অন্তমিল

অন্তমিল
অফিস যাওয়ার আগে নিশির দিকে একবার তাকালাম। স্নিগ্ধ নীল আকাশের মেঘের মতো মুখের মায়াগুলো কেমন যেন মেঘলা আকাশে ছেয়ে গেছে । এই মলিন মুখটির দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপের এক নীল রোদের বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায় । যে বিষণ্ণতা কখনো দেখা যায় না শুধু অনুভব করা যায়। নিশি আমার তাকানোর দৃষ্টিতে মন খারাপের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“কখন আসবে?”
“দেখি,যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার চেষ্টা করবো।”
“ওহ্,আমার কেন যেন ভালো লাগছে না একদম। অস্থিরতা ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধু।” আমি নিশির কোমল গালদুটো আলতো করে ধরে বললাম, “চিন্তা করো না। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো।”
নিশি আমার কথায় কিছু বললো না। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শাড়ির আঁচলটা মুষ্টিমেয় করে আঙুল দিয়ে পিচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। নিশির এমন তাকিয়ে থাকা আমার মনে অবহেলায় ফোঁটা কাশফুলের মতো বিষাদময় করে তোলে। নিশির মুখ যেন বলছে,আজ না গেলে হয় না। তুমি জানো না আমার খুব ভয় হচ্ছে। সেই ঘটনাটা আমাকে দিনরাত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি নিশির থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু মনের ভেতর নিশির জন্যে অস্থিরতা কিছুতেই দূর হচ্ছে না। একবার ভাবলাম যাওয়া বাদ দিলেই ভালো হয়। কিন্তু কয়দিন পরেই কুরবানীর ইদ। তাই এখন ছুটি নেওয়াটা বেমানান।
গেটের সামনে এসে আমি তিনতলার বিল্ডিং এর ঝানালার দিকে একবার তাকালাম। দেখি নিশি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশে শিউলি ফুলের গাছ থেকে পাড়ার ছেলেপেলেরা ফুল কুড়াচ্ছে। আমি কি জানি ভেবে তাদের কাছ থেকে শিউলি ফুলগুলো কিনে নিয়ে দৌড়ে গেলাম আবার নিশির কাছে। কারণ শিউলি ফুল নিশির খুব পছন্দের। রিকশাওয়ালা রোগা। কিন্তু রিকশা চালাচ্ছে বেশ জোরে। এদের গায়ে তেমন কিছু না থাকলেও মনের জোর দিয়ে এরা অসাধ্য সাধন করতে পারে। বাড়ির মানুষের চিন্তা এদের মনোবলকে আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজের জীবনের সুখ না থাকলেও পরিবারের কাছ থেকে প্রাপ্তির সুখ এদের খুব প্রয়োজন। আমি কি জানি ভেবে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি অবস্থা চাচা?”
“জি, ভালো।”
“কোথায় থাকেন?” রিকশাওয়ালা বেশ সময় নিয়ে বললেন, “সাত নম্বর বস্তিতে।”
আমি বেশ বুঝতে পারলাম রিকশাওয়ালার বেশ অস্বস্তি লাগছে। অচেনা কারো কাছে রিকশাওয়ালারা সহজে পরিচয় দিতে চায় না। রিকশাওয়ালাদের সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার স্বভাব আমার কখনো ছিল না। এই স্বভাবটা নিশির। অচেনা, অজানা মানুষের সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়া তার কাছে ছিল এক ধরণের অন্যরকম ভালোলাগা অনুভূতি। কিন্তু আমার কাছে ছিল নিছক পাগলামি। এই স্বভাব নিয়ে নিশিকে মাঝে মাঝে বলতাম, “কি বিশ্রী স্বভাব তোমার? অচেনা মানুষের সাথে কথা বলা কিন্তু একটা বড় বদ অভ্যাস।” নিশি হাসতো। হাসতে হাসতে বললো, “কই কথা বলি? মাঝে মাঝে দু-একটি বলি। আর শুনো বদ অভ্যাস ছিল বলেই তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে। তা না হলে এই নিশির সাথে তোমার পথচলা কখনো হতো না মশাই।” একদিন এক রিকশাওয়ালার সাথে আলাপ করতে করতে শুনলো তার মা খুব অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য হাজার দশকের মতো টাকা প্রয়োজন। এই কথা শুনে নিশির কি জানি হলো। নিশি হ্যান্ডব্যাগে হাত দিতে যাওয়ার সাথে সাথে আমি হাতটা ধরে ইংরেজিতে নিশিকে বললাম,
“লোকটির কথায় বিশ্বাস করো না, হয়তো মিথ্যা কথা বলছে।”
“সত্যিও তো হতে পারে। বেনিফিট অফ ডাউট বলে একটা কথা আছে।”
“দেখো আজকাল এসব অহরহ হচ্ছে। আমি নিশ্চিত লোকটা ধোঁকা দিচ্ছে। কে জানে এই টাকা নিয়ে লোকটা মদ গাঁজা কিনে খায় কিনা?” নিশি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, “আমরা বরং এক কাজ করি তার বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করি। তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।”
আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিশি জোর করে আমাকে রিকশাওয়ালার বাসায় নিয়ে গেল। গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি তার মা খুব অসুস্থ। এরপর আমরা ওনার মা’কে হাসপাতালে ভর্তি করাসহ চিকিৎসার জন্য সকল খরচপাতি দেই। নিশিই মূলত এইসব করে। রিকশাওয়ালার মা নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, “অনেক বড় হও মা। তুমি দেইখো আল্লাহ তোমারে এর প্রতিদান একদিন ফিরাইয়া দিব। আল্লাহ ভালার জন্য ভালা কিছু রাখে।” বিদায়ের সময় সেই রিকশাওয়ালা কিছু বলতে পারেনি। শুধু হাত জোর করে কৃতজ্ঞতার চোখের পানি ফেলছিল। হয়তো কৃতজ্ঞতায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। আর আমার মনে নিশির প্রতি স্নিগ্ধ অনুভূতির এক আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। যে অনুভূতি নিজের ভেতর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করাচ্ছিল।
অফিসে প্রবেশ করার সাথে সাথে আবিদ ভাইয়ের সাথে দেখা। এই ইট পাথরের শহরের মাঝে একমাত্র এই মানুষটি আমার খুব আপন। পড়াশোনা কমপ্লিট করে যখন চাকরি খুঁজছি তখন এই মানুষটি আমার পাশে দাঁড়ায়। মাস্টার্সে পড়াকালীন তার সাথে অদ্ভুতভাবে পরিচয় হয়। অথচ সুসম্পর্ক হতে সময় লাগেনি। আর এই ভালো সুম্পর্কের জন্য তিনি নিজ থেকে আমার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেন। ভোজনপ্রিয় মানুষ ইনি। বউ এর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে পেট বাড়িয়েছেন,সাথ ে ডায়াবেটিস।আমি বললাম, “আসসালামুয়ালাইকুম ভাই,কি অবস্থা?” আবিদ ভাই সালামের উত্তর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বুঝলি আরিফ,এই মেয়ে জাতিরা খুব অদ্ভুত। এদের বুঝানোও যায় না, আবার বুঝাও যায় না।” “কেন ভাই? হঠাৎ এই কথা কেন বলছেন?” “আর বলিস না। সামনে ইদ। এবারের বেতনটা এখনও হাতে পাইনি। অথচ তোর ভাবী কেনাকাটার জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করেছে। আমি তো বুঝতে পারছি যে সে কেন কেনাকাটা করতে চাইছে? শুনেছি ওর সব বান্ধবীদের কেনাকাটা শেষ। শুধু ওর বাকি। আর এজন্যই কেনাকাটা করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তুই বল আমি টাকা পেলে কি ইদের কেনাকাটা করবো না? আর আজ এই বিষয় নিয়ে তোর ভাবীর সাথে সকালে রাগারাগী করেছি।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি জানি মিতালি ভাবী একটু অন্যরকম। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ভালোবাসে। কিন্তু মনটা খুব ভালো। আমি বাসায় গেলে আমাকে না খাইয়ে ছাড়েন না। আবিদ ভাই আবার বললো,
“আমার খবর বাদ দে। বল নিশির কি অবস্থা? মেয়েটা কি এখন স্বাভাবিক?” “স্বাভাবিক হওয়ার মতো কিছু নেই ভাই। সারাদিন একা একটা মেয়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকলে স্বাভাবিক হওয়া সহজ নয়।” আবিদ ভাই আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আমি আর কিছু না বলে সোজা নিজের ডেস্কে এসে বসলাম। আমারও কিছু ভালো লাগছে না। নিশির কথা খুব মনে পড়ছে। কি জানি নিশির অবস্থা এখন কেমন? বেশ কিছুক্ষণ পর মিতালি ভাবী আমার ডেস্কের সামনে এসে বললো,
“কেমন আছো আরিফ?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
“ভালো আর থাকি কই? ভাবলাম এবার কিছু কেনাকাটা করবো? তোমার ভাই খুব কিপ্টা। এমনিতেই খরচ করতে চায় না। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হয় না অনেকদিন। এবার যাবো। কিন্তু এতদিন পর যাওয়ার সময় তাদের জন্য কিছু না তো কিছু কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু দেখো তোমার ভাই কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। আমি জানি তার বেতন দেয়নি। কিন্তু এমনও তো না যে কেনার মতো সামর্থ্য নেই। আর তুমি তো জানোই তার ভুঁড়ি কেমন করে বাড়ছে। সাথে আবার ডায়াবেটিস। আর এই নিয়ে তার সাথে সবাই হাসি তামাশা করে। মাঝে মাঝে এই নিয়ে লোকটার মনে বিষণ্ণতা এসে দলা বাঁধে। আর এই বিষণ্ণতা দূর করার একমাত্র উপায় আমি। তাহলে বলো আমিই কেমন করে তাকে বুঝাই যে এই কড়া রোদের মধ্যে ভুঁড়িওয়ালা একজন ডায়বেটিস রোগিকে নিয়ে ভিড়াভিড়ির মধ্যে কেনাকাটা করা কষ্টকর। পরে আড়ালে আবার মনে কষ্ট পাবে। এমনিতেই এই লোকটাকে দেখলে এক প্রচন্ড মায়া জন্মে। তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয় না গো। তাই বলছি ইদের বেশ কিছুদিন আগে কেনাকাটা করবো যেন কোনো সমস্যা না হয়।”
আমি ভাবীর কথায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আমি অনুধাবন করি এই শহরের মাঝে মানুষের ভেতরের চিন্তা ভাবনাগুলো কতোটা ভিন্ন। প্রিয় মানুষটার জন্য একেক জনের মনে একেক রকম ভাবনা।
এই ছোট ছোট ভাবনাগুলোর মধ্যে এক জন আরেকজনকে ভালো রাখার জন্য মনে যে স্বচ্ছ অনুভূতিগুলো জন্ম নেয় তা প্রিয় মানুষটির সাথে ভালোবাসায় বেঁচে থাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিতালি ভাবী বিষণ্ণ মুখে বললো, “তোমার ভাই আমার উপর এই নিয়ে না জেনে রাগ করেছে। আর এই নাও তোমাদের জন্য খাবার। আমি শুনেছি তোমাদের অবস্থা। ছেলে সোহেলের জন্য দেখতে যাওয়া হচ্ছে না। তোমার খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে বলেই দিয়ে যাচ্ছি। তুমি আর ও মিলে খেয়ে নিও কেমন। আসি আমি।” আমার ডেস্ক আর আবিদ ভাইয়ের ডেস্ক বেশ দূরে। তবুও মিতালি ভাবী যাওয়ার আগে আবিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে বললাম। কিন্তু ভাবী দেখা করলেন না। হয়তো অভিমান করেছে। আমি অনুধাবন করি এই ভালোবাসাময় স্বপ্নছবির। যেই ছবিতে রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সবকিছু লুকায়িত আছে সেই প্রিয় মানুষটার জন্য। যার বুকে মাথা রেখে যেমন বাঁচতে চায়। আবার তেমনি অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রাখতেও চায় যেন প্রিয় মানুষটি তার মনের কথা বুঝে তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
কিন্তু আমার মনে এসবের বাইরে একটা ভিন্ন চিন্তা উদয় হলো। আমার অতীতের কিছু দুঃস্বপ্নের ছায়াছবির গল্পকথা আমার হৃদয়ের মাঝে উথাল পাতাল ঢেউ বয়ে আনলো। আজ কেন জানি আমার বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ছে। যা আমার বুকের মাঝে কষ্টময় উপলব্ধি ছাড়া আর কিছু দিতে পারছে না। আক্ষেপ জাগাচ্ছে সেই ধূসর অতীগুলোর কিছু ভুলবৃষ্টির গল্পগুলোর জন্য। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব একরোখা টাইপের ছিলাম।মন যা চাইতো তাই করতাম । কখনো নিজের অভিযোগ শুনতে চাইতাম না। আর এই আত্নকেন্দ্রিক স্বভাব আমাকে আমার পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রায় সাত বছর পরিবার থেকে দূরে সরে আছি। বাবা-মার সাথে অনেকদিন হলো দেখা হয় না। কথাও হয় না। আমিই যোগাযোগের সবকিছু আড়ালে রেখে দিয়েছি। মনের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে মিথ্যে হাসির জীবন নিয়ে চলছি।
আমার মা ছিল খুব জেদি । আর বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী। আর এই দুজনের স্বভাব নিয়েই আমার বড় হয়ে উঠা। তাদের শাসনের পর্যায়ে যখন থেকে প্রতিবাদ করতে শুরু করলাম তখন থেকেই আমি তাদের কাছে খুব অবাধ্য হয়ে গেলাম। ভালোমন্দ সবকিছুতেই নিজের ইচ্ছে প্রাধান্য দিতাম। আর বাবা-মার সাথে রাগারাগী করতাম। বাজে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিশে ধীরে ধীরে আমার স্বভাব আরো অবনতির দিকে যাচ্ছিল। ক্লাস নাইনে সিগারেট ধরি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পড়ালেখায় আগ্রহটা হারাইনি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে আমার কাছে পড়াশোনা করা একপ্রকার জেদ হিসেবে ছিল। আমার আগে কেউ যাবে এটা সহ্য করতে পারতাম না। এসএসসি পাশ করার পর আমার চরিত্র যখন ধীরে ধীরে আরো অবনতি হচ্ছিলো তখনি আমার জীবনে আবির্ভাব ঘটে মিলির। মিলি আমার সাথেই পড়তো।
দীর্ঘদিন পরিশ্রম করার পর তার সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক হয়। প্রেমে পড়লে প্রেমিকার সবকিছু মানতে ইচ্ছে করে। আর আমি সেই সময় ছিলাম উঠতি বয়সের যুবক। মিলির প্রেমের ছোঁয়ায় খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে লাগলাম। এরপরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো। মিলির সাথে প্রেম করা যেন আমার জীবনে এক নতুন মোড় নিল। আমি মিলির প্রায় সব আবদার রাখতাম। পড়াশোনাতে মোটামুটি থেকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব উন্নতি করার চেষ্টা করতাম। কারণ আমি মিলিকে নিয়ে মনের ভেতর হাজার বছর বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম। মিলির ঠোঁটের নিচে তিলটাতে আমার দুর্বলতা লুকায়িত ছিল। আমি মাঝে মাঝে তা ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য বলতাম, “জানো তোমার ঐ তিলটাতেই আমার যতো দূর্বলতা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোমার ঠোঁটের নিচে ঐ তিল হয়ে তোমার ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দেই।“ মিলি কপাট রাগ করে অভিমান করতো। আমি অভিমানী মুখ থেকে হাঁসি ফুটানোর জন্য পাগলামি করে তার গোলাপী ঠোঁট জোড়ার হাসির কারণ হতাম। এভাবেই আমাদের প্রেমের বসন্ত চলছিল।
দু’বছর পর একদিন হঠাৎ করে আমার বাবা-মা আমাদের ভালোবাসা সম্পর্কে সবকিছু জেনে গেল। আর এই জেনে যাওয়াই যেন কাল হলো আমাদের। বাবা সব জেনে রাগারাগী শুরু করলেন। মারও দিলেন বেশ কয়েকটা। আর মা উস্কানি দিচ্ছিলেন। কিন্তু কথায় আছে না রক্ত কথা বলে। আমি আমার জেদ ধরে রাখলাম। যতো কিছুই হোক মিলিকে আমার চাই। একদিন মিলি আমাকে রাতে ফোন দিলে ফোনটা আব্বা ধরে মিলিকে অপমান করতে শুরু করে। জোর করে মিলির বাবার সাথে কথা বলে এই বিষয়ে। মিলির বাবা সবকিছু শুনে মিলিকে বিয়ে দিয়ে দ্রুত দেয়। আমি বিয়ের আগে মিলিকে বলেছিলাম, “চলো, হারিয়ে যাই।দূর অজানায় সংসার পাতি দুজনে।” মিলি বাংলা সিনেমা নায়িকাদের মতো করে ঐ এক কথায় বলেছিল, “আমি আমার বাবা-মাকে খুব ভালোবাসি। তাদের অবাধ্য হতে পারব না। আমাকে মাফ করো।”
আমি সেদিন মিলিকে একটি চড় দিয়ে চলে আসি। এরপর থেকে আমার মনে হতে লাগলো মিলির বিয়ে হওয়ার জন্য আমার বাবা-মা দায়ী। তাদের অতিরিক্ত চুলকানি মিলিকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আমি কেমন যেন হয়ে যাই। মেজাজ আগের চেয়ে আরো অবনতি ঘটতে থাকে। বাবা-মার কোনো কথায় সহ্য হয় না। রাগ হয় ভীষণ। আর এই রাগী মনোভাব আমার জীবনে অন্য একদিকে মোড় নেয়। এইচএসসি পরীক্ষার দেওয়ার পর হঠাৎ একদিন মা’র সাথে আমার কি বিষয় নিয়ে যেন খুব রাগারাগী হয়। আমার মা’র জিদ আর আমার রাগ এবং জিদের সংমিশ্রনে এক ধরনের বড় ঝগড়া সৃষ্টি হয়। মা’র কথাগুলো যখন গায়ে লাগতে শুরু করলো তখন আমার হঠাৎ কি জানি হলো। নিজের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে মা’কে একটা প্রচন্ড ধাক্কা দেই। যার ফলে মা টেবিলের কানি লেগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা কিছুক্ষণ বোঝার পর আমার মাথায় ভাবান্তর হতে শুরু করে। বাবা বাসায় ছিল না। ছোটবোন কোথা থেকে এসে মা’র মাথায় রক্ত দেখে জলদি হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মাথায় প্রচন্ড চাপ অনুভূত হচ্ছিল। বিশাল পাহাড় সমান অপরাধ মাথা চাড়া দিচ্ছিল। আমার এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে এতটাই অপরাধবোধ মনে হচ্ছিল যে নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে করছিল। মা’র অবস্থা দেখার জন্য আমার বাবা আমাকে মা’র কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। বাবা আমাকে চড় দিয়ে বলেছিল, “কুত্তা জন্ম দিছি একটা। মা’র গায়ে হাত তুলে যে সে আমার ছেলে হতে পারে না। তোর মরে যাওয়া উচিত শুয়োর।” সেদিন বাবার চোখের জলে সংমিশ্রনে কথাগুলো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছিল। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপর আর অপরাধ সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাই বাসা থেকে। মা’র সামনে দাঁড়ানোর সাহসটা কপূরের মতো হাওয়ায় উড়ে গেছিলো। দূরে সরে যাই তাদের থেকে।
ঢাকায় আসার পর এ পথ থেকে ও পথ ঘুরে রাস্তার দোকানে একটা চাকরি নিয়েছিলাম। সারাদিন দোকানে কাজ করতাম আর রাত্রে ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার জন্য পড়তাম। নিজেকে অসহায় মনে হলে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন এমনি এমনি জোরদার হয়। আমার মনে সব সময় অনুশোচনা জাগতো সেই ঘটনার। নিজের প্রতি অপরাধবোধ মনোভাব আমাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে দিল। দিনরাত আল্লাহর কাছে মা’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সাহসটা হতো না। আল্লাহর অশেষ রহমতে ভার্সিটিতে ভর্তি হবার সুযোগ হয়। এরপর ধীরে ধীরে জীবনে নিজেকে একলা চলার সংগ্রামী হিসেবে চলতে শিখি। নিশির সাথে আমার পরিচয় হয় প্রায় একবছর পরে।সেদিন বাংলা একাডেমিতে কি জানি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ জয়ন্তী টয়ন্তী হবে হয়তো। এমনিতেই এসব অনুষ্ঠানের প্রতি আমার বেশ অনাগ্রহ। আরো ছিল প্রচুর গরম। মানুষের আনাগোনায় তাপমাত্রা যেন বেড়েই চলছিল। রাস্তার পাশে একটা আইসক্রিমওয়ালা দেখতে পাই।
আমি কি জানি ভেবে আইসক্রিম কিনতে যাই। যদিও এটা ছিল খুব জঘন্য একটা ব্যাপার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে আইসক্রিম খাওয়া আমার কাছে বড্ড বেমানান লাগছিল। তবুও যাই খেতে। আইসক্রিমওয়ালাকে আইসক্রিম দিতে বললাম। একটু পর ছয়-সাত বছরের বালিকা এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। মেয়েটার স্নিগ্ধ কোমল মুখের মায়াটা আমাকে আচ্ছন্ন করে এক অদ্ভুত মায়া সৃষ্টি করলো। কি জানি ভেবে আইসক্রিমওয়ালাক ে বললাম, “এর জন্য একটা আইস্ক্রিম দেন?” আইসক্রিমওয়ালা বিরক্তি মুখে একটা কম দামের আইসক্রিম বের করে দিল। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগলো। আমি বললাম, “কম দামের কেন? আমারটা যে দাম সে অনুসারে দেন।” আইসক্রিমওয়ালা আর কিছু না বলে একটা চকোবার আইসক্রিম দিল। একটু পর আরেকটা ছোট ছেলে এসে মেয়েটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেয়েটি বললো, “ও আমার ভাই।”
আইসক্রিমওয়ালাকে তার জন্যেও একটি আইসক্রিম দিতে বললাম। আইসক্রিমওয়ালা এবার বেশ বিরক্ত নিয়ে বললো, “লাভ নাই ভাইসাপ।এমনে করলে পুরো শহরের ফকির আইয়া পড়বো।” আমি কিছু বললাম না। বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি সুন্দর করে টুকে টুকে আইসক্রিম গুলো খাচ্ছিল। দুজনের চোখে কোমল লেপ্টে থাকা কি অদ্ভুত মায়া । আমি তাদের বললাম, “কি ভালো লাগছে?” দুজনে হাসিমুখে উত্তর দিল। তাদের হাসিটা যেন আমার হৃদয়ে সোনালি রোদের মতো ছুঁয়ে দিল। কিন্তু একটু পর আরেকটি মেয়ের হাসিতে আমার চোখ আটকে যায়। একটু দূরে একটা স্নিগ্ধ,রোগা, ফর্সা গোলগাল মুখে স্কাপ পড়া একটি মেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু পর মেয়েটি আমার কাছে এসে বললো, “বাহ্, বাচ্চাগুলোর সাথে দেখছি আপনার বেশ ভাব হয়ে গেছে?”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মেয়েটার মায়াময় মুখটির দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটা একটু পর বললো, “আপনি কি প্রায়ই এমন করেন?” “না।” মেয়েটা এরপর সোজাসুজি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমি নিশি। আমার বান্ধবীর আজ গান গাওয়ার কথা এখানে। ভেতরে প্রচুর গরম তাই বাইরে হাওয়া খেতে আসলাম। আমার এসব অনুষ্ঠান ভালো লাগে না। অথচ আমি এসেছি। কি অদ্ভুত তাই না?” মেয়েটাকে আমার বেশ অদ্ভুত লাগছিল। অচেনা একটা ছেলের সাথে কি সহজভাবে কথা বলছে। কোনো সংকোচ, দ্বিধাবোধ নেই। আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে ইতস্তত করে বললাম,
“আপনিও কি আইসক্রিম খাবেন?” “না। আমার গলায় টনসিল আছে। ঠান্ডা লাগলেই কথা বন্ধ হয়ে যায়।” আমি সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর নিশির সাথে পরিচয় হলো। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হলো। নিশির মায়ায় জড়ানোর স্বপ্ন জাগলো। কিন্তু আমি এই মায়াকে কখনো আপন করে নিতে চাইনি। আমার ভয় হতো। আবার কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। কিন্তু আমি যতো দূরে সরে যেতাম নিশি ততো আমার সাথে তার মায়াটাকে জাগিয়ে তুলতো। মাঝে মাঝে যখন নিশির কাজলের আঁকা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আমার স্বপ্নগুলো আঁকতাম তখন নিশি দুষ্টুমি মার্কা হাসি দিত। আমি কি করবো বুঝতে না পেরে পালিয়ে বেড়াতাম। একদিন নিশি আমাকে বলে, “তুমি আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকো?এই তাকানোর মাঝে আমি যেন অন্য কিছু খুঁজে পাই। কি খুঁজে পাই বলবে আমায়? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন কথা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার চুপ থাকা দেখে নিশি মিটমিট করে হাসতো। আমাকে লজ্জায় ফেলে সে মজা নিত। আর শুভ্র মাখা হাসি দিয়ে আমার নাকটা ছুঁয়ে দিত। এভাবে কয়েকটি বছর কেটে যায়। আমি ধীরে ধীরে অনুধাবন করি নিশির সাথে আমার বন্ধুত্ব একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। যা আমার মোটেও উচিত নয়। আর এই অনুভূতি আমার হৃদয়ের অন্তরালে যতোটা না শুভ্র অনূভুতি হয়ে ধরা দিয়েছে তার থেকে বেশি ধরা দিয়েছে আমার ধূসর অতীতের বিষাদ স্মৃতিগুলোর দুঃস্বপ্ন হয়ে। আর এই ভয়ে আমি অন্য এক শহরে চলে যাই। সেখানে নতুন করে মাস্টার্স করার জন্য এডমিশন নেই। নিশির সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। আমি চাইনা আমার ভাঙাগড়ার জীবনের মাঝে সে দূর নক্ষত্রের মৃদু আলো হয়ে জ্বলুক।
একদিন হুট করে নিশি আমার বাসায় এসে হাজির। আমি অবাক হয়েছিলাম যে আমার খোঁজ ও পেল কীভাবে। নিশি আমার কলার ধরে রাগী চোখে বললো, “আমাকে রেখে পালিয়ে চলে আসলি কেন কুত্তা?তুই কি বুঝতি না এই কাজলের আঁকা চোখের মায়া দিয়ে তোকে নিজের মাঝে আবদ্ধ করতে চাইতাম? তাহলে কেন আমাকে একা রেখে হারিয়ে গেলি?” আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলাম, “আমার এই জীবনে শুধু বিষাদের নদী প্রবাহিত হয়। স্বপ্নের ইচ্ছামতী নদীর মতো নয়। এই জীবনে কষ্ট ছাড়া আর কিছু নাই। বিশ্বাস করো আমার জীবনের সাথে জড়িত হলে তুমি তোমার স্বপ্নের রঙগুলো হারাবে। বিষাদের অনলে দগ্ধ হয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবে।” নিশি আমার দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, “শুনো তোমার জীবনে যতোই বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যাক। আমি সেই বিষণ্ণতার মাঝে ঝুম বৃষ্টি হয়ে তোমার মনটাকে ভালোলাগায় ছুঁয়ে দিব। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিব। তবুও প্লিজ আমাকে দূরে ঠেলে দিওনা।”
আমি সেদিন নিশির চোখের জলকণায় তাকে অনুভব করি জড়িয়ে ধরি। এরপর নিশি আমার জীবনের ভাঙাগড়ার কাব্যের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নেয়। আর এর ফলে তার পরিবারের সাথে অনেক ঝামেলা হয়। তবুও নিশি আমাকে ছাড়েনি। আমার ভালোবাসা হয়ে আমার পাশে থাকতে শুরু করে। আমার বিষণ্ণতার অন্ধকারে আলো হয়ে মিটমিট করে জ্বলে। আমি মুগ্ধ হই। মুগ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে আমার কাব্যে প্রেমকাব্য আঁকি। দুপুরে হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি নিশির ফোন। আমার বুকটা কেঁপে উঠে। নিশির কিছু হলো নাকি। আমি ফোন ধরার সাথে সাথে নিশি ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো, “তুমি প্লিজ চলে এসো। আমার একা একা ভালো লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। খুব ভয় লাগছে আরিফ।” আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি কোনোভাবে ‘আসছি’ বলে ফোনটা কেটে দ্রুত ছুটে যাই আবিদ ভাইয়ের কাছে। আবিদ ভাই আমাকে দেখেই বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, “তুই যা। আমি একদিকটা সামলাচ্ছি।“
আমি পুনরায় ডেস্কে এসে সবকিছু গুছিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে মিতালি ভাবীর টিফিন বাটির কথা মনে পড়লো। আমি তা আবিদ ভাইয়ের কাছে দিয়ে বললাম, “জীবনে কিছু কিছু ভাবনা থাকে যা নিজের মতো করে নয়, একটু সার্বিক পরিস্থিতি ভেবে ভাবতে হয়। আমরা যেটা ভাবি সেটা হয়তো আমাদের দিক থেকে ঠিক। কিন্তু মাঝে মাঝে জীবনের সাথে জড়িত মানুগুলোর ভাবনাটাকেও সম্মান দিতে হয়। সেখানে যেমন ভুল থাকে ঠিক তেমনি থাকে আমাদের জন্য অনুরাগ। যে অনুরাগের মাঝে আমাদের ভালো রাখার জন্য সব সময় শুভ্র ভাবনাগুলো লুকায়িত থাকে। মিতালি ভাবী আপনার জন্য পাঠিয়েছে।খেয়ে নিয়ে ফোন করে বলবেন, আজ তার ইচ্ছা রাখবেন। দেখবেন তখন তার হাসির কাছে আপনার এসব চিন্তা ভাবনাগুলো কতোটা ফিকে মনে হয়। দিনশেষে সেই হাসিটাতেই আমাদের সব সুখ-দুঃখ লুকায়িত। আর তা নিজের মাঝে আবদ্ধ করতে পারলেই আত্মতৃপ্তিটা উপলব্ধি হয়।”
আবিদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। আমি আর কিছু না বলে সোজা চলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দরজা খোলার সাথে সাথে নিশি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। দরজাটা কোনোভাবে বন্ধ করে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কি হয়েছে? এমন করছো কেন?” “আমার খুব ভয় করছে? ঐদিনের স্মৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। খুব ভয় করছে। আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরো প্লিজ।” আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। নিশির এই ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আমার মনকে বিষাদ করে তোলে। এমন নয় যে নিশি একা থাকতে ভয় পায় অথবা সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। নিশির এই ভয় পাওয়ার পিছনে গত তিনদিন আগের ঘটনা দায়ী।
গত শুক্রবারে ঘুরাফেরা করে একটু রাত করেই বাসায় ফিরছিলাম। দশটার মতো বাজে। ঠিক তখনই একটা গাড়ি আমাদের ক্রস করে চলে গিয়ে আবার হঠাৎ করে সামনে থামলো। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের দিকে ব্যাক করতে লাগলো। তিন চারজনের মতো ছিল সেই গাড়িতে। তারা আমাদের দেখে টিটকারি মারতে শুরু করলো। নিশি খুব ভয় পেয়ে আমার হাত খামচে ধরলো। আর বললো কিছু না করতে। আমি নিশির কথায় চুপ করে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে দুজন গাড়ি থেকে নেমে আমাকে আর বাকি দুজন নিশিকে টেনে গাড়িতে উঠাতে লাগলো। আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম, “ভাই কি হচ্ছে এসব? ছেড়ে দেন ওকে। আপনাদের কাছে হাত জোড় করছি?” এদের মধ্যে একজন আমার চুল ধরে ছুরি গলায় নিয়ে বললো, “বেশি চিৎকার পারলে এই ছুরি দিয়ে জিব কেটে দিবো শালা। অনেকদিন ধরে ফূর্তি করি না। আজ একটা খাসা মাল পাইছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পেটের ভেতর হান্দাই দিব শালার পুত।”
ওদিকে নিশি চিৎকার করে নিজেকে ছাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। রাস্তায় মানুষজন কম ছিল। হয়তো কেউ দেখেও আমাদের বাঁচাতে আসছিল না। এরমধ্যে একটু পর তাদের একজন বললো, “ভাই,মাল তুলছি। তাড়াতাড়ি আহেন।” তার কথা শুনে যে আমার চুল ধরছে সে বললো, “শোন নিজে বাঁচলে বাপের নাম। বাইচা থাকলে এরকম আরো অনেক ভাল মাল পাবি। তাই বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। না হলে শইলের মধ্যে জীবনডা আর থাকবো না।” ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যেতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গাড়ির পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। আর বলতে চিৎকার করে মানুষজনকে ডেকে বাঁচাতে বললাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। হঠাৎ করে উস্টা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। ঠোঁট কেটে গেল। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেই। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।
যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দেখি নিশি আমার দিকে দৌড়ে আসছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। নিশি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি পুলিশের চেকপোস্ট। তাই হয়তো ওরা নিয়ে যেতে পারেনি। সেখানে কোনো এস আই ছিল না। কিছু হাবিলদার ছিল। আমি সামনে যেতেই ঐ গাড়ির ভেতর থেকে একজন বেড়িয়ে বললো, “মালটার কপাল ভালা আজ।” আমি রাগে হাবিলদার দের বিষয়টা খুলে বললে তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক হাবিলদার বললো, “ভাই এদের চিনেন না? আসিফ নেতার পোলা। এদের হাত অনেক লম্বা। কিছুই করতে পারবেন না। মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে যান। আল্লাহ বাচাইছে। দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া করুন। কতো বড় ফাড়া কাটছে বুঝতে পারছেন?” হাবিলদারদের কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠে। এই দেশের আইন ব্যবস্থার উপর প্রচন্ড রাগ হয়। জানোয়ার গুলোর দিকে তাকিয়ে মনের আগুন জ্বালাতে থাকি। আর ধিক্কার জানাই এই দেশের আইন ব্যবস্থার প্রতি।
সেই ঘটনার পর থেকে নিশি কেমন যেন হয়ে যায়। সারাদিন চুপচাপ থাকে। চোখেমুখে সেই রাতের ভয়ের ছাপ। আমি নিশির চোখে এ ভয় দেখে নিজেকে সহ্য করতে পারিনা। বুকের ভেতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। তাই কাল আবিদ ভাইকে নিয়ে গেছিলাম পুলিশের কাছে ডাইরি করতে। কিন্তু তারা ডাইরি লিখতে নারাজ।বলে,
“নেতাখেতা মানুষের পোলা একটু আধটু দুষ্টুমি করছে তাই নিয়ে অভিযোগ না করে ভুলে যাওয়াই বরং ভালো।”
আমার কথা শুনে তো মাথায় আগুন ধরে গেল।মনে হচ্ছিলো কাঁচা চিবিয়ে খাই শুয়োরের বাচ্চাদের। অনেক বুঝানোর পর তারা এটাই বললো কিছু হবে না। তবুও আমি ডাইরি করতে চাইলে আবিদ ভাই আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে বলে, “দেখ,এই শহরে তোদের কেউ নেই। তাই যদি তোদের কিছু হয় কেউ খোঁজ খবর নিবে না। আর তোদের পাশেও কেউ নেই যে তোদের রক্ষা করবে। সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য ওসব দুঃস্বপ্ন ভাবা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।”
“কিন্তু আবিদ ভাই তাই বলে লড়বো না? এভাবে অন্যায় সহ্য করবো।” “তুই ভেবে দেখ এই অবস্থায় লড়াই করা যায় না। তার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে পরিবারের লোকজন। কারণ তারা হলো বেঁচে থাকার শিকড়। শিকড়ের জন্য তোদের বেঁচে থাকা। আর তুই দীর্ঘদিন যাবত দূরে আছিস তোর পরিবার থেকে। তাই বলছি কিছু করার আগে ভেবে দেখ।” আবিদ ভাইয়ের কথায় আমি কিছু বলতে পারিনি। সত্যি এই শহরে আমি একা। আর এই দেশে একা লড়াই করা যায় না। নিজের প্রতি অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। প্রয়োজনবোধ হয় একটা বেঁচে থাকার আমরণ অবলম্বনের।
বেশ কিছুদিন ধরে আমি খুব ভেবেছি। জীবনে চলার পথে কখনো একা চলা যায় না। যাদের জন্য আমরা চলতে শিখি তাদের উপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। যে শিকড়টার উপর আমাদের বেড়ে উঠা তাদের কাছেই আমাদের নিরাপত্তা, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা নিহিত। কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞ হয়ে সব ভুলে যাই। ভুলে যাই আমাদের জীবনের সাথে যাদের আত্নার অন্তমিল রয়েছে। বেঁচে থাকার সাহস, আত্নবিশ্বাস এবং দৈনিক যোগান দিয়ে যারা আগলে রেখেছে। আর এসব চিন্তা ভাবনা আমাকে আমার পরিবারের কথা খুব মনে পড়িয়ে দেয়। মনে পড়িয়ে দেয় আমার বাবা-মা এবং ছোটবোনের কিছু অনুভূতিকে। যে অনুভূতিগুলোর মায়াকে আমার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজের প্রতি অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায়। কিছু ভুল কি ক্ষমা করে আপন করে নেওয়া যায় না? আজ সকালে কি জানি ভেবে বহুদিন পর বাবার নাম্বারে ফোন দেই। বাবা কান্না ভেজা কণ্ঠে ফোন ধরে বলে, আমাদের ভুলে গেলি বাপ? কতো খুঁজেছি তোকে? আমরা না হয় একটা ভুল করেছিলাম তার শাস্তিও পাচ্ছি। জানিস তোর জন্য তোর মা খুব কাঁদে। কবে আসবি? তোকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বাবার কাছে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাই। বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে বাসায় যেতে বলেন। মার কাছেও গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাই। মা আমাকে বলে, “আরে পাগল ছেলে। বাবা-মা দের কখনো মন থেকে সন্তানদের প্রতি অভিযোগ থাকে না। আমার কি সেদিনের কথা মনে আছে। তোকে তো কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি। জানিস তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তাই বাবা সামনে ইদে তুই তোর বউকে নিয়ে আসোই। তোকে প্রাণভরে দেখি একটু। আসবি না বাবা?” মা’র সাথে কথা বলে মনটা কেমন যেন হালকা লাগছিল। আমি যাব বলে প্রতিশ্রুতি দেই। এই শহর ছেড়ে আবার
নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। আমি ফোন কেটে দিয়ে এগুলো ভাবছি। নিশি আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এসে বলে, “কাঁদা অবস্থায় তোমার মুখখানি দেখতে খুব সুন্দর। একদম ছোট বাচ্চাদের মতো।” আমি নিশি কথায় মুচকি হাসি।নিশিও হাসে। আমি সেই প্রতিক্ষিত হাসিটা হৃদয়ে মাখি আর ভাবতে থাকি কবে কাটব বাড়ি ফেরার টিকিট..
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত