বর্ণিল ক্যানভাস

বর্ণিল ক্যানভাস

বারিধারা তখনো থরে-থরে দালানকোঠা, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট আর বিদেশি দূতাবাসে ভরে ওঠেনি। বিকেল হলেই আমরা বান্ধবীরা, মূলত তালাত আর আমি, শোঁ-শোঁ করে সাইকেল ছুটিয়ে আমেরিকান দূতাবাস পর্যন্ত ছুটে যেতে পারতাম অনায়াসে। তারপর হঠাৎ করে জানি কী হয়ে গেল। খালি জায়গাগুলোর গর্ভ চিরে দুমদুম করে এক-একটা প্যালেস তৈরি হলো। নিরিবিলি শান্ত-স্নিগ্ধ এলাকাটি ভরে গেল লোকে-লোকারণ্যে। তাও ভালো আমাদের পাশের পস্নটটি অনেকদিন খালি ছিল। শেষ পর্যন্ত সেখানে যখন একটা লাল ইটের দোতলা বাড়ি উঠল তখন আমার এ-লেভেল দেওয়ার আর ছয় মাস বাকি। বাড়িটার নাম নিভৃতি। কিন্তু আমরা চিনলাম হাই সাহেবের বাড়ি বলে। সে-সময়টা আমি বড্ড একা। খুব লাজুক আর অন্তর্মুখী। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আর তেমনটি যাই না। ওদের হইচই, লেইট নাইট পার্টি, সিসা ক্লাব, আড্ডা সব কিছুতেই আমি বড় অর্বাচীন। তাই গোত্রছাড়া। একমাত্র বান্ধবী তালাত। ও একটা পার্টি অ্যানিমেল। আমার জন্য ওর সময় খুব একটা নেই। আমার সেই একাকিত্বের সময়টাতে প্রথম সে-ছেলেটিকে দেখি। হাই সাহেবের বাড়ির দোতলা গাড়িবারান্দার ওপরে। বুঝলাম দুবাড়ির দোতলায় আমরা দুজন পাশাপাশি ঘরের বারান্দা। আমাদের ঘর-বারান্দা মুখোমুখি। আমরা দুজনই একই বয়সী। কিংবা হয়তো আমার থেকে একটু বড়ই হবে। সে দারুণ ফিট। বারান্দায় বেরোলে তার সঙ্গে দেখা হতো। কিন্তু কখনো কথা হতো না। কেন? বোধহয় আমরা একই মাত্রার অহংকারী ছিলাম। কিংবা ওর হয়তো কোনো আগ্রহ ছিল না। বিপরীত লিঙ্গ দেখলে কথা বলা যাবে না, এরকম কোনো মূল্যবোধের সঙ্গে তো আমরা পরিচিত নই। গ্রিন হেরাল্ডে ও-লেভেলের সময়েও তো শর্টস পরে ছিলøyর সঙ্গে টেনিস খেলতাম। ছিলøy ছিল আমার প্রথম ক্রাশ। নাচ জানা কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে নেই। ছিলøy এখন নাজিফার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো ছেলেটি ম্যানারাতে পড়েছে। ছেলেটির মা কোনো হালাক্কা পার্টির দলনেত্রী, যেখানে মহিলারা হিসাব কষে বলছেন কে কতবার হজে গেলেন কিংবা কার কতটা আধুনিক সৌদি মডেলের বোরখা আছে, আর আছে দুবাই থেকে সদ্য কেনা ডায়মন্ডের সেট। নতুন পয়সা হওয়া এখনকার বড়লোকদের যা হচ্ছে আরকি! সেদিন আববুর কথা শুনেঅবশ্য তা মনে হলো না। হাই সাহেবদের দুই প্রজন্মের ব্যবসা। ওনার প্রথম স্ত্রী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে পিএইচডি করেছেন। হুম প্রথম স্ত্রী এখানে একটি প্রশ্ন থাকে বইকি। কিন্তু তাই বলে কি তার কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব জমাতে নেই? তাহলে কি ধরে নেব সে আসলে গে? একজন সমকামী? আমার প্রতি কোনো আকর্ষণবোধ করে না? এই চিন্তাটা অবশ্য তালাত আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। একদিন আমার ঘর থেকে ওকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখ, দেখ, সাফা, গে’দের মতো বাম কানে একটা দুল পরে আছে।’ নানারকম চটকদার কথা বলে তালাত প্রায়ই ওভারস্মার্ট ভাব করে। তাই ওর কথা আমি খুব একটা বিশ্বাস করি না। তবে এ-কথাটি বিশ্বাস করলাম। আমার প্রতি ওর এত নিস্পৃহ আচরণের একটা ব্যাখ্যা দরকার ছিল। অন্তত আমার অহমকে একটা সান্তবনা দেওয়ার জন্য হলেও। তা সে যা হয় হোক – তারপরও কি আমরা বন্ধু হতে পারি না? শুধুই বন্ধু? সেও তো আমার মতোই। কোনো হই-হুলেস্নøvড় দলবাজিতে নেই। নির্জনতায় বিশ্বাসী। ভোরবেলায় বারান্দায় এসে যোগীর মতো যোগব্যায়াম করে। আর বাদবাকি সময় যতটুকু দেখি হাতে থাকে বই।  কখনো ওকে হাতে বই ছাড়া দেখিনি। কী অত পড়ে? অথচ সেদিন আববু ডাইনিং টেবিলে বলছিলেন যে, হাই সাহেবের ছেলেটা নাকি কোনো ডিগ্রি না নিয়েই লন্ডন থেকে ফিরে এসেছে। গত এক বছর ধরে বাসাতেই বসে আছে। তারপর আক্ষেপ করে বললেন, যাদের অফুরন্ত সুযোগ তারা অবলীলায় সে-সুযোগটা নষ্ট করছে। আর যাদের হাজারটা অসুবিধা রয়েছে দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত তারাই লেখাপড়াটা শেষ করছে। আববুকে অনেক কষ্ট করে ওপরে উঠতে হয়েছে। আমাদের সে-গল্প প্রায়ই শুনতে হয়। আমি মাথাটা নিচু করে ছিলাম। চোখাচোখি হলেই আববু হয়তো আবার আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন। তিনি চান আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ি। তারপর আববু একটা পত্রিকা বের করবেন। আমি হব সেটার সম্পাদক। আর ভাইয়া দেখবে গার্মেন্টসের ব্যবসা। আশির দশকে আববু এটি শুরু করেছিলেন। সে-সময় আমাদের খুব অভাব আর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়েছে। নববইয়ের দশকে এর পালে হাওয়া লাগে। ঠিক হয়ে আছে ভাইয়া এর হাল ধরবে। এর মধ্যে আমি নেই। সহজ হিসাব। মসনদ পাক্কা। এ-লেভেলের পর লন্ডন যাচ্ছি লেখাপড়া করতে তা ঠিকঠাক হয়ে আছে। আববুর যত ভয় এর মধ্যে যদি একটা ভুল প্রেম-ট্রেম করে বসি। হয়তো ওকে নিয়েই ভয়টা কাজ করে। তাই আজকাল প্রায়ই ডাইনিং টেবিলে হাই সাহেবের পরিবারের প্রসঙ্গ চলে আসে। শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে হাই সাহেবের নাকি তেমন ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে না। বি-ঘরানার লোক বলে এ-ঘরানার পার্টিকে ঠিকমতো চাঁদা দেননি। সামনেই নাকি পত্রিকাগুলোতে ঋণখেলাপির তালিকায় ভদ্রলোকের নাম উঠবে। তা ঋণখেলাপি এ-বিষয়টি আববুর কাছে খুব একটা বড় বিষয় নয়, পত্রিকায় নাম ছাপানোটা ব্র্যান্ডনেমের ওপর ব্রণের কালো দাগের মতো। হাই সাহেবের প্রথম স্ত্রীর প্রসঙ্গও আসে। সে-মহিলার মৃত্যু নিয়ে বাজারে অনেক গুজব আছে। ছেলেটি হচ্ছে সেই প্রথম স্ত্রীর সন্তান। গুজবটা কিন্তু মারাত্মক রকমের ভয়ংকর। বুঝতে পারছি আববু আমাকে খুব পরোক্ষভাবে সাবধান করে দিচ্ছেন। এতকিছুর দরকার ছিল না। ছেলেটির আমার ওপর কোনো আগ্রহ নেই। বরং আববু এতসব গল্প বলে ওর ওপর, ওর প্রতি আমার আগ্রহটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক আগ্রহ নয়, এক ধরনের মায়া। আহা, ওর তাহলে নিজের মা নেই! হাই সাহেবের বর্তমান স্ত্রী খুবই সুন্দরী। একসময় ভদ্রলোকের সেক্রেটারি ছিলেন। এখানেই রহস্য আরো ঘোরাল হয়েছে। এতসব রহস্য ছাড়িয়ে আমার শুধু মনে হয়, আহারে এজন্য বুঝি ও এমন একা। সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখে। এখন তো ভার্সিটিই ছেড়ে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে কয়েকদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। যায় কোথায়? অবশ্য ছেলেমানুষ। ওরা তো যে-কোনো সময়ই ডানা মেলতে পারে। পুরো আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াতে পারে। তারপর যখন ইচ্ছা হবে তখন ডেরায় ফিরবে। আচ্ছা মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে উড়তে পারে না? আমি একদমই বিরক্ত করব না। শুধু পাশে থাকব। বিশাল আকাশটাকে একটু কাছ থেকে দেখব। একদিন রাতে ছাদে গিয়ে দেখি ওদের ছাদের ওপর সে উপুড় হয়ে শুয়ে অন্ধকার আকাশের তারা দেখছে। একদম ধ্যানস্থ মুনির মতো নিশ্চুপ হয়ে তারা দেখা। এই নাগরিক জঙ্গলে আমাদের দুছাদের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। একটু ডাকলেই সে শুনতে পেত। কিন্তু এত কাছাকাছি থেকেও দূরত্ব যে অসীম। কীভাবে এই অপরিচয়ের অসীমতা ভাঙা যায়? গে না হলে লন্ডনে চলে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে একটু এপেটাইজার টাইপের প্রেম করলে মন্দ হতো না। এরকম ধ্যানমগ্ন ছেলেরা খুব গভীর হৃদয়ের হয়। হয়তো-বা সে কবিও। এই মুহূর্তে যদি ওর পাশে থাকতে পারতাম তাহলে হয়তো আমাকে অনেক কবিতা শোনাত।

দুই

সেবার শীতের শেষে পাহাড় কাঞ্চনপুরে চলে গেলাম। সেখানে আববুর একটা বাগানবাড়ি আছে। তার পাশ দিয়ে তুরাগ নদ বয়ে যাচ্ছে। শান্ত-সম্মোহিত স্রোত সেখানে ধীরে-ধীরে বয়। গোধূলির সময় হরেক রঙের পাল তোলা নৌকা আর দূর থেকে ভেসে আসা মাঝির ভাটিয়ালি সুর পরিবেশটাকে সম্মোহিত করে তোলে। অনেকটা আমার বাড়ির পাশের বাড়ির পড়শির মতো। হায়, সব আরশিনগরের বাসিন্দাকেই কেন মরীচিকা হতে হবে? ধরাছোঁয়ার বাইরে। মায়াবী গোধূলি খুব দ্রুতই ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। আমি ফিরে আসি বাংলোতে। অনেকটা দিন কয়েক থাকব এখানে। আববুকে বললাম নিরিবিলি কোথাও যেতে চাই। পড়াশোনায় মনঃসংযোগের জন্য। ইদানীং আমারও খুব ধ্যানস্থ হওয়ার ইচ্ছা জাগে। হয়তো ওকে দেখে এমনটা হয়েছে। ঢাকায় থাকলেই বন্ধু-বান্ধবদের হলস্না চাইলেও খুব একটা এড়ানো যায় না। বিশেষ করে তালাত আমাকে প্রায়ই ডলের সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছে। রেস্টুরেন্টে খেতে যাও তো নয় দুম করে কলকাতা গিয়ে হিন্দি মুভি দেখে আস। এবার ওরা চেপে ধরল দুবাইয়ে যাওয়ার জন্য। একটা বড় কনসার্ট আছে। আমার ভয় এতসব কিছু করলে পড়শির থেকে দূরে সরে যাব। পড়শি হয়তো জানেই না যে, সে আমাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে। এখন আমার খুব বই পড়তে ভালো লাগে। স্ট্যাইনবেক আর হেমিংওয়েতে নেশা হয়ে গেছে। কিংবা গভীর রাতে ছাদে চলে যাই আকাশের তারা দেখতে। দুদিন ধরে ওকে দেখছি না। আর তাতেই আমার উধাও হওয়ার ইচ্ছেটা জাগল। পাহাড় কাঞ্চনপুরের এ-বাংলোটাতে মামণি আসেন না। আববু আসেন। আববুর জীবনেও অনেক রহস্য আছে। সেসব নিয়ে মাঝেমধ্যে মামণির সঙ্গে আববুর খুব ঝগড়া হয়। বিশেষ করে আববুর একটা লম্বা বিদেশ ট্যুরের পরে। আমি সেসব না-শোনার ভান করি। আববুর কাছ থেকে দামি কোনো উপহার পেয়ে মামণিও আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। আমরা আসলে সবাই এক অদ্ভুত নিরাপত্তার শেকলে বাঁধা পড়ে আছি। পাহাড় কাঞ্চনপুর তাই আমার কাছে দুদিনের মুক্তি। খুব নিরিবিলি এখানটা। চারপাশে এখনো ছোট এক টুকরো বন জেগে আছে। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে শান্ত-সিণগ্ধ তুরাগ নদের রুপালি স্রোত কুলকুল শব্দে বইতে দেখা যায়। তার ও-পাশে বাসমত্মী বাতাসে ঢেউ-খেলানো সবুজ ধানক্ষেত। এই এপ্রিলে গেটের পাশের মস্ত বড় মহুয়া গাছটার ফুল থেকে চারদিকে মাতাল হাওয়া ছুটছে। কিছুক্ষণ দুচোখ বন্ধ করে ভাবি, জীবনটা কি ঠিক এ-মুহূর্তে স্থির হয়ে থাকতে পারে না? তখনই বন্ধ চোখের পর্দার ওপর ওর ছবি ভেসে ওঠে। কী যন্ত্রণা! মানুষ কি একা ভালো থাকতে পারে? বিশেষ করে এই বয়সটাতে? একটা সময় আববু আর মামণির মতো ঝগড়া করতে হবে জেনেও? অস্থিরতা না দুঃখবোধ জানি না কোনটি আমাকে ধেয়ে নিয়ে যায় তুরাগ নদের কাছে। হাঁটতে শুরু করি নদের পাশ ঘেঁষে। একা-একাই। মানা করার পরও দেখি কেয়ারটেকার সাহেব একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমার সঙ্গে হাঁটছেন। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাই পেছনের দৃশ্যপট। এগিয়ে যাই সামনে। থমকে দাঁড়াই নদীটার বাঁকের মুখে এসে। আমার সামনে ও দাঁড়িয়ে আছে। স্বপ্ন না বাস্তব! একদম সিনেম্যাটিক। অনেকে হয়তো বলবে, এমন কাকতালীয় ঘটনা বাস্তবে সচরাচর ঘটে না; কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল এমনটা ঘটারই কথা ছিল। এটিই স্বাভাবিক। কারণ আমরা তো একই বলয়ের। একই ক্লাস। আমাদের আববুদের ইনভেস্টমেন্ট প্যাটার্নটা তো এরকমই হওয়ার কথা। তুরাগ নদের পাশে আমাদের মতো আরো অনেকের বাংলো আছে। ওদেরও।

তিন

জানলাম ওর নাম। আরো জানলাম ও ছবি আঁকে। লেখালেখি করে। হাই সাহেবের এই বাংলোটা আসলে ওর ছবি আঁকার একটা স্টুডিও। দোতলায় একটা বিশাল হলঘর। প্রথমটায় টারপেন্টাইন, লিনসিড অয়েল আর অয়েল পেইন্টের মিশেলে একটা বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগে। কিছুক্ষণ পর তা সয়ে আসে। আসলে চারপাশের ক্যানভাসগুলোতে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে সম্মোহিত হয়ে যাই। এক-একটা ক্যানভাস এক একটা গল্প বলছে। দুটোতে শুধু পাহাড় কাঞ্চনপুর। সবুজ বন, ঢেউ-খেলানো ধানক্ষেত, তুরাগ নদ আর তাতে লাল-নীল-হলুদ পাল তোলা নৌকা। আর বাকিগুলোতে আবস্ট্র্যাক্ট আর্ট। একটা ক্যানভাসে যতসব অন্ধকার এসে জমে গেছে। সেখানে তাকালে কেমন জানি মন খারাপ করে ওঠে। আবার তার পাশের ক্যানভাসটাই একদম অন্য গল্প শোনাচ্ছে। সেখানে খুব সবুজ আর হলুদের ছটা। মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি বিহবল দর্শক। ক্যানভাস থেকে ক্যানভাসে ছুটতে থাকি আর স্থবির হয়ে পড়ি। ওর নাম দিই পিকাসো। পিকাসো আমার ছেলেমানুষি দেখে হাসে। তারপর আবার ছবি আঁকায় নিবিষ্ট হয়। ছবি আঁকার স্টুডিওর পাশের রুমটা ওর লাইব্রেরি। ফ্লোর থেকে সিলিং পর্যন্ত বিসত্মৃত বুকশেলফে থরে-থরে সাজানো বই। সেখানে আছে পেস্নøটো, অ্যারিস্টটল, মিশেল ফুকো, ক্যান্ট, ডারউইন, বারট্রান্ড রাসেল, দস্তয়েভস্কি, জন স্টুয়ার্ট মিল, ভার্জিনিয়া উলফ, রুমি, শাদি, থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল আরো কত জানা-অজানা লেখকদের বই। প্যারিসের ইম্প্রেশনিজম আর বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের ওপর বই দুটি পাশাপাশি। সেখান থেকে আমি টলস্টয়ের আনা ক্যারেনিনা টেনে নিই। ওর স্টুডিও রুমের সোফার ওপর আলতো করে শুয়ে পড়তে শুরু করি। পিকাসো তখন নিবিষ্ট হয় ওর ক্যানভাসে। ওকে দেখলে আমার তুরাগ নদের কথা মনে হয়। স্রোতস্বী আবার মগ্ন। একজন পুরোপুরি ধ্যানী মানুষ। এরপর থেকে আমার প্রতিদিনের রুটিন হলো পিকাসোর স্টুডিওতে চলে আসা। আমি ওর সোফায় আধশোয়া হয়ে বই পড়তে থাকি। আর পিকাসো একমনে ছবি আঁকতে থাকে। মাঝে-মধ্যে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হই। ঘুমিয়ে পড়ি। জেগে দেখি সে আমার মাথার কাছে বসে আছে। আমাকে জাগতে দেখে দুজনের জন্য স্বচ্ছ কাপে চায়ের লিকার নিয়ে আসে। এর রং আর ম-ম সুগন্ধ দুটোই আমার কাছে অপরিচিত। জানতে চাই এর রহস্য। তখন পিকাসো ওর মায়ের কথা বলতে শুরু করে। ওর নানার চা-বাগান আছে। ওর মায়ের ছিল নানারকম চায়ের বেস্নন্ড তৈরি করা। পিকাসোও এখন তা চালিয়ে যায়। এই লিকারে আছে গ্রিন টি, পেঁপে, কমলার খোসা, রোজমেরি, দারুচিনি আর আনারসের নির্যাস। এরকম এখন প্রায়ই হয়। ধ্যান ভেঙে পিকাসো একটা সময় আমার সোফায় এসে বসে। তারপর টুকটাক কথাবার্তা। আনা ক্যারেনিনার প্রথম লাইনটি আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয়।

‘All happy families are alike; each unhappy family is unhappy in its own way.’

আমরা আমাদের ডিসফাংশনাল পরিবারের গল্পগুলো খুব অবলীলায় বলে যাই। এর মধ্যে পিকাসো আমাকে রং চেনায়। আনন্দের রং শেখায়, বেদনায় রং চেনায়। লাল আর বেগুনির মিশেলে ওই কোনার ছবিটা কেন এত প্রাণপ্রাচুর্যময় তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। নিবিষ্ট মনে শুনে যাই উনিশ শতকে প্যারিসে ঘটে যাওয়া বিমূর্ত শিল্পের বিপস্নব। বোঝানোর চেষ্টা করে এর ভাষা। বিপস্নবের পেছনের সংগ্রাম। কীভাবে একদল পাগলা আর্টিস্ট মানুষের মন থেকে পেইন্টিং সম্পর্কে সনাতনী ধারণাটা পালটে দিয়েছিলেন। সে-সময় তাঁদের ছবি দেখে সমালোচকরা মানসিক রোগীর পাগলামো বলতেন। আমি জিজ্ঞেস করি, ও আচ্ছা, তুমি ভার্সিটি ছাড়লে কেন?

সে বলে, ‘না, ওই আর্কিটেকচার আমাকে দিয়ে হবে না।’

‘তাহলে তুমি অন্য কিছু পড়ো। যা ভালো লাগে তাই।’

‘তাই তো পড়ছি। তুমিই তো বলো, ভালো ছাত্রের মতো প্রতিটি বই আমি দাগিয়ে রাখি। মার্জিনে নোট টুকে রাখি।’

‘কিন্তু এসব তো তোমাকে কোনো ডিগ্রি দেবে না।’

পিকাসো চুপ।

‘তুমি কি সারাজীবন ছবি এঁকে যাবে? তোমার আববার বিজনেস দেখবে না?’

‘আমার জীবনের জন্য কারো কিছু আটকে থাকবে না।’

কথাগুলো বলার সময় পিকাসোর চারপাশ ধূসর হয়ে আসে। ধূসরতা বেদনার রং। পিকাসোই আমাকে তা চিনিয়েছে। আমরা এখন কথা দিয়ে রঙের খেলা খেলতে পারি। ওর ধ্যানমগ্নতার রং নীল। নদের পাড় ঘেঁষে আমরা যখন এক-এক করে ধানক্ষেত আর সরষে ক্ষেতের আইল দিয়ে চলি, তখন একরাশ সবুজ আর হলুদ আমাদের আনন্দময় সময়গুলোকে রঙিন করে তোলে। এর মধ্যেই আমরা আমাদের বেদনার কথা বলি। স্বপ্নের কথা বলি। পিকাসো ওর মাকে নিজের চোখের সামনে আত্মহত্যা করতে দেখেছে।

গনগনে আগুনের মধ্যে ওর মা পুড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারি, মাকে বাঁচাতে না পারার বেদনা ভোলার জন্য ও একটি ভিন্ন পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। সে-পৃথিবীতে কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। এমনকি আমারও। গত কয়েকদিন আমাকে চুপচাপ অপেক্ষা করে যেতে হয়েছে কখন সে তার ওই ভুবন ছেড়ে আমার কাছে আসবে। যখন আসে তখন আমার পৃথিবী আলোকিত হয়ে ওঠে। আমি প্রতীক্ষায় থাকি। প্রত্যাশাহীন এক অনন্ত প্রতীক্ষা। যার শেষ কোথায় তা জানা নেই। এই অনিশ্চয়তাটুকু আমাকে আরো স্থির হতে শেখায়। একসময় আমার যাওয়ার সময় হয়। এক যোগীর কাছে দীক্ষা নিয়ে এক অন্য আমি অবশেষে আবার নাগরিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

অনুভব করি পিকাসো আমাকে ভালোবাসা চিনিয়েছে। প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা।

চার

একদিন কলেজ থেকে বের হয়ে দেখি পিকাসো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে একটু হাসল। লাজুক হাসি। অপ্রস্ত্তত ভাবভঙ্গি। যেন অজুহাত খুঁজছে এদিকটায় ভুল করে চলে আসার। আমি বললাম, ‘আমার কেন জানি মনে হতো একদিন তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব।’

পিকাসো সহজ হয়। জানাল দৃক গ্যালারিতে ওর প্রদর্শনী চলছে। আজকেই শেষ দিন। অভিমানী হতে গিয়ে হলাম না। যাক, বাবা, তাও তো এলো। আমাকে নিয়ে গেল দৃক গ্যালারিতে। পাহাড় কাঞ্চনপুরে ওকে এই ছবিগুলো আঁকতে দেখেছিলাম। জানলাম, ওর সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। কানেকশন একটা শক্তিশালী মাধ্যম। পিকাসোর সমাজের বাসিন্দারা ওর ছবি কেনার সামর্থ্য রাখে। আমিই তো কিনতাম। কিন্তু আর তো কোনো ছবি বাকি নেই। এবার সত্যি-সত্যিই অভিমানী হলাম। ‘আমার জন্য একটা পেইন্টিংও রাখলে না?’

‘সব ছবি এখানে আনিনি। কয়েকটা এখনো স্টুডিওতে রয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা তোমাকে দেখাতে চাচ্ছিলাম।’

‘আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। গ্যালারিতে আনবে কবে?’

‘আজকে প্রদর্শনীর শেষ দিন না? আর তো এখানে আনা হবে না।’

‘তাহলে চলো এই শুক্রবার পাহাড় কাঞ্চনপুরে যাই।’

‘আমি একমাস পর প্যারিস চলে যাচ্ছি। পেইন্টিংয়ের ওপর পড়তে। আর কালকে যাচ্ছি ইন্ডিয়াতে।’

স্তম্ভিত আমি এতটুকু বুঝলাম প্রচ-রকম এই অন্তর্মুখী মানুষটার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে, অভিমান করে কোনো লাভ নেই। আর তা ছাড়া আমরা তো জানি না আমাদের সম্পর্কটা কীরকম। সে-বিষয়ে আমাদের মধ্যে তো কোনো কথা হয়নি। প্রত্যাশাহীন সম্পর্ককে প্রত্যাশার বেড়াজালে বাঁধতে নেই।

‘ইশ! একদিনের জন্য যদি এয়ারপোর্টটা বিকল হয়ে যেত!’ খুব মৃদু স্বরে কথাটা বলে ফেললাম। এর থেকে আমার আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

পরদিন কলেজে ঢোকার সময় দেখি পিকাসো ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম। বিস্ময়াভিভূত আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খুব অপ্রস্ত্তত ভঙ্গিতে পিকাসো বলে উঠল, ‘ফ্লাইটটা একদিন পেছালাম। কালকে ভোরে যাব।’

এরপর আর দেরি না করে কলেজ পালিয়ে পিকাসোর গাড়িতে করে আমরা পাহাড় কাঞ্চনপুরের দিকে ছুটে গেলাম।

পিকাসো আমাকে সাহসী করে তুলল। জীবনে এই প্রথম নিয়ম ভাঙলাম।

পাঁচ

এই সেই গ্যালারি। পিকাসোর প্রার্থনার স্থান। রুমে ঢুকতেই অভ্যর্থনা করে ল্যানসিড অয়েল আর তেলরঙের মিশেলে এক মিষ্টি মিহি গন্ধ। দেয়ালের চারপাশে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে থরে-থরে ক্যানভাস। আগের থেকে এখন ক্যানভাসের সংখ্যা অনেক কম। সবই অসমাপ্ত অথবা অব্যবহৃত। শুধু ইজেলের ওপর রাখা ক্যানভাসটা সম্পূর্ণ। পিকাসো আমাকে অবাক করতে চেয়েছিল। এবং আমি সত্যি-সত্যিই অবাক হই। আশ্চর্য! ক্যানভ্যাসের মধ্যে আমার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সচরাচর যেভাবে আমি এ-ঘরের সোফাটায় আধশোয়া অবস্থায় থাকতাম, ছবিতেও সেরকম। পেছনে এই ঘরের বড় জানালাটা। সেখানটায় নীল আকাশ আর লাল কৃষ্ণচূড়া। বাইরে এতো উজ্জ্বল রং আর ভেতরটা কেমন যেন ধূসর। পিকাসো আমাকে এমন বিষণ্ণ আঁকল কেন? ও কি তবে আমার মনের ভেতরটা দেখতে পায়? আনমনা উদাস দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার লম্বা চুলগুলো মেঝেতে লুটাচ্ছে। সাইড টেবিলে খোলা বই। যে-কটা দিন এখানে এসেছিলাম তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি পিকাসো আমাকে এত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হয়তো এটাই প্রকৃত শিল্পীর ধর্ম। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাবে না, তাঁদের উদাসীনতাটুকুই সাধারণ মানুষের কাছে প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা অনেকটা সিন্ধু সেচে মুক্তা আনার মতো। ছবিতে আমার অভিব্যক্তির প্রতিটি রেখা মুক্তার মতো প্রখর, উজ্জ্বল। প্রায় স্বচ্ছ মসলিনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি। অনেকটা বট্টেসেলির এলিগরি অব স্প্রিংয়ের অপ্সরাদের মতো। স্বচ্ছতার আচ্ছাদনে পবিত্র অবয়ব। নিজের ছবির মুখোমুখি হয়ে বাস্তবের এই আমার চোখের দুকোণ চিকচিক করে উঠল। অনুভব করলাম সেখানে পিকাসোর স্পর্শ। ওর মুখ আমার মুখের খুব কাছে চলে আসে। খেয়াল করলাম পিকাসোর বাম কানে কোনো দুলের চিহ্ন নেই। তালাতটা আসলেই খুব চাপাবাজ। ততক্ষণে আমার অশ্রম্নবিন্দুর ওপর ও তার ঠোঁট চেপে ধরেছে। আমি সম্মোহিত। আমি প্রস্ত্তত। ওর দুহাতের কোলের মধ্যে করে সেই সোফায় নিমজ্জিত হলাম। এ এক অন্য তুরাগ! এখন সেখানে তীব্র জলোচ্ছ্বাস। কখনো-বা আমাকে ভাসাচ্ছে আবার ডুবাচ্ছে। কখনো-বা শক্ত করে পিকাসোকে জড়িয়ে ধরি যাতে এ-যাত্রায় আমরা বিচ্ছিন্ন না-হয়ে পড়ি। এ এক অদ্ভুত আবেশ! ভেসে আসে দূর থেকে সেতারের ঝংকার। ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে আছড়ে পড়ে সোনালি রোদ। স্রোত, সুর আর মিষ্টি আলোয় স্নাত হতে-হতে এক প্রশামিত্মময় আচ্ছন্নতা আমাকে অবশ করে ফেলে। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি জানলাম, প্রেম কী! ওহ পিকাসো!

ছয়

পিকাসো গাড়ি চালিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। এর আগে কখনোই এতো রাত করিনি। আমার বান্ধবীরা করেছে। কিন্তু আমি একদমই ভীতু। আমার শৈশবের মধ্যবিত্ত আচ্ছাদন এখনো আমাকে অনেক হাতছানি থেকে টেনে ধরে রাখে। আবার তারুণ্যের বৈভবতার প্রেক্ষাপট অনেক মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকেই এড়িয়ে চলার সাহস দেখাতে পারে। এই যেমন পিকাসোর বাংলোতে আজ একটি নিয়ম ভাঙলাম – রক্ষণশীল সমাজের মধ্যবিত্তের নিয়ম। পাশ্চাত্যের সাহিত্য আর চলচ্চিত্রে প্রভাবিত হওয়া আমার চারপাশের ইংরেজি মিডিয়ামের বান্ধবীরা এরকম নিয়ম অহরহই ভাঙছে। তাই কোনো অপরাধবোধ নেই। বোধের উৎস তার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা। তাই কেউ দুর্নীতি করেও ভালো থাকে, সহকর্মীরা করছে বলে। আবার অনেকে বন্ধুমহলে গর্ব করে নিজেদের করা

ধর্ষণের সংখ্যা গোনে – একেবারে অনুতাপহীন মানসিকতায়। মানুষ পরিবেশ গড়ে। আবার সেই পরিবেশ গড়ে মানুষ। আমি প্রথাবিরোধী নই। আমি আজকে আমার পরিবেশের কোনো নিয়ম ভাঙিনি। তবে সংকোচ যে কিছুটা নেই, তা নয়। প্রথম তো। তাই এ-মুহূর্তে বাড়ি ফিরে আববুর মুখোমুখি হতে চাই না। গেটের সামনে থেমে পিকাসোকে বলেছিলাম চলে যেতে। কিন্তু ও ভদ্রছেলের মতো আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো। আর তখনই আববু দরজাটা খুললেন। আমাকে এড়িয়ে পিকাসোর দিকে তাকিয়ে একটি সৌজন্যসূচক হাসি দিলেন। তাকে ঘরের ভেতর আসার আহবান জানালেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পিকাসো আববুকে অনুসরণ করে লিভিং রুমে ঢুকল। আমাদের এ-রুমটায় দেয়ালের চারপাশে জয়নুল আবেদিন, শাহাবুদ্দিন, কালীদাস আর ফিদা হুসেনের ছবি টানানো আছে। সবকটিই অরিজিনাল। শাহাবুদ্দিনের পেইন্টিংটা আববু প্যারিস থেকে কিনে এনেছিলেন। গত বছর। আববু খুব যে একটা চিত্রকলা বোঝেন, তা নয়। পুরো ব্যাপারটাই সোশ্যাল স্ট্যাটাস। দেয়ালে থাকতে হবে বিখ্যাত আঁকিয়েদের অরিজিনাল। মেঝেতে থাকতে হবে পারসিয়ান কার্পেট, লনে বেলজিয়াম ঘাস আর গ্যারেজে নিদেনপক্ষে মার্সিডিজ। এখন অবশ্য তাতেও কুলাচ্ছে না। আববুর এক বন্ধু নাকি একটা ট্যাক্স ফ্রি পোরশে কিনেছে। ঘরে ঢুকে পিকাসো বিভোর হয়ে জয়নুল আবেদিনের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। দুর্ভিক্ষের ছবি। মৃতপ্রায় মা রাস্তায় শুয়ে আছে। পাশে বোধহয় তার ছেলে আর একটি কাক। মাথার ওপর উড়ছে একটি শকুন। দু-দুটো পাখি আর দু-দুটো মানুষ। ছবির পাখি দুটো সুস্থ-সবল কিন্তু মানুষ দুজন কংকালসার। কী অদ্ভুত! দুর্ভিক্ষে পাখিদের পোয়াবারো। মানুষ মরলে ওদের ভোজ শুরু হয়। আববু পিকাসোর পেছনে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ছবিটা ১৯৪২ সালের। জয়নুল আবেদিনের। অরিজিনাল। এই ছবিটি আমি সংগ্রহ করি।’

ওখান থেকে চলে আসি। আববু এরপর চিত্রকলা নিয়ে যত কথা বলবেন সব আমার জানা আছে। ঘড়ি ধরে বলতে পারব পাক্কা বিশ মিনিট লাগবে। ফ্রেশ হয়ে আসতে-আসতে লিভিংরুমে ঢুকে দেখলাম পিকাসো এর মধ্যে চলে গেছে। সোফায় আববু চুপচাপ একা বসে আছে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। আমি স্তম্ভিত! আববু কি আমার সঙ্গে সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট শুরু করেছে? হ্যাঁ, তাই-ই। প্রায় একমাস আববু আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না, দেখেও না দেখার ভান করলেন। এ এক নরকবাস! যেদিন নীরবতা ভাঙলেন তার পরদিন আমাকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে গেলেন। আববুর সেক্রেটারি মিস রমিতাকে বোধহয় আগেই নির্দেশ দেওয়া ছিল। কিছু সস্তা দরের কাপড় পরে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে আমাকে একদম গার্মেন্টকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে হলো। এটাকে আমি একদিনের অ্যাডভেঞ্চার হিসেবেই নিলাম। কিন্তু রাতে ডিনারের টেবিলে বিষয়টি অন্যদিকে গড়াল। আববু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন কাটল আজকে সারাদিন?’

‘বেশ ভালো। একটা পিকনিক ভাব।’

‘এটি কিন্তু একদিনের পিকনিক নয়। পারবে তুমি সারাজীবন এমন কাটাতে?’

আমি খুব অবাক দৃষ্টিতে আববুর দিকে তাকালাম। আববু কখনো আমার সঙ্গে এমন করে কথা বলেনি।

‘একজন আর্টিস্টের বউ এর থেকে ভালো জীবন কাটাতে পারে না। হাই সাহেবের অবস্থা খুব পড়তির দিকে। গুজব আছে সম্পত্তি সব নিলামে উঠছে। যদি কিছু রাখতে পারে তো ছোট ছেলেটা সব পাবে। বড় ছেলেটার না সে বুদ্ধি আছে, না আছে কোনো বাস্তব জ্ঞান। ছবি এঁকে আর কয় পয়সা পাওয়া যায়? তাও যদি কোনো বিখ্যাত আর্টিস্ট হতো?’

‘আববু, কেউ তো একদিনে বিখ্যাত হয় না।’

‘কেমন লাগবে তোমার যখন দেখবে যে তোমার ছবি এঁকে-এঁকে বাইরে বিক্রি করছে? তাও আবার যেই সেই ছবি না, একেবারে ন্যুড – তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে। বুঝতে পারছ নিশ্চয় কী বলতে চাচ্ছি।’

‘এটা কী বলছ তুমি?’

আববু তার সব সময়ের সহকারী এখলাসকে ডাক দিলেন। এখলাস একটা বড় ক্যানভাস নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমার সেই ছবিটা। পিকাসো এটি তার স্টুডিওতে এঁকেছিল। একদম আমাকে না জানিয়ে। তারপর এই ছবিটার সামনে আমরা। অদ্ভুত ব্যাপার যে, পরিবেশ একটি ছবির আবেদনকেও সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। পিকাসোর স্টুডিওতে আমার শরীরে জড়ানো স্বচ্ছ মসলিনকে কী পবিত্র লাগছিল! অথচ এখন তা কীরকম অশস্নীল দেখাচ্ছে। আববু বললেন, ‘ছবিটা চিনতে পারছ? এটি বিক্রি হচ্ছিল। আমি কিনলাম।’

 

সাত

এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। ঘটনার পরপর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আববু লন্ডনে নিয়ে এলেন চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসকদের মতে আমি ক্রনিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। এরপর আর দেশে ফিরিনি। পিকাসোকে এড়িয়ে যাওয়ার সব পন্থাই অবলম্বন করি। কিন্তু আমার জীবন আর আগের মতো থাকেনি। এখলাসের হাতে আমার ছবিটি দেখার ঠিক সেই মুহূর্তটির পর থেকে। সে-সময়টায় আমার ঠিক কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা এখনো মনে করতে পারি না। ওটি আমার জন্য একটি বস্ন্যাক-আউট সময়। কিন্তু ক্যানভাসটি নয়। পিকাসো এরপর থেকে হঠাৎ-হঠাৎই আমার স্মৃতিতে ধুপ করে ভেসে উঠত। আমার একা থাকার মুহূর্তগুলোতে এমনটি হলে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। একটা বোবা কান্নার ঘূর্ণিঝড় আমার ভেতরটা বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। সেই ঘূর্ণিঝড়টা ফিরে এলেই দেখতে পেয়েছি একটি ক্যানভাস। সেখানে আমার ছবি। একটি বিক্রীত বিশ্বাস। পিকাসো আমাকে প্রচ-রকমভাবে মানুষকে ঘৃণা করতে শেখাল। আমি আর এরপর কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি।

আট

লন্ডনে এসে এ-লেভেল শেষ করে পুরাতত্ত্বের ওপর পড়াশোনা শেষ করলাম। আববুর পছন্দমতো বিয়ের আসরে বসে পড়লাম। লন্ডনে ওদের বিরাট পারিবারিক ব্যবসা। কাঁচা সবজি আমদানি আর রেস্টুরেন্টের। দুই প্রজন্মের ব্যবসা। দ্বিতীয় প্রজন্ম আমেরিকা থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। এক-একটা চেকমার্ক দিয়ে গেলে আমার বরের সবই আছে। টাকা, ডিগ্রি, চেহারা-সুরত – সব। কিন্তু নীরবে যে ব্যাপারটা একটা মানুষকে গড়ে তোলে তা হচ্ছে সেই চিরাচরিত পরিবেশ। আমাদের দুজনের বেড়ে ওঠার সেই পরিবেশটা খুব ভিন্ন ছিল। সে চেয়েছিল আমি শুধুই মিসেস সবজিওয়ালা হয়ে থাকি। তাতেও আমার খুব একটা আপত্তি ছিল না। আমি তো আর খুব ক্যারিয়ারিস্ট মহিলাদের আশপাশে দেখিনি। দেখেছি মামণির মতো মিসেস হাই, মিসেস রবদের। তারা সবাই সুন্দর-সুন্দর বাড়িতে থাকে, বাচ্চাদের দেখাশোনা করে আর সময়মতো পার্টি করে। এরকম জীবনের ব্যাপারে আমার তেমন আপত্তি ছিল না। সমস্যাটি ছিল অন্য জায়গায়। তাই আর আমাদের একসঙ্গে থাকা হলো না। সেপারেশনে চলে গেলাম। সরকারি একটা জাদুঘরে কিউরেটরের চাকরি পেয়ে গেলাম। তেমন আহামরি বেতন না – তবে কাজটায় অনেক মজা আছে। অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া যায়। বিশেষ করে শিল্পীদের সঙ্গে। এই চাকরিতে আমার একার ভালোই

চলে যায়। আববু বিষয়টি একদমই পছন্দ করেননি। ডিভোর্সের আগ দিয়ে মামণি এসে একটা শেষ চেষ্টা করেছিল আমাদের মিলিয়ে দিতে। পারেনি। তবে সেবার মামণির সঙ্গে খুব খোলামেলা আলোচনা হয়। জীবনে প্রথমবারের মতো। হয়তো এটাই শেষ।

‘সাফা, তুই এভাবে চলে আসলি অথচ জামাই এখনো তোর ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। কোনো শর্ত ছাড়াই। কই জামাইয়ের কী বিরাট প্যালেস আর কই তোর এই এক বেডরুমের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট! একেবারে আগরতলা আর জুতোরতলা। এটা কোনো একটা জীবন হলো?’

‘মামণি তুমি বাবুই পাখি আর চড়ুই পাখির গল্পটা জানো না? এটা হলো আমার বাবুই পাখির জীবন। নিজের তৈরি করা ভুবন। যেমনই থাকি নিজের পছন্দ-অপছন্দ আর মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বাস করার বাধ্যবাধকতা এখানে নেই।’

‘জামাইয়ের কী অপরাধটা শুনি? একবার একটা পুলিশি কেসে নাম জড়াল তো সব শেষ? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি শুধু সুসময়ের বন্ধুর মতো যে, একবার কেউ বিপদে পড়লে তাকে ছেড়ে চলে আসতে হবে?’

‘মামণি, এটি শুধুই একটা পুলিশি কেস নয়। আমি ওর দিকের সাইড টেবিলের ড্রয়ারে একটা ড্রাগের প্যাকেট দেখতে পেয়েছিলাম। তার থেকেও বড় কথা, যখন আমি প্যাকেটটা নিয়ে তোমাদের জামাইকে প্রশ্ন করলাম তখন সে বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করল। আমি অনেক প্রমাণ পেয়েই নিশ্চিত হয়েছি যে, সে এখন ড্রাগের ব্যবসাও শুরু কয়েছে। তাকে শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হয়নি কারণ ওরা সেটা কোনোভাবে ম্যানেজ করে ফেলেছে। সব লেভেলেই ওদের কানেকশন আছে।’

‘ওরকম সৎ মানুষের বউ হতে চাইলে আমি বলব তুই এখনো রূপকথার রাজ্যে বাস করছিস। তোর বাবার অনেক কিছু মেনে নিয়ে আমি কি তার সঙ্গে সংসার করে যাইনি?’

আরো দশ বছর আগে আববু সম্পর্কে এরকম কিছু বললে আমি সেটি মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু এখন বেশ বুঝে গেছি একই পুরুষের এক বাবা আর আরেক স্বামী হিসেবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সত্তা থাকতে পারে। কারণ দুটি সত্তাকে দেখা হয় দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাবাও কখনো-কখনো হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম স্বামী। আমি জানি, মামণি অনেক কিছুই মেনে নিয়েছে। এই যেমন রমিতা অ্যান্টির ব্যাপারটি। আববুর সঙ্গে মামণির এই নিয়ে অনেক ঝগড়া হতো। কিন্তু মামণি কখনোই সেই চড়ুই পাখির রাজপ্রাসাদের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে পারেনি। এখানে প্রশ্নটা কে ভুল কে ঠিক তা নিয়ে নয়। সবারই নিজেদের পছন্দ মতো জীবন গড়ে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। আবার স্বাধীনতার সঙ্গে ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি চলে আসে। মামণি আগের প্রজন্মের। তার হয়তো এই ক্ষমতায়ন প্রয়োগের সামর্থ্য ছিল না। আমার আছে। আমি কি তা করব না?

‘মামণি, তুমি তো নানির মতো জীবন কাটাওনি। ক্লাব করেছ, পার্টি করেছ। তোমার নিজেরও একটা হিসাব ছিল। একপালস্নায় ছিল আববুর প্রতি তোমার যত অভিযোগ আর অন্য পালস্নায় ছিল আববুর তৈরি করে দেওয়া স্বাচ্ছন্দ্য আর স্ট্যাটাস। তুমি দ্বিতীয় পালস্নাটি বেছে নিয়েছ। সেটি ছিল তোমার সিদ্ধান্ত, তোমার জীবন। এটি ২০১৩ সাল। আমি তো তোমার জীবনের কার্বনকপি হতে পারি না। ঠিক তুমি যেমনটি হওনি নানির জীবনের। তোমার মতো হিসাব কষার আমারও দুটো পালস্না আছে। প্রথম পালস্নায় তোমার জামাইয়ের প্রতি অভিযোগের পাশাপাশি আমি আরো চাপাচ্ছি স্বাধীনতাবোধ, আত্মসম্মানবোধ, এথিক্স। দ্বিতীয় পালস্নার স্ট্যাটাসের থেকে আমার জীবনে প্রথম পালস্নাটা যে অনেক বেশি ভারী মামণি, তাই আমার সিদ্ধান্তও অন্যরকম। তুমি তোমার জীবনে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তার ব্যাপারে আমি কোনো জাজমেন্টাল হচ্ছি না। আমি শুধু চাইছি আমাকে তোমার জামাইয়ের কাছে ফিরে যেতে আর অনুরোধ করো না।’

মামণি এবার হাল ছেড়ে দিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কখন আবার বিয়ে করবি? সময় তো চলে যাচ্ছে। কবে আবার মা হবি? বাচ্চাকাচ্চা না হলে বুড়ো বয়সে একা-একা হয়ে পড়বি।’

‘তোমার তো দুটো বাচ্চা ছিল। তারা তোমার একাকিত্ব কাটাতে পারছে? এই আমি তোমার থেকে অনেক দূরে লন্ডনে বসে আছি। ভাইয়া তো ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। আর ভাবি দোতলা থেকে গুনে-গুনে তিনবার একতলায় নামবে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার। সকালে ফ্রুট স্মুদি, দুপুরে চিকেন স্যালাড আর রাতে স্যুপ। সেটার ব্যবস্থা আবার তোমাকেই করে দিতে হয়। সারাদিনে কয়টা কথা বলতে পারো ভাবির সঙ্গে?’

না, এভাবে বলাটা হয়তো আমার ঠিক হলো না। নিজের কাছেই কেমন যেন ননদীয় কুটনামি শোনাল। আর মামণিও খুব আহত হলেন। আমরা এ-যুগের আত্মকেন্দ্রিক সন্তান। আমাদের জন্য ওনাদের কত আত্মত্যাগ ছিল। তার বিনিময়ে কী পেলেন? আগের প্রজন্মকে দেখে আমরা এখন নিজেরা সাবধানি। বাবা-মায়েদের আত্মত্যাগটা তো আসলে এক ধরনের বিনিয়োগ : সন্তানদের দুর্বল সময়ে আমরা ছিলাম, আমাদের দুর্বল সময়ে ওরা থাকবে। জীবনের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে যাওয়াতে আগের সেই বিনিয়োগ সিস্টেমটা এখন প্রায় ভেঙে পড়ার দশা। যারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে তারা খুব ভেবেচিমেত্ম সন্তান নিচ্ছে। আমাদের এই প্রজন্মের নারীদের খুব স্বার্থপর বলা হয়। কিন্তু আমরাই পারছি বুড়ো বয়সে ওরা আমাদের দেখবে না সেটি মাথায় রেখে সন্তান পালন করতে। সত্যিকারের আত্মত্যাগ এটিই। যারা এই ত্যাগে বিশ্বাসী নয়, তারা সন্তান নেবে না। এ-কথাটি এখন বললে মামণি আরো মন খারাপ করবে। তার থেকে বরং মামণির মন ভালো করে দেওয়ার চেষ্টা করি। মামণির কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এখন আমরা ডিভোর্স করি সামনের দিনগুলোতে আরো ভালো থাকব বলে, দুঃখ পুষে জীবনটা শেষ করে দেওয়ার জন্য নয়। দেখো তোমার সবজিওয়ালা জামাইও তার মনের মতো বউ পেয়ে যাবে আর আমিও খোঁজ পাব আমার স্বপ্নের পুরুষের।’

মামণি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসলেন। আমি বললাম, ‘হেসো না মা, বুড়ো বয়সে স্বপ্ন দেখতে নেই? অল্প বয়সের প্রিন্স চার্মিং একটি অলীক ধারণা। এই বয়সেই বরং আমরা সত্যিকারের রক্তমাংসের স্বপ্নপুরুষ রচনা করতে পারি। তুমি শুধু আমার জন্য তোমার শুভকামনা রেখো।’

নয়

এই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের আমার এই জীবনটা কখনো যে থমকে দাঁড়ায় না তা নয়, তখন নানাভাবেই এই জীবনকে গতিময় করে তুলি। মিটআপ গ্রম্নপে আমাদের বান্ধবীদের দলটি সুযোগ পেলেই ইউরোপের কোনো দুর্গম অঞ্চলে চলে যাই। গত বছর ঠিক করেছিলাম সবাই মিলে ভারত যাব। পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত। ভারতে মহিলা ট্যুরিস্টদের ওপর যেরকম ধর্ষণের কাহিনি প্রচার পাচ্ছে তাতে আর আমাদের সাহস হয়ে উঠল না। ট্রেসি খুব মজা করে বলে, ‘তোমরা এশিয়ানরা আসলে খুব হিপোক্রেট। পশ্চিমাদের খোলামেলা জীবন নিয়ে তোমরা খুব সমালোচনা করো। আর এখন ট্যুরিস্টরাও তোমাদের ওখানে নিরাপদ নয়। না জানি ঘরে-ঘরে কী হয়। তোমাদের শুধু খাবারই অভাব না, সেক্সেরও অভাব। নইলে সবাই এরকম হামলে পড়ে ধর্ষণ করে কেন?’

ট্রেসি আমার খুব ভালো বান্ধবী। আবার সহকর্মীও। এ-বিষয় নিয়ে ওর সঙ্গে আর তর্ক করি না। করলে সেটা হিপোক্রেসি হতো। বাংলাদেশের কথাই ধরি, এখানে মানুষের অভাব নেই, কিন্তু যৌনকাতর মানুষের সংখ্যা অগণিত। একটু ভিড় বা আড়ালের মধ্যে সেসব মানুষের ক্ষুধার্ত হাতগুলো পিপাসা মিটিয়ে নিতে চায়। তবে সমাজের ওপরতলা আর নিচের তলার হিসাব কিছুটা আলাদা। মাঝখানের মানুষজনেরা পড়েছে বেশি বিপদে। চাকরি না হলে তারা বিয়ে করতে পারে না। বিয়ে না করতে পারলে ক্ষুধা মেটাতে পারে না। তাই তাদের চুরি করতে হয় বাসের ভিড়ে, ডাকাতি করতে হয় বাসার দুর্বল কাজের মেয়ের ওপর হামলে পড়ে। বিবাহিত মানুষজনেরাও কি ধোয়া তুলসীপাতা? অপরিতৃপ্ত হৃদয়ও ক্ষুধার্ত রয়ে যায়। যেনতেন রেসিপিতে কার মন ভরে? হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মেটে না। না, এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না। পুরুষদের থেকেও ভয় নারীকুলের তীব্র সমালোচনা। তারা শুধু মনে করে দশ রকম পদ রেঁধে পুরুষের পেট ভরিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করতে হবে। এর বাইরে আর নতুন কোনো পথের সন্ধান তারা চান না। তবে ট্রেসির সঙ্গে নিজের দেশের সমালোচনা করতে চাই না। কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠি, ‘এখানেও তো ধর্ষণ হচ্ছে। তার কারণ কী?’

‘সব দেশেই কিছু না কিছু সেক্স ম্যানিয়াক থাকে। এখানে সাবওয়েতে তো নিয়মিত চড়ছো। তোমার কি মনে হয়েছে একটু ভিড়-ভাট্টা হলেই ছেলেরা মেয়েদের শরীরে হাত বুলাতে চাচ্ছে?’

এজন্যেই ট্রেসির সঙ্গে আমি তর্কটা করতে চাই না। ওর অনেক পড়াশোনা। ওর সঙ্গে-সঙ্গে আমিও একটা বুকক্লাবের মেম্বার। আমরা অনেক কিছুই একসঙ্গে করি। চাকরির জায়গায় আমাদের দুজনের শিফট দুই-একটা বিশেষ দিনে আলাদা হয়ে যায়। যেমন আজকে ওর দিনে আর আমার বিকালের শিফট। কিছুক্ষণ আগে আমাকে সে ফোন করে বলল, প্যারিস থেকে গতকাল যে শিল্পী এসেছেন তার ওপর ট্রেসির ক্র্যাশ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অন-এয়ারে বিবিসি থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করা হবে। আমাকে অবশ্য বিকেল থেকেই সে-শিল্পীর সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। গ্যালারিতে তাঁর চিত্র-প্রদর্শনীর দায়িত্ব আমার।

দশ

সকাল আর দুপুরের খাবারটা আজকে একসঙ্গে প্রস্ত্তত করে নিলাম। আট আউন্স এলমন্ড দুধের সঙ্গে এক টেবিল চামচ অরগ্যানিক প্রোটিন পাউডার, একটা কলা আর আধ কাপ ওটমিল। সবকিছু একসঙ্গে মিলিয়ে লাই বানিয়ে নিলাম। এখন বেলা ১২টা। রাত ৮টা নাগাদ এই দিয়ে বেশ চলে যাবে। বাসার মধ্যে খুব একটা রান্নাবান্না করা হয় না। উৎসাহও নেই, পারিও না। আমার বিয়েটা না টেকার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল। লন্ডনে জন্ম, লন্ডনে বড় হয়েছে, তারপরও বাঙালি বউ দশ রকম মিষ্টি বানাতে জানে না সেটি তার কাছে একটি বিস্ময় ছিল। আমার পছন্দ গ্রিন টি। গ্রিন টির কথা মনে হতেই মাথার মধ্যে কী জানি ক্লিক করে উঠল। রিমোটে বোতাম চেপে চ্যানেল সচল করলাম, যা ভেবেছিলাম তাই। সেই-ই। পিকাসো। মাথায় টাক পড়েনি, একটুও মোটা হয়নি। বয়স কেন মানুষকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে? সময় কেন ঘৃণার তেজ মিইয়ে দেয়? নাকি আমার মধ্যে দার্শনিক-উদারতা ভর করেছে? সাক্ষাৎকারটা মাঝপথে। উপস্থাপক জিজ্ঞেস করছেন, ‘তারপর আপনার সেই অনুপ্রেরণার সঙ্গে আর দেখা হয়নি? কোনো যোগাযোগ হয়নি?’

‘না, যেভাবে আকস্মিক সে আমার জীবনে এসেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ করেই সে হারিয়ে যায়। তার বাসায় অনেক চিঠি লিখেছিলাম। কোনো চিঠির উত্তর পাইনি। ফোন করেছিলাম। তার পরিবার থেকে জানিয়েছে, সে আর আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না।’

‘তাঁর কোনো চিহ্ন নেই?’

‘আমি তার একটাই ছবি এঁকেছিলাম। কিন্তু সে-ছবিটা আমার স্টুডিও থেকে চুরি হয়ে যায়।’

‘আপনি কি তার জন্যই অবিবাহিত থেকে গেছেন?’

‘আসলে উত্তরটা আমি নিজেও জানি না। আমার সংগ্রামের সময়টাতে অনুপস্থিত থেকেও সে আমাকে যেভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, সে-সময় হাত ধরে দুজন পাশাপাশি চললে এর হিতে বিপরীতও হতে পারত। যে-স্পেসটা আমি পেয়েছি সেটি হয়তো পেতাম না। ও খুব স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছে। আমার সেই সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে সে মানিয়ে নাও নিতে পারত।’

‘আর এখন যদি তার দেখা পান?’

‘সে হয়তো এখন বেশ সুখে আছে। হয়তো তার দুটি সন্তান আছে। ওদের কাছে সে আমার থেকেও বেশি জরুরি। আমি শুধু ওকে একটাই প্রশ্ন করব, আমার কী অপরাধ ছিল?’

সেলফোনটা বেজে উঠল। ট্রেসির ফোন। ধরলাম না। থাক ট্রেসি ওর ক্র্যাশ নিয়ে। আমার কিছুটা সময় একা থাকার দরকার। অনেক বছর ধরে বুকের ভেতর আটকে থাকা এক বোবা কান্নার ঘূর্ণিঝড় দমকা বাতাসের মতো বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ভার নেমে গেলে যেরকম হালকা বোধ হয়, আমার সেরকম হচ্ছে। আববু তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের বিচ্ছেদ পিকাসোকে শিল্পী বানিয়েছে আর আমি পুতুল থেকে হয়ে গেছি সত্যিকারের মানুষ। এই পিকাসো একদিন আমাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিল, আবার আজ এই পিকাসোই আমাকে ক্ষমা করতে শেখাল।

এগারো

আমি এখন গ্যালারিতে ছুটছি। আজ পিকাসোর সঙ্গে আমার অনেক বোঝাপড়া আছে। আমার জীবনটা তো একটা সাদামাটা ক্যানভাস হতে পারত – দুলাইনেই যার গল্প শেষ। পিকাসো সেটি হতে দিলো না। বারবার সেখানে সে রঙের আঁচড় বুলিয়েছে। আমি ভালোবাসতে জানলাম; সাহসী হতে শিখলাম; প্রেম বুঝলাম; ঘৃণা, অবিশ্বাস আর ক্রোধে ফেটে পড়লাম; ক্ষমার মাহাত্ম্য অনুভব করলাম – সব শেষে জানলাম মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত