয়িতা আহসান শান্তা এসে তাদের খাবারের জন্য ডেকে গেল। নিচতলার উদ্দেশে ছায়াসঙ্গীর মতো তার পাশে যেতে-যেতে জয়িতা বলল :

আমি আর এক সপ্তাহ থাকব। এই এক সপ্তাহে আমি কোনো বেলার খাবার আপনাকে আর শান্তাকে ছাড়া খেতে চাই না। আশা করি আমার এইটুকু চাওয়া পূরণ হবে।

 

পাঁচ

কয়েকদিন তারা একসঙ্গে শুধু খেলই না, বিকেলে হাঁটতে-হাঁটতে অর্কিড-গোলাপের বিশাল চত্বর পেরিয়ে গ্রামের মাঠ, সরিষাক্ষেত আর নদীর ঘাট হয়ে পতিত জমিতে লাগানো বড়-বড় আম-মেহগনির বাগান হয়ে বাসায় ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা করল। ঢাকার চাকার জীবনে অভ্যস্ত জয়িতার পা নামের চাকাদুটো যে প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছে তা সে তাদের সঙ্গে, এমনকি অপূর্বর সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে টের পেল। প্রতিদিন আট-দশ কিমি হাঁটার পর তার পা শুধু নয়, সারাশরীর ব্যথা করে। কিন্তু এই ব্যথার মাঝে কী এক আবেশ লুকানো। গ্রামের ভেজালমুক্ত জৈব খাবার এবং বাগানের পাশে নিজেদের পুকুরের মাছের স্বাদে তার শরীরের সংবেদনশীলতাও যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। শীতের নিস্তব্ধ মায়াবী রাতে কম্বলের মাঝে মা-ছেলের উষ্ণতায় যেন চাঁদের রুপালি আস্তরণ মহাকালের কাছ থেকে পাওয়া আশিস ঢেলে চলছে।

আজ ভরা পূর্ণিমার এক মধ্যরাত। আকাশ আজ কুয়াশা আর জোছনার রহস্যময়তায় পৃথিবীকে, এই ফুলে-ফুলে ভরা বাগানকে রহস্যম–ত করে রেখেছে। জয়িতা ঢিলেঢালা ডিভাইডারের ওপর শান্তার পাতলা রাতপোশাক পরে শুয়েছিল। কম্বলের ভেতর থেকে সে উঠে বসল। অপূর্বর গায়ে ভালো করে কম্বলটা জড়িয়ে দিয়ে নিজের গায়ে শাল জড়িয়ে নিয়ে সন্তর্পণে সে ভেজানো দরজা পেরিয়ে প্রতীকের ঘরের দরজা আলতো ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের সব আলো নিভিয়ে গভীর অন্ধকারে প্রতীকের ঘুমানোর অভ্যাস। তাতে নাকি তার ঘুম গভীর হয় এবং লেখার সময় তার ব্রেনের গভীরতর অংশ পর্যাপ্ত সক্রিয় থাকে।

তবু বাইরের মৃদু চাঁদের আলোর জন্য ঘরের মাঝে সেই নিকষ কালো ভাবটা আজ নেই। জয়িতা দ্বিধাহীন হয়ে শালটা গা থেকে ফেলে দিলো। তারপর কম্বলের প্রান্ত টেনে প্রতীকের কোলে জড়ানো কোল-বালিশ ফেলে দিয়ে তার স্থানে নিজের শরীরটা প্রতিস্থাপন করল। অন্ধকারেই দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সে প্রতীককে দেখল। ক্রমশ বদলে যেতে থাকল জয়িতার চোখের ভাষা। সে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে তার ভেতরে মিশে যেতে চাইল।

নারীর ত্বক-চুলের প্রথম পাওয়া গন্ধে স্বপ্নঘোরের মাঝে প্রতীক জয়িতাকে জড়িয়ে ধরল। তার বিভাছড়ানো মুখের কাছে আর মেঘসম বিশ্রস্ত চুলের ভেতর সে নিজেকে হারাতে থাকল। সে হারিয়ে গেল চাঁদের আলোকে ফাঁকি দিয়ে বয়ে চলা মহান সময়ের ভেতর। আরো এক আগামী প্রজন্মের ভেতর। প্রতীক হারিয়ে গেল তার হারিয়ে-যাওয়া স্বপ্নের ভেতর। হারিয়ে যেতে-যেতেই বলল :

আমার জয়ি, আরো আগে কেন তুমি আমার বুকের মাঝে বাসা বাঁধা এই অবসাদকে এমন করে ভেঙে, গুঁড়িয়ে দাওনি! কেন সাত বছর সময় নিলে? তোমার চেয়ে অনিন্দ্য করে স্রষ্টা পৃথিবীতে যে আর কিছুই সৃষ্টি করেননি!

ভোররাতে প্রতীক যখন অতল ঘুমে তখন জয়িতা তার দুচোখে আলতো চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, সৃজনের জন্য, তার সৃষ্টিকে ধারণের এবং প্রবহমান রাখার জন্য স্রষ্টা নারীর গর্ভকেই বেছে নিয়েছেন। ভয় পেয়ো না, নারীর গর্ভ শ্রেষ্ঠ বীজটাকেই অঙ্কুরোদ্গম করতে চায়। ধর্ষক নয়, নারীকে সম্মান করতে জানা পুরুষরাই জিতে যায় বলে স্বপ্ন কোনোদিন হারিয়ে যাবে না। সৃজনের, স্বপ্নকে লালনের এবং স্রষ্টার সৃষ্টিকে ধারণের অধিকার স্রষ্টা স্বয়ং নারীকে দিয়েছেন। তারাই নির্ধারণ করবে পৃথিবীতে কাদের বংশস্রোত প্রবাহিত হবে…

মেঝেতে ফেলে-দেওয়া শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল জয়িতা। ফিরে আসার আগে ছলছল চোখে পুনরায় প্রতীকের কপালে চুমো দিয়ে

মনে-মনে বলল :

পাপ যদি হয়, তার উত্তর স্রষ্টাকে আমি দেব। তাকে বলব, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইনস্টাইন থেকে পৃথিবীতে এমন কোনো মহাবীর নারীর গর্ভের সযত্ন লালন ছাড়া কে জন্মেছে! আমার গর্ভ আজ থেকে সযত্নে লালন করবে আগামী দিনের আরো এক শিল্পময় মানব-সত্তাকে।

ঘরে ফিরে এসে কম্বলের মধ্য ঢুকতে-ঢুকতে জয়িতার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। মনে-মনে সে শোধ নেওয়ার ভঙ্গিতে অদৃশ্য এক মুখ কল্পনা করে কথোপকথন চালিয়ে গেল,

আর তিন মাস পর তোমাকে তালাকপত্র পাঠাব। আমার গর্ভের সন্তান নিয়ে কারো মাথাব্যথা না থাকলেও তুমি আকাশের কাছে হাপিত্যেশ করে ফিরবে অথচ কোনোদিন এই রহস্য জানবে না… এই-ই তোমার শাস্তি।

দুদিন পর ঢাকায় ফিরে আসার আগের রাতে জয়িতা চুপি-চুপি প্রতীকের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কানকে উন্মুখ করতেই জয়িতা শুনল; জয়িতা আহসান শান্তা তাকে বলছে :

উফ! তুমি হঠাৎ এমন দুষ্টু হলে কীভাবে, বলো তো? সামান্য এক কম্পোজারের সঙ্গে একজন ঔপন্যাসিকের এমন কাজ কি মানাচ্ছে, স্যার?

প্রতীক জয়িতা আহসানকে বলছেন,

কম্পোজার যদি মধ্যরাতেও ঔপন্যাসিকের শরীর-মনকে এভাবে ডিসপোজ করে যে…

সত্যি বলছি, আমি নই আমার ভূত এসেছে তোমার কাছে। সাত বছরের স্বপ্নরা আর কতকাল স্বপ্ন হয়ে বসে থাকে বলো? ওরা তো ভূত হবেই। ভূতের হাত থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করো…

হুম, জয়িতাকে বলো, বিয়ের ঝামেলা শেষ না করে তার আর ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না…

কথাগুলো শুনে জয়িতার মনে কলকল আনন্দস্রোত বয়ে গেল। সে ঘরে ফিরে গেল। অনেকদিন পর উলস্নসিত একঝাঁক আনন্দ-লহরি যেন তার চারপাশে ডানা মেলেছে। সেই আনন্দের রেশ ধরেই সে তার স্যুটকেসে গুছিয়ে নেওয়া কাপড়গুলো আবার নামিয়ে আলমিরায় গুছিয়ে রাখতে-রাখতে তবু নিজের অশ্রম্নকে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দিয়ে সংবরণ করে নিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত