গতকাল রাতে রিম্মি কল করে বলেছে আজ বাড়িতে যেতে।রিম্মি কথা বলার সময় তার কন্ঠের মধ্যে এক প্রকার খুশির আমেজ ছিলো,কিন্তু তার এত খুশি কিসের জন্য সেটা বলেনি এবং তাতে আমার মনের মধ্যে নানান কথা ঘুড়ছে পাগলীর হঠাৎ এত খুশি হওয়ার কারণ কি?মাকে কল করেছিলাম কারণ জানতে,তবে সেও আমার থেকে সত্য গোপন রেখেছে।হয়তো কোন সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে আমার,যার কারণে আমাকে বলা হয়নি। বাসের মধ্যে বসে বসে ভাবছি,কি হতে পারে সারপ্রাইজ?তবে কোন কিছু আঁচ করতে পারছি না।বাসে উঠেও রিম্মিকে কয়েকবার মেসেজ করেছি,কিছুটা বলার জন্য,কিন্তু পাগলীর কথা,আমি তার সামনে হাজির হলেই বলবে।
আমি,নিয়ান হাসান।পড়াশুনা করার জন্য অন্য শহরে থাকতে হয়।হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করি।রিম্মি আমার বাল্যকালের বন্ধু।প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে দুজন মিলে কাটিয়েছি শৈশব,কৈশর।দিন পাড় হয়েছে আমরা বড় হতে শুরু করেছি,সাথে বন্ধুত্বের মানে কতটা গভীর বুঝতে শিখেছি,কিন্তু সময়ের সাথে,সাথে আমাদের দুরত্ব বাড়তে শুরু করেছে।যত বড় হয়েছি,ততই দুজন দুজনের থেকে দূর থেকে দূরে গিয়েছি,কিন্তু দুজনের মনের যে মিল,টান সব আগের থেকে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।ছুটিতে যখন বাড়িতে যায়,তখন পাগলী তো পাগলের মতো হয়ে পড়ে।যে কয়দিন আমি বাড়িতে থাকি,সে সব সময় বাহানা খুজে,কিভাবে আমাকে তার নজর বন্দি করে রাখবে?মোট কথা,আমি বাড়িতে থাকলে তার কথা মতো চলতে হবে আমাকে,আর দূরে থাকলে তার দেওয়া টাইম টেবিল আমাকে ফলো করতে হবে।আর যদি কোন কারণে একটু এদিক-সেদিক হয়,তাহলে তো পাগলীর অভিমান ভাঙাতে আমার ঘাম ছুটে যায়।
বাড়িতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গিয়েছে।বাড়িতে প্রবেশ করেই দেখি রিম্মি আমার রুমের দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।রিম্মি,আমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,”নিয়ান,নিয়ান,নিয়ান আমার সপ্ন পূরণ হতে চলেছে।” রিম্মি তো আমাকে আষ্টে-পিষ্টে ধরেই নাচতে শুরু করেছে।বাবা-মা রিম্মির নাচ দেখে হাসতে লাগলো।মা রিম্মির দিকে তাকিয়ে বলল,”রিম্মি,আজ প্রথমবার কোন মেয়েকে দেখছি,তার বিয়ে ঠিক হওয়াতে সে খুশিতে নাচছে।” রিম্মির বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে তো আমার মনের মধ্যেও নাচতে শুরু করেছে।ইচ্ছে তো করছে লুঙ্গি ড্যান্স করতে,কিন্তু পরণে লুঙ্গি নেই। রিম্মিকে সরিয়ে মুখের সামনে এনে বললাম,”সারপ্রাইজ দিবি জানতাম,কিন্তু এত বড় সারপ্রাইজ দিবি কখনো ভাবিনি?”
“কুত্তা,তোকে কি সারপ্রাইজ দিবো,আমি তো নিজেই বিয়ের কথা শুনে সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছি।”
“কিভাবে,কি?”
“জানি না,হঠাৎ করে খালু বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।যাকে নিয়ে মনের মধ্যে কয়েক বছর ধরে সপ্ন সাজাতে শুরু করেছি,তার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে ভাবতেও পারছি না।”
“তো ম্যাম,পার্টি কখন হবে?”
“সব হবে,তার আগে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়,নিজের হাতে তোর জন্য রান্না করে রেখেছি।বিয়ের পড়ে তো আর সব সময় খাওয়াতে পারবো না,তাই তোকে এখনি সব গিলাবো।”
“গিলাবি?”
“মানে,তোর যত প্রিয় খাবার আছে,সব আমার বিয়ের আগে তোকে রান্না করে খাওয়াবো।”
“তোর হাতের রান্না খাওয়া যাবে?”
রিম্মি আমার কথা শুনে ইচ্ছে মতো আমাকে কিলাতে শুরু করলো।তবে রিম্মির হাতের রান্না কিন্তু সেই,আমি তো পাগলীকে রাগানোর জন্য মাঝে,মাঝেই বলি ওর হাতের রান্না ভালো না। রিম্মি,যখন থেকে বিয়ের মানে বুঝতে শুরু করেছে,তখন থেকেই সে তার মনে হাজারটি সপ্ন বুনে নিয়েছে,তার বিয়ে কেন্দ্র করে।রিম্মি,অনেক আগে থেকেই তার খালাতো ভাইকে,আকিবকে পছন্দ করতো,কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলার সাহস করে উঠতে পারেনি।আমি অনেক বার বলেছি,আমি গিয়ে ভাইয়াকে বলি,কিন্তু তার কথা কিছু বলতে হবে না।
কিন্তু সে আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে পারেনি খেলতে,কারণ রিম্মি আকিব যখন থেকে প্রেম শুরু করেছিলো,তখন থেকেই আমি জানতাম।আমি যে জানি,সেটা রিম্মি জানে না,কারণ আমি চাইতাম রিম্মি আমাকে নিজের মুখে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা বলুক।তবে সেই আশা,আশায় রয়ে গিয়েছে,মাঝ থেকে ওদের বিয়ে ঠিক।
আকিব ছেলেটি অসম্ভব সুন্দর দেখতে,যে কোন মেয়ে তার চোখের প্রেমে পড়ে যাবে।আকিব ভাইয়াকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না যে ছেলেদের চোখেও লুকিয়ে থাকে,মায়া,যে মায়াতে বাধা পড়তে পারে শত রমণী। রিম্মির গায়ে হলুদ কাল,ওদের বাড়িতে আড্ডা শেষ করে পুকুড় পারে বসে সিগারেট টানছি,রিম্মি পাশে এসে চুপ করে বসলো।আমি আমার মতো সিগারেট টানছি সাথে মোবাইল টিপছি।রিম্মি উঠে চলে গেলো।আমি জানি রিম্মি কোথায় গিয়েছে।একটু পরে রিম্মি দুই হাতে দুটি চায়ের কাপ নিয়ে এসে আমার দিকে একটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”সিগারেটের সাথে চা না হলে কি জমবে আড্ডা।”
“সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে,তোর চা আনতে হলো?”
“এটা শেষ তো কি হয়েছে?আরেকটি ধরা।”
“এত ইচ্ছে নেই তাড়াতাড়ি দুনিয়া ছাড়ার।”
“ভয় যখন আছে,তাহলে কেন খেতে হবে এই ছাঁই?”
“এটা তো একটি অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।আর তোকে তো কথা দিয়েছি,দিনে তিনটির বেশি খাবো না।তো আজকের দিনের শেষ এটা।”
“কষ্ট লাগছে,তোর?”
“কিসের কষ্ট?”
“এই যে,আমি তোকে ছেড়ে চলে যাবো।”
“কষ্টের থেকে বেশি আনন্দ লাগছে,যে পাগলী ঘাড় থেকে নামবে,এখন?”
“হারামী তোকে কিন্তু খুন করে তারপরে শশুড়বাড়ি যাবো।”
“ইচ্ছে হলে করতেই পারিস।তো কি দিয়ে করবি,ছুড়ি না বটি?”
“কোনটাই না।”
“তাহলে কিভাবে?”
“কুত্তা,তোর গলায় কামড় দিয়ে সব রক্ত খেয়ে তারপরে তোকে রক্ত শূন্যতায় মারবো।”
“ওকে,তো কখন রক্ত খাবি?”
“সময় হলে,তার আগে বল না দোস্ত,তুই আমার বিয়েতে আমাকে কি উপহার দিবি?”
“তোকে আবার কিছু দিতে হবে না কি?আমি তো ভেবেছি তুই চলে যাবি,হয়তো তুই আমাকে উপহার দিয়ে তারপর যাবি।”
“বিয়ে আমার আর উপহার দিবো আমি,তোকে?”
“হুম দিবি,কারণ ব্যাচেলার বন্ধুত্বের শেষ স্মৃতি দিয়ে যাবি।”
“কাচা লঙ্কা দিবো তোকে,গাধা।চা শেষ হলে কাপ নিয়ে রুমে যাবি,আমি ঘুমাতে গেলাম আর কাল সকালে ঘুম থেকে উঠবি।”
ভোর বেলা রিম্মি চিল্লানোর আওয়াজে ঘুমাতে পারছি না।বালিশ মাথার উপর চেপে রেখে তার ককিল কন্ঠ কানে পৌছানোর থেকে আটকানোর জন্য বৃথা চেষ্টা করছি,কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।আগে তো দূর থেকে তার কন্ঠস্বর ভেসে আসছিলো আর এখন আমার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে চেঁচাচ্ছে,আমাকে বাহিরে আসতে।
“রিম্মি একটু ঘুমাতে দে না।কাল ভোরে উঠবো।”
“আসবি না আমি তোর কাছে এসে টেনে তুলবো?”
“কাল?আর তোর না আজ গায়ে হলুদ,তো এত ভোরে কেন উঠেছিস?রুমে গিয়ে ঘুমা,না হলে সন্ধ্যায় বানরের মতো লাগবে।” রাগে ফুলতে ফুলতে আমার কাছে এসেই গায়ের উপর থেকে কম্বল টেনে সরিয়ে আমাকে দেখেই হাসতে,হাসতে বলল,”এখনো জিন্স পরেই ঘুমাস?”
“লুঙ্গি না পড়তে পারলে কি করবো?”
“বিয়ে করার পরে কি করবি?”
“এখস যা করছি?”
“সময় বাঁচাতে চাইলে লুঙ্গি পড়া শিখে নিস বিয়ের আগে।না হলে কবে বউ এর হাতে পিটানি খাবি,বুঝতেও পারবি না।”
“মানে?”
রিম্মি আর কিছু বলল না,কম্বল নিজের দখলে নিয়ে চলে গেলো আমাকে ফ্রেশ হতে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে।
এই সকালে আমাকে নিয়ে এসেছে চা খেতে।মেজাজ যা খারাপ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না।মাঝে,মাঝে এমন পাগলামী করে যা নিতে কষ্টকর হয়ে পড়ে আমার পক্ষে। চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে আবার দোকানের দিকে হাটা শুরু করলো।আমি দুই হাতে দুটি চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছি।হাতে একটি লাইটার নিয়ে সেটা জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে এবং আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে,হাসতে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল,”তোর জন্য?” একটু অবাক হলাম,কারণ ও নিজে থেকে কখনো আমাকে সিগারেট দেয়নি,তবে মাঝে মাঝে বাসা থেকে লুকিয়ে লাইটার এনে দিতো।
“হঠাৎ সিগারেট?”
“দিতে ইচ্ছে করলো।”
“কাহিনী কি?কিছু বলবি,আমাকে?” রিম্মির চোখের মধ্যে পানি টলমল করছে।এই চোখের পানি আসার কারণ বুঝতে পারছি না।
“রিম্মি,কান্না করছিস তুই?” আমার কথা শুনে হেসে দিয়ে বলল,”না,কান্না করছি না,হাসছি আমি।”
“কি হয়েছে?”
“আর একদিন পর,তোদের থেকে দূরে চলে যাবো,তখন ইচ্ছে হলেও দেখা করতে পারবো না,তোকে বারবার কল করে জ্বালাতে পারবো না,তোর উপর অধিকার খাটাতে পারবো না,তাই না রে?”
“হঠাৎ এই কথা কেন?”
“জানি না,আগে যতই বিয়ে নিয়ে মজা করেছি,কখনো ভাবিনি মেয়দের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে,তাদের অনেক ইচ্ছের মৃত্যু হওয়া।মেয়েদের কিছু ইচ্ছে থাকে যা বিয়ের পরে জীবত থেকেই মৃত হয়ে জমে থাকে মনের মাঝে।তারা চাইলেও সেই অনুভূতির ইচ্ছের সাথে ভাব জমাতে পারে না।” “আরে পাগলী,এত ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিস কেন?বিয়ে হচ্ছে তোর,বিয়ে হয়ে গেলেই যে সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে,সেটা তো না।তোর যখন খুশি আমাকে কল করতে পারিস,তোর ইচ্ছে মতোই আমাকে জ্বালাতে পারিস,আমার কোন সমস্যা নেই।”
“তোর না থাকলেও অনেকের থাকবে,কারণ বিয়ের পরে মেয়েদের সবকিছু করার অনুমতি থাকে না।”
“আরে,তুই তো তোর অন্য একটি পরিবারের যাচ্ছিস,সেখানে গিয়ে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিবি।আর আকিব ভাইয়া তো তোর,আমার সম্পর্কে সব জানে।আমাদের মধ্যে এমন কোন সম্পর্ক নেই,যে বিয়ের পরে সেটা রাখা যাবে না।”
“ভয় করছে খুব,তোকে হারানোর ভয়।বুঝতেও পারিনি বিয়ের মাধ্যমে হয়তো আমাদের দুজনের সস্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি হতে পারে?”
“এমন কিছুই হবে না,পাগলী।”
“জানি না কি হবে?কিন্তু অজানা এক ভয় কাজ করছে।বাইশ বছরের বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়তো এই বিয়ে নামের একটি সস্পর্কে জড়িয়ে শেষ হয়ে যাবে?”
রিম্মি হাউমাউ করে কান্না করে দিয়েছে।রিম্মির কান্না দেখে নিজের বুকের মধ্যে সব ভেঙে চুড়ে এক হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি,কারণ আমার চোখে পানি দেখলে নিতে পারবে না। রিম্মি ওর চোখের পানি মুছে বলল,”চল বাড়িতে যাবো।” দুপুরে রিম্মির বাড়িতেই খাওয়ার কথা সবার।বাবা-মা রিম্মিদের বাড়িতেই রয়েছে।সন্ধ্যার সময় রিম্মির গায়ে হলুদ,তো সব রকমের প্রস্তুতি চলছে সেখানে।আমি গোসল করতে বাড়িতে এসেছি।গোসল শেষ করে রুমে বসে আছি,কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করছে।। কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি রিম্মি দাড়িয়ে আছে।কখন চোখ লেগে গিয়েছে বুঝতে পারিনি। রক্ত রাঙা রং মেহেদী জাড়ানো হাত দুটোর মধ্যে খাবার প্লেট ধরে রেখেছে।আমি বিছানায় উঠে বসার সাথে বলল,”এড়িয়ে চলছিস কেন?”
“আরে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি,বুঝতে পারিনি।”
“এড়িয়ে চলছিস কেন সেটা জানতে চেয়েছি?”
“তোকে কেন এড়িয়ে চলবো?”
“হাত-মুখ ধুয়ে আয়।”
ফ্রেশ হয়ে রিম্মির সামনে বসার পরে রিম্মির খাবার মাখিয়ে নিজেই খাবার মুখে তুলে দিলো।এর আগে বহুবার রিম্মি আমাকে খাইয়ে দিয়েছে,কিন্তু আজ খাবার মুখে তুলে দেওয়ার সময় রিম্মির হাত থরথর করে কাঁপছে।রিম্মি কোন কথা বলছে না,প্লেটের দিকে তাকিয়েই হাত উচু করে খাবার তুলে দিচ্ছে এবং ফুপিয়ে কান্না করছে।” আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছি না,কারণ নিজের বুকের মধ্যেও বন্ধুকে হারানোর কষ্টের পাহাড় তৈরি হয়েছে।সত্যি বিয়ে নামক সম্পর্কটি শেষ করে দেয় তার অতীতের অনেক রকমের ইচ্ছে,অনুভূতিকে।অনেক সময় তো বাল্যকালের বন্ধুত্বও টিকেনা বিয়ে নামক সম্পর্কের পাশে। রিম্মি হাত ধুয়ে এসে আমার সামনে দাড়িয়ে আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল,”নিয়ান,শেষবারের মতো তোর বুকে একটু ঠায় দিবি আমাকে?” ইচ্ছে তো করছে ঝাপটে ধরি পাগলীকে বুকের মধ্যে।কিন্তু কাল ওর বিয়ে এখন এটা ঠিক হবে না,কখন কে কি বলে বসে কে জানে?
“রিম্মি,তুই এখন বাড়িতে যা,বাবা-মা কেউ নেই বাড়িতে।”
“সবার থাকার কথা ছিলো এখানে?কখনোই তো তোর আমার মধ্যে কেউ থাকতো না।আর সবাই থাকলেও তো কখনো কেউ কিছু বলেনি।”
“এখন আর আগের দিন গুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।”
“বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে আমি অন্যের হয়ে গিয়েছি?এখন,কি বন্ধুর বুকে মাথাও রাখতে পারবো না?”
“সেটা না!কিন্তু কে কখন কি বলে বসবে,ভালো হবে না।”
“তুই কখন থেকে এসব ভাবতে শুরু করলি রে?”
“সময় সবকিছু ভাবতে বাধ্য করে।”
“এত কথা জানি না,প্লিজ দোস্ত একটিবার দে না ঠায় তোর বুকে,একটু নিঃশ্বাস নিবো প্রাণ ভরে তোর বুকে মাথা রেখে।এই শেষবার,আর কখনো তোর কাছে কোন কিছুর জন্য আবদার করবো না।তোকে কখনোই বলবো না,নিয়ান একটু জড়িয়ে ধরবি?” পাগলী আমাকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিলো।কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না।আমার চোখের কোণে উঁকি দেওয়া জলের কণা তাড়াতাড়ি মুছে রিম্মিকে বললাম,”চাপ নিচ্ছিস কেন পাগলী,আমি তো তোর পাশে সব সময় আছি? রিম্মি কান্না করতে,করতে খাটের উপর বসে বলল,”তুই থাকতে চাইলেও আমি যে রাখতে পারবো না আমার পাশে তোকে,নিয়ান?”
“মানে?”
“দোস্ত”
বলেই রিম্মি আবার কান্না করে দিলো।আমি রিম্মিকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি,কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।সে তার নিজের ইচ্ছে মতো কান্না করছে খাটের উপর বসে। মা,আমার রুমে প্রবেশ করেই রিম্মিকে কান্না করতে দেখে রিম্মির পাশে বসে বলল,”মা,মেয়ে হলে যে তার বাবার বাড়ির সকল কিছু ছেড়ে যেতে হবেই।পরিবারের সাথে বন্ধুদের কেউ ছেড়ে যেতে হয়,কিন্তু তারমানে এটা নয় যে সারা জীবনের জন্য সবাইকে হারিয়ে ফেলছো।বিয়ের পরে হয়তো এখন যেভাবে দুজন মিলে মজা,মাস্তি করছো সেটা করতে পারবে না,কিন্তু বন্ধুত্ব তো ঠিকি টিকে থাকবে।তো পাগলের মতো কান্না বন্ধ করে চলো।আর নিয়ান তুই ও চল।”
রিম্মি চোখের পানি মুছে আমার দিকে তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”চাচী আমার কপাল হয়তো এতো ভালো না।বিয়ের আগেই আমাকে শর্ত দিয়েছে নিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না।” আমি ভুল শুনেছি ভেবে আবার সিউর হওয়ার জন্য বললাম,”কি বললি?” রিম্মি আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল,”হুমম নিয়ান,আকিবের প্রথম শর্ত তার সাথে সংসার করলে আমার কোন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না।বিশেষ করে তোর সাথে।চাচী,কিভাবে পারবো নিয়ানের সাথে কথা না বলে থাকতে?” রিম্মি আবার কান্না করে দিয়েছে।সত্যি বলতে আমি নিজেও পারছি না রিম্মির কথা শুনে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে।যে মেয়ের সাথে ছোট সময় থেকে বড় হয়েছি,খেলা করেছি,হাসি-ঠাট্টা,ঝগড়া তার সাথে কথা না বলে কিভাবে থাকবো?
মা আমার দিকে তাকিয়ে রিম্মির মাথায় হাত রেখে বলল,”সব ঠিক হয়ে যাবে।” “কি ঠিক হবে?আকিবকে ভালোবাসি মনের মানুষ হিসাবে আর নিয়ানকে জীবনের একটি খুশি হিসাবে।যে ছেলে আমার মন খারাপরের সময় জোকারের মতো ব্যাস্ত হয়ে পড়ে আমাকে হাসিয়ে মন ভালো করতে।সেই ছেলের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে বলে শর্ত দেয়,এটা কিভাবে মানবো?” “আকিব হয়তো তোমার সাথে মজা করেছে?” “আগে আমিও সেটাই মনে করতাম,কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে সরাসরি বলেছে।আমি পারছি না চাচী নিয়ানকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে ভাবতে।” আমি কি বলবো?এখানে কি বলা উচিত বা কি বলে নিজেকেই বোঝাবো?কোন কিছু মাথায় আসছে না।চুপকরে রিম্মির সামনে ফ্লোরে বসে আছি ওর দিকে তাকিয়ে।আর রিম্মি মায়ের কাধে মাথা রেখে ঝড়াচ্ছে অনবরত তার চোখের নোনা পানি।
হলুদ শাড়ী,সবুজ পেড়ে মাথায় গেন্দাফুল,কপালে রজনীগন্ধার মালা দিয়ে টিকলি,ঠোটে হালকা লিপিষ্টিক,কপালে লাল টিপ,হাতে লাল কাচের চুড়ি,পায়ে রুপার নুপুর,কালো চুলের খোপায় গোলাপ ফুল। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করছে একমনে,কিন্তু তাকিয়েও থাকতে পারছি না।এত সুন্দর লাগছে পাগলীকে বলে বোঝানো যাবে না।রিম্মি বারবার আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলতে বলছে তাকে কেমন লাগছে?কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ করলাম,”পাগলী কপালে একটি কালো টিপ দিয়ে আয়,নজর লেগে যাবে।” মেসেজ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে হাত উচু করে থাপ্পড় দেখিয়েই মুখ ভার করে মাথা নিচু করে নিলো।যতটুকু দেখতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে ওর চোখের মধ্যে পানি টলমল করছে?
রিম্মির পাশে বসে অনেকক্ষণ মজা করেছি।যতটুকু পারি ওকে হাসানোর চেষ্টা করেছি এবং সেটা করতেও পেরেছি।ওর কপালে হলুদ ছুঁয়ে আবার দূরে এসে দাড়িয়ে পাগলীকে শেষ দিনের মতো কাছ থেকে দেখতে শুরু করলাম।
পুকুর পাড়ে দুজন সামনা-সামনি দুটি চেয়ারে বসে আছি।আর আমাদের থেকে কিছুটা দূরে রিম্মির চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনেরা আড্ডা দিচ্ছে। রিম্মি হাত মুঠো করে অনেক সময় কিছু একটা ধরে আছে।আমি জানি কি আছে হাতে?তাও বললাম,”কিরে হাতে কি লুকিয়ে রেখেছিস? রিম্মি হাতের মুঠো খুলে সিগারেট বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে।সিগারেট হাতে নিয়ে লাইটার বের করতে গিয়ে দেখি পকেটে লাইটার নেই।রিম্মির দিকে তাকাতেই ও লাইটার বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে।সিগারেট জ্বালিয়ে মনের সুখে টানছি আর রিম্মি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনেই চুপচাপ,হঠাৎ রিম্মি নিরবতা ভেঙে বলল,”নিয়ান,তুই ও কি বিয়ে করার সময় তোর বউকে তার অতীতের সকল ছেলে বন্ধুকে ছাড়তে বলবি?”
“এসব নিয়ে এখনো চিন্তা করিনি?”
“এখানে চিন্তা করার কি আছে?কেন বলে ছেলেরা এমন কথা?তারাও কি বিয়ের পরে তাদের বাল্যকালের,শৈশবের মেয়ে বন্ধুকে ছেড়ে তার পরে বউ এর হয়?”
“জানি না?”
“কেন জানিস না?তুই তো ছেলে,তোর সামনে তো আমি কত ছেলের সাথে কথা বলেছি,কই তুই তো তখন বলিসনি তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হলে অন্য ছেলের সাথে কথা বলা যাবে না।”
“রিম্মি,বন্ধু আর স্বামীর মধ্যে অনেকটা পার্থক্য।”
“পার্থক্য তোরা করেছিস,স্বামী যদি স্ত্রীর কি ভালো লাগে,কে তার সব থেকে কাছের বন্ধু এতটুকু বুঝতে না পারে,তার বন্ধুত্বকে মানতে না পারে,তাহলে কিভাবে সে তার স্ত্রীর বন্ধু হয়ে উঠবে?”
“রিম্মি সব মানুষ কিন্তু এক রকম না।”
“হ্যা,কিন্তু বেশির ভাগ সময় মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়।”
“ছাড় না এসব।কাল তোর বিয়ে,আজ চিল কর একটু।”
“সব হচ্ছে আমার।চিল,টেনশন,ভয় এবং রাগ।”
“আরে পাগলী,আল্লাহুর কাছে শুকরিয়া কর যে অবশেষে তুই তোর ভালোবাসাকে পেতে চলেছিস।”
“সেটা করেছি,কিন্তু এক ভালোবাসা পেয়ে অন্য ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছি।”
“আবার শুরু করলি।কাল তোকে সকালে উঠতে হবে,তো এখন যা ঘুমিয়ে পড়।”
রিম্মি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,”নিয়ান,অনেক শুনেছি ছেলেরা না কি অনেক শক্ত হয়,বিশেষ করে নিজের কান্না আটকানোর দিকে।আজ সেটা নিজ চোখে দেখছি।কেন বৃথা চেষ্টা করছিস চোখের পানি বয়ে যেতে আটকিয়ে।ঝড়িয়ে দে না সে যতক্ষণ ঝড়তে পারে।এরপর আর হয়তো পানি ঝিলিক দিবে না তোর চোখে।” “আরেহ ধুর কি যে বলিস।” “আমাকে বৃথা শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করবি না।নিজের চোখের পানি না ঝড়িয়ে কি মনে করছিস,আমি তোর মনের কষ্ট বুঝতে পারছি না?নিয়ান,তোর এই লাল টকটকে চোখ দুটোই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে এটা ভাবিয়ে যে আমি কষ্ট পাবো দেখে তুই তোর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিস তোর চোখের পানি ধরে রাখতে।আর তোর চোখের রং দেখে আমার বুকে বারবার আঘাত এবং মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি যাচ্ছি দূরে তোর থেকে।”
“তুই যা ঘুমা। “পারলে কান্না করে মনটাকে হালকা করে নিস,না হলে কাল তো আবার মেহমানদের মেয়েদের সাথে হারামীগিরি করতে পারবি না।তোর এই লাল চোখ দেখলে মেয়েরা মনে করবে গাঞ্জা খেয়ে টাল হয়ে আছিস।আর হ্যা পারলে নিজের জন্য সিরিয়াসলি একটি মেয়ে পছন্দ করিস।এরপর থেকে তো আর আমাকে পাবি না,তো নতুন কোন পাগলীর সন্ধান শুরু কর।”
“কি যে বলিস?”
“ঠিক বলেছি।
আমার তো ইচ্ছা থাকলেও আর কিছু বলতে পারলো না।ওর গলা মনে হয় আটকে আসছে।চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে।হাত দিয়ে পানি মুছে একবার আমার দিকে দেখে বাড়ির মধ্যে চলে গেলো। রিম্মিকে এখন নিয়ে যাবে তার বাবার বাড়ির ঠিকানা ছেড়ে শশুড় বাড়ির নতুন ঠিকানায়।গাড়ির সামনে দাড়িয়ে রিম্মি ওর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিম্মি গাড়িয়ে উঠতে গিয়ে থমকে দাড়ালো।রিম্মির মা রিম্মির হাত ধরে দাড়িয়ে আছে।আমি দূরে দাড়িয়ে দেখছি সবকিছু।যেখানে আছি রিম্মির নজরের বাহিরে। রিম্মির বাবা আমার কাছে এসে কাধে হাত রেখে বলল,”বন্ধুকে বিদায় জানাবি না?” “চাচা,বিদায় কেন জানাবো?ও তো একেবারে যাচ্ছে না,আবার তো আসবে?” “তোকে ডাকছে,না হলে যাবে না বলেছে।”
রিম্মির সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।রিম্মি আমার দিকে তাকিয়ে একটু নিচু হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিরে গাধা,তোর চোখে পানি নেই কেন?” রিম্মি কথা গুলো কান্না জড়িত কন্ঠে বলছে আর আমি আমার কান্নাকে আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।রিম্মির কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে।আমি মাথা নিচু রেখেই বললাম,”ভালো থাকিস।” “নিয়ান,তাঁকা একটু আমার দিকে তোর চোখে পানি আছে না কি দেখি?” আশে-পাশে থেকে একেক জন একেক কথা বলে মজা নিচ্ছে।আর রিম্মি ফুপিয়ে কান্না করছে আর আমার সাথে কথা বলছে।আমি পারছি না রিম্মির কান্নার আওয়াজ শুনে নিজের কান্না আটকিয়ে রাখতে। “তাঁকা একটু আমার দিকে দোস্ত,তোকে আর তো জ্বালাবো না।শেষবারের মতো একটিবার তোর গাল টানতে দিবি আমাকে?”
রিম্মির দিকে মাথা উচু করে তাঁকালাম,রিম্মি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার গালের মধ্যে চেপে ধরে টানতে টানতে বলল,”এত বছরের বন্ধুত্বের মাঝে যদি তোকে কখনো কোন রকম কষ্ট দিয়ে থাকি,যদি কোন ভুল হয়ে থাকে,তাহলে ক্ষমা করে দিস আমাকে প্লিজ?” আর পারছি না।নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্তেও চোখের পানি ঝড়ঝড় করে পড়তে লাগলো মাটিতে।ঠোট কাপছে কারণ শব্দ করে যে কান্না করতে পারছি না।ইচ্ছে তো এখন করছে চিৎকার করে কান্না করি। রিম্মি কান্না করতে করতে আমাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কান্না করে দিলো।আমি রিম্মিকে কোন রকম শান্তনা দিয়ে গাড়িতে তুলে দিলাম। পাগলী যতদূর দেখা যাচ্ছিলো গাড়ীর জানালা দিয়ে চোখ বের করে দেখছিলো আমার অসহায়ের মতো তাঁকিয়ে আছে।একটু পরেই রিম্মিকে বহন করা হরেক রকমের ফুলিয়ে সাজানো গাড়ি চোখের নজরের বাহিরে চলে গেলো। ছোটবেলার খেলার সাথী যাচ্ছে চলি আমায় ছাড়ি, পাবো কি আবার ফিরে সেই খুনসুটি? পুতুল খেলা থেকে ফুসকার বাহানা, সবই যে ছিলো আমার কাছে, সময় মতো না খেলেই বাকাবকি, টাইম টেবিল বাধিয়ে ছিলো আমার প্রানের বন্ধু।
নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে রুমে এসে রুম বন্ধ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে একটি চিৎকার দিলাম। আমি জানি এটাই নিয়ম।আদিম যুগ থেকে এটাই হয়ে আসছে এবং এটাই হবে,কারণ মেয়েদের যে সবকিছু ছেড়ে বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিতেই হবে। বাইশ বছরের বন্ধুত্বের সম্পর্ক।দুজন,দুজনের মতো চলেছি ঠিকি,কিন্তু মনের মধ্যে বন্ধুর জন্য যে ভালোবাসা ছিলো,সেটা হাজার ব্যাস্ততার মধ্যেও থাকতো,দুজনের মধ্যে যে খুনসুটি সেটা সবার মাঝেই হয়ে উঠতো,দুজনের মধ্যে যে মান,অভিমানের ছাড়াছড়ি সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকেই হতো।দুজনের মনের মধ্যে দুজনের জন্য যে ভালোবাসা ছিলো সেটা শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প