প্রায় সব লিখিত ভাষাতেই সাহিত্য-বৃক্ষের তরুণতম শাখাটি হলো ছোটগল্প। সবচেয়ে পুরনো শাখার বা বৃক্ষটির মূল কা-ই মহাকাব্য ও কাব্য। মহাকাব্যের এই ইতিহাসটা পুরনো হলেও আধুনিক কবিতা দেখা দিয়েছে অনেক পরে। জলমগ্ন চরে জল শুকিয়ে গেলে সেটা সঙ্গে-সঙ্গে মাটিতে পরিণত হয় না। তৃণাচ্ছাদিত ভূমিখ– পরিণত হতে গেলে জলস্রোত তার অনেক আগেই রুদ্ধ হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। তারপর ধীরে-ধীরে মাটি, ঘাস, শাখা-প্রশাখাবহুল বৃক্ষের সমাহার। আমাদের সাহিত্যের জমিতেও দেখা যাবে, কবিতাই সবচেয়ে পুরনো এবং তার মূলটি সবচেয়ে গভীরে প্রোথিত আছে। এ হিসেবে একালের ছোটগল্পের ইতিহাস অর্বাচীনকালের বললে ভুল হবে না।
মেঘের গর্জন যেমন কানের মধ্যে গড়িয়ে-গড়িয়ে বাজতেই থাকে, বিদ্যুৎ চমক এক পলকও স্থায়ী হতে চায় না। কিন্তু ওই এক পলকের দ্যুতিই তীব্রতম আলো দিয়ে থাকে। ছোটগল্প সম্পর্কে এই তুলনাটাই এতক্ষণ ধরে মনে-মনে খুঁজছিলাম। সাহিত্যের বিশাল ভারী শরীরে ছোটগল্পের বিদ্যুৎচিকুর বোধে আনার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মানুষের মন, ভাবনা, উপলব্ধি, কল্পনাধারা এতই অস্থির আর বহুমুখী, তাকে কোনোমতেই একসঙ্গে আটকে রাখা যায় না। ছোটগল্পকেও একরকম করে বোঝাতে গিয়ে আর একরকম হয়ে যায়। আবার আরো আরেকরকম করে বোঝাতে গিয়ে আকস্মিকভাবে ভিন্ন রকম হয়ে দেখা দেয়। অনেকটা পারদের মতো। কোথাও স্থির থাকতে চায় না। এবার মাত্র দুশো-আড়াইশো বছরের পুরনো ছোটগল্প শাখাটি মাথায় আনার চেষ্টা করে দেখুন। কোথাও তাকে মুহূর্তের জন্য স্থির রাখতে পারছেন না। সেই জন্যে যাকে অতি সূক্ষ্ম তারেও বাঁধা যায় না, তাকে মোটা রশিতে বাঁধার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। কাজেই ছোটগল্প সম্বন্ধে আমার নির্দিষ্ট কোনো কথা নেই। এ কথাহারা হওয়াটাকেই আমি কথার বা ছোটগল্পের একমাত্র সংজ্ঞা বলে মনে করি।
মানুষ চিরকাল গল্প শুনতে চেয়েছে। সে তার মসিত্মষ্কের উত্তম গ্রন্থিরজ্জু দিয়ে মুখে-মুখে গল্প তৈরি করা এবং বলা সম্ভব করে তুলেছে। গল্পেরও কোনো অভাব ঘটেনি, গল্প বলারও কোনো অভাব ঘটেনি। গল্পের পর গল্প, তারপর আবার গল্প, আবার গল্প, তারপর গল্প শেষ। জীবনও আর নেই। অতএব গল্পের অভাব কখনো হয়নি, গল্প বলা এবং শোনার লোকেরও কোনো অভাব হয়নি। মানুষ গল্প দিয়েই তার পৃথিবী রচনা করেছে। গল্প দিয়েই তার পৃথিবী ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বালির প্রাসাদের মতোই জীবনের গল্প তৈরি করেছে এবং ভেঙেছে। এর মধ্যে হঠাৎ শ-দুই আড়াইশো বছর আগে সাহিত্য-বৃক্ষের একটা তেজস্বী শাখা বেরিয়ে এলো। তার পাতাগুলি সুচিক্কণ, সবুজ; শাখা কমনীয় অথচ ভঙ্গুর নয়। আমরা এরকমভাবে লিখিত সাহিত্যের ভিতর থেকে এই যে শাখাটির উদ্গম লক্ষ করি তাকেই ছোটগল্প বলতে চেয়েছি। তাহলে প্রতিদিন সহস্র গল্প নির্মিত হচ্ছে যার কেউ অল্পপ্রাণ, কেউ ধাতবকঠিন, কেউ প্রাচীন শিলার মতো অক্ষয় ও মৃত্যুহীন। এই সামান্য দুশো-আড়াইশো বছরের মধ্যে এরকম যে-শাখাটি জন্ম নিয়েছে তাকেই কি ছোটগল্প বলতে হবে?
বর্ণনা, বিবরণ পেশ করার চাইতে সরাসরি উদাহরণ সামনে আনলেই বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করা যাবে বলে আমার মনে হয়। কিছু ছোটগল্পের কথা বলি তাহলে। ইতালীয় লেখক ডেকামেননের যে-বইটা প্রকাশিত হয়েছিল তাতে অনেক ছোট-ছোট কাহিনি ছিল। সরল, সোজা কাহিনি। তবু আমরা ডেকামেননের
‘কথা’গুলোকেই ছোটগল্পের উন্মেষের উদাহরণ বলে মনে করি। কিন্তু আজ ছোটগল্প যে তুঙ্গ স্পর্শ করেছে তাতে ডেকামেননের ‘কথা’গুলোকে আর ছোটগল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া চলে না। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় মহাকাব্য না লিখে গীতিকবিতার দিকে কেন গেলেন একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তিতে তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন :
আমি নাব্য, মহাকাব্য
সংরচনে ছিল মনে
কিন্তু তোমার কিনকিনিতে
কল্পনাটি গেল ফাটি
হাজার গীতে।
ছোটগল্পের বেলাতেও এই কথাটা অনেকটা খাটে। অণু-পরমাণু দিয়েই বিশ্ব গড়া। কিন্তু অণু-পরমাণু সহজে চোখে পড়ে না। জীবন যখন একটানা বয়ে চলে, তখন তাতে সম্বিতহারা না হওয়া পর্যন্ত ছেদ চোখে পড়ে না। অথচ এই নিঃশব্দে গভীর প্রবহমান স্রোত কিন্তু বিন্দু-বিন্দু জল দিয়েই সৃষ্টি। জীবনের টানা প্রবাহের মধ্যে যদি কিছু অণু-পরমাণু, কিছু সুদৃশ্য পাথরকণা বা হীরককণা হঠাৎ দেখা দেয় সেটাকে আমরা দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে চাই। প্রবহমান জীবনের এই খ-চিহ্ন অথচ অনবরত চলমান স্রোতের ছিন্ন পৃথক কণাগুলিকে অবলম্বন করে পূর্ণাঙ্গ কিছু সৃষ্টি করা ছোটগল্পের কাজ। একটি অতি দীর্ঘ জীবনকে ছোট্ট একটা রুপোর কৌটোয় যদি ভরে নেওয়া যায়, দৈনন্দিন জীবনের ভিতর থেকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বা নিশ্ছিদ্র আঁধারের কোনো একটা জমাট মুহূর্ত আমরা যদি ভাষার বাঁধনে চিরস্থায়ী করে আটকাতে পারি, সেটাকে কি ছোটগল্প বলা যাবে? আবার বলি, বর্ণনা-বিশেস্নষণের চাইতে উদাহরণ বেশি কার্যকর। ছোটগল্পের পরিসর খুব ছোট হোক, মাঝারি হোক, দীর্ঘ হোক, তাকে সময়ের জমাটবাঁধা একটা আকার হিসেবে মনে করা যায়।
আমরা এবার দু-একটি ছোটগল্পের কথা বলব। কারণ ওই যে একটু আগেই বললাম, বর্ণনা-বিশেস্নষণের চেয়ে উদাহরণ শ্রেয়। বাংলা ছোটগল্পের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে পাই। তার আগে কথাসাহিত্য, প্রবন্ধসাহিত্যের পত্তন ভালো করে হলেও, এমনকি আখ্যায়িকা জাতের রচনা কিছু মিললেও বাংলা ভাষার প্রথম ছোটগল্প লেখক এবং সম্ভবত এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কিছু গল্পের উলেস্নøখ করি : ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘ছুটি’, ‘কঙ্কাল’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘গুপ্তধন’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘একরাত্রি’, ‘শাসিত্ম’ ইত্যাদি অনেক গল্পের কথাই আমাদের মনে পড়বে। তাঁর শেষের দিকের গল্প ‘রবিবার’, ‘ল্যাবরেটরি’ তো বটেই, এমনকি ছোট-ছোট উপন্যাসকেও একদিক থেকে ছোটগল্পই বলা যায়। চতুরঙ্গ, চার অধ্যায়, দুই বোন ইত্যাদি ঠিক উপন্যাস নয়, আখ্যায়িকাও নয়। এদের জন্যে সাহিত্যের আলাদা জাঁর খুঁজতে হবে। এইসব গল্প আমাদের সাহিত্যে চিরকালীন সম্পদ। এই একই সূত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এমনসব লেখকের একটি-দুটি গল্প উলেস্নøখ করা যায় যেগুলো আমাদের সাহিত্যে স্থায়ী আসন পাবে বলে মনে করতে পারি। এই কথাগুলি যখন বলছি তখন মাথায় ঘুরছে ইভান তুর্গেনেভ, আন্তন চেখভ, লেভ তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ও’হেনরি, গি দ্য মোপাসাঁ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইলিয়াম ফকনার, মার্ক টোয়েন, এডগার অ্যালান পো – এঁদের নাম ও তাঁদের কিছু-কিছু গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। মূল্যবান রত্নের মতো এসব গল্প। কিন্তু কেউ যেন মনে না করেন এই তালিকাই চূড়ান্ত। পাঠককে মনে না করিয়ে দিলেও তারা এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার’, চেখভের ‘দ্য কিস’, একালের চিনুয়া আচিবি ও আরো কিছু আফ্রিকীয় লেখকের অসহনীয় নিষ্ঠুর বাস্তবতার গল্প মনে করবেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস খুব বেশি গল্প লেখেননি। তবু তাঁর কিছু গল্প আছে যা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। তাঁর ‘ইনোসেন্ট’, ‘ইরিন্দিরা অ্যান্ড হার ক্রুয়েল গ্র্যান্ডমাদার’ কিংবা ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল’ – এসব নভেলাধর্মী গল্পের তুলনা মেলা ভার। অথচ আমরা খেয়ালই করি না, মার্কেস কিংবা তাঁর চেয়েও সরেস ছোটগল্পকার হুয়ান রুলফো, আলেহো কার্পেমিত্ময়ের, বোর্হেস প্রমুখ লাতিন আমেরিকার এই ধরনের অনেক লেখকের গল্প আমরা পেয়েছি যাঁদের লেখা পড়ে মনে হয় ছোটগল্প তার নির্মাণের তুঙ্গে পৌঁছে গেছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের বাংলা ভাষার গল্পের বর্তমান অবস্থাটি কী? এইটুকু বলতে পারি, খুব খারাপ হচ্ছে আমাদের লেখা ছোটগল্প তা ঠিক নয়। গল্প এখন নতুন-নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে, সমাজের কাঠামো বদলাচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রকৃতিও অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিমুহূর্তের বাস্তবতা হাতের তালু বেয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। নগর, শহর, গ্রাম কেমন একটা হতচ্ছাড়া চেহারা নিয়েছে। গল্পও কি তারই মতো ছেঁড়া-খোঁড়া, তালি মারা হয়ে যাবে? গল্পপাঠকরা হয়তো এই দিকেই চেয়ে আছেন।