বৈশাখের এক ঝিমধরা তপ্ত দুপুরে ফ্ল্যাটবাড়িটি একেবারে নিঝুম হয়ে আছে। সবার চোখে নেমেছে ভাতঘুম। রান্নাঘর থেকে নীলুর মায়েরও কোনো কাজের আওয়াজ নেই।
মাধবী নিঃসাড়ে ঘুমচ্ছে। মাথার ওপরে চক্রের মতো ফ্যান ঘুরছে, তাতে দাবদাহ মোটেও কমছে না। মাধবীর কপালে, গলার খাঁজে বিনবিনে ঘাম। ফ্যানের হাওয়ায়ও যেন গরম ভাপ।
অসোয়াস্তিতে বিছানা ছেড়ে রুদ্রনীল চেয়ারে বসেন। গ্রীষ্মের এই দুপুরগুলো ভারি অদ্ভুত! আপনমনে নীরবে হাসেন, – পিয়ার মতো ছটফটে নাতনিও ঘুমে ঢলে পড়েছে, নয়তো কম্পিউটারের সামনে বসে টুকটাক আওয়াজ করত, ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা জলের বোতল উপুড় করে গলায় ঢালত। নাতি প্রীতম ডাক্তারি পড়ছে। ওর ফিরতে বেশ দেরি হয়, নয়তো ওর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটানো যেত।
এই মুহূর্তে রুদ্রনীল একেবারেই একা। একমাত্র টিভি-ই সদাসঙ্গী তার। টিভিটা অন করে দেখেন সিরিয়াল চলছে। উদ্ভট কা- সব – বাস্তব থেকে বহুদূরে। ওসব কোনোদিন দেখেন না তিনি, বরং দেশের ও বিদেশের খবরাখবর শুনতে বেশি আগ্রহ তাঁর। অনেক সময় মতের মিল না হলেও টক শো দেখতে ও শুনতে তার বেশ লাগে।
টিভি স্ক্রলিংয়ে অবিরত ভেসে যাচ্ছে কিছু খবর। চমকে ওঠেন রুদ্র। খবর না বলে ওগুলোকে দুঃসংবাদ বলাই ঠিক হবে।
গণধর্ষণের শিকার হয়ে কলেজের একটি মেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, আশঙ্কাজনক ওর অবস্থা। বসত্মাবন্দি এত তরুণের মৃতদেহ, বাসচাপায় দুজন কলেজছাত্রের মৃত্যু, রাসত্মা অবরোধ করে রেখেছে সহপাঠীরা।
দুঃসহ এসব খবর দেখতে-দেখতে বুকের ভেতর হালকা চাপ অনুভব করতে থাকেন রুদ্র। এসব হচ্ছেটা কী?
বসত্মাবন্দি রয়েছে যে-ছেলে – সে যখন দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী বাড়িতে ফিরবে না, তখন দুশ্চিমত্মাগ্রস্ত মা-বাবা-স্ত্রী পথের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ওর প্রতীক্ষা করবে। এক সময় জানতে পারবে, কোনোদিন আর ছেলেটি বাড়ি ফিরবে না।
বাসের নিচে চাপা পড়েছে যে-দুটি ছাত্র, ওদের পরিবারের লোকেরা কেমন করে নিজেদের সান্তবনা দিয়ে স্থিতধী রাখবে?
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অনামি মেয়েটি কারো মেয়ে, কারো বোন। সে কেন কতগুলো পাষ–র নিগ্রহের শিকার হবে?
ভাবতে-ভাবতে তার মগজটা তেতে ওঠে। বাইরে নেমে এসেছে সিণগ্ধ বিকেল। ক্যালকনিতে টবের চারাগুলোর পাতা মৃদু হাওয়ায় দুলছে। বুকের ভেতরের দহন তবু তার কমছে না। হাজারো প্রশ্ন ঝমঝম করে দুকানে ঝাপটা দেয়, – এসব হচ্ছেটা কী?
মেয়েটির ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে লোলুপ কজন পুরুষ, ওদের উলস্নসিত শীৎকারে যখন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল হাওয়া, তখন মেয়েটির অসহায় আর্তি আর কান্না হারিয়ে গেছে পৈশাচিক হাসিতে। কল্পনার চোখ দিয়ে ওসব দেখতে-দেখতে তিনি অনুভব করেন, বুকের ভেতরে অসহনীয় এক ব্যথা, কেউ যেন ধারালো বেস্নড দিয়ে হৃৎপি-টা চিরে দিয়েছে।
– আহ্ – নাভিমূল থেকে উত্থিত হওয়া অব্যয়ধ্বনি শুনে বিছানায় উঠে বসেন মাধবী।
– কী? হলো কী তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? এত ঘামছ কেন?
রুদ্র বলেন, তুমি অস্থির হয়ে পড়লে কেন? কিছু হয়নি তো। টিভির খবর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
– ওহ্ – তাই বলো।
টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন মাধবী। ঘুমের আমেজ এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় – কী করে মানুষ এত নির্বিকার থাকে? মাধুরও অনেক মানুষের মতো কোনো চিত্তবৈকল্য নেই।
তার কেন এমন হয়? প্রাণ কেন তার কেঁদে ওঠে? আমি রুদ্রনীল রয় কি অন্যরকম একজন মানুষ? হৃৎপি- থাকলে বুঝি করুণা, প্রেম-ভালোবাসা, সহমর্মিতাবোধ সবার থাকে না, এর জন্য হৃদয়ে ভালোবাসার প্রস্রবণ থাকতে হয়।
এমন নতুন নয়, শুধু খবরের কাগজ কেন, কারো মুখে মন খারাপ করার কথা শুনলে কিছুতেই তিনি ভুলতে পারেন না, বারবার বুকের ভেতর হ্যামারিং করতে থাকে।
ক্ষোভের সঙ্গে তার মনে হতে থাকে – স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য বুঝি মানুষকে এখন প্রার্থনা করতে হবে? পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, এখানে-ওখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। রোগ-জরা তো রয়েছেই। ক্যান্সার, হেপাটাইটিস-বি, কিডনি ফেইলিওর, সোয়াইন ফ্লু, এইডস – মিছিলের মতো ধেয়ে আসছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও যখন-তখন আচমকা ঝাপটা দিয়ে যায়। ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, রিটা, রেকি, নার্গিস – মানুষকে বিপর্যস্ত করতেই আসে।
তাহলে মানুষ মানুষকে খুন-জখম-নির্যাতন করবে কেন? প্রকৃতির থাবায় মানুষ এখন দিশেহারা।
জীবনের চারপাশে যে-বিষবাষ্প ছড়ানো রয়েছে, তা জানতে তো দূরে কোথাও যেতে হয় না। এই তো গেল শীতে কমলা রঙের গাজর, ঘন সবুজ রঙের গাজর, ঘন সবুজ রঙের মটরশুঁটির দানা আর বড়সড় ফুলকপি নিয়ে এসেছিলেন রুদ্র। ছুটির দিন, বউমা পূরবী দারুণ খুশি। মাধবীকে জিজ্ঞেস করে – রুই মাছ দিয়ে আলু-ফুলকপির তরকারি হোক মা, আজ কিন্তু আপনাকেই রাঁধতে হবে। বেশ একটা খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছিল বাড়িতে।
নীলুর মা সবজি কুটতে বসলেই বিপত্তি ঘটে। ফুলকপির ভেতরের দিকে বেগুনি রং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবাই অবাক,
এমন সবজি তো কখনো দেখিনি। রবীন বলে, ফেলে দাও সব, পোকামাকড় মারার বিষাক্ত সার দিয়েছে নিশ্চয়ই, না-হলে ফুলকপিতে এমন রং হয়?
প্রীতম বলে, আজকাল ফরমালিনও দেয় দাদু – তাহলে কী খাব আমরা?
সত্যিই তো – কী খাব আমরা?
সযত্নে ব্যাগভর্তি বাজার এনেছিলেন রুদ্র। নতুন আলু, ব্রোকোলি, ক্যাপসিকাম – কোন সবজির ভেতর ফরমালিন দেওয়া আছে কে জানে!
অফিস কলিগ ওমর তো প্রায়ই বলত, আমরা যে বেঁচে আছি – এটাই আশ্চর্য। সবকিছুতে ফরমালিন দেওয়া। জিলিপি নাকি এখন মবিল দিয়ে ভাজা হয়। কালচে হয়ে যাওয়া পোড়া তেল দিয়ে চপ ভাজা হয় – তাহলে খাবটা কী?
ইউসুফ এসব কথা শুনে বলেন, আমরা বেঁচে আছি কী করে, তাই তো ভাবি ওমর।
রুদ্র বলেন, আমরা যে বেঁচে আছি – এই-ই তো আশ্চর্যের ব্যাপার। আই থিংক, আমাদের স্টমাক খুব স্ট্রং।
অ্যাকাউন্টস সেকশনে কাজ করতেন আমীরুল। গভীর চিমত্মাভাবনার মানুষ। তিনি বলেন, দিনের পর দিন ভেজাল খাবার খেতে-খেতে কি হবে জানো? শরীরের বিভিন্ন অরগ্যানগুলো ফেল করতে থাকবে, ডাক্তারি টেস্টেও কোনোকিছু ধরা পড়বে না। শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিডোটও নাকি কাজ করবে না। আঁতকে উঠেছিলেন তিন সহকর্মী। ওমর, ইউসুফ ও রুদ্র। এই কিছুদিন আগেও শরীর সবল ছিল সবার, তখন ডায়াবেটিস-প্রেসার রুদ্রকে কাবু করতে পারেনি, ওমরের স্ট্রোক হয়নি, অস্টোপরোসিসে ইশতিয়াককে এতটা কষ্ট পেতে হয়নি, ইউসুফের স্ত্রী-বিয়োগ হয়নি, অ্যাজমায় ইউসুফ ততটা কাতর হননি। বয়স হলেও ওরা ছিলেন মানসিকভাবে সবল, শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ। রোজ কাঁচাভোরে প্রভাতি হাওয়া গায়ে মেখে রমনা পার্কে গিয়ে দুচক্কর হেঁটে গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরতেন। ওমর জিজ্ঞেস করেছিলেন, আরে বাবা, অ্যান্টিডোট আবার কী? কথায়-কথায় অতো শক্ত ইংরেজি বলবি না তো। আমীরুল বলেন – প্রতিষেধক ওষুধেও কাজ হয় না, তাই বললাম। শক্ত কিছু বলিনি তো।
গ্রীষ্মের উত্তাপ প্রখর আর নেই। মৃদু হাওয়ার ছোঁয়া-লাগা কোমল সন্ধ্যায় ফেলে আসা স্মৃতির স্পন্দনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রায় সমবয়সী কলিগরা এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এই বিরহকালে বুকের ভেতর স্বরচিত প্রশ্ন জাগে – চারপাশে এই মৃত্যুর ডামাডোলের পরও এত খুনখারাবি, বসত্মাবন্দি লাশ, বালিকা-বয়সী মেয়েকে নির্যাতন করে সেই বীভৎস ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া – এসব বিকৃত রুচির পরিসমাপ্তি কোনো দিন ঘটবে কি? না-হলে যে এ-ব্রহ্মা–র সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রহে একদিন নেমে আসবে বিষণ্ণতার পীতাভ ছায়া। চায়ের পেয়ালা আর সুগার-ফ্রি দুটো বিস্কিট নিয়ে আসে পিয়া।
রিমোট হাতে নিয়ে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছে প্রীতম।
পিয়া মৃদুগলায় জিজ্ঞেস করে, এত মনমরা হয়ে আছ কেন দাদু? ঠাম্মার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?
মাধবী বলেন, আমি মোটেও ঝগড়া করি না পিয়া, সে তো তুমি জানো। আসলে তোমার দাদু খবর দেখে খুব মন খারাপ করেছে। এদিকে-ওদিকে রোজ মানুষ মারা যাচ্ছে – এসব দেখে কি আর মন ভালো থাকে?
প্রীতম বলে, দাদু – ম্যান ইজ মরটাল, মানুষ মরণশীল। এ নিয়ে ভেবে কী লাভ আছে? শুধু-শুধু কষ্ট পাওয়া। পিয়া মৃদুস্বরে বলে, ও-কথা বলিস না দাদা, সবার তো আর তোমার মতো স্টোনের হার্ট নয়। হৃদয় যাদের আছে তাদের তো কষ্ট হবেই।
দাদুর গলা জড়িয়ে পিয়া বলে, ইসস্ দাদু – তোমার মতো মন যদি সবার থাকত, পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো বল তো!
কিশোরী নাতনির একটু স্পর্শ, দুটি মিষ্টি কথায় মন ভরে যায় রুদ্রনীলের। এই দুষ্টু-মিষ্টি নাতনিটাই তাকে কিছুটা বোঝে।
দুপুরের সেই অসহনীয় তাপ, টিভির স্ক্রলিংয়ে দেখানো মন খারাপ করা সংবাদ রাতের সিণগ্ধতার মাঝে মিইয়ে যায়।
দুই
প্রাত্যহিক জীবনযাপনে এক ধরনের মাদকতা আছে। ছেলে রবীন ব্যাংকে যাবে, বউমা পূরবী স্কুলে পড়ায়, পিয়া কলেজে, প্রীতম ডিএমসিতে যাবে। – আমি কি ডিম পোচ খাই? পোচ আমি খাব না। প্রীতমের গলা, – আমি আজ বেশি করে পেঁয়াজকুচি, টমেটো-কাঁচালংকা দিয়ে ওমলেট খাব।
পূরবী তৈরি হতে-হতে বিরক্ত হয়ে বলে, সব সময় নিজের মর্জিমতো চলতে হয় না পিয়া, অ্যাডজাস্ট করতে শেখো।
নীলুর মা একা হিমশিম খায় বলে সকালবেলা মাধবী অনেকটা কাজে স্বেচ্ছায় হাত দেন। বলেন, পিয়ামণি, আমাদের সময় স্কুলের গুরুমা শেখাতেন, অ্যাডাপ্টিবিলিটি হলো মানুষের বড় গুণ।
ঠাম্মা আধুনিকমনস্ক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতেন। তার কোনো কথাতেই রাগ করে না পিয়া। মুখ ভার করে বলে, হ্যাঁ ব্রাউন আটার রুটি খেতে হবে। কেন ঠাম্মা – লুচি করতে পারো না? আমি কি ডিম পোচ খাই? মাসি ওমলেট করতে পারল না?
প্রীতম কাঁধে ঢাউস ব্যাগটা নিয়ে বলে, মা-ঠাম্মা আসছি, দাদু আসছি।
মুখ ভার করা বোনের কানের কাছে বেসুরোতে গেয়ে ওঠে – ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’ – ভালো হবে না দাদা, দেখেছ মা – তোমার প্রীতু কী করছে? তাও যদি গানের গলা থাকত।
ঘরে বসে সকালের এই জমজমাট আসরের ছোটাছুটি, খুনসুটি শুনতে-শুনতে রুদ্রনীল রোমাঞ্চকর এই প্রাণমত্ততা উপভোগ করেন। পারিবারিক এই প্রাণময়তা ভুলিয়ে দেয় বয়সের রোগ-শোকের জ্বালা, একাকিত্বের যন্ত্রণা। প্রিয়-পরিজনের অবহেলা।
মাধবী প্রায়ই বলেন, পৃথিবী তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না, বদলাবেই – আমি-তুমি হাজার চেষ্টা করেও তো তা রুখতে পারব না। হ্যাঁ মানি – লোভ-লালসা বেড়েছে, হিংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন বাপু? একটুতেই যখন কষ্ট পাও তো খবর না দেখলেই পারো।
হ্যাঁ – তাই করব। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেন রুদ্র। ঘরের এককোণে রাখা বস্ন্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি আজ আর খুলবেন না, কিছুই তো করতে পারব না, অযথা মন খারাপ করে লাভ কী?
তাহলে কি আমি এসকেপিস্ট? পলায়নি মনোবৃত্তি আমার? মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করার শক্তি …
নিজের মনোবিশেস্নষণ করার আগে বাড়িতে ফিরে আসে পূরবী। তিন-চারজন মেয়ের সঙ্গে ফিরল পিয়া, – কী দাদু – কেমন আছ?
খুশি হয়ে ওঠেন রুদ্র। মানুষজনের কাছাকাছি থাকতে আজকাল ভালো লাগে। একা থাকলেই নানা এলেবেলে ভাবনা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। খুশি হয়ে বলেন, দিদিদের সঙ্গে আজ চা খাই মাধু।
ডল-মুমু-জেনিফার উসখুস করতে থাকে। মাধবী বলেন, তুমিও যেমন, বুড়ো-বুড়ির সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলতে ভাল্লাগে – বলো। – না না – সে কী? মোটেও নয়।
ডাইনিং স্পেসে বসে ওরা গল্প করছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে কখনো-কখনো – এই হাসিখুশি আর আনন্দের ছোঁয়া বাড়িটিকে অন্যরকম করে তুলেছে। রুদ্রও এতে শরিক হন।
প্রীতম ডাক্তারি পাশ করে দেশের বাইরে যাবে পড়াশোনা করতে। এলেবেলে গল্প এদিকেই গড়িয়ে যেতে থাকে। সামনে বড় বাটিতে মুড়িমাখা, পাঁপর, কাজুবাদামের পেস্নট। হাতে-হাতে স্ট্রং লিকারের কফির মগ।
রুদ্র বলেন, ‘বউমা আমাকে হালকা চায়ের লিকার দাও। মাধবী বলেন, বিদেশের জন্য তোরা এত পাগল কেন দাদু? কী করতে যাস?
প্রীতমের বন্ধু পলিন বলে, সোনার হরিণ ধরতে। ডল বলে, তুমিও যাবে পলিন ভাইয়া? – অফকোর্স। কারণ ইট ইজ অ্যা স্ট্যাটাস সিম্বল। রুদ্রনীল গম্ভীর মুখে বলেন, সবাই যাচ্ছে, সবাই ছুটছে – আধুনিক জীবনের মানেই হলো গতি। তাই না দাদুভাই? – দ্যাটস রাইট।
পূরবী বলে, প্রীতু, পাশ করে বিদেশ যাবি যা, দু-তিন বছর পর এসে ফুটুনি করিস না। মনে আছে নীয়নের কথা? পূরবীর বড় বোনের ছেলে নীয়ন, নিউইয়র্কে থাকে।
পিয়া বলে, নীয়নদাদা কী করেছে মা? বলো না মা, শুনি।
পূরবী হাসতে-হাসতে বলে, বাবা ভালো জানেন, জিজ্ঞেস করো দাদুকে।
বহুদিন পর রুদ্রনীল প্রাণখোলা হাসি হাসেন। পিয়া-প্রীতম দুজনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ইসস্ দাদু – কী হ্যান্ডসাম লাগছে তোমাকে। হাসলে তোমাকে দারুণ সুইট লাগে। তুমি হাসো না কেন দাদু?
মাধবী বলেন, দুনিয়ার সব ঝুট-ঝামেলা নিয়ে কে অত মাথা ঘামাবে বল। ওনার হাসবার কি সময় আছে? রুদ্র হাসিমুখে বলেন, কাম ট্যু দা পয়েন্ট। নীয়নকে নিয়ে ব্যাংকে গেছি, যেমন হয় আর কী। অ্যাকাউন্ট্যাট ভদ্রলোক ক্যান্টিনে চা খেতে গেছেন। ন্যাচারালি দেরি হলো কিছুটা, এরপর অ্যাকাউন্ট নম্বর, আইডি নম্বর দেওয়া – এসব নিয়ে বেশকিছু সময় গড়িয়ে গেল।
নীয়নের তর সইছে না, অ্যাংরি ইয়াংম্যান তো। বারবার বলছে, আমাদের আর কতক্ষণ ওয়েট করতে হবে, সেই কখন এসেছি। আমাদের ওখানে এতক্ষণে দশজন ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিয়ে দিত।
ডিপার্টমেন্টের ভদ্রলোক ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে ফিরেছেন, অবভিয়াসলি আঁতে ঘা লেগেছে তার। নীয়নকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোথায় থাকেন মি. ডে, আই মিন বাংলাদেশে তো আর থাকেন না।
কাঁধ নাচিয়ে নীয়ন বলে, নিউইয়র্কে।
পিয়া হেসে ওঠে।
– কাঁধ নাচিয়ে না, বলো শ্রাগ করেছিল নীয়নদাদা। প্রীতু বলে, কথার মাঝে একদম ইন্টারাপ্ট করবি না পিয়া। রুদ্র বলেন, ততক্ষণে ব্যাংক ম্যানেজার এসে দাঁড়িয়েছেন। ক্লায়েন্টকে অপ্রিয় কথা বলতে নেই। উনি মিষ্টি করে বললেন, ভাইজান, আপনি হলেন ধনী দেশের গরিব প্রজা আর আমরা হলাম গবির দেশের ধনী প্রজা। অফিসে রওনা হওয়ার সময় ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে, ফোলিও ব্যাগটা নেয় -। তারপর আমি গাড়িতে বসি।
পলিন বলে – বাহ – দারুণ গুগলি মারলেন তো ভদ্রলোক। পূরবী বলে, নীয়নকে বলেছি, বাবা বিদেশ থেকে এসেছ, কায়দা-কানুন বুঝে কথা বলো। ইউরোপিয়ান কান্ট্রিতে আছিস ভালো কথা। হইহই করে এত বলার কী আছে? তা স্বভাব কি আর পাল্টায়?
পূরবী ফের হেসে বলে, খাবারের গল্পটা বলুন না মা। – হ্যাঁ, তাইতো, বউমা, সন্ধ্যাবেলা আমাদের খাওয়াতে নিয়ে গেছে রেস্টুরেন্টে। ব্যস হয়ে গেল, এখানে সুইফটলি কাজ ভেড়ে না, সেই কখন অর্ডার নিয়ে গেছে, খাবার দেওয়ার নাম নেই। পূরবী হাসতে-হাসতে বলে, আমি আর মা যত বলি, নীয়ন আমাদের কোনো তাড়া নেই। দ্যাখো কত ভিড়, ওয়েটাররা হিমশিম খাচ্ছে। নীয়ন, কথা বলিস না বাবা, ‘পিস্নজ’।
মাধবী বলেন, খাবার সার্ভ করার পরও রেহাই নেই। রবীন বলে, আমিও তো ছিলাম মা তোমাদের সঙ্গে। কিছুই মনমতো হয় না নীয়নের। পরাটা ভালো করে ফ্রাই হয়নি, ভেতরটা কাঁচা – কথাটি বোধহয় কানে গেছে মালিকপক্ষের।
স্মার্ট একজন ইয়াং ছেলে এসে বলল, এক্সকিউজ মি স্যার, আমাদের রেস্টুরেন্টে অ্যারাবিয়ান কুক রয়েছে। এখানে একশ রকমের মশলা মাখিয়ে মুরগি গ্রিল করা হয়। রেস্টুরেন্টটার খুব নাম রয়েছে স্যার, লাইন মেনটেন করে লোকজন খেতে আসে। পূরবী বলে, ওর জন্য লজ্জায় আমাদের মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়।
বিদেশ কী করে এত প্রিয় হয়ে উঠল সবার কাছে প্রীতম – ডল-পলিন-দাদু এ নিয়ে কথা বলতে থাকেন। রুদ্র বলেন, – ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী – এ এখন পুরনো সেস্নাগান। পৃথিবী এখন মুঠোবন্দি হয়ে সবার কাছে ধরা দিচ্ছে। পিয়া বলে, দাদু, এখনকার সেস্নাগান হলো – নতুন দেশের অভিবাসী হও।
মাধবী বলে, এটা কেমন কথা পিয়ামণি? শেকড়কে তো ভুলতে নেই। রুটই হলো আসল কথা। প্রীতম উঁচুগলায় বলে, হোয়াই ইজ শেকড় ঠাম্মা? রুটকে এখন ভুলে যেতে বসেছে মানুষ। পলিন বলে, মানুষকে এখন রেকলেস হতে হবে, নয়তো ভুবনজোড়া স্বপ্ন তো ফুলফিল হবে না।
একরাশ, বিষণ্ণ হাওয়া নিঃশব্দে খেলা করে রুদ্রনীলের চেয়ারটা ঘিরে।
রবীন গম্ভীর গলায় বলেন, মানুষ কত বদলে গেছে মা দ্যাখো, বেশ আগে লস অ্যাঞ্জেলসে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুজন জাপানি ছাত্র। ওদের একজন একটি জার্নালে লিখেছিল – ‘আমার জন্মভূমি জাপান কিন্তু তার পরও যুক্তরাষ্ট্রকে আমার খুব ভালো লাগে। উদ্বাস্ত্ত হিসেবে হলেও আমি এখানে থেকে যেতে চাই। ক্যালিফোর্নিয়ার বাতাস মরুভূমিতে পানির মতোই আরামদায়ক।’
মুমু – জেনিফার বলে, ওয়াও।
পিয়া বলে, ইংল্যান্ড-আমেরিকায় আমার যেতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
রাত নেমেছে, হিরের টুকরোর মতো লাইটগুলো জ্বলছে। মুমু-জেনিফার চলে গেছে। ওদের ভাবনাটুকু বিষণ্ণতার ছোঁয়া এনে দেয় রুদ্রের মনে। বিড়বিড় করে রুদ্র বলতে থাকেন, ও মাই পুওর প্রজন্ম।
তিন
মাঘ মাস। শীতের বৃষ্টিঝরা এক গোধূলিতে রুদ্রনীল আচমকা ফিরে যান তার শৈশবে-কৈশোরে।
এও কি হয়? বহু বছর আগের ফেলে আসা সুখাইড় গ্রাম, পীতাভ অগুনতি স্মৃতিগুলো শিশুর মতো হামা দিতে-দিতে গুটি-গুটি পায়ে চলে এসেছে একেবারে মুখোমুখি।
কই – কোনোদিন তো এমন হয়নি। শীতের মিহিদানা এই বৃষ্টি-বাদলা হাওয়া বুঝি নিয়ে এসেছে স্মৃতিমাখা মণিকণাগুলো।
বাহারি মেঘের সুন্দর স্বপ্ন দেখে, শিক্ষায়-দীক্ষায় উন্নত জীবনের আশায় শিকড় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন রুদ্রনীল। চাকরিজীবনের বাঁধাধরা জীবনের বৃত্ত, প্রমোশনের আনন্দের মাঝে নিস্তরঙ্গ জীবন বয়ে গেছে। আজ উপলব্ধি করেন, গাঁয়ের সেই চাঁদোয়ার মতো আকাশ বহুতল বাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেছে। পুকুর-নদী কিছুই আর এখানে নেই, শ্যামসিণগ্ধ বন-বনানী বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। আমি কি পলিন আর সুদীপের মতো সোনার হরিণের পেছনে ছুটেছি?
অভ্যাসবশে একসময় খাবার টেবিলে আসেন। ক্যাসারোলে রাখা ধোঁয়া-ওড়া রুটি, ফুলকপি-বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকোলি আর সুইট কর্ন দিয়ে রাধা পছন্দের সবজি সবকিছুই ভালো লাগে
আজ। মাধবী জিজ্ঞেস করেন, আর একটা রুটি দিই? শরীর ভালো আছে তো?
প্রীতম বলে, ঠিক আছে দাদু। এক্কেবারে পারফেক্ট। হার্টবিট-পালস ওকে। বিপিও নরমাল।
খুব কনফিডেন্ট হয়ে রুদ্র বলেন, আজ আমি খুব ভালো আছি, ভাবনার কিছু নেই।
পিয়া বলে, ভোরবেলা যে চক্কর দিয়ে এসেছ দাদু।
হ্যাঁ, হয়তো তাই। সবসময় হাসিখুশিই তো থাকতে চান তিনি। সদাসঙ্গী টিভির দিকে তাকিয়ে, খবরের কাগজ পড়ে কি হাসতে পারেন রুদ্রনীলের মতো হৃদয়বান মানুষ?
কত কথাই মাঝেমধ্যে মনে পড়ে যায়। সত্তরের দশকে অল্পবয়সী মাধবীকে নিয়ে সংসার শুরু করেছেন। পেতলের বড় হাঁড়িতে ভাত রাঁধা হতো। পকেটে ফর্দ আর চটের ব্যাগ নিয়ে নিজের হাতে বাজার সেরেছেন। তখন সেগুনবাগিচায় থাকতেন, ভাড়াবাড়িটি পারিবারিক মিলনকেন্দ্র ছিল। বাড়িতে কেউ এলে ডাল-ভাত-মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরে খাও, বিশ্রাম করো, বিকেলের চা খেয়ে তবেই বাড়িতে ফিরে যাও।
কতদিন বয়ে গেল, দিন তো অন্যরকম হবেই। মানিয়েও নিয়েছেন তিনি। পরিবর্তন আপন গতিতে আসবেই। পূরবী হঠাৎ বলল, পাঁচতলার ফ্ল্যাটের সুরাইয়া খালাম্মা ফিরে এসেছেন। মনে আছে – রফিক আংকেলের স্ত্রী।
বেসিনে হাত ধুতে-ধুতে মনে পড়ে। বলেন, – কে বলত বউমা? তৌহিদ-তামান্নার মা? এ আর নতুন কী? উনি তো মাঝেমধ্যেই আসেন।
পূরবী বলে, এবার খালাম্মাকে চিরদিনের মতো পাঠিয়ে দিয়েছে।
– তার মানে?
– তৌহিদ-তামান্নার বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে তো, এবারে ন্যানির আর কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন বাবা? আবার তার চারপাশে মন খারাপের এক কু-লী তৈরি হয়। বুকের ভেতর তীব্র এক দহন জাগে। নিজের জঠরজাত সমত্মানরা মায়ের জীবনীশক্তি, কর্মক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এবার তিনি ফিরে এসেছেন আপন গৃহকোণে। ছেলেমেয়ের নীরব অঙ্গুলি হেলন বলে দিয়েছে – তোমাকে আমাদের আর প্রয়োজন নেই, বাতিলের দলে তুমি। ‘সিলভার রেইন’ অ্যাপার্টমেন্টে শুয়ে ওদের মা একাকী চোখের জল ফেলছেন। হায় সুরাইয়া ভাবি।
স্বামীকে ভালো করে চেনেন মাধবী, বড় আবেগপ্রবণ মানুষ। শুতে এসে বলেন, শৈত্যপ্রবাহ কতদিন চলবে গো? বড্ড ঠান্ডা। ও হ্যাঁ – বন্ধুদের কথা কিছু বললে না তো। রুদ্র মস্নান হেসে বলেন, ছেলে ভোলাতে চাইছ মাধু? আমার শুধু মনে হচ্ছে – কী করে তামান্না-তৌহিদ মাকে ফেরত পাঠাতে পারল।
স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে মাধবী বলেন, সুরাইয়া ভাবির কথা আর ভেবো না। সকালে বন্ধুদের সঙ্গে বসে যে রমনা
পার্কে আড্ডা দিলে, নিশ্চয়ই খুব এনজয় করেছ – সে-কথা ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ো। সুন্দর ভাবনা, গান – এসব নাকি থেরাপির মতো কাজ করে। সত্যি বলেছে মাধু, অনেকদিন পর ভারি আনন্দে কেটেছে কিছুটা সময়।
মোবাইলে যোগাযোগ করে ছিল ইশতিয়াক আলী। ফোনটা হাতের কাছেই রাখেন, বেজে উঠলে অন করে কথা বলেন। এর বেশি যন্ত্রটির ব্যবহার তিনি জানেন না। তবে মোবাইল দিন-রাত বেজেই যায়, তাড়াহুড়া করে রিসিভ করেন – ও গড, শুধু বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। এত স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনুন, নতুন সিডি বেরিয়েছে তার হদিস জানানো হয় – এটা কিনুন, সেটা কিনুন। খালি কিনুন আর কিনুন।
জ্বালিয়ে খেল, গোটা পৃথিবীটাই অহেতুক কলরোলে সারাক্ষণ ঝমঝম করছে। এ এক অন্যরকম পৃথিবী। পিয়া ওর বন্ধুকে বলে, পেপার কাটিংটা আমার জন্য কি পাঠাবি ডল?
ডল বলে, শিগগির পাঠাব, স্ক্যান করে হোয়াটস আপে দিয়ে দেব।
সেদিনের পুঁচকে নাতনি কত কী দুর্বোধ্য কথা বলে – বুঝতে পারেন না রুদ্র। তিনি তো মেসেজও ওপেন করতে পারেন না। টুকটুক করে মোবাইলের রিংটোন বদলে দেয় ও। গেল কাল সকালে চা খাওয়ার পর মোবাইলে বেজে ওঠে গান, আমি শকুন্তলা নই – ওপাশ থেকে ভেসে আসে, – ব্যাপার কী ব্রাদার? তুমি শকুন্তলা নও বলে কনফেস করছ কেন? জেন্ডার চেঞ্জ হয়েছে নাকি?
বহুদিন পর ঠা-ঠা করে হেসে ওঠেন রুদ্র। – তুমি নিশ্চয়ই ইশতিয়াক। এত ফাউল টক তো কেউ করে না। ও আমার নাতনি পিয়ার কান্ড।
দু-চারটে কথার পর তখনই ঠিক হয়েছে, আগামীকাল ভোরে রমনা পার্কে দেখা হবে। পুরনো ক্লোজ ফ্রেন্ড দু-চারজনের সঙ্গে দেখা হবে।
কথা বলতে-বলতে চার্জ শেষ হয়ে গেছে। চার্জ দেওয়াও কি কম ঝকমারি।
প্রীতম বলে, দাদু, হটাও ইসকো। আমার মোবাইলে চার্জ দেব কখন?
মাধবী বলে, – তুমি মেসেজ করতে জানো না, নম্বর সেভ করতে পারো না –
রুদ্র মাঝেমধ্যে কপট রাগি সুরে বলেন, বয়স হয়েছে বলে এমনই হয়ে গেছি, তুমি অন্তত আমার ফেভারে থাকো।
হ্যাঁ, আজ সকালবেলাটা সত্যি অন্যরকম কেটেছে তার। পুরনো পাঁচ কলিগ সার্পেন্টাইন লেকের পাড়ে অনেকক্ষণ বসেছেন। কথায়-কথায় ইলিয়াস বলেছেন, মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়েছে। এইট্টি প্লাসে তো হয়েই আছি, সেঞ্চুরির কাছাকাছিও চলে যেতে পারি। কী বলিস শালা।
ওমর বলেন, হ্যাঁ – আমার ছেলে কম্পিউটার ঘেঁটে সেদিন বলল, অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা নাকি ওয়ান্ডার পিল উদ্ভাবন করেছেন। এটা খেলে সেঞ্চুরি নাকি অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়। অতএব ভাবনা নেই। খাও দাও আর ফূর্তি করো। পার্কের রেস্টুরেন্টে বসে গরম স্যুপে চামচ নাড়তে-নাড়তে রুদ্র গেয়ে ওঠেন – চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।
– ও বুঝেছি, পার্কের দেয়ালে উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরের বিজ্ঞাপন দেখে বুঝি গানটা গেয়ে ফেললি। বহুত খুব রুদ্রনীল। তবে সুরের রাজ্যে এ যে অসুরের আগমন।
শুয়ে-শুয়ে মধুর আর মায়াবী সকালটার কথা ভাবতে থাকেন। সত্যি, বালিশে মাথা রেখে মন খারাপ করা কথা ভাবতে নেই।
নীরব-নিঝুম শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়া, মিহিদানার মতো বৃষ্টিঝরা মধ্যরাত নেমে এলো, লেপের ওমে ডুবে যেতে-যেতে শুনতে পান – বেঙ্গল গ্যালারি থেকে ভেসে-আসা সংগীতের সুর-লহরি। মৃদু, মোছা-মোছা – বেজে ওঠে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি, রশীদ খানের মনকাড়া মালকৌষ, পন্ডিত শিবকুমারের সন্তুরের ললিতধারা, কৌশিকী চক্রবর্তীর খেয়ালের বিসত্মার বাতাসে মিশে শীতার্ত রাত বুঁদ হয়ে যেতে থাকে।
সে-সুরের তরঙ্গ যেন বলে যায় – হে মানবপুত্র – তুমি এ কোন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রয়েছ? মায়া-মমতাহীন উত্তরসূরিদের আচরণে তুমি ব্যথিত, ক্ষুব্ধ। এ তো নবসৃষ্টিকাল।
২৭ নম্বর রোডের ধানমন্ডির তিনতলা ফ্ল্যাটের একটি কামরায় শুয়ে রুদ্রনীল নামের মানুষটির বুকের ভেতরের সব দাহ, সব অভিমান বিন্দু-বিন্দু সুরের সুধায় ধুয়ে যেতে থাকে।