-তোমার কি চাকরিটা করতেই হবে? তানিয়া কোন উত্তর দিলো না। পাব দিয়ে মুখে চেপে চেপে ফেসপাওডার বসাচ্ছে। লিপিস্টিক দিয়ে মাথা বাধঁছে।
-চাকরি করতে হলে স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করো। এই করর্পোট জব-
কথা টা শেষ করতে পারলাম না।তানিয়া এইবার মুখ ঘুরিয়ে বলল-
-কেন? করর্পোট জব করলে কি আমি সবাই সব বিলীয়ে বসে থাকব?
-ছি, তানিয়া এইসব কি ভাষা?
-তোমার কি ভাষা? কিছুদিন আগেও তো নারী স্বাধীনতার কথা বলতে স্বাধীন চেতার কথা বলতে। বাইরে গল্পে কত নারীর ইচ্ছা মূল্যায়নের কথা বলো। যে ঘরের ব্যাপার এলো অমনি পুরুত্ব বেড়িয়ে এলো? এমন হলে প্রথমে বলতে চাকরী নিতাম না।
-তোমার চাকরী করা নিয়ে আমার কখনো আপত্তি নেই। তবে ক্ষেত্রটা পছন্দ না।
-তো তোমার মায়ের মতো প্রাইমারী টিচার হয়ে জীবন কাটানো তোমার পছন্দ?
-কেন টিচারিতে খারাপ কি? বাবা যাওয়ার পর মা প্রাইমারী টিচারি করে আমাদের মানুষ করে নি?
-তাহলে তোমার সমস্যাটা কোথায়? সেটা বলো, এত ভালো সেলারি, এত ভালো পরিবেশ, এত ভালো মানুষজন।
-সেটাই তো ভয়। খুব বেশি ভালো মানুষ গুলো মেয়েদের আশেপাশেই ঘুরে।
– রকিব স্যার কি নিয়ে আবার ফালতু কথা বলবে না। তুমি আসলেই সাইকো হয়ে যাচ্ছো।
আর কথা বাড়ালাম না। দুই জনে টিফিন নিয়ে বের হয়ে গেলাম। সি এন জি পেয়ে গেলাম। আগে আমার অফিস পরে তানিয়ার। আগে ওকে দিয়ে আমি আবার ঘুরে আসতাম। এখন নাকি আমি তাকে সন্দেহ করি তাই আর যাওয়া হয় না।
তানিয়া যখন অর্নাসে থার্ড ইয়ারে, আমার আর তানিয়ার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল। পড়ালেখায় ভীষণ ভালো ছিলো। ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। খুব সহজে আমাদের ঘরটা গুছিয়ে তুলে। বোনদের বিয়ের পর মা একা হওয়ায় তানিয়াকে পেয়ে ভীষণ খুশি মা। ওর পরীক্ষার সময় মা বাপের বাড়ি পাঠাত না ওকে। তখন মা সব কাজ করত। তিনজনের ঘর আর কাজ কি মা বলত। তানিয়ার পড়ালেখা শেষ হওয়ার জন্য বেবি নিলাম না আমরা। জবের জন্য ফরম গুলো আমিই পূরণ করে দিয়েছি। ভালো রেজাল্ট থাকায় ভালো একটা কোম্পানিতে ওর জব হয়ে যায়। সবাই খুশী ছিলো। আমিও ভাবলাম নিজের টাকা দিয়ে সেভিংস করলে আমি না থাকলে কখনো ওকে কষ্ট করতে হবে না মায়ের মতো। কিন্তু ওর অফিসের বস রাকিব সাহেব কে আমার ভালো লাগে নি। যথেষ্ট ভদ্র আর মার্জিত ব্যাবহার এইসব লোক কে প্রথমে কেউ বুঝতে পারবে না এরা এক একটা শয়তানকেও হার মানায়।
এরা প্রথমে ভালো ব্যবহার করে মেয়ে কর্মীদের বিশ্বাস অর্জন করে পরে আসল রূপ দেখায় যারা স্বেচ্চায় ধরা দেয় তারা উপরের দিকে উঠে। যারা স্বেচ্চায় ধরা দেয় না তাদের চাকরি চ্যুত করার ভয় দেখায় মেন্টাল টরর্চার করে।
আমি বুঝি কারণ আমাদের অফিসে এক জন আছে মইনুল স্যার। আমার পাশের সিটে বসে পলি। এই পোস্টে গত পাঁচ বছরে সাত জন এসেছে কেউ উপরের দিকে গেছে, কেউ না পেরে চাকরি ছেড়েছে। এখনো পলি যখন মুখে চূড়ান্ত বিরক্ত নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে তখন ও মনে করে আমি কিছু বুঝি না। আমি আর শফিক সব বুঝি ওরা প্রতিবাদ করে না তাই আমিও বুঝতে দিই না আমি বুঝেছি। মেয়েরা মনে করে না বললে ছেলেরা বুঝে না কিন্তু ছেলেরা অন্য পুরুষদের মানসিকতা যে মেয়েদের চেয়ে ভালো বুঝে সেটা তারা মানতে চায় না।
আমার ভয় হয় তানিয়ার জন্য, তানিয়ার মতো মেয়েরা যারা আদুরে মানুষ হয়, যারা ঠকবাজ দুনিয়াকে কাছ থেকে দেখে না, যেখানে ৫০ টাকা লাগত সেখানে ৫০০ টাকা নিয়ে কলেজে যায়, তারা সবাই খুব সহজে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করা একটা বদ অভ্যাস তাদের। নিজেরা যেমন অন্যকে তা ভাবে। তাই যখন ধাক্কা খায় পুরোটা ভেঙে যায়।
তাই বলে সবাই খারাপ না। ভালোর সংখ্যা হয়ত বেশি তাই মেয়েরা এত দূর এগিয়ে চলছে। অফিসে ডুকে বসলাম পলি তখনো আসে নি। মেয়েটা অনেক ঝামেলা নইলে হয়ত ছেড়ে যেত এই জব। বাবা নেই মা নাকি প্যারালাইজড ছোট একটা ভাই আছে মামার বাড়ি থাকে তাই জব টা ওর প্রয়োজন। মইনুল স্যার দুইবার ঘুরে গেছে। অন্য মেয়ে কলিগ দের ডেস্কে গিয়ে গিয়ে অশ্লীল কথা বলে বিরক্ত করে। পলি এলে ওর ডেস্কে ফোন এলে ফাইল নিয়ে যেতে। পলি আমাকে বলল –
-অসিফ ভাইয়া তুমি কি তোমার ফাইলটা জমা দিয়েছো? চলো একসাথে যাই। আমি এইটার অপেক্ষা করছিলাম। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। দুইজনে যেতেই স্যার কিছুটা বিরক্ত হলো। পলি কে দেরীতে আসার জন্য বকা দিচ্ছে আমি জানি এইটা আমাকে নিয়ে কেবিনে আসার জন্য রাগ ঝাড়চ্ছে। আমার ফাইলে সই করে বলল – তুমি যাও। পলি থাকো। আমি তাও দাঁড়িয়ে রইলাম। পলি চেহেরাটা দেখে মনে হলো সাহস পাচ্ছে।
-কি তোমাকে যেতে বললাম না?
-স্যার পলির এই ফাইলে আমিও সাহায্য করেছি যদি কিছু না বুঝেন আমি তাই- স্যার এইবার বিরক্ত হলো, –
-যাও দুইজনেই যাও , আমি দেখে নিবো। পলি বের হয়ে ধন্যবাদ দিলো। আমি বললাম
– দেখ নিজের রক্ষা নিজেকে করতে হয়। তোমার যুদ্ধে তুমি যোদ্ধা, আমরা হব সারথী। আমি আর কিছু না বলে চলে গেলাম। তানিয়া বাসায় এলো ভীষণ খুশি সে নাকি বড় একটা প্রেজেন্টেশন এর কাজ পেয়েছে। আমি বুঝতে পারি এইসব টোপ, তানিয়াকে বললেও বিশ্বাস করবে না, মানতে চাইবে না। আমি ওকে বললাম,
-তিন মাস হলো জবে ঢুকেছ, এত তারাতারি যদি এত বড় কাজ হাতে নিও না, ভুল হতে পারে। তুমি বরং অভিজ্ঞ কাউকে হ্যান্ডওভার করো। তানিয়া রেগে গেলো, তোমার আসলে হিংসা হচ্ছে। আমি দ্রুত উন্নতি করব এই ভয়ে। তোমরা ছেলেরা ভীষণ জেলাস। আমি রাগ করতে গিয়ে হেসে দিলাম।
-তোমার কি তাই মনে হয়?
-মনে হতো না। দেখছি।
-দেখ তানিয়া তুমি এখনো অনেক কিছুই বুঝ না। তোমাকে বিপদে পড়তে দেওয়া অবধি আমি অপেক্ষা করতে পারি না তার আগেই সরিয়ে নেওয়া আমার দায়িত্ব।
-কিসের বিপদ? ফালতু কথা বন্ধ করো।
এই বলে বাথরুমে ডুকে গেল। আর কোন কথা নেই। রাতে খেয়ে ঘুমাতে গেলে সরি বললাম। সেও বুকে ঘুমিয়ে গেল। আমি চিন্তা করছি তানিয়াকে কিভাবে বুঝাব। পরের দিন দিদি আর ছোটন এলো। দিদির ছেলে। শুক্র বার তাই বেড়াতে এসেছে। ভীষণ দুষ্ট ছেলেটা। সব কিছু নষ্ট করে ফেলে আর লাফালাফি করে। তানিয়া ভীষণ ভালবাসে ওকে। দিদি ওকে মারধোর করে দুষ্টমির জন্য তানিয়া বার বার বাচাঁয়। কিন্তু রান্না ঘরে তানিয়ার সাথে দুষ্টমি করলে তানিয়া বের করে দেয়। ও কান্না করতে করতে বের হয়ে আসে। ও নাকি মরিচের গুড়ো নিতে চেয়েছে। সবাই মিলে টিভি দেখছিলাম। ছোটন বার বার একটা টুলের উপর উঠে লাফ দিচ্ছে। আর আলমারির দিকে ছুটে যাচ্ছে। তানিয়া বার বার আটকাচ্ছে যাতে ধাক্কা না খায়। দিদি বলল-
-তানিয়া চুপ করে বসে থাকো। একবার ধাক্কা খেতে দাও তাহলে ও ওটা বাঁচিয়ে দৌড়াবে। তুমি বার বার বাঁচালে ও বুঝবে না।
কথাটা আমার খুব মনে ধরল। আমিও তানিয়ার ব্যাপারে বেশি ভাবছি। ধাক্কা খেলেই ও বাঁচিয়ে দৌড়াতে শিখবে। তাও আমার কিছুটা সর্তকতা রাখতে হবে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যাবে ভাবি নি। এক শুক্র বার তানিয়া দুপুরে বের হচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছো জিজ্ঞেস করলে ও বলে, ওর নাকি জরুরি মিটিং পরেছে। আমি নিষেধ করলাম। ও শুনল না। কোথায় জিজ্ঞেস করলে ও বলে, অফিসেই, রকিব সাহেব আর মিতালী ওকে তুলে নিবে। আমি জানি মিতালী নামে কেউ যাবে না সাথে। কিছু না বলে যেতে দিলাম। বললাম
-দরকার পড়লে সাথে সাথে কল দিবে।
কিছুক্ষন পর আমিও বের হলাম। তানিয়ার অফিসের পিওয়নের সাথে আমার আগেই ভাব জমিয়েছি মাঝেমধ্যে সিগারেট খাওয়ানো মাধ্যমে। তানিয়ার অফিসের কাছাকাছি থাকি আমি। কিছুক্ষন পর আমি তানিয়ার ফোন পেয়ে রিসিভ করে দৌড় মারি। তানিয়া কথা বলতে পারছে না। হিচকির মতো তুলছে। আমি দারোয়ান কে নিয়ে সেখানে যাই। গিয়ে দেখি তানিয়া সোফায় বসে আছে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রকিব সাহেব মাথায় হাত চেপে বসে আছে। তানিয়া পেপার ওয়েট দিয়ে মেরেছে। উচিত শাস্তি। তানিয়াকে ডাকতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল৷
-বিশ্বাস করো আসিফ….
-কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝছি। তানিয়া হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি রকিব সাহেব কে পুলিশে দিবো বললে তানিয়া নিষেধ করে। সে নিজেও রিকুয়েষ্ট করে। তানিয়াকে নিয়ে আমি বাসায় চলে যাই। তানিয়া বার বার সরি বলে।আমি তানিয়াকে বলি,
-তানিয়া এতে তোমার কোন দোষ নেই। আমাদের আশেপাশে এমন লোক অনেক। আমাদের অফিসে একজন আছে। আমরা সব জানি বুঝি কিন্তু কিছু করতে পারি না।
সমস্যা হচ্ছে তোমরা মেয়েদের মাথায় নারী স্বাধীনতার বিষয়টা বিষয় টা এমন ভাবে ঢুকছে আজকাল। যারা তোমাদের ভালো চায় তারা হচ্ছে শত্রু আর যারা এর ফরদা করতে চায় তারা হচ্ছে শুভাকাঙ্ক্ষী। এইসবের দোষ অবশ্য কিছু মেয়ের যারা স্বেচ্চায় এইসব জগন্য খেলায় সামিল। আর যারা সব সহ্য করে। আমি তোমাকে বার বার সবধান করেছি। তুমি ভেবেছো আমি তোমাকে আটকাচ্ছি। তুমি যদি স্বেচ্চায় ভুল পথে যাও তা আমার দুর্ভাগ্য আর তুমি যদি ভুলে পথ হারাও তা আমার ব্যার্থতা। তুমি যেমন সেদিন ছোটনকে রান্না ঘরে আটকিয়েছো ও আগুন ধরবে বলে মরিচ ধরবে বলে। কারণ তুমি ভালো জানো বিপদ কোথায়। তেমনি আমরা ছেলেরাও বাইরের দুনিয়া কোথায় বিপদ ভালো জানি। তুমি ভেবেছো আমি তোমাকে আটকাচ্ছি, আসলে আমি তোমাকে আগলাচ্ছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প