দেখতে তো প্রাচীন লাগে না।
কত বয়স হবে?
ষাট পঁয়ষট্টি।
সবই তো শেষ হয়।
মৃত্যু আসে।
পায়ে পায়ে চুপিচুপি।
জানো তো চেনাজানা কত লোক মরে গেছে।
সবকিছুর শেষ হয়।
তুমি আর আমি রোজ একসঙ্গে কাটাচ্ছি।
এবং রাত।
আগামীকাল আমাদের চেনাজানার দু-বছর হবে।
ভালোবাসা যখন মরে যায় তখন কী থাকে?
বিয়ে।
বাকি জীবন বিয়ের মধ্যে থাকা যায় না।
তাহলে।
জানি না।
শেক্সপিয়র পড়েছ?
না।
শুনবে।
বলো।
সত্য নিয়ে মাথা ঘামাই না।
একজন মানুষ একবারই মরে।
আমরা ঈশ্বরের কাছে ঋণী একবার মরার জন্য।
আমরা ঋণী তাই না।
আমাদের ঋণ ফুরায় না।
মৃত্যুর কথা কখনো ভেবেছ?
সবসময় না।
মাঝেমধ্যে ভাবা ভালো।
হয়তো।
এন্ডি ওয়্যারহলের জীবনীটা পড়েছ।
সবটা পড়িনি।
এন্ডির বাবা যখন মারা যান, সেই অংশটা।
সেই অংশটা পড়েছি।
ওরা তো গ্রিক ক্যাথলিক। তাই না?
বাবার শব তিনদিন ধরে বাড়িতে রাখা।
এন্ডি ভয়ে বাড়ি ছেড়েছে।
ভয়?
মৃত্যুর ভয়।
মানুষ তো খুব নিঃসঙ্গ।
তা ঠিক।
নিঃসঙ্গতার একটা কথা বলি।
বলো।
আমার একটা বেড়াল আছে।
জানি।
বেড়ালটা খুব নিঃসঙ্গ।
প্রেমে পড়ে আমি বুঝেছি জীবনটা কত একঘেয়ে।
কথাটা কি আমার দিকে তাক করা।
তা নয়।
একেবারে অস্বীকার করা কি সম্ভব।
আমি পেইন্টিং করি, তুমি ডিজাইন করো।
তা দিয়ে কি কিছু প্রমাণ করা যায়।
হয়তো যায় না।
তবু।
একই জিনিস রোজই দেখি। এসব এঁকে আমি বুঝি জীবন কতো বোরিং।
তা ঠিক।
সংস্কৃতির মধ্যে আমার জায়গা এখানেই।
আমি তাই বুঝি। রকেটের আমি যেমন অংশ,
তেমনি আমি এই সময়ের অংশ।
একঘেয়ে। সব একঘেয়ে।
আমার তাই মনে হয়। সব একঘেয়ে। সব একঘেয়ে।
জীবন তো যথেষ্ট আছে। একটু মৃত্যু দরকার।
আমার তাই মনে হয়।
তাহলে আর্ট ও কমার্সের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচে যাবে।
দূরত্ব কমানো দরকার।
পেইন্টিং ও ডিজাইন আসলে একটাই।
আমি পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে ডিজাইন খুঁজে পাই।
আমি সকল দূরত্ব মুছে ফেলতে চাই।
দূরত্ব বুর্জোয়ারা চায়।
আমি বুর্জোয়া হতে চাই না।
বুর্জোয়ারা নিপাত যাক।
আমি শাহীনের হাত ধরে যেতে চাই।
জানো শাহীন।
বলো।
আমি চোখের সঙ্গে চোখ যোগ করতে চাই।
অনেক চোখ অজস্র চোখ।
তাই হচ্ছে শিল্প।
শাহীন কি ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিস্টিয়ান ডিওর হতে চায়? কিংবা পেইন্টার। কিংবা দুই-ই।
আমি নিজের কথা ভাবি। কী হতে চাই আমি। আমি কি অ্যাবসট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম কনসলিডেট করার জন্য সাহায্য করতে চাই।
ছবি বিক্রির সঙ্গে ভাগ্যের খুব সম্ভব সম্পর্ক আছে। এন্ডি ওয়্যারহল তার ক্যাম্পবেল স্যুপ ক্যান বিক্রি করতে চেয়েছে এক হাজার ডলারে। চৌত্রিশ বছর পর ওই ক্যান মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে বিক্রি হয়েছে পনেরো মিলিয়ন ডলারে।
শাহীন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আমি শাহীনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি চিৎকার করে বলি : চোখের সঙ্গে চোখ যোগ করতে চাই। শাহীনও চিৎকার করে : তাই হচ্ছে শিল্প।
১৯৫৮।
মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট ভবনে নিউ আমেরিকান পেইন্টিং প্রদর্শিত হচ্ছে। একটা বড় মিউজিয়াম এই প্রথম অ্যাবসট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম এনডর্স করছে। তারপর মমা এই প্রদর্শনী ইউরোপ ভ্রমণে পাঠিয়েছে। এ এক দারুণ ঘটনা। ইউরোপিয়ানরা একবার যখন মেনে নিয়েছে তখন আমেরিকান সাংস্কৃতিক এস্টাবলিশমেন্ট হইহই করে উঠেছে। আমেরিকান সাংস্কৃতিক এস্টাবলিশমেন্ট ইউরোপকে অনুকরণ করে রুচির ক্ষেত্রে জায়গা করে দিয়েছে অ্যাবসট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমকে মিউজিয়ামে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রোববারের সংবাদপত্রে।
জয়ধ্বনি সবক্ষেত্রে।
এই জয়কে হারানো যায় না।
শাহীন।
বলো।
সর্বনাশের মানবিক অবস্থানটা তোমার জানা আছে?
হয়তো জানি।
কেন আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই সর্বনাশ থেকে?
শুধু জানি তোমার হাত ধরে বেঁচে থাকতে চাই।
একদিন, ভালোবাসার পর, আমি আর শাহীন, হঠাৎ ঠিক করি, বিছানায় শুয়ে-শুয়ে, আমরা একটা কবিতা তৈরি করব।
কীভাবে।
প্রথম লাইনটা তুমি বলবে।
দ্বিতীয় লাইনটা আমি।
তাহলে শুরু করা যাক।
তোমার আঙুলগুলো আমার মুখে
তোমার বুকদুটো আমার হাতে
সবকিছুর একটা দাম আছে
ভালোবাসার দাম কত
শাহীন এবং আমি শেষ দুটো লাইন একসঙ্গে বলি :
তোমার আঙুলগুলো
তোমার বুক দুটো
আমাকে তুমি দিয়েছ
ভালোবাসার পর এই কবিতার তুলনা হয় না।
যতক্ষণ আমি শাহীনের সঙ্গে থাকি, আমি আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম এবং আন্ডারগ্রাউন্ড পেইন্টিং হয়ে যাই। রুমের মধ্যে নীল মেঘ ঘুরে বেড়ায় ঈশ্বরের মতো। একটা নীল মেঘ আমি ধরতে থাকি।
এভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড পেইন্টিং তৈরি হয়ে যায়।
শাহীন আমার নুনুর দিকে চোখ রেখে বলে, দেখেছ কত বড়।
আমি বলি, দুলছে পতাকার মতো।
শাহীন ওর বুকের দিকে চোখ রেখে বলে, পছন্দ?
হ্যাঁ। খোলা বুক আমার সঙ্গী।
আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্মে নুনু বিশাল হয়ে যায়। খোলা
দুধ মুখের কাছে এসে যায়।
শাহীনকে আমি বলি পেইন্টিং করতে।
আর শাহীন আমাকে বলে কবিতা লিখতে।
নীল মেঘের পতাকা তুলে আমরা একসঙ্গে বের হয়ে যাই। নীল মেঘ ছড়িয়ে-ছড়িয়ে আমরা ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াই। শামিত্ম শামিত্ম।
সময় পেলেই আমি অজস্র বই পড়ি। শাহীনও অজস্র বই পড়ে। বইপড়া নিজেদের মধ্যে সাহস তৈরি করে। যে-ধরনের জীবনযাপন করি, সাহস কমে যায়। সাহস না থাকলে জীবনযাপনের বীরত্ব থাকে না।
এ-কথাটা জাঁ পল সার্ত্রে স্পষ্ট করে বুঝেছেন। তাই না শাহীন : আমরা কাপুরুষ বলেই বীরের ভূমিকায় অভিনয় করি। সমেত্মর ভূমিকা আমরা পালন করি বদমাশ বলেই। হত্যাকারীর ভূমিকা পালন করি অজস্র মানুষ খুন করি বলেই। জীবনযাপন করি জন্মের পর থেকেই মিথ্যাবাদী বলেই।
শাহীন শাহীন : আগাগোড়া আমরা মিথ্যুক, কাপুরুষ, বদমাশ এবং খুনি।
আমাদের খুন থেকে উদ্ধার করার কেউ নেই। সেজন্য তুমি পেইন্টিং করো, আমি কবিতা লিখি।
ছবিতে রক্তের দাগ মুছতে পারি না। কবিতার স্তবকে রক্তের দাগ লেগে থাকে।
রক্ত এবং রক্ত এবং রক্ত।
আমরা যা কিছু করি সবই অ্যাবসার্ড। বাস্তব অ্যাবসার্ড। অ্যাবসট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম অ্যাবসার্ড।
পেইন্টিং অ্যাবসার্ড। ডিজাইন অ্যাবসার্ড। আমরা চোখ মেলে অথবা চোখ বন্ধ করে জীবন সংগ্রহ করি।
শাহীন অন্ধকার পৃথিবীতে তোমার পেইন্টিং সেক্সজুয়ালাইড মেলোড্রামা।
আমার কবিতা উজ্জ্বল এক শাদা স্পেসে শব্দের মাতামাতি।
বিভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে আমরা কীভাবে নেভিগেট করছি। এসব ভাবি, এসব প্রশ্ন করি; কেন এসব ভাবি, কেন এসব প্রশ্ন করি, জানি না।
আমি শিল্প ও ভালোবাসা সংগ্রহ করি।
এই সংগ্রহের শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে : শাহীন তুমি। আর ভালোবাসা।
জীবন এমনই : সুন্দর ও ভয়ার্ত। বুর্জোয়ারা তার মধ্যে ভায়োলেন্স ঢুকিয়ে রেখেছে। ভায়োলেন্স বিদায় দিয়ে যদি সুন্দরের কাছে ভয়ে-ভয়ে যাই, জীবন অন্যরকম হয়ে ওঠে।
শাহীন কদিন থেকে জেগে উঠে নান্দনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তগুলি নান্দনিক চিন্তা। এই চিন্তার কেন্দ্র ভিত্তিমূল হচ্ছে : আমি বুর্জোয়া হতে চাই না।
শাহীন ও আমি শরীরের সব জোর একত্র করে চিৎকার করি, চিৎকার করি শেষ পর্যন্ত : বুর্জোয়ারা নিপাত যাক।
শাহীন : শিল্প হচ্ছে ভালোবাসা। আমাদের কাজ হচ্ছে ভালোবাসা সংগ্রহ করা।
ভালোবাসার সংগ্রহ থেকে শিল্প উঠে আসে।
বুর্জোয়ারা নিপাত যাক। নিপাত যাক।