বাসের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে আজিজুর রহমান একসময় বাসের কথা ভুলে গেল। অফিস ছুটির পর তার যথারীতি ক্লান্ত লাগছিল, প্রতিদিন যেমন ভাবে – অফিস থেকে বেরোবে আর বস বা এলাকার কোনো মাস্তান কষে একটা লাথি কষাবে পেছনে, সে বাড়ি পৌঁছে যাবে – এমনও ভেবেছিল একবার। তারপর, এটাও নিয়মমাফিক, সে হাঁটতে-হাঁটতে এসে দাঁড়িয়েছিল বাসস্টপেজে, লাইনে। লাইনটা বড়, গুঁতোগুঁতি ধাক্কাধাক্কি নেই, তবে ধুলো-ধুলো একটা ব্যাপার আছে, ঘামের গন্ধ আছে, আর সবার ওপর সবার বিরক্তি আছে। তা যা হলো, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে আজিজুর রহমান বাসের কথা ভুলে গেল। তার মনে হলো সে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। সাদা সবুজ আর লাল মেশানো ট্রেনের শরীর, ভেতরটা পরিপাটি সাজানো, আপনি দাঁড়াতে পারবেন, হাঁটতে পারবেন, বসতে পারবেন, শুতে পারবেন। আপনি মৃদু ঘণ্টা বাজালে খেদমতের জন্য লোক চলে আসবে। আপনার যা খেতে ইচ্ছা করবে, বলবেন, চলে আসবে। গতরাতে সে আর মাহফুজা এক টিভি চ্যানেলে রয়্যাল রাজস্থান রেইলওয়ের একটা অনুষ্ঠান দেখেছিল। তারপর, বাকি রাতের যতটা তারা জেগেছিল, আর আজ অফিসে কাজের ফাঁকে কিংবা কখনো কাজের ভেতরই, সেই ট্রেন ঢুকে পড়ছিল। এখন আবার। আজিজুর রহমান তাই পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে একবার লাইন থেকে সরে এসে আরেকবার দেখল – ট্রেন আসছে কি না। দেখা গেল না, তবে আজিজুর রহমানের মনে হলো চলে আসবে যে-কোনো সময়। পাশের রাস্তার একপাশে রেললাইন তৈরি হয়ে যাবে। ট্রেন এসে দাঁড়াবে, আজিজুর রহমান, যেন সে প্রতিদিনই এমন এক ট্রেনে বাড়ি ফিরছে, এভাবে উঠে পড়বে। চারপাশের কেউ-কেউ ওঠার চেষ্টা চালাতে পারে। খালি ট্রেন, ভাববে ট্রেন বুঝি তাদের সবার জন্য এসেছে, তা এরকম ভাবতে অসুবিধা নেই, দুবেলা কত কী ভাবছে মানুষ, শুধু তার ট্রেনে চড়তে না পারলেই হতো।… তার ট্রেন? একটু ভাবল আজিজুর রহমান – নাহ্ আর একার না, তার আর মাহফুজার। এমন হতে পারে ট্রেন এসে থামার পরপর সে উঠলে দেখা গেল মাহফুজা সেখানে আগে থেকেই বসে আছে, বলল – এই একটু
হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। তাই দেরি হলো একটু, রাগ করেছ? আজিজুর রহমান ঠিক করল মাহফুজা এমন প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেবে – না না, রাগ কিসের! তবে দুজনের জন্য দুটো ট্রেন হওয়া আরো ভালো। যে যার মতো ঘুরলাম, আবার একসঙ্গেও ঘুরলাম।
কাল রাতেও তারা দুটো ট্রেনের কথাই ভেবেছিল। অনুষ্ঠান দেখতে-দেখতে সে যখন বলল – ইশ, আমার যদি এরকম একটা ট্রেন থাকত – মাহফুজা তার দিকে কটমট করে তাকাল – সবসময় শুধু নিজেরটার কথা ভাবো কেন! তোমার একটা আমার একটা দুটোই থাকতে পারে।
হে-হে। সে বলল। আমার থাকা মানেই তোমার থাকা।
তাহলে আমারই একটা থাক। আমার থাকা মানেও তোমার থাকা।
আচ্ছা, দুজনের দুটো। কিনবই যখন…।
আজিজুর রহমান আবার লাইন থেকে বের হয়ে দেখতে গেল ট্রেন আসছে কি না। নাহ, ট্রেনের দেখা নেই। একটু বিরক্ত বোধ করল সে, লাইনে ফেরার সময় তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হলো পেছনের লোকটা – বারবার পা উঁচা কইরা, লাইন ছাইড়া কী দেখেন? আপনে দেখলেই বাস আগে চইলা আসব?
আজিজুর রহমান একবার ভাবল সে কিছু বলবে না, তবে সে চুপ করেও থাকতে পারল না। পেছনে ফিরল, বলল – দেখি ট্রেন আসে কি না।
ট্রেন!… গরমে বাঁচি না আর আপনে মজা মারেন!
আজিজুর রহমান বলল – মজা ভাবলে মজা, সত্য ভাবলে সত্য।
বাড়ি ফিরে আজিজুর রহমান দেখল মাহফুজা বাসায় নেই। এ-সময় মাহফুজার বাইরে যাওয়ার কথা নয়। গেলেও তাকে ফোনে জানিয়ে যেতে পারত। তাতে এক টাকাও খরচ না। তারা এত গরিব না ওই কটা পয়সা খরচ করতে পারবে না! পোশাক পালটে সে-ই ফোন করল মাহফুজাকে – কই তুমি? বাড়ি দেখি আন্ধার!
তুমি ফিরেছ?
বললাম না, বাড়ি আন্ধার।… কই? ট্রেন কিনতে গেছ?
ট্রেন! মাহফুজার গলায় প্রথমে বিস্ময়, পরে হাসি শোনা গেল – না, ট্রেন না, এসি।
অ। পয়সা নষ্ট, কথা তো ছিল পয়সা জমিয়ে প্রথমে ট্রেন কিনব।
ফিরছি। দাঁড়াও, কিংবা চা বানিয়ে খাও।
মাহফুজা ফিরলে বিস্তারিত জানা গেল। সে এসিই কিনতে গিয়েছিল। পাশের বাসার ভাবি তারান্নুমের সঙ্গে। মাহফুজা বলল – দুপুরে হঠাৎ তারান্নুম ভাবি এসে হাজির। তাঁর সঙ্গে যেতে হবে, এসি কিনবেন। ঘোরাঘুরির কোনো ব্যাপার নেই। নির্দিষ্ট দোকান, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড, নির্দিষ্ট, ওই যে… দেড় টন। রাস্তায় জ্যাম, ফিরতে-ফিরতে তাই দেরি হলো।
…আজিজ, খারাপ লাগছিল জানো…!
আজিজুর রহমান বলল – আমরা অনেক দিন হলো এসি কেনার কথা ভাবছি।
সেজন্যই।… লজ্জাও পেয়েছিলাম। তারান্নুম ভাবি হঠাৎ করে বললেন – এসি কি আর আমাদের মতো লোকজনকে মানায়! কিন্তু যে গরম পড়েছে! আপনারা কিনছেন না কেন ভাবি?
এটা হচ্ছে শয়তানি।
হ্যাঁ, শয়তানি। মহিলা খোঁচা মারতে ওস্তাদ। আমি বললাম – আর বলবেন না, ও তো রোজই বলছে, কিন্তু আমার না ঠান্ডা লেগে যায়।
আজিজুর রহমান হাসল।
হাসছ কেন!
এই যে বললে না। এসব লোকজন আজকাল টের পেয়ে যায়।
তা ঠিক। তারান্নুম ভাবিকে দেখলাম একটু মুচকি হাসলেন। তখন আবার লজ্জা পেলাম।
গরিবের এই একটাই সম্বল…।
দেখো, একদম গরিব আমরা না…।
আবার দু-চারটা শখ মেটানোর মতো ধনীও না। এই গতরাতেই বলছিলাম না, টিভিটা আরেকটু বড় হলে বেশ হতো।
তা বলেছি। পিকচার কোয়ালিটি কিন্তু ভালো, শুধু আরেকটু বড়…।
তারপর দেখো, গরমে হাঁসফাঁস করি, ওই যে… সঙ্গমের সময় ঘেমে একাকার, কিন্তু একটা এসি আমরা কিনতে পারি না…।
তারপর ট্রেন…।
একটাই সমাধান মাহফুজা। একটাই।
ধনী হতে হবে। প্রায় বলো তুমি।
হ্যাঁ, ধনী-ধনী। বিশাল বড়লোক। ইচ্ছা হবে, খাব। ইচ্ছা হবে, কিনে ফেলব। ইচ্ছা হবে – এই। ইচ্ছা হবে – ওই।
এরজন্য একটা ডাকাতদল দরকার, তুমি বলেছ।
হেসো না। ভুল কিছু বলেছি নাকি।
না। কিন্তু সদস্য আমরা মাত্র দুজন। চলবে?
প্রথমে আমরা সদস্য বাড়ানোর চেষ্টা করব। বিশ্বাস করো – পাওয়া যাবে। দেখিয়া-শুনিয়া, খেপিয়া গিয়াছি – ডাকাত হওয়ার ইচ্ছাটা এখন অনেকের। তবে বাঙালির বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। ভেতরে ইচ্ছা ষোলো আনা, কিন্তু এমন ভাব দেখাবে – ভাজা মাছ উলটে খাওয়া দূরের কথা, ভাজা মাছই দেখেনি জীবনে…।
তুমি কিন্তু বলেছিলে অবস্থা এখন অনেক বদলিয়েছে…।
তা বদলিয়েছে…। তোমারও কি তা মনে হয় না?
হয়। রাখঢাক এখন অনেক কম।
একটু ডেসপারেটও, তাই না। সুতরাং সদস্য পাওয়া যাবে।
দেখো একটু। পিস্নজ।
দেখব। দরকার হলে পিঠে কাগজ সেঁটিয়ে বের হবো – ডাকাতদলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলছে। উচ্চাশা যাদের আছে ও অনৈতিক হতে পারবেন, তারা যোগাযোগ করুন এই নাম্বারে…।
সাহস? সাহস লাগবে না?
নাহ। আজকাল সাহস লাগে না মাহফুজা। করে ফেললেই হলো। সবাই জেনে গেছে – করে ফেললেই হলো, তারপর কিছু হইচই ছাড়া কিছু হবে না। তবে লাইনটা ঠিক রাখা চাই।
বুঝলাম। তবে আমার কিন্তু তোমার দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা বেশি পছন্দ।
আজিজুর রহমান হাসতে আরম্ভ করল।
হাসছ কেন! আশ্চর্য, খামোখা হাসছ কেন তুমি!
কত কী ভাবি আমরা…।
আহা, হতে পারে না ওরকম!
যাও, এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা খেতে-খেতে ভাবি, হতে পারে কিনা।
এখনো চা খাওনি! তখন না বললাম বানিয়ে নিতে।
খেয়েছি। আরেক কাপ খাব। না হয় গল্প জমছে না। আমি বারান্দায় বসছি।
বসো। কিন্তু গল্প বলবে না, কখনো গল্প বলবে না। এসব গল্প না।… হয়।
বারান্দাটা ছোট। বেশ ছোট। কখনো-সখনো ঘসা খেতে হয়। আজিজুর রহমান একবার তার এক বন্ধুকে বারান্দার পরিসরের কথা জানাতে গিয়ে বলেছিল – বুঝেছ, এতই ছোট দুজন নারী-পুরুষ যদি কোনোমতে ওখানে শারীরিকভাবে নানা কসরতের পর মিলিতও হয়, এতই ছোট জায়গা, আটকে যাবে, আর বিযুক্ত হতে পারবে না।
বারান্দায় এসে আজিজুর রহমান আড়মোড়া ভাঙল, চেয়ারে বসতে-বসতে তার হঠাৎই মনে হলো নিচে রাস্তায় ট্রেনটা দাঁড়িয়ে
আছে। আজিজুর রহমান গ্রিল ধরে আরেকটু ঝুঁকে তাকানোর চেষ্টা করল। হ্যাঁ, ট্রেন, ওই ট্রেনই, অন্ধকারে তাকে আরো মায়াবী লাগছে। মাঝে-মাঝে যেন ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকাচ্ছে – আজিজুর রহমান আর মাহফুজা কি প্রস্ত্তত? আজিজুর রহমান সেদিকে তাকিয়ে থাকল। মাহফুজা চা নিয়ে ফিরলে সে বলল – ট্রেনটা ভোগাচ্ছে।
ট্রেন! কোন ট্রেন!
রয়্যাল রাজস্থান।
ওহ। আমিও ভুলতে পারছি না। তুমি ট্রান্স-সাইবেরিয়ান না কি এক রেলপথের কথা বলেছিলে না…।
হুমম।…, মাহফুজা, ওরকম আরো আছে। কত কী যে আছে, তা-ই আমরা জানি না।
জানার জন্য গুপ্তধন পাওয়াটা জরুরি, আজিজ।
আজিজুর রহমান সামান্য হাসল – আজকালকার দিনে কেউ আর গুপ্তধন পায় না, মাহফুজা।
বললে! মোহাম্মদ আলী ভাই গুপ্তধন পাননি।
মোহাম্মদ আলী তাদের পরিচিত। বছর দুয়েক আগে পরিচয়টা এখনকার তুলনায় বেশি গাঢ় ছিল। এখন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাদের তরফ থেকে একটা সমীহ তৈরি হয়েছে। মোহম্মদ আলী, মাহফুজাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়, ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট, গোছানো সংসার। তারা বেড়াতে গেলে দেশ, উন্নয়ন, মানুষের জাগরণ এসব বিষয়ে কথা হতো। আজিজুর রহমান ও মাহফুজার মনে হতো, এই লোকটা সত্যিই দেশ ও মানুষের ভালো চান। তো, এই মোহাম্মদ আলী কী করে এক সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। বছরখানেক সম্ভবত চেয়ারম্যান ছিলেন। মেয়াদ শেষ হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলেন তবে বেশিদিন থাকলেনও না। চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। ব্যবসা শুরু করলেন, ঠিক তাও না, কারণ সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, কিন্তু তার টাকার গরম টের পাওয়া গেল। বেশ গরম, তার আঁচ ততদিনে বেশ অনেকটা দূরে সরে যাওয়া, আজিজুর রহমান ও মাহফুজাও টের পেল।
ব্যাপারটা কী বলো তো? মাহফুজা জানতে চাইল আজিজুর রহমানের কাছে।
ডাকাতি করেছে?
ধ্যাত।
ধ্যাত কেন?
কই, এতদিনেও একটা অভিযোগ দেখলাম না কোথাও।
তাহলে গুপ্তধন পেয়েছেন।
গুপ্তধন!
হ্যাঁ। ভল্টের ভেতর আরেকটা ভল্ট ছিল। সেই ভল্টে ছিল গুপ্তধন। এতদিন কেউ বুঝতে পারেনি। মোহাম্মদ আলী ভাই সেটা প্রথম বুঝতে পারেন। ভেতরের ভল্টে তিনি খুঁজে পান হীরে-জহরত, মণি-মুক্তা।
মাহফুজা মাথা ঝাঁকাল – ঠিক। গুপ্তধনই পেয়েছেন।… গাজীপুরে বিশাল এক বাগানবাড়ি তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন, শুনেছ।
গুপ্তধন পেলে কত কী করা যায় মাহফুজা, তার কটাই-বা আমরা জানি!
আমরা একটা ভুল করেছি।
হয়তো একটা না, অনেক।
না, আমি অনেক কিছুর কথা বলছি না। একটার কথা বলছি। আমাদের হায়দার আলী ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে সরে আসা উচিত হয়নি।
আজিজুর রহমান আবার হাসল – তুমি কী ভাব, আমরা চাইলেই তিনি আমাদের কাছে রাখতেন?
মাহফুজা মৃদু গলায় – তবু, চেষ্টা করে দেখা যেত – বলতে-বলতে চুপ করে গেল।
আজিজুর রহমান শব্দ করে আড়মোড়া ভাঙল – চা-টা ভালো বানিয়েছিলে।
তাহলে গুপ্তধনের কথা একটু বলো।
ওই কথাই বহাল – গুপ্তধন এখন আর কেউ পায় না।
মোহাম্মদ আলী ভাই যে পেলেন!
উনি মোহাম্মদ আলীবাবা… আরে! আজিজুর রহমানকে বিস্মিত ও আনন্দিত দেখাল। দেখেছ, আমি ওনার একটি নাম দিয়ে দিলাম। আলীভাই কেন বলি ওনাকে, আলীবাবাভাই বলব এখন থেকে।
একদম ঠিক নাম হয়েছে। আলীবাবাভাই, দারুণ!… কিন্তু আজিজ, আমরা পাব না?
নাহ।
কেন?
কারণ আমরা না ডাকাত, না গুপ্তধন-সন্ধানী।
তাহলে আমরা কী?
চোর। মানে খুব বেশি হলে আমরা চোর হতে পারি।
চোর?
চোর। ছোটখাটো।
কথা না বলে তারা বেশ অনেকটা সময় বারান্দায় বসে থাকল।
কোনো-কোনোদিন অফিসে এত বেশি কাজ থাকে, মাথা তোলার উপায় থাকে না। আজিজুর রহমানের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সে বেশিক্ষণ মাথা নিচু করে থাকতে পারে না। তার ঘাড় টনটন করতে আরম্ভ করে, তার বমি-বমি লাগে। বমি-বমি অবশ্য তার সকাল থেকেই লাগছে, ফাইলে মাথা নিচু করার আগেই। সকালে মাহফুজা যখন রান্নাঘরে, দেশের বাড়ি থেকে একটা ফোন এসেছিল তার কাছে। ছোট ভাইয়ের ফোন, বক্তব্য প্রায় বরাবরের মতো – মা একটা ভালো হুইল চেয়ারের আবদার করেছে।
সে তখনই বলল – কেন, ঘরে বসে দুনিয়া দেখা হচ্ছে না?
সেইটা তুমি মারে জিগাও। আমারে জিগাও ক্যান!
তো তুই একটা কিনে দে না।
তুমি আমার অবস্থা জানো না?
তুই আমার অবস্থা জানিস না?
শুনো, মা কইছে এইটা বড় ছেলের কাছে তার শেষ আবদার।… রাখলাম, পয়সা উঠতেছে।
ছোট ভাই লাইন কেটে দিলে প্রথম যে প্রশ্নটা তার মাথায় এলো সেটা এরকম – আচ্ছা, মায়ের বয়স কত হলো?… কম তো না। দুনিয়া দেখার সাধ তাহলে ফুরায় না ক্যান! এই প্রশ্ন কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেলে সে প্রথমে কিছু স্বসিত্ম, তারপর কিছু অস্বসিত্ম, তারপর স্বসিত্ম-অস্বসিত্মর মিশ্রণ পেল, তারপর কিছু অপরাধবোধে ভুগতে আরম্ভ করল।
আজিজুর রহমান – সে বলল – তোমার এইভাবে ভাবা উচিত হয়নি। সে তোমার মা। সে তোমার জন্মদাত্রী। সে তোমাকে বহু কষ্ট সহ্য করে বড় করেছে। তুমি যে আজ এইখানে আছ, তার পেছনে তোমার মায়ের ভূমিকা কম নয়। এই কথাগুলো সে বলল বটে, তবে বলতে-বলতেই টের পেল, ঠিক জুতসই হচ্ছে না। একটা অপরাধবোধ থেকে যাচ্ছে, রাগটা থাকছে তার বেশি – হ, হুইল চেয়ার! নিজেরটাই কিনতে পারি না!… নিজেরটার কথা বলছি মানে, এখন না লাগলেও লাগবে তো। তখন কিনতে পারব?
মাহফুজাকে এ-বিষয়ে কিছু বলবে না ঠিক করেছিল আজিজুর রহমান। কিন্তু মাহফুজাকে কিছু না বলে সে থাকতেও পারে না।
মাহফুজা বলল – কী করবে! অফিস থেকে বেরিয়ে দাম দেখো।
দাম দেখলে চলবে! ব্যাপারটা কেনার।
আমি দাম দেখতে বলেছি মানে কিনতেই বলেছি।
টাকা? তুমি দেবে?
আমার থাকলে আমি দিতাম, তুমি জানো।… ওই যে, কিছু আছে না হাতে…।
ওটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন কেনার টাকা জমাচ্ছি আমরা।
আশ্চর্য, তাই বলে তোমার মায়ের একটা ইচ্ছা তুমি পূরণ করবে না! ওভেন আমরা পরে কিনব। ওনার বয়স হয়েছে…।
তাই বলে ভেবো না সহজে মরবে। আমাকে আরো অনেক জ্বালাবে।
ছিঃ, এভাবে বলে না। উনি মারা গেলে তুমি খুশি হও?
এই প্রশ্নের উত্তর আজিজুর রহমানের জানা নেই। মাহফুজা উত্তর পাওয়ার জন্য কথাটা বলেওনি। কিন্তু কথাটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে আজিজুর রহমানের ভেতরে থেকে গেল। সে কি তার মা মারা গেলে খুশি হয়? হ্যাঁ, খুশি হয় সে, নাকি বেশি বা কিছু দুঃখ পায়? প্রশ্নটা অমীমাংসিত হয়ে ঝুলে থাকল ও আজিজুর রহমান এক সময় টের পেল এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজের ভেতর তৈরি করতে পারছে না বলেই তার বমি পাচ্ছে। কাজের চাপ প্রচুর, মাথা তোলা উচিত হবে না, সামনে ইনক্রিমেন্টের একটা মুলো আছে, সবাই পাবে না। কেউ-কেউ পাবে, এখন দক্ষতা ও আনুগত্য দেখানোর সময়, আজিজুর রহমান তবু মাথা তুলল। বড় করে শ্বাস নিল, পাশের টেবিলের মোস্তাকিম তাকালে সে বলল – বমি পাইতেছে রে।
পাইতেই পারে। গরম পড়ছে। যা কইরা আয়।
টেবিলে-টেবিলে করব।
টেবিলের ওপরই করবি?
টেবিলের ওপরই করা – এটা মোস্তাকিমের পুরনো কথা। তাদের চারজন নারী সহকর্মী আছে। তাদের একজনের প্রতি মোস্তাকিমের আসক্তি। তার বহুদিনের ইচ্ছা, অফিস ছুটির পর সবকিছু ম্যানেজ করে সে মেয়েটির সঙ্গে টেবিলের ওপর মিলিত হবে। মিলনটি কেমন হবে – তার বিশদ বর্ণনাও সে মাঝে-মাঝে দেয়।
আজিজুর রহমান বলল – তোর মতন না। আমি টেবিলে-টেবিলে বমি করব।
আমিও তো বমিই করতে চাই, অন্যভাবে।
আমি সত্যই বমি করব। আজিজুর রহমান বমি করার ভঙ্গিতে মোস্তাকিমের টেবিলের দিকে এগোল।
তুই মর হারামজাদা।
এইখানে সবার টেবিলে করা শেষ হলে এমডির টেবিলে যাব।
যা, তোর পায়ে ধরি, পিস্নজ যা।
আজিজুর রহমান সত্যিই এরকম ভেবেছে। সবার টেবিলে কাজটি সারার পর সে এমডির রুমে যাবে – স্যার।
আপনি?
আমি স্যার আজিজুর রহমান, এই অফিসে চাকরি করি।
সে আমি জানি। কী দরকার?
বমি করব স্যার।
বমি করবেন মানে। বমি করবেন তো এখানে কেন!
আপনার টেবিলে বমি করব…। আজিজুর রহমান দুপা এগোবে।
এমডি দাঁড়িয়ে যাবে – আপনি দেখি… আরে, এ কী…!
বমি, স্যার।
আজিজুর রহমান মোস্তাকিমের দিকে ফিরল – হুইল চেয়ারের দাম জানস?
কী দরকার? হুইল চেয়ারে বইসা বমি করবি?
মারে একটা কিইন্যা দিতে হইব…। অবশ্য আরেকটাও দরকার। দুইটা। একজোড়া।
আরেকটা কার শাশুড়ির?
না, সংসারের।
কী!
সংসারের।
মোস্তাকিম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আজিজুর রহমানের দিকে। চেয়ার ছেড়ে উঠল সে, কোনোদিকে না তাকিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সিগারেটের একটা প্যাকেট আজিজুর রহমানের দিকে বাড়িয়ে দিতে-দিতে বলল – এক প্যাকেটই কিনমু ভাবছিলাম। পয়সা শর্ট। ১০টা দিতেছি। যে একখান কথা বলছস, লোম খাড়ায়া গেছে। সংসারের জন্য হুইল চেয়ার। আরেববাস! কখনো এইভাবে ভাবি নাই।
ভাইবা বলি নাই। বাইর হইয়া গেছে।
বাইর হইয়া গেছে মানে ভেতরে ছিল?
আজিজুর রহমান মাথা ঝাঁকাল – ছিল নিশ্চয়।
লাঞ্চের পর আজিজুর রহমান ও মোস্তাকিম অফিসের বাইরে এসে সিগারেট ধরাল।
মনটা খচখচ করতেছে। মোস্তাকিম বলল।
আজিজুর রহমান ধোঁয়া ছেড়ে মোস্তাকিমের দিকে তাকাল। কিছু বলল না।
তোর জন্য এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে চাইছিলাম…।
সিগারেট আমি কম খাই, তুই জানস।
তোর সিগারেট কমবেশি খাওনের ইয়া করি। এইটা ব্যাপার না। কিনতে চাইছিলাম এক প্যাকেট, পারি নাই – ব্যাপার হইল এইটা।
মাসের শেষ…।
এক প্যাকেটের দাম কত যে মাসের শেষে পারুম না।
বাদ দে। কত কি পারতেছি না।
বাদ দিমু?
না, থাক। আজিজুর রহমান বলল। বলুক। বাদ দিলেই তো বিদায় হইতেছে না।
আসলে আর পারতেছি না। সব সময় মনে হয় হাঁপাইতেছি।
অবস্থা যে বদলাইব, দেখ, তারও কোনো সম্ভাবনা নাই। একটা ইনক্রিমেন্ট বাড়তে পারে, বেতন কত বাড়ব তাতে?
সেইটা তোর আমার মাথাব্যথা। এমডির না।
এমডি একা পারে না, বোর্ড আছে।
কিন্তু সে একটু জোর গলায় কথা তো কইতে পারে।
সেইটা সে কইতে পারে।
কইব না। ব্যাডায় ফকিন্নির পুত। এমডির বাপে ছিল দরজি, এইটা জানস?
নাহ। শুনি নাই। তোরে কে কইছে?
কইছে। এই রকম কত আছে। ছিল ফকিন্নির পুত, এহন টাকা রাখনের জায়গা পায় না।
এভাবে কথা এগোলে একসময় মোহাম্মদ আলীর কথা উঠে এলো। মোস্তাকিম বলল – তোর উচিত ছিল ঘেসটাইয়া পইড়া থাকা।
লাভ হইত না। ব্যাংক যখন ছিল, একবার কনজুমার লোনের জন্য গেছিলাম। হাসতে-হাসতে বলল, চেয়ারম্যানের আসলে নাকি কোনো ক্ষমতাই নাই। আমি একটু গাঁইগুঁই করলে বলল – আজিজুর, তোমার স্যালারি তো অ্যালাউ করতেছে না। তুমি দুইটার বদলে একটা জিনিস নাও।… ওই ব্যাটার লগে তো ঘেসটাইয়া লাভ হইত না।
এইটাও ঠিক।
অথচ দেখ, নিজের অবস্থা কেমনে বদলায়া ফেলল। গাজীপুরে বিশাল বাগানবাড়ি তুলতেছে। মাঝে-মাঝে দলেবলে গিয়া ফুর্তি করব।
করব। ডাকাতির টাকা।
হ, ডাকাতির টাকা।… আমি তো মাঝে-মাঝে ভাবি একটা ডাকাতদল থাকা উচিত।
ডাকাতি কইরা বেড়াইতি?
বেড়াইতাম।… তুই চিন্তা কর মোস্তাকিম, সারাজীবন এইভাবে পার করবি?
মোস্তাকিম বলল – একটা ডাকাত দল থাকা উচিত।
মোস্তাকিমকে আজিজুর রহমান গুপ্তধনের কথা বলল না। জানে সে, মোস্তাকিমের যে স্বভাব, এই নিয়ে বহুদিন তাকে খেপাবে – কিরে, পাইলি?… মন দিয়া বোধ হয় খোঁজস নাই।… এক কাজ কর, বাইর হইয়া পড়। চাকরিও করবি আবার গুপ্তধনও খুঁজবি, এইটা হয় না। সুতরাং মোস্তাকিমকে সে বলেনি, মাহফুজাকেও সে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চায় না। বরং সেদিন সে বলেছে – আজকাল গুপ্তধন আর পাওয়া যায় না। সে জানে, মাহফুজা মজাই করে, গুপ্তধন পাওয়া যায়, কিংবা তারা পেয়ে যাবে কোনোদিন – এমন নিশ্চয় সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই মজা থেকে ব্যাপারটা একটু-একটু করে চেপে বসলে কী হতে পারে, তার ধারণা আছে। এই ধারণা সে নিজের কাছ থেকে পেয়েছে। সে মোস্তাকিমকে বলেনি, সে মাহফুজার সঙ্গে মাঝে-মাঝে ইয়ার্কির ছলে বলে, কিন্তু সে বোঝে – এই ব্যাপারটা তার ভেতর আছে। গুপ্তধন পাওয়ার ইচ্ছা। তার প্রায়ই মনে হয়, হঠাৎ সে কোনোদিন গুপ্তধন পেয়ে যাবে। হ্যাঁ পেয়ে যাবে, হঠাৎ। কীভাবে পাবে, তা সে নির্দিষ্ট করে জানে না, তবে পাবে। তারপর তাদের এই অবস্থা আর থাকবে না।
দুই
আজিজুর রহমান বলল – আমি যাব না। কেন যাব, বলো?
মাহফুজা মাথা নাড়ল – না, আমি যাব। কেন যাব না, বলো?
তুমি কেন যাবে, আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।
আমিও বুঝতে পারছি না। তুমি কেন যাবে না!
এটাকে তুমি দাওয়াত বলবে! আমার কাছে এটাকে অপমান মনে হচ্ছে।
আর, আমার কাছে মনে হচ্ছে সুযোগ।… না, কথা বোলো না। আজিজ, আমি তোমার কথা শুনি না বা তর্ক করি – এমন খুব কমই ঘটে।
আর, আমি শুনি না?
না, আমি সে কথাও বলছি না। তুমি শোনো। শুধু এবার শুনতে চাচ্ছ না। আমি জানি তোমার কথার পেছনে যুক্তি থাকবে। সেই যুক্তির সঙ্গে আমি হয়তো পারব না। তবু আমি যেতে চাচ্ছি। চাচ্ছি, তুমিও যাবে।
আমি না গেলে তুমি একা যাবে?
তা যাব না। কিন্তু তুমি যাবে, এটা আমার অনুরোধ।
এটা, মোস্তাকিম যেদিন সিগারেট দিয়েছিল আজিজুর রহমানকে, তার মাসদেড়েক পরের কথা। এর মধ্যে আজিজুর রহমানের মা মারা গেছেন। খুব হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। ছোটভাই জানিয়েছিল তাকে, সে যখন মাহফুজাকে নিয়ে গিয়েছিল মৃত মাকে শেষবারের মতো দেখতে – সব ঠিকই ছিল, বুঝছ? তারে তো চিনতা তুমি, শুধু হাঁটতে পারত না। আর সব ঠিক। তা, মা-ও আমাকে জিগাইল – আজিজুর কী বলছে? হুইল চেয়ার কিন্না দিব? আমি কইলাম – দিব তো বলছে। মা-ও কইল – যাউক, চিন্তা গেল। পরদিন সকালবেলা দেখি মা-ও নেই।
এই কথা শুনে আজিজুর রহমান হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল। এর আগে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে থম্ মেরে গিয়েছিল, কাঁদেনি, পরেও কাঁদেনি, শুধু মৃতদেহ কবরে নামানোর পর একটু চোখ মুছেছিল।
রাতে, মাকে হুইল চেয়ার কিনে দেওয়া হয়নি, এই নিয়ে খুব মনমরা ছিল আজিজুর রহমান, মাহফুজাকে সে বলেছিল – দেখো, তুমি তো জানো, হুইল চেয়ার কিনে দেওয়ার ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে ছিল।
মাহফুজা বলেছিল – শোনো আজিজ, এইটা শুধু আমি জানি না, মা-ও জানে।
কী বলো! মায়ের কী জানার কথা। সে কীভাবে জানবে!
তুমি জানবে, অথচ মা জানবে না – এইটাও কি হয়!
শুনে আজিজুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
এছাড়া, তুমি যে কিনে দিচ্ছ, এইটা তিনি শুনেও গেছেন।
কিনে তো আমি দিতামই, তুমি জানো।
জানি আজিজ, জানব না কেন!
সময়মতো কিনে দিলে হুইল চেয়ারে দুইটা দিন ঘুরতে পারতেন।
তিনি জেনে গেছেন।
শুধু একসঙ্গে এতগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে, বাধো-বাধো ঠেকছিল, তাই কেনা হয় নাই। তুমি জানো।
আমি সব জানি। জানি বলেই তোমাকে এসব কথা আর বলতে হবে না।
না, বলব না। একটা হুইল চেয়ার, মায়ের একটা শখ, কিনে দিতে পারি নাই, এই কথা বারবার বলার কী আছে!
আজকের সামান্য কথাকাটাকাটির মধ্যে, প্রায় মাসদেড়েক পর সেই হুইল চেয়ারের প্রসঙ্গ উঠে এলো। ওঠাল মাহফুজা, সে বলল – তুমি জানো না মোহাম্মদ আলীভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে আমাদের ভালো হতো কি না।
মোহাম্মদ আলী তার বাগানবাড়ির উদ্বোধন উপলক্ষে আজিজুর রহমান ও মাহফুজা দম্পতিকে দাওয়াত দিয়েছে। ফোনটা করেছে সে মাহফুজাকে – অনেকেই আসবে। তোমরা হচ্ছো আমাদের নিজের লোক। তোমরা কিন্তু অবশ্যই আসবে।
প্রথমে কিছু দ্বিধা ছিল মাহফুজার। কিন্তু মোহাম্মদ আলী যখন বেশ অনেকটা সময় ধরে কথা বলল, তারা যোগাযোগ রাখে না – এই অভিযোগও তুলল কিছুটা, মাহফুজার মনে হলো কিছুটা অভিমানই যেন মোহাম্মদ আলীর গলায়, তখন, কথা এগোলে মোহাম্মদ আলী যখন বাগানবাড়ির কিছুটা বর্ণনা দিয়ে ফেলল ও বলল – আসার ঝক্কি তাদের পোহাতে হবে না। সে গাড়ি পাঠাবে, সেই গাড়ি তাদের তুলে নেবে ও রাত যতই হোক, অবশ্যই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে, মাহফুজার মনে হলো তাদের যাওয়া উচিত।
আজিজুর রহমান যেতে রাজি হয়, সে বলল – আমি জানি, সম্পর্ক কিছুই ভালো হতো না। মোহাম্মদ আলীভাইয়ের হচ্ছে আলগা ভাব।
ফোনে মোটেও সেরকম মনে হলো না।
আমার জানা হয়ে গেছে। সামান্য একটা কনজুমার লোন দেয়নি।
দিতে তো চেয়েছিল। নাওনি তুমি।
কেন নেব। চেয়েছি দুটো জিনিসের জন্য, বলে – একটাই নাও।
একটাই নিতে।
আচ্ছা মাহফুজা, হঠাৎ তুমি আলীবাবার জন্য এত দরদ দেখাতে আরম্ভ করলে কেন!
কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, বড়লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দরকার।
সম্পর্ক রাখবে? পাত্তাই দেবে না।
আমরা পাত্তা পাওয়ার চেষ্টাই করিনি। ভাব আমরাও কম নিইনি।
আমরা আবার কিসের ভাব নিই!
নিই। যার আছে তার সামনে একটু কাঁচুমাচু হয়ে থাকলে কিছু এসে-যায় না।
ডেকেছে তো শান-শওকত দেখাবে বলে।
দেখব। অসুবিধা কী। দেখব আর তার প্রশংসা করব।
তাতে অবস্থা বদলাবে?
বদলাতেও পারে। দেখি না একবার চেষ্টা করে। আমরা কখনো সেভাবে তার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি বলো?… আমাদের
অবস্থা কি বদলানো দরকার না?
সেটা আমি অস্বীকার করছি না।
সারাজীবন নিশ্চয় আমরা এভাবে কাটাতে চাই না?
আহা, আমি বলেছি এভাবে কাটাতে চাই!
একটা কথা বলি, কিছু মনে করো না। আমাদের অবস্থা যদি বেশি না, আরেকটু ভালোও হতো, মাকে আমরা সময়মতো একটা হুইল চেয়ার কিনে দিতে পারতাম।
আজিজুর রহমান চুপ করে গেল।
তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে স্যরি।
না, দাওনি। ঠিক কথাই বলেছ।
যাবে?
যাব।… তুমি যে-কারণে যাচ্ছ সে-কারণে যাব না।
তাহলে। গুপ্তধন বলো আর লুটকরা ধন বলো, সেই ধনে তিনি কী বানিয়েছেন, দেখতে যাব।
মাহফুজা হেসে ফেলল – বেশ, তাই সই।
হাসল আজিজুর রহমানও – বলা যায় না, গুপ্তধনের বাকি অংশ তিনি হয়তো ওই বাগানবাড়ির কোনো চোরা কুঠুরিতেই লুকিয়ে রেখেছেন। সেটা খুঁজতেও যাব।
তিন
মোহাম্মদ আলীর বাগানবাড়ি বড় ও জমকালো। কথামতো গাড়ি গেছে তাদের বাসায়, তারা রওনা দিয়ে পৌঁছেছে দুপুর ১২টার দিকে। মোহাম্মদ আলী তাদের দেখে উচ্ছ্বসিত – থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ ফর কামিং। খুব খুশি হয়েছি তোমরা আসায়। আজিজ, বলো তুমি কেমন আছ?
আজিজুর রহমান ও মাহফুজা আশা করেছিল তারা পৌঁছে বেশ অনেক লোকজনের দেখা পাবে। কিন্তু খুব একটা লোক নেই। যারা আছে, কয়েকজন বাদে, সবাই এখানকার ফুটফরমাশ খাটার লোক।
মাহফুজা জিজ্ঞেস করল – লোকজন যে দেখছি না, আলীভাই!
দেখবে-দেখবে। মোহাম্মদ আলী যেন আশ্বস্ত করতে চাইল। অনেকে আসবে। কিন্তু তারা আসবে বিকালের পর। মূল অনুষ্ঠান তখনই।
ও মা, তাহলে আমরা এত সকাল-সকাল কেন!
যারা আমার নিজের লোক, আরো কজন আসবে, তাদের আমি আগেই আসতে বলেছি। তারা ঘুরবে-ফিরবে।… অনেক পরিশ্রম করে বানিয়েছি, নিশ্চয়ই তোমাদের ভালো লাগবে।… আর আমি থাকি বা না থাকি, তোমরা কিন্তু নিজেরাই এসে এখানে থেকে যেতে পারবে। মূল বিল্ডিংটায় রুম অনেক, তাছাড়া কটেজও আছে, তোমাদের যেখানে ইচ্ছা থাকবে।… আজিজ মুখ গম্ভীর কেন তোমার?
আমার! আজিজুর রহমান হাসার চেষ্টা করল। কী যে বলেন না! আমার এতই ভালো লাগছে যে কী বলব!
সত্যি! মোহাম্মদ আলীকে খুশি দেখাল।
জ্বি সত্যি। একদম মুগ্ধ হয়ে গেছি।… তা, কী পরিমাণ গুপ্তধন পেয়েছিলেন, আলীবাবাভাই?
এই শেষ কথাটা মোহাম্মদ আলী শুনতে পেল না। কারণ সে তখন কিছুটা এগিয়ে, আজিজুর রহমান বলেছেও গলা নামিয়ে। মাহফুজা অবশ্য ভয়ে ও বিস্ময়ে তাকাল, মোহাম্মদ আলীও ফিরল – কিছু বললে?
এতই ভালো লাগছে যে থেকেই যেতে ইচ্ছা করছে এখানে।
মোহাম্মদ আলী হাসল – থেকে যাবে থেকে যাবে।… বাগানবাড়িটা কেন বানিয়েছি, জানো? বানিয়েছি মানসিক বিশ্রামের জন্য। দরকার আছে না, বলো? শহরে থাকতে-থাকতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই, এখানে এসে সতেজ হয়ে ফিরে যাব।
মোহাম্মদ আলী তার কথা বেশিক্ষণ চালাতে পারল না। তার জরুরি ফোন এলো। সে বলল – তোমরা নিজেরাই ঘুরে-ঘুরে দেখ। আগে বাইরেটা দেখো। হাঁটতে পার, বসতে পার, ঘাসের ওপর শুয়েও থাকতে পার।… গরম আছে, আজিজ, একটা ঠান্ডা বিয়ার নেবে নাকি?
মোহাম্মদ আলী চলে গেলে মাহফুজা ফিরল আজিজুর রহমানের দিকে – তোমার কি মাথা খারাপ? তখন কী বললে তুমি ওটা!
যেন না শোনে, সেভাবে বুঝেশুনেই বলেছি।
পিস্নজ, আজিজ…।
আর একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করব – ওই যে, গুপ্তধন, নাকি লুটকরা ধন কি এখানেই লুকিয়ে রেখেছে।
আমার ধারণা খরচ করে ফেলেছে?
না। আলীবাবা বুদ্ধিমান মানুষ। সে হাত খালি করে ফেলবে না। দেখছ না, চেহারা কেমন চকচক করছে। মানে, হাতে এখনো অনেক আছে।
কিন্তু তুমি খেপিও না আলীভাইকে।
খেপাব না।… চলো, আমরা বরং গুপ্তধন খুঁজি।
আজিজুর রহমান ও মাহফুজা মৃদু পায়ে সামনে এগোল। হাঁটতে-হাঁটতে তারা বেশ অনেকটা সময় পার করে দিলো। চারপাশ তাদের মোহিত করল, ক্ষিপ্তও। শেষে মাহফুজা বলল – চলো, খুব গরম, টায়ার্ড হয়ে গেছি। এবার মূল বাড়িতে যাই।
মোহাম্মদ আলীকে পাওয়া গেল বাইরের ঘরেই। বিশাল একটা ঘর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন করে বসার ব্যবস্থা। মোহাম্মদ আলী এক কোণে, ফোনে কথা বলছিলেন, কথা শেষ করে তাদের দিকে ফিরে হাত তুললেন – গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে একটু মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম। এরা সব বিগ শট, খুব ব্যস্ত থাকেন।… তা তোমরা কেমন দেখলে?
অপূর্ব! আজিজুর রহমান বলল! কী অসাধারণ রুচি আপনার আলীভাই।
মোহাম্মদ আলী হাসল – বসো, একটু বিশ্রাম নাও। তারপর এ-বাড়িটা দেখবে।
বেয়ারা এসে পানীয় দিয়ে গেল। মোহাম্মদ আলী আজিজুর ও মাহফুজাকে পানীয় নেওয়ার ইঙ্গিত করে বলল – এখানে এলে আমার মনটা জুড়িয়ে যায়। দেখ শীতকালে আরো অনেক ভালো লাগবে। তখন ফ্যামিলি পিকনিকের জন্য দারুণ। বাচ্চারা ইচ্ছামতো দৌড়াদৌড়ি করবে, আমার তো আর সে-বয়স নেই, হা-হা-হা, কিন্তু আজিজ… মাহফুজা, তোমরা বাচ্চা নিচ্ছ না কেন এখনো!
এটা আজিজুর রহমান ও মাহফুজার জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। তারা এ-বিষয়ে কখনো কারো সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না। নিজেদের মধ্যেও না। ফলে মোহাম্মদ আলীর কথায় তাদের দুজনেরই চোখেমুখে একটা ছাপ পড়ল। মোহাম্মদ আলীও সেটা খেয়াল করল – স্যরি, আমি হয়তো অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলে ফেললাম।
না, প্রাসঙ্গিক। আজিজুর রহমান বলল। আপনার ভার্সিটির কোয়ার্টারেও একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, উত্তর দিয়েছিলাম।… হচ্ছে না। তখন ট্রিটমেন্টে ছিলাম।
ওহো, একদম ভুলে গেছি। তা, এখন?
এখনো ট্রিটমেন্টে আছি। তবে ডাক্তার শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থার কথা বলেছে, সেটা খুবই ব্যয়বহুল। আমাদের পক্ষে সেই খরচ মেটানো সম্ভব না।
কেমন খরচ, বলো তো?
আজিজুর রহমান বলল।
মোহাম্মদ আলী সামান্য মাথা ঝাঁকাল – হুমম…আজিজ, তোমার চাকরির কী অবস্থা? ওখানেই আছ?
মাহফুজা তড়িঘড়ি করে বলল – আলীভাই, আমরা দুজনই ভাবছিলাম একটা ব্যবসা-ট্যাবসা শুরু করার কথা।
ব্যবসা? আজিজ কি পারবে! পারলে অবশ্য খুবই ভালো।
পারবে। পারবে না কেন! তাছাড়া বুদ্ধি দেওয়ার জন্য আপনি আছেন…।
মোহাম্মদ আলী সামান্য হাসল – এ-বাড়িটা তোমরা দেখোনি। ঘুরে দেখো। তারপর তোমাদের মুখ থেকে শুনব, কেমন লাগল।
আজিজুর রহমান ও মাহফুজা বসে থাকল।
কই যাও। পরে লোকজন সবাই এসে গেলে সেভাবে আর সুযোগ পাবে না।
জি-জি, নিশ্চয়। মাহফুজা বলল। আজিজ আসো।
মাহফুজা উঠলে আজিজও উঠল। কিছুটা এগোল তারা, আজিজ চাপাগলায় বলল – একে তোমার মানুষ মনে হচ্ছে?
এসে যখন পড়েছি, ভুল ধরো আমারই। মাহফুজা বলল। আমি শেষ দেখতে চাই।
কিছুই পাবে না তুমি এখানে। আমাদের সব কথা কীভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে দেখেছ?
দেখেছি।…আমাদের বেবি হচ্ছে না, খুব খরচের চিকিৎসা… এ প্রসঙ্গও কীভাবে পাশ কাটাল।
খুব খরচের, আমাদের জন্য। তার জন্য ওটা কোনো খরচ না সেও জানে।
আজিজ। মাহফুজা আজিজুর রহমানের হাত ধরল। আমি তবু দেখতে চাই।
আমার রাগ হচ্ছে। দেখব কী, আমার সবকিছু ভাঙতে ইচ্ছা করছে।
মাহফুজা হেসে ফেলল।
হাসছ!
ধরো এমন হলো, হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ভেঙে ফেললে তুমি, আর, দেয়ালের ভেতর থেকে গুপ্তধন বের হলো।
গুপ্তধন আমাদের জন্য না।
লুট করা ধন আমাদের জন্য না। কিন্তু গুপ্তধন আমাদের হতেই পারে। ভাবো না তুমি। আমি ভাবছি।
কী?
গুপ্তধনের বাকি অংশ কোথায় লুকিয়ে রেখেছে আলীভাই।
ওই ব্যাটা যে পাশ কাটিয়ে গেল, তুমি সেটা থেকে আমার মন সরাতে চাইছ, না?
আহা, ভাবো না তুমি, মজা পাবে।
শালা, অমানুষ একটা। আজিজুর রহমান বলল। বলল, তবে একটু পর দেখা গেল মাহফুজার পাশাপাশি সে-ও উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক দেখছে কত টাকা খরচ করেছে, বলতে পারবে?
আমার আন্দাজের বাইরে। তোমার?
আমারও। …গুপ্তধনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছ?
কী?
বাকি অংশ কোথায় রাখতে পারে লুকিয়ে?
সেটাই আজ আমরা বের করব।
হুমম। করব।…একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ?
দোতলায় ওঠার বাঁকানো সিঁড়িটা?
আমাদের প্রায় কিছুই নেই, অথচ আরেকটা মানুষের কত আছে, কত যে আছে… খুব অদ্ভুত, তাই না?
দোতলায় ৬-৭টা ঘর। একটা বোধহয় মোহাম্মদ আলীর বেডরুম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। কারুকাজ করা দেয়াল, কোথাও দেয়াল মসৃণ, সেখানে ছবি টানানো কয়েকটা, দারুণ দুটো আলমারি, একটা ওয়্যারড্রোব, একসেট বেডরুম সোফা, একটু অদ্ভুত শেপের ফ্রিজ, একদিকের দেয়ালে কাভার্ড স্ক্রিনের টিভি। আজিজুর রহমান সেদিকে তাকিয়ে বলল – এরকম টিভি আগে দেখেছ?
শুনেছি। তোমার মুখে। এটার দাম কত হবে?
দশ-এগার লাখ। শুনেছিলাম।… মাহফুজা?
মাহফুজা ফিরল।
আমার মনে হচ্ছে গুপ্তধন এখানেই লুকানো আছে।
মাহফুজা হাসল – তাই বুঝি!
হেসো না। আমি সিরিয়াস।
আজিজুর রহমানের গলায় কিছু একটা ছিল, মাহফুজা ফিরে তাকাল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল – তোমাকে সত্যিই অন্যরকম দেখাচ্ছে।
এই যে দুই আলমারি, আমার মনে হচ্ছে এর কোনো একটার ভেতরে সুড়ঙ্গ আছে।
দেখবে?
তারা অবশ্য সে সুযোগ পেল না। তার আগেই দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে পড়ল একজন, জানাল – মোহাম্মদ আলী তাদের নিচে ডাকছেন।
নিচে ছোটখাটো একটা জমায়েত, আরো কয়েকটি পরিবার চলে এসেছে। মোহাম্মদ আলী বলল – লাঞ্চ টাইম। তারপর রেস্ট।
ডাইনিং রুমের দিকে এগোতে-এগোতে মোহাম্মদ আলী তাদের দিকে কিছুটা ঘেঁষে এলেন – কেমন দেখলে?
কী বলব, আলীভাই! মাহফুজা বলল। আপনার রুচি এতই সুন্দর!
ধন্যবাদ-ধন্যবাদ।…ছাদের ঘরটা দেখেছ?
না তো! জানিই না। আপনার বেডরুমের চেয়েও সুন্দর?
না না, দুটো দুরকম ব্যাপার।… বেডরুম দেখেছ?
কী যে সুন্দর…!
কী আর, বেডরুম তো বেডরুমই…। মোহাম্মদ আলীকে খুব একটা প্রসন্ন মনে হলো না। ওটা আর দেখার কী! মোহাম্মদ আলী পেছনে ফিরল – আসুন আপনারা। খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে সবার আলাপ-পরিচয় হবে।
আজিজুর রহমান ফিরল মাহফুজার দিকে, গলা নামিয়ে বলল – খেয়াল করলে? আমরা যে তার বেডরুমে গেছি, এটা তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। ওই রুমটা নিয়ে কথাও বলতে চাচ্ছে না।
মাহফুজা মাথা ঝাঁকাল – হুমম ব্যাপার আছে কোনো।
আছে যে। আমি নিশ্চিত।
চার
বিকালের পর থেকে অতিথিরা আসতে আরম্ভ করল। বাইরে পুকুর পাড়ে বিশাল ব্যবস্থা করা হয়েছে, ব্যবস্থা করা হয়েছে মূলবাড়ির সুইমিংপুলের পাশেও। বার-বি-কিউ হবে, অঢেল মদ্যপানের ব্যবস্থাও আছে। মোহাম্মদ আলী বলল – আজ হচ্ছে মাতাল হওয়ার রাত। মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী এসেছে একটু আগে। তার এক ভাই অসুস্থ, লাইফ সাপোর্টে। সেখানে তাকে যেতে হয়েছে, থাকতে
হয়েছে – এই কথা সে বারবার জানাচ্ছে বিভিন্ন জনকে। না হয় সকাল থেকেই থাকতে পারত। মোহাম্মদ আলীর কথা শুনে বলল – অ্যাই, তুমি কিন্তু বেশি খাবে না। তোমার অবস্থা ভালো না।
ঘণ্টা দুয়েক পর চারপাশের চেহারা বদলে গেল। কে কোথায় কী করছে, বোঝার উপায় নেই। কে কোথায় কখন আছে, কখন নেই – জানার উপায় নেই। আজিজুর রহমান ও মাহফুজা শুধু এটুকু বুঝেছে, সুইমিংপুলের পাশের জমায়েত ওজনদার লোকদের জন্য। পুকুরপাড়েরটা হালকা-পাতলা লোকজন যারা, তাদের। আজিজুর রহমান বলল – দেওয়ানি আম ও দেওয়ানি খাস। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তাদের একবারই কথা হয়েছে। মোহাম্মদ আলী বলেছে – তোমাদের নিজেদের পছন্দ থাকলে অন্য কথা। না থাকলে, আজিজ, তুমি নেবে হুইস্কি বা ভদকা, মাহফুজা, তুমি ওয়াইন। কয়েকজন দারুণ মিক্সোলজিস্ট নিয়ে এসেছি। তাদের যে কতরকম প্রিপারেশন। ট্রাই করেই দেখো।
তারা ট্রাই করল না। তাদের ট্রাই করার ইচ্ছা হলো না। মাহফুজা বলল – তুমি খাবে না কিন্তু। মাতাল-টাতাল হয়ে গেলে…।
খাব না। দু-একদিন খেয়েছি। ভালো লাগেনি।… কিন্তু মাহফুজা, আমরা করবটা কী?
মজা হচ্ছে চারপাশে। মজা দেখি।
ভালো লাগছে না। মজা ওদের, আমাদের কী!… চলে যেতে পারলে হতো।
চলো, একটু হাঁটি।
তারা দুজন হাঁটল কিছুক্ষণ। তবে লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, হেঁটেও মজা নেই। আজিজুর রহমান থামল – একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? উত্তর অবশ্য আমিও জানি না।
তাহলে আমিও জানি না।… বলো।
এখানে আজ কত টাকার মদ কেনা হয়েছে?
হাজার-হাজার টাকার।… মানে লাখ…।
কয়েক লাখ। কিছু-কিছু বোতলের দাম নাকি ৭-৮ থেকে ১৪-১৫ হাজার টাকাও। ভাবতে পার?
ইশ, অতগুলো টাকা যদি আমরা একসঙ্গে পেতাম।
সামান্য হাসল আজিজুর রহমান – আমাদের যে চিকিৎসাটা দরকার, ২-৩ বার করতে পারতাম। …শালার টাকা। …মাহফুজা…?
মন খারাপ করে দিয়েছ।… বলো।
থাক।… চলো, ওদিকটায় যাই।
তারা মৃদুপায়ে আরো কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে আজিজুর রহমান আবার বলল – মাহফুজা…?
বলো।
একটু সময় নিল আজিজুর রহমান – কিছু না।…এমনি…এমনি।
কী হয়েছে তোমার? খারাপ লাগছে?
উত্তর দিলো না আজিজুর রহমান। তারা আরো কয়েক পা হাঁটল। আজিজুর রহমান বলল – মাহফুজা…?
আশ্চর্য তো।
যাবে?
সেটা ভালো দেখাবে? আমি সুযোগটুকু নষ্ট করতে চাই না।
আমিও না। চলো যাই।
মানে!
মোহাম্মদ আলীর বেডরুমে।
ধাৎ।
যাই, চলো।
মোহাম্মদ আলীর বেডরুমে ঢুকতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না তাদের। মূলবাড়িতেও এদিক-ওদিক কিছু লোক আছে। তবে তারা সবাই যে যার মতো। যারা দেখভালের দায়িত্বে আছে, আজিজুর রহমান ও মাহফুজাকে শুধু তাদের চোখ এড়িয়ে ওপরে উঠে আসতে হলো। দোতলায়ও কিছু লোক। তবে তাদেরও পাশ-কাটানো গেল। মোহাম্মদ আলীর বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দুপাশে দেখে নিল তারা, তারপর লক ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে পড়ল সাবধানে, কারণ ভয় ছিল – ভেতরে কেউ থাকতেও পারে; কিন্তু নেই। বড় করে শ্বাস ফেলল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল।
তুমি কি ভাবছ এই দুই আলমারির কোনো একটাতেই? মাহফুজা জিজ্ঞেস করল।
আমার কোনো সন্দেহ নেই। আলমারি খুলতে হবে, বুঝলে? কোনো একটা আলমারির ভেতরে পথ আছে, সেই পথে চোরাকুঠুরি, সেখানে গুপ্তধন।
মাহফুজা এগিয়ে আলমারির সামনে থমকে গেল – আরে, হাতল-টাতল কিছু নেই। এটা খোলে কীভাবে? আজিজুর রহমান দাঁড়াল আরেকটার সামনে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে – আছে কোনো সিস্টেম। আলীবাবা নিশ্চয় চাইবে না সেটা অন্য কেউ বুঝুক।
দুজন তবু বেশ কিছুক্ষণ টানাটানি করল। আলমারি খুলল না। একসময় হেসে ফেলল আজিজুর রহমান – আমরা বোকার মতো কাজ করছি। কম্বিনেশন লক এখানে? কী ছিল কম্বিনেশন, মনে আছে তোমার?
আমার? কম্বিনেশন?
কম্বিনেশন বলো পাসওয়ার্ড বলো,… দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে পড়েছে – চিচিং ফাঁক। চিচিং ফাঁক, না?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। চিচিং ফাঁক।
তাহলে সরে এসে একটু পেছনে দাঁড়াও।
তারা পেছনে সরে এসে আলমারির মুখোমুখি দাঁড়াল। আজিজুর রহমান মাহফুজার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, চোখ সরিয়ে নিল। দুজন একসঙ্গে বলে উঠল – চিচিং ফাঁক।
আলমারি খুলল না।
আবার। …চিচিং ফাঁক।
আলমারি খুলল না।
তারা একটু পেছনে সরে বলল – চিচিং ফাঁক।
আলমারি খুলল না।
তারা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে বলল – চিচিং ফাঁক।
আলমারি খুলল না।
তাদের দুজনকে অস্থির দেখাল। মাহফুজা বলল – কী ব্যাপার? আলীবাবা কি পাসওয়ার্ড বদলে ফেলেছে।
না-না, ওটাই পাসওয়ার্ড। ওটাই পার্মানেন্ট পাসওয়ার্ড। আসলে আমাদের ঠিকমতো বলা হচ্ছে না। আসো, আবার…।
তারা নানাভাবে বারবার চিচিং ফাঁক বলে যেতে লাগল। তারা নানাভাবে চিচিং ফাঁক বারবার বলল। তারা বারবার এগিয়ে পিছিয়ে জায়গা বদলিয়ে চিচিং ফাঁক চিচিং ফাঁক করল। কিন্তু আলমারি খুলল না।
তারা হতাশ ও ক্লান্ত চোখে দুজন দুজনের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর তারা দুজন প্রায় একইসঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠল। তারা হাসল বেশ অনেকক্ষণ ধরে – আমরা না… আমরা না… আজিজুর রহমান বলল, আর মাহফুজাও তাতে হাসি সামলাতে সায় দিলো – আমরা কী আমরা কী?
তারপর হঠাৎই তারা সতর্ক হয়ে উঠল – অনেকক্ষণ হয়েছে। কেউ চলে আসতে পারে।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, চলো বেরোই।
তারা বেরোবার দরজার কাছে পৌঁছালে আজিজুর রহমান হাত রাখল মাহফুজার কাঁধে – বেশি ভিজে গেছ। কেউ দেখলে কী না কী ভাববে। চোখ মুছে নাও।
মাহফুজা বলল – তুমিও।