নিঝুম রাতের গল্প

নিঝুম রাতের গল্প
নাজনীন শুয়ে আছে আমার পাশে। আমার একটা হাত ধরে আছে সে। আজকাল নাকি তার মৃত্যু ভয় হয়। নাজনীন বলেছে গর্ভবতী সব মেয়েদেরই নাকি মৃত্যু নিয়ে এমন ভয় হয়। এই সময় তাদের ভরসার প্রয়োজন। সাহসী একটা হাত প্রয়োজন তাদের।যে হাত পৃথিবীর সমগ্র কুশক্তিকে বিনষ্ট করে দিবে।সে হাত উপরে উঠবে খোদার দরবারে তার প্রিয়তম মানুষটির জন্য ফরিয়াদ জানাতে। নাজনীনের এই কথাগুলো আমায় শান্তি দেয়। মনে মনে আমি নিজেকে মহান ভাবতে পারি তখন। কোন মেয়ে যদি আপনার উপর অতটা বিশ্বাস রাখতে পারে তখন আপনিও ঠিক নিজেকে মহান ভাবতেই শুরু করবেন।
আজ নাজনীনের মুখটা অন্যদিনের চেয়ে একটু কালো। কেমন মন মরা হয়ে আছে সে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,’নাজনীন, তোমার শরীর খারাপ?’ নাজনীন বললো,’না।’ ‘তাহলে? তাহলে তোমায় এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?’ সে চাপা গলায় বললো,’আম্মা বলেছেন–‘ আমি বললাম,’থামলে কেন?বলো।কী বলেছেন আম্মা।’ নাজনীন কাঁপা গলায় বললো,’আপনাকে বলতে নিষেধ করেছেন তিনি।’ ‘নিষেধ করেছেন তো বললে কেন?কী প্রয়োজন ছিল কথাটা তোলার।যা বলতে পারবে না তা বলা শুরু করে মাঝ পথে থেমে যাওয়া কী ঠিক?’ আমার কথা শুনে নাজনীনের চোখ কেমন টলমল করে উঠলো।মেয়েরা তো এমনই। সামান্য একটা কথার জন্যও কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলে। নাজনীন বললো,’তাহলে কথাটা বলেই ফেলি?’ আমি বললাম,’না। আগে আম্মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নাও। অনুমতি দিলে বলবা না দিলে বলবা না।’ নাজনীন বললো,’আমার এখন বলতে মন চাচ্ছে।’
আমি বললাম,’তাহলে এখনই মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসো।’ নাজনীনের পেট ভারী। তার পেটের ভেতর দুষ্টুমি করছে আমাদের সাত মাসের বাচ্চা। পেটের বাচ্চা নিয়ে হাঁটাচলা করতে তার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এই সময় বিছানা থেকে উঠে আম্মার কাছে যেতে তার মোটেও কষ্ট হলো না। আম্মার কাছ থেকে এসেই সে হাসিমুখে বললো,’অনুমতি পাওয়া গেছে।’ আমি অস্হির হয়ে বললাম,’এখন চট করে বলো আম্মা কী বলেছেন।’ নাজনীন বললো,’আম্মা বলেছেন আমাদের যদি মেয়ে সন্তান হয় তবে তিনি সেই মেয়ে সন্তানের নামে তার নিজের মালিকানাধীন বারো বিঘা জমি এবং তার সব গয়নাগাটি লিখে দিবেন।’ আমি অবাক হয়ে বললাম,’আর যদি ছেলে সন্তান হয় তবে?’
নাজনীন বললো,’তাহলে কিছুই দিবেন না।ছেলে সন্তানেরা তো এমনিতেই জন্ম গ্রহণের সময় অনেকের আশির্বাদ প্রাপ্ত হয়। কারণ সাধারণ মানুষেরা মনে করে ছেলেরা ভাগ্যের পয়গাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।অথচ আমাদের নবীজি কিন্তু বলে গেছেন এর উল্টো কথা। তিনি বলেছেন, মেয়ের পিতা মাতা ভাগ্যবান। তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদও আছে। আম্মার কোন মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়নি। তার নামে যে সম্পত্তি আছে তা তো তোমার নানার দেয়া। তিনি তার একমাত্র মেয়েকে জান্নাতুল ফেরদৌস ভাবতেন তাই তার নামে অতকিছু দিয়ে গেছেন। আমার শাশুড়িও চান তার নাতনীকে সম্মান দেখিয়ে সারা পৃথিবীকে থমকে দিতে। তিনি প্রমাণ করে দিতে চান,মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া অপরাধ নয়, সৌভাগ্য।
নাজনীনের মুখ থেকে কথাগুলো শুনার পর বড় অবাক হলাম আমি। এবং এক সময় আমার চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা জল। মনে মনে আমি তখন বির বির করে বললাম,’আল্লাহ, আল্লাহ গো, তুমি আমাকে কন্যা সন্তানের পিতা বানাও। আমার মায়ের জন্য পুতুলের মতো সুন্দর একটা নাতনি দান করো।’ দু মাস পরের কথা। নাজনীনের পেটে ব্যথা।রাত থেকে ক্রমাগত পানি ভাঙছে। ব্যথায় তার নাক মুখ কেমন নীলাভ হয়ে গেছে।ধাত্রী মহিলা বারবার নাজনীনকে বলছে,’আরেকটু সবুর করো মা। আল্লাহ তোমারে আসান করবো। মনে মনে আল্লাহর নাম জপো।বলো,ইয়া সালামু।’ নাজনীন বিরবির করে জপতে লাগলো,’
ইয়া সালামু।
ইয়া সালামু।
ইয়া সালামু।’
দুপুর বারোটা বাজে। এই সময় আমাদের বাড়িতে একটা বাচ্চা শিশু ওয়াও ওয়াও করে কেঁদে উঠলো। আম্মা চিৎকার করে ধাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,’কে কাঁন্দেরে ময়মুনা ধাই?’ ধাত্রী জোর গলায় বললো,’আপনার নবাগত নাতনী।’ ধাত্রীর মুখ থেকে আম্মা সুসংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করলেন,’বাড়ির সবাই শুনে রাখো,আমি আমার আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার নামে লিখা যত সম্পত্তি আর গয়না গাটি আছে তার সম্পূর্ণের একমাত্র উত্তারাধিকার আমি আমার নাতনীকে করলাম।’
বাড়ির সবাই আম্মার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। যেন এমন ঘটনা পৃথিবীতে কোনদিন ঘটেনি,ঘটতেও পারে না কোনদিন।আর এই ফাঁকে আমি মনে মনে আরেকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যে মেয়ে তার পেট থেকে আমার জন্য অতবড় একটা জান্নাত বের করে দিলো তার জন্য উত্তম কোন প্রতিদান আমি অবশ্যই দিবো। নিজের সবটুকু ভালোবাসা তাকে দিয়ে বলবো,’আমাকে আরো অনেকগুলো জান্নাত দান করো। আমি অনেক গুলো জান্নাতের মালিক হতে চাই!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত