গ্রামে পৌঁছতে-পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে গেল। অটোটা রায়মনির ডাঙ্গার পাশে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ওপর থেকে অপেক্ষমাণ সবাই হুড়মুড় করে নেমে আসে। বয়োজ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি কাইয়ুমভাই বললেন, আমরা কখন থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সে ঘণ্টা দেড়েকের ওপরে হবে… ভাই…
রাস্তার যা অবস্থা… বারেক পেটে ভাত ছিল না… বলে ফজল, অটোচালকের পাওনা
মিটিয়ে দিতে-দিতে। ততক্ষণে তার সুটকেসটা একজন হাতে উঠিয়ে নিয়েছে।
গাড়িতে আমি একা… ঝাঁকুনি খাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য প্যাসেঞ্জার পর্যন্ত নিয়েছি… তারা সব নেমে গেছে রাজহাটিতে। এদিকের রাস্তাটা অবশ্য অনেকটা ভালো… মোরাম বেশ বসে গেছে। পাকা হবে কবে? সবলসিংহপুর খুব ধীরে এগোচ্ছে।
কথা চলছে দু-বছর ধরে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। নতুন পুকুরের পাড় ধরে তারা মেহেদি
মহলস্নার ভিটেয় ওঠে। দুটি বাড়ি ছাড়িয়ে একতলা পাকা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। এটা ফজলের বড় ভাগ্নে নাজিরের। দোতলাটা করতে পারেনি। একতলায় দুটো কামরা। বেশ বড়। গাঁথুনিও ভালো। বারান্দার বাঁদিকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে রান্নাঘর করে নিয়েছে। বেশ ভালো ব্যবহার করেছে স্পেসটা। ঘরদোরের রংও করেছে সুন্দর। একটা রুচির পরিচয় আছে।
ফজলের আগমনের জন্যে নাজিরের স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি কামরাচ্যুত। বেডটা ডাবল, ধোয়া চাদর মোড়া। বালিশের ওয়াড়ও পরিচ্ছন্ন। আছে এক্সট্রা চাদর, ভাঁজ করে রাখা। সব ব্যবস্থা সুচারু।
ভাই, জুতো খুলে পা উঠিয়ে বসুন।
কামরায় একটা পস্নাস্টিকের চেয়ার ছিল, ফজল চেয়ার টেনে ওটার ওপর বসে জুতো খোলে।
ভাই, খাবার দিয়ে দেব? কাইয়ুমের প্রশ্ন।
তৈরি করতে থাকুক। আমি ততক্ষণ হাত-মুখ ধুয়ে নিই।
ঠিক আছে। ছোট ভাইদের একবার দেশে আসতে বলবেন না? কাইয়ুম কথা চালিয়ে যায়।
বলব। ওরা সবাই কাজে ব্যস্ত। আমি অবসরপ্রাপ্ত বলে ইচ্ছা করলেই আসতে পারব।
তা ঠিক। চাকরি-জীবন বাঁধা-জীবন। ইচ্ছা করলেই দেশ-বিদেশে যাওয়া যায় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়ার সম্পর্ক ভালো হওয়া সত্ত্বেও এখনো ভিসা করাটা বড় ঝামেলার। আপনাকে সশরীরে হাজির হতে হবে। বুড়ো-হাবড়া যা-ই হোন।
ফজল ঘর থেকে বেরিয়ে রকে বসে হাত-পা ধুয়ে নেয়। চাপকলের জলটা ঠান্ডা। বেশ আরাম পায়।
এরই মধ্যে বিছানায় দস্তরখান বিছিয়ে ভাত-তরকারি রাখা হয়ে গেছে।
ছোটবেলায় দাদির হাতের রান্নার কথা মনে পড়ে ফজলের। পুঁইশাক-কচু-কুঁচোচিংড়ির রান্নাটা তার খুব প্রিয় ছিল। সামনে তা পেয়ে সে খুব খুশি।
শুধু ডাল আর শাক দিয়েই খাচ্ছে দেখে ভগ্নিপতি বলে, মাছ-মাংস কিচ্ছু ধরছেন না যে?
শাকটা খুব ভালো লাগছে। আর কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না।
তা বললে কী হয়! কষ্ট করে আপনার বউমা সব রান্না করেছে।
সত্য বলতে কি কাইয়ুমভাই, মাছ-মাংসে এখন অরুচি ধরে গেছে।
তা রোজ খেলে হতে পারে।
খাওয়া শেষে ফজল এবার বিছানায় গা রাখবে।
কাইয়ুমভাই, একটু গড়িয়ে নিই, বিকেলে তখন গ্রামে রোঁদ দিতে বেরোব।
বিকেল হতে আর কতক্ষণ। আপনি বিশ্রাম নিন, সময়মতো আমি ডাক দেব।
ভাদ্র মাস। ভ্যাপসা গরম। পাখাটা ফুল দমে ছাড়তে হলো। সব জানালা বন্ধ করে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে কাইয়ুম বেরিয়ে যায়। ছোটদের নির্দেশ দেয়, কেউ যেন গোলমাল না করে।
মিনিট পনেরো-বিশ পর ফজলের চোখজোড়া সবে লেগে এসেছে, এমন সময় মাথার কাছে গলিতে দুড়দাড় শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে, অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ। একবারে যে থেমে গেল তা-ও নয়, থেকে-থেকে জোড়ায়-জোড়ায় চলেছে। এবার হইচইও শুনতে পেল।
এই সময় তার দরজার সামনে একটি বালিকার তীব্র কণ্ঠস্বর কানে এলো। বেশ ক্ষুব্ধস্বরে বলছে, শালা হুনমোন, তোর পোঁদে গরম সিক ঢুকিয়ে দিলে তবে মজাটা বুঝবি…
চমকে ওঠে ফজল। মনে হলো, সে যেন ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগের হুগলির সবলসিংহপুরে ফেরত গেছে। তখন এই গ্রামে অনেক হনুমান ছিল। এরা দল বেঁধে থাকত। দলের সর্দারটাকে বলা হতো বীর হনুমান। অবশ্য গ্রামের লোক হনুমান বলত না, বলত হুনমোন। সেই হুনমোন শব্দ এখনো চলে আসছে!
ঘুমের বারোটা বেজে যাওয়ায় উঠে পড়ে। দরজা খুলে দেখে, পাঁচ বছরের মেয়েটি পুকুরের পুবপাড়ের দিকে চেয়ে। ওদিকে দৃষ্টি চালিয়ে ফজল একটি ধেড়ে হনুমান দেখতে পেল। বড় একটা বাক্সবাদাম গাছের ডগায় বসে। আর নিচ থেকে ছেলে-ছোকরার দল ঢিল মেরে চলেছে। হনুমানের ভাগ্য ভালো, ঢিল অদ্দূর পৌঁছোচ্ছে না।
কে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, এই হুনমোনটাকে মারার জন্যে একটা বন্দুক দরকার। হারামিটা বড় জ্বালাচ্ছে। আমাদের দুটো লাউ ছিঁড়েছে!
আর একজন বললে, আমাদের কলার কাঁদিটা সাবাড়।
এই আপদটাকে শেষ করতে হবে বলে ওঠে আর একজন।
বন্দুক কথাটা ফজলের কানে বেশ শব্দ করে বাজতে থাকে। আবার সে অতীতে পৌঁছে যায়। মনে পড়ে সেই ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসের কথা। তার বয়স তখন পাঁচ-ছয়, তারা আছে গ্রামে। এদিকে বাবা-চাচারা সবাই কলকাতায়। শুরু হয়েছে হিন্দু-মুসলমানে ইতিহাসখ্যাত গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। পাকিস্তান-আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই সময়ের ঘটনা। বেশ কয়েকটা দলছুট হনুমান গ্রাম সবলসিংহপুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের ফলমূল সাবাড় করছে। দাঙ্গার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে যুবকরা সবাই গ্রামে। তারা এই হনুমান নিধনের জন্যে উঠেপড়ে লাগে। একদিন সকালে সবাই মিলে দলটাকে তাড়া করল। হনুমানগুলো এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া, কিন্তু গ্রাম ছাড়ছে না। এই গ্রাম ছেড়ে যাবেই বা কোথায়! অন্য গ্রামে খাবার-দাবার না পেয়েই তো তারা এখানে আস্তানা গেড়েছে। হনুমানকুল এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। এমন করতে-করতে ওরা মেহেদিমহলস্নার একটা বড় কদমগাছে আশ্রয় নেয়। গাছটা বেশ উঁচু। ঢিল মেরে কাবু করা যায় না। তবু চারদিক থেকে ঢিল ছোড়া হচ্ছে। ছোটরা পাটকেলগুলো কুড়িয়ে এনে বড়দের হাতে তুলে দিচ্ছে। ছেলেরা ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এবার বন্দুক জোগাড় করবে।
গ্রামে একমাত্র তিনতলা পাকাবাড়ি কাজী খিলাফত হোসেনের। তাদের আছে বন্দুক। সবাই মিলে কাজী সাহেবদের বাড়িতে হাজির। তাদের জোয়ান ছেলেদেরও কোনো কাজ ছিল না। তারা সানন্দে বন্দুকে টোটা ভরে সঙ্গ নেয়। সবাই কদমগাছতলায় পৌঁছে দেখে শুধু বীর হনুমানটা আছে। হঠাৎ দলবেঁধে সবাইকে আসতে দেখে হনুমানটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। হয়তো ভাবছে এবার কী করবে। তার দল অন্যদিকে চলে গেছে। সে একা।
কাজীদের ছোট ছেলে জালালের হাতে বন্দুক। সে হনুমানটাকে তাক করে। কী অদ্ভুত, সবাইকে অবাক করে দিয়ে হনুমানটা জোড়হাত করে। ঠিক মানুষের মতো মাফ চাচ্ছে। কিন্তু তার শত্রম্ন মানবকুলের মনে কোনো রকম করুণার উদ্রেক হলো না। তারা আরো বিদ্রূপে ফেটে পড়ে।
হারামি, এখন জোড়হাত করা হচ্ছে!
তখন দু-একজন বললে, জালালভাই, একটা ফাঁকা আওয়াজ করে তাড়িয়ে দিন।
কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ছেলেপিলে হনুমান নিধনের পক্ষে।
জালাল কোনোরকম আর কালবিলম্ব করে না। ফায়ার।
অব্যর্থ তাক। গুলির মূল ছররাগুলো বুক বিদ্ধ হয়।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপাস করে হনুমানটা মাটিতে এসে পড়ে।
দুবার হাত-পা খিঁচিয়ে স্থির হয়ে গেল।
ছেলের দল গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ফজলের মনে পড়ে, সে পেছন থেকে দেখছিল। সামনে যেতে ভয় লাগছিল। এতটুকু মানুষ রক্ত দেখে ভয় পাওয়ারই কথা।
এই সময় পেছন থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে, এ্যাই, তোরা কী করছিস ওখানে!
সবাই লোকটির দিকে চেয়ে দে ছুট।
ফজল পালাতে পারল না। দেখল লোকটা তার বাবা, তখন তার পেছনে চলে এসেছে।
ফজল, ঘরে যাও। বাবা ধমক দিলো। চলে যেতে-যেতে সে ফিরে দেখে, বাবা তখন হনুমানটার সামনে বসে চেয়ে থাকা চোখদুটো বন্ধ করে দিচ্ছে।
এখনো পরিষ্কার মনে আছে, বাবা বাড়িতে ঢুকে রাগারাগি করতে লাগল দু-দাদার ওপর।
আপনারা সব ঘরে বসে আছেন, ওদিকে ছেলেরা বন্দুক দিয়ে হনুমান শিকার করছে। এদিকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে হত্যা করছে। গ্রামে ফিরেও যদি শামিত্ম না পাই, এখানেও যদি হত্যাকা- দেখতে হয়… তা-ও নিরীহ প্রাণী…
পরে বাবা কয়েকজনকে ডেকে চাটাইয়ে তুলে হনুমানটাকে কবরস্থানের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় মাটি খুঁড়ে কবর দেয়।
কাঁচাঘুম ভেঙে গিয়েছিল ফজলের, তবু নিজেকে শান্ত করে এগিয়ে চলে পুকুরপাড়ের দিকে। কাছে গিয়ে ছেলেদের বলে, সবাই এদিকে এসো। তোমাদের একটা গল্প বলি। আজ থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগের ঘটনা।
সবাই তার সামনে এসে গোল করে ঘিরে দাঁড়ায়।
ফজল পুরো ঘটনাটা বলে চলে।
তারপর জিজ্ঞেস করে, তোমরা জানো, সেই লোকটা কে? লোকটা যে তার বাবা, এই কথাটা সে ছেলেদের সামনে চেপে যায়।
পনেরো-ষোলো বছরের এক যুবক বললে, জানি, তিনি আমাদের গ্রামের একজন নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন। আমরা প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তাঁর জন্মদিন পালন করি। ফজলের পরিচয় সে তখনো জানে না।
ফজল এবার পরিচয় দেয়। তারপর বলে, তোমরা এই হানুমানটাকে মেরো না। খাবার না পেয়ে এদিকে দলছুট হয়ে চলে এসেছে। চলো, আমরা সেই বন্দুকের গুলি খাওয়া হনুমানটার কবর দেখতে যাই।
ফজলের পিছু-পিছু ছেলের দল এগিয়ে চলে হনুমানের কবর দর্শনে।