এধরনের পরিস্থিতি তার কাছে নতুন কিছু নয়। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতার পর স্কুল ক্রিকেট থেকে শুরু করে পেশাদার লীগের খেলায় প্রায়ই তাকে বুকের মাঝে শ্বাস চেপে ধরা টানটান উত্তেজনার সেই অস্বসিত্মকর মুহূর্তটির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
‘তবু আজকের দিনটি কি একটু অন্যরকম হতে পারে?’ – ভাবতে থাকে আনিস।
হয়তো বিক্ষিপ্ত জীবনের মাঝে কিছু সময়কে বিশেষ আর অনন্য কিছুর সূত্র ধরে ভালোবাসার ঠুনকো মানবিক রোমান্টিসিজম থেকেই তার ওই চিন্তার আবির্ভাব। তবু দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় তার চিন্তাটাকে এক্ষেত্রে একটু গুরুত্ব দেওয়াই যায়।
হতাশা, আক্ষেপ আর দুঃখমিশ্রিত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ ওভারের আগে বাউন্ডারি লাইনের
এক প্রান্ত থেকে অন্যদিকে ধীর বিষণ্ণ ভঙ্গিতে স্থান পরিবর্তন করতে-করতে ভাবছিল সে –
– ‘আর কতদিন? এই খেলাটাই বা তাকে কি দিলো?’
অথচ এরকম তো কখনো হওয়ার কথা ছিল না। এই তো বছর পনেরো আগে যখন বয়সভিত্তিক দলের নেট থেকে লীগের এক দলের কর্তা তাকে ডেকে নিয়ে যায়, তখন তার কোনোভাবেই সেরকম মনে হয়নি। বুক ফুলিয়ে মাকে জানিয়েছিল সে, ‘আনিসের কোনো বাবা-চাচা লাগে না।’
যদিও ছবির ফ্রেমে স্থায়ী হয়ে যাওয়া বাবার ওপর নির্ভরহীনতার অভ্যাস তার বহুদিনের। মা এবং বোনের সঙ্গেই ছোটকাল থেকে জীবনের অধিকাংশ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আনিসকে।
শরতের দিগন্তজোড়া পটে নীল সমুদ্রের ঠেউয়ে টুকরো মেঘের সঙ্গে ভেসে যাওয়া নিঃসঙ্গ ঘুড়ির হঠাৎ ভোকাট্টার মতো দোলা খেয়ে তার অবচেতন ভাব কেটে যায় ‘আনিসভাই, বোলিংয়ে আসেন’ ডাক শুনে।
বাড্ডা ইয়ুথ ক্লাবের ক্যাপ্টেন ইফতেখার মামুন বোলিং ক্রিজ থেকে তাকেই ইশারা করছে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলে আনিস সেদিকে। কেউ খেয়াল না করলেও আনিসের একটু চমকানো ভাবটা চোখ এড়ায় না রবিউলের।
সাত বছর ধরে আনিসের সঙ্গে বাড্ডা ইয়ুথ ক্লাবে একসঙ্গে খেলে
আসছে রবিউল। ‘আনিসভাই’য়ের ভীষণ অনুরক্ত রবিউল তার খামখেয়ালিপনা আর নির্বুদ্ধিতার সঙ্গেও বহুল পরিচিত। দ্বিতীয় বিভাগের লীগে খেলে পেশাদার খেলোয়াড়ির স্বপ্ন দেখে না সে আনিসের মতো। খেলা শেষ করে পৈতৃক ভিডিও দোকানের তদারকি করতে যাওয়ার জন্য ছুটতে গিয়ে তার সেই স্বপ্ন দেখার অবকাশটিও নেই। তবু এই খেলাটিকে ভীষণ ভালোবাসে রবিউল। মাঝেমধ্যেই এদিক-ওদিক থেকে খ্যাপ খেলার ডাক পড়লে একটুও ভাবতে দেরি করে না।
কিন্তু এই অলস পড়ন্ত বিকেলে খেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দলের ধুঁকে-ধুঁকে টিকে থাকা এক দ্বিতীয় সারির বুড়ো বোলারকে ডাকার সিদ্ধান্ত তার মনে ক্লান্ত শিখার মতো নিভুনিভু করতে থাকা অনেকদিনের সন্দেহকে বাতাসের মৃদু পরশ দিয়ে যায় বইকি।
অবশ্য, অবাক আনিসও একটু হয়েছিল। চৌত্রিশ বছর বয়সে বলে আগের মতো ধার নেই তার। আর তার সঙ্গে, সেরকমভাবে খেলায় মনোযোগও দিতে পারে না আগের মতো। কোথায় যেন এলোমেলো হয়ে যেতে চায় তার সবকিছুই।
সেই যে মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকে তার ভোকাট্টা মনঘুড়িটা। প্রায়ই চলে যায় সে কাকার দেওয়া প্রথম ব্যাট-বল দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মুহূর্তে। ক্ষণেই মনে পড়ে যায় বল করতে গিয়ে পিছলে পড়ে পা ভাঙার সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা। আবার মনে হয় এই তো সেদিনও সে কল্পনা করত ইডেন গার্ডেন্সে বল করছে কপিল দেবের মতো, পরমুহূর্তেই লর্ডস ময়দানে তার দুরন্ত গতির বাউন্সারের ঝাঁঝে মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা মুহুর্মুহু বাহবা দিচ্ছে।
ইফতেখারের উদ্ধতভরা জড়ানো গলার ‘কী করবেন? কোথায় ফিল্ডার দেব?’ শুনে ঘোর অবস্থাটা এবারের মতো কেটে যায় আনিসের। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরে আসতে হয় তাকে মর্তে। সম্বিত ফিরে পেয়ে সে দ্রুতই মনোযোগ দেয় মাঠে।
পুরনো ঘুণে ধরা কাঠের স্কোরবোর্ডে লেখা আছে – শেষ ওভার। কাকলি ক্রিকেটারস অ্যাসোসিয়েশনের দরকার আর মাত্র ৮ রান। ছয় বলে আটটি রান। হাতে পাঁচটি উইকেট যার তেমন কোনো গুরুত্ব যে নেই তা সবাই বোঝে।
ব্যাটিংয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে বছরের সবচেয়ে বেশি রান করা বাইশ বছরের ঝকঝকে তরুণ সরোয়ার অপরাজিত আটাশি রানে। সবাই জানে, সে পরের বছরই প্রথম বিভাগের গোপীবাগ স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে খেলতে যাচ্ছে। এ বছরেই চারটি সেঞ্চুরি করে খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে স্পটলাইটের নিচে নিয়ে এসেছে সরোয়ার। ক্লাসিক স্টাইলে ব্যাটিং করেও সরোয়ারের অফসাইডে মেরে খেলার প্রচ- সামর্থ্যের কথা সর্বজনবিদিত।
মুখে চুইংগাম চিবোতে-চিবোতে খুবই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অফসাইডে পাঁচ আর অনসাইডে চারজন ফিল্ডার রেখে ইফতেখার খুব আয়েশি ভঙ্গিতে আনিসকে বলে, ‘ভাই বল মিডলে রাইখেন, অফে করলে ফাটায় ফেলবে।’
কিন্তু নিজের অজামেত্মই আনিস কেন জানি আজ দাঁত চেপে বলে ওঠে, ‘আমি অফেই বল করব।’
একটু অবাক হলেও অতিরিক্ত একজন ফিল্ডারকে অফসাইডে যাওয়ার আদেশ দিয়ে নিজের পজিশনে যাওয়ার আগে ইফতেখার একটু মুচকি হেসে ভাবে, ‘বুঝবি মজা আজকে, হাহ, অফে বল করব’।
জয়ী হওয়ার স্বাভাবিক তাড়না যে ইফতেখারের মধ্যে কম তা কিন্তু সত্যি নয় মোটেও; অথচ বুড়ো ঘোড়াদের সঙ্গে নিয়ে খেলতে তার ঘোর আপত্তি। মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই দলের অধিনায়ক হয়ে মূল ক্ষমতা সে নিজের হাতে কুক্ষেগত করে ফেলেছে। সে আধুনিক খেলায় বিশ্বাস করে, দলে তরুণ খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ চায় আরো বেশি, আর বুড়োদের ওপর ছড়ি ঘুরাতেও তার যে খুব অস্বসিত্ম বোধহয় তাও হয়তো আনিসকে অপছন্দ করার আরেকটি কারণ।
দলের কোচ মুকুল দত্তও কিন্তু সব কর্তৃত্ব ইফতেখারের কাছেই ছেড়ে দিয়েছে। আর দেবে নাই বা কেন? ইফতেখারের বাবা ক্লাবের বড় কর্তা। কর্তাদের ছেলেরা এখানে প্রায়ই খেলতে আসে। যতদিন ভালো লাগে খেলে, মন উঠে গেলে আবার চলে যায়, তার শূন্যস্থান অন্য কোনো কেউকেটা দ্রুত কেড়ে নেয়। এইসব মুকুল খুব ভালো করেই জানে তার বিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে। জীবনসায়াহ্নে এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন তার ফুরিয়েছে। সবার মন খুশি করে রুটিরুজির ব্যবস্থা হলেই সে সন্তুষ্ট।
কিন্তু তার অনেক পোড়-খাওয়া সচেতন মন ঠিকই বুঝতে পারে আনিসকে এখন বল দেওয়ার আসল কারণ। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সরোয়ার আনিসের বলকে খুব হেলা করেই ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে পারবে আর সেইসঙ্গে ইফতেখারও পেয়ে যাবে আনিসকে দল থেকে ছুড়ে ফেলার অজুহাত। কর্মকর্তাদের ছেলেদের কিছু বলতে নেই, তারা আসবে-যাবে; কিন্তু মুকুলের জীবন ঠিক যেমনটি চলছে, তেমনি চলতে থাকবে।
মেপে-মেপে উইকেট থেকে ঠিক পনেরো গজ দূরে এসে একপলক মাঠের চারপাশে তাকিয়ে আনমনে ট্রাউজারে হালকাভাবে বল ঘষতে থাকে আনিস। কোথা থেকে যেন সেই পুরনো ভয় আবার তাকে এসে ঘিরে ধরে। কেমন যেন অদ্ভুত এক অশরীরী অনুভূতির পরশ শীতের কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে যায় তার সমস্ত শরীরে। দুরু-দুরু বুকে দৌড় শুরু করে আনিস। পপিং ক্রিজের কাছে এসে সমস্ত জোর দিয়ে অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে লক্ষ করে বল ছুড়ে মারে।
ওপারে প্রস্ত্তত সরোয়ার দেহটাকে সামান্য পিছে মুচড়ে নিয়ে আশ্চর্য দক্ষতায় সজোরে ড্রাইভ করে। মুহূর্তেই বল ছুটতে থাকে এক্সট্রা কাভার বাউন্ডারির দিকে। ডিপ মিডঅফ থেকে মুরাদ ছুটে এসে বল ছুড়ে ফেরত পাঠানোর আগেই ২ রান নেওয়া শেষ করে ব্যাটসম্যানরা।
হতাশায় হাঁটু মুড়ে আসতে থাকে আনিসের। সেই ভয়ংকর মুহূর্তকাল আবার ফিরে এসেছে, ঠিক যেন সেই দিনটির মতো। জীবনের প্রথম প্রিমিয়ার বিভাগ লীগের ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে সে। শীতের ভোরে কাকডাকার সঙ্গে-সঙ্গে তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছিল সেদিন আনিস। নাস্তা মুখে পুরে খেতে-খেতেই মাকে সালাম করে নেয় সে। অন্য ঘর থেকে ঘুম-জড়ানো গলায় তার বোন রোজি বলে ওঠে ‘খুব ভালো করে খেলিস ভাই’।
কিন্তু সেই ভালো খেলাটা তার আর হয়ে ওঠেনি ওইদিন। উত্তরা স্পোর্টিং লিমিটেডের ব্যাটসম্যানরা যেন ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার সমস্ত জীবনের স্বপ্ন একদিনেই। এক জাভেদই তার বলে হাঁকায় দশটি বাউন্ডারি। আট ওভার বল করে সত্তর রান দেয় সেদিন কোনো উইকেট ছাড়া। এরপর তার আর সুযোগ হয়নি প্রিমিয়ার ডিভিশনের কোনো খেলায় বল করার।
ক্ষমাহীন পেশাদারি সংস্কৃতিতে আবদ্ধ ক্রিকেট তাকে আর কোনো সুযোগ দেয়নি উঁচুজাতের মাঝে। ভাঙা হৃদয় আর ফিকে স্বপ্ন নিয়ে পরের বছর থেকে সেই যে দ্বিতীয় বিভাগে খেলা শুরু করতে থাকে আনিস, আরেকবার আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায়, তা শুধু লক্ষ্যই থেকে যায়। সেরাদের মাঝে তার আর ফেরা হয় না।
মিডঅন থেকে ছুটে আসা রবিউলের ‘আনিসভাই’ চিৎকার শুনে বীভৎস আঠালো আতঙ্কের জাল থেকে জেগে ওঠে আনিস।
‘আমি সরি আনিসভাই’ বলে রবিউল। কিন্তু আনিসের বুঝতে
কষ্ট হয়। সঙ্গে-সঙ্গেই বলে ওঠে রবিউল ‘বোঝেন না? কেন আপনাকে আনলো! ইফতেখার চায় না আপনি আর থাকেন।’
হালকা স্রাগ করে ‘উঁহু! আমি দলের সবচেয়ে সিনিয়র বোলার। আমি এখন বল করব না তো আর কে করবে’ বলে পনেরো গজ দূরে তার দাগের কাছে আবার ফিরে যায় আনিস। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবিউলও বিরক্ত ইফতেখারের নির্দেশমতো মিডঅন থেকে দূরের লংলেগে নতুন জায়গায় ফিরে যায় মাথা নাড়তে-নাড়তে।
আবার দৌড় শুরু করে আনিস।
অনেক মনোযোগ দিয়ে অফস্টাম্পের দিকে তাকিয়ে ইয়র্কার লেন্থে বল ছুড়ে দেয় আনিস। কিন্তু সে-বল ইয়র্কার লেন্থের অনেক আগেই মাটিতে পড়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে যায় সরোয়ারের ব্যাট। প্রচ- ধাক্কা দিয়ে আবারো অফের দিকে বল ঠেলে দেয় সে। বল প্রচ-বেগে মাটি কামড়ে মিড অফের পাশ দিয়ে ছুটে যায় কিন্তু ভাগ্য এবারো ভালো আনিসের। লংঅফ থেকে জিয়া ঠিকই বাউন্ডারিতে পৌঁছানোর আগেই বলটা তুলে নেয়। সরোয়ার আর রনি এর মাঝে আরো ২ রান নিয়ে নেয়।
ভেঙে পড়তে থাকে আনিস। আর এক বা দুই বলের মধ্যেই খেলা শেষ হয়ে যাবে। আবারও এই শেষ ওভারটা ঠিকমতো করা হবে না তার, যেমনি হয়নি করা তার জীবনের অনেক কিছুই।
মাকে তার আর কখনো বুক উঁচিয়ে কিছু বলা হয়নি প্রিমিয়ার বিভাগের ব্যর্থতার পর। বোনের বিয়ে নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা থাকলেও অভাবের দরুন কিছুই করা হয়নি তার। যে-পাড়ায় একসময় কলার উঁচিয়ে দর্পে চলাফেরা করত, সেখানে রাতের আঁধারে মুখ লুকিয়ে ঢুকতে হয় তাকে। বন্ধুদের আর ক্রিকেট নিয়ে বড়াই করে গল্প করাও হয়নি তার কোনোদিন। জীবনের বাকি নীরস খেলাগুলোর মতো আজকের খেলাও শেষ হয়ে যাবে। হয়তো আর মাত্র দুই বল।
হঠাৎ দূর থেকে রবিউলের চিৎকার ভেসে আসে তার কানে – ‘সাবাস আনিসভাই, আপনি পারবেন।’
হ্যাঁ। পারতেই হবে আজ আনিসকে। হারতে-হারতে জীবনে অনেকে জিততে শেখে। আনিস কি পারবে না? ভাবতে থাকে সে।
ধীরে-ধীরে গ্রহণের অন্তকালের মতন ভয়ের মেঘ কেটে একটু আশার আলো জাগতে থাকে আনিসের মনে। ফিরে যেতে থাকে সে তার দৌড় শুরু করার স্থানে।
দৌড় শুরু হতেই মনে প্রতিধ্বনিত হয় প্রথম জীবনের পাড়ার ক্লাবের কোচ টিপুভাইয়ের কথা
– ‘কক্ষনো ভয় করবি না ব্যাটসম্যানকে। একটা মারলেও তোর ঠিকই সুযোগ থাকবে আরেকবার। চিন্তা করবি ব্যাটসম্যান কী ভাবছে। কী আশা করছে তোর কাছ থেকে। তাকে চমকে দিবি। কপিল দেব, ইমরান খান শুধু বল করেই চ্যাম্পিয়ন হননি। তাঁরা চিন্তা করতে জেনেছেন। ব্যাটসম্যানকে পড়তে পেরেছেন, বুঝতে শিখেছেন।’
মাথার মধ্যে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে যায় আনিসের। ‘সরোয়ারকে আচমকা সেস্না ডেলিভারি দিলে কেমন হয়?’
কোর্টনি ওয়ালসের অদ্ভুত সেস্নøv ডেলিভারির কথা তার মনে ভেসে ওঠে। বল ছুড়ে দেওয়ার শেষ মুহূর্তে হাতের চেটোর আলতো ধাক্কায় বলের হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার দৃশ্য সে কল্পনা করে। অনেক চেষ্টা করেও সে কখনো এরকমটা করতে পারেনি। বয়স প্রতিযোগিতার টুর্নামেন্টে দিপুভাই কব্জির মোচড়ে বল সেস্নøv করে দেওয়ার টেকনিকটা দেখানোর পর সেটাই সে করে এসেছে এতদিন। কিন্তু আজকে আনিস তার প্রিয় বোলার কোর্টনি ওয়ালসের বলটাই করবে। করতেই হবে তাকে কারণ এখন যে শেষ ওভার।
দৃঢ়সংকল্প নিয়ে এক নতুন খেলোয়াড়ের উদ্যম নিয়ে এবার দৌড় শুরু করে আনিস। কিপার মঞ্জু থেকে শুরু করে বাকিরাও তার দৌড়ে নতুন চাঞ্চল্য দেখে অবাক হয়। মসৃণগতিতে বোলিং ক্রিজে এসে সর্বশক্তিতে বল ছুড়ে দেবার শেষ মুহূর্তে ঠিক ঠিক চেটো দিয়ে আলতো ধাক্কা দেয় এবার আনিস। বল কিছু দূর বাতাসে ভেসে আলতো ভাবেঝুলে পড়তে মাটিতে। কোন কিছু বোঝার আগেই সরোয়ারের ব্যাট অনেক আগেইঘুরে যায়।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সরোয়ার দেখতে থাকে যে বল তার ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে অফস্টাম্পের মাত্র এক ইঞ্চি দূর দিয়ে চলে গেছে। কিপার মঞ্জু বল ধরেই চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিন্তু আনিস এর কোনো কিছুই শুনতে পায় না। তার মনে আজ শুধুই ভেসে উঠছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
নিজের অজামেত্ম আজ সে প্রাপ্তি, প্রয়াস আর না পাওয়ার অসম সমীকরণের সমাধান খুঁজছে।
সরোয়ারের একটু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শেষ বলটি খেলে। এরকম অদ্ভুত সেস্নøv বল এর আগে সে খেলেনি। টিভিতে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু আজই প্রথম বুড়ো আনিস তাকে এভাবে তাক লাগিয়ে দিলো।
আনিসকে সে দুই-তিন বছর ধরে চেনে। মিষ্টভাষী খামখেয়ালি খেলোয়াড় হিসেবেই চেনে তাকে সরোয়ার। কিন্তু তেমন মনে রাখার মতো কোনো কিছু মনে করতে পারে না সরোয়ার। এরকম চেপে থাকা ভাঙ্গা স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেট খেলে যাচ্ছে কত শত-শত যুবক। হিসাব মেলাতে না পারার খামখেয়ালিপনাতেই তাদের মুক্তি।
কিন্তু এবার খুব সতর্ক হয়ে ওঠে সরোয়ার। আর তিন বলে চার রান তাকে করতেই হবে। সামনের বছর প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলার আগেই চৌকস খেলোয়াড় হিসেবে নাম কামাতে চায় সে।
অন্যদিকে আনিস এক দৃঢ় পদক্ষিপে এক ঘোরময় মন্ত্রচালিত মানুষের মতো ফিরে যেতে থাকে তার বোলিং মার্কে। তার মনে ভাসতে থাকে, আয়নার সামনে কপিল দেবের মতো ভঙ্গি করে কল্পনার মিয়াঁদাদকে ছুড়ে দেওয়া সেই বলের কথা। মনে হতে থাকে স্কুলক্রিকেটের কথা। কী চমৎকার বল করে ৬ উইকেট তুলে নিয়েছিল সে। আবার বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় প্রচ- জোরে ইয়র্কার ছুড়ে উইকেট ভেঙে ফেলেছিল; কিন্তু এই তেরো বছরের পেশাদার খেলার কিছুই তার মনে পড়ছে না।
জীবনের প্রথম পেশাদার খেলাতেই জাভেদ কি সুনিপুণভাবেই না ধ্বংসের বীজ বুনে দিয়েছিল তার জীবনে।
আবার ছুটতে থাকে আনিস। ‘এবারো কি সে ব্যর্থ হবে?’ ভাবে সে। সেই ছোটবেলা থেকে তার যে ছুটে চলা তা আজো থামেনি। ব্যর্থ হতে হতে জয়ী হওয়ার খোয়াবটাও যেন ভুলতে বসেছে সে।
পনেরো গজ ছুটে এসে এবার বাতাসে ভাসিয়ে দেয় সে বলটিকে যেন তার জীবনের জরা যন্ত্রণাগুলোকে চিরবিদায়ের বিসর্জনের পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। পুরনো বলটি সাপের মতো হিস-হিস শব্দ তুলে হঠাৎ গোত্তা খেয়ে দিক পরিবর্তন করে উইকেটের দিকে ঘুরে আসতে থাকে।
সরোয়ার কিন্তু ব্যাট ঠিক বলের লাইনেই চালিয়েছিল। কিন্তু অকস্মাৎ বাতাসের সঙ্গে বলের যোগসাজশের এই প্রতারণা বুঝতে পেরে তার সারাশরীর স্তব্ধ হয়ে ওঠে। এবার অবশ্য বল লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে দিয়েই চলে যায় সরোয়ারের ব্যাট-প্যাড সবকিছুকে ফাঁকি দিয়ে।
‘ওহ্-আহ্’ ধরনের শব্দে কিছুক্ষণের জন্য চারদিক কেঁপে ওঠে। এর মাঝেই রবিউলের উলস্নসিত কণ্ঠ সব থেকে জোরে শোনা যায় ‘সাবাস আনিসভাই, সাবাস।’
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ইফতেখারকে বিড়বিড় করতে শোনা যায় ‘এরকম সুন্দর রিভার্সসুইং আমি আগে কক্ষনো মাঠে দেখিনি।’ কোনো দৈবিক কারণে পুরো দলের মধ্যেই তরঙ্গের মতন ঢেউ খেলে যেতে থাকে। অনেক দিন পর আজ ইফতেখারও নিজেকে বুঝতে শিখে। হারতে সেও কিন্তু চায় না। সবার সাথে এভাবে ছলচাতুরী করে এতদিন সে আসলে নিজেকেই যে নিজে প্রতারিত করছে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা। দৌড়ে যায় সে ঘোরমগ্ন আনিসের দিকে।
ইফতেখারের ‘আনিসভাই, আপনি পারবেন, আনিসভাই আপনাকে পারতেই হবে’ শুনে নতুন করে উদ্যম খুঁজে পাওয়া আনিস আবার আবেগাপস্নুত হয়ে পড়ে। কিছু না বলে হালকা করে মাথা নেড়ে সে আবার ফিরে যায় তার দৌড় শুরুর স্থানে।
মসৃণ গতিতে ছুটে চলেছে আনিস।
আজ আবার তার ছুটে চলার মাঝে এক অদ্ভুত সংকল্প দেখা যায় অনেকদিন পর। যেন হঠাৎ করেই জীবন উপভোগ করা শুরু করেছে এক কিশোর ছেলে। ক্রিজে এসে বল ছাড়ার শেষ মুহূর্তে চোয়াল শক্ত করে প্রচ- জোরে মাঝ পিচে আছড়ে দেয় সে বলটিকে।
আবারো সরোয়ারকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে হিংস্র বাউন্সারটি তার মাথার দিকে ছুটে আসতে থাকে। চোখ বুজে নিজেকে বাঁচানোর শেষ আশ্রয় হিসেবে ব্যাট দিয়ে মুখ ঢেকে দেয় সরোয়ার। কিছুক্ষণের জন্যে অসাড় হয়ে যায় তার সমস্ত অনুভূতি-চেতনা।
কোথা থেকে তার কানে বেজে-ওঠা ‘দৌড়া, দৌড়া’ শুনে যান্ত্রিকভাবেই সরোয়ার দৌড় শুরু করে আর উলটোদিকে চোখের আড়াল দিয়ে তাকিয়ে দেখে কাকতালীয়ভাবে তার ব্যাটে লেগে বল কিপারের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির দড়ির দিকে।
হতাশ আনিস লক্ষ করে, প্রচ- গতিতে লংলেগ থেকে জীবনপণ বাজি রাখার মতো ভয়ংকর বেগে ছুটে আসছে রবিউল। বল যখন বাউন্ডারির দড়ি ছুঁইছুঁই, তখন ছুড়ে দেয় সে নিজেকে বলের দিকে। আনিস বিশ্বাস করতে পারে না কীভাবে রবিউল ছুটে এলো আর কীভাবেই সে চার রান বাঁচিয়ে দিলো।
রবিউলের দৈবিক প্রচেষ্টায় অবিশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে একই সঙ্গে নিজেকেও ভাগ্যের কাছে প্রতারিত মনে হতে থাকে আনিসের। এত ভালো বল করেও তো কোনো লাভ হলো না। জীবনের আর সব অবিচারের কথা ভেসে আসে তার কাছে – ‘কই, সে তো অন্যদের মতো শৈশব পায়নি।’
স্বামীহারা মায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই চলেছে তারও স্বপ্নের সংগ্রাম। কতবার শুনতে হয়েছে তাকে ক্রিকেট বড়লোকদের খেলা। তার মতো অভাবীদের এর পেছনে ছুটে চলতে নেই। ব্যাট-বলের টাকা না থাকার কারণে কতবার বন্ধুরা তাকে অগ্রাহ্য করেছে। সংগ্রাম করে ঠিকই সে উঠছিল তার অভীষ্ট লক্ষে্য; কিন্তু একটি সুযোগের বেশি তো পায়নি সে নিজেকে প্রমাণের জন্য। ছুড়ে দিয়েছে সবাই তাকে অন্য জীবনে, যেখানের জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠতে পারেনি সে।
চোখ তার আর্দ্র হয়ে ওঠে। দূরে স্কোরবোর্ডে নতুন করে লেখা ভেসে ওঠে ২ রান প্রয়োজন।
শেষ বলে কাকলি ক্রিকেটারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রয়োজন আর ২ রান।
মাঠের বিভিন্ন প্রামেত্ম গোটা দশেক দর্শক একটু নড়েচড়ে ওঠেন।
জলে ভেজা চোখ নিয়ে ছুটে চলে আনিস। আজ তার শেষ ওভার। আজ তার শেষ বল। আজকেই সে তার জীবনের চেষ্টা আর প্রাপ্তির শেষ ফলাফল জানতে পারবে। আজকে তাকে সেই স্কুলজীবনের মতো বল ছুড়ে উইকেট ভাঙতে হবে। এই শৃঙ্খল থেকে তাকে মুক্তি পেতেই হবে।
বাতাসের বারণ অমান্য করে ঠিক পনেরো গজ দৌড়ে এসে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে উইকেটের দিকে ছুড়ে দেয় সে বলকে। ভেজা চোখে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে আনিস দেখতে পায়, সরোয়ারের স্থানে জাভেদ ব্যাটিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর মৃদু সরসর শব্দ তুলে তার দিকে ছুটে চলেছে লাল রঙের ক্রিকেট বলটি।