একা দাঁড়িয়ে থাকা

তিন বছর বয়সে রূপশ্রী বাবাকে হারিয়েছে। ও এখন একুশ বছর বয়সের তরুণী। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢোকার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে।

বাবার কোনো স্মৃতি ওর নেই। মা বলেছে, ওর নামটি বাবা রেখেছে। ওর জন্য এটুকু একটি সম্বল। নিজেকে ফিরে দেখার সময় এই সম্বল সহযোগিতা করে। বিশেষ করে সম্পর্কের ভালো-মন্দের হিসেবে। রূপশ্রীর বেড়ে ওঠা এই সূত্র ধরে এগোয়। রূপশ্রী মনে করে, নাম রাখার সম্বল ওর দিনযাপনের খুঁটিনাটিতে সঞ্চয় মাত্র।

সার্টিফিকেটে বাবার নাম ব্যবহার ওর পরিচয়। সৈয়দ সিকান্দার শাজাহান বর্তমানে ওর কাছে এই পরিচয়ই মাত্র। যার অনুভব জীবনের কোনো জায়গা আলোকিত করে না, তাকে আর নাম দিয়ে কত স্মরণে রাখা যায়। এই ভাবনায় রূপশ্রী দমে থাকে। বুঝে নেয় মৃত্যুর কাছে পরাজিত মানুষ ও। এই ভাবনা ওকে বিষণ্ণ করে রাখে। বাবা ওর স্মৃতিতে নেই, এটা ও আর ভাবতে পারে না। ওর এখন কান্না পায়।

বান্ধবী কণা প্রায়ই বলে, এভাবে বেঁচে থাকা জটিল করার দরকার কী? খালাম্মাকে বলব তোকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।

খালাম্মা! মানে আমার মা!

বাঁধভাঙা হাসিতে ঘর ভরিয়ে দিয়ে ও কণাকে বলে, প্রতিদিনের দেখা মায়ের চেহারাও আমার কাছে অস্পষ্ট।

অস্পষ্ট! চেঁচিয়ে ওঠে কণা। আসলে তোকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতেই হবে। খালাম্মাকে আজই বলব।

না। চেঁচিয়ে ওঠে রূপশ্রী। একসময় নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমার জীবনে বাবার আড়াল হয়ে যাওয়া একরকম, মায়ের আড়াল হয়ে থাকা আর একরকম।

কণা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, তোর মতো এমন মেয়ে আমি দুটো দেখিনি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদের কারো বাবা নেই, কারো মা। তারা তোর মতো কথা বলে না।

ওরা ভাবতে শেখেনি।

বুঝেছি, তুই কি গল্প লিখবি, নাকি কবিতা? ওই খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা

ঘামাস কেন?

বুঝবি না। এসবই অভিজ্ঞতা। আমার দুনিয়া নিয়ে আমিই তো মাথা ঘামাব, নাকি অন্যরা ঘামাবে?

কণা হাল ছেড়ে দেওয়া স্বরে বলে, জানি না বাপু। এও বুঝি না যে, এত সম্পর্ক আবিষ্কারের ধান্দা কেন তোর মধ্যে।

ধান্দা? বাজে কথা বলবি না কণা।

আমি বলি, এসব ভাবনা ছাড়। আমাদের এখন অনেক কিছু করতে হবে। এসব ভাবনায় তলিয়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে পারবি না।

তুই দেখি আমার সঙ্গে ভালোই মাস্টারি করছিস।

আমি তোর বান্ধবী, টিচার না। যা বলার তা তোর ভালোর জন্য বলছি। আমি যা ভাবি তা আমি ছাড়তে পারব না। তোর আর আমার জীবন একই রেললাইনে ছোটে না। তোর রেললাইন আলাদা, আমার রেললাইন আলাদা।

বুঝেছি, গল্প লিখবি। লিখ, লিখে ধন্য হ।

কণা ওকে ভেংচি কেটেছিল। তারপর খিলখিল হাসিতে ভরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এখন আমাদের প্রেম করার সময়। এসব আজেবাজে ভাবনার সময় নয়।

রূপশ্রী চোখে আগুন ছড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল। কণা হাসতে-হাসতে বলেছিল, চোখ রাঙাস না। তোর কাউকে পছন্দ হয়নি রূপশ্রী?

ও আগুন-চোখেই বলেছিল, হয়েছে।

সত্যি? বলিসনি তো।

এটা ঢোল পিটিয়ে বলার জিনিস নয়।

বাববা, তুই দেখছি সেয়ানা মেয়ে। অবশ্যই, সেয়ানা তো হবিই। এতকিছু যার মাথায়, সে সেয়ানা হবে না তো কী হবে।

রূপশ্রীর কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কণা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তড়িঘড়ি বলে, যাই। রেগে আছিস। এরপর মার লাগাবি।

চলে যায় কণা।

বাড়ির দরজায় চুপচাপ বসে থাকে রূপশ্রী।

তিনতলা এই বাড়িটি বানিয়েছে ওর নানা। ওর জন্মের আগে বানানো হয়েছিল। রূপশ্রীর মনে হয় এই বাড়ির মধ্যে মাটির মায়া আছে। সামনে ছোট্ট একটি বাগান আছে। বাগানে কয়েক রঙের জবা ফুলের গাছ আছে। কামিনী ফুলের ঝাড় আছে। মৌসুমি ফুল লাগানো হয়। ওর বেশি ভালো লাগে, যখন লাল রঙের তরুলতা ফুল ফোটে। মাঝে-মাঝে ছোট ফুলগুলো গুচ্ছ বানিয়ে চুলে গুঁজে রাখে।

এই বাগানটি রূপশ্রীর নানা-নানির শখ। এই বয়সেও দুজন বেশ খুনসুটি করে। বাগানে দাঁড়িয়ে ওর নানা লাল জবা ফুল নানির খোঁপায় গুঁজে দেয়। ও বেশ মজা পায়। দুজনের বয়সের কথা মনে হয় ওর। একদিন নানাকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, আমার বয়স ছিয়াত্তর। তোর নানির বয়স একাত্তর।

ও ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমাদের এত্ত বয়স হয়েছে।   তোমরা কিন্তু বুড়ো হওনি।

হইনি? বেশ বলেছিস।

মোহসিন মিয়া নাতনির দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসি হাসে। রূপশ্রী তার দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে, তোমরা কি প্রেম করে বিয়ে করেছিলে নানা?

আমরা কি তোদের মতো খোলা হাওয়ায় বড় হয়েছি যে প্রেম করে বিয়ে করব?

বুঝেছি, বলেই হাসতে থাকে রূপশ্রী।

কী বুঝেছিস, বল?

বুঝেছি, তখন প্রেম করা হয়নি বলে তোমরা এখন প্রেম করছ।

মেয়েটা একটা পাক্কুবড়ি।

ঠিক বলেছি কিনা বলো?

বলেছিস।

এরপর শুরু হয় নানা-নাতনির হাসি। পরে হাসিতে যোগ দিয়েছিল নানি হানুফা বেগম। এরপর খালা দিলরুবা। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। থাকলে হয়তো তারাও হাসিতে যোগ দিত। এমন একটি হাসির সময় কখনো-কখনো রূপশ্রীকে সম্পর্কের সূত্রের বাইরে নিয়ে যায়। ও তখন বুঝতে পারে, নানা-নানি ওর কাছে আড়াল হয়ে থাকে না। নানা-নানি ওর জীবনে আলো।

ও গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে ওর স্বপ্নের বাগানে এসে দাঁড়ায় রূপক। ওর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। রূপক বলেছে, আমাদের ভালোবাসায় খাদ থাকবে না। আমাদের ভালোবাসা হবে ভরাট জমিন।

রূপশ্রী চোখ উজ্জ্বল করে বলেছিল, জমিন? জমিন কি খোলা প্রান্তর থাকবে? শূন্য? ধুলোয় ভরা?

মোটেই না। জমিনে ভালোবাসার সরোবর থাকবে। সেখানে পদ্মফুল ফুটবে।

আর?

প্রেমের খুনসুটি পাখি থাকবে।

আর?

অভিমানের পোকামাকড় থাকবে।

আর?

বিরহের কাঁকড়া-কাছিম থাকবে।

আর?

দুঃখের বৃষ্টি থাকবে।

আর?

সন্তানের গাছগাছালি থাকবে।

এটুকু বলার পরই হা-হা হো-হো করে হেসেছিল দুজনে। রূপশ্রীর ভীষণ ভালো লেগেছিল সে-মুহূর্তের রূপককে। ও ভেবে দেখেছিল, সম্পর্কের ওই গিট্ঠু যদি শক্ত হয় তাহলে রূপকের চেহারা ওর সামনে অস্পষ্ট হবে না। ও প্রতিদিনের জীবনে থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যাবে-আসবে না। রূপশ্রী একা-একা খুশিতে ভরে ওঠে। দুই লাফে তরুলতার ফুলের লতার কাছে যায়। লতাগাছটিতে অনেক ফুল ফুটে আছে। কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে গুছি বানিয়ে নিজের চুলের ক্লিপের সঙ্গে গেঁথে রাখে। খুশিতে ওর চঞ্চলতা বাড়ে। বেশ লাগে ভাবতে যে, ওরা চাইলে অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে করতে পারবে। শুরু হবে সংসার। নতুন জীবন। রূপকের চাকরি হয়েছে একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সে। ও নিজে ঢুকবে কোথাও। আপাতত যা পাওয়া যায় সেখানে, তারপর পছন্দমতো কোথাও ঢোকার চেষ্টা করবে। ওর পছন্দ শিক্ষকতা। কোনো কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের সঙ্গে দিন কাটাবে। পড়ালেখা শেখানো আর ওদের হাসিমুখ দেখা। এভাবে নিজের শৈশব দেখা নিশ্চিত হবে, যে-শৈশবের স্মৃতি সবচেয়ে বেশি  নানা-নানির সঙ্গে সম্পর্কের গিট্ঠু।

রূপশ্রী আবার দরজায় এসে বসে।

মৃদু বাতাস ওর শরীরে পরশ বুলায়। বদলে যায় ওর ভাবনার জগৎ। প্রবল ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে মনে করে কত-কত বছর পরে এমন একটি দিন ওকে আনন্দ দিচ্ছে। শৈশবে নিয়ে গেল ওকে। আহ, এভাবে একটা দিন আর একটা দিনের ভেতরে প্রবেশ করে। এভাবে এক জীবন অন্য জীবন হয়ে যায়। আনন্দের রং বদলায়। অন্ধকারও রঙিন হয়। মায়ের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার চিন্তা যে নিগূঢ় অন্ধকার হয়, সেখান থেকে এভাবেই বেরিয়ে আসা হয়। ছোটবেলায় নানা-নানি ওকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিল। হাতির পিঠে উঠিয়েছিল। মাহুতকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল হাতির পিঠে। চিড়িয়াখানার বড় গাছগুলোর নিচে ঘুরতে-ঘুরতে অনেক পাখি দেখেছিল। হাতির সঙ্গে-সঙ্গে হাঁটতে থাকা নানা-নানির হাসিমুখ দেখেছিল। সেদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ার কথা ভুলে গিয়েছিল ও। হাঁ করে তাকিয়ে ছিল গাছের ডালে বসে থাকা দশ-বারোটা

কাকের দিকে। তখন ওর বয়স ছিল ছয়, নানি মাঝে-মাঝে বলে, ছয় বছর বয়সে তোকে আমরা হাতির পিঠে উঠিয়েছিলাম। হাতির পিঠে বসে থাকা সোনামণিকে একটি পরির মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বুঝি ডানা মেলে উড়ে যাবে। এমন স্মৃতি মায়ের সঙ্গে নেই। ওর কোনো কিছুতে মাকে ও বিরক্ত হতে দেখেছে। সেই চোখ কোঁচকানো, ভুরু কোঁচকানো চেহারা ও ক্রমাগত ওর সামনে থেকে সরিয়েছে। আড়াল হয়েছে মায়ের চেহারা। মাঝে-মাঝে মনে হয়, এই বাড়িতে যখন ও থাকবে না, তখন ও মাকে চিনতে পারবে না। প্রতিদিন দেখার পরও তো মা আড়াল হয়ে যায়, প্রতিদিন না দেখলে সেটা মুছে যাবে – এমন ভাবনা নিয়ে রূপশ্রী বিষণ্ণ হয়ে যায়। যে আনন্দ একটু আগে উৎসব মনে হয়েছিল সেটুকু এখন শ্মশান। দাউ-দাউ জ্বলছে আগুন এবং পুড়ছে।

মুহূর্তে টুনটুন শব্দ হলে তাকিয়ে দেখে সাদা জবাফুলের গাছটার ডালে লাফাচ্ছে টুনটুনি পাখি। কোথাও কোনো পাখি নেই। ও ঘাড় উঁচু করে আকাশ দেখে। সময়টা পড়ন্ত বিকেল।

গেট খুলে ওর মা ঢোকে। হাসনা বেগম।

ঢোকার পরে গেট বন্ধ করে। সারাদিন অফিস করার পরে চেহারায় ক্লামিত্ম। হাতে একগাদা কাগজপত্র। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। একদম মেয়ের মুখোমুখি। রূপশ্রী দরজা ছেড়ে নড়ে না। হাসনা বেগম পাশের জায়গা দিয়ে ঘরে ঢুকতে পারবে। যদিও লম্বায় খাটো মোটাসোটা এই মহিলার চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়; কিন্তু কণ্ঠের ঝাঁজ চড়া।

প্রথম প্রশ্ন করে, এভাবে বসে রয়েছিস যে?

রূপশ্রী কথা বলে না। তার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়।

কথা বলছিস না যে?

ইচ্ছে করছে না।

চুলে ফুল গুঁজেছিস কেন?

আমার খুশি।

এই ফুলের যা ছিরি, তাও আবার তোর ভালো লাগে? ছিঃ –

তোমার গোলাপ পছন্দ। ওই ফুল আমার সহ্য হয় না। ওই ফুলকে পরপর লাগে। আপন মনে হয় না।

তোর কাছে আপন হওয়া কঠিন।

হাসনা বেগম ওর পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। রূপশ্রী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। ড্রইংরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে গেল হাসনা বেগম। এটা রূপশ্রীরও ঘর। নানাবাড়িতে ওকে আলাদা একটি ঘর দেওয়ার মতো ঘর আর নেই। বাড়ির কোথাও ওর বাবার ছবি নেই। ওর মা রাখতে দেয়নি। বলে, কোনো লুচ্চার ছবি দেয়ালে ঝুলবে না। ছোটবেলা থেকে এসব শব্দ শুনতে-শুনতে বড় হয়েছে। বড় হয়ে জেনেছে, ওর মাকে রেখে ওর বাবা আর একটি বিয়ে করেছিল।

রূপশ্রী দরজা ছেড়ে বাগানে নেমে আসে। ভাবে, রূপক ওকে যেভাবে প্রেমের কথা বলে, ওর মা কি এমন প্রেমের কথা শোনেনি?

নিশ্চয় শুনেছে কিংবা শোনেনি। দুটোই হতে পারে। নানি বলেছে, মাকে কোনো একজন প্রেমের কথা বলেছিল। একটি মেয়ে আছে জেনে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বলেছে, পরের মেয়ের বোঝা ঘাড়ে নিতে পারবে না। মায়ের ভাষায় এই লোকটিও লুচ্চা। রূপশ্রী সাদা রঙের জবা ফুল ছিঁড়ে চুলে গোঁজে। কণা জিজ্ঞেস করেছিল, তোর সামনে থাকা মা আড়াল হয় কী করে? সে তো তোর বেঁচে থাকার সঙ্গী।

সঙ্গী? চোখের দেখা দেখলেই কি সঙ্গী হয়? মনের দেখাও লাগে।

মা তো তোকে বড় করেছে।

আমি নানা-নানির কাছে বড় হয়েছি। নানা আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত। নিয়ে আসত। নানি টিফিন বক্সে খাবার দিত। ঘরের পড়াশোনা করাত; মা আমার স্মৃতির মানুষ না।

ঘুমপাড়ানি গান শুনিসনি?

জানি না। ও ধমক দিয়ে বলেছিল, আমার স্মৃতি নেই।

কণা তাকিয়ে থেকে বলেছিল, এভাবে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের।

কষ্ট! রূপশ্রী শব্দটা উচ্চারণ করে।

বাগানে সন্ধ্যা নেমেছে। দিনের আলো ফুরিয়েছে। ওর নানি ঘরের বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাগানে আলো-আঁধারির ধুপছায়া। রূপশ্রী হেঁটে গেটের কাছে আসে। গেট খুলে রাস্তায় দাঁড়ায়। মানুষ চলাচল করছে। দু-চারটে রিকশা যাচ্ছে। ও অন্যমনস্ক স্বরে বলে, কষ্ট! দিন দশেক ধরে রূপক ঢাকায় নেই। ও এয়ারলাইন্সের কাজে সিঙ্গাপুরে গেছে। নিঃসঙ্গতার কষ্ট ওর বুকের ভেতরে ঘুরপাক খায়। ও বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা দেখে ভেতরে ঢোকে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরে রূপক ওকে একবারও ফোন করেনি। ওখানকার ফোন নম্বর না জানার কারণে রূপশ্রী নিজেও যোগাযোগ করতে পারেনি। প্রবল মন খারাপ নিয়ে ও বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে।

তখন বেজে ওঠে ফোন।

কে ফোন করেছে সেটা দেখার আগ্রহ প্রকাশ না করে ও ফোন ধরে।

হ্যালো।

আমি রূপক সোনাবরু।

ওহ রূপক! তোমার খবর না পেয়ে আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম।

ওপাশ থেকে শোনা যায় হা-হা হাসি।

রূপ সোনাবরু, মরণ কি এতই সহজ!

তুমি কেমন আছো রূপক?

ভালো আছি, খুব ভালো আছি। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন অফিস – সব মিলিয়ে আনন্দে আছি।

আমাকে মিস করোনি?

মিস করার সময়ই তো পাইনি। রাতে ঘরে ফিরে কী খাব এসব নিয়ে ব্যস্ত থেকে, অনেক রাতে ঘরে ফিরে ঢাকা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।

ও তাই। রূপশ্রীর বিষণ্ণ কণ্ঠ ওর নিজের কাছেই বেমানান শোনায়। রূপক দূরে আছে, যোগাযোগ করেনি ভাবতে ওর চোখ ভিজে যায়।

ভেসে আসে রূপকের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ। রূপশ্রীর বিষণ্ণ কণ্ঠ উপেক্ষা করে এই হাসির তোড় ওর মন আরো খারাপ করে দেয়।

তোমাকে একটি জরুরি কথা বলার জন্য ফোন করেছি সোনাবরু। তুমি এখন কী করছ?

বাগানে দাঁড়িয়ে আছি।

সন্ধ্যা হয়েছে না? তোমার সঙ্গে আর কে আছে?

কেউ নেই। আমি একা।

ভালোই হয়েছে।

তোমার জরুরি কথা কী?

আমার এই অফিসে পোস্টিং হয়েছে। আমি ঠিক করেছি এখানেই থেকে যাব। আপাতত কয়েক বছর দেশে ফিরব না।

দেশে ফিরবে না? তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না? তুমি আমাকে মিস করবে না?

আবার হা-হা হাসি। হাসির তোড় ছড়িয়ে যায় রূপশ্রীর পুরো শরীরে। ও ভয়ে-আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে। রূপককে অচেনা মনে হয় ওর। হাসি থামিয়ে কথা বলে রূপক।

তোমার সঙ্গে আমার প্রেমের স্মৃতি আমার বুকে সোনার খনি হয়ে থাকবে রূপশ্রী সোনাবরু। আমি তোমাকে মিস করছি না। সামনে আমার নতুন জীবন।

বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফোনের লাইন। রূপশ্রীর সামনে থেকে আড়াল হয়ে যায় রূপক। ও আকাশে উড়িয়ে দেয় একটি শব্দ, লুচ্চা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত