ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে বাঁয়ের অপূর্ব দৃশ্যাবলি দেখতে-দেখতে মোবাইলে ছবি তোলে আরোহী দুই নারী। শহুরে তারা। রিজার্ভে যাচ্ছে! ভ্যানচালক তাদের প্রফুলস্নতায় খানেক ধুমো দিয়ে ভ্যান থামায়, – তোলেন, নেইমে শামিত্ম কইরে ছবি তোলেন আপা! সালোয়ার-কামিজের মহিলারা লাফিয়ে নামে। বসন্তমেদুর আকাশের নিচে কী অপূর্ব দেশ, তাই দেখে। সবুজ আর সবুজ। পিচঢালা রাস্তার গা-ঘেঁষে ঠোঁট নাচিয়ে উদ্ভাসিত ভাঁটের হাসি, আহা মরি মরি!
টাপা ভ্যানে চড়ে ওরা ফিরছে আট কবর থেকে দুপুরের একটু আগে। আট কবর নামেই পরিচিত স্মৃতিসৌধটা। সম্মুখ সমরে তাঁরা শহিদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, তাঁরা তখন কিশোর ছিলেন, দুরন্ত বয়সে প্রাণ দিয়েছিলেন দেশ বজ্জাতমুক্ত করতে, মুক্তদেশে সুস্থভাবে বাঁচতে। ভ্যানে উঠতে গিয়ে দেখে দুজন পর্দানশিন মহিলা ভেতরে চুপটি করে বসে আছে, একে ঘাপটিও
বলা চলে। একটুখানি ছইয়ের ভেতর জায়গা অল্প, তাতেই বহাল আছে তারা। ভ্যানওয়ালা তাদের নিতেই চায়নি,
– এরা শহুরে মানুষ রাগ করবে গো, তোমরা অন্য ভ্যানে আসগে!
– অল্প একটু বাবা, ভ্যান তো পাইচি নে, দুপুরবেলা অনেকক্ষণ দেঁড়িয়ে আছি!
অগত্যা…
ভ্যানে উঠতে গিয়ে অবাক, অস্ফুট বলে ওঠে একজন – এরা এলে কোথা থেকে!
ইতস্তত করে ভ্যানচালক,
– এট্টুখানি যাবে, তুইলে নিলাম আপা! সামনেই নেইমে যাবে! ভ্যান পাচ্চে নাকো!
হাসিতেই জয় করে নিল চালক। গুঁতিয়ে-গাতিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢোকে একজন। বসতে গিয়ে দেখে বসার জায়গাও দখলে নিয়েছে একটা ছোট বস্তা। বস্তায় হাত দিয়ে বলে, কী ওতে, নারকেল?
ঘোমটার তল থেকে বলে ওঠেন – না, বাতাবিনেবু।
– বাপরে, এত বড়!
– আপনি একটা নেবেন? নেন।
– নিতে পারি যদি দাম নেন। ভ্যান চলতে থাকে। শহুরে মহিলা একজন জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছেন? মহিলা ঘোমটা অর্ধেক ফেলে প্রশান্ত উজ্জ্বল মুখ
বের করে বলে, মেয়ের বাড়ি, নাতিটা নৌকাডুবিতে বেঁইচে গেছে, তারে দেখতি যাচ্ছি।
– কোথায়?
– রসিকপুরে, বাগোয়ান। আপনি কিন্তু একটা বাতাবি নেবেন!
– আমি তো নেবই, নাতির বয়স কত?
– আশ্বিন মাসে দশ বচ্ছর হবে।
– সাঁতার জানত না?
– না, জানত না, জানবে কেমন কইরে, দেশে কি এতকাল পানি ছিল? টিউবওয়েলের লাল বিতিকিচ্ছিরি পানি, তাও চোত-বোশেখে অন্যের টিউবওয়েলে যেতে হয়, পাইপ পানির নাগাল পায় নাকো। বর্ষায়ও পুকুরে একফোঁটা পানি নেইকো, পুকুরের মধ্যিখানে জঙ্গল হয়ে মেছোবাঘ থাকার দশা, এবার যে কতকাল পর পানি দেখলাম! অন্যবার নদীতে ভরা বর্ষায় মাঝখানটায় একটু প্যাক থাকে, সাঁতার কেমনে শিখবে, প্যাকে কি সাঁতার কাটা যায়! আপনারা এদিকপানে কই যাবেন আপা?
– মুজিবনগর।
এতক্ষণ অন্য মহিলা কথা বলেননি। বিশাল ঘোমটার আড়ালে মুখটাও দেখতে দেয়নি। এখনো আড়াল থেকেই তিনি অনুযোগের কণ্ঠে বলে উঠলেন, ভৈরবে পানি হয়ে কী লাভ হলু, আরেটটু হলি তো নাতিন ছাওয়ালটা ভেসে যেত। আবার পাড় কাইটে নদী চওড়া করতেছে, লোকে পাড়ের গাছগাছালি কাইটে সুমুর কইরে দিচ্ছে!
– দুটো মেয়ে মারা গেছে না এই নৌকাডুবিতে?
– আহা, সক্কাল বেলা নদীর পাড় ভাইঙে মানুষ দেঁড়িয়ে ছিল লাশ উঠাবার সময়, কেউ আশা কইরে ছিল বাঁচে নাকি থাকতেও পারে!
– চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা পর! কীভাবে?
– আশা করতি অসুবিধা কী? নেহাত দুর্ঘটনা তো নয়! এই যে এত পানি, এতকাল পর, সেইটাই বা কিসের ইশারা! বোঝা দায়।
সত্যি কথা এবার নদীতে পানি, শুধু পানি কেন, রীতিমতো জোয়ার-ভাটা দেখে বিস্মিত মানুষ। মরা নদীটা কোনো এক জাদুবলে প্রাণ ফিরে পেল! কিন্তু অনেকেই ভেবে পেল না, নদী ড্রেজিং করতে পাড় কাটবে কেন, ভয়ে তাই আগেভাগে গাছ কেটে ফেলছে পাড়ের লোকেরা। বলা তো যায় না পাড়ের সঙ্গে গাছও কেটে নিয়ে যায় কি না!
পথে মহিলাদ্বয় নেমে পড়ল। বাতাবিনেবুর টাকা দিতে গেলে আত্মপ্রত্যয়ী স্বর, দশ টাকার বেশি নেব না কিন্তুক, টাকা না নিলি জিনিস নেবেন না, তাই নিলাম। গাছের জিনিস এমনি লোকে কত চায়ে নিয়ে যায়, না বলার অভ্যেস নেই কো…, কাউকে না বলি না!
বিশাল এক নেবুর বিনিময় এত কম দাম হয় কেমন করে, ভাবতে-ভাবতে একজন বলে ওঠে, গুলশানে এর দাম একশ তো হবেই! নিনা, এক কাজ করি চল, ঢাকায় গিয়া গুলশানে উহাকে বেচিয়া দিয়া ফরমালিনসমৃদ্ধ এক কেজি পেয়ারা কিনিয়া লইব, বাহির পানে টসটসে, ভিতরপানে বিশুষ্ক… পদ্মার চর!
– সবুজের আঁচ লাগলে সত্যি কথা নেচে ওঠে, না!… হা হা হা। সবুজের পানে…।
একই দুর্ঘটনায় মহিলার নাতির বেঁচে যাওয়া আর দুদিন আগের ভৈরবে মেয়েদুটোর মৃত্যু মনে এলো ভ্যান কেদারগঞ্জ হয়ে মুজিবনগর মোড় নেওয়ার আগে। মাত্র দুদিন আগের কথা, পত্রিকায় পড়েছে – ‘মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার রসিকপুর খেয়াঘাটে নৌকাডুবিতে দুই স্কুলছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার, সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় ডুবুরি বেলস্নাল হোসেন ঘাটের অদূর নদী থেকে রসিকপুর গ্রামের ববিতা খাতুন ও তানিয়া খাতুনকে মৃত উদ্ধার করে, তারা বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। নৌকা রোববার বিকেলে ডোবে, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌকা ডোবার কারণ বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মত… মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজের সঙ্গে-সঙ্গে উদ্ধার অভিযান চলে, রাতে বন্ধ থাকে, সকালে আবার অভিযান শুরু হয়… সকালে…।’
দুই
বিকেলে নৌকা ডোবার সময় শ্যামল কেবল মাছ বিক্রি করে ক্যারিয়ারে হাঁড়ি-বাঁধা সাইকেলটা নারকেল গাছে হেলান দিয়েছে কি দেয় নাই, তখনি হইহই রব। না, ফেরার পথে মেঘের ছায়াও গায়ে পড়ে নাই কো, এক টুকরো ওড়া মেঘও তো দেখেনি টুপলার বিল পেরোতে! তো কী হলো ঝড় বই!
– শ্যামলা কীভাবে উঠাবে গো! ও তো ডুবুয়ে-ডুবুয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছে!
– আমি চুল ধইরে প্রায় তুইলেই ফেললাম জল থেইকে কিন্তুক নিচ থেকে টাইনে ধরে রাখছে, আমি তার সঙ্গে পারব কেমনে! বলেন, কেউ কি তা পারে?
হালদারের কথা কয়টা ঘিরে ধরে গ্রামবাসী।
শেষ পর্যন্ত ডুবুরিরাও অকৃতকার্য!
কে একজন বলে ওঠে, তেনার ইচ্ছা কী? তিনি ইচ্ছা করলেই দুটো আবিয়াত্তা মেয়েরে পানির তলে আটকে রাখতে পারেন না! সরকার নদী কেইটে যে অবিচার কইরেছেন, তিনিও তেমন অবিচার করতে পারেন না!
সরকার আর অদৃশ্য শক্তি, দুইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় বাগোয়ান রসিকপুরে মানুষ হতবিহবল। ঝঞ্ঝাপীড়িত এক উপদ্রুত লোকালয় যেন। ঝড় থেমে যাওয়ার পর তা-বে মানুষ যেমন অভিভূত তেমন।
অমাবস্যারাতে মারেফ ম-লের উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শ্যামল হালদার সন্ধ্যার কথা কয়টা ফের বলে ঈশ্বরের উদ্দেশে বুকে কপালে হাত ছোঁয়ায়। মাছ ধরা বেচা হালদারের পেশা, পিতৃপুরুষদের ধর্ম পালটে গেলেও পদবি কি পেশা এখনো মজুদ আছে। ছোটখাটো মজবুত গঠন। পঞ্চাশের অল্প কিছু বেশি বয়স। সেও আজ ডুবুরিদের সঙ্গে নেমেছিল পানিতে আশা নিয়ে, কিছু করে দেখাবে। কিন্তু অনভ্যাসবশত পাড়েই সে চেষ্টা চালিয়েছে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে। ভৈরবের কিঞ্চিৎ রূপ দেখেছে বইকি ছেলে বয়সে। নৌকায় চড়ে বাপের সঙ্গে মাছ ধরেছে ভৈরবে, সাঁতারে দারুণ পটু ছিল একদা। এখন হাঁড়িতে করে চাষের জ্যান্ত মাছ বেচে।
শ্যামলের কথাটা কারো-কারো কানে নির্মম লাগে কিন্তু শোকাতুররা চুপ থাকে। ফিসফিস সামান্য, তানার ভাব আমরা কি বুঝি!
ঘোর কেটে গেলে শ্যামল অন্ধকারে যেন পালাতে চায় যাবতীয় কথা থেকে, এসব সে বিশ্বাস করে না, কোনোকালে করতও না; কিন্তু সত্যি তো নিচের থেকে কে প্রবল শক্তিতে টেনে ধরে ছিল! প্রাণপণ চেষ্টা বৃথা গেছে। কয়টা চুল ছিঁড়ে হাতে উঠে এসেছিলও তো!
শ্যামল বলে, সকালে তো ডুবুরিরা আবার নামবে তখন কী হয় দেখি!
– কী হবে? মরা লাশ পাবানে গো, মরা লাশ পাবানে!
– ডুবুরিরাও তো অজায়গায় ডুবুয়ে-ডুবুয়ে রাত করলু, বললু, সকালে আলো ফুটলে চেষ্টা করবেন, বলি মেয়েদুটো কি জলের তলে পাতালের রাজপারসাদে হাসিখেলা করে কাটাচ্ছু!
অন্ধকারের দিকে মুখ করে সিগরেট ফোঁকা মারেফ ম-ল ঘুরে তাকায় কথা কটা বলে। পকেট থেকে খিলাল বের করে নিবিড় হাতে দাঁত খোঁচায়। খাসির মাংসটা আজ ভালো রান্না হয়েছিল। পোলট্রি সে খায় না কোনোকালেই, নাকে বাস লাগে। থুথু ফেলে মুখ ভোচকায়, সাজানো দাড়িতে হাত বোলায়।। তারপর বলে, ত্রিশ বছর যে-নদীতে পানি নেই কো, সেথায় পানির ধারার দরকার কী পড়ল? কারে খুশি করতে? পাড়ের গাছ কাটল লোকে বাধ্য হয়ে, পাড় কাটে ফেললে গাছ না কাইটে কী করবে? এখন এই যে মেয়েদুটো হারাল নৌকা উল্টে, তার দায় তো কাউকে নিতে হবি, নাকি?
– কে কোনকালে কার দায় নিছে? ওই যে খবরে কবানে, একলাক টাকা করে দিব পরিবারকে, খুশি থাক, খুশি না থাকে যাবে কুতায়!
– খবরে বেরোবে লাক। হাতে পাবে কপাল ভালো থাকলে দশ কি পনারো, পাঁচও হতি পারে, এর বেশি নয় কো!
– নদী কেন কাটবে? নদী হলো গিয়ে আলস্নার দান, তিনি দেবেন তিনি নেবেন, এখানে হাত লাগানো মানে তো খোদার ওপরে খোদকারি। মারেফ ম-লের জ্ঞানী বয়ান।
থুথু ফেলে ফের মারেফ ম-ল বলে, ভারত যে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখল, তারে কিছু কতে পারল না! খালি আমাগের ভোগামিত্ম! গাঙের মাটি কাটা ভালো কথা নয়। মেয়েদুটোর এখন কী হবে, শেখের বেটি আসুক, পানি থেকে ওদের তুলে আনে দেখাক কেমন সে পারে! আমরা কিছু চাই না কো আর। নারী হওয়া নারীর মান তিনি রাখুন!
ঘাটের কাছে ছাতিমগাছের নিচে দাঁড়ানো ববিতার ছোটখালা সাবেরা বেগম তেনার কথা ভাবছেন, তেনার তো অনেক শক্তি, তো তিনি ইচ্ছা করলে কাল সকালেও তাদের জীবন্ত ফিরিয়ে দিতে পারেন, এখানে হাসিনা কি খালেদার ভূমিকা কী সে ভেবে পায় না। শ্যামল তো বলেই দিয়েছে তিনি নিচ থেকে টেনে রেখেছেন! পানির তলে শুনেছে খিজির আলাইহে সালস্নামের ঘরবাড়ি আছে! সেথায় কী হচ্ছে কে জানে! আর একটা কথা, বারবার নদী কাটার কথা হচ্ছে, তো নদী কাটবে, কাটছে, পাড় কাটার কথা তো হচ্ছে না! অথচ সারা গাঁয়ে মারেফের লোকজন বলে বেড়াচ্ছে, সরকার পাড় কাটবে, গাছ কাইটে ফেল! মানুষ পাগলের মতো গাছ কাইটে যাচ্ছে। সত্যিই কি তবে প্রাণ পাওয়া নদী প্রাণ চায় তরুণীর, কিশোরীর কিংবা বালকের! নতুন করে খনন করার জন্য তার পাওনা! কত গল্প শুনেছে ছেলেবেলায় এমন, প্রাণ না দিলি দিঘিতে পানি উঠবে নাকো! এখন তো গল্পও নেই, গল্পের সময় সিরিয়াল গিলে নিয়েছে! গাঁয়ের রাস্তায়ও সিরিয়াল কি গুঁড়া সাবানের অ্যাডভারটাইস!
অমাবস্যার রাতে নদীর কালো টলমল পানি বয়ে যায় বহু বছর পর। নদীর মাঝখানে এতকাল ধানের বীজতলা হয়েছে। এমনকি ভরা বর্ষায়ও পাট ভেজাতে পারেনি নদীতে। এখন স্রোত, ঘূর্ণিস্রোত নৌকা উল্টায়, ভৈরব নদ তরুণী চায়! যেসব প্রত্যক্ষদর্শী বলেছে নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল, তারা এখন নীরব। নৌকা ডুবতে না দেখা লোকেরাই বরং বেশি বলে, একটা ঘূর্ণি দিয়ে নাবিয়ে নিয়েছে গো! স্রোতখানা দেখবেন না! এইটেই তো চাওয়া হয়েছিল, হলো!
তবে দ্বিমত করার লোকও আছে বইকি! দারিয়াপুর মোনাখালির ব্রিজ এতকাল খালি-খালি খটখটে নদীর ওপর অকম্মার মতো বাস-ট্রাক বুকে নিয়ে চলেছে। নদী না ছাই! নদীর পানে চাইতেই ইচ্ছে করেনি, কি ছিরি… খুব বেশি হলে চোখে মিলবে রসশূন্য হাড়-জিরজিরে ল্যালব্যালা ধানের বীজতলা। এখন নদী কি ব্রিজ নিশ্চয় খুশি থাকবে, নিচপানে তাকানো লোকগুলো যখন বলে উঠবে, ওরে বাসরে, চায়ে দেখ, কী স্রোত!
– খাল কেটে কুমির আনেছে! কে যেন বলে ওঠে।
মারেফ ম-ল সায় দেয়, পাড় কাটবে আবার পাড়ে ভাঙন লাগবে, তেবে না জনগণে বাঁশখান ঠিকমতো দেওয়া যায়। পারে তো খালি ফাঁসির দড়িগাছা লইয়া…।
চারপাশে তাকিয়ে কী কারণে থেমে যায়। হয় তার কথা বোঝার লোক ধারেকাছে নেই অথবা ব্যবসার মৌসুমে চুপ থাকাই বুদ্ধির কাজ।
হিসাব মুন্সি কাতর ছিল নিজ স্কুলের কন্যাদের জন্য। অন্ধকারে ঘাটের অদূরে দাঁড়িয়ে স্বজনের মতো নদীর পানে তাকিয়ে থাকে। যদি কন্যারা ভেসে ওঠে! নদীপানে চেয়ে ভাবে তারও তো কথা আছে! বলতে চায়, খাল কেটে কুমির তো কত জনাই আনে! তাই বলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে মানুষ! জনশ্রম্নতির কথাই যদি ধরি তো এই বাগোয়ানেই তো গোয়ালা চৌধুরীর বাড়িতে ডাকাতি করতে এসেছিল বর্গিনেতা রঘুজি ভোঁসালা, ত্রাসের ত্রাস! পথ দেখিয়ে এনেছিল গোয়ালা চৌধুরীর নিজ তৈরি যৎকিঞ্চিৎ রাস্তাঘাটই! ভূতলে আশ্রয় নিয়েও প্রাণে বাঁচেনি বেচারা রাজা গোয়ালা চৌধুরী। সভ্যতা মানেই তো রাস্তা, পথ! তা তৈরি করবে না! আহা! তাঁরও তো সাধ ছিল বাঁচার! গল্পটা বলতে চায় মুন্সি, বৃদ্ধ আলীবর্দী খাঁ মারাঠা নেতা রঘুজি ভোঁসালার সঙ্গে লড়তে-লড়তে সীমাহীন ক্লান্ত, শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন আপসরফায়। সেই সামান্য সুখের সময়ে আসেন মৃগয়ায়, এই বাগোয়ানের গহিন জঙ্গলে, গোটা তিনেক জাহাজ নিয়ে। জলঙ্গী নদী বয়ে সরস্বতী খাল হয়ে এই বিশাল ভৈরবে জাহাজ থামে। ফাল্গুনের মনোহর প্রকৃতি। বিশাল বাহিনী নিয়ে ভরা দুপুরে শিকার ধরার আশায় চারিদিক থেকে কেবল জমিয়ে এনেছেন শিকার। ঠিক তখন কোনোরকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই গভীর অরণ্যে প্রবল শীলাবৃষ্টির কবলে পড়েন নবাব। নবাবের বেহাল অবস্থায় মাসিক আট টাকা বেতনের খেদমতগাররা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে খুঁজে পান জঙ্গলাকীর্ণ এক পরিত্যক্ত ভগ্নদশা প্রাসাদ। তাতে কয়েক ঘর জুড়ে স্বাস্থ্যবান গাভি আর বাছুর। সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে এক তরুণী কি যুবতী বিধবা, এক কিশোর পুত্রসহ ভয়ে কাঁপছেন। ভাবনা ছিল, নির্ঘাত মারাঠাদের আক্রমণ!
মাতাপুত্র আশ্বস্ত হলে নবাবকে আপ্যায়নে লেগে পড়েন রাজু গোয়ালিনী। প্রথমে দেন তাঁর বানানো দই, ছানার সন্দেশ আর ক্ষীর। এতদঞ্চলে রাজু গোয়ালিনীর দই-সন্দেশ আর ক্ষীর বিখ্যাত। দরিদ্রলোক এর আস্বাদ পেত না, পেতেন কেবল বাগোয়ান পরগনার জমিদাররা। বিকেলে পাতে দিলেন ঘি-মিশ্রিত অন্ন আর ঘরের ছাগলের মাংস। সজনেডাঁটা আর চালকুমড়ার বড়ির অপূর্ব ঝোল। নবাবের মুখে অনাস্বাদিত স্বাদ! এসব যে খাবার, এখানে না এলে তিনি জীবনে জানতেই পারতেন না! শেষ পাতে আবার মিষ্টান্ন। নিজ হাতে তিনি খাবার পরিবেশন করলেন, আতিথেয়তা যাকে বলে! রাজু সৌন্দর্যে যেমন অপরূপা, তেমনি গুণেও তুলনারহিত। গোত্রহীন এই বিধবা, খুবসম্ভব স্বামীর সহমরণের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিলেন এখানে শিশুপুত্র কোলে। পরিত্যক্ত সাপখোপ-সমৃদ্ধ জঙ্গল-মহল নিজগুণেই গড়ে তুলেছেন স্বর্গ। কোথা থেকে একটি গাভি পেয়েছিলেন, গোপনে বাপেরই পাঠানো কিনা, কিংবা কোনো জমিদার (!) কে জানে, এক-দুটি গাভি থেকেই হয়তো তাঁকে ঘর ভরিয়ে দিয়েছে ঈশ্বর!
আতিথেয়তায় মুগ্ধ এই নবাব বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, পুত্রকে উপহার দেন রাজা উপাধি। রাজা গোপাল চৌধুরী বড় হয়ে রাস্তাঘাট তৈরি করেন জনগণের খেদমতে। এতেই পড়েন মহাসংকটে! কিন্তু মায়ের মতো তিনিও সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন, বাঁচার মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন বইকি! কাঁটার ভয়ে গোলাপকে হেলা করতে শেখেননি যে একেবারে!
এই নদী দিয়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে মেহেরপুরের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে একদা। ইংরেজ পাদ্রিরা যেমন আসে দারিদ্রে্যর সুযোগে অমত্ম্যজ শ্রেণি হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে, গড়ে তুলেছে খ্রিষ্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান, তেমনি নীলচাষ করিয়ে প্রজাকুলকে সর্বস্বান্ত করতে সে-জাতিই সৃষ্টি করেছে কালো ইতিহাস। কালের সাক্ষী হয়ে নীলকরদের নীলকুঠি এই ভৈরব নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোতে আজো আছে। আবার একাত্তরে ভরা বর্ষায় প্রমত্তা এই নদীই সেদিন পাকিস্তানিদের আগ্রাসী যাত্রা রুখে দিয়েছে, যেন-বা মায়ের আঁচল, বিপুল জলরাশি দিয়ে বাঁচিয়েছে গ্রামবাসীকে। প্রাকৃতিক প্রতিরোধ, দ্বিতীয় ফ্রন্ট।
সকালে আলো ফোটার বহু আগেই ভৈরব পাড়ে সমুৎসুক মানুষ। ‘ডুবুরি আসে না কেন কিংবা শ্যামলও তো এখন নেবে এটটু চেষ্টা করতে পারে!’ মাঝনদী বরাবর স্রোতরাশি ঘূর্ণি দিয়ে-দিয়ে চলে যায়, জোয়ারের সময়। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে, এত পানি! পাড়-ছুঁইছুঁই পানি। পাড়ের গাছ কেটে উজাড় করেছে, গোড়া হাঁ করে আকাশের পানে চেয়ে আছে। কেদারগঞ্জে ট্রাকে লোড হচ্ছে গুঁড়ি, কড়াই, মেহগনি, সেগুন, বাবলা, নিম অল্প কিছু শিশু। চুরানববইয়ে বেশিরভাগ শিশু অজানা রোগে মারা পড়েছিল যে! অভিজ্ঞরা আর বপন করেনি। পানির দামে কেনা গাছ, শহরে গিয়ে সোনা হবে। মারেফ ম-লের কাঠের আড়তের কাজ বন্ধ করে শ্রমিকরা এখন এসব নিয়েই মহাব্যস্ত গ্রামে। ক্ষমতায় থাকারা জোর-কদমে শুরুর আগে যতটা সম্ভব দ্রুত কাজ সেরে ফেলতে হবে। কোনো-কোনো পাড়ে তারাও নাকি বৈদ্যুতিক করাত নিয়ে এসেছে। কোথা থেকে কখন কী হয়ে যায়, তো তাড়াতাড়ি গাছকাটার কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে!
রসিকপুরের খেয়াঘাটে ভোরেই ডুবুরি নামে শ্রাবণের ভরা নদীতে। পাড়ের খুব কাছেই ছিল তারা, ছিল দুজন গলাগলি করে। উঠিয়ে খুব কষ্টে তাদের ছাড়ানো গেল।
তরুণী চাওয়া পূর্ণস্রোত পাওয়া ভৈরবের বদনাম আর যে করে করুক, হিসাব মুন্সি করতে নারাজ।