রোববার দুপুর গড়িয়ে বিকাল আসার সবুর সয়নি, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে প্রতাপের মেয়ে-জামাই সুদেষ্ণা আর সুপ্রতিম। ওদের আর তর সইছে না। এদিকে পাড়ায় একেবারে ঢিঢি পড়ে গেছে। পড়বে না? প্রতাপ রায়ের মতো মানুষের যদি এই ভীমরতি হয়! সে তো নাকি হয় বাহাত্তরে! কিন্তু প্রতাপ রায়ের এখন বাষট্টি। অবশ্য কেউই তা বলবে না। একেবারে হাতের মুঠোয় দশ দশটা বছরকে ধরে পকেটে পুরে রেখেছেন এই প্রতাপ রায়। প্রচ- গম্ভীর আর রাশভারী মানুষ। সমাজে প্রতাপ আর প্রতিপত্তিও কম নয়। ডবিস্নউবিসিএস অফিসার ছিলেন। কণ্ঠস্বর বেশ ঋজু। দীর্ঘ, ফর্সা, শরীর বেশ টানটান। ব্যাকব্রাশ করা একমাথা চুল। ঠাস বুনোট কালো চুলে যেন কোনো থিয়েটারের দক্ষ মেক-আপম্যান আলতো করে খানিক জিংক অক্সাইড বুলিয়ে দিয়েছেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। একজন পরিচ্ছন্ন ভদ্রমানুষের সবকটি গুণ ও লক্ষণ একেবারে পূর্ণমাত্রায় দেদীপ্যমান প্রতাপ রায়ের মধ্যে। পাড়ার ফাংশনে রবীন্দ্রগানের সঙ্গে প্রতাপ রায় এস্রাজ ধরলে শ্রোতারা মোহিত হয়ে পড়েন। ভাল বক্তৃতা করেন। পাড়ার দুর্গাপুজোর স্যুভেনিরের জন্য সম্পাদকীয় লিখে দেন। সুন্দর ভাষাজ্ঞান। সবাই বলে, অমন ভদ্র আর গুণীমানুষ পাড়ার অ্যাসেট। যারা বলেছে, তারাই এখন দশকান ভাঙিয়ে বেড়াচ্ছে। পাড়ার আধবুড়ো, নেই-কাজমার্কা লোকগুলোর পাঁচমাথা এক হলেই এই এক আলোচনা। তারা বলছে, ‘বাবা! গুণীমানুষই বটে। তার যে তলে-তলে এই গুণও বিদ্যমান তা তো জানা ছিল না। এ যে ছাইচাপা আগুন গো।’ পাড়ার বখাটে বিটখচ্চর ছেলেগুলোর মধ্যে তো রীতিমতো হুলেস্নাড় পড়ে গেছে। ওদের দলেরই ঢ্যাঙা পল্টু প্রতাপ রায়কে শুনিয়ে সেদিন ক্লাবের জানালা দিয়েই চিৎকার করে বলেছে, ‘এ তো দেখছি অলরাউন্ডার বস্। ক্যাচটা তো বিন্দাস নিয়েছে। কী ঝাক্কাস দেখতে মাইরি! মাধুরি দীক্ষে কোথায় লাগে।’ ওদের মধ্যে টুকটাক ভদ্রতার ধার ধারে তিমির। সেই তিমিরও হাসিতে প্রশ্রয়ের কৌতুক নিয়ে পল্টুকে শাসনের ভঙ্গি করে বলেছে, ‘কী হচ্ছে কী? এভাবে আওয়াজ দিস না। রিলেটিভও হতে পারে।’ ক্যারামের স্ট্রাইকারে লাগসই একটা স্ট্রোক দিতে-দিতে বাডু বলল, ‘এই বয়সেও এরকম স্ট্রেট ব্যাটিং! ক্ষমতা আছে বস্।’
পাড়ার মহিলাদের তো ঘুম উবে গেছে। তাদের কৌতূহলের নিবৃত্তি হয় না আর কিছুতেই। লোকটা এত রাশভারী যে, কেউ ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, সেই সাহসে কুলোচ্ছে না। প্রতাপের বউ মারা গেলে, বুড়ানের মা, তোতনের মা আঁচল পাকিয়ে দাঁতে গুঁজে ভড়ঙের কান্না চেপে ‘দাদা, আমরা আছি। আমরা আছি’ গোছের আমড়াগাছি করতে গেছিল। পাত্তা পায়নি। তখনই বুঝেছে, বউ-বিয়োগে কেতরে পড়ার মতো ঘেঁটুরাম নয় এই লোকটা।
এখন সেই বুড়ানের মা মুখে জর্দাপান ঠেসে গায়ের জ্বালা মিটিয়ে বলছে, ‘তখনই বুঝেছিলাম এই কা-ই ঘটাবে লোকটা। বউ ম’লো, একটুও কাঁদল না! এত বছর একসঙ্গে সংসার করলি, মায়া-দয়া বলে কি কোনো বস্ত্ত নেই গো দিদি? মেয়ে-জামাই রয়েছে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন শুনলে তখন কী বেইজ্জত বলো দিকি?’
এসব খবর বাতাসে ওড়ে না। রাস্তায় নিরীহের মতো হাঁটে। হাঁটতে-হাঁটতে যায়, যার খবর তার কানে তুলে দিতে। রাস্তায় চেনাজানা সবারই হাতে রয়েছে রং আর পিচকিরি। তারা কথায় রং ছিটিয়ে দেয়। ফলে কথায় অনেক রং চড়ে যায়। তাই প্রতাপ রায়ের মেয়ে আর জামাইয়ের কানে যখন কথাটা গিয়ে উঠল, তখন কথার বিস্তর রকমফের হল। তবু যা রটে, তার কিছু তো বটে। খবরের সত্যতা যাচাই করতেই ছুটে এসেছে মেয়ে আর জামাই।
ডোরবেল শুনে নিচে নেমে এসে দরজার কাছে যেতে-যেতেই ফের ডিং ডিং। আগন্তুক কে বা কারা বিলক্ষণ জানেন প্রতাপ রায়। জানতেন ওরা আসবেই। প্রতাপই চাইছিলেন ওরা আসুক। দরজা খুলে দিয়ে দেখলেনও তাই। সুদেষ্ণা আর সুপ্রতিম। প্রতাপ দুজনেরই মুখে ভাবগম্ভীর ছায়া দেখলেন। গাঢ়স্বরে বললেন, ‘ভেতরে এসো।’
সুপ্রতিমের চোখ ও চিবুক কঠিন হয়ে আছে। প্রতাপ যেন ধরা দেওয়া আসামি তার কাছে। প্রতাপ ওসবের তোয়াক্কা না করে হাতের ইশারায় মেয়ে-জামাইকে বসতে বললেন। মুখোমুখি সোফায় বসলেন তিনি। বললেন, ‘খবরটা পেয়েই এসেছো বোধহয়।’ কথা শেষ করে প্রতাপ কমুহূর্ত তির্যক দৃষ্টিকে চালনা করলেন হতভম্ব দুই আগন্তুকের চোখে।
বাবার এই বেপরোয়া ভাব হতবাক করে দেয় সুদেষ্ণাকে। পাখার নিচে বসেও সে ঘামতে থাকে। রুমালে কপালের ঘাম মুছে নেয়। শ্বশুরের ডোন্ট কেয়ার অ্যাটিচুড দেখে বেমক্কা ধাক্কা খায় সুপ্রতিম। সে ভাবে, যা শুনেছি তাহলে সব সত্যি! এই বয়সে বিয়ে করবে?
মান-সম্মান সব ধুয়ে-মুছে যাবে। লোকসমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। কিছুক্ষণ দুপক্ষই চুপ।
প্রতাপ যেন কিছু শুনতে চাইছিলেন। সুদেষ্ণা অনবরত ঘামছিল। বড়-বড় নিশ্বাস ছাড়ছিল। নীরবতায় সেই নিশ্বাসের শব্দ সিলিংফ্যানের হাওয়ায় লাট খেয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ছিল। একটু নড়েচড়ে বসল সুপ্রতিম।
সুদেষ্ণা এবার খুব মৃদু শব্দে গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, ‘বাবা এসব কী শুনছি তোমার নামে?’ প্রতাপ বললেন, ‘কী শুনেছিস?’
‘এই বাড়িতে একটা মেয়ে নাকি প্রায় রোজই তোমার কাছে আসে। এসে থাকেও?’
‘আসে তো। হ্যাঁ থাকেও তো!’
‘ও, তাহলে যা শুনেছি সব সত্যি?’
‘আর কী শুনেছিস?’
‘তুমি নাকি মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের বেনারসি কিনতে গৌরহরি বস্ত্রালয়ে গিসলে?’
‘মেয়েটাকে নিয়ে গেলাম, কারণ বেনারসিটা যার গায়ে উঠবে, তার তো পছন্দ হওয়া চাই।’
‘ওহ্, এতদূর গড়িয়েছে?’
‘হ্যাঁ, তা গড়িয়েছে বলতে পারিস। এই মাঘের সাতাশেই তো বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। তোদের বলতামই। এভাবে পড়িমরি ছুটে আসার দরকার ছিল না।’
শ্বশুরের কথা শুনে সুপ্রতিম থ মেরে গেল। সুদেষ্ণার দিকে একবার করুণার দৃষ্টি ঝাঁকল। হেদুয়া থেকে আসতে-আসতে বাসে সে বেশ কয়েকবার এভাবে তাকিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, ‘আমায় যে বলতে আসো, তোমার বাপের কীর্তিকলাপই বা কম কী? তোমার বাপ তো বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাচ্ছে।’
সত্যিই কিছু বলার আর মুখ নেই সুদেষ্ণার। প্রতাপের স্ত্রী গত হয়েছেন আজ চার বছর হল। পরম সৌভাগ্যবতীর মতোই সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর নিয়ে পায়ে আলতা মেখে সাদা কাগজে পায়ের ছাপ রেখে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে চলে গেলেন। বছর ঘুরতেই মেয়ে সুদেষ্ণাও সীমমিত্মনী হয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। সুপ্রতিমের সঙ্গে বিয়েটা ঠিক করাই ছিল। স্ত্রী গত, মেয়ে পরের ঘরে গেল নিজের ঘর গোছাতে। অগোছালো হয়ে গেল প্রতাপের ঘর। শিউলি আসে। দাদু-দাদু করে। ভাত রেঁধে দেয়। বিছানা ঝেড়ে দেয়। ঝড়ের বেগে ঘর মুছে দিয়ে চলে যায়। আর শুধু মুখ করে। বলে, রোজ-রোজ আমি এই তিনতলা একতলা করে ঘর মুছতে পারব না। লাখ টাকা দিলেও পারব না। তুমি বাপু লোক দেখে নাও।’
প্রতাপ একবার সুপ্রতিমের চোখে সরাসরি তাকায়। বলে, ‘লজ্জায় তোমার কতটা মাখা কাটা যাচ্ছে সুপ্রতিম?’ সুপ্রতিম ভাবে লোকটা তারই দলের। তাই কোনো দ্বিরুক্তি না করে সে বলে, ‘আজ্ঞে, একটুও না। আমি আপনার পাশেই আছি।’
‘পাশে তো তোমরা সবাই আছো। তবে কি জানো? পাশে কে থাকল না থাকল সে নিয়ে আমার কোনো কালেই কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আজো নেই।’
সুপ্রতিম পুরোদস্ত্তর দমে গেল প্রতাপের কথায়। সে মনে-মনে ভাঁজতে থাকে, যতই তেঞ্জাই-মেঞ্জাই করো না কেন, তোমাকে চাঁদু কীভাবে বাগে আনতে হয়, তা আমার জানা আছে। সে-ওষুধও আছে আমার কাছে। শুধু একটু সময় দাও আমাকে। বুড়ো বয়সে একবার তোমার ঘোড়ারোগ যখন ধরেছে, তখন আমাকে তোমার দরকার হবেই।
বসার ঘরে মায়ের একটা নতুন বাঁধানো ছবি দেখে সুদেষ্ণা বলল, ‘বাবা, এই ছবিটা কবে বাঁধালে?’
‘এই তো কালই ওরা ডেলিভারি দিয়ে গেল।’
‘ভালই করেছো। হচ্ছে যখন, মাকে সাক্ষী রেখেই সব হোক তাহলে।’
‘একশবার। সে তো বটেই। শুভ অনুষ্ঠান বলে কথা। তোর মা থাকবে না? তা কি হয়?’
এ-বাড়ির সব কিছুর সঙ্গে নিরুপমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যে-খাটে নিরুপমার সঙ্গে ফুলশয্যা হয়েছে, জীবনের অতগুলো বছর কেটেছে পাশাপাশি শুয়ে, সেই খাটে অন্য এক নারীর সঙ্গে শোওয়ার কথা কোনো দিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি প্রতাপ। নিরুপমার
ড্রেসিংটেবিল, ওর ওয়ারড্রবে সাজানো শাড়ির মেলা, বাথরুমে জং-ধরা খোঁপার কাঁটা, সেফটিপিন, পুরনো সোপকেসে নিরুপমার ক্ষয়াটে সুগন্ধি সাবান, ব্যালকনির বেতের চেয়ার কোনো কিছুতেই অন্যের হস্তক্ষেপ সহ্য হবে না প্রতাপের। বেঁচে থাকতে নয়। এসবই নিরুপমার স্মৃতি।
এখনো চোখ বুজলে তিনি স্পষ্ট দেখতে পান ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে বসে সকালের চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন নিরুপমা।
বাথরুমের বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কান সজাগ করলে এখনো শুনতে পান ঝর্ণাতলায় গুনগুনিয়ে গাইছেন নিরুপমা, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে…’। এই বাড়িতে নিরুপমার হাজার দিনের হাজার স্মৃতি। নিরুপমার এসব স্মৃতিই তো সম্বল তাঁর। সেই স্মৃতিই তো প্রতাপকে তাড়া করে ফেরে। নিরুপমা চলে গেছেন চার বছর হল, তবু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে প্রতাপের মনে হয়, নিরুপমা বাথরুমে গেছে। এখনই মশারি উঁচিয়ে বিছানায় উঠে আসবেন। বলবেন, ‘কী হল? খোকাবাবু জেগে কেন?’ তখন হু-হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা।
এই হা-হুতাশ, হাহাকার থেকে মুক্তি নেই প্রতাপের। তবু এই হাহাকারের মধ্যে দিয়েই প্রতাপ নিরুপমাকে যেন কাছে পান। প্রতাপ বললেন, ‘বিষয়টা তোর লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মত কিছু নয়। আমি যা করছি তা ভালর জন্যই করছি।’
বাবার কথায় সুদেষ্ণার চোখের কোণে দুফোঁটা মুক্তোদানা উঠে এল। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে সুদেষ্ণার। মা খুনসুটি করে বাবাকে বলতেন, ‘আমি তোমার আগেই মরব। তখন তুমি আবার বিয়ে কোরো।’ মায়ের সেই ঠাট্টা আজ সত্যি হতে চলেছে। সত্যিই হোক। বাবার একাকিত্বটাও মাঝে-মাঝে অসহ্য লেগেছে তার। সত্যিই সে তো আর বাবার কাছে এসে দিন দুই থাকতেও পারে না। দূরত্বটা অনেক। শেষ বয়সে বাবাকে দেখাশোনার জন্যেও তো একজন দরকার। সব ঠিক আছে। কিন্তু হাজার হলেও বাবার বিয়ে। সে বড় লজ্জার। আবার ভাবে, বাবা যদি রক্ষেতা রাখতেন, তাহলে সে তো আরো লজ্জার হতো। সেই লজ্জার কাছে এ-লজ্জা অবশ্য কিছুই না। বাবার স্বভাব-চরিত্র খারাপ, আজ অবধি সেসব অপবাদ কেউ দিতে পারেনি। বাবাকে সে জন্ম থেকে দেখছে। কোনোদিন কোনো বেচাল দেখেনি। মাকে খুবই ভালবাসতেন বাবা। অফিস ছুটির পর বাড়ি ছাড়া কিছু জানতেন না। সুদেষ্ণার বন্ধুরা বলত, ‘তোর বাবা খুবই হ্যান্ডসাম, খুব এলিগ্যান্ট।’ অনেক মহিলাই বাবাকে একটু বিশেষ নজরেই দেখত। চাউনিতে মুগ্ধতা মিশে থাকত। মেয়ে বলেই তা বেশ বুঝত সুদেষ্ণা। ভাল লাগত।
সেই বাবা এখনো হ্যান্ডসাম। বিয়ে করবে। লোকে শুনলে হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রূপ করবে। সে করুক। সুদেষ্ণা মনে-মনে ঠিক করে নেয়, সে যুক্তি দেখাবে, সব মানুষেরই শেষ বয়সে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। এত বড় বাড়িতে আজ চার বছর বাবা একলা মানুষ। কেউ দেখার নেই। কেউ জিজ্ঞেস পর্যন্ত করার নেই। সুদেষ্ণার মনে পড়ে, বাবার সঙ্গে খটাখটি হলে মা বলতেন, ‘আমি একবার চোখ বুজি, তখন বাছাধন টেরটি পাবে। কত ধানে কত চাল হয় বুঝবে। হাড়ে তোমার দুবেবা গজাবে।’
মায়ের সেই কথাও যেন বাবার জীবনে কিছুটা সত্যি হয়েছে। বাবার বন্ধু শিশিরকাকুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখ মা, বুড়ি মরে গেলে বুড়ো আর বেশিদিন বাঁচে না রে।’ বাবার দশাও যদি শিশিরকাকুর মতো হয়? তারচেয়ে বিয়েই করুক বাবা। লোকে যা খুশি বলে বলুক। সে অন্তত বাবার পাশেই থাকবে। ভেবে নেয় সুদেষ্ণা।
সুদেষ্ণা বলল, ‘বাবা, মেয়েটিকে কিন্তু আমি একটু দেখতে চাই।’ প্রতাপ বললেন, ‘নিশ্চয়ই দেখবি। সে তো কোনো অশরীরী আত্মা নয়। দেখতে তো পাবিই।’
‘না, আমি আগে দেখতে চাই।’
‘আচ্ছা সে হবেখন। অত ব্যস্ত হোস না। বোস।’ সুদেষ্ণা বলল, ‘বাবা, তোমরা বোসো। আমি সবার জন্যে একটু চা করি।’ প্রতাপ বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখন বোস তো। কেন? তোদের কি তাড়া আছে নাকি?’
‘না না, তাড়া কিছু নেই।’ সুদেষ্ণা মনে-মনে ভাবছিল, তাড়া তো সত্যিই নেই। সেই তো বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি। তারচেয়ে এই তো বেশ লাগছে সুদেষ্ণার। সে একবার সুপ্রতিমকে বলল, ‘তুমি এক ফাঁকে উঠে যাবে, আমাদের তিনজনের জন্যে পার্সেল নিয়ে আসবে।’ সুপ্রতিম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। বলল, ‘আগে তুমি একটু চা করো। চা খেয়ে একটু পরেই যাব।’
কে বলবে, কাল রাতে সুপ্রতিমের এই মুখ থেকেই নর্দমার আবর্জনা বেরচ্ছিল? সুদেষ্ণার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। সুদেষ্ণা ওকে ফোর নাইন্টি এইটের ভয় দেখিয়েছে। শুনে দস্ত্তরমত ঘাবড়ে গিয়েছিল সুপ্রতিম। এখন সব কেসই মেয়েদের ফেভারে। ফোর নাইন্টি এইট একেবারে মুখিয়ে আছে। একবার সেই ফাঁদে পড়লে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। অফিসের কানে একবার গেলে আগে সাসপেন্ড, পরে কথা। তারপর লোকমুখে যেসব শুনেছে সুপ্রতিম, রীতিমত হরিবল। জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা। তেরো দিন তো মিনিমাম
থাকতে হবে জেলহাজতে। জেলে নাকি ফোর নাইন্টি এইট কেসের অ্যাকিউসডদের খুনের আসামিরা জামাই-আদর করে। গা-হাত-পা টেপায়। পেলস্নাই-পেলস্নাই সব ডাবু কড়া মাজায়। ঘর মোছায়। ভেবেই কাল রাত থেকে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে ছিল সুপ্রতিম।
শ্বশুরের এই কীর্তির কথা শুনে সেই বেলুন আবার গিট্টু মেরে ফুলে উঠতে চাইছে। সুপ্রতিম ভাবে, যাক, বাবার বিয়ের খবরে সুদেষ্ণা যেভাবে ঘাবড়ে আছে, আপাতত মেঘ কেটে গেছে। শ্বশুরও চাইছেন, জামাই হিসেবে সুপ্রতিম যেন তাঁর পাশে থাকে। সুপ্রতিম অনুচ্চারে বলে, ‘চাইছো। বাওবা চাইছো। মুখে না বললে কী হয়? বিয়ের ব্যাপারে সবাই একটু মেন্দা মেরে যায়। সেখানে শ্বশুর প্রতাপ রায় তো শিশু। বুড়ো বয়সে টোপর পরবেন। ঝাক্কাস বউভাত হবে। নতুন জামাইয়ের কাছে স্কচ ডিমান্ড করবে সে। লজ্জা কীসের? সব লজ্জা তো নতুন বরের।’ সুপ্রতিমের মাস্তান বন্ধু সমর কথায়-কথায় বলে, ‘শালা বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ব।’ এখন এই কথাটার তাৎপর্য মর্মে-মর্মে বুঝতে পারছে সুপ্রতিম। মনে-মনে সে বলে, ‘মেয়েকে এখন বাপের বিয়ে দেখাবেন প্রতাপ রায়। বউকে নাকি ভীষণ ভালবাসতেন। বুড়ো বয়সে এখন আত্মীয়স্বজনের বগলে কাতুকুতু দিয়ে বাবু চললেন। কোথায়? না বিয়ে করতে। দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ নাকি কী সব বলেটলে।’
প্রতাপ সোফায় বসে নেহাতই অভ্যেসের বশে আয়েশে দু-পা নাড়াচ্ছিলেন। বললেন, ‘বুঝলি, একটা অসহায় মেয়ের হিলেস্ন হোক, কেউ চায় না। সমাজ একেবারে তার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছে। এই সমাজের যত আধুনিকতা সে তো সবই গালভরা। বুলিসর্বস্ব। আধুনিকতা এখন দেখানোর ব্যাপার। সেটা কিনতে হয়। মনটা পড়ে থাক ত্রেতাযুগে। কিন্তু দেখনধারির কোনো খামতি নেই। আবার জায়গামত ঘা পড়লে তখন আধুনিকতার নেগেটিভটা বেরিয়ে পড়ে। আমি তো বলি, ড্যাম ইওর সোসাইটি। হু কেয়ারস?’
প্রতাপ মেয়ে-জামাইয়ের দিকে তাকালেন একবার। বললেন, ‘বলব কী, সমাজের শতকরা নববইভাগ মানুষই এখন আধুনিকতার নামে এক আশ্চর্য কমোডিটির শিকার। তোমার পোশাকটা দামি ব্র্যান্ডেড হওয়া চাই, ছিমছাম বড় ফ্ল্যাট থাকা চাই, একটা ফোর হুইলার, গুচ্ছের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, তেরোটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকা চাই, উইকএন্ড পার্টিতে একগলা মদ গিলে বেলেলস্নাপনা করা চাই, নেশার ঝোঁকে এর-ওর বউয়ের কোমর জড়িয়ে স্যরি বলে জিভ কাটার অদ্ভুত ভঙ্গি রপ্ত করা চাই। মাঝেমধ্যে বাড়িতে বসে মিঞা-বিবির একসঙ্গে ঢুকু-ঢুকু করা চাই। এসবই তো এখন আধুনিকতা আর আভিজাত্যের লক্ষণ। মনে কিন্তু জমে আছে হাজার বছরের পুরনো পচা পাঁক আর শ্যাওলা। আঁতে ঘা লাগলে পচা পাঁকের সেই ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে যায়। উৎকট গন্ধ বেরিয়ে আসে। সেই গন্ধে বমি উগরে আসে।’
মেয়ে-জামাইয়ের দুর্ভাবনার আগুনে আরো এক কুশি ঘি ঢেলে দিয়ে প্রতাপ বললেন, ‘দেখো, এই সমাজ সবকিছুতেই গেল-গেল করা ছাড়া আর কিছু শেখেনি। এই পাড়ায় তো সব সার্কাস দেখার মজা পেয়েছে। তোমার সার্কাস আমি দেখবই। দেখো না! তাই বলে ভয়ে শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে হবে নাকি? আমি যা করছি, সেটা না হয় একটু বাড়াবাড়িই করছি। এ-যুগে হয়তো কেউ করে না। কিন্তু, আমি যে করছি, তার পেছনে তো সংগত কারণ রয়েছে। ভগবান আমায় সেই সংগতিও দিয়েছে, তাই তো করতে পারছি। সেখানে কার কী বলার আছে?’ সুদেষ্ণা বলল, ‘বাবা, এবার আমি যাই, সবার জন্যে একটু চা করে আনি।’ সুদেষ্ণাকে ফের বাধা দেন প্রতাপ। বলেন, ‘বোস বোস। চা হবেখন।’ সুপ্রতিম বলল, ‘শুধু মুখে চা? আমি বরং সামনের মিষ্টির দোকানটা থেকে গরম গরম শিঙাড়া নিয়ে আসি।’ ‘যাবে? আনবে শিঙাড়া? তা আনো। মন্দ হবে না।’
শ্বশুরের কাছে সিগন্যাল পেয়ে চট করে উঠে বেরিয়ে যায় সুপ্রতিম। বাইরে এসে সে আড়মোড়া ভাঙে শরীরের। একটা সিগারেট ধরায়। ভাবে, আর কদিন পরে প্রতাপ রায়ের সামনেই টানবে। মিষ্টির দোকানের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে সুপ্রতিম ভাবতে থাকে, ওর শ্বশুর লোকটার জন্য সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। লোকটা কী বলছে, তা কি ভেবে দেখেছে? একটা সাংঘাতিক কা- ঘটাতে যাচ্ছে। আর তার সাক্ষী থাকতে হবে কিনা তাকে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব ছ্যা ছ্যা করবে। টিটকিরি মারবে। চাটবে ওকে। তারপর কেসটা কেউ ফেসবুকে পোস্ট করে দিলে তো আরেক কেলোর কীর্তি। এই লোকটা এখনো মুখে কত বড়-বড় বাত মারছে। কত আদর্শ, কত নীতিমালার গপ্পো শালা! তবু ভাল, লোকটাকে সোনাগাছি থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে ফোন করে বলেনি, আপনার শ্বশুরের জামিনের ব্যবস্থা করুন। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবু রস মরেনি লোকটার। সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগে সুপ্রতিমের আঙুলে। আঙুল আলগা করে সেটাকে খসিয়ে দেয় মাটিতে।
গরম-গরম শিঙাড়া নিয়ে ফিরে আসে সুপ্রতিম। তার শ্বশুর লোকটার ওপর সব শ্রদ্ধা-ভক্তি কর্পূরের মত উবে গেছে। প্রতাপ মেয়ে-জামাইকে নিচের ঘরে বসিয়েছেন। থাকেন ওপরের ঘরে। সুদেষ্ণা কিচেন থেকে পেস্নট নিয়ে আসতে চাইলেও বাধা দিলেন প্রতাপ। খবরের কাগজটা বিছিয়ে দেন সেন্টার টেবিলের ওপর। সুদেষ্ণার হাত থেকে শিঙাড়ার ঠোঙাটা ছোঁ মেরে নিয়ে খবরের কাগজে সাজিয়ে দেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লাগে সুদেষ্ণার। সে ভাবে, জামাই মানুষকে কেউ খবরের কাগজে শিঙাড়া ঢেলে খেতে দেয়? বাবার কি ভীমরতি হল? এই বয়সে বিয়ের ভূত যখন চেপেছে ঘাড়ে, ভীমরতি ছাড়া আর কী? কিন্তু, বাবা যদি বিয়ের নামে সামান্য সৌজন্যটুকুও হারিয়ে বসেন, তাহলে তো খুবই খারাপ সেটা।
শিঙাড়া মুখে নিয়ে প্রতাপ বলেন, ‘বিয়ের বন্দোবস্ত করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বুঝলি।’
‘কেন? কোনো উপায় ছিল না কেন? আগে পেট বাঁধিয়ে অবলিগেশনের বিয়ে নাকি? উপায় ছিল না মানে কী?’ না না, সুপ্রতিম এসব মুখ ফুটে বলল না ঠিকই। কিন্তু, মনে-মনে এসব কুকথার জাবর কাটতে লাগল। ভাবল, যাকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে লোকটা, সে ওই কাজের মেয়েটা নয়তো? বেশ ডবকা শরীর মেয়েটার। চোখ টাটানোর মতই। মেয়েটা বেশ খিলিস্ন খায়। শালির বেশ লবছবানি, খলবলানি আছে। সে যদি লোকটার বিয়ের পাত্রী হয় তো কেলোর একশেষ হবে। একে বুড়ো বয়সে বিয়ে, তাও বাড়ির কাজের মেয়ে বিয়ের পাত্রী। কী কেস? না কেস জন্ডিস। লোকের গালগল্পের চোটে বুকের হার্ডডিস্কটাই বিকল হয়ে যাবে। শ্বশুর যদি এসব কেলো করে সে-বেলা কিছু নয়! আর তারই জামাই হয়ে সে যদি একটু উড়ে-উড়ে মধু খায় তো সেই বাপের মেয়ে হয়ে সুদেষ্ণা তাকে বলতে আসে কোন মুখে?
সুদেষ্ণা অনেকক্ষণ থেকেই এ-বাড়িতে যেন আরো একটি প্রাণীর সাড়া পাচ্ছে। একেবারে খুবই অস্পষ্ট। মেয়েদের সহজাত একটা সজাগ কান আছে। এসব ক্ষেত্রে শিশির পতনের শব্দ পেয়ে যায় ওরা। পুরুষের চোদ্দোপুরুষেরও ক্ষমতায় কুলোবে না সেটা। সুদেষ্ণার সেই কান বলছে, এ-বাড়িতে ওরা তিনজন ছাড়াও কেউ আছে। তাই ভেতরে-ভেতরে সে ছটফট করে ওঠে। প্রতাপের ঘাগু চোখে তা ধরা পড়ে যায়। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘তোর অনুমান ঠিক। ওপরের ঘরে তাকে এনে রেখেছি। তোদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব বলে।’
‘আমি ওপরে যাব বাবা?’
‘যা। ও তোদের জন্য চা করছে হয়তো। সুদেষ্ণা হরিণীর ক্ষেপ্রতায় ছুটে ওপরে উঠে যায়। কৌতূহলে সুপ্রতিম কিছুটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। প্রতাপ রায় হাতের ইশারায় তাকে দমিয়ে দেন। বলেন, ‘তুমি বোসো। ওসব অন্দরমহলের ব্যাপার।’
ওপরের ঘরে চা রেডি ছিল। চার কাপ চা ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে নিচের ঘরে পায়ে-পায়ে চলে এল অপূর্বসুন্দর এক মানবীমূর্তি। সুদেষ্ণাদেরই বয়সী। আগুনের মতো রং-রূপ। সুন্দর গড়ন। একটা আকাশ রঙের ঝলমলে শিফন শাড়িতে সেজেছে। কালো সাবেক ঘটিহাতা বস্নাউজ। চিরকেলে কনে দেখা এপিসোডের লজ্জাবনত মুখ নয়। বেশ সাবলীল ও সপ্রতিভ চাউনি। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে এক আশ্চর্য বিভঙ্গ। আধফোটা গোলাপের মতোই মুখে স্মিত হাসি। পেছনে সুদেষ্ণা। তার চোখ আর মুখের পেশি থর-থর করে কাঁপছে। মেয়েটাকে দেখে আঁতকে ওঠে সুপ্রতিম। তারও সর্বাঙ্গ কাঁপছে।
ঘরের ভেতর এখন চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দ শুধু। সুপ্রতিমের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় সুমনা। হাত বাড়িয়ে সেটা নেওয়ার ক্ষমতাও যেন নেই আর। মাথা নিচু করে সোফায় বসে থাকে সুদেষ্ণা। প্রতাপ রায় মৃদু কাশলেন। নেহাতই কপট সেই কাশি। তারপর যেন কিছুই ঘটেনি তেমনই সহজ সুরে বললেন, ‘বুঝলে সুপ্রতিম, সুমনার খুবই অভাব। সেই অভাবের তাড়নাতেই ও তোমার সঙ্গে স্রেফ ফ্লার্ট করেছে। খবরটা আমি অনেক আগেই পেয়েছিলাম। মেয়েটা বড় দুখী। সহায়-সম্বল বলতে কিছুই নেই। সে যাকগে, কথা হল, আজ দিন দশেক হল, সুমনা আমার কাছেই আছে। এই দশদিনে তুমি সুমনাকে কমপক্ষে দশ হাজারবার ফোন করেছ। ও ফোন ধরেনি, নির্লজ্জের মতো এসএমএস করেছ। আর এই তিন মাসে তুমি ওকে কত টাকা দিয়েছ, সুমনা আমায় সব বলেছে। তা আমি ভেবে দেখলাম, শুধুমাত্র টাকার জন্য একটা মেয়ে পরের ঘর ভাঙবে কেন? বড় কথা, সেই ঘর যখন আমারই মেয়ের ঘর। তাই ঘর ভাঙার খেলা থেকে ওকে সরিয়ে এনে আমি ওর ঘরবাঁধার পাকা বন্দোবস্ত করেছি। একটা ভাল পাত্রের সঙ্গে সাতাশে মাঘ এই বাড়িতেই ওর বিয়ে দিচ্ছি আমি। আমার যদি আর একটি সন্তান থাকত তাহলে তো আমাকেই করতে হতো। কী বলো?’