নীল অবন্তী

নীল অবন্তী
এই মুহূর্তে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে মেয়েটি কাতরাচ্ছে, কে বলবে কিছুক্ষণ আগেও সেই মেয়েটি দিব্যি কফি ক্যাফে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল?বেশ অনেকক্ষণ যাবত আনমনে হয়ে ক্যাফের কর্ণার সিটটিতে বসে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল অবন্তী। ওর চোখে মুখে বিরক্তি আর উদাসীনতার একটা স্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পাচ্ছিল। নিজের ইচ্ছায় আসেনি এখানে, সেটা এক পলক ওকে দেখলেই বুঝা যায়।
=>আপনি অবন্তী?
=>জ্বি।
=>অহ্,আমি আমান।সরি আমার জন্য আপনাকে অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করতে হয়েছে।আসলে প্রথম দিনই আমার দেরিতে আসাটা মোটেও উচিত হয় নি।কিন্তু কি করব বলুন অফিস থেকে বের হতে হতে সেই সাথে রাস্তায় জ্যামের কারনে এতটা দেরি হয়ে গেল।
=>ঠিক আছে, সমস্যা নেই।
=>ধন্যবাদ। তো কি নিবেন চা না কফি?
=>আপনার খুশি।
=>দেখুন আমার আর আপনার বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হতে চলেছে।কিন্তু তার আগে আমি চাই আপনার আর আমার মাঝে প্রথমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হোক।
=>জ্বি।
=>যদি তাই হয় তাহলে কি আমি জানতে পারি আপনার আনমনা আর বিষন্নতার কারন,? আপনি কি এই বিয়েতে রাজি নন,?
=>অবন্তী খুব ইতস্ততা বোধ করছে।
=>আপনি ঠিক আছেন,? আপনার কি শরীর খারাপ করছে!?
=>এক গ্লাস পানি।
বলতে বলতে মুহূর্তের মধ্যে অবন্তীর পুরু শরীর লাল হয়ে যায়।ওর দম নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।অবন্তি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে ফ্লোরে পড়ে যায়। আমান স্পর্শ করতেই দেখে অবন্তীর শরীর তীব্র গরম।এরই মধ্যে অবন্তী জ্ঞান হারায়। আমান কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করে ওকে হসপিটাল নিয়ে আসে।এরই মধ্যে অবন্তীর মা বাবা ও হসপিটালে এসে পৌছায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর অবন্তীর জ্ঞান ফিরে,জ্বরটাও এখন বেশ কমেছে। অবন্তীর চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। হসপিটালের বেডে শুয়ে ওর বার বার একটা প্রতারকের কথাই বার বার মনে পড়ছে।যে কালপিটটা ওর সাজানো স্বপ্নগুলো গলা টিপে হত্যা করেছে।মেরে ফেলেছে অবন্তীর মধ্যে থাকা মায়া, মমতা ভালবাসা।জন্ম দিয়ে গেছে ঘৃণা।
“নীলয়”। একটা সময় যে ছিল অবন্তীর বেঁচে থাকার অবলম্বন।যাকে নিয়ে শুধু এক জনম না হাজার জনম বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল সে। ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসত।তাই মেয়ের সুখের জন্য নীলয়কে মেনে নিয়েছিল তার পরিবার।অবন্তী শুধু বউ সাজার স্বপ্ন এঁকে যেত। তাই একদিন নীলয় এসে অবন্তীকে জানায় সে গ্রমের বাড়িতে যাবে।তাদের বিয়ের জন্য নীলয় তার বাবা মা কে রাজি করিয়ে সাথে করে নিয়ে আসবে।অবন্তী ভালবাসার স্বপ্নতে অন্ধ হয়ে হাসি মুখে অনায়াসে নীলকে বাড়ি যেতে দেয়। কিন্তু এটাই ছিল নীলয় অবন্তীর শেষ দেখা।কারন সে দিনের পর নীলয় আর ফিরে আসেনি।অনেক খুঁজা খুঁজি করেও নীলয়ের কোন সন্ধান পায় নি অবন্তী।
তার পরও সে নীলয়ের পথপাণে চেয়ে অপেক্ষায় থাকে এই ভেবে যে নীলয় একদিন ফিরে আসবে। দিন,সপ্তাহ, মাস এই করে করে বছর চলে যায়,কিন্তু নীলয় ফিরে আসেনা।আস্তে আস্তে ভালবাসাটা অভিমানে পরিণত হয়।স্বাভাবিক জীবন চলা হারিয়ে ফেলে।তার বাবা মা নিজের মেয়ে এমন করুণ অবস্থা সহ্য করতে পারছিলনা। অবন্তী কে অনেক করে বুঝিয়েছে নতুন করে আবার শুরু করার জন্য।কিন্তু সেই ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে।হারিয়ে ফেলেছে বিশ্বাসটুকু, নতুন করে শুরু করার জন্য মিনিমাম ভালবাসাটুকু তার আর নেই। তাই অবন্তীর বাবা এক প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে মেয়েকে আজ পাঠিয়েছে আমানের সাথে দেখা করার জন্য।ভেবেছে বিয়ে হলে হয়তো অবন্তী আবার স্বাভাবিক জীবনে চলে আসবে।তাছাড়া আমান খুব ভদ্র আর ভালো পরিবারের ছেলে। অবন্তীকে ভালো রাখবে। কিন্তু অবন্তী,,,,,,,,!! রাত ২ টা। সবাই ঘুমিয়ে আছে।অবন্তী ঘুমের মধ্যে খুব ছটফট করছে।
=>অবন্তী,,, অবন্তী,,।
=>কে,? কে,ওখানে,?
অবন্তী নিজেকে ধোঁয়া আর অন্ধকারময় ঘরে আবিষ্কার করল।কেউ তাকে আর্তনাদ কন্ঠে ডেকে চলেছে।কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট।
=>অবন্তী,। আস্তে আস্তে কন্ঠটা স্পষ্টতর হয়ে ওঠছে,,।
=>নীলয়,!! তু,,তুমি এখানে,?ঠকবাজ,চালবাজ।কি চাও,? কেন এসেছ,?আমি তোমার মুখও দেখতে চাই না।আমার সাথে এমন করার আগে তোমার বিবেক একবারও তাড়না দেয় নি,?আমার অপরাধ কি ছিল,?কেন এমন করলে আমার সাথে,? কান্না করতে করতে অবন্তী নীলয়কে সজোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু অবাক করা বিষয় সে ধাক্কা নীলয়কে স্পর্শ করেনি।
=>খুব অবাক হচ্ছো তাইনা অবন্তী,?তা হবারই কথা। আমি আর তোমাদের এক জগৎ এর কেউ নই অবন্তী। তুমি আমাকে কখনো স্পর্শ করতে পারবেনা।তবে হ্যা পরকাল বলে যে দুনিয়া আছে ওপর ওয়ালা চাইলে সেখানে হয়তো তুমি আমাকে পেতে পারো। জানো অবন্তী যে দিন তোমার কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম সেদিন আমি ট্রেন টা মিস করি।তোমাকে বার বার বলছিলাম দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাকে বিদায় দাও নয়তো ট্রেন মিস করব।হয়তো শেষবারের মতো কছে পেয়েছিলে তাই আরেকটু বেশিক্ষণ আমাকে বেঁধে রেখেছিল ভালবাসায়। ট্রেন মিস করায় বাসে করে বাড়ি যাচ্ছিলাম।বাসে যাচ্ছি শুণলে হয়তো তুমি রাগ করবে তাই তোমাকে বল হয়নি।দেখো কি ভাগ্য প্রথমবার তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছিলাম তাই এত বড় শাস্তি পেতে হয়েছে।কিছুটা পথ যেতেই আমাদের বাসটা এক্সিডেন্ট করে।জানো কিছু বুঝে ওঠার আগেই না দেহ থেকে আত্নটা বেরিয়ে যায়। তোমাকে শেষ বারের মতো কপালে একটি বার চুমু খেয়ে বলা হয়নি ভালবাসি।
পারিনি বাবা মা কে বলতে তোমাদের হবু বউমা লাল বেনারসিতে বধু সেজে অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য।জানো অনিক খুব করে বলে দিয়েছিল ভাইয়া এবার আসার সময় আমার জন্য ব্যাট নিয়ে আসবি।নয়তো তোর সাথে কথা বলব না আর,আড়ি।ওর জন্য কেনা ব্যাটটা ওর হাতে তুলে দিতে পারিনি।বলতে পারিনি ভাই তোর টিমে মেম্বার বাড়ানোর জন্য তোর ভাবিকে আনতে যাচ্ছি।ভাইটা মনে হয় এখনো অভিমান করে বসে আছে,তোমারই মতো বড্ড অভিমানী কিনা। তোমার হয়তো খবরের কাগজটায় চোখ পড়েনি।তাই আমার খবরটাও,,।আর কেনইবা পড়বে বল,?প্রতিদিনতো এমন ঘটনা কতই ঘটছে।আর দশটা ঘটনার মতো আমাদের দেশে রোড এক্সিডেন্ট একটা স্বাভাবিক ঘটনা।যেগুলো কিনা পত্রিকা বা হেডলাইনে খুব ছোট্র করে ছাপানো হয়।কারো চোখেই পড়েনা। অবন্তি কিছুই বলতে পারছে না।বাকরুদ্ধ সে।শুধু চোখ থেকে পানি ঝরে চলছে
=>কেঁদোনা অবন্তী।
=>আমি তোমাকে একটি বার দেখতে চাই নীলয়।অন্ধকার থেকে প্রকাশে এসো।
=>তুমি আমাকে দেখলে সহ্য করতেপারবে না আবন্তী তবুও অনেক জোরাজোরি শেষে নীলয় দেখা দিল ওর মুখটা খুব বাজে ভাবে থেতলিয়ে গেছে।খুব বিবস্ত্র আর বাজে দেখাচ্ছে। অবন্তী শুধু জোরে জোরে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে।
=>অবন্তী,, অবন্তী,,
সেদিন সবার ডাকে অবন্তীর ঘুম ভেঙ্গে ছিল ঠিকই কিন্তু স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসা হয়নি তার। আজ ১ বছর যাবত মানসিক হাসপাতালে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে সে। এভাবেই প্রতিদিন অদক্ষ আর উগ্র চালকের কারনে মারা যাচ্ছে অবন্তি আর নীলয়ের মতো হাজারো ভালবাসা।হারাচ্ছে মা বাবা শেষ বয়সের অবলম্বনকে।ব্যাট নিয়ে প্রিয় ভাইয়া ফিরে আসবে সেই অপেক্ষায় অভিমানের প্রহর গুণে অনিকের মতো অগনিত প্রান।তাতে দেশ,রাষ্ট্র বা সমাজের কিছু যায় আসে না। শুধু জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকে মৃত মানুষটির অসহায় ভালবাসার মানুষগুলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত