সম্মতি

আসিফের ঘুম ভাঙল জানালার বাইরে মানুষের হইচই আর চিৎকারের শব্দে। অনেক রাতে বিছানায় গেছে সে, শুয়ে-শুয়ে একটা সিগারেট খেয়েছে, ইয়ারফোন লাগিয়ে মোবাইলে গান শুনেছে, আর চোখের পাতা ভারী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুলকিত মনে সন্ধ্যার ঘটনাগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেছে। সন্ধ্যায় ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়িতে দশজন মুরবিবর সামনে মেয়ে রোজিনার সঙ্গে আসিফের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তিনি কথা দিয়েছেন ঈদের পরই অনুষ্ঠানটি সারবেন এবং দু-একদিনের মধ্যেই মেয়েকে মামাবাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনবেন। সবাইকে হাওলাদার আশ্বস্ত করেছেন, মেয়ে অসুস্থ মামিকে দেখতেই শুধু নবীনগর গিয়েছে; মেয়ে এই বিয়েতে সম্মত, এবং মেয়ের মন কাউকে কখনো দেয়নি, দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

হাওলাদারের দরজার বাইরে আসিফের দুই বন্ধু দাঁড়িয়েছিল, তাদের ডাকা হলেও ভেতরে যায়নি, যেমন বাড়িতেই ঢোকেনি গেটের বাইরে মোটরসাইকেলে বসা আরো দুই বন্ধু। তারা কথাবার্তায় অংশ

নিতে আসেনি, তাতে উৎসাহ পাওয়ার কথাও তাদের নয়। তাদের অভ্যাস আসিফের হয়ে অন্যের সম্মতি আদায় করা – যে-কোনো কিছুতে, যে-কোনো উপায়ে। আসিফের বাবা খোকন চেয়ারম্যান যাতে সম্মত, আসিফও তাতে সম্মত। তার চার বন্ধুও। এবং অন্যরা যাতে এই সম্মতির সঙ্গে গলা মেলায় সে-ব্যবস্থা করা তাদের অভ্যাস।

হাওলাদার তা জানেন। তিনি সম্মতি দিয়েছেন। তারপর বাড়ির অন্দরে খবর পাঠিয়েছেন মেহমানদের, মুরবিবদের আপ্যায়নের আয়োজন শুরু করতে। আসিফ অবশ্য হাওলাদারের সম্মতিকেই যথেষ্ট আপ্যায়ন ভেবে মুরবিবদের কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে। মুরবিবরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছেন; তাদের কেউ-কেউ হাওলাদারের কষ্ট আর অপমানকে নিজেদের দীর্ঘশ্বাসে একটা জায়গা করে দিয়েছেন। তারা জানেন সন্ধ্যাটা রোজিনার জন্য একটা বিভীষিকা হয়ে থাকবে। তাদের দুজন জানেন, রোজিনা তার মন দিয়ে রেখেছে কিসলুর করকমলে। কিসলু সুদর্শন ছেলে, গ্রামের একমাত্র এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার, যদিও তার চাকরি জেলা হাসপাতালে। তার সমস্যা তার বাবা। পেশায় জেলে ছিলেন। মাছ মারতে গিয়ে এক বিকেলে বাজ খেয়ে মরে গেলেন, কিসলু আর তার তিন বোনকে পথে বসিয়ে।

ও, এদের সঙ্গে কিসলুর মা-ও ছিলেন, তবে তার থাকা না-থাকায় পার্থক্য খুব একটা নেই, যেহেতু চার বছর আগে কোমর ভেঙে তিনি বিছানাতেই থাকেন।

তাহলে কিসলু ডাক্তার হলো কী করে, জিজ্ঞেস করলেন? আপনাদের বলি,

ইচ্ছাশক্তিটা যার থাকে কিসলুর মতো, সে ডাক্তার কেন, রকেটবিজ্ঞানীও হতে পারে। তবে তারাকাটা ইউনিয়নে রকেটবিজ্ঞানী হয়েও খুব একটা নিরাপদ কেউ থাকতে পারবে না, যদি না খোকন চেয়ারম্যানের সকল সম্মতিকে নিজের সম্মতি বলে সে মেনে নেয়। মাস তিনেক আগে চেয়ারম্যান শুনেছেন ইদ্রিস হাওলাদারের মেয়েকে ছেলে মনে ধরেছে। হাওলাদারের জমিজমা, টাকাপয়সা আছে, তবে মানুষের সম্মতি আদায়ে পারদর্শী লোকজন নেই। আসিফের পছন্দ চেয়ারম্যানেরও মনে ধরেছে। তবে তাতে সম্মত হয়নি রোজিনা আর কিসলু। রোজিনার বাবা যেহেতু জানেন, সম্মত না হলে মেয়ের (এবং তার নিজের) কপালে কী থাকতে পারে, তিনি মেয়েকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে চেয়ারম্যানকে সম্মতি জানিয়েছেন। আর মামাবাড়ি পাঠানোর আগে কাতরকণ্ঠে মেয়েকে বুঝিয়েছেন, সম্মতি না দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে।

তার চোখে পানি দেখে মেয়ে চুপ থেকেছে। তারপর মামাবাড়ি গেছে।

কিসলুর অবশ্য বাবা নেই যে তার হয়ে তিনি কিছু একটা করবেন। থাকলেও জেলে বাবার হাত কতটাই আর শক্ত, যে অসম্মতির বিপদ তিনি সামলাবেন? নদী আর বিলের বিপন্ন মাছগুলির বিপদ ডেকে আনা ছাড়া তার দুই হাত কারো গায়ে একটা টোকাও তো দিতে পারত না। কিসলু তার অসম্মতি নিয়ে জেলা শহরেই থেকে গেছে। তার পক্ষে গ্রামে আসা এখন ট্রেন আসার আগে রেললাইনে শুয়ে পড়ার মতো।

ভাগ্যিস তিনটি বোনের বিয়ে হয়েছে; তারা অন্য গ্রামে, অন্য ঠিকানায় আছে। বড় বোনটি মাকে নিয়ে রেখেছে তার ঠিকানায়, যেখান থেকে কিসলু তাকে উদ্ধার করে তার শহরের বাসায় নিয়ে যাবে। কিসলুর অবশ্য আরেক বিপদ। রোজিনার ব্যাপারটাতে চেয়ারম্যানের সম্মতির বাইরে গিয়ে সে না হয় ফেরারি, কিন্তু আসিফের এবং চেয়ারম্যানের চোখ যদি রোজিনার ওপর না-ও পড়ত, তাহলেও ইদ্রিস হাওলাদারের সম্মতিটাও সে হয়তো শেষ পর্যন্ত পেত না। কারণ তার বাবা। আরো নির্দিষ্ট করে, বাবার পেশা। তবে তাতে বিপদ খুব একটা হতো না। রোজিনা তো পা বাড়িয়েই আছে। দিনক্ষণ ঠিক হলে তার মামাতো ভাই আলিফকে নিয়ে শহরে কাজির অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে নেয়া যাবে। তারপর অনন্তকালের মধ্যে নিশ্চয় হাওলাদারের মন মেয়ের জন্য নরম হবে, তার সম্মতিও মিলবে। সেই অনন্তকাল পর্যন্ত তারা জেলা শহরেই না হয় থেকে যাবে। তারাকাটায় না হয় না-ই যাবে।

মামাত ভাই আলিফ বলেছে রোজিনাকে, আপু, কিসলু ভাইয়াকে যেদিন দুলাভাই বলে ডাকব, সেদিন আমার মনটা শান্ত হবে। রোজিনা খুশি হয়ে তাকে একটা স্মার্টফোন কেনার পয়সা দিয়েছে।

স্মার্টফোনের কথায় মনে পড়ল, স্মার্টফোন রোজিনাও একটা কিনেছে, তাতে নতুন সিমকার্ড লাগানো। এই নাম্বারটি শুধু কিসলু জানে। আসিফ জানে না। কিসলুকে বলেছে রোজিনা, এই ফোনটাই তোমার-আমার মাঝখানের একটা সেতু। রোজিনা ঘর থেকে বের হয় না, জেলা শহরে যাওয়া তো দূরের কথা, যেহেতু বাড়ির বাইরে আসিফের সম্মতি আদায়কারী বন্ধুরা পাহারায় থাকে। তাই কিসলু যে বলেছে আলিফকে নিয়ে চলে আসো, বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে, রোজিনা যায় কীভাবে?

ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিফ গেছে তারাকাটা বাজারে। সেখানে শিপনের ওষুধের দোকানের পেছনে বসে তারা ডাইল খেয়েছে। সঙ্গে মার্লবরো সিগারেট। তারাকাটায় নতুন এসেছে এই সিগারেট, দামটাও চড়া। তাতে অবশ্য আসিফের কিছু যায় আসে না। আসিফকে বলেছে তার এক বন্ধু, জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করলে কেমন হয়?

বন্ধুটির মাথায় অপারেশন নবীনগর নামের একটা সিনেমা সক্রিয় হয়েছে, যার নায়ক, অবাক কা-, সে, আসিফ না। আসিফ বরং তার কৃপাপ্রার্থী।

আসিফ বলেছে, ইডিয়টের মতো কথা বলিস না। বাবা সেটা পছন্দ করবেন না। আমিও না। সে আমার জীবনসঙ্গী হবে, তার ওপর জোর খাটাব না।

জোর খাটানো নয়, তবে সম্মতিটা আদায় করতে হবে। জোর যদি না খাটানোই গেল, তাহলে কীভাবে তা অসম্ভব?

বিছানায় শুয়ে আসিফের ভারী চোখেও একটা সিনেমার ছবি ভেসে উঠেছে, সিনেমাটার নাম তুমি আমার, যেখানে রোজিনার বাড়িতে আগুন লেগেছে, আর রোজিনা ঘরে আটকা পড়েছে, আসিফ দৌড়ে এসে তাকে উদ্ধার করেছে, পাঁজাকোলা করে বাইরে নিয়ে এসেছে। বাইরে চাঁদের আলো। সেই আলোয় আসিফের গায়ে লেপ্টে থাকা রোজিনা বাতাবি লেবুর মতো চাঁদটির দিকে তাকিয়ে বলেছে, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

ঘরের বাইরে হইচই, কোলাহল। আসিফ অবাক হলো, ঠিক শুনছে তো? এত সকালে এত শব্দ? এত মানুষ? সে বিছানার পাশের জানালাটা খুলল। জানালার বাইরে বাগান, ফুলের, ফলের। একটু দূরে পাঁচিল। পাঁচিলের বাইরে হলস্না। পাঁচিলের ভেতরে, বাগানের মাঝখান দিয়ে বসানো সিমেন্টের রাস্তায় কাজের লোকজন, পাইক-পেয়াদা। যে-কোনো দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে দশ-পনেরো জোয়ান থাকে। এরাও চিৎকার করছে।

আসিফ উঠল। দুহাতে লুঙ্গিতে গিট্টু মেরে, চুল সমান করতে করতে সে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু চেয়ারম্যানের দুই খাস লোকের একজন, বদি, তাকে আটকালো। বদি বলল, গ্রামে পুলিশ এসেছে।

পুলিশ? আসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। পুলিশকে সে পছন্দ করে না, ভয়ই পায় বরং।

বদি তাকে বলল, পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য জমি দখল নিতে পুলিশ এসেছে। এখন যাকে দেখবে, ধরে নিয়ে যাবে।

আসিফ বুঝল, বিপদ। সে পাওয়ার পস্ন্যান্টের ইতিহাসটা জানে। দুই বছর আগে তারাকাটার উত্তরে আশি একর খাস জমি লিজ নেয় হিরো কোল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়াও লাগিয়েছিল। আট-দশ ইউনিফর্ম পরা পাহারাদারেরও ব্যবস্থা করেছিল। তারপর আর কোনো খবর নেই। মাসদুয়েক আগে হঠাৎ এক জরিপের দল এসে হাজির। তারা নানা মাপজোখ করল। তারপর একদিন চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে গেল।

রাতে খেতে বসে চেয়ারম্যান তার তিন ছেলে আর দুই মেয়ে জামাইকে জানালেন, কোম্পানির জন্য আরো চলিস্নশ একর জমি চাই। এই চলিস্নশ একরের সবটাই তারাপুর ইউনিয়নের – তারাপুর আর মূলত ইন্দুয়া গ্রামের। কোম্পানি কিনতে চেয়েছে। চেয়ারম্যান জানালেন, তিনি সম্মতি দেননি। ওই চলিস্নশ একরের তিন একর তারও কিনা।

আসিফের বড় ভাই আরিফ বলেছে, সম্মতি না দিলে তারা কি তা মানবে?

চেয়ারম্যান বলেছেন, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু তিনি সম্মতি দেবেন না, তার ইউনিয়নের কোনো মানুষও না।

সপ্তাহখানেক আগে চেয়ারম্যানকে থানায় ডেকেছে। তিনি সকালে গিয়ে দুপুরে ফিরে এসেছেন হাসিমুখে। বলেছেন, তার অসম্মতি বিবেচনা করে কোম্পানি চলিস্নশের বদলে ত্রিশ একর কিনবে। ওই ত্রিশ একরে তার তিন একর নেই।

আসিফ অবাক হয়েছে, কোম্পানি-পুলিশের মতো ক্ষমতাবানদেরও বাবার সম্মতিতে মাথা দোলাতে হয়েছে।

বদি তাকে ঘরে থাকতে বলে বেরিয়ে গেছে। বদি উত্তেজিত। পুলিশের এক বাহিনী এসে কোনো সময় না দিয়ে মানুষজনকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। যারা বাধা দিয়েছে, তাদের পিটিয়েছে। কাজটা শুরু করেছে সাতসকালে, যখন মানুষ দিনের জন্য তৈরি হয়।

এক  মহাবিপর্যয়।

চেয়ারম্যান গেছেন বিষয়টার সুরাহা করতে। কিন্তু বদি শুনেছে, তাকে পুলিশ আটকে রেখেছে। কথাগুলি বলতে না বলতে বদির ফোন বেজেছে। ফোনে সে চিৎকার করেছে; তার চিৎকারে বাগানের আশপাশ দিয়ে ঘুরতে থাকা দুই মোরগ কক কক করে উঠেছে। বদি উত্তেজিত গলায় বলেছে আসিফকে, আমার বউটাকে বাসা থেকে বের করে জিনিসপত্র ভেঙে দিয়েছে পুলিশ।

বদির ধারণা ছিল, সে শক্তিশালী। তাকে, তার পরিবারকে কেউ ছোঁবে না। বদি অবশ্য বোঝেনি, তারাকাটার কেউকেটাদের পুলিশ পরোয়া করে না। পুলিশের দুনিয়াটা তারাকাটা থেকে যেহেতু অনেকটা  বড়।

 

দুই

খোকন চেয়ারম্যানকে থানায় নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে বোঝানো হলো, আজ শুধু পুলিশ ভয় দেখিয়ে গেল। তাকে হপ্তা দুয়েক সময় দেওয়া হলো, তিনি যেন তারাকাটা-ইন্দুয়ার মানুষজনকে বোঝান, কোম্পানি যে-দাম দেবে, মানুষ যেন তা মেনে নিয়ে জায়গা ছেড়ে দেয়। তা না হলে জমি যাবে, কিন্তু পয়সা পাওয়া হবে না।

আমও যাবে, ছালাও যাবে, থানার ওসি বললেন, এবং হাসলেন। হাসিটা বুকে বাজল চেয়ারম্যানের। এই হাসি তাকে বলছে, কোম্পানির কথা শোনো, কোম্পানির সম্মতি মাথায় নিয়ে গ্রামে যাও। কাজে নামো। কাজ হলে ভালো, না হলে দেখা যাবে।

রাতের খাবার খেতে বসে তিনি কথাটা তুললেন। বড় ছেলে আরিফ বলল, তাই হোক বাবা। আপনি মানুষকে বোঝান।

মেজ ছেলে আতিফ ঢাকায় থাকে। আবহাওয়া অফিসে চাকরি করে। তার আলাদা থাকতে, চাকরি করতে, তারাকাটায় না থাকতে, বউ-ছেলে নিয়ে নিউ মার্কেটে বাজার করতে ভালো লাগে। বাবাকে তার ভালো লাগে, যদিও তার অনেক কিছুই তার অপছন্দ। সে বলল, বাবা আমার সঙ্গে ঢাকা চলেন। তারাকাটা আপনার জন্য নিরাপদ নয়।

চেয়ারম্যান হাসলেন। বললেন, মানুষগুলা জমি ছেড়ে দিলে যাবে কোথায়?

তিন ছেলেই অবাক হলো। কথাগুলো বাবা বলছেন? খোকন চেয়ারম্যান বলছেন? মানুষকে জমি ছাড়া করে যিনি ওই তিন একরসহ পাঁচ একরের মালিক হয়েছেন? আসিফ বুঝল, বাবার কথায় আর পুলিশ বা কোম্পানি কেউ সম্মতি জানাচ্ছে না, এজন্য তার গলা নরম হয়ে গেছে। বাবার রাজত্বের দিন কি তাহলে শেষ? সে দেখেছে বদির মতো কঠিন মানুষও মিইয়ে গেছে। আসিফকে বদি অনুরোধ করেছে, চেয়ারম্যান সাহেবকে বলে যেন এক টুকরা জমির বন্দোবস্ত করে দেয়। ঘর সে নিজেই তুলবে।

অর্থাৎ পুলিশের লাঠির বাড়িতে বদির সাহস এতটাই গেছে, চেয়ারম্যানকে এই অনুরোধটাও নিজে সে করতে পারছে না।

তিনদিন পর কোম্পানির লোকজন এলো। মানুষের সঙ্গে কথা বলল। চেয়ারম্যানের বাড়িতে এসে জানাল, মানুষজনকে বাজারদর থেকে বেশিই দর দেবে জমির জন্য। তবে দেরি করলে চলবে না। পাওয়ার পস্নান্টের কাজ দ্রুতই শুরু হবে। চীন থেকে ইঞ্জিনিয়াররা আসবে। তাদের জন্য দালান ওঠাতে হবে।

আসিফ দেখল, সকাল থেকে মানুষ এসে ভিড় করে, চেয়ারম্যানের কাছে ফরিয়াদ জানায়। চেয়ারম্যান একদিন তাদের বলেছেন, এমপি সাহেব কোম্পানির সঙ্গে আছেন, এমপি সাহেবের ছেলেও আছে, যেহেতু সে একটা বড় কাজ পেয়েছে। এখন তার কিছুই করার নেই।

এখন ওপরওয়ালা যদি দয়া করেন, খোকন চেয়ারম্যান বলেছেন।

আসিফের মনটা খারাপ হয়ে গেল। না, মানুষের দুঃখে না, তার মন খারাপ হলো বাবার অসহায় মুখটা দেখে। বাবাকে সে জন্ম থেকে দেখেছে উঁচুমাথার মানুষ। একসময় তারাকাটা বাজারে আড়ত ছিল তার। কৃষিজমি ছিল। বরাবরই অবস্থাপন্ন, সে-কারণে মাথাটা উঁচু রাখতে পারতেন। তারপর ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার হলেন, চেয়ারম্যান হলেন, মাথাটা উঁচুতেই রেখে দেওয়ার অবস্থা তৈরি হলো। আসিফ স্কুল-কলেজ পাশ করেছে, বিএ পর্যন্ত পড়েছে। তারপর পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে বাজারের আড়ত আর অন্যান্য ব্যবসায় আরিফের সঙ্গী হয়েছে। কিন্তু আরিফ যেখানে শুধু ব্যবসাপাতি ইত্যাদি নিয়ে থাকে, আসিফ সেখানে রাজনীতিতেও নেমেছে। বাবার রাজনীতি সেও করে। আরিফ আপত্তি করেনি, সে জানে, পরিবারের একজনকে বাবার সঙ্গে থাকতে হবে। থাকাটা জরুরি। কিন্তু আরিফ খেয়াল করেনি, বাবার মতো অন্যের সম্মতি আদায় করাটা আসিফেরও একটা নেশা হয়ে গেছে।

একদিন আতিফ বলেছে আরিফকে, যদি তারাকাটায় বাবার শক্ত কোনো প্রতিপক্ষ থাকত, তার যেমন বিপদ হতো, আসিফেরও হতো। হয়তো বেশিই হতো। তাদের কপাল ভালো, তারাকাটায় বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।

এজন্য ইদ্রিস হাওলাদারের মতো মানুষরাও খোকন চেয়ারম্যানের সকল কথায় মাথা নাড়েন; কিন্তু এরকম কি সারাজীবন থাকবে?

রোজিনার সঙ্গে যেদিন বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়িতে, আতিফ ইচ্ছা করেই তাতে যোগ দেয়নি। যদিও সেদিনই ঢাকা থেকে এসেছিল সে। মাথাব্যথার দোহাই দিয়ে বাড়িতে শুয়েছিল। আরিফ ফিরে এসে যা বলেছিল, তাতে আতিফের খুব খারাপই লেগেছিল। সে বলেছিল আরিফকে, বিয়েশাদিতে জোর খাটানো কি ঠিক ভাইয়া?

আরিফ নিচু গলায় বলেছিল, বাবার ইচ্ছা।

আতিফ ঢাকা ফিরে যাওয়ার আগে আসিফকে শুধু বলেছিল, মেয়েটা যদি নিজ থেকে রাজি না হয়, আমি তোর বিয়েতে আসব না।

আসিফ হেসে বলেছিল, যদি না হয় মানে কি, সে তো এখনই রাজি।

কথাগুলো বলতে-বলতেই আসিফ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রোজিনার সঙ্গে সে নবীনগর গিয়ে দেখা করবে। কোনো জোর খাটাবে না, শুধু রোজিনাকে সম্মত করাবে। আর একটা ফোন দিয়ে বলবে, আমি প্রতিদিন দুই বেলা ফোন করব, ফোনটা ধরবে। কথা বলব।

তাতেও সম্মত করাবে রোজিনাকে।

ফোনটা সে আগেই কিনে রেখেছে। স্মার্টফোন।

 

তিন

কিন্তু তারাপুরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকল। এক দুপুরে কোম্পানির লোকজনের ওপর হামলা হলো। পুলিশ এসে প্রথমে ধরপাকড় করল, পরে লাঠি চালাল, আরো পরে টিয়ারগ্যাস আর গুলি মারল। সোবহান মাঝি গুলিতে মরল। সোবহান মাঝির বয়স ৭২, মুখে একটাও দাঁত নেই। মাথায় একটাও চুল নেই, শুধু সাদা দাড়ি বুক সমান।

এবার খবরের কাগজের আর বড়-বড় ক্যামেরা কাঁধে টেলিভিশনের লোকজন এসে হাজির হলো। এদের দেখে তারাকাটার মানুষ ক্ষিপ্ত হলো। তারা ঘোষণা দিলো, জান দেবে, জমি দেবে না। মানুষ আশা করেছিল খোকন চেয়ারম্যান তাদের সঙ্গে থাকবেন, কিন্তু চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলেন। মানুষ দুদিন তার অসুস্থতা মেনে নিল, কিন্তু তৃতীয় দিন বাড়ি গিয়ে তাকে সাদা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে ঘরের বারান্দায় বসে হুঁকা খেতে দেখে মানুষ গেল ইদ্রিস হাওলাদারের কাছে। হাওলাদারের কিছু জমি চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তার বেরিয়ে আসার কারণ সেটি নয়, কারণ রোজিনা। রোজিনা তাকে বলেছে, প্রতিবাদ করতে হবে বাবা। বসে থাকলে চলবে না।

আপনাদের বলা হয়নি, পুলিশ গ্রামে হামলে পড়ার পরদিনই রোজিনা ফিরে এসেছে। কিসলুকে ফোন করে বলেছে, টিভিতে দেখেছি, এই পাওয়ার পস্নান্ট বসলে তারাপুর ইউনিয়নের সব কৃষিজমি নষ্ট হবে। পানির ঘাটতি হবে, আমাদের বিলসা নদী তো শুকিয়ে কবেই বুড়ো হয়ে গেছে।

রোজিনা কিসলুকে আরো খোঁজখবর নিতে বলেছে। তৈরি হয়ে আসতে বলেছে।

কিসলু অবশ্য তৈরিও হয়নি, তারাকাটাতেও আসেনি। তার ডাক্তারি কাজ তাকে এক মিনিট বাড়তি সময় দেয় না। এমনকি টিভি দেখার সময়টাও সে পায় না। আর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যে কথা বলবে, কার সঙ্গে? সে কাউকে চেনে না। পরিবেশ দূষণ ব্যাপারটা নিয়েও সে ভাবেনি। তাছাড়া, তারাকাটা গেলে আসিফের লোকজন তাকে কতটা কী করবে, সে-হিসাবটাও মাথায় রাখতে হয়। সে ফোনে এই তো, আসছি, ইত্যাদি বলে সময় কাটায়।

কিন্তু কাটাবার জন্য সময় বসে থাকে না। তারাকাটায় সময় ঘোড়ার মতো চলছে। এক সকালে পাঁচ হাজারের মতো মানুষ ঘিরে ফেলল হিরো কোল থারমাল কোম্পানির জমি। যে দশ-বারো পুলিশ ও পাহারাদার ছিল, তারা ভয়ে পালাল। মানুষ হিরো কোম্পানির যা সামনে পেল – পাকা দালান হলে পাকা দালান, কাঁটাতারের বেড়া হলে কাঁটাতারের বেড়া, সব গুঁড়িয়ে দিলো।

খবরের কাগজ, টিভি এলো, পরিবেশবাদীরা সেই ঢাকা থেকে এলেন, তারাকাটা থেকে লাইভ শো হলো টিভিতে। পরিবেশবাদীরা বললেন, কিছুতেই পাওয়ার পস্নান্ট বসানো চলবে না, পরিবেশের তাতে বারোটা বাজবে, জমি নষ্ট হবে। ইত্যাদি। ইদ্রিস হাওলাদারকে প্রশ্ন করলেন সঞ্চালক। হাওলাদার বললেন পরিবেশ-টরিবেশ বুঝি না, মানুষের জমি নেওয়া চলবে না। সরকার চাইলে খাস জমিতে বসাক পাওয়ার পস্নান্ট, কিন্তু মানুষের জমিতে নয়।

সঞ্চালক বললেন, আপনি তো প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা। আপনি কেন পাওয়ার প্লান্ট চাইবেন, এমনকি সরকারের জমিতেও?

হাওলাদার বোকার মতো তাকালেন। আমি নেতা হব কেন? আমি তো এই মানুষদের একজন।

বাবাকে বোকা বনতে দেখে রোজিনা এগিয়ে এলো। সে বলল, আমার বাবা নেতা নন, এখানে কেউ নেতা নন। এখানে যারা তারা সবাই ভুক্তভোগী। বাবা শুধু মানুষের প্রতিবাদের ভাষাটাই প্রতিধ্বনিত করছেন।

সঞ্চালক পুলকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও কি আছেন এই প্রতিরোধ-আন্দোলনে?

রোজিনা বলল, আপনিও আছেন, আপনাকেও থাকতে হবে, যেহেতু এটি আমাদের সকলের জীবন-মরণ সমস্যা।

সঞ্চালক বিমোহিত হয়ে বললেন, আমাদের দর্শকদের জন্য একটু কি বুঝিয়ে বলবেন?

উৎসাহ পেয়ে রোজিনা পরিবেশ চিন্তার ওপর একটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতাই দিয়ে দিলো। কিসলুর ‘আসছি আসব, দিচ্ছি দিব’ তাকে বিরক্ত করেছে। সে তার স্মার্টফোনে গুগল আর পরিবেশবাদীদের নানা লেখালেখি ঘেঁটে যা জেনেছে, সহজ করে তাই বলল। ডিগ্রিওয়ালা পরিবেশবিদদের অপেক্ষায় রেখে রোজিনাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সঞ্চালক। তার প্রত্যয় জন্মাল, এই মেয়েটি তার টিআরপি রেটিং বাড়িয়ে দেবে।

একটু দূরে থেকে রোজিনার কথা শুনছিল আসিফ। এই কদিন, সত্যি বলতে কি, রোজিনাকে সে ভুলেই গিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা – এক সময়ের পরাক্রমশালী বাবা ঘরে বসে থাকেন, অসুস্থতার ভান করে। বিষয়টা আসিফকে পীড়া দেয়। সে অবশ্য বোঝে, বাবার পরাক্রমের দিন শেষ। এমপির ছেলে নাইমুল এখন বাবাকে গিলে খেতে পারে। আসিফ আরো ব্যতিব্যস্ত বদির কারণে – বদির মাথাটা খারাপ হয়েছে, আবোল-তাবোল বকে। তার চার বন্ধুর দুই বন্ধুকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল নাইমুল, সেই নাইমুলের বাড়ি শিমূলিয়া। ওরা এখন নাইমুলের সঙ্গেই আছে।

মাত্র কয়েকটা দিন, আসিফ ভাবে, অথচ চেনা দুনিয়াটা কীভাবে পালটে গেল। যেন ভোজবাজি।

রোজিনার কথা শুনতে-শুনতে তার মনে হলো, এরকম করে কথা বলতে কাউকে সে শোনেনি। তার মা হয়তো বলতেন, কিন্তু মাকে এখন মনে পড়ে একটা দূরের অস্পষ্ট ছবির মতো। ছোটবোন সেলিমা হওয়ার সময় তিনি চলে গেলেন। সে কতদিনের কথা।

মা থাকলে তাকে কী বলতেন, হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্ন তার মনে এলো। কেন, সে বলতে পারবে না। অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিল, রোজিনার সঙ্গে একটু কথা বলবে। মায়ের কথাটা বলবে। জোর খাটানো মা পছন্দ করতেন না; এবং মা চাইতেন, মানুষ তার কথা শুনুক। কারণ তিনি সবার মঙ্গলের জন্য কথা বলেন।

এই চিন্তা ধন্ধে ফেলল আসিফকে, কারণ মা তাকে এসব বলেননি। কাকে বলেছিলেন তাহলে? কে তাকে বলল? তার মনে পড়ল আরিফ তাকে একদিন বলেছিল, মা চাইতেন, সবাই যেন পড়ালেখা করে মানুষ হয়। সে যে পড়ালেখা তেমন করতে পারেনি, তা তাকে কষ্ট দেয়। সেজন্য আরিফ মানুষ হতে চেষ্টা করেছে। সেজন্য বাবার মতো রাজনীতি করতে নামেনি।

চার

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে রোজিনা টের পেল, কেউ তার পেছন-পেছন হাঁটছে। সে থামল। থেমে পেছনে না তাকিয়ে বলল, আমার পেছন নিয়েছেন কেন?

রোজিনা বুঝেছে, কে তার পেছন নিতে পারে।

পা চালিয়ে রোজিনার পাশে এসে দাঁড়াল আসিফ, বলল, একটা কথা বলব, শুনবে?

রোজিনা চুপ করে রইল।

আসিফ বলল, শুনেছ নিশ্চয়, তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম? তোমার বাবা তো রাজি হয়েছেন।

রোজিনা হাসল, বলল, বিয়েটা তো বাবা করছেন না। তাই না?

আসিফ একটু থেমে বলল, জানি তোমার আপত্তি থাকবে, কারণটাও জানি; কিন্তু একটু ভাববে কি?

আপনি যদি আমার আপত্তির কারণটাই জানেন, এ-ও নিশ্চয় জানেন, এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই। আপনার বাবা আমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করেছেন, আপনিও গুন্ডা লাগিয়ে রেখেছেন, এসব কি ঠিক?

আসিফ হাসল। জোর খাটাব না, কিন্তু  তুমি রাজি হবে, আমার বিশ্বাস।

রোজিনাও হাসল, কারণ তার হঠাৎ মনে হয়েছে লোকটা শুধু বদই না, মোটা মাথারও। না হলে এরকম কথা কেউ বলে?

রোজিনা হঠাৎ বলল, শুনুন, আমি যদি বলি আপনি আমার কথাতে রাজি হবেন, আমি জোর খাটাব না। তাহলে কথাটা কেমন শোনাবে?

কোন কথা? আসিফ জিজ্ঞেস করল।

রোজিনা হাসল। লোকটা সত্যি মোটা মাথার। বাংলাও বোঝে না। তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। কয়েক সেকেন্ড ভেবে সে বলল, যেমন ধরুন এই পাওয়ার পস্নান্ট যাতে না হয়, সেজন্য কাজ করুন, প্রতিরোধ আন্দোলনে নাম লেখান।

রোজিনার কথাগুলো একটা বাচ্চা মেয়ের কথার মতো শোনাল আসিফের কাছে। সে মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, যদি তোমার কথায় রাজি হই, তুমি রাজি হবে আমার কথায়?

রোজিনার ধৈর্য চলে গেল। আপনি আসলেই মোটা মাথার একটা লোক, সে বলল, আর বদ। আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কথা বলাটাও সময়ের বাজে খরচ।

আসিফের মাথায় রাগ চড়ে এলো। কিন্তু সে নিজেকে সংবৃত করল। তার মনে হলো, কথা বলাটা তার জন্যও সময়ের অপচয়।

খোকন চেয়ারম্যান নিসেত্মজ হয়ে যেতে পারেন, আসিফ মিয়াজি নিসেত্মজ হওয়ার মানুষ না।

সে নিজেকে বলল, আর কটা দিন। পাওয়ার পস্ন্যান্টের ঝামেলাটা মিটুক। তারপর দেখা যাবে।

 

পাঁচ

বাড়ি ফিরে রোজিনা তার বাবার সঙ্গে বসল। হাওলাদার মাত্র ফিরেছেন, ঘামছেন। প্রতিরোধ-আন্দোলনের নেতা বনে যাওয়াটা তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তার কোনো উপায় ছিল না, ইউনিয়নের মানুষ ঠেলে তাকে সামনে এনেছে। তারপর তিনি পড়েছেন মিডিয়ার হাতে। এখন ঢাকা থেকে ফোন করে পত্রিকা তার সাক্ষাৎকার চায়। বিবিসি রেডিও নিতে চায় তার এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ। এটা ঠিক কী, বুঝতে না পেরে তিনি বলেছেন সন্ধ্যায় যোগাযোগ করতে।

মেয়ের সঙ্গে তারও কথা বলতে হবে। এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউটা কী, এটি মেয়ে হয়তো বলতে পারবে। ভীষণ পড়ুয়া তার মেয়ে।

রোজিনা প্রশ্ন করল আগে। জিজ্ঞেস করল, কেন তিনি চেয়ারম্যানকে বললেন না, কিসলুর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।

 

হাওলাদার অবাক হলেন।

চোখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?

রোজিনা মাথা নাড়ল।

এ বিয়েতে তো আমি সম্মতি দেব না, মা, তিনি বললেন।

কেন?

হাওলাদার চুপ করে থাকলেন।

কিসলুর বাবা মাছুয়া ছিলেন, সেজন্য? গলায় শেস্নষ ঢেলে জিজ্ঞেস করল রোজিনা।

কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে গেলেন হাওলাদার। তার বিরক্তি হলো। মেয়ে বেয়াদব হচ্ছে, জেলের ছেলে কিসলুটা লাই পাচ্ছে। আর, ধুত্তুরি, এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউটা কী জিনিস, জানা হলো না।

 

ছয়

জানার প্রয়োজনও হলো না, কারণ সন্ধ্যায় গ্রামে পুলিশ নামল। হাওলাদারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল। তবে তার সঙ্গে ব্যবহারটা খারাপ করল না। খারাপ ব্যবহারের শিকার হলো বদি। সে এত মার খেল যে, তাকে পুলিশকেই ভ্যান জোগাড় করে হাসপাতালে পাঠাতে হলো।

যদি জানতে চান, বদি তার স্ত্রীকে প্রথম দিন পুলিশ গালিগালাজ করায় আজ তার বদলা নেওয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে একটা লাঠি নিয়ে তাড়া করতে গিয়েছিল।

যদি আরো জানতে চান, বদি পথেই ভ্যান গাড়িতে মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার মুহূর্তে বদি দেখেছে, স্ত্রী তার মাথার পাশে বসে তাকে আদর করছে, পানি খাওয়াচ্ছে। বদির তাই মনে হলো না যে সে মারা যাচ্ছে। এজন্য কিনা, ময়নাতদন্তওয়ালা ডাক্তার তার মুখে একটা হাসি দেখে চমকে উঠেছিলেন।

বদির মৃত্যু, অথবা হাওলাদারের গ্রেফতার, অথবা কোম্পানির পালিয়ে যাওয়া পাহারাদারদের পুলিশ পাহারায় ফিরে এসে বদলা নেওয়ার আকাঙক্ষা, কারণ যা-ই অথবা যতটা হোক, একটা বিস্ফোরণের বারুদ হিসেবে কাজ করল এর সবই। ছোটবেলা আমি, এই অধম গল্পকার, অবাক হয়ে দেখতাম, মা রান্নাঘরের একখানে মাছ কেটে রেখেছেন, অন্যখানে রেখেছেন কাটা সবজি, বাটা মসলা। ক্ষুধা নিয়ে তাকাতাম, আর ভাবতাম, এসব একখানে করে কীভাবে একটা তরকারি হবে। মনে হতো অসম্ভব। কিন্তু মা ক্ষিপ্র হাতে রান্না চড়াতেন। তাতে পেঁয়াজের সময় পেঁয়াজ, নুনের সময় নুন, মাছের সময় মাছ কড়াইতে পড়ত। আধাঘণ্টা পর সুগন্ধ ছড়ানো, জিবে জল নিয়ে আসা নিটোল তরকারি আমাকে ডাকত। বলত, আমি তৈরি। আমার মনে হতো, মার কুশলতাটা এক অপার্থিব রসায়নবিদ্যা।

তারাকাটাতেও আলাদা-আলাদা উপাদানগুলি কখন একখানে হয়ে যে একটা রসায়নের সূত্রপাত করল! আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, চলিস্নশ ঘণ্টার কম সময়ে একটা বিপস্নব হয়ে গেল।

বিপস্নবের দিন সকালেও হইচই-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল আসিফের। তবে, আজ সে লাফ দিয়ে উঠল। গত রাতে বাবার সঙ্গে তার তর্ক হয়েছে। জীবনের প্রথম তর্ক, কিন্তু তর্কটা যেন অবধারিত ছিল। রাতে খেতে বসে আসিফ শুধু বলেছিল, বাবা, আপনি একটু বেরোন না, মানুষ আপনাকে চায়।

চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আমি অসুস্থ।

একথা শুনে আসিফ নিশ্চয় একটু হেসেছিল।

তাতেই চেয়ারম্যানের গলা বাজের শব্দে ফাটল। বেয়াদব, তিনি বললেন, এখন শ্বশুর অ্যারেস্ট হয়েছে বলে আমাকে মাঠে নামাচ্ছ? আমার অসুস্থ শরীর নিয়ে ওই ল্যাংড়াটাকে ছাড়িয়ে আনতে যাব?

ল্যাংড়াটা মানে হাওলাদার, যদি জানতে চান। তিনি একটু পা টেনে হাঁটেন, গাছ থেকে পড়ে সেই কবে একটা পা যাচ্ছেতাই জখম হয়েছিল কিনা, সে জন্য।

আসিফ সিদ্ধান্ত নিল, সে বেরোবে। তার চার বন্ধুর শেষ দুই বন্ধুও মোটরসাইকেলসমেত নাইমুলের দলে যোগ দিয়েছে। এতে আসিফের বুকে হাহাকার বাজছে।

 

সাত

রোজিনা ফোন করেছে – ফোনের পর ফোন করেছে, এবং কিসলুকে আকুল আহবান জানিয়েছে তারাকাটাতে আসতে। পুরো ইউনিয়ন জ্বলছে, সে বলেছে, এখন জেগে ওঠার সময়। পাওয়ার পস্নান্ট সব শেষ করে দেবে, একে রুখতে হবে। কিন্তু কিসলুর ওই একই কথা, ‘আসছি।’ অথবা ‘এসে পড়লাম বলে’। হাওলাদার গ্রেফতার হওয়ার রাতে সে জানাল, তিনদিনের সেমিনারে ঢাকার পিজি হাসপাতালে তাকে যেতে হবে। এ এক বিরল সৌভাগ্য! সিভিল সার্জন স্যার যাচ্ছেন!

উত্তেজনায় তার গলা কাঁপল।

রাতটা খুব ফাঁকা মনে হলো রোজিনার।

সকাল দশটায় ঘরে বসেই বন্দুকের গুলির শব্দ শুনল রোজিনা। সারারাত প্রায় জেগেই ছিল সে। বাবা রাতে ফিরেননি, তাকে থানায় নেওয়া হয়েছে। জেগে-জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল। গুলির শব্দের আগেই অবশ্য ঘুম ভেঙেছে। করিমা বুয়া উত্তেজিত গলায় তাকে জাগিয়ে বলেছে, গ্রামের মানুষ কোম্পানির জায়গা ঘেরাও করতে গেছে। সে  শুনেছে এক ট্রাক পুলিশ এসেছে।

কাপড় বদলে রোজিনা ছুটল কোম্পানির দিকে।

মানুষ ছুটছে। সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে। মানুষ আতঙ্কিত, ক্রুদ্ধ। তীব্র হইচই। উন্মত্ত চিৎকার, ভয়ার্ত চিৎকার। পুলিশ পাহারাদারের গর্জন। গুলির শব্দ। কোনটা ফাঁকা, কোনটা ভরাট, জানার উপায় নেই।

অনেক লোক বলেছে রোজিনাকে, ওই দিকে যাবে না/ যাবেন না। খবরদার, ওরা শেষ করে দেবে।

রোজিনা থামল। না, ভয়ে নয়, মানুষের একটা ভয়ার্ত ক্রুদ্ধ দল একজন মানুষকে পাঁজাকোলা করে ছুটে আসছে পথ দখল করে। সেজন্য। সে পথ থেকে একটু নেমে জায়গা করে দিলো। একজনকে জিজ্ঞেস করল। কে মানুষটা?

আসিফভাই।

আসিফ!

কী হয়েছিল?

আমাদের সামনে ছিল, আমাদের হয়ে চিৎকার করছিল। গুলি বুকে লেগেছে।

লোকগুলোর সঙ্গে রোজিনাও ছুটল।

একটা বাড়ির টুঙ্গিঘরে ঢুকে পড়ল মানুষ। বাড়ির লোকজন ছুটে এলো। তারা প্রথমে ভয় পেয়েছিল, পরে রক্তাক্ত আসিফকে দেখে কর্তব্যবোধ জাগল তাদের। একটা খাট পাতা ছিল, তাতে শোয়ানো হলো আসিফকে।  বাড়ির লোকজন ছুটল পানি, গামছা এসবের ব্যবস্থা করতে।

আসিফের বুক ভেজা রক্তে। জামাটা কেন জানি ছেঁড়া, তাতে বুকের ক্ষতের উঁকিটা দেখা যায়। তার চোখ বোজা। বোঝাই যাচ্ছে, সময় শেষ হয়ে আসছে তার।

আসিফের বোজা চোখ দেখে কান্না পেল রোজিনার। সে বিছানার পাশে বসে তার কপালে হাত রাখল। আসিফ, আসেত্ম করে সে ডাকল।

দুবার ডাকার পর আসিফের চোখটা নড়ল। একটা ঝিলিমিলি দেখা গেল বোজা চোখে – সে-দুটো অল্প খুলল, যেন অনেক কষ্টে কেউ বাড়ির বাইরে ডাকতে আসা বসমেত্মর ভোরটাকে দেখার জন্য বন্ধ জানালা খুলছে।

রোজিনাকে দেখল সে দুই নরম চোখ। তাতে ওই দুই চোখের ঝিলিমিলিটা আরেকটু হয়তো বাড়ল। রোজিনার দিকে তাকিয়ে এবার শরীরের শেষ শক্তি বিন্দুগুলি এক আজলা পানির মতো তুলে সে বলল, আমাকে তোমার কথায় রাজি হতে বলেছিলে, রোজিনা, আমি তো রাজি।

আসিফের চোখ বন্ধ হওয়ার আগে তার একটা হাত তার হাতে নিয়ে একটুখানি চাপ দিলো রোজিনা। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা কিছু বলল, যা শুনে চোখে ঝিলিমিলি নিয়েই ঘুমাতে গেল আসিফ।

রোজিনা কী বলেছিল মানুষের শব্দে তা শোনা মুশকিল ছিল। কিন্তু আমাদের মনে হলো, রোজিনা বলছে, আমিও রাজি, আসিফ। বা এই রকম কিছু।

যাই হোক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত