অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে মিলন বুঝল অহেতুক দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। পনেরো মিনিটের মতো হয়ে গেছে। বাসের দেখা নেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু দূরে ট্রামের লাইন। এক নম্বর ট্রামটা যেখানে এসে থামে বাসস্ট্যান্ডটা তার খুব কাছেই। রাস্তার ওপর দিয়ে ট্রামলাইন। কাইয়াতসো থেকে মিলনকে বাসার কাছে গিয়ে নামতে হলে তাকে বাস অথবা ট্রামে যেতে হয়। হেঁটে গেলে মিনিট পনেরোর রাস্তা। বাস-ট্রামে গেলে আর কতক্ষণ? মিলন যখন কাজে যায় তখন সে খুব একটা হাঁটে না। কাজ থেকে বের হয়েও মিলন বাস-ট্রাম কিংবা মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করে। হাঁটে না। কারণ মাস পয়লা তাকে মাসিক যাতায়াত কার্ডে গুনে-গুনে ত্রিশ ইউরো ভরতে হয়। অনেকটা ব্যাংক কার্ডের মতো দেখতে। বাস বা ট্রামে টিকেটিং মেশিন থাকে, যেখানে টিকিট পাঞ্চ করতে হয়। মেশিনটা দেখতে ছোটখাটো টিফিন বক্সের মতো। হলুদ রঙের। মেশিনের ওপর একটা
লম্বা চিকন ফাঁকা জায়গা থাকে, যেখানে টিকিট পাঞ্চ করতে হয়। পাঞ্চ হয়ে যাওয়া টিকেট দিয়ে পরবর্তী পঁচাত্তর মিনিট যাত্রীবাস-ট্রামে মিলানের যে-কোনো প্রামেত্ম ঘুরে বেড়াতে পারবে। সময় শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন করে টিকিট কাটো। ইতালিতে ঢুকে অন্য বাঙালিরা সাধারণত যা করে প্রথম-প্রথম মিলনও তাই করত। একসঙ্গে দু-তিনটা টিকিট কিনে শার্টের পকেটে রেখে দিত। বাস বা ট্রামে উঠলে আইকার মতো টিকিট পাঞ্চ করার ছোট মেশিনটার আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকত। বাস, ট্রামের হাতলে ধরে মিলনকে সামনের স্টপেজের দিকে শকুনের মতো তাকিয়ে থাকতে হতো। টিকিট-চেকাররা পালা করে একেকদিন একেক স্টপেজে দলবেঁধে কাঁধে চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাস-ট্রাম স্টপেজে এসে থামলে টিকিট-চেকাররা ত্বরিতগতিতে সবগুলো দরোজা আগলে রেখে নিপাট ভদ্রলোকের মতো যাত্রীদের বিনীতভাবে সালুতে (শুভেচ্ছা) জানিয়ে বলে, সিনোরে, সিনোরিনা পেরফাভোরে, দাই তুও বিলিয়েত্তো (জনাব, জনাবা দয়া করে তোমার টিকিটটা কি আমাদের দেখাবে)? দূর থেকে শকুনদৃষ্টিতে টিকিট-চেকারদের দেখামাত্র মিলন ভদ্রলোকের মতো টিকিট-মেশিনে ঢুকিয়ে টিকিট পাঞ্চ করে দিত। টিকিট-চেকার দেখে মিলনের অমন তড়িঘড়ি করে টিকিট পাঞ্চ করা দেখে ইতালিয়ানরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে মুখ টিপে পরিহাসের হাসি হাসত। ব্যাপারটা কয়েকবার খেয়াল করে মিলনের কাছে খুব অপমানজনক মনে হয়েছিল। তারপর সে যাতায়াতের
জন্য মাসিক কার্ড বানিয়ে নিয়েছে। চেকারদের সঙ্গে এরকম চোর-পুলিশ খেলা তার পছন্দ নয়। মানিব্যাগের টাকা-পয়সার সঙ্গে ভেতরে সেই কার্ডটাও থাকে। বাস-ট্রাম-মেট্রোতে উঠে মেশিনের সামনে হাতে মানিব্যাগ নিয়ে ছুঁয়ে দিলেই মেশিন শব্দ করে জানান দেয়। মিলনকে যাতায়াতের এই মাসিক কার্ড করার জন্য পরিবহন যোগাযোগ অফিসে গিয়ে কড়কড়ে চলিস্নশ ইউরো গুনে-গুনে দিতে হয়েছিল। সঙ্গে নিজের স্ট্যাম্প সাইজ ছবিও। চলিস্নশ ইউরো খরচ করে মিলনের এই রাজসিক হাবভাব দেখে ওর রুমের কুইচ্চামারা-আবুল বলেছিল,
মিয়াভাই হুদা কামে এতগুলি টাহা জলে ঢাললেন।
বাস-ট্রামে উইঠা চোরেগো মতো ড্রাইভারের পেছনে খাড়ায়া থাকন আমার ভালো লাগে না।
হেইলস্নাইগা আপনে চলিস্নশ ইউরো দিয়া কার্ড বানাইবেন! চলিস্নশ ইউরোতে বাংলা টাহায় কত হয় জানেন? বলে আবুল ইউরোর সঙ্গে বাংলা টাকার গুণ করতে শুরু করল। তারপর বলল, পেরায় চাইর হাজার টাহা! ও মোর খোদা!
কুইচ্চামারার লোকজন টাকাকে টাকা বলতে পারে না। বলে টাহা। আর কথায়-কথায় বলে, ‘ও মোর খোদা’ – এসব ওদের মুদ্রাদোষ।
আবুলের বিস্ময়ভরা কৌতূহলে মিলন কোনো কথা বলল না। তবে ভেতরে-ভেতরে নিঃশব্দে বলল,
আরে পা ফাটার দল, তরা প্যাক-কাদা থিকা উইঠা আইছস। ঢাকা শহর না দেইখা রাশিয়া দিয়া টারজান ভিসায় ইতালি আইছস। কথাগুলো মিলনের ভেতরেই রইল। শোনা গেল না।
বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে মিলনের মেজাজ নববই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে খারাপ হয়ে গেল। মিলান সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে কাইয়াতসো। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো আমলের পাথরের বাড়িঘর। তিনতলা-চারতলা। প্রত্যেক বাড়ির সামনে কমন ঝুলবারান্দা। প্রশস্ত জানালা। জানালায় ফুলের টব। রঙিন বাহারি ফুলে দূর থেকে জানালাকে এক চিলতে ঝুলন্ত বাগান বলে ভ্রম হয়। বাড়িঘরের নিচে দোকানপাট। বার। আলিমেন্টারি। গ্রোসারি শপ। টেলিফোন-ইন্টারনেট শপ। ইন্ডিয়ান পাথরের গহনার দোকান। রেসেত্মারাঁ চিনেজি। বিদেশিদের কোলাহল। ব্যস্ত রাস্তায় রোমানিয়া-আলবেনিয়া-ইউক্রেনের জিঙ্গারির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিঙ্গারি মানে হলো ভবঘুরে। বাস্ত্তহারা। স্টেশন, মেট্রোর নিচে, রেললাইনের ধারে, পার্কে, পরিত্যক্ত বাড়ি, খোলা জায়গায় এরা নিজেদের মতো কাঠ, পলিথিন, তেরপল দিয়ে অস্থায়ী ঘরবাড়ি তৈরি করে কোনোরকমে থাকে। পতিতাবৃত্তি, মাদক বিক্রি আর ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে এরা নিজেদের জড়িয়ে রাখে।
মিলন জিঙ্গারিদের এড়িয়ে-এড়িয়ে চলে। পথচলতি মানুষকে নানা বিড়ম্বনায় ফেলতে ওস্তাদ এরা। তবে অল্পবয়সী জিঙ্গারি মেয়েগুলোকে দেখলে ওর ভালোই লাগে।
হঠাৎ ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে কোত্থেকে ময়লা পোশাকের এক মানুষ এসে উপস্থিত। বেশ লম্বা-চওড়া। সে করল কি, প্যান্টের চেইন খুলে জননতন্ত্র বের করে উঁচিয়ে ধরল। তারপর তীব্র বাজে ভাষায় বিদেশি অভিবাসীদের চৌদ্দোগোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগাল শুরু করে দিলো, বাস্তারদো তুত্তো স্ত্রেইনারি। বাই ভিয়া তুত্তো (বিদেশিরা সব জারজের দল। তোরা সব তোদের দেশে ভাগ) বলে মানুষটা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। দেখতে-দেখতে ব্যস্ত রাস্তার গাড়ি, হোন্ডা সব থেমে গেল।
অনাকাঙিক্ষত এ-ঘটনায় বাড়িঘরের জানালা, বারান্দা দিয়ে উৎসুক মানুষজন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে যা হওয়ার তা-ই হবে। একটু পর রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। গ্যাঞ্জাম হবে। এ-ধরনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে-সঙ্গে আশপাশের বাড়িঘরের লোকজন নিজ দায়িত্বে পুলিশকে খবর দিয়ে দেয়। খবর পেয়ে দ্রুত বিকট আওয়াজ তুলে গাড়ির বহর নিয়ে চলে আসে ক্যারাবিনিয়েরি। বাঙালিদের কাছে ক্যারা মামু।
মিলন ঘটনা দেখে বুঝে ফেলে বাড়ি যেতে তার আরো দেরি হবে। মেজাজটা আরো একপ্রস্থ খারাপ হয়ে গেল তার। পকেট থেকে মার্লবোরো রোসসো বের করে ধরাল। রোসসো মানে লাল। ইতালিতে মার্লবোরো রোসসো খায় ছেলেরা। আর মেয়েরা খায় মার্লবোরো বিয়ানকো। বিয়ানকো মানে সাদা। মোবাইল বের করে সময় দেখল মিলন। বেলা এগারোটা বিশ। রাস্তা থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল মিলন। মিলনের সারাশরীর ভারী হয়ে আছে। পা আর চলতে চাইছে না। মাথা ঘুরছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে একটানা ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত নাইট ক্লাবে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কাজ করেছে। এই বারে মিলনের কাজ হলো বারিস্তার (যে মদ বানায়) পেছনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করা। ককটেল বানানোর সময় বারিস্তার কখন কোন বোতল লাগে দ্রুত তার জোগান দেওয়া। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে মালপত্র এনে শোকেস ভর্তি করে রাখা। কখনো-কখনো বরফ শেষ হয়ে গেলে মেশিন থেকে বালতি ভরে-ভরে ছোট-ছোট চৌকোনা বরফের টুকরো আনা। কাজ শেষে আধাঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে হেঁটে সকালের প্রথম মেট্রো ধরে পত্রিকা বিলি করার কাজ সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। এই কাজটা তাকে করতে হয় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে। পত্রিকা বিলি করার পর বাস-ট্রামের জন্য আবারও দাঁড়িয়ে থাকা। আজো সে দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মিলন অধৈর্য হয়ে পড়ে। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে মিলনের মনে হয়, ও বুঝি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে একসময় ঘোড়াই না হয়ে যায়!
রাস্তা থেকে ফুটপাতে নেমে মিলন ক্লান্ত ঘোড়ার মতো ধীরপায়ে হাঁটতে থাকে। হেলেদুলে কাইয়াতসোকে পেছনে ফেলে মিলন ভিয়া বেনিনির দিকে এগোতে থাকে। সোয়া এগারোটার সকালবেলাকে মিলনের কাছে মনে হয় যেন মধ্যদুপুর! ছোট-ছোট চারকোনা পাথর দিয়ে বানানো রাস্তা। হাঁটতে-হাঁটতে রাস্তার দিকে ভালো করে তাকালে মনে হবে যেন মাটি ফুঁড়ে পাথরের টুকরোগুলো মানুষের মতো দাঁত বের করে হাসছে। মিলনের মাথা ঝিমঝিম করছে। পেটের ভেতরটা গুলিয়ে আসছে। একটানা ষোলো-সতেরো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কাজ করার ধকলটা মানিয়ে নেওয়া কঠিন। মিলন দ্রুত পা চালায়। ঘরে ঢুকে জম্পেস একটা গোসল দিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টার একটা ঘুম দিতে হবে তাকে। ঘুম থেকে উঠে নাকে-মুখে দুটো ভাত খেয়ে আবার তাকে ছুটতে হবে কাজে। সারারাত কাজ। তারপর ভোর সাড়ে চারটার দিকে আধাঘণ্টা নামকাওয়াসেত্ম বারের ছড়ানো-ছিটানো টেবিল-চেয়ারে শুয়ে-বসে বিশ্রামের নামে কোনোরকম মুরগির রানীক্ষেত স্টাইলে ঝিম মেরে থাকা। পত্রিকা বিলির কাজ শেষ করে বাড়ি।
সন্ধের আগে-আগে ঘর থেকে বেরিয়ে মিলন প্রথমে বাড়ির সামনে তাবাক্কি থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কেনে, কড়া করে এক কাপ কাফে খায়। দোকান থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ভিয়া ক্রেসপির সরু রাস্তা ধরে হেঁটে-হেঁটে চলে আসে ট্রাম স্টপেজে। এতটুকু পথ পেরিয়ে আসতে অনেক বাঙালির সঙ্গে তার দেখা হয়। ইচ্ছে করেই সে কারো সঙ্গে কথা বলে না। মিলনকে কেউ কিছু বললে সে শুধু মুখে হালকা একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে। কী হয়েছে, আজকাল মানুষের সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কী কথা বলবে? ঘুরেফিরে এর বদনাম ওর কাছে। ওর বদনাম এর কাছে। কাঁহাতক এসব ভালো লাগে? তাই মিলন আজকাল খুব সযতনে এখানকার বাঙালিদের এড়িয়ে চলে। এদেরকে যত এড়িয়ে চলা যায় নিজের জন্য তত ভালো। এড়িয়ে চললেও মিলন কিন্তু মুখে পস্নাস্টিক ফুলের মতো একটা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখে। বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হলে কথা বলার চেয়ে মুখের কোনায় ঝুলিয়ে রাখা মোনালিসা মার্কা হাসিটি সমানভাবে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেয়।
মিলনের এই হাসি নিয়ে পেছনে অনেকে কথা বলাবলি করে। তাতে মিলনের কিচ্ছু যায়-আসে না। ইতালিয়ানরা আলতু-ফালতু বা অপ্রয়োজনীয় কথা শুনলে হাত-মুখ নেড়ে যেমন বলে, কী কাছছু ম্যায়নে ফ্রেগা (তার কথা শুনে আমার কী বয় আকার বা ল হবে)।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশের বেশ কয়েকটা গাড়ি পুরো এলাকা ঘিরে ফেলল। পাগলমতো লোকটা এর মধ্যে ইট দিয়ে দুটো গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলেছে। ইট হাতে নিয়ে আরো গাড়ির কাচ ভাঙবে বলে হুংকার দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করছে। গাড়ি-বাস-ভেসপা সব থেমে আছে। বিদেশি অভিবাসীদের চোদ্দোগোষ্ঠী উদ্ধার করে পাগলের অশস্নীল গালাগাল চলছে। মিলনের কান অবধি এসে কথাগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছে। অভিবাসীদের যন্ত্রণায় ইউরোপের মানুষরা আজ যারপরনাই বিরক্ত। বেকার সমস্যা বাড়ছে। পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অভিবাসী জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত হারে। মিলান, রোম, বোলোনিয়া, মানতোভা, ভিচেনসা, মোদেনা, পাদোভা, কোমো, লোদি, বেরগামো, ফৌজ্জাসহ ইতালির যে-কোনো শহরে-উপশহরের রাস্তাঘাটে বের হলে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ান গাভির মতো মোটা-তাগড়া অ্যারাবিয়ান আর আফ্রিকান মহিলারা স্বামী নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের পেটে বাচ্চা, বুকে বাচ্চা, হাতে বাচ্চা, কোমরে বাচ্চা, পেছনে বাচ্চা। সামনে বাচ্চা। খালি বাচ্চা আর বাচ্চা। এসব মহিলা যেন একেকটা জলজ্যান্ত বাচ্চার গাছ, রাস্তাজুড়ে যেন তরতাজা বাচ্চাদের মিছিল। মিলনের সঙ্গে নাইট ক্লাবে কাজ করে গ্রেসিয়া। সিসিলির মেয়ে। গ্রেসিয়া ক্যাশ মেইনটেইন করে। মালিকের খুব কাছের লোক। রাস্তাঘাটে বিদেশিদের গ-ায়-গ-ায় বাচ্চাকাচ্চা আর বিশালদেহী মহিলাদের দেখে গ্রেসিয়া মিলনের কাছে উৎসুক হয়ে জানতে চায়, মিলন, অ্যারাবিয়ান মহিলাদের কি সঙ্গম ছাড়াই বাচ্চাকাচ্চা হয়! এরা সারাদিন কাজ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে রাতেরবেলা কীভাবে সময় পায় ওই কাজ করার!
গ্রেসিয়ার কথায় মিলন হাসতে-হাসতে ওর সঙ্গে রসিকতা করে,
তুমি যদি আমার ঘরের বউ হইতা তাইলে তো আমি প্র্যাকটিক্যালি জিনিসটা কইরা দেখাইতে পারতাম। অহন আমি তোমারে কেমনে বুঝাই বলে মিলন গ্রেসিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গ্রেসিয়াও কম যায় না। ওর বাবা তুর্কি। গ্রেসিয়া হেসে বলল,
মিলান তুই ওই কাজ অ্যারাবিয়ানদের মতো এত বেশি করতে পারবি না। মাথা ঘুইরা পইরা যাইবি। কারণ তুই হইলি ইন্ডিয়ান। ওই কাজে আরবদের ওপরে কেউ নাই বলে গ্রেসিয়া কিছুটা ক্ষোভ ঝেড়ে অন্য ইউরোপিয়ানরা যেরকম করে বলে সেরকম করে বলল, অ্যারাবিয়ানরা যখন নিজের দেশে থাকে তখন প্রোডাকশনে যায় না। আমাদের দেশে এলে ওরা ওদের শিশ্নের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। নয় মাস ঘুরতে না ঘুরতে ওরা পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করে! ওদের জন্যই আজ আমাদের এ-অবস্থা। আমরা বেকার। আমাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। কাজের জন্য আমাদের জার্মান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ছুটতে হয়।
কোয়েসেত্মা ননে জুসতো (এটা খুব অন্যায়) বলে গ্রেসিয়া পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করে, মিলান তু ছেই মুলতো জেনটিলে। মি পিয়াসে কুজি… (মিলন তুই খুব ভালো ছেলে। তোর মতো ছেলে আমি পছন্দ করি)। গ্রেসিয়ার চেহারার মধ্যে তখন পাহাড়, অরণ্য আর সমুদ্রঘেরা সিসিলিয়ান নির্মল সৌন্দর্য খেলা করে। গ্রেসিয়া মিলন উচ্চারণ করতে পারে না। প্রথম ও যেদিন বারের কাজে ঢোকে, তখন লুকা মিলনকে গ্রেসিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে গ্রেসিয়া বলল,
কমেইস্তাই মিলান (তুমি কেমন আছো মিলন)? বলে গ্রেসিয়া একটু হাসল, তু আই সেনতিতো নমে দি মিলান কুন্ডেরা (তুমি কি মিলান কুন্ডেরার নাম শুনেছ)?
মিলন যে খুব ভালো করে মিলান কুন্ডেরাকে চেনে সেটা সে বুঝিয়ে দিয়ে গ্রেসিয়াকে বলল,
প্রাগ শহরে কেটেছে কুন্ডেরার অনেক সময়। ওর লেখা পড়ে আমি দুবার প্রাগে গিয়েছি। মি পিয়াসে প্রাহা।
চেক প্রজাতন্ত্রে প্রাগকে প্রাহা বলে।
মিলনের কথা শুনে গ্রেসিয়ার চোখ কপালে উঠে গেল! গ্রেসিয়া মুগ্ধতার মিশেলে বলল,
ব্রাভো, আংকে তু ছেই মুলতো ইনতিলিজেন্টে! এরপর থেকে বারের কাজে গ্রেসিয়া মিলনকে আর দশজনের চেয়ে একটু অন্য চোখে দেখে। সময়ে অসময়ে গ্রেসিয়া এসে মিলনকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায় ওর কাজে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কী-না।
দুই
মিলন কাইয়াতসো ছেড়ে হেঁটে-হেঁটে বাসার খুব কাছাকাছি চলে আসে। সিগারেটের দোকান দেখে মিলনের খুব কাফে খেতে ইচ্ছে করল। মিলনের এই এক বদভ্যাস। কাফের দোকান দেখলে এককাপ কাফে না খেলে তার চলে না। মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে। সারামুখ করলার মতো তেতো হয়ে আছে। শরীর ব্যথা। পা আর চলতে চাচ্ছে না। কাফে খেলে যদি একটু ভালো লাগে। সিগারেটের দোকান মানে তাবাক্কি। এসব দোকানে কাফে, হালকা খাবার-দাবার, পানীয় পাওয়া যায়। সিগারেট নিয়ে এক ইউরোর কয়েন ক্যাশে দিয়ে এক কাপ কাফে মাক্কিয়াতো দিতে বলল, কাফে বানিয়ে দিলো অল্পবয়েসি এক মেয়ে। মেয়েটার বয়স আর কত? সতেরো-আঠারো। দেখলে মালুম করা যায়। মিলন মেয়েটাকে দেখে আন্দাজ করে নিতে পারে, মেয়েটা ইতালির কোনো অঞ্চলের। অঞ্চলভেদে ইতালির মানুষজনকে বোঝা যায়।
কাফের কাপ মিলনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মেয়েটি মিলনকে বলল,
তু ছেই ইনডিয়ানো?
মিলন মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিয়ে মেয়েটাকে পাল্টা বলল,
আংকে তু ছেই নাপোলিতানো!
মিলনের অনুমান শতভাগ সঠিক হয়েছে জানিয়ে গর্ব করার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটি,
পেরকে নো! ইয়ো সনো নাপোলিতানো। কমে নো (কেন নয়! আমি নেপোলির মানুষ)!
মিলন কাফে খেয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। অনেকটা পথ হেঁটে-হেঁটে তাকে এখন ঘরে যেতে হবে। হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। কিছুটা পথ গিয়ে সে পেছনে তাকাল। না বাস-ট্রামের কোনো দেখা নেই।
ব্যাপার কী?
আজ কী সপেরো (হরতাল) নাকি!
ইতালিতে বাস-ট্রাম-ট্রেনে হরহামেশা সপেরো লেগেই থাকে। চার ঘণ্টার সপেরো। ছয় ঘণ্টার সপেরো। আট ঘণ্টার সপেরো। দশ ঘণ্টার সপেরো। তবে সপেরোর আগে কর্তৃপক্ষ সবাইকে আগে থেকে জানিয়ে দেয়। সপেরোর সময় সবই চলে তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। বাস-ট্রামের বিলম্ব দেখে মিলনের সপেরোর কথা মনে পড়ে গেল। হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির দরজার সামনে এসে সে টের পেল মোবাইলে মেসেজ টোন।
একটা মেসেজ নয়, পরপর দুটো।
মোবাইল বের করে দেখল। পরপর চারটা মেসেজ এসে জমা হয়ে আছে। ফোর মেসেজ রিসিভড। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি মিলন, ওপেন করল সে। ঢাকা থেকে চারটা মেসেজই পাঠিয়েছে সুলতানা। একটা রাত তিনটা বিশ মিনিটে, একটা ভোর পাঁচটা আটচলিস্নশ মিনিটে আর দুইটা এই মাত্র। সর্বশেষ মেসেজে সুলতানা লিখেছে, ঈদের দিনে তোমার ফোন না পেয়ে ছেলে আমাকে বলেছে, বাবাকে কি তুমি বকাঝকা করেছ? ছেলেটার জন্য ফোন দিও পিস্নজ! সুলতানা।
মিলনের বাসার নিচে ফোনের দোকান। মালিক মিশরের। সঙ্গে ফ্যাক্স-ইন্টারনেট-ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন। সুলতানার মেসেজ পড়ে মিলনের একবার মনে হলো, ফোনের দোকানে ঢুকে দেশে ফোন দিয়ে কথা বলবে ছেলের সঙ্গে। ছেলেটার চেহারা মিলনের সামনে ভেসে উঠল।
এই ক-বছরে কত বড় হয়ে উঠল পুত্র!
মিলনের মাথা ঘুরছে। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। এগারোটা পঁয়তালিস্নশ। তার মানে দেশে এখন বিকেল পৌনে চারটা। বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল মিলন। কাঠের বড় দরোজার পাশে লম্বা চারকোনা বক্সমতো একটা বোর্ড। তাতে বাড়ির ভাড়াটেদের কলিংবেলের বোতাম-সুইচ। তার নিচে ছোট করে ভাড়াটিয়াদের নাম। সুইচের মাঝখানে ছিদ্রঅলা সাউন্ডবক্স। বোতাম-সুইচে চাপ দিলে ওপর থেকে সংকেত বেজে উঠবে। বাড়ির ভেতর থেকে রিসিভার তুলে বাড়ির মালিক আগত মানুষের সঙ্গে কথা বলে যদি বোঝেন যে আগন্তুক তার পরিচিত তাহলে খট্ করে শব্দ হয়ে দরোজা খুলে যাবে।
মিলন বোতাম-সুইচে চাপ দিতে যাবে তার আগেই দেখল খট্ শব্দে দরোজা খুলে গেল। মিলনের মাথাটা তখনো ঝিম মেরে আছে। দরোজার ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ছেলে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে মুখ বের করে বাবা বলে মিলনের হাত ধরে দরোজার ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। মিলনের পা আর চলছে না।
এত দেরি করে বাড়ি ফিরলে যে! তোমার বিচার হবে। তাড়াতাড়ি ঘরে চলো বলে ছেলেটি তার হাত ধরে টানতে-টানতে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। মিলন চারতলা বাড়ির দোতলায় থাকে। তিনদিকে পাঁচ-ছয় তলার পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ি। মাঝখানে খালিমতো জায়গা। চারতলা বাড়ির প্রত্যেক তলায় টানা চিকন বারান্দা। বারান্দার গ্রিলে ঝোলানো ফুলের টব। শুকোতে দেওয়া কাপড়-চোপড়।
মিলন টের পায় ছেলেটি তাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে টেনে ওপরে নিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হঠাৎ মিলনের মাথাটা চক্কর মেরে উঠলে সে মাঝ সিঁড়িতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গেল। মিলনের মনে হলো রেলিং থেকে এখুনি তার হাত ছুটে যাবে। সে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়ল সে।
ছেলেটি তখন মিলনকে শক্ত করে ধরে বলল, বাবা তোমার খারাপ লাগছে? বসে পড়লে যে! আমি আছি না? আমার হাত ধরো বলে ছেলেটি তার হাত বাড়িয়ে ধরল মিলনের সামনে।
মিলন দেখল তার সামনে মেলে-ধরা রংধনুর ঔজ্জ্বল্যে মোড়ানো একটি হাত। সেই হাত ধরে মিলন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর মিলন পাঁড় মাতালের মতো হেলতে-দুলতে তার ঘরের দরোজা পর্যন্ত চলে এলো। সারারাতের ক্লামিত্ম তার শরীরকে ভেঙেচুরে দিচ্ছিল। টলতে-টলতে লম্বা চিকন বারান্দা হয়ে মিলন কোনোমতে দরোজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। দরোজার কাছে এসে মিলন অবাক হয়ে দেখল তার ঘরের দরোজা বন্ধ। বাইরে থেকে তালা মারা। দরোজা বন্ধ দেখে সে একা দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।
মিলন পেছনে তাকাল। না, তার আশপাশে কেউ নেই। তাহলে কে তাকে নিচের দরোজা খুলে দিল? কে-ই বা তাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে এলো? সিঁড়িতে বসে পড়ার পর তাকে কে অমন করে বলেছিল, বাবা, তোমার খারাপ লাগছে? বসে পড়লে যে!
মিলন পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল। ঘরে ঢুকে মিলন দরজার পাশে রাখা লম্বা সোফায় বসে কোনোমতে পা থেকে জুতা-মোজা খুলে লম্বা হয়ে মরার মতো শুয়ে পড়ল দরজা হালকা ভিড়িয়ে।
ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে ভিড়িয়ে রাখা দুই পালস্না দরোজার ফাঁকফোকর দিয়ে এক চিলতে আকাশ এসে আছড়ে পড়ল মিলনের চোখে।