আমি শিবানি। শিবরামের বউ…।
সেদিন আষাঢ়ের তিন, গোদার তিন নম্বর বউ সারাদিন কেঁদে-কেটে অস্থির। কী জল যে সারাদিন ঢালল চোখের! ওরা সহোদর সাত বোন গোদার সাত বউ। সবাই বুড়ো হয়েছে। চুল পেকে হয়েছে শনপাটের মতো সাদা। দাঁত পড়ে গেছে। হাসলে খয়েরি মাড়ি বেরিয়ে আসে।
তো, এই বুড়ো বয়সেও ওরা শ্বশুরবাড়ি যেতে কাঁদে। সে যে কী কান্না? একেবারে কিশোরী-বউয়ের মতো। যেন চিরতরে বাবার বাড়ি ত্যাগ করছে, আর কোনোদিন নাইওর আসতে পারবে না। যা হোক, সেদিন গোদার তিন নম্বর বউ, ওরা সাত বোন, সাতদিন কাঁদতে-কাঁদতে শ্বশুরবাড়ি যায়; সারাদিন কেঁদে-কেটে, দেশগ্রাম চোখের জলে ভাসিয়ে বিকেলের
দিকে কান্নাকাটিতে একটু বিরতি দিতেই লোকটা বলল, ‘শিবু, বৃষ্টি ধরেছে, আবার নামতে পারে, এই সুযোগে আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি…।’
লোকটা যে শিবরাম, আমার স্বামী; এটা তো আর কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। শিবরাম আমাকে ‘শিবু’ বলে ডাকে, আমি তো আর – যে-লোকটি আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে তাকে নাম ধরে ডাকতে পারি না। আমি ‘লোকটা’ বলেই চালিয়ে দিই…।
‘বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি’ – কথাটির একটি মানে আছে। মানেটা হলো – দু-কলকি গঞ্জিকা সেবন। আমি তেমন একটা লেখাপড়া জানি না। প্রাইমারি পাস করার পর আর স্কুলে যাইনি। লেখাপড়ার চেয়ে পুতুলের সংসার সাজানো, কনে-পুতুলের বিয়ে দেওয়া, বর-পুতুলকে বিয়ে করানোই প্রিয় ছিল আমার। তাছাড়া আমার মা ছিল পাগলাগোছের মানুষ, সংসার সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে পারত না। আমি আমার পুতুলের সংসার সাজাতে-সাজাতে মায়ের সংসারটিও সাজানো শিখে ফেলেছিলাম। ওই কিশোরী-বয়সেই, বলতে গেলে সংসারের হাল ধরেছিলাম আমি। এতে, মা ভীষণ খুশি। তাকে তার বাবার বকুনি খেতে হয় না। ফলটা হলো কী? মা আর
আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করত না। বাবাও বলত না কিছু। সে তার হাটবাজার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা হাটবাজারে গজা বিক্রি করে। যাহোক, অল্পবিদ্যার মানুষ আমি, ‘গঞ্জিকা’ শব্দটি মুখে আসতে চায় না, ‘গাঁজা’ বলতেই আরাম পাই; কিন্তু লোকটার জন্যই আমি গঞ্জিকাকে গাঁজা বলতে পারি না, কষ্ট করে হলেও গঞ্জিকাই বলতে হয়। গঞ্জিকাকে গাঁজা বললে, লোকটা আমার চেয়ে তিন ক্লাস বেশি পড়েছে, তাতেই সে বড়ো বিদ্বান; বলে – গঞ্জিকাকে অপমান করা হয়…।
সবতাতেই ভালো লোকটা। আমি কষ্ট পেতে পারি – সজ্ঞানে এ-ধরনের কোনো কাজ সে করে না। দোষ একটাই – গঞ্জিকাসেবী। তবে ভগবান আমাকে বাঁচিয়েছে, সবই তাঁর কৃপা; লোকটা গঞ্জিকা সেবন করে পরিমিত, কোনোদিন মাতাল হয় না; মাতলামি করে না…।
গোদার বউ সারাদিন কেঁদেছে। ঢল ছিল চোখে। ঘরের বাইরে বেরোনোর জো ছিল না। লোকটা সারাদিন ঘরে বসে-বসে বাঁশি বাজিয়েছে। আড়বাঁশি। বংশীবাদক হিসেবে সুনাম আছে লোকটার। সাগর কবিয়ালের দোহারি করে সে। কবিয়ালের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। কবিয়ালের সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার বংশীবাদনেরও প্রশংসা করে মানুষ। তা শুনে খুব ভালো লাগে আমার। লোকটার প্রশংসা শুনলে আমার বুকের ভেতর ‘শিবরাম’, ‘শিবরাম’ শব্দ ওঠে। আমি দুহাত তুলে ভগবানের উদ্দেশে প্রণাম জানাই – ‘ভগবান, এই লোকটাকে আমার স্বামী করেছো, পরলোকেও যেন পাই তাকে…।’
কাইতান কিংবা অন্য কোনো কারণে লোকটা হাটে না-গেলে বাড়িতে বসে বাঁশির সুর তোলে। আমার বাবার মতোই লোকটা হাটে-হাটে গজা বিক্রি করে। হাটে গজা বিক্রি করে হাট থেকেই ময়দা-চিনি কিনে আনে। আমরা দুজনে মিলে বাড়িতে গজা বানাই। ময়রা হিসেবেও লোকটার সুনাম আছে…।
সেদিন ঘরে বসে বাঁশি বাজিয়েছে সারাদিন। লোকটা যখন বাঁশিতে সুর তোলে, তখন আমার বুক কাঁপে। কী যে করুণ-কষ্ট সুর তোলে বাঁশিতে! লোকে বলে, শিবরামের বাঁশির সুর শুনে যার চোখে জল না-আসে সে নাকি মানুষের পর্যায়েই পড়ে না। সে একেবারে পাথর দিয়ে তৈরি অমানুষ। গাঁয়ে গানের আসর বসলে আমিও যাই। লোকটার বাঁশির সুর শুনে আমার চোখে অশ্রম্নপস্নাবন নামে। নিজের চোখের জল মুছতে-মুছতে বলি – ‘ভগবান, লোকে তাহলে মিথ্যে বলে না…।’
লোকটা বাঁশিতে নানা ধরনের সুর তোলে। তবে, কেন জানি না, একটা সুর তার খুবই প্রিয়। সব আসরেই নাকি সে সুরটা তোলে। সে নিজেই তা বলেছে একদিন। সেদিনও বৃষ্টির মধ্যে বারবার ওই সুরটা – ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি/ সুখের সার সে চোখের জলেরে/ তুমি হাস আমি কাঁদি/ বাঁশি বাজুক কদমতলে রে… ’, তুলছিল, আর কাঁদছিল সদ্য-মাতৃহারা বালকের মতো…।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে, খালপাড়ে জোড়া কদমগাছ। আষাঢ়-মেঘের জলের ছোঁয়া পেয়েই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। তিন দিনেই কাঁচা-হলুদ-রঙের ফুলে-ফুলে ভরে গেছে গাছ। বৃষ্টি-ধোয়া বাড়ি ম-ম করছে ফুলের গন্ধে। এই ফুলের সুবাস গায়ে মেখে, ‘বাঁশি বাজুক কদমতলে রে…’ – গুনগুন করতে-করতে আমি উনুনে হাঁড়ি চাপিয়েছি। লোকটার বাঁশির সুরে, এই গানটির সুর শুনতে-শুনতে; গানটি আমার মনেও গেঁথে গেছে। হঠাৎ-হঠাৎ আমার ভেতরের আমিও গুনগুন করে ওঠে – ‘বাঁশি বাজুক কদমতলে রে…।’
একটানা বৃষ্টি ছিল সারাদিন। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ আর লোকটার বাঁশির সুর আমাকে কেমন যেন অবশ করে ফেলেছিল। দুপুরে রান্নাবান্নার আয়োজন করিনি। আমরা দুজনে কাঁঠাল-মুড়ি খেয়েছি। সুবর্ণ কাঁঠাল খেতে চায় না। চার বছর বয়স হয়ে গেল – এখনো ভাতই ভালো করে খেতে শিখল না। বড়ো যন্ত্রণা হয়েছে ছেলেটাকে নিয়ে। ঘরে দুটো সন্দেশ ছিল, তাই খাইয়েছি ওকে। এখন তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করা দরকার। কে জানে, গোদার বউ আবার কখন কান্না জুড়ে দেবে… !
সাঁঝ নামার আগেই আমার রান্নাবান্না শেষ। ভাতের সঙ্গে বাজালি মাঝের চ্চচড়ি, শোল মাছের ঝোল আর মুগের ডাল। দুধ তো আছেই। লোকটাকে প্রতিদিনই দুধ দিতে হয়। গঞ্জিকাসেবীদের দুধ না-হলে চলে না। সুবর্ণ ডাল আর দুধ দিয়ে দু-লোকমা ভাত খেয়েছে। মাছও খেতে চায় না ছেলে। কাঁটা বেছে খাইয়ে দিতে চাইলাম, তবু খেলো না। রাত বেশ হয়েছে। গোদার বউ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে আবার। চোখের ঢল নামতে পারে যে-কোনো সময়। আমি খাইনি। স্বামীর আগে খেলে সংসারের অকল্যাণ হয় – বিয়ের দিন মা কানে-কানে বলে দিয়েছে, শ্বশুরবাড়ি এলে – শাশুড়িও শুনিয়েছে এই বেদবাক্য; লোকটা বাড়িতে না-এলে, তাকে না-খাইয়ে আমি খাই কী করে? সংসারের অমঙ্গল হবে যে… !
কিন্তু লোকটা যে আসছে না! রাতও বাড়ছে। কুমারপাড়া মন্দিরে এক প্রহর পরপর ঘণ্টা বাজাচ্ছে পুরোহিত। এখন রাতের শেষ প্রহর। তবু লোকটা আসছে না। আমার চোখে ঘুম নেই। স্বামী ‘বাজার থেকে একটু ঘুরে আসছি’ বলে রাতে আর ঘরে না-ফিরলে, কোনো নারীর চোখেই ঘুম থাকে না…।
লোকটা সকালেও এলো না, দুপুরেও না…।
আমি ভেবেছিলাম – লোকটা বৃষ্টির দিন দেখে অন্যদিনের চেয়ে বেশি গঞ্জিকা সেবন করেছিল, তারপর খেয়েছিল মদ। সাগর কবিয়াল বানুটি খায়, তার পালস্নায় পড়ে লোকটাও খেতে পারে। গঞ্জিকা ও মদের নেশায় কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালে ঘুম ভাঙলেই চলে আসবে। কিন্তু সকাল গেল, দুপুর গেল; পরের রাত গেল – লোকটা এলো না…।
লোকটা আর ফিরে আসেনি…।
কোথায় গেল লোকটা… ?
দেশে, পাবনা, যশোর, চাঁদপুর – আরো যেসব গাঁয়ে আমাদের কিংবা লোকটার তরফের আত্মীয়স্বজন আছে, আমার ভাইয়েরা, ভাসুরঠাকুর-দেবরঠাকুরেরা মাস ভরে খোঁজাখুঁজি করল – না, কোথাও লোকটার খোঁজ পাওয়া গেল না। তারপর আরো দুমাস ভারতের আসাম-কোচবিহার – যেখানে-যেখানে আমাদের দুই পরিবারের দূরবর্তী আত্মীয়স্বজন আছে, সবখানে খোঁজ করা হলো – লোকটার কোনো খোঁজ মিলল না…।
তারপর… ?
তারপর একদিন আমার কানে এলো, পালবাড়ির পুকুরঘাটে, গ্রামে – আমাদের হিন্দুপাড়ায় পালবাড়ির পুকুরটিই বড়ো। সারা বছর জল থাকে, বাঁধানো ঘাট আছে; সেই ঘাটে বসে; বড়ো মন্দিরটিও পালবাড়ি, ওই মন্দিরের পাশে বকুলতলা বসে আমাদের পড়শিরা জাবর কাটে – ‘দেখ, ভগবানের কী বিচার! কচি বয়সেই শিবানিটা বেধবা হয়ে গেলো…।’
বিধবা… !
লোকটার কি মৃত্যু হয়েছে? কীভাবে? আমি কি সিঁথির সিঁদুর মুঝে ফেলব? সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলে সেই হিন্দু-নারীর তো বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এই পার্থিব দুনিয়াটা তখন তার কাছে নরকতুল্য। তাহলে আমি এখন কী করব, ভগবান… ?
লোকটা কেন এভাবে বাড়িঘর ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে, সুবর্ণকে ছেড়ে; সুবর্ণা তখন আমার পেটে; সুবর্ণাকে ছেড়ে চলে গেল – এই হিসাব আমি কোনোদিন মেলাতে পারিনি। নিশ্চয়ই আমার কোনো অপরাধ ছিল, কিন্তু কী সেই অপরাধ, কত বড়ো অপরাধ; যা লোকটা আমাকে বলতে পারল না, কিংবা ইচ্ছা করেই বলল না; নিজেই ঘরবিবাগি হলো? বাঁশিতে যারা সুর তোলে, সুর তুলে যারা শিশুর মতো কাঁদে; তারা কি নিজের মনের দুঃখ-কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না… ?
বাড়ি ছেড়ে লোকটা বেঁচে গেল নাকি মরল – কে জানে ভগবান।
কিন্তু আমি এখন কী করি? দিন-দিন আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে উঠছে। ওই যে, পড়শিরা বলে – কচি শিবানি, কথাটা তো ঠিক। চোদ্দো বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছে। পরের বছরই কোলে আসে সুবর্ণ, ওর বয়স কেবল চার; অর্থাৎ গুনে দেখলাম – আমার বয়স এখনো বিশই হয়নি।… তো, এরকম একটি অরক্ষেত কচি শরীর, রাতে আমার ঘরের চালে ঢিল পড়ে, দরজায় টোকা পড়ে; দিনে সাগর কবিয়াল আর শিবানিকে নিয়ে গান বাঁধে নতুন কবিয়াল; তাহলে আমি বাঁচব কী করে… !
সাগর কবিয়াল আগেও আমাদের বাড়িতে আসত। ঘরের বারান্দায় বসে-বসে গান বাঁধত, লোকটা সুর তুলত বাঁশিতে। এখনো কবিয়াল আসে। আমার খোঁজখবর নেয়, সুবর্ণ-সুবর্ণাকে আদর করে। ভগবান জানে, তিনিই সাক্ষী – এর বেশি কিছু না। মানুষই তো মানুষের খোঁজখবর করে। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়। সাগর কবিয়াল লোকটার বন্ধুমানুষ। সে আমার এই বিপদে পাশে দাঁড়াবে না? দাঁড়াবেই তো। তা ছাড়া, কবিয়াল বড়ো নরম-মনের মানুষ, সুন্দর মনের মানুষ। তার সঙ্গে গানের আসরে লড়াই করে না-পেরে, শত্রম্নতা-সাধনের জন্য যে-গান বেঁধেছে নতুন কবিয়াল, এ-গান বাঁধা, এ-গান গাওয়া যে পাপ, মহাপাপ…।
এই, এতদিনে, বহুবার মনস্থ করেছি; এবার গলায় দড়ি দেব। মাথার কাছে বঁটি রেখে বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই। কিন্তু সুবর্ণকে বড়ো হতে দেখে, সুবর্ণাকে বড়ো হতে দেখে, ওদের দুই ভাইবোনের জারুলফুলের মতো স্নিগ্ধ মুখ দেখে কাজটা আর করতে পারিনি…।
গোদার বউরা বছরে একদিন কাঁদে, আমি ২০ বছর ধরে প্রতিদিনই কাঁদছি। আমার চোখের জল কেউ দেখে না – এই যা তফাৎ… !
দুই
আমি শিবরাম। শিবানির স্বামী…।
সেদিন ঢল-বর্ষণ ছিল সারাদিন। মাটি-কাঁপানো মেঘগর্জন আকাশে-আকাশে। এরই মধ্যে ঘরের বারান্দায় বসে আমি বাঁশিতে সুর তুলছিলাম। আমার প্রিয় সুর – ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি/সুখের সার যে চোখের জলে রে…।’ সাগর কবিয়াল যখন আসরে এই গীত ধরে, তখন সব দর্শক-শ্রোতার চোখে জল নামে; সবাই বোঝে, সবার মনই বলে – জীবনে ভালোবাসার সুখ, সে শুধুই চোখের জল, আর কিছু না। আমি শিবানিকে ভালোবেসে আরো বিশদ আকারে তা বুঝেছি। তাই তো সাগর কবিয়াল এ-গানে সুর তুলতেই আমার চোখেও জলপস্নাবন নামে…।
আমি অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম – বাড়ি থেকে চিরকালের জন্য বেরিয়ে পড়ব। আমার বাড়ি আমার কাছে নরক হয়ে উঠেছে। বাড়ির শোবার ঘরে, রান্নাঘরে, উঠোনে – সর্বত্র শুধুই আগুন। সবখানেই জ্বলন্ত চিতা। আমি সেই অগ্নিকু– পুড়তে-পুড়তে ছাই হচ্ছি। তবে কেন আর ঘর? কেন আর সংসার? সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়াই তো শ্রেয়…।
বাড়ির সর্বত্র আগুন, অগ্নিকু-; এটা কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ দেখে না। শিবানি না, সুবর্ণ না, যেটি শিবানির পেটে আছে, সেও না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য এটিই আমার জন্য সুবিধাজনক সময়। কেউ কোনোদিন কিছুই অনুমান করতে পারবে না – বংশীবাদক শিবরাম কেন ঘর-সংসার ছেড়ে পানকৌড়ির মতো ডুব মেরে পালাল… !
সেদিন বিকেলের দিকে, বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই, শিবানিকে বললাম – ‘শিবানি, আমি বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি…।’ আমার কথা শুনে, শিবানি পেটেরটার জন্য কাঁথা সেলাই করছিল; আমার দিকে তাকাল। তারপর একটু হেসে বলল, ‘এই বিষ্টি-বাদলা মাথায় করেই বাজারে যাবা…?’ আমি কিছু বললাম না। শিবানি জানে, আমি এখন বাজারে যাবই। আমার গঞ্জিকাসেবনের সময় হয়ে এসেছে। আমি এমনিতেই, প্রত্যেকদিন বিকেলে-সন্ধ্যায় গঞ্জিকাসেবন করি, সেদিন ছিল ঝুম-বৃষ্টি; এই ধরনের বৃষ্টির দিনগুলোতে গঞ্জিকা আরো বেশি করে টানে; সে আর কিছু বলল না; আমি বেরিয়ে পড়লাম…।
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারের পথ না-ধরে সোজা পাকা-সড়কের পথে নামলাম। শিবানি তো আমার মনের কথা জানে না, সে একমনে কাঁথা সেলাই করছে; আমি বাজারের পথ ছেড়ে পাকা সড়কের দিকে যাচ্ছি কিনা – এটা দেখার কথা তার মনে হয়নি। মনে হওয়ার কোনো কারণও ছিল না…।
গঞ্জিকা আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল। কিন্তু ওই টান আমি প্রবলবেগে উপেক্ষা করে পাকা-রাস্তায় উঠলাম। আজই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাড়ির সর্বত্র নরকের আগুনের মতো আগুন। আমি আর পারছি না। পাকা-সড়কে উঠে শিবানি-সুবর্ণকে মনে পড়ছিল, শিবানির পেটেরটার কথাও মনে পড়ছিল। কিন্তু তখন আমার মনে জেদ চেপে বসেছে। না, আর বাড়িতে ফিরব না। বাড়িতে ফিরলেই পুড়ে চিতাকাঠের মতো ছাই হয়ে যাব…।
সড়কে উঠে কবিয়ালের কথাও মনে পড়ছিল। কবিয়াল নতুন গান বেঁধেছে – ‘ও আমার মনের মানুষ গো/ তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধলাম ঘর…।’ কবিয়ালের মনের মানুষ যে কে, তা আমি জানি। আমাকে বাঁশিতে সুর তুলতে বলেছে। আজই সুর তোলার কথা ছিল। কিন্তু আমি আর নেই। কবিয়াল নতুন বংশীবাদক খুঁজুক…।
আমি কেন ঘর-সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম? বলেছি তো – আমি আর পারছিলাম না। পুড়ে ছাইভস্ম হচ্ছিলাম প্রতিদিন। দৃশ্যমান আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা হয়তো সহ্য করা যায়, অদৃশ্য আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন…।
যাই হোক, ভেবে দেখলাম; সবকিছু বলা সমীচীন হবে না। সামান্য কিছু বলি…।
শিবানিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। শিবানিও আমাকে, বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসত। অর্থাৎ, আমাদের দুজনের মধ্যে প্রেম ছিল। শিবানির বয়স ছিল কম। তাই ওর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল ফুলের কুঁড়ির ভেতর থেকে সুবাস ছড়ানোর মতো…।
আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা। জাতিতেও এক – ময়রা। তাই, দুই পরিবারের সম্মতিতে, সাতপাক ঘুরেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি এখনো শিবানিকে সেই ঝিনুক-তীরের কাশবনে ভালোবাসার মতোই ভালোবাসি। শরতে ওর খোঁপায় গুঁজে দিই কাশফুল, বর্ষায় গুঁজে দিই কদমফুল। শিবানিও আমাকে ভালোবাসে সেই আফোটাবেলার মতোই। এখনো ভোরবেলা বিছানা ছাড়ার সময় আমার পা-ছুঁয়ে প্রণাম করে, এখনো বিশ্বাস করে – স্বামীকে অভুক্ত রেখে নিজে খেলে সংসারের অকল্যাণ হবে। আমাদের ভালোবাসায় দৃশ্যত কোনো ফাঁকফোকর নেই। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় – আমাদের ভালোবাসার সংসারে একটি সাপ ঢুকেছে; দুধরাজ। শিবানি বাটি ভরে দুধ খাওয়ায় সাপটিকে…!
আমার কেন মনে হবে – কেন সন্দেহ – আমাদের সংসারে সাপ ঢুকেছে; আমি বাঁশিতে ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি/ সুখের সার সে চোখের জলে রে…; সুর তুলে কাঁদি। কিন্তু মনের সন্দেহ দূর করতে পারি না। মনে-মনে ভগবানকে ডাকি, আমার চোখের জলস্রোতে মনের সন্দেহ ভেসে যাক; কিন্তু চোখের জল ফেলাই সার, মনের সন্দেহ দূর হয় না। আমার চোখে-চোখে ভাসে দুধরাজ সাপ; শিবানির হাতে দুধের বাটি…।
এই যে, আমি বাঁশিতে গানের সুর তুলে কাঁদি, শিবানি তো বাইরের সত্যটাকেই দেখে। তার স্বামী শিবরাম বাঁশিতে সুর তোলে কাঁদছে। এটা তার অভ্যাস। বাঁশিতে সুর তোলে আবেগ ধরে রাখতে পারে না – তাই কাঁদে। কিন্তু আমি কষ্টে, ক্রোধে কাঁদি – ভালোবাসার কষ্ট, ভালোবাসার ক্রোধ; শিবানি এটা বোঝে না। কিংবা কে জানে, শিবানি
বুঝেও না-বোঝার ভান করে… !
সাগর কবিয়াল বয়সে আমার চেয়ে দুবছরের ছোট; তারপরও আমার ওস্তাদ সে। বন্ধুও বটে। যারা গীত বাঁধে, আসরে গায় – তাঁরাই তো ওস্তাদ। সেই হিসেবে সাগর কবিয়াল আমার ওস্তাদ। আমি বাঁশিতে ওর গানের দোহার করি। তবে, কবিয়াল আমাকে বেশ শ্রদ্ধাভক্তি করে। আসরে নামার আগে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। লোকটা ভালো। বড়োমনের মানুষ। আমাদের বাড়িতে ওর অবাধ যাতায়াত। ও বাড়িতে এলেই শিবানি চা করে দেবে। কিন্তু কবিয়ালের একটা ব্যাপার আমি মেনে নিতে পারি না। শিবানিকে ও ‘ঠাকুরঝি’ ডাকে…।
দিদি না, বউদি না; ঠাকুরঝি কেন… !
কবিয়ালকে একদিন ধরলাম – ‘সাগর, শিবানিকে তুমি দিদি ডাকতে পারো, বউদি ডাকতে পারো – ঠাকুরঝি কেন? ঠাকুরঝি তো শ্যালিকা। শিবানির সঙ্গে তুমি শ্যালিকার সম্পর্ক পাতাও কীভাবে…?’
সাগর কিছু লেখাপড়া জানে। হাইস্কুলেও পড়েছে কিছুদিন। শিক্ষিত কবিয়াল কী যে বলল আমার কথার উত্তরে, আমি ধরতে গেলে অশিক্ষিত মানুষ, প্রাইমারি স্কুলে কদিন মাত্র গেছিলাম; ওর কথার মাথামু- আমি কিছুই বুঝলাম না। কোন পালা-বইয়ের নায়ক নিতাই কবিয়াল তার বন্ধুর শ্যালিকাকে ঠাকুরঝি ডাকে – তাই সাগর কবিয়ালও আমার বউকে ঠাকুরঝি ডাকবে – এটা কেমন কথা? ভেতরে কোনো গূঢ়তত্ত্ব আছে কিনা, কে জানে! আমার মন বলে, কিছু একটা আছে ভেতরে; নইলে আমার কথা শুনে শিবানি কেন হাসতে-হাসতে বলল – ‘দূর, তুমি যে কী লোক না! সাগরদা আমাকে ঠাকুরঝি ডাকে, তাতে কী হয়েছে? ঠাকুরঝি ডাক শুনতে আমার ভালই লাগে…।’
সাগর কবিয়াল শিবানিকে ‘ঠাকুরঝি’ ডাকে, আর ওই ডাক শুনে আমার ভেতরে পুনের আগুনের মতো আগুন জ্বলে…।
তখনো আমি বাড়ির সর্বত্র আগুন দেখি না, আগুন আমার বুকের ভেতর সাপের মতো কু-লী পাকিয়ে শুয়ে থাকে; আমার ভেতরটা পুড়ে ছারখার করে; কিন্তু আমি টের পাই, এ-আগুন এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সময় এসেছে – একদিন হলোও তাই…।
কবিয়াল নতুন গীত বেঁধেছে। বাঁশিতে সুর তুলতে হবে। সন্ধ্যায় আমাদের উঠোনেই আসর। কৃষ্ণদাও থাকবে। বেহালা বাজায় দাদা। সাগর বিয়ে করেনি। বাড়িতে চা করে দেওয়ার লোক নেই। তাই গানের সুর তোলার আসর আমাদের বাড়িতে বসে বেশি। কদাচিৎ বাজারে, বটতলা…।
দোতারায় টুংটাং শব্দ তুলে গলা খুলল সাগর কবিয়াল – ‘কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছো কি নয়নে… ?’
বলেছি তো, আমার বুকের ভেতরে কু-লী পাকিয়ে থাকা আগুনের বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে, সাগর কবিয়ালের গান শুনে সেই আগুন বাড়ির সবখানে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ঘরের বেড়ায় আগুন, ঘরের চালে আগুন – বাড়ির সব গাছপালাতেও আগুন লেগে গেল। শিবানির গায়ের রং কালো, ওর বড়ো-বড়ো চোখদুটোও কালো। অল্পবয়সী মেয়েটির জামের মতো কালো চোখ দুটি দেখেই আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। ওর তো তখন সেই অর্থে প্রেমে পড়ার বয়সই হয়নি – তবু কেন আমাকে ভালোবাসত, জানি না। সেই মেয়েটি, শিবানি – আমার বউ, আর আমার বউকে নিয়ে গীত রচনা করে সাগর কবিয়াল! শিবানির দীর্ঘ কালো চুল, যাকে বলে – মেঘবরণ চুল, খোঁপা বাঁধলে – খোঁপার চূড়াটিকে রাঙা-ফুলের মতোই মনে হয় – কবিয়াল বলছে – ‘রাঙা কুসুম’। কবিয়াল শিবানিকে ঠাকুরঝি ডাকে – তাও, বুকের ভেতরে নরকের আগুন জ্বলে উঠলেও; দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য করছিলাম; কিন্তু এখন দেখি – শিবানিকে নিয়ে গীতও বাঁধছে কবিয়াল, শিবানিও চায়ের কাপ হাতে দম বন্ধ করে শুনছে সেই গান; আমি আর সহ্য করতে পাছিলাম না। আমার বাঁশিতে তখন আপনাআপনি সুর উঠছিল – ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি/ সুখের সার সে চোখের জলে রে…।’
কবিয়াল গুনগুন করছিল – ‘কালো কেশে রাঙা কুসুম’ – শিবানি চায়ের কাপ ধরেছে কবিয়ালের সামনে, আমার মনে হচ্ছিল – শিবানির হাতে চায়ের কাপ নয়, দুধের বাটি; দুধরাজ সাপটি এখন চুকচুক করে দুধ খাবে…।
সেদিন থেকেই আমি তৈরি হচ্ছিলাম, ঘর-সংসার আর না। ঘরে সাপ ঢুকেছে, সাপটিকে দুধ-কলা খাওয়ায় শিবানি, আমার বউ; কখন সাপটি আমাকে ছোবল মারবে, কে জানে! কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরোতে পারছিলাম না। শিবানি যতই সাপ পুষুক, মেয়েটিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি, আমি সাগর কবিয়ালের মতো গান বাঁধতে পারলে গান বাঁধতাম – ‘ব্রজ-গোকুলের কুলে কালো কালিন্দীরই জলে/ হেলে-দুলে ওরে সোনার কমলা’ – সেই শিবানিকে ছেড়ে, সুবর্ণকে ছেড়ে, শিবানির পেটে যেটি আছে – তাকে ছেড়ে, বেরোই কী করে? দীর্ঘদিন ধরেই নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম – শিবানি কি আমাকে আর ভালোবাসে না? আমাকে ভালোবাসলে সাপ পুষবে কেন? কিন্তু শিবানির কথাবার্তা, আচার-আচরণ, রাতের সংসার – কোথাও কোনো বিচ্যুতি আমার চোখে পড়ে না। শিবানি যেন সেই আগের শিবানিই। কিন্তু ঘরে যে-সাপ ঢুকেছে, সাপটির কথা মনে পড়লেই কোত্থেকে যেন আগুনের গোলা এসে পড়ে আমার মাথায়, চকিতে আমার পুরো শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমি দগ্ধ হই জতুগৃহে যুধিষ্ঠিরের মতো। তারপরও, ঘর ছাড়ার প্রস্ত্ততি নিয়েও, আগুনে পুড়ে ছারখার হতে-হতেও; ঘরেই ছিলাম। কিন্তু কবিয়াল আবার গান বাঁধল – ‘ও আমার মনের মানুষ গো/ তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধলাম ঘর/ ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার নিশানা/ আমায় হেথা টানে নিরন্তর’ – ওই গীত আমাকে শোনানোর পরই আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম – সব থাক, সবাই সুখে থাক, সুখভাগ্য আমার নেই; আমাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে…।
সেদিনের বর্ষণ দেখে, আমার মনে হয়েছিল – এ-বর্ষণ কালবর্ষণ; সহসা, অন্তত দু-চারদিনে ছুট দেবে না; বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার এই তো সুযোগ… !
এককাপড়ে বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে, বাঁশিটি ছিল শুধু হাতে। এখনো, এই বিশ বছর পরও, শিবানিকে যখন মনে পড়ে – আমাকে শিবানির মনে পড়ে কিনা জানি না; হয়তো মনে পড়ে, নীরবে-নিভৃতে ফেলে চোখের জল; কিংবা এতদিন আমার মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে পরছে সাদা শাড়ি; তখন আমি বাঁশিতে সুর তুলি, পথে-পথে কেঁদে বেড়াই – ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি/ সুখের সে সার চোখের জলে রে…।’
তিন
আমি সাগর। সাগর কবিয়াল…।
সেদিন সারাদিন ঝুমবৃষ্টি, বিকেলের দিকে একটু ছুট দিয়েছে; আমি বাজারে কৃষ্ণদার ঘরে বসে আছি, শিবুদার জন্য অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি না-থামলে বাজারের বটতলায় বসতাম। বড়ো বন্যার বছর, বন্যার পানি নেমে গেলে বটচারাটি রোপণ করা হয়। গাছটি বেশ ঝোপাল। গাছটির পিতৃত্ব নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছে এখন। এই, এতদিন পর, গাছটি যখন জোয়ান হয়ে উঠেছে, তখন আরো কেউ-কেউ দাবি করছে; তারাই নাকি রোপণ করেছে চারাটি। সে যাই হোক, আমি বাজারে এলে বটতলায়ই বসি; বটতলায় বসেই গীত বাঁধি। এখনো পর্যন্ত যতগুলো গীত বেঁধেছি, আসরে পালøvয় নেমে যেগুলো বেঁধেছি, তা বাদে – বেশিরভাগ গীতই বেঁধেছি এই বটতলায় বসে। সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি, আগের দুদিনও সারাদিন বৃষ্টি ছিল, বটতলায় বসার জো নেই; কৃষ্ণদার ঘরে বসেছি। কৃষ্ণদা আমার পালøvর আসরে বেহালা বাজায়, এমনিতে দর্জির কাজ করে। বাজারে ঘরটি তার নিজের। সন্ধ্যায় বা রাতে, মাঝে-মধ্যে তার ঘরেও বসি। নতুন-বাঁধা গীতের সুর তুলি…।
নতুন গীত বেঁধেছি – ‘ও আমার মনের মানুষ গো…।’ শিবুদাকে শুনিয়েছি গীত। সব গীত বাঁধার পরই আগে তাকে শোনাই। সেদিন শিবুদার বাঁশিতে নতুন গীতের সুর তোলার কথা। বিকেলে বাজারে আসবে বলেছে। কিন্তু বিকেল শেষে সন্ধ্যা, তারপর রাত; শিবুদার দেখা নেই। আর বৃষ্টি নামেনি। তাহলে সে আসছে না কেন? বাড়িতে কোনো বিপদ হয়নি তো…?
ভেবেছিলাম, নতুন গীত-বাঁধাকে উপলক্ষ করে শিবুদাকে নিয়ে বানুটি খাব। দাদা গঞ্জিকাসেবন করে, কিন্তু মদ ছুঁয়েও দেখে না। নতুন গীত-বাঁধা উপলক্ষে আমি জোরাজুরি করলে তবেই খায় দু-চার চুমুক। কৃষ্ণদা মদ-গাঁজা কিছুই ছুঁয়ে দেখে না। রাত বাড়ছে। ঘনঘোর বৃষ্টির রাত। বাজারের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষ্ণদাকেও দোকান বন্ধ করতে হবে। সে একাই বেহালায় সুর তোলার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু বাঁশি ছাড়া সুর তোলা জমে না। কেন যে এলো না শিবুদা! বোতল খুলে ঢকঢক করে বানুটি খেতে শুরু করলাম। বোতল শেষ করেই উঠব। কৃষ্ণদাকে আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না। আমি বাড়িতে গেলেও যা, না-গেলেও তাই। কৃষ্ণদার জন্য তার বউ বসে আছে…।
আমি খালপাড় দিয়ে হাঁটছি। মুখ ভার করা আকাশ মাথার ওপর নেমে এসেছে। আলকাতরার মতো কালো অন্ধকার পথে। কিছুই চোখে দেখছি না। আন্দাজের ওপর হাঁটছি। শিবুদার খোঁজটা নিয়ে যাই। নতুন গীতের সুর উঠাবে, যেতে চেয়েও গেল না। হঠাৎ বাড়িতে কোনো বিপদ কিংবা কেউ অসুখ-বিসুখে পড়ল কিনা, তাই বা কে জানে… !
– ঠাকুরঝি…।
ঠাকুরঝি জেগেই ছিল। আমার ডাক শুনে একটু কেঁপে উঠল কি? তা কাঁপতে পারে। এখন তো তাকে আমার ডাক দেওয়ার কথা না…।
– সাগরদা তুমি একা? বংশীবাদক কই… ?
– শিবুদা তো আজ যায়নি বাজারে। তাই খোঁজ নিতে এলাম…।
– বলো কী সাগরদা? সে তো বাজারের কথা বলে বাঁশি হাতে সেই বিকেলে বেরিয়ে গেল…।
– তাই নাকি? অবাক কা-! আমি আর কৃষ্ণদা তো তার জন্যই এই এত রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। ভাবলাম বাড়িতে কোনো বিপদ…।
– না, বাড়িতে কোনো বিপদ হয়নি। বিপদ তো দেখছি তাকে নিয়েই। কী করব এখন সাগরদা… ?
– অপেক্ষা করো। কোনো জরুরি কাজে হয়তো দূরে কোথাও গেছে, হয়তো ওখানে বৃষ্টি আছে এখনো, তাই বেরোতে পারছে না। বৃষ্টি ছুট দিলেই এসে পড়বে…।
শিবুদা রাতে আসেনি। পরদিন সকালে না, সন্ধ্যায় না, রাতেও না – শিবুদা এলো না। তারপর একমাস, দুমাস – একবছর, দুবছর – না, শিবুদার কোনো খোঁজ নেই। দেশের আনাচে-কানাচে, আসাম-কুচবিহার-হাওড়া – ব্যর্থ সব খোঁজাখুঁজি। ঠাকুরঝি কত পুজো যে দিলো মন্দিরে-মন্দিরে – ভগবান চোখ মেলে তাকাল না। খোঁজ মিলল না শিবুদার। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে – এ যে কল্পনা করাও কঠিন। বিশটি বছর কেটে গেল…।
শিবুদার নিখোঁজ-কাহিনি কিছুদিন সরব আলোচনার বিষয়বস্ত্ত ছিল গ্রামে…।
– শিবু বোধহয় গুম-খুন হইছে কোথাও…।
– দূর, কী যে কও না? শিবু কি কারো সাতে-পাঁচে আছিল? গজা বেচতো আর বাঁশি বাজাইতো। সে গুম-খুন হবে কেন… ?
– ব্যবসায় ম্যালা ট্যাকা ঋণ হইতে পারে। ট্যাকার তাগাদায় পলাইছে…।
– হেন্দুগো তো ম্যালা দেবতা। কোনো দেবতার সঙ্গে দেওয়ানা হয়ে মথুরা-বিন্দাবন যাইতে পারে…।
– কামরূপ-কামাক্ষা জাদুর দেশেও তো যাইতে পারে…।
– ভগবান জানে…।
– আলস্নায় জানে…।
কেন জানি, আমার মনে কোনো প্রশ্ন জাগত না – শিবুদা কেন ঘর-সংসার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে? ঠাকুরঝির মতো প্রণয়িনী বউ, চার বছরের ছেলে, বউয়ের পেটে আরেকটি সন্তান – এইসব রেখে কেউ কি সংসার ত্যাগ করে? না করতে পারে? শিবুদা তো করেছে। তাহলে আমরা বাইরের যে সত্য ও সুখ দেখি – এর সব সত্য হয়তো সত্য না, সব সুখ সুখের না। সত্যের ভেতরে মিথ্যা, সুখের ভেতরে দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে থাকে। শিবুদার মনেও হয়তো এমন কষ্ট ছিল, যা আমরা দেখিনি; সেই কষ্টের পাথর-ভার সইতে না-পেরে সে গৃহত্যাগী হয়েছে…।
শিবুদার বাড়িতে আগে থেকেই আমার অবাধ যাতায়াত। এখন, ঠাকুরঝির এই বিপদের দিনে ওই বাড়িটিই যেন আমার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। আমি কবিয়াল মানুষ, গীত বাঁধি কিন্তু ঘর বাঁধিনি। সংসারকর্ম ভালো বুঝি না। তারপরও ঠাকুরঝির সংসারের অনেক কিছুই আমাকে দেখতে হয়। ঠাকুরঝির দুই ভাসুর, এক দেবর; তারা যার-যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শিবুদার নিখোঁজের পর তারা তিন ভাইয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। আর কত? যে-ভাই নিখোঁজ, সে তো গেছেই; তার জন্য তো নিজেদের সংসার ফেলে রাখা যায় না। ঠাকুরঝির দুই ভাসুর শিবুদার মতোই গজা বানায়, গজা বিক্রি করে। দেবরটা পানিয়া, হাটে-বাজারে পান বিক্রি করে…।
সেই ঘনঘোর বৃষ্টির দিনের মাসদুয়েক পর, এক সন্ধ্যায় সেদিনও ঝুমবৃষ্টি, সুবর্ণর জ্বর, আমি ওর জন্য ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলাম, ঠাকুরঝি ককাতে-ককাতে বলল – ‘সাগরদা, আজ রাতে তুমি এখানেই থেকে যাও…।’
ঠাকুরঝির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। বললাম, কেন, কী হয়েছে তোমার? রাতে তোমার ঘরে থাকলে রাত পোহানোর আগেই তো গাঁয়ে ঢিঢি পড়ে যাবে…।
আমার কথা শুনে ঠাকুরঝির কষ্ট যেন আরো বেড়ে গেল। কী হয়েছে ঠাকুরঝির? অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, ‘যা হবার হবে।
লোকে যা বলার বলবে, তুমি এখন যেও না। আমার ব্যথা উঠেছে। প্রচ- ব্যথা। রাতেই খালাস হবে। এই বৃষ্টির মধ্যে আমি একা মেয়েমানুষ কী করব? ও মাগো, মা…।’
সুবর্ণা। সে-রাতে ঠাকুরঝি কন্যাসন্তান প্রসব করে…।
সেই সুবর্ণার বয়স এখন ষোলো, বিয়ে হচ্ছে। হিন্দু ছেলেমেয়েদের বিয়েতে কত কী যে লাগে, কত যে আচার-অনুষ্ঠান – কোনোকিছুই আমার ভালো করে জানা নেই। তারপরও প্রকৃত কন্যাদাতার মতো আমি সবকিছু গোছানোর চেষ্টা করছি। সুবর্ণও খাটছে যথেষ্ট। ছোট বোনের বিয়ে, বাবা নেই; কোথাও যেন কোনো ত্রম্নটি-বিচ্যুতি না-ঘটে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি আছে ওর।… আর ঠাকুরঝি? একমাত্র মেয়ের বিয়ে – আমরা তার হাসিখুশি মুখ দেখছি, কিন্তু আমরা তো জানি – বাইরে যেসব সত্য আমরা দেখি, সব সত্যই সত্য না; ঠাকুরঝি আসলে সবসময়ই কাঁদছে, কিন্তু সত্যটা এই – তার চোখের জল আমাদের চোখে পড়ে না…।
বিয়ের আর দিনসাতেক বাকি। পঁচিশে আশ্বিন লগ্ন; আমাদের গোছগাছও শেষের দিকে, তখনই ঘটল ঘটনাটি…।
দুবছর ধরে গাঁয়ের এক ছোকরা-ছেলে, মতি, কবিয়াল সেজেছে। আমার সঙ্গে আসরে পালøvও করেছে দুবার। চোখের জলে, নাকের জলে কেঁদেছে। কাঁদবে না? কিছু খিসিত্মখেউড় ছাড়া আর তো কিছু জানে না। ওই ছোকরা গীত বেঁধেছে, আমাকে আর ঠাকুরঝিকে নিয়ে; ছিঃ ছিঃ, এমন ধারা গীতও কোনো কবিয়াল বাঁধতে পারে – ‘ওলো শিবানি তুই পটের রানী দেখে যা আসিয়া/ সাগর কবিয়াল মরছে যে তোর প্রেমে ফাঁসিয়া…।’
আমার গুরু মধুপুরের রমেশ কবিয়াল। গুরু বলতেন, ‘সাগর, কাউকে ছোট করার জন্য, কারো মনে কষ্ট দেওয়ার জন্য কোনোদিন গীত বাঁধবে না। গীত মনের আনন্দ-প্রস্রবণ। কিন্তু নিজের আনন্দের জন্য অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার তোমার নেই…।’ সেই গুরুবাক্যকে বেদবাক্য মনে করে অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলছি। আর মতি, দুদিনের ছোকরা-ছেলে; কে-যে তার গুরু, জানি না; আসরে পালøvয় হেরে এমন ধারা নোংরা গীত বাঁধল? এখন এই নোংরা গীতের কারণে সুবর্ণার বিয়ে না ভেঙে যায়…?
শিবুদা বাড়িতে থাকতে, ওই বাড়িতে আমার সকাল-সন্ধ্যা ছিল না। আমি গীত বাঁধি, শিবুদা বাঁশিতে সুর তোলে, ঠাকুরঝি চা করে খাওয়ায়; এই তো ছিল অনুষঙ্গ। তারপর, শিবুদা নিরুদ্দেশ; এখন ঠাকুরঝি বাঁশিতে সুর তোলে, আসরে দোহারি করে – কই, এই এতদিনে আমরা তো কখনো বিপজ্জনক নৈকট্যে যাইনি। না কথাবার্তায়, না আচার-আচরণে। আমরা পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে গেলে, সুবর্ণ আর সুবর্ণা, ওরা এখন বড়ো হয়েছে; আর কেউ কিছু বুঝুক বা না-বুঝুক – ওরা বুঝত। আমি নিশ্চিত, আমাদের পা পিছলে গেলে, আমরা ওদের হাতে একদিন না একদিন ধরা পড়ে যেতাম…।
তবে, একটা কথা বলি, মতি কবিয়ালের গীত শুনে; এই, এতদিন পর আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে – আমি কি ঠাকুরঝিকে ভালোবাসি না? ঠাকুরঝি কি আমাকে ভালোবাসে না? আমি যদি ঠাকুরঝিকে ভালো না বাসতাম তবে কেন তাকে নিয়ে গীত বাঁধলাম – ‘কালো কেশে রাঙা কুসুম…।’ আমি তো ঠাকুরঝির খোঁপার চূড়ায় জবাফুলের মতো রাঙা কুসুমই ফুটতে দেখি। ঠাকুরঝি যদি আমাকে না-ই ভালোবাসে, তবে কেন আমার বাঁধা গীত – ‘তোমার চরণে আমারই পরাণে লাগিল প্রেমের ফাঁসি/ জাতিকুলমান সব বিসর্জিয়া নিশ্চয় হইনু দাসী…’ সবসময়ই গুনগুন করে…।
আমরা একই গাঁয়ের বাসিন্দা। আমাদের গ্রামটিকে উত্তরে-দক্ষিণে দুভাগ করে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে খাল। বর্ষায় খালটি প্রচ- খরস্রোতা হয়ে উঠলেও শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। যাহোক, খালের উত্তরপাড়ে হিন্দুপাড়া – পালবাড়ি, ময়রাবাড়ি, শীলবাড়ি, বেহারাবাড়ি…। দুর্গাপূজায় পালবাড়িতে কবিগানের আসর বসে। আমি কৈশোরকাল থেকেই অনুভব করি, আমার করোটিতে গীত আছে, কখনো-কখনো বেরিয়ে আসে; আমি ধরতে পারি, বাঁধতে পারি। তো পূজায় কবিগানের আসর বসলে আমার আর নাওয়া-খাওয়া থাকে না। দিনরাত আসরেই পড়ে থাকি। বড়ো-বড়ো কবিয়াল আসেন, তবে মধুপুরের রমেশ কবিয়ালের গীত শুনলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ইস! আমি যদি এরকম গীত বাঁধতে পারতাম! তার মতো করে আসরে গাইতে পারতাম! সুযোগ পেলেই আমি রমেশ কবিয়ালের কাছাকাছি ঘুরঘুর করি। একদিন তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘তুমি কোন বাড়ির ছেলে বটে? দেখতে তো ভারি চমৎকার! ঠিক যেন শিবঠাকুর…।’
কাছেই ছিলেন গগন পাল। আমাদের বাড়িতে তাকে দেখেছি। মাকে হাঁড়ি-পাতিল দিয়েছে। আমাকেও বোধকরি চিনেছেন পাল মশাই। বললেন, ‘ও তো মুসলমানপাড়ার, জহুকাকার ছোট ছেলে…।’
‘- কী করো বাবা? লেখাপড়া? চাষবাস…?’
আমার মুখ থেকে কথা ফুটছে না। কী বলব? আমি আসলে কী করি? লেখাপড়া কিংবা চাষবাস কোনোটাই তো করি না। স্কুলে গেছি কদিন, হাইস্কুলেও উঠেছিলাম – এখন আর স্কুলে যাই না। ক্ষেত-খামারের কাজেও যেতে শুরু করিনি। আপাতত বন-বাদাড়ে, নদীর টোকে-টোকে ঘুরে বেড়াই আর গুনগুন করি – ‘সেই মেলাতে কবে যাবো…।’
‘ – বলো বাবা – ভয় কীসের…?’
তখন আমার ওপর কোন জোনার ভর করেছিল জানি না – মুখ ফুটে বলে ফেললাম – ‘আমি আপনার মতো গীত বাঁধতে পারি…।’
‘ – বলো কী?’ কবিয়াল রমেশ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘নিজের বাঁধা একটা গীত গাও তো দেখি বাবা…।’
আমি ওঁকে মনে-মনে গুরু মেনে, ওঁর পা ছুঁয়ে গীত ধরলাম – ‘সেই মেলাতে কবে যাবো/ ঠিকানা কি হায়রে/ যে-মেলাতে গান থামে না/ রাতের আঁধার নাইরে…।’
কবিয়াল আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারায় কাঁদতে লাগলেন…।
তারপর তিন বছর ছিলাম গুরুগৃহে। গুরুর পদসেবা করেছি আর গীত বেঁধেছি। ফিরে এসে, পরের দুর্গাপূজায় পালবাড়ির আসরে নাটোরের নীতেশ কবিয়ালের সঙ্গে দ্বৈরথে নামলাম। কৃষ্ণদা-শিবুদাকে দোহার পেয়েছি। ওরা আগে থেকেই মনের সুখে বেহালা-বাঁশি বাজাত। এখন আমার সঙ্গে দোহারে নেমেছে। নীতেশ কবিয়াল বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো, গুণী কবিয়াল। আসর শুরুর অনুমতি দিলেন আমাকে। আমি মনে-মনে গুরু রমেশ কবিয়ালের চরণে প্রণতি জানিয়ে – ‘সেই মেলাতে কবে যাবো…।’ দিয়ে শুরু করে যেই দ্বিতীয় গীতটি – ‘ব্রজ-গোকুলের কুলে কালো কালিন্দীরই জলে/ হেলেদুলে ওরে সোনার কমলা/ কালো হাতে ছুঁয়ো নাকো, লাগিবে কালি – / ওহে কুটিল কালা…।’ – ধরেছি, তখনই চোখে পড়ল – একটি কালো-কিশোরী, কচি কলাগাছের মতো সুডৌল শরীর; আসরের সামনের দিকে যারা বসেছে, তাদের পেছনে আরো কজন মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গান শুনছে; ওর কালো চোখ অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে; চোখ দিয়েই যেন আমাকে গিলে খাবে। এই প্রথম একাকী আসরে নেমেছি, কেবল ধরেছি গীত, এই সময়, এই কালো-কিশোরীর আগুনের গোলার মতো চোখের সামনে পড়ে আমি কেমন ভীত-বিহবল হয়ে পড়েছি তখন – যদি গীতের তাল কেটে যায়…!
তিন বছর গাঁয়ে ছিলাম না। তার আগে মেয়েটিকে দেখেছি হয়তো; কিন্তু ওই রাতে মেয়েটিকে চিনতে পারিনি। তিন বছরে মেয়েরা অনেক বড়ো হয়ে ওঠে। হঠাৎ দেখলে অচেনা ঠেকে। কিন্তু ওই কিশোরীর কচি কলাগাছের মতো শরীর, জামের মতো কালো বড়ো-বড়ো চোখ ভুলতে পারছি না। মেয়েটি কে… ?
বিকেলে শিবুদার কাছে খোঁজ মিলল – মেয়েটি ময়রাবাড়ির
সুনীল ময়রার মেয়ে শিবানি…।
তখন আমি একটি কাজ জুটিয়ে নিলাম, গজা খেতে পছন্দ করি না; খাইও না, তবু প্রতিদিনই সুনীল ময়রার বাড়িতে গজা কিনতে যাই যদি মেয়েটির দেখা মেলে… !
না, দেখা মেলে, ঠিক তা বলা যাবে না। তবে দেখি, দূর থেকে দেখি। একটি লালঝুঁটি মোরগের সঙ্গে মেয়েটির খুব খাতির। মোরগটি, যখনই ওই বাড়িতে যাই; সকালে কিংবা দুপুরে, দেখি – মোরগটি ওর পেছনে-পেছনে হাঁটছে। ও কিছুক্ষণ পরপর খুদ ছিটিয়ে দিচ্ছে মোরগটির মুখের সামনে। একদিন দেখি মোরগটি ওর কাঁধে বসে আছে, কাঁধে বসেই ডাকছে – কুক্কুরে কুক… কুক। তো, কালো-কিশোরী কদাচিৎ আমার দিকে তাকায়, হয়তো মনে-মনে বলে – এই কবিয়াল কত গজা খেতে পারে! প্রতিদিনই গজা কিনতে আসে? নাকি অন্য কিছু ভাবে? মনে-মনে যা ভাবে ভাবুক, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। অন্তত একবার, দূর থেকে হলেও; আমার দিকে তাকালেই হয়। আমি তো ওর চোখ দুটো দেখতেই আসি…।
কদিন পর যে-খবর পেলাম, শিবুদার কাছেই; আমার বুকে যেন অর্জুনের তির এসে লাগল, বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল বিষমাখা তির – কালো-কিশোরীর বিয়ে, বর আমাদের শিবুদা। দাদা নিজেই বলল, মেয়েটির সঙ্গে নাকি তার আগে থেকেই প্রণয় আছে…।
তাই নাকি! তাহলে তো সেদিন পালবাড়ির আসরে কালো-কিশোরী আমার মুখের দিকে নয়, তাকিয়ে ছিল শিবুদার মুখের দিকে। মনের মানুষ বলে কথা… !
যাহোক, আমি কিন্তু একটি অপার সুবিধা পেলাম। শিবুদা আমার গীতের দোহারি করে। ওই বাড়িতে আমার যখন-তখন যাতায়াতে কোনো বাধা নেই। কিশোরী এখন যুবতী হয়ে উঠেছে। তো, এই যুবতী বোঝে কি বোঝে না, জানি না; সুযোগ পেলেই আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। একদিন দেখি, শিবুদার বউ, শিবানিও তাকায় আমার চোখের দিকে। তারপর থেকে আমি শিবানিকে ঠাকুরঝি ডাকা শুরু করি…।
ঠাকুরঝিকে আমি কোনোদিন বলিনি, ঠাকুরঝি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। ইশারা-ইঙ্গিতেও না। ওই, তার চোখের দিকে, প্রেমাকুল হরিণের মতো তাকানো পর্যন্তই আমার ভালোবাসার বিসত্মৃতি। শিবুদাকে আড়াল করে আমার চুরি করে ঠাকুরঝির চোখ দেখা – এই চোখ দেখার অর্থ ঠাকুরঝি কী বুঝত, কী মনে করত, তা সে-ই জানে…।
একটা সময় এসে গেল, যখন, আমি আর পারছি না। মনে হতো এই বুঝি কোনো পাপ করে ফেলব। আবার মনে হতো প্রেম-ভালোবাসায় কোনো পাপ নেই। ঠাকুরঝিও নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসে। নাহলে শিবুদার বউকে আমি বউদি না-ডেকে ঠাকুরঝি ডাকছি, সে আমাকে ভালো না বাসলে আমার ‘ঠাকুরঝি’ ডাকে সাড়া দেবে কেন…?
তারপরও যখন কোনো পথ খোলা নেই; আমি ঠাকুরঝিকে নিয়ে গীত বাঁধা শুরু করলাম। শিবুদা কি আমার বাঁধা গীতের মর্মকথা বুঝে ফেলেছিল – ঠাকুরঝিকে ভালোবেসেই আমি গীত বেঁধেছি। ঠাকুরঝিও আমাকে ভালোবাসে…।
আমি জানতাম না বিয়ের পর, ফিরানিতে এসেই সুবর্ণা ঠাকুরঝিকে জিজ্ঞেস করেছিল – ‘মা, সাগরকাকার সঙ্গে তোমার আসলে কী সম্পর্ক…?’ হয়তো শ্বশুরবাড়িতে সে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল কিংবা কোনো কানাঘুষা শুনেছিল – তাই সোজা প্রশ্নটা করেছিল মাকে। ঠাকুরঝি এই পাঁচ বছরে কোনোদিন কথাটি আমাকে বলেনি। সেদিন সুবর্ণার ছোট মেয়ের অন্নপ্রাশন, অতিথি বিদায় করে সবকিছু গোছগাছ করতে-করতে রাত এগারোটার মতো বেজে গেছে। সুবর্ণ-সুবর্ণা যার-যার ঘরে। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি, ঠাকুরঝির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে যাব। ঠাকুরঝি গেল কই? আকাশে সিকি চাঁদের নতুন কনের মতো ঘোমটা দেওয়া আলো। উঠোনে আবছা-আবছা অন্ধকার। ঠাকুরঝি কোত্থেকে হঠাৎ এসে আমার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল – ‘আমি আর পারছি না সাগরদা, আমাকে একটা পথ দেখাও…।’
হঠাৎ কান্নাকাটি কেন – কী হয়েছে আবার নতুন করে, ঠাকুরঝি যা সহ্য করতে পারছে না – এখন তো সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক, ঠাকুরঝি সব মেনে নিয়েছে; আমি কিছুই বুঝতে না-পেরে ঠাকুরঝির মুখের দিকে ভ্যাবলাকান্তর মতো তাকাতেই সে বলল – ‘সুবর্ণার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সন্দেহ করে তোমার সঙ্গে আমার গোপন কোনো সম্পর্ক আছে। মতি কবিয়ালের গানটা হয়তো তারা শুনেছিল। তোমার চোখে পড়েনি – সুবর্ণার বড়ো মেয়ের অন্নপ্রাশনেও তারা ছিল না, আজো ও-বাড়ির কেউ আসেনি…।’
এবার ঠাকুরঝির হাত ধরলাম, এই প্রথম; বললাম, ‘ঠাকুরঝি, আমাদের সম্পর্ক – সে তো প্রকাশ্যই, গোপন কিছু তো নেই…।’
ঠাকুরঝি কাঁদছিল। কাঁদতে-কাঁদতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে-ঠোঁট রাখল। আমিও ঠাকুরঝিকে সাপের মতো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলাম…।
পরদিন সকালে, ঘুম ভাঙতেই কানে এলো – বাড়ির পেছনে শেওড়াগাছে ঝুলছে ঠাকুরঝি…।
পাদটীকা
আমরা, ২০ বছরের কম বয়সী ছেলেরা, ময়রাবাড়ির বংশীবাদক শিবরামকে কোনোদিন দেখিনি। শুনেছি সে নিরুদ্দেশ। শিবরাম কোথাও বেঁচে আছে কী মরে গেছে তাও কারো জানা নেই। সেদিন ওর বউ, শিবানি বউদি আত্মহত্যা করল। কেউ, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যা করে – কে জানে! শিবানি বউদি কেন আত্মহত্যা করল আমাদের বোধে আসে না। শিবরামদার বাঁশি শুনিনি, বউদির বাঁশি তো শুনেছি; কী যে মন-আকুল-করা সুর! শিবানি বউদির বাঁশির সুর আর কোনোদিনই শুনতে পাব না – এই কষ্ট বুকে পুষে যখনই বাজারে যাই, দেখি – সাগর কবিয়াল বটতলায় বসে চোখ বুজে গান ধরেছে – ‘ভালোবেসে মিটলো না সাধ/ কুলালো না এ-জীবনে।/ হায় – জীবন এতো ছোট কেনে/ এ ভুবনে…?’
কবিয়ালের চোখে জলপস্নাবন, কেউ তা দেখে না…!
[ঋণস্বীকার : গল্পে ব্যবহৃত গানগুলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাস থেকে নেওয়া।]