ডিভোর্স লেটারটা হাতে পাবার পর লুসির মুখটা ছিলো দেখার মতো। আহত, বিস্মিত, ব্যথিত, আরও অনেক নাম না জানা অনুভূতির মিশেল ছিলো ওর চোখে-মুখে। বহুদিন পর ওর চেহারাটা দেখে আমার অন্তর্জ্বালা কিছুটা হলেও জুড়োলো। কষ্টে আছি বহুদিন। আজ থেকে না হয় লুসি কষ্টে থাক। একতরফা শুধু আমাকেই কেনো কষ্ট বইতে হবে? শুধু ওর চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দুটুকু স্মরণ করে আনমনা হয়ে যাচ্ছি বার বার। যদিও পেপারে সাইন করিনি আমি। তবে সেটা খেয়াল করার মতো মানসিক অবস্থা লুসির ছিলোনা। গ্লাসটা দ্রুত শেষ করে আরেক পেগ ড্রিংক নিলাম। সামনের দিকে স্টেইজে উদ্দাম নৃত্য চলছে। মিউজিক আর ছেলে-ছোকড়াদের হাততালি এবং শিষের শব্দে কান পাতা দায়। দর্শকের সারিতে কমবয়সী ছেলেপেলেই শুধু নয় আমার মতো চল্লিশোর্ধ্ব মানুষও আছে। কেনো আসে ওরা? আমার তো রীতিমতো ঘৃণা হচ্ছে৷ শুধু লুসির সাথে রাগ করে সময় কাটাবার জন্য এখানে আসা৷ নাচ-গান হচ্ছে আমার পেছনে৷ স্টেইজের দিকে পিছন ফিরে বসে আছি আমি।
দশ বছরে একটা মানুষ আমূল বদলে যাবে তা আমার ধারণাতেও ছিলোনা।এতো পাল্টাবে কেনো? হাসি-খুশী প্রাণোচ্ছ্বল একজন মেয়েকে বিয়ে করলাম৷ আমাদের ইচ্ছে-পছন্দ-অভিরুচি সবই মিলতো। সুখী ছিলাম। লিরা আর লায়ার জন্ম হলো আমাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায়। এখন ওদের বয়স সাত বছর৷ আমানের বয়স এখন তিন বছর। বাচ্চাগুলো নিয়ে মহাব্যস্ত থাকে লুসি। কাজ সেরে ঘরে ফিরলে বাচ্চারা হাসিমুখে ছুটে আসে। সব ক্লান্তি উবে যায় আমার। অনেকটা সময় হুটোপুটি শেষে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। লুসির সাথে একান্ত সময় বলতে এটুকুই। এই সময়টুকুতেও যদি সে বিষন্ন থাকে তবে আর বাকি রইলো কী? রোজই যে এমনটা হয় তা বললে মিথ্যে হয়ে যাবে। তবে অধিকাংশ দিনই সে নিস্পৃহ থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে।
এ কি সেই লুসি?! ঠিক যেনো বিশ্বাস হয়না আমার। আমরা মাঝরাতে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তাম। বৃষ্টিমুখর রাতে দীর্ঘ সময় জলকেলি করতাম। ছুটির সময়গুলোতে এ্যাডভেঞ্চারের জন্য ফরেস্টে তাঁবু টানিয়ে রাত কাটাতাম। একসাথে স্কেটিং করেছি, পাহাড়ে উঠেছি। কোনো কিছুতেই ক্লান্তি ছিলো না লুসির। আমার খুশীই ছিলো ওর খুশী। যখন যা মনে চাইতো তখন তাই করতাম। আমার প্রতিটি কাজে সোৎসাহে সঙ্গ দিতো লুসি। লুসির প্রাণোচ্ছ্বলতার কারণে বেশী ভালোবাসতাম ওকে। সেই গুণই যদি আর না থাকে…. ওর ক্লান্ত আর বিষণ্ন মুখ দেখতে দেখতে বিরক্ত আমি। আজ-কাল আর ঘরে ফিরতে মন চায় না। অফিস থেকে সোজা বারে চলে আসি৷ গভীর রাতে বাসায় ফিরি৷ লুসি রাত জেগে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করে৷ ওর উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠিত মুখ দেখতেও আজ-কাল ভালো লাগেনা। ভালো লাগেনা ওর প্রশ্নের জবাব দিতেও।
নাহ আমার অন্য নারীর প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই৷ আমি শুধু আগের লুসিকে খুঁজে ফিরি। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে একটাই চাওয়া –“ আমার হারিয়ে যাওয়া লুসিকে ফিরে চাই।“ অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম লুসিকে ডিভোর্স লেটার দেবো। ওকে শায়েস্তা করার জন্য এরচাইতে ভালো আর কিছুই হতে পারেনা। আমার প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসায় একেবারেই অন্ধ লুসি- এটা ভালো করেই জানা আছে আমার। ওকে আঘাত করার এটাই মোক্ষম উপায়। আজ সকালে বের হবার আগে লুসির হাতে ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দিতেই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ও। জানি অজস্র প্রশ্ন বের হবার ভাষা না পেয়ে লুসির ভেতরেই গুমড়ে মরছে।
এতোটা পাল্টে যাবে তা কখনও ভাবিনি। তোমার সম্ভবত একঘেয়েমি দূর করা প্রয়োজন।‘-জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শীতলকন্ঠে বললাম আমি। আমার মনে হয় আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। লুসির বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম আমি। তবে ওর চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দু নজর এড়ায়নি আমার। আত্মতৃপ্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ঘরে ফিরছি রাত বারোটায়। দরোজার লক খুলে লাইট অন করলাম। ডাইনিং টেবিলে ডিনার সাজানো আছে৷ ঢেকে রাখা খাবারগুলো যে ঠান্ডা হয়ে গেছে তা যে কেউ না দেখেই বলে দিতে পারবে৷ ঘরে শুনশান নীরবতা। উঁকি দিয়ে প্রত্যেকটি ঘর দেখলাম। ঘরগুলো মানবশূণ্য। ওষুধ কাজ করেছে তবে! লুসি বাসা ছেড়ে চলে গেছে। সাথে করে বাচ্চাদের নিয়ে গেছে। এমনটা তো কথা ছিলোনা! বিরক্তিতে ভ্রু কোঁচকালাম আমি। আমার বাচ্চারা আমার কাছে থাকবে।
ঘুমুতে যাবার আগে বেডসাইড টেবিলে একটা ভাঁজ করা কাগজ নজরে পড়লো। সম্ভবত কোনো ইমোশনাল নোট রেখে গেছে লুসি৷ পড়ে দেখা যাক একবার- “প্রিয়তম” একটা সময় ছিলো যখন আমি প্রাণচঞ্চল ছিলাম। অনেক উচ্ছ্বল ছিলাম। কিন্তু সময়টা ভিন্ন ছিলো। তখন একাকী ছিলাম। আমার কাঁধে কোনো দায়িত্ব ছিলেনা। আমার আজও উচ্ছ্বলভাবে জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে। আবারও ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমি একজন মা! কি করে দায়িত্বগুলো এড়িয়ে যাই বলো? আমি এমন একজন মা যে কিনা একাধিক সার্জারীর মুখোমুখি হয়েছি। আমাকে একজন শেফের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমার পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে একজন হোমমেইডের কাজ করতে হয়। ঘরের প্রতিটি কোণ পরিষ্কার রাখাটা খুবই জরুরী। একজন টিচারের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমি বাচ্চাদের দিকে মনোযোগ না দিলে তারা পড়ায় মন দেয়না। মেয়েদের স্কুল এবং কোচিং এ আনা-নেবার দায়িত্বও আমার। আমাদের আমানকে প্রতিনিয়ত আমাকেই চোখে চোখে রাখতে হয়। নয়তো যে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে৷
আমাকে ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে আনতে হয়৷ কারণ, পুরো সপ্তাহজুড়ে তুমি সে সময়টুকু কখনোই পাওনা। আমাদের সবার কাপড় আমাকেই পরিষ্কার করতে হয়। আমি স্বেচ্ছায় কখনো বিশ্রাম নেবার কথা ভাবতেও পারিনা যতোক্ষণ না বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ছে৷ আর তখন আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত থাকি। তুমি আমার প্রতি বিরক্ত তা-ও বেশ বুঝতে পারি৷ আমার ইচ্ছে করে কিছুটা অবসর সময় কাটাতে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। নিজের জন্যে কিছু করতে মন চায়। তা-ও আর হয়ে ওঠেনা। তোমার পূর্ণ অধিকার আছে জীবনকে আনন্দময় করে তোলার। তুমি তোমার দিক থেকে সম্পূর্ণ সঠিক। তোমার প্রতি কোনো অনুযোগ আমার নেই। তবে একটা অনুরোধ আছে। জানি, আদালত আমাকে আমার বাচ্চা রাখার পারমিশান কখনোই দেবেনা। কারণ আমি একজন “বেকার মা”। আমি শুধু আমার বাচ্চাদের মাঝে মাঝে দেখতে চাই। দেখতে দেবে তো?
শুধু আজকের জন্য ওদের নিয়ে যাচ্ছি। ওরা তো বাসায় একা থাকতে পারবেনা। তুমি অনেক অনেক ভালো থেকো। তোমার জীবন আনন্দময় হোক এই দোয়া করি। লুসি। কাগজটা ছিঁড়তে গিয়েও ভাজ করে রেখে দিলাম। রাত একটা বাজে। ভোর হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। এর আগে কখনোই কোনো রাতকে এতোটা দীর্ঘ বলে মনে হয়নি আমার। আবছা আলো-আঁধারে মুখটা বড়ো মায়াবী দেখাচ্ছে লুসির। ওর ফোলা চোখদুটো বলে দিচ্ছে সারা রাতে অনেকটা পানি গড়িয়েছে দু’চোখ বেয়ে। কাপড়ের ওপরে একটি সাদা চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে লুসি। আলগাভাবে খোঁপা করায় চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে।
“ছেলে-মেয়েরা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। আগে উঠুক তারপর না হয় যাবে?”- বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠলো লুসির। মাথা নিচু করে আছে ও। “ওরা ঘুমোচ্ছে ঘুমাক। এসো আমরা ওদিকটাতে যাই।”- হাত উঁচিয়ে পলাশ ফুলের গাছটা দেখিয়ে বললাম আমি। তেমনি মুখ নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো লুসি। হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাত স্পর্শ করলাম আমি। হাতটা বেশ উষ্ণ। সম্ভবত জ্বর এসেছে লুসির। “চলো, অনেকদিন একসাথে ভোরবেলা হাঁটিনা। দেখো সূর্যের রং টা কি অদ্ভুদ! তুমি না বলতে এমন সূর্য দেখলেই তোমার ওমলেট করা ডিমের কথা মনে পড়ে যায়!” -জোরে হেসে উঠলাম আমি। “রাতে তোমার জন্য রজনীগন্ধা তুলে রেখেছিলাম। এখনও শুকিয়ে যায়নি দেখো”- বলে অনেক অনেকদিন পরে লুসির হাতে রজনীগন্ধার দু’টো ডাল গুঁজে দিলাম আমি।
“আজ আমরা আমাদের মতো কোথাও হারিয়ে যাই চলো, ঠিক আগের মতো। বাচ্চাদের দায়িত্ব একটা দিনের জন্য না হয় আমার শাশুড়ী মা কে দিলাম। কি বলো?” -লুসির চিবুক স্পর্শ করে বললাম আমি। মুখভাবের কোনো পরিবর্তন হলোনা লুসির। বিষন্ন দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। খুবই স্বাভাবিক। যে মানুষটার জন্য তার এতোটা পরিবর্তন হয়েছে তারই কাছ থেকে এতোবড় আঘাত পেলে জীবনের কোনো আনন্দই আর অনুভব করতে পারার কথা নয়। “লুসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি”- খুব ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে উচ্চারণ করে বললাম আমি। এবারও তাকালো না লুসি আমার দিকে। শুধু ওর চোখে বেয়ে আরেকটু পানি গড়িয়ে পড়লো।
“লুসি, আমি এতোটাই বোকা যে বুঝতেই পারিনি তুমি নও বরং আমিই তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা। তুমি আছ বলেই না আমি নিশ্চিন্ত মনে সব তোমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজটুকু করতে পারি। সব কিছুকে আগলে রেখে তুমিই আমাকে স্বার্থপর করে তুলেছ৷ কেনো কখনও অভিযোগ করোনি? তাহলে তো আমি আমার ভুলগুলোকে খুঁজে পেতাম। অফিস বাদে ঘরেও যে আমার কিছু দায়িত্ব আছে তা বুঝতাম। এভবে সবদিক একা সামলেছ বলে নিজের ভুল না খুঁজে তোমার ভুলই খুঁজতে থাকতাম। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমার কোনো ভুলই নেই৷ আমার ভাবনায় ভুল ছিলো। তুমি তোমার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছ শুধুমাত্র পরিবারকে ভালোবেসে। কাল থেকে তোমাকে এতোটা পরিশ্রম করতে হবেনা। আমার ছুটির দিনগুলোতে বাইরের কাজগুলো আমি করবো। এর বাইরেও তোমাকে একজন সাহায্যকারী জুটিয়ে দেবো।
আমি জানি তুমি আমার সেই আগের লুসিই আছ। শুধু বাড়তি দায়িত্ব তোমাকে পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু এখন থেকে আমি কখনই তোমাকে এতোটা পরিশ্রান্ত হতে দেবোনা। এটা আমার ওয়াদা।”– লুসির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম আমি। আবারও পানি গড়াতে শুরু করলো লুসির চোখ বেয়ে৷ তবে আগের অশ্রু আর এখনকার অশ্রুর মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। সেটা ছিলো কষ্টের কান্না। আর এটা হলো সুখের কান্না। আমি অবাক হয়ে ভাবছি– কান্নার যদি ভিন্ন ভিন্ন রং হতো!
গল্পের বিষয়:
গল্প