মরস না ক্যান তুই! তুই মরলে আমার হাড়টা জুড়াইতো। তুই মরলে তোর দাদার কবরের পাশে তোরে খাদায়া আইসা আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তাম।
আকাশে-বাতাসে ছোট-বড় ঢেউ তুলে যেতে-যেতে আমেনার এই কথার টুকরো-টাকরা এ-বাড়ি ও-বাড়ি হয়ে বাড়ির পেছনের এজমালি পুকুরটার ওপর দিয়ে বিলের দিকে চলে যায়। তখন প্রখর রোদের বিলে অন্যের ক্ষেতে কামলা-খাটা আমেনার স্বামী বাহারুলের কানে তা কি পৌঁছায়! পৌঁছালে সে নির্ঘাৎ তার প্রতিবাদ জানাতো সঙ্গে-সঙ্গে। ঘরে থাকলে সে-ও চেঁচিয়ে বলতো, মর-মর কয়্যা তুমি তো পোলাডারে হাচা-হাচাই মাইর্যা ফালাইবা! আমেনাও দমবার পাত্র নয়। সে বলতো, তুমি তো হারাডা দিন নিড়ানি-খুরপি লইয়া ক্ষেতে থাকো। পোলার কা–কারখানার তুমি কি জানো!
কা–কারখানা কথাটা শুনলে মনে হতে পারে, যার সম্পর্কে কথাটা বলা হচ্ছে সে এই দুনিয়ার
প্রতাপশালী কোনো মানুষ। আসলে সে মাত্র চৌদ্দো বছরের এক কিশোর। নিমপুর গ্রামের মৃধাবাড়ির ছেলে নিশান – এটুকু বললেই তার সম্পর্কে অনেকটা বলা হয়; কিন্তু তার জননী আমেনার অষ্টপ্রহরের জীবনটা যেন তার দৈনন্দিন কর্মকা– তছনছ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। বলা যায়, নিজের কর্মগুণে সে-নিশান যতটা না পরিচিতি পেয়েছে তার চাইতেও তার নিজেরই মা আমেনার সগর্জ ঘোষণা তাকে অঞ্চলটিতে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। মৃধাবাড়ির প্রায় সকলেরই এখন ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারা জানে যে, নিশানের জন্মদাত্রী স্বয়ং তার সন্তানের মৃত্যু কামনা করে। জগতে এমন ঘটনা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়, যেহেতু নিশান আমেনার স্বগর্ভজাত সন্তানই। লোকজনের কেউ-কেউ আড়ালে হাসে, বেচারি মা ছেলের দস্যিপনায় অতিষ্ঠ হয়ে তার মৃত্যু-কামনা করে বটে। করে মনের রাগ কমায়। দিনের-দিনের ক্ষুধা-অভাব আর কষ্টের জ্বালা মেটায় কিন্তু ভেতরে-ভেতরে, গিয়ে দেখো সে প্রার্থনা করে – ছেলেটা আমার শতায়ু হোক।
ঠিক কবে থেকে আমেনার এই মৃত্যু-কামনার আরম্ভ, সেটা দুম করে বলে দেওয়া মুশকিল। কেননা, লোকজনের মনে পড়ে, আরো বহুকাল আগে তারা শুনেছিল, নিশানের মা ‘মর-মর’ গর্জনে তার বেঁচে-থাকা ছেলেটাকে কথার চাপেই মেরে ফেলে আর কি! ছেলে তো মরেই না, বরং সে দপদপিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে-বাড়তে সাত থেকে একদিন চোদ্দো হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে
জনশ্রম্নতি সত্য হলে সাত বছর বয়সেই নিশানের কর্মদক্ষতার নজির প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। কামলা খেটে ফেরা বাহারুল কেবল পুকুরঘাট থেকে ফিরে একটা পাটি বিছিয়ে বসেছে ভাত খাবে বলে। ভাপ-ওঠা গরম ভাত, টাকি মাছের ঝোল আর ঢোলকলমির শাক – এসবের ওপর তীব্র এক পরত আঁচের ঝাঁঝ লেপে দেয় আমেনা, তোমার পোলা আইজক্যা সিরাজ মিয়ার বাগান থিক্যা মিষ্টিআলু চুরি কর্যা খাইছে। এক মুহূর্ত কথাটা শোনে বাহারুল। আসলে শোনার চেষ্টা করে। পুত্র-সম্পর্কিত এমন প্রতিবেদন সেটাই প্রথম। ফলে কথাটা তার কানে ঢুকলেও করোটিতে ঢোকে না। ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলে কোথায় কাঁচুমাচু হয়ে তাকে বলবে, ভুল হইছে আর করুম না – তা না, ছেলে বলে, আমার নিড়ানি নাই খুরপি নাই, আমি ক্যামনে মাটির নিচ থিক্যা আলু তুলি? কিন্তু নিশানের চৌর্যবৃত্তির সাক্ষী জনৈক রহিম বলে, আরে কিসের নিড়ানি-খুরপি হ্যাঁ, তার হাতের আঙুল দিয়া মাটি খুঁড়্যা বাদামি রঙের মিষ্টিআলু তুল্যা খাইয়া নিল, কী আশ্চর্য!
একা আমেনা কেন বাহারুলেরও তাতে উৎক্ষেপ্ত হওয়ার কথা। কেননা, নিশান-সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি সত্য হলে প্রথমে মৃধাবাড়ি তারপর নিমপুর গ্রাম হয়ে ধরো মীরগঞ্জ রাখালিয়া শ্যামগঞ্জ এবং আরো-আরো কাছের-দূরের যত গ্রাম আছে সর্বত্র আমেনা আর বাহারুলের যে-পরিচিতি ছড়িয়ে পড়বে তাতে তাদের এতদঞ্চলে সমূহ সংকটেই পড়ার কথা। সেই সংকটময়তা তাদের অভাবগ্রস্ততার পর্বকে প্রলম্বিতই করে তুলবে। লোকজন বলবে, আমেনাকে দেখিয়ে লোকজন বলবে, ওই দেখো চোরের মা যায়! বাহারুলকে দেখিয়ে তারা বলবে, ওই দেখো চোরের বাপ যায় এবং আমেনা ও বাহারুলকে দেখিয়ে তারা বলবে, ওই দেখো চোরের মা-বাপ যায়! নিশান যতই নিজেকে নিরপরাধ বলে স্বীকারোক্তি দিক না কেন, কালপরম্পরায় তার তৎপরতায় আমেনা-বাহারুলের জীবনের ঝুঁকি বাড়তেই থাকে। লোকজন যে সবসময় ছেলেটাকে অকুস্থলে দেখতে পায় তা হয়তো নয় কিন্তু তারা ধরেই নেয়, কারো গাছ থেকে ডাব-সুপারি-নারকেল চুরি গেলে, কারো ক্ষেতের মাটির গর্ভ থেকে আলু-হলুদ-মিষ্টিআলু জনামিত্মকে সরিয়ে নেওয়া হলে, কারো গাছ থেকে কামরাঙা-পেয়ারা-লেবু-তেঁতুল খোওয়া গেলে তাদের অধিকাংশ মনে-মনে সন্দেহের তির নিশানের দিকেই ছোড়ে এবং তাদের অপরাংশ প্রকাশ্যে দায় চাপায় নিশানের ঘাড়ে। সেই দায় নিশানের ঘাড়ে তত বোঝা না হলেও সেটা আমেনার ঘাড়ে বিশাল ভারী পাথরের মতো চেপে বসে। তখন সবকিছুর একমাত্র সমাধান হিসেবে আমেনা ছেলের মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। চুরি যাওয়া লোকেদের তাতে ক্ষতিপূরণ না হলেও তারা মনে-মনে আমেনার স্ব-সন্তানের মৃত্যুকামনাকে আন্তরিক বলেই গ্রহণ করে। তাদের কেউ-কেউ কিছুক্ষণের জন্যে চুরি-যাওয়া বস্ত্তর শোক সামলে উলটো আমেনার জন্যেই কোথাও একধরনের সহানুভূতি অনুভব করতে শুরু করে। তারা ভাবে, ছেলেটা মেয়েলোকটার জীবনটা কাহিল আর বরবাদ করে দিলো। এমন সন্তান না থাকাই ভালো। কিন্তু অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চারপাশে গহিন আঁধার আর স্বল্প চাঁদের আলো ঘুমন্ত নিশানের অবয়বে যে-উদ্ভাসন তোলে, তাতে আমেনার ভেতরটা গলে যেতে থাকে। তার মনে হয়, দুনিয়ার সব লোক একজোট হয়ে তার আদরের সন্তানটাকে চোর বানাবার তালে আছে। অথচ গভীর দৃষ্টিতে দেখলে তার এই ছেলেটাই তাকে দুনিয়া ঢুঁড়ে এনে দেবে ভবিষ্যতের অবলম্বন। শোনা যায় কি যায় না স্বরে আমেনা বলে, পরান আমার কবে তুই বড় হবি ক তো দেহি! আমেনার সেই নিভৃত উচ্চারণ কারো কানে যায় না। এমনকি তার স্বামী বাহারুলের কানেও না। দিনভর নিড়ানি-খুরপিব্যস্ত শ্রমিক বাহারুল তখন ঘুমের ঘোরে মাঠভর্তি ফসলের সত্মূপ থেকে অবিরাম ফসল কেটে-কেটে গোলা ভরিয়ে তুলেছে। হয়তো ঘুম ভাঙলে পর সে বুঝবে সব ফসল তোলার মধ্যে স্বপ্ন থাকে না। এত ফসল সে রাখলোটা কই! তার তো গোলাই নেই!
বৈশাখ মাস তীব্রতর হয়ে ওঠে নতুন আগুনের আঁচে। আমেনা খেয়াল করে, তার ছেলে নিশান দিন-দিন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, কখনো-কখনো মনে হয় অচেনা। সারাদিন কই-কই যায়, কই-কই থাকে তার নেই ঠিক। একদিন প্রতিবেশী ফাতেমার মায়ের কাছে জানা যায়, নিশানকে দেখা গেছে পাশের মিয়াবাড়িতে – ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রেডিও শুনতে। তার এই দাঁড়িয়ে থাকাটা একটি অনুলেস্নখযোগ্য নিভৃত পর্বেই সীমাবদ্ধ থাকতো, যদি না ভিড়েরই কেউ একজন ‘ওই চোর’ বলে চেঁচিয়ে উঠতো। সবাই তখন এদিক-ওদিক তাকায় চোরের সন্ধানে কিন্তু তারা চোর খুঁজে পায় না। শেষে তাদের এই বোধ জাগে, নিশান নামের মৃধাবাড়ির ছেলেটাকে চোর বলে সম্বোধন করলে তার সম্পর্কে নতুনভাবে যেহেতু আর কিছুই জানার থাকে না, তারা রেডিওতেই মনোনিবিষ্ট থাকে। অথবা তারা বুঝতে পারে, চুরির চাইতেও ডাকাতির গুরুত্ব অধিক – গোটা দেশটাকেই ডাকাতির মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা ভয়ংকর বন্দোবস্ত যখন চারদিকে চলমান, তখন নিতান্ত অপটু একটি কিশোরের এসব টুকিটাকির কোনোই মানে হয় না। কাজেই তারা জলস্নাদের দরবারের ব্যঙ্গ-গলা শুনতে থাকে মনোযোগ দিয়ে।
সেদিন দুপুরবেলা আমেনা পুকুরঘাট থেকে ঘরে ঢোকামাত্র ছেলে নিশান তার গলা জড়িয়ে ধরে আবদারি ঢংয়ে। গলা জড়িয়ে ধরে সুর করে-করে সে বলতে থাকে, আমরা তোমার শামিত্মপ্রিয় শান্ত ছেলে! আমেনার মাথায় কিছুই ঢোকে না এসব। তার মনে হয় নিজেকে শান্ত ছেলে বলে নিশান হয়তো আমেনাকে তার দুরন্তপনার ইতিহাসে আসন্ন কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ‘আমরা’ শব্দের ব্যঞ্জনা আমেনার মনে ফের একটা আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। কারা এই ‘আমরা’, কেন এই ‘আমরা’ – তাহলে ‘আমরা’ আসলেই কে বা কারা! তার বা তাদের সঙ্গে তার ছেলে নিশানের সম্পর্কই বা কী! এই ‘আমরা’ থাকেই বা কোথায় – ‘আমরা’ কি নিশানকে বাদ দিয়ে, না তাকে সঙ্গে নিয়েই! মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে ওঠে আমেনার। চোদ্দো বছরের ছেলেটা তার আয়ু মনে হতে থাকে দশ বছর কমিয়ে দিয়েছে। যখন-তখন ঘরের বার হয়ে যায়, যখন-তখন তাকে লোকেরা ভিড়ের মধ্যে আবিষ্কার করে – সে রেডিও শোনে। আর সবচাইতে বিস্ময়কর – একদিন ঘুমের মধ্যে তার বিড়বিড় শুনে ভীত আমেনা তার স্বামী বাহারুলকে জিজ্ঞেস করে, ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল, ঘুমের মধ্যে কীসব কথা বলে! শুনে বাহারুল বলে, ভয়ের কিছু নাই, এইডা হইলো নতুন মন্ত্র, ডাকাতি ঠ্যাকানোর মন্ত্র, পোলায় তোমার ‘জয়বাংলা’ কয় ঘুমের মধ্যে। গোটা দ্যাশের মানুষ অহন ‘জয়বাংলা’ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। অহন ‘জয়বাংলা’ ছাড়া বাঁচনের আর কোনো পথ নাই।
আমেনার ভীতি কাটে। আবার নতুন ধরনের ভয়ও আঁকড়ে ধরে। শোনা যায় শহরের যুদ্ধ শিগগির দেশগেরামের ভেতরেও ঢুকতে শুরু করবে। পাকিস্তান থেকে ভয়ংকর সব অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছে মানুষ মারার – বাঙালিকে মেরে শেষ করে তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। বাঙালিও সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা পাকিস্তানিদের ঠেকাবে। এসব কথা আমেনার মধ্যে ভাবান্তর ঘটায়। কিন্তু সে শঙ্কিত বোধ করতে শুরু করে তার ছেলেটার জন্যে। সে যে এই রেডিও শুনতে যায়, যারা রেডিও শোনে আর বাঙালির পোলা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানিরা মারা পড়েছে শুনে উলস্নাস করে, হাততালি দেয়, আনন্দে ফেটে পড়ে, তাদের সামনে কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে না তো! হঠাৎ যদি একদিন পাকিস্তানিরা এসে যারা রেডিও শুনতে যায়, ভিড় করে, তাদেরকে ঘেরাও দিয়ে বলে, হারামজাদা জয়বাংলার দল, তোদের দিন শেষ! – তখন কি তার মাত্র চোদ্দো বছরের ছেলেটা, নিশান, পারবে কি বাঁচতে! আমেনার শঙ্কাটা গাঢ় হয়ে তাকে চেপে ধরে। বাড়ি থেকে, গ্রাম থেকে, নিমপুর ছাড়াও রাখালিয়া, মীরগঞ্জ,
রামগঞ্জ, শ্যামগঞ্জ এসব এলাকা থেকে যুবক-ছোকরাদের অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। কোথাও তাদের হদিস থাকে না। কেবল হঠাৎ-হঠাৎ শুনতে পাওয়া যায়, কাছের-দূরের গ্রামের নিখোঁজ ছেলেদের খোঁজ মিলেছে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের মেরে অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছে, কিংবা পাকিস্তানিদের মারতে গিয়ে অনেক লড়াই চালিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেরা মারা পড়েছে। আমেনার শঙ্কা হলেও নিশানের বয়সের কারণে সে একটু স্বসিত্মও বোধ করে। যারা ইতোমধ্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা পড়েছে এবং যারা কাছের-দূরের গ্রাম থেকে হঠাৎ-হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে তাদের সকলেই যুবক বয়সী। তার মানে দাঁড়ায়, তারা নিশানের চাইতে কম করে হলেও চার বছরের বড়। কাজেই ছেলের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বা তার কখনো-কখনো রেডিও শুনতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত করে ফেলা এসব আর আমেনার উদ্বেগের সীমানায় ঢোকে না। তবে যুদ্ধ যদি গ্রামে ঢুকে পড়ে, ঢুকে গায়ের কাছে এসে পড়ে, তখন সে আমেনা, বাহারুল, নিশান কিংবা মৃধাবাড়ি ও নিমপুরের লোকেদের কী পরিণতি হবে!
সেদিন সকালটা ছিল ভাদ্রের মেঘরোদের পটভূমিতে মিশ্র, দুপুরটা তাতানো আর বারুদের গন্ধ ও বিবিধ মৃত্যুর প্রসঙ্গে দাহ্যময়। সেই দাহ্যতা অপরাহ্ণের রূপকে করাল করে তুললে মীরগঞ্জের ছোট কাসেম হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে ঢোকে মৃধাবাড়িতে। সে খোঁজ করে নিশানের বাপ বাহারুলকে। বাহারুল কেবলই কাউনের পাতলা জাউ মুখে তুলেছে, একটু পরেই সে ফের নিড়ানি-খুরপি হাতে ক্ষেত্রকর্মে যোগ দেবে। জাউ তার সামনেই পড়ে থাকে। শুনেই জ্ঞান হারায় আমেনা। ছোট কাসেম তাদের জানায়, নিশান পাকিস্তানি সেনাদের গুলি খেয়ে মারা পড়েছে। পাকিস্তানি সেনা, ছেলে মারা গেছে গুলি খেয়ে কথাগুলো ঠিক-ঠিক বাহারুলের মাথায় ঢোকে না। কদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানি সেনারা ক্রমশ অভ্যন্তরের দিকে এগোবে। সে-অবস্থায় সবাই স্থিরও করে রেখেছিল, নিমপুর ছেড়ে রাখালিয়ায় বা আরো নিরাপদ রাখালিয়ার ভেতর দিয়ে রসুলপুরের দিকে চলে যাবে। একটা বস্তায় আপৎকালীন সঞ্চয়স্বরূপ চিড়ে-গুড়ও পুরে রাখা আছে। এখন লোকে যদি বলে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে ছেলে মারা পড়েছে তাহলে সে-ও প্রশ্ন করতে পারে, পাকিস্তানি সেনাই বা এলো কখন আর তার ছেলেই বা মারা পড়ল কখন, কীভাবে? মরতে হলে তো তাকে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রের নাগালে পড়তে হবে। আর সম্মুখযুদ্ধে সে মরবে কেন! তার মতো চোদ্দো বছরের একটা ছেলের পক্ষে তো যুদ্ধ ব্যাপারটাই খাপ খায় না। তবে কি ছেলে তার সম্পূর্ণ নিরীহ অবস্থাতেই কোথাও মারা পড়ল? চকিতে একটা আশঙ্কা বাহারুলের মাথায় চক্রাকারে ঘোরে, কেউ কি তাকে ধরে নিয়ে গেল নাকি সেই রেডিও-শোনা লোকেদের জলস্নাদের দরবার বা শামিত্মপ্রিয় শান্ত ছেলে শোনা অবস্থাতেই আচমকা হামলা করে মেরে ফেলল হানাদারের দল!
ততক্ষণে বাহারুলের ছোট্ট ঘরে ভিড় জমে যায়। প্রতিবেশীদের তৎপরতায় আমেনার জ্ঞান ফেরে বটে; কিন্তু তার অভিব্যক্তির আভাসে কেউ জীবনের প্রতীক খুঁজে পায় না। ছেলের মৃত্যুসংবাদে ছেলের মৃত্যু বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়েও আমেনা মৃতবৎ পড়ে থাকে। বাহারুলকে সান্তবনা জোগায় কেউ-কেউ – ভাই রে, কে যে কখন মরি অহন কি তার কোনো ঠিক আছে! ছেলে তোমার না আমগোই মরছে! মর্যা আমগো নিমপুর গ্রামের একজন শহিদের খাতায় নাম লেহাইছে, তোমার পোলা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হইছে, আলস্নায় হ্যারে অবশ্য-অবশ্য ভেস্ত নসিব করবো! পাড়াগাঁর লোকজন সর্বদাই উদ্যোগী। তারা সত্য খবর মিথ্যে খবর সবই দ্রুত সংগ্রহ ও প্রচারে পারদর্শী। তারা সত্যই নিশানের লাশটাকেও হাজির করে। মাথায় গামছাবাঁধা রসুলপুরের একজন কৃষকের নেতৃত্বে জনাচারেক লোক নিশানের মৃতদেহটাকে বয়ে নিয়ে আসে। সকালবেলা যে-ছেলেটি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে নিজেকে শান্ত ছেলে বলে ঘোষণা দিয়েছিল এই সন্ধেতে সে আসলেই সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেছে। তার আর অশান্ত হওয়ার কোনোই উপায় নেই। গুলি তার মাথার খুলিটাকে পরিচয়শূন্য অবস্থায় নিয়ে গেছে। রক্তলিপ্ত তার শরীরটা একটি করুণাখ- হয়ে সবার সামনে উপস্থিত হলে এই প্রথম নিজের জড়স্থিরতা ভেঙে কান্নায় ভেসে যেতে থাকে তার মা, বাহারুলের স্ত্রী – আমেনা।
প্রতিবেশী আর সমব্যথীরা ধরাধরি করে আমেনাকে ধাতস্থ করার চেষ্টা চালাতে থাকে। বাহারুল তার ছেলে নিশানের রক্তমাখা শরীরটাকে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দেয়। খানিকটা কালচে শুকনো রক্ত আর বাহারুলের অভক্ষ্য কাউনের জাউ মিশে কেমন যেন একটা ঝাপসা অবর্ণনীয় শোকের পটভূমি রচনা করে। সবাইকে
শুনিয়ে-শুনিয়ে বর্ণনা দেয় রসুলপুরের কৃষক লোকটা – চোদ্দো বছরে যোদ্ধা হওয়া যায় না, কিন্তু এই পোলাডা হইছে। অহনতক আমরা চোদ্দো বছরের কাউরে হুনি নাই শহিদ অইতে, এই পোলাডা হইছে! তারপর সে সবিস্তারে উপস্থাপন করে নিমপুরের মৃধাবাড়ির বাহারুল মৃধার একমাত্র সন্তান নিশান মৃধার প্রথমে যোদ্ধা এবং শেষে শহিদ হওয়ার বৃত্তান্ত। সবাই জানতো, যে-কোনো দিন পাকিস্তানি সেনারা এসে পড়বে। প্রত্যন্ত গ্রামগুলিও একসময়ে তাদের লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত হবে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের প্রতিরোধ করবার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল ভেতরে-ভেতরে। কিন্তু এর মধ্যে মৃধাবাড়ির কিশোর নিশানটা যে কীভাবে জড়িয়ে পড়ল তা একমাত্র সে-ই জানতো। শোনা যাচ্ছিল তারা মীরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প গড়বে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাদের প্রথম কনভয়টা। হয়তো জনা সাত-আটেক পাকিস্তানি সেনা ছিল সেই কনভয়ে। তবে পথনির্দেশক দুয়েকজন বাঙালিও নাকি সঙ্গে ছিল, এমন কথা নিমপুর এবং প্রতিবেশী গ্রামের সকলেই বলাবলি করে। যেইমাত্র কনভয়টা মীরগঞ্জের বড় রাস্তার মাথার বটগাছটার কাছে পৌঁছায় তখনই বিকট শব্দে বোমা ফাটে। ভয়ংকর শব্দে হুড়মুড়িয়ে কনভয়টা ছিটকে গিয়ে পড়ে সন্নিহিত খালে। আষাঢ়-শ্রাবণের জল-জমে-থাকা ভাদ্রের খাল মুহূর্তেই কনভয়টিকে গ্রহণ করে এবং গ্রেনেড আর সলিল এই দুয়ের শিকারে পরিণত হয়ে সেনারা অনতিবিলম্বে মৃত হয়ে যায়। গ্রেনেড ফাটিয়ে দ্রুত কেটে পড়ছিল নিশান। ততক্ষণে দ্বিতীয় কনভয়টা সন্নিকটে এসে পড়ে এবং দ্রুত ধাবমান নিশানের মস্তক ভেদ করে চলে যায় পাকিস্তানি সেনার এসএমজি বা এলএমজির গুলি। সবকিছুর নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচীন সেই বটের গাছ।
স্মম্ভিত বাহারুলের বোধশক্তি বিলুপ্তপ্রায়। নীরবে-নিভৃতে কী করে ছেলে তার যোদ্ধা হয়ে যায়! তাহলে যোদ্ধা হওয়া এতই সহজ! আর সে ভেবেই যাচ্ছিল, যুদ্ধ করতে গিয়ে এ-কদিনে যারা মারা পড়েছে তারা সবাই কমপক্ষে আঠারো। তার চোদ্দোর ছেলে নিশান কী করে এক লাফে আঠারো হয়ে গেল! কোনোভাবেই হিসাব মেলে না তার। সবটাই এক অমীমাংসিত ধাঁধার মতো লাগে তার। সেই ধাঁধাকে আরো ঘোরালো করে তোলে তার স্ত্রী আমেনার প্রলম্বিত বিলাপ। স্ত্রীকে কী বলে শান্ত করবে বাহারুল! তবু কোন বোধে কে জানে, রাগ না ক্ষোভ না দুঃখ না বেদনা, কেউ বলতে পারে না, হয়তো পারে না বাহারুল নিজেও, বিলাপ আর কথকতার ভঙ্গিতে হয়তো নিজেকে হয়তো আমেনাকে হয়তো বিধাতাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে থাকে – তুমিই তো ছেলেরে মরতে কইছিলা, হারাডা জীবন তোমার মুহে হুনলাম, মরস না ক্যান, তুই মরস না ক্যান! অহন হাচাই তোমার পোলা মরছে – মইর্যা গেছে! অশ্রম্ন লবণ লালা ইত্যাদি মিলেমিশে আমেনার চেহারা তার চিরপরিচিতির বাইরে চলে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু তাও তার কান্নার সঞ্চয় কমে না। কাঁদতে-কাঁদতে দুই হাতে বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে সে বলতে থাকে – হ গো হ, পোলারে আমি মরতে কইছি, আমিই হ্যারে মরতে কইছি, কিন্তুক ক্যামনে মরবো হেইডা কই নাই, তয় আজ হ্যা-ই আমারে দ্যাহাইয়া দিয়া গেল, ক্যামনে মরতে অয়!