জীবন যুদ্ধ

জীবন যুদ্ধ
জীর্নশীর্ন শরীর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মুন।পা জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত কনা।তবু ও হেঁটে যাচ্ছে ও।কারন থামা চলবেনা। হয়ত ওর বাঁচাটাই ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জোরপূর্বক পিছনে তো মৃত্যু আর ওর ধ্বংস।চোখজোড়া বুজে আসতে চাইছে তবুও জোর করে সেগুলো জাগ্রত রেখেছে।চোখ জোড়ায় ভরে আছে হাজার অশ্রুকনা যা ওর ভুল গুলোকে মুহূর্তে ওর মন পিঞ্জরে জানান দিচ্ছে ভরে তুলছে নিজের ওপর একরাশ ঘৃনা।
ওর পাপ হয়েছিলো একা ঘর থেকে বের হওয়ার পাপ ওর পাপ হয়েছিলো মেয়ে হয়ে ও জব করার পাপ।ওর পাপ হয়েছিলো মৃত বাবা মায়ের সাথে না মরার পাপ।এই পাপ গুলোই আজ ওর জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছে।ওকে আজ ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে।ওর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে ওর এই পাপ গুলো।ঘন্টাখানেক আগে ও কতো সুন্দর ওর জীবনটা।পবিত্র ছিলো একটা ফুলের মতো।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো।অতীতে চলে যায় মুন।অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো বাস স্টেশনের পথে।তখনই কল এসেছিলো ওর চাচী কল দিয়ে শুনিয়ে দেন হাজার বাজে কথা বার্তা।বলেছিলে বাজারের বেশ্যা এতো রাত পর্যন্ত বাহিরে কি করিস?তারপরই তুলে ধরনের বড় রকমের লিস্ট।ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্রের তালিকা।
সেগুলো ওকে কিনেই ঘরে ফিরতে হবে।কান থেকে ফোন সরিয়ে কেঁদে দেয় মুন।তারপর ফোন ব্যাগে রেখে পার্স থেকে কিছু টাকা বের করে।আছে মাত্র পাঁচশত দশটাকা। এখন কিছু কিনলে যাতায়তের টাকা থাকবেনা।তারপর ও কিনতে হবে নয়তো চাচী আরো অপমান করবেন।কথা গুলো ভেবে বাজারে এলো মুন।তারপর জিনিস গুলো কিনে নেয় তবে সব কেনা সম্ভব হয়নি।সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসে মুন।হাঁটতে শুরু করে ঘরের পথে।হঠাৎ শুনতে পায় মদ্যপ কিছু লোকের হাসি আর অশ্রাব্য কিছু শব্দ।দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখান থেকে সরে আসে ও। ভেবেছিলো এবার হয়ত বেঁচে গেলাম। কিন্তু ভাগ্য ওকে নিয়ে এসেছে মরন রাস্তায়।সামনে এসে দাঁড়ায় মামুন। ওর ভার্সিটির বড় রাজনীতিবিদ।ছেলেটা ওকে গত দুবছর যাবৎ বিরক্ত করছে।কিন্তু কখনো পাত্তা দেয়নি মুন।ছেলেটা বলেছিলো ওকে নাকি ভালবাসে।কিন্তু সবসময় মুন এড়িয়ে গিয়েছিলো মামুনকে। মামুন ঘৃন্য হাসি দিয়ে বলল,
”এতো রাতে রুপসী বাহিরে?কারোর সাথে মজা নিয়ে এসেছো নাকি?”
”একদম বাজে কথা বলবেনা।আমাকে যেতে হবে সরেন।”
”সারারাত মজা নিয়ে এখন যেতে চাইছো কেন?আমাকে ও অানন্দ দাও।তোমার তো গায়ে অনেক ঝাঁঝ।আমার ও তোমার ঝাঁঝের স্বাদ নিতে ইচ্ছে হচ্ছে।আসো আমার কাছে।” মামুন এগিয়ে আসতে থাকে মুনের কাছে।মুন পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
”একদম আগাবেন না খুন করে ফেলবো।যেতে দিন আমাকে।”
”কিভাবে যেতে দেই বলো তোমাকে দেখলে গায়ে আগুন লেগে যায় বুঝোনা?”
মুন মামুনের কাছ দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে তখনই ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাঁশ ঝাড়ের ঝোপের মাঝে আড়াল হয়ে যায় মামুন।ঝাঁপিয়ে পড়ে মুনের ওপর। খুবলে খেতে থাকে ওর শরীরটাকে।চিৎকার করে কাঁদতে চেয়ে ও কাঁদতে পারেনি মুন। কে একটা যেন গলা চেঁপে ধরেছিলো ওর।সব শেষে মামুন ওকে গলা চেঁপে ধরে।মুন ভাবছে এখন ওকে মেরে ফেললে ওর মত অনেক মুনের জীবন শেষ হয়ে যাবে এমন নরপিচাশদের হাতে।তাই মরার ভান করে পড়ে রইলো মুন।ওকে মৃত ভেবে বেরিয়ে গেলো মাতাল মামুন। মামুন বেরিয়ে পড়তেই উঠে যায় মুন।তারপর চলতে শুরু করে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।হঠাৎ প্রচন্ড আলোকিত কিছু চোখে এসে লাগে ওর।তারপর আর কিছু মনে নেই।পরদিন সকাল আটটায় জ্ঞান ফিরে ওর।নিজেকে আবিষ্কার করলো আলোকিত একটা স্থানে নরম কোন বিছানায়।পাশে স্যালাইন চলছে আর সামনে বসে আছেন একজন লোক। অতিরিক্ত সুদর্শন সে।লোকটা মুন কে চোখ খুলতে দেখে উঠে এসে দাঁড়ায় ওর পাশে।ওর গালে কপালে হাত ছুঁয়ে বলল,
”কেমন লাগছে?”
”জানিনা।কই পেলেন আমাকে?”
”আমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে বলছিলেন হেল্প হেল্প!!!এখন বলো কি হয়েছিলো তোমার সাথে?”
”আমি বলতে চাইছিনা এসব।প্লিজ আমাকে জোর করবেননা এখন।”
”ঠিক আছে।তবে তোমার চাচা চাচী এখনে আসছেন তোমার জন্য।”
”ওনাদের কল দিয়েছেন?”
”ইয়েস।কেন সমস্যা?”
”নাহ।সমস্যা নেই।”
কিছুক্ষন পরই দুজন বয়স্ক লোক আর মহিলা ভিতরে আসলো।ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করলো,
”কি হয়েছে ওর?”
”সি ইজ রেপড!!” লোকটা বলে মুনের দিকে তাকায়। কিন্তু ডাক্তারকে অবাক করে দিয়ে চাচা চাচী মারতে লাগলো।অশ্রাব্য গালা গালি আর অভিশাপ দিতে শুরু করে।মুন কেঁদে কেঁদে ওনাদের বুঝাতে চায় ও নির্দোষ।কিন্তু শুনেনি তারা।শেষমেষে ওনারা ওকে নিজেদের ঘরে নেয়ার জন্য রাজি হননি।মুন তাদের পা ধরে মাফ চেয়েছে।কিন্তু চাচী ওর বুকে লাথি দিয়ে চলে যায় । মুন পড়ে গেলে ওর হাত ধরে উঠায় ডাক্তার তারপর বেডে শুইয়ে বলল,
”এখানে আর কোন আত্মীয় স্বজন নেই তোমার?”
”নাহ নেই।” লোকটা কি যেন ভেবে বলল,
”আমার সাথে চলো তুমি। এখন তুমি অসুস্থ তোমাকে এমন কোন মানুষের হাতে দেয়া যাবেনা।”
”কিন্তু আপনার পরিবার!!!”
”আমি এতিম।কেউ নেই আমার।”
”ওহ।খারাপ লাগলো শুনে।”
অবশেষে মুন ডাক্তার পুলক চৌধুরীর বাসায় গেল!বেশ বড় বাসায় থাকেন ওনি।খুব সুন্দর একটি ঘর ওনার।তবে মনটাই বেশি সুন্দর।খুব খেয়াল রাখেন মুনের।একমাস পেরিয়ে যায়।মুন না চাইতেও খুব আপন করে ভাবতে থাকে পুলককে।লোকটা অজান্তেই ওর হৃদয়ের খুব কাছে চলে এসেছে।মুনকে নিয়ে নাস্তা করে পুলক।মুন বলল, ”আমার চলে যাওয়া উচিৎ।এভাবে আপনার ঘরে থাকাটা ভালো দেখাচ্ছেনা।” ভ্রু কুঁচকায় পুলক।ও বলল,
”সে ভাবনা আমার তোমার নয়।”
”কিন্তু !”
”কোন কিন্তু নয়।পড়াশুনা করেছো কিছু?”
”জি।মাস্টার্সে এডমিট হয়েছিলাম।এরপাশাপাশি জব করছিলাম।”
”শুনো আপাতত পড়াশুনায় মন দাও।কাল থেকে ভার্সিটি এ্যাটেন্ড করবে।আমার গাড়ি তোমাকে নিয়ে যাবে নিয়ে আসবে।”
”আমার ফিরতে রাত হয়।”
”কেন?”
”ঐ যে অফিস!!!”
”রিজাইন লেটার পাঠিয়ে দাও।,”
”তাহলে বেতন কিভাবে দিবো?”
”এই মেয়ে তোমার কাজ পড়াশুনা।এতো ভাবছো কেন এসব নিয়ে?যা বলছি করো বুঝলে?” বলে উঠে হাসপাতালের জন্য বেরিয়ে যায় পুলক।মুন পড়াশুনা শুরু করে।পুলক ওকে বড্ড সাহায্য করেছে পড়াশুনায়।এমনকি ওর সব খরচ নিজের দায়িত্ব ভেবে নিয়েছে পুলক।হঠাৎ ঘটে যায় এক দূর্ঘটনা।অসুস্থ হয়ে যায় মুন।মুখে লাগেনা স্বাদ।মাথা ঘোরে তো বমি ও পায়।ভয় বাসা বাঁধে মুন এর মোনে।অবশেষে ওর ভয়কে সত্য করে দিয়ে বেরিয়ে আসলো ওর মা হবার ঘটনা। লজ্জা শরমে যায় যায় অবস্থা মুন এর।
সারাদিন রাত কেঁদে কেঁটে বুক ভাসায়।ব্যাপারটা চোখে লাগে পুলকের।মুনকে বারবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর দিতে রাজি হয় ও জানিয়ে দেয় মা হতে যাচ্ছে ও।তারপর কেঁদে ফেলে পুলকের সামনে।কিছু বুঝে উঠতে পারেনা পুলক।মেয়েটাকে কিভাবে স্বান্তনা দেবে ও?তারপর ও নিজেই অজান্তেই বাহুডোরে বন্দী করে নেয় মুনকে।আশ্বাস জাগায় ওর সরল মনে।দিন পেরিয়ে যায়। মুনের শরীরে ফুটে ওঠে অন্তঃসত্ত্বার চিহ্ন।সবাই জানে ও অবিবাহিতা।তাহলে মা হবার কারন কি ওর অশ্লীলতা?সারা কলেজে পড়ে যায় গুঞ্জনের শব্দ।ওর ওপর এসে পড়ে হাজারো থুথু আর ধিক্কার।
সেদিন ভাগ্যক্রমে সেখানে চলে আসে পুলক।সবার মুখের ওপর বলল, ‘মুনের’ গর্ভের সন্তান আমার।ওকে ভালবাসি আমি আর সেই ভালবাসার চিহ্ন এই সন্তান।” অবাক মুন ।ও ভেবেছিলো হয়ত ওকে বাঁচাতে এসব বলছে।কিন্তু ওর ভুল ধারনাকে মিথ্যা প্রমানিত করে কাজী ডেকে সেখানেই ওকে বিয়ে করে পুলক।মুন যেন হাঁফ ছেড়ে আলোর দিশা খুঁজে পেল ।নাম পেয়ে গেলো ওর সন্তান।বাবা ও পেলো।আজ ওকে কেউ বলবে না জারজ সন্তান।এর পর কেটে গেল কয়েক বছর সুখের সংসার মুন আর পুলক এর । আজ মামুনের ফাঁসির দিন।পুলকের বুদ্ধিমত্তা আর মুনের সাহসিকতা মামুনের মতো জঘন্য নরপিশাচকে তার চরম পরিনতির দিকে নিয়ে এলো।আজ পরিপূর্ন মুন আর পুলক দম্পতি।একে অপরকে ভীষন ভাবে ভালবাসে ওরা।আর এই ভালবাসাকে নাম দিতে আসতে চলেছে নতুন আরেক অতিথি।দুইমাসের অন্তসত্তা মুন।
প্রথম সন্তান ওর মেয়ে মেঘা।নামটা পুলকেরই রাখা।মেয়েকে ভীষন ভালবাসে পুলক।আর মুনকে আদর করে ডাকে প্রিয়তমা। মুনের কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল প্রিয়তমা বড় ভালবাসি অনেকটাই ভালবাসি!!!! তুমি এসে আমার একাকীত্ব জীবনকে পরিপূর্ণতা দান করেছো।লক্ষী মেঘাকে উপহার দিয়েছো সেটার জন্য তোমাকে খুব বেশি ভালবাসি। “আমাদের সমাজে মেয়েরা বরাবরই অসহায় এটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা” প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে এমন হাজাও মুন সমাজ তাদের তাদের উপহার হিসেবে দিচ্ছে লাঞ্চনা গঞ্জনা। “”দৃষ্টি ভঙ্গি বদলান বদলে যাবে সমাজ ।সুন্দর হবে জীবন। “আমাদের উচিত সমাজে এমন মুনদের পাসে দাঁড়ানো তাদের সম্মান করা”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত